#প্রেমজাল
পর্ব ২০ [ বোনাস পর্ব ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
গাড়ি শো শো করে চলছে নিজ গতিতে। গাছ-গাছালির সবুজ সমারোহ ফেলে চলে এসেছি ব্যস্ত নগরীতে। সারা রাত বৃষ্টির পর মেঘের আড়াল থেকে সূর্যীমামা উকি দেওয়া মৃদু আলো গাড়ির জানালা ভেদ করে করে আমার উপর পরতেই নড়েচড়ে বসলাম। আড়চোখে একবার আয়ানের দিকে তাকালাম। উনি একধ্যানে গাড়ির স্ট্রেয়ারিং সামলাতে ব্যস্ত। শুনেছি যারা সত্যিকারে ভালোবাসে তারা নাকি নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কারোর ছায়াও সহ্য করতে পারে না! তাহলে আমি কি আয়ানকে পাবো না জেনেও ভালোবেসে ফেললাম? নাকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেলেছি? কেনো আমি তখন উনার সাথে তিথি নামের মেয়েটাকে দেখে এতো অসহ্যকর অনুভব করলাম? কেনো আমি ঈর্ষান্বিত হলাম? না না! আয়ান চৌধুরী আমার ভালো লাগা হতে পারে তবে ভালোবাসা নয়। গাড়ির সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় আওড়াতে লাগলাম। আয়ান শুধু আমার ভালো লাগা নট ভালোবাসা!!
.
.
.
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবকিছু পরিপাটি করে ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমার মেজাজ যেনো ৪২০ ভোল্টে বিগড়ে গেলো। আয়ান কলপারের দিকে দাড়িয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিচ্ছে। আর তার পাশেই তিথি নামক মেয়েটা গামছা হাতে নিয়ে আছে। হুহ! কেমন করে তাকায় আছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আস্ত কাচাই গিলে খাবে। এই মেয়ের লজ্জা শরম নাই নাকি? অন্যের জামাই এর দিকে কিভাবে যেন তাকায় থাকে!
আয়ান হাত-মুখ ধুয়ে মেয়েটার দিকে মোছার জন্য গামছা হাত বারিয়ে চাইলো। কিন্তু মেয়েটার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। থাকবেই বা কিভাবে? চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে যে। মেয়েটার চোখ যুগলের চাহনি উনার বুকের দিকে নিবদ্ধ আছে। শার্টের দু’কয়েক বোতাম খোলা থাকার কারণে লোমহীন উন্মুক বুক উকি-ঝুকি করছে। আমি খানিকটা দূরে দাড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করলাম। মন তো চাইছে এই শাকচুন্নি মেয়ের চুল ছিড়ে শাক-পাতা রান্না করে খাই। রীতিমতো আক্রোশে আমার গা রি রি করে যাচ্ছে। বড় বড় পা ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি এগিয়ে যেতেই আয়ান স্মিত হেসে তার হাত গুটিয়ে কপালের সন্তদর্পে পরে থাকা চুল গুলো ঠিক করতে লাগলো। আমি একবার তিথির দিকে আরেকবার আয়ান দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে তিথির হাত থেকে ছো মেরে গামছা নিয়ে নিতেই মেয়েটার ধ্যান ভাঙ্গলো। তিথি হতভম্ব হয়ে গেলো। পরক্ষণে গলা খাকারি করে আমতা আমতা করতে লাগলো। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের করতে পারলো না। পরিশেষে আর এক মিনিট দেরই না করে টুপ করে পাতলা গলি দিয়ে পালালো।
আয়ান আমার থেকে গামছা টান দিয়ে নিতে নিলেই আমি শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি উনার ভ্রু যুগল সংকোচন করে তাকালো আমার দিকে। উনি নিতান্তই আমার এরূপ ব্যবহারে অবাক। যা তার চাহনি স্পষ্ট অর্থ বহন করছে।
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম কড়া গলায় বললাম,
-“ এখানে কি ফ্যাশন শো চলছে? যে বোডি শো অফ করছেন?…… (কিছুক্ষণ থেমে) এভাবে বুক দেখানোর মানে কি? এই মেয়ে কীভাবে ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে ছিলো জানেন? নাকি এইসব মেয়েদের দেখাতে অনেক ভালো লাগে আপনার? যদি কোনোদিন এমন দেখেছি তাহলে আমার একদিন কি আপনার একদিন, বুঝলেন?”
আমি কোনো মতো আমার কথা শেষ না করতেই উনি আমার হাত টেনে উনার খানিকটা কাছে আনলেন। আমি কিছুটা বিব্রতকর বোধ করলেও প্রকাশ করলাম না। উনার মুখে রম্যতার ছাপ ফুটে আছে।
-“ আমার আছে আমি দেখালাম। তোমার থাকলে তুমিও দেখাও। আমারটা যখন দেখিয়েছি এখন না হয় তোমার টাও…” বলে ঠোঁট চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলেন।
আমি উনার কথায় হতবাক। আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। কি দেখাবো? পরক্ষণে বিশ্লেষণ করে বুঝতেই আমার চোখ দু’টো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্বেল আকৃতির রূপ ধারণ করলো। সাথে সাথে উনার থেকে ছিটকে দূরে সরে আসলাম। ইশ!! ছীঃ কী অশ্লীল লোক।
আমাকে দূরে আসতেই উনি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন,
-“ কি? আমার প্রপার্টি দেখার সময় ষোলো আনার আর তোমারটার বেলায় কাচকলা?”
আমি উনার প্রতিত্তোরে ফটাফট বলে ফেললাম,
-“ আমার সাথে সাথে অই লুচি পরোটার সর্দারনী তিথিও দেখেছে। যান ওর টা দেখেন” বলে নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম। হায় আল্লাহ!! কি বলে ফেললাম। নাউযুবিল্লাহ!! এই ঠোটকাটা লোকের সাথে থাকতে থাকতে আমিও কি তাইলে বেহায়ার খাতায় নাম লিখালাম। আমি আর এদিক-অদিক না তাকিয়ে সোজা টুপ করে উনার কাধে কোন রকম গামছা ঝুলিয়ে দৌড় দিয়েছিলাম।
এই ঘটনার পর থেকে যতটা পেরেছি দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। যদি কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! দিনশেষে তো উনার কাছেই ফিরে যেতে হবে। সবার থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শুধু এক নজর তাকিয়েছিলাম। যখন দিদুনকে সালাম করে রওনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
-“ খুব তাড়াতাড়ি তোদের কোলে জুড়ে ছোট অতিথি আসুক”
কথাটি শুনে আয়ান মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। যা ছিলো খুবই মোহনীয়। কিন্তু অইখানেও লুচি পরোটার সর্দারনী তিথি হ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে ছিলো। আমার খুবই অসহ্যকর লাগছিলো। মন চাইছিলো ঠাফায় দেই একটা, হুহ!
.
.
.
আমার স্মৃতিচারণ ভাবনার ফোড়ন কেটে গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো। আমি আস্তে আস্তে সোজা সাবলীল হয়ে বসলাম। সামনে সোনালী ফলকে “Chowdhury Mansion” লেখাটি দণ্ডায়মান। দু’তিনেক গার্ড ছুটাছুটি করে মেইন বড় গেইট খুলতে ব্যস্ত। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললাম। অবশেষে আমরা আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে সুস্থ ভাবে এসে পরলাম।
গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো। গাড়ি থামতেই পার্স টা হাতে নিয়ে নিলাম। সীট বেল্ট খুলে যখনি গাড়ির দরজা ঠেলে বের হবো তখনি আয়ানের ফোনটা আকস্মিক ভাবে বেজে উঠলো। না চাইতেও একপলক উনার ফোনে তাকালাম। ভালোভাবে পুরো নাম স্পষ্ট ভাবে বুঝতে না পারলেও “R” অক্ষর টা দেখতে বোধগম্য হলাম। বুকের ভেতর কেও হাতুড়ি পিটাতে লাগলো। আয়ান ফোনটা নিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলো। আমি তাচ্ছিল্য হাসি টেনে আমিও বেরিয়ে আসলাম। উনি গাড়িতে ঠেস দিয়ে ফোন রিসিভ করলেন। আমি নিস্তব্ধে নতজানু হয়ে প্রস্থান করলাম। আমি চাই না কারোর সম্পর্কের মাঝে দেয়াল হতে। যেখানে আমার সম্পর্কই টিকে আছে এক ঠুনকো কাগজের ভিত্তিতে। কি লাভ আয়ান আর রিয়া আপুর সম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে? থাকুক না সে তার ভালোবাসার সাথে। তারই ভালোবাসার মানুষের সাথে।
আমি সোজা আমার নির্ধারিত ঘরে এসে দরজা চাপিয়ে দিলাম। একবার সারা ঘর চোখ বুলাতেই সব ঝাপসা হতে লাগলো। কোনো রকম খাটের পাশে ঠেস দিয়ে বসে পরলাম। এতোক্ষণ মনের পিঞ্জরায় ধামাচাপা রাখা কষ্ট গুলো যেনো উতলাতে লাগলো। বুকের বাম পা পাশটা বড্ড ব্যথা করছে। জোর করে আটকে রাখা চোখের পানিও এবার বাধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো। পানির স্রোতধারা ক্রমশ গাল বেয়ে বিসর্জন হয়ে যাচ্ছে।
#চলবে ~ ইনশাল্লাহ …