ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-৩২+৩৩

0
1069

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অতঃপর বাড়ির প্রতিটি রুমের সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নেওয়া হলো। ঐশী স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখলো শুধু এসব। কোথাও যেন একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। সব বাঁধা এভাবে নির্মূল হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। ঐশী রুমে বসে মাথায় হাত চেপে এগুলোই চিন্তা করছে। আচ্ছা, কোনক্রমে কি জুভান ওর খুনের ব্যাপারে জেনে গেছে? না,না। তা কেনো হবে? তাহলে তো জুভানের নানা প্রশ্নের সামনে ঐশী টিকতেই পারতো না। মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছে কিন্তু তাদের উত্তর? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না ঐশী। হঠাৎ ঐশীর ফোনে রিং বাজলো। ঐশী ধ্যান ভেঙে ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করলো।
— ” বলো অনল। ”
— ” ঐশী একবার দেখা করতে হবে। আমি কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি। ”
— ” ওহ। কখন ফ্রি আছো? ”
— ” এখনই আসো। আমি আমাদের হিডেন জায়গায় ওয়েট করছি। ”
— ” ঠিক আছে। আমি আসছি। ”

ঐশী ফোন কেটে দিয়ে কাবার্ডের সামনে গেলো। দুই নাম্বার তাকের একদম পিছনে একটা কালো বোরকা রাখা। ঐশী সেটা হাতে নিয়ে দ্রুত গায়ে জড়িয়ে নিলো। মুখে কালো নিকাব আটকে সন্তর্পনে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

_________________________
— ” সাজ্জাদ হোসেন! দা গ্রেট মাফিয়া লিডার। সচরাচর সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া এক পাও চলেন না। মন এবং শরীরের দিক থেকে খুবই শক্তিশালী। এখন পর্যন্ত নিজ হাতে করা পঞ্চাশটা খুনের আসামী। কিন্তু এই খুনগুলোর বিচার একটাও হয়নি। ”

ঐশী তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে সামনে টাঙানো সাজ্জাদ হোসেনের বিশালাকার ছবির দিকে। অত্যন্ত হাস্যোজ্বল দেখা যাচ্ছে তাকে। আর এই হাসি দেখেই ঐশীর রাগে মাথা গরম হয়ে উঠছে। মন চাচ্ছে ছবির ভিতরে ঢুকেই এই পাপী বান্দাকে খুব করে ফেলতে। ঐশী নিজের রাগ সামলাতে চোখ বন্ধ করে জোড়ে নিঃশ্বাস নিলো। তারপর অনলের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” আমাদের ওর দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে। ”

অনল কম্পিউটারে স্লাইড পরিবর্তন করলো। ঐশী ডেস্কে দুহাত রেখে ঝুঁকে এলো কম্পিউটারের দিকে। অনলের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
— ” সাজ্জাদ হোসেনের পাশে এই মেয়েগুলো কারা?”

অনল মাউস একটা মেয়ের মুখের দিকে তাক করলো। বললো,
— ” এই মেয়েটা সাজ্জাদ হোসেনের বিশাল সংখ্যার গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে একজন। তবে সে ততটা ইম্পর্ট্যান্ট না তার জন্যে। ”

ঐশী সচেতন চোখে কম্পিউটারের স্ক্রিন জুড়ে কিছু একটা খুজতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
— ” এই মেয়ে? ”
— ” ইয়েস। এই মেয়েটা সাজ্জাদ হোসেনের প্রাণ বলতে পারো। তবে মেয়েটা খুব টাকার কাঙাল। টাকার জন্যে সাজ্জাদ হোসেনের পাশাপাশি আরো অনেক এফেয়ার আছে ওর। ”

ঐশীর চোখ চকচক করে উঠলো। যেনো এটাই খুঁজছিল ও। ঐশী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— ” পারফেক্ট। আমাদের নেক্সট টার্গেট এই মেয়েটাই। “.

অনল ঐশীর কথা বুঝতে পারলো না। বললো,
— ” আমাদের টার্গেট তো সাজ্জাদ। তাহলে এই মেয়ে কেনো? ”
ঐশী মুচকি হাসলো। পায়চারি করতে করতে বললো,
— ” টাকার মায়া বড় মায়া। মানুষ টাকার জন্যে পশু হতেও একবার ভাবে না। এই মেয়ে নিজে আমাদের হাতে সাজ্জাদ হোসেনকে তুলে দিবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি। ”

অনল ঐশীর কথা শুনে ঐশীর দিকে তাকালো। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কত জলদি প্ল্যান সাজিয়ে ফেললো। বাহ! কিন্তু? অনল প্রশ্ন করলো,
— “কিন্তু ওতো টাকা তুমি কই পাবে? ”
— ” তন্ময়কে মারার আগে ওর সব টাকা আমি আমার ব্যাংকে ট্রান্সফার করে ফেলেছি। তন্ময়ের অবৈধ টাকা আমি নিজে খরচ করবো না। সবগুলো কালো টাকা ওই পাপিদের খুন করার কাজে লাগবে। তাই রেখে দিয়েছি। ”

অনল অবাক হলো। বললো,
— ” বাহ্, বাহ্। জিও তুমি। ”
ঐশী বিরক্ত হয়ে অনলের দিকে তাকালো। বললো,
— ” ওহ। প্লিজ। ”
— ” ওহ। সরি সরি। এখন চলো তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। ”
ঐশী ডেস্ক থেকে ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বললো,
— ” না। লাগবে না। আমি একাই যাবো। ”
— ” কেনো কেনো? তোমার জুউউভান স্যার কি মাইন্ড করবে আমাকে দেখলে? ”

অনল ঐশীর দিকে ফিরে ব্যঙ্গ করে বললো। ঐশী এই কথা শুনে মৃদ হাসলো। তারপর সিরিয়াস হয়ে বললো,
— ” অনল প্লিজ। লেগপুল করো না। জুভান স্যার বাসায় নেই। আর আমি এমন কিছু করতে পারবো না , যেটাতে জুভান স্যারের সন্দেহ হয়। বুঝতে পারছো ? ”

অনল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা হেলালো।

__________________________
রাত হয়ে এসেছে। আকাশে বাঁকা অর্ধ চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সেই চাঁদের আলো গায়ে মেখে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে ঐশী। শীতল পরিবেশ। মাঝেমধ্যে ঝড়ো বাতাস এসে ছুঁইয়ে দিচ্ছে ঐশীর গা। কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো নেড়ে উঠছে সে বাতাসের ঝাপটায়।

— ” কফি গরম। কফি গরম। ”
জুভানের কণ্ঠস্বর শুনে ঐশী পিছন ফিরে তাকালো। জুভান দুহাতে দুকাপ কফি নিয়ে দাড়িয়ে আছে ওর সামনে। কাপ দুটো থেকে ধোঁয়া উড়ছে বাতাসে। জুভান এগিয়ে এসে এক কাপ কফি ঐশীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— ” মন খারাপ? ”
ঐশী না বোধক উত্তর দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলো। কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
— ” আপনি কখন আসলেন? টের পেলাম না। ”
জুভান রেলিঙে হাত দিয়ে কাপে চুমুক দিলো। তারপর মাথা উচুঁ করে বললো,
— ” এই ঘণ্টা আগে। রুমে বসে কাজ করছিলাম। নতুন গানের সুর মেক করছিলাম। ”
— ” ওহ। এটা খুব কঠিন কাজ। তাইনা? ”
— ” গান আমার পেশন। তাই কঠিন-ফটিন কিছু না। ”
— ” ওহ। ”
তারপর নিরবতা গ্রাস করলো এই দুজন মানব-মানবীকে। জুভান কফির কাপে পরপর চুমুক দিচ্ছে আর বারবার তাকাচ্ছে ঐশীর দিকে। ঐশীর সেদিকে লক্ষ নেই। সে বাইরে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। একবার ঐশীর ছোট কয়েকটা চুল ঐশীর চোখের সামনে পড়তেই ঐশী বিরক্ত হলো। হাত দিয়ে চুল কানের পিছনে গুঁজে দিতে চাইলে জুভান হাত আটকে নেয়। ঐশী অবাক হয়। জুভানের দিকে তাকালে জুভান মাদক গলায় বলে,
— ” থাকুক না। ভালো লাগছে। ”
ঐশী বিস্ময় নিয়ে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান সেসব পাত্তা না দিয়ে বললো,
— ” আজ চাঁদের আলোয় সাঁতার কেটে গল্প করা যাক। কি বলো? ”

ঐশী এক হাফ ছেড়ে বললো,
— ” ঠিক আছে। ”
— ” তোমাকে নিয়ে প্রথমে জানি। তারপর আমাকে নিয়ে বলবো। শুরু করো। ”

ঐশী চোখ ছোটছোট করে তাকালো বাইরে। এক উষ্ণ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ” আমার জীবনটা অনেকটা সিনেমার মতন। একসময় প্রতিটা মুহূর্ত খুশি আর খুশি ছিল। কিন্তু এখন সব নাটক,সব ধোঁয়াশা। পূর্বের যা ভালো লাগতো , এখন তা বিষাক্ত লাগে। মন বলে যে একটা বস্তু আছে, সেটাই ভুলে গেছি। ”

জুভান ঐশীর দিকে এগিয়ে এলো। ঐশীর কপালের চুল কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে আবারও সামনে এনে দিলো। গালে হাত রেখে আলতো গলায় বললো,
— ” একবার মন-কে বুঝতে শিখো। মন যা চায় তাই করো। দেখবে আবার সব ফিরে এসেছে। সব ভালো লাগা সকল পূর্ণতা তোমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ”

ঐশী জুভানের সান্নিধ্য থেকে দুকদম পিছিয়ে গেলো। বললো,
— “সম্ভব না। আমি সেই সুন্দর রাস্তা পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছি।সেই জগৎ থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব না। *

জুভান হাসলো। কিন্তু সেই হাসিতে বরাবরের মতন মুগ্ধ হলো না ঐশী। জুভানের সেই হাসিতে এক লুকানো কষ্ট আছে। ঐশী সেই কষ্টের কারণ বুঝতে পারলো না।

— ” কফি শেষ। ”
ঐশী ধ্যানে ছিল। তাই শুনলো না কথাটা। জুভান ভ্রু নাচিয়ে আবারও বললো,
— ” কফি শেষ। আর এক কাপ আনি? গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে। ”
— ” না, না। আর লাগবে না। ”
জুভান ঐশীর হাত থেকে কাপ নিয়ে দুনো খালি কাপ টেবিলে রেখে দিয়ে আবারও বারান্দায় এলো। বারান্দায় রাখা দোলনায় বসে পাশে হাত রেখে ঐশীকে বললো,
— ” আসো। বসো এখানে। ”
ঐশী চুপচাপ জুভানের পাশে দূরত্ব রেখে বসে গেলো। জুভান পা দিয়ে দোলনা আলতো করে দুলিয়ে বললো,
— ” আমার সম্পর্কে জানতে চাও? ”
ঐশী সামনে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় দিলো।

#চলবে

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঐশী চুপচাপ জুভানের পাশে দূরত্ব রেখে বসে গেলো। জুভান পা দিয়ে দোলনা আলতো করে দুলিয়ে বললো,
— ” আমার সম্পর্কে জানতে চাও? ”

ঐশী সামনে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় দিলো। জুভান এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঐশী জুভানের দিকে আগ্রহ চোখে তাকালে জুভান বলতে থাকে,
— ” আমার জীবনটা তোমার মতন সাজানো গুছানো ছিলো না,ঐশী। বরং অনেকটা যান্ত্রিক ছিলো। আর আমি ছিলাম সেই যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রমানব। যার কোনো অনুভূতি, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য ছিলো না। ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখেই বড় হয়েছি। আমার কাছে তখন মনে হতো একটা সম্পর্ক মানেই হয়তো প্রতিদিন এই খিটখিটে আচরন, একে অপরকে অভিশাপ দেওয়া, সারাদিন ঝগড়া করে রাতে না খেয়ে ঘুমানো। সেদিন রোজকার মত মায়ের কাছে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু সকালে উঠে এমন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম যেটা আমি কল্পনায় ভাবিনি। বাবা মা দুজন মিলে আমাকে প্রশ্ন করেন, –আমি কার কাছে থাকবো। বাবা নাকি মা? তখন ছোট মনে এই প্রশ্নের বিষাক্ততা বুঝতে পারিনি। তাই সরলমনে বলেছিলাম — দুজনের সাথে। মায়ের মুখ এই কথা শুনে কঠিনরূপ ধারণ করলো। সেই সাথে বাবাও হলেন বিরক্ত। শেষ পর্যন্ত আমার স্থান হয়েছিল মায়ের কাছে ,মায়ের নিজস্ব বাসায়। কদিন ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর মা নতুন বিয়ে করলেন। তারপর মায়ের কাছেও আমার মূল্য ফিকে হয়ে গেলো। ডাস্টবিনের মতন অযত্নে পড়ে থাকতাম ঘরের এক কোণে। দিন যেতে লাগলো, মায়ের কাছে দূরত্ব বাড়লো। মায়ের মমতার সুতো একসময় ছিঁড়ে যেতেই পা বাড়ালাম ঢাকাতে। একা, নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতাম সেই শহরে। একসময় নাম- দাম সব হলো আমার। টাকা পয়সা হাতের ময়লায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু কোথাও মনে শান্তি পেলাম না। মেয়ে, মদ আমার রোজকার সঙ্গী হয়ে উঠলো। তারপর একদিন একে মেয়ের সাথে দেখা। যার জন্যে আজকের আমার এই বদল। সে যখন আমার ঘরে গুটিগুটি পা নিয়ে ঘোরাফেরা করে তখন আমার মনে হয় আমার ঘরে দীর্ঘ সময় পর পূর্ণতা এলো। এখন সেই কালো ঘরের আনাচে কানাচে শুধু সুখ আর সুখ। সেই সুখে কোনো স্বার্থ নেই। সেই মেয়েটা কে, চিনেছো নিশ্চই। ”

ঐশী একদলা বিস্ময় নিয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা এত কষ্ট পেয়েছে? ও তো দু মাস ধরে একাকী আছে, আর তার পাশের মানুষটা সারাজীবন ধরে একা একা গুমরে মরেছে। ঐশীর চোখ ভিজে এলো। চোখের গা বেয়ে একফোঁটা জল মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই জুভান সেই জল আঙ্গুল দিয়ে শুষে নিলো। ঐশী অবাক হয়ে তাকালে জুভান বললো,
— ” তোমার চোখের একফোঁটা জল আমার বুকের সবটুকু পানি শুষে নেয়। তাই সেই জলের অপচয় করবে না। ”

ঐশী অবাক হলো কিন্তু এই কথার মানে বুঝলো না।
নিরবতায় কেটে গেলো আরো আধা ঘণ্টা। নিশ্বাসের নিঃশ্বাসের খেলায় ভারী হলো রাতের আকাশ। সেই আকাশে জ্বলজ্বল করে উঠলো অসংখ্য তারা। কিন্তু সেই বিশাল আকাশের একদম পশ্চিম দিকে দুটো উজ্জ্বল তারা বসে আছে। সবার থেকে আলাদা, একদম স্বকীয়। ঐশী সেদিকে চোখ রেখে মনে মনে নানা কল্পনা আঁকছে। অযথাই ওদের নিয়ে নিজের ভাবনার সুতো বুনছে। আচ্ছা, এই দুটো কি ঐশীর বাবা-মা। যারা এই নিষ্টুর পৃথিবীতে ওকে একদম একা করে রেখে গেছেন। শুনেছে , মানুষ মরার পর আকাশের তারা হয়ে যায়। তাহলে ঐশীর বাবা-মাও কি তারা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের ঐ কালো জগতে? ঐশী কোনো উত্তর পেলো না। হবে হয়তো। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে ঐশীকে অন্যমনস্ক দেখে জুভান ঐশীকে ডাক দিলো। কিন্তু ওর মুখে “রা” নেই। জুভান এবার ঐশীর বাহু ধরে ঐশীকে ঝাঁকালো। খানিক জোরগলায় বললো,
— ” ঐশী, এই ঐশী? ”

ঐশী হুড়মুড়িয়ে জুভানের দিকে তাকালো। চোখের দৃষ্টি তার এলোমেলো, ছন্নছাড়া। জুভান সেই দৃষ্টি দেখে কিছুটা অবাক হলো। হঠাৎ করে কি হলো এই মেয়ের? জুভান ঐশীর চোখের কোণ থেকে একফোঁটা জল নিজের আঙ্গুল দিয়ে আনলো। জলের স্বচ্ছ ফোঁটা ঐশীকে দেখিয়ে বললো,
— “আবার কাদঁছো কেনো? ”
ঐশী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে চোখের জল মুছে নিলো। জুভানের থেকে কষ্ট লুকানোর কি সোচ্চার চেষ্টা তার! জুভান মৃদু হাসলো। সে ঐশীর দু বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরালো। ঐশী বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জুভান যেনো তার অশ্রু দেখে না নেয়। জুভান ঐশীর থুতনি ধরে মুখ উচু করলো। কণ্ঠে আকাশসম আদর ঢেলে বললো,
— ” মা, বাবার কথা মনে পড়ছে? কাদছো কেনো? হুম? ”

ঐশী ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বরাবরের মতন ব্যার্থ হলো সে। নিজের অনুভূতি লুকানোর ক্ষমতা কখনোই ছিল না তার। এবারও হয়নি। মাথা নিচু করে হুহু করে কেঁদে উঠলো ও। আকস্মিক কান্নার শব্দে জুভান হতভম্ব হয়ে গেলো। কি করবে ভেবে না পেয়ে ঐশীর মাথা নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো। মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
— ” হুশশ। কাদে না। আরে। এমন করে কান্না করার কি আছে। শান্ত হও ,ঐশী। রিলাক্স।”
ঐশী জুভানের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে নাক ঘষে কান্না করতে করতে বললো,
— ” কি দোষ ছিল আমার। বলতে পারেন। ওরা আমার পুরো পৃথিবীকে কেড়ে নিলো। আমার সম্বল, আমার বেচেঁ থাকার কারণ সব, সব কেড়ে নিল ওরা। কেনো করলো এমন? আমি তো নির্দোষ ছিলাম। ওরা তাহলে আমায় খুন করে ফেললো কেনো? আমার তো দোষ ছিল না। তাহলে? কেনো করলো এমন? কেন..”

ঐশীর কান্নার একেকটা ফোঁটা জুভানের বুকের উপর পড়ছে। সেই ফোঁটা ঐশীর মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই জুভানের বুকে বিষের মতন জ্বালা ধরছে। তার প্রেয়সীকে কান্না করতে দেখে দিল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায়। এখনো তার হাতে এখনো কিছু করার মতন সুযোগ আসে নি। জুভান ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো গলায় বললো,
— ” তোমার কোনো দোষ নেই,ঐশী। তুমি পবিত্র। দুনিয়ায় যত পবিত্রতা আছে সব তোমায় ঘিরে থাকুক, তোমার মনের কুলষিত অংশ সেই পবিত্রতার ধারালো আচড়ে ধুয়ে মুছে যাক। দুনিয়ার সব শুভ সুখ তোমার পায়ের কাছে আত্মসমর্পন করুক। আমার ভাগ্যের সুখটাও আজ থেকে তোমার হোক, ঐশী।”

ঐশী জুভানের বুক থেকে মাথা তোলে তাকালো। এ কি বললো জুভান! ঐশীর চোখে মুখে খেলে গেলো অপার বিস্ময়, রাজ্যের চমক। জুভান ঐশীর অবাক হওয়া মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আবারও বললো,
— ” আমিন, আমিন। পবিত্র এই দোয়ার জন্যে সহস্রবার আমিন। ”
ঐশী কান্নার মধ্যেই হেসে ফেললো। জলে টুইটুম্বর মুখে সেই হাসি খুব বেশি মোহময় ঠেকলো। ঐশী জুভানের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,
— ” আমিন। ”

আচমকা ঐশী জুভানের কাছ থেকে সরে এলো। মুখে খেলে গেলো লজ্জার আভা। শরীরে আড়ষ্ঠভাব জরিরে ধরতেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো ঐশী। দুনো হাত একসাথে কোলের উপর রেখে কচলাতে লাগলো। একটু আগে জুভানের এতটা কাছাকাছি ছিল ও। ইশ! কি লজ্জা! কি লজ্জা! ঐশীর এমন লজ্জা পাওয়া দেখে জুভানের অযথাই হাসি পেলো। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে বললো,
— ” অনেক গল্পসল্প হলো। এখন ডিনার করা যাক। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গেছে। ”

ঐশী জড়তা ঠেলে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আচমকা পায়ে পা লেগে হোচট খেলো। সঙ্গেসঙ্গে কোমর ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলে জুভান একহাত দিয়ে ঐশীর কোমড় আকড়ে ধরে। ঐশী চোখ খিচে বন্ধ করে আবারও পিটপিট করে তাকালো। জুভান ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
— ” সাবধানে ম্যাডাম। আপনি হোচট খাচ্ছেন। ”
ঐশী ফ্যালফ্যাল করে জুভানের দিকে তাকালো। কিন্তু এই কঠিন কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে হতাশ হলো। ঐশী স্বাভাবিক হলে জুভান ঐশীকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঘড়ি দেখে বলে,
— ” ডিনার টেবিলে দেখা হচ্ছে। কুইক এসো। ”
ঐশী মাথা নিচু করে সায় দিলো। জুভান ঐশীর দিকে একঝলক তাকিয়ে মুচকি হেসে সেই জায়গা থেকে চলে গেলো।

#চলবে