#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ১০
লেখা- #Anjum_Tuli
.
.
রায়ান উঠে বসে দম নিলো। কিছু বলতে চাইলে আমি বাধা দিলাম। কিন্তু সে শুনলো না বলল,
‘আমি এই কাহিনীর সমাপ্তি ঘটাতে চাই রোদু। এই কষ্ট আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। আমার খুব করে পাশে কাউকে প্রয়োজন। যার সাথে সব দুঃখ শেয়ার করা যাবে। তোমাকে সুখের রাজ্যে ঘুরাতে না পারলেও আমার অল্প সুখ আর দুঃখের সঙ্গী করতে চাই। হবে তো?’
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এভাবে বললে কি কভু ফিরিয়ে দেয়া যায়? না। অতটুকু সুখই যে আল্লাহ তায়ালা আমার কপালে লিখে রেখেছেন এই বা কম কিসে? স্বামীর সুখ দুঃখে পাশে থাকতে পারাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
রায়ান তার দু হাতের মুঠোয় আমার হাত রেখেই বলল,
‘জানো রোদু ভাই বাউন্ডুলে ছিলো। কিন্তু বখাটে নয়। আমি স্বচক্ষে কখনো তাকে কোনো রকমের কোনো অন্যায় করতে দেখি নি। বরং বড়দের সম্মান করতে দেখেছি আর ছোটদের স্নেহ। আমাকে তো কখনো কোনো বিপদ দূর ছোট ব্যাথার আছরও আসতে দেয় নি। আমাকে কখনো ছোট করে নি। সে পড়ালেখায় বলতে গেলে জিরো ছিলো। অথচ আমি বুয়েটের মত জায়গা থেকে নিজের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। ভাই চাইলেই এ নিয়ে মন কষাকষি করতে পারতো। কিন্তু তা করে নি উল্টো আমাকে নিয়ে গর্ব করতো। বাবার হাজার বকা খেয়েও আমাকে নিয়ে মাতামাতি করতো। আমার রেসাল্টে খুশি হত। কি থেকে কি হয়ে গিয়েছিলো সে সময়টাতে ভাবলে এখনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাই সব কিছু।
সেদিন ভাইয়ের সাথে দেখা করে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি জানতাম ভাই আমাকে সত্য টাই বলবে। তবে এত জঘন্যতম সত্যের প্রকাশ ঘটাবে তা ছিলো কল্পনাতীত।
ভাইয়ের কাছে আমি ছিলাম প্রিয়। খুব প্রিয় কেউ। আমার আবদার গুলো কিভাবে যেনো ভাই পূরন করে ফেলতো। আমি কখনো ভাবি নি আমার আবদার মেটাতে গিয়েই ভাই এত নোংরা এক খেলায় মেতে উঠবে। আচ্ছা রোদু টাকাই কি সব? ভাইয়া আমাকে সেদিন কি বলেছিলো জানো?
বলেছে, তুই ছোট রায়ান। তুই দুনিয়ার কঠিন সত্য গুলো এখনো উপলব্ধি করতে পারবি না। যেদিন নিজের উপরে ঝড়ের তাণ্ডব দেখবি সেদিন বুঝবি দুনিয়া কত কঠিন।
আমি তাচ্ছ্যিল্য হেসে বললাম,
এর পরও কি আর কোনো ঝড়ের বাকি আছে ভাই বলতে পারো? বাবা হাসপাতালে , মায়ের অবস্থাও ভালো না। আর আমার ভালবাসা? সে বেচেও মরার পথে। সবকিছুর জন্যই দায়ী তুমি ভাই তুমি।
ভাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। তর ভালোবাসা মানে?
আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললা, রোদুসি।
ভাই তারপরেও চিনলো না। পরে তুতলিয়ে বললো, ঐ মেয়েটা? বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে উচ্চারণ করলো, শিট!!
ভাই রোদুসির নামটা পর্যন্ত জানে না। ব্যাপারটায় আমার কেমন খটকা লাগলো। আমি ভাইয়ের হাত জোর করে বললাম, প্লিজ ভাই আমাকে খুলে বলবে সবটা।
এর ভিতরই ভিসিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেলো। কন্সটেবল পরিচিত হওয়ার রিকুয়েস্ট করলাম আরেকটু সময়ের জন্য। ভাই বলতে চাইলো না কিছুই । শুধু বলল, যা এখনি চলে যা। আমি ইচ্ছে করেই করেছি সবটা । এবারে আমার ফাসি টাসি হবে নাকি রে? হয়ে গেলেই ভালো। এমনিতেও আর কারো সামনেই মুখ দেখাতে পারবো না।
ভাইয়ের পায়ে ধরতে বাধ্য করেছে ভাই যখন কোনো ভাবেই আমার কথা শুনছিলো না। এদিকে বাবা মায়ের অবস্থাও খারাপ। চারিদিকের মানুষের কথায় বাবা আরও অসুস্থ হয়ে পরছিলো। এত বড়ো অপারেশনের পর বাবাকে নিয়ে টেনশন ছিলো সবচেয়ে বেশি। এদিকে সব সত্য না জেনে ভাইকে সাজা দিতেও মন মানছিলো না। আমি কেনো যেনো কোনো ভাবেই মানতে পারছিলাম না যে ভাই এসবে জড়িত। আমি জানি ভাইকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করলে সে মানবে। হলো ও তাই। থার্ড ক্লাস ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলাম। যদি ভাই সবকিছু খুলে না বলে সবছেড়ে ছূরে নিজেকে শেষ করে দেবো। এই পেইনগুলো আমি আর যাস্ট নিতে পারছি না। ভাই আমার কথা গভীর ভাবে বিশ্বাস করে। সে কেদে দেয়।
আমার হাত ধরে বলে, তুই বাইরে এদিকে বাবার বিজনেসের অবস্থাও খারাপ। আমিও পড়াশুনা করিনি। মায়ের ওষুধপত্র বাড়িভাড়ার টাকা। সবকিছুর জন্য বাবা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমাদের কিছুই জানায় নি। প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফিরতেই বাবার সাথে আমার ঝামেলা হত। নানা রকম গালি দিত বাবা আমাকে। আমি বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করি নি। উল্টো বাবার উপরও রাগ দেখাতাম। বাবাকে বলেই ফেলি একদিন বাবা টাকার গরম দেখাচ্ছে এরকম দু-কড়ি রোজগার করা আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সত্যিটা বুঝার চেষ্টা করিনি। বাহিরের জাগজমকতাটা যতটা সুন্দর যতটা উজ্জ্বল আমার ভবিষ্যৎ টা ঠিক ততটাই অন্ধকার সেটা সেদিন উপলব্ধি করলাম যেদিন বুঝলাম আমার মত অশিক্ষিতদের কেউ চাকরি দিবে না। দোকানের কর্মচারী হওয়ার অফার দিলো এক বন্ধু এটা আমার খুব ইগোতে লাগলো। আশ্চর্য আমি কিনা দোকানের কর্মচারী হবো?জিনিসটা মানতে পারিনি। এ নিয়ে বন্ধুর সাথে বিরাট ঝামেলা হয়।
সেদিন রাতেই একটা আননোন নাম্বারে কল আসে। লোকটা জানায় সে একটা বেসরকারী কোম্পানির ম্যানেজার। বিশ্বাস না হওয়ার মত কথাবার্তাগুলোকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। কারণ আমার মাথায় তখন টাকার চিন্তা চলছিলো। যেকোনো ভাবেই একটা না একটা চাকরির ব্যাবতস্থা করতেই হবে। লোকটি দেখা করতে বললে আমি এর পরের দিনই দেখা করি তার সাথে। কথায় কথায় বুঝতে পারি কাজগুলো সম্পূর্ণ বেয়াইনি। তবে তারা ডাইরেক্টলি কিছু বলে নি। আমার মন কিছুতেই সায় দিলো না। তবে উনারা বার বার আমাকে বুঝিয়েছে যে আমাকে তেমন কিছুই করতে হবে না। যাস্ট মাল আনা নেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। এর মধ্যে কেমন মাল থাকবে না থাকবে ভেবে আমি নাকোচ করে দেই।
বাড়িতে ফিরে এসে দেখি মালিক এসে মা’কে যা নয় তা বলে অপমান করে যাচ্ছে। বাবা বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না নাকি গত তিনমাস যাবত। বাবার অবস্থা এত খারাপ তা বুঝতে পারি নি। মায়ের থেকে জানলাম বাবার ব্যাবসা শেষ। আর পঞ্চাশ লাখ টাকা লস হওয়ার কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পরলো। সেদিন রাতেও বাবার বুকে পেইন উঠলো। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার ঔষধের সাথে কিছু টেস্ট করতে দিলেন। বাবাকে হাজার বার জোর করলেও কোনো রকম টেস্ট করালেন না। আমারও জোর করানোর মত অবস্থা ছিলো না। কারণ কমপক্ষে হলেও সে মুহুর্তে ২০-২৫ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিলো। ভাবলাম ক’টা দিন পর হাতে টাকা আসলে বাবার ট্রিটমেন্ট করাবো। এর ভিতর ঐ লোকের সাথে যোগাযোগ করি। বলি যে আমি কাজটা করতে রাজি। তবে কোনো ধরণের অনৈতিক কাজে আমি জড়াতে চাই না। লোকটা আমাকে ভরসা দেয়। তাদের বসের অর্ডার মত মাল সাপ্লাই দিতাম। একজায়গা থেকে একজায়গায় নিয়ে যেতাম। এই কাজের জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা দিত। বাড়ি ভাড়া বাবা মায়ের ঔষধ সব পরিশোধ করলাম। একদিন পুলিশ আমাদের ট্রাক ধাওয়া করলো। জংগলে লুকালাম। তিন্, চারদিনের মত পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। আমার উপর বাবার সন্দেহ বাড়তে থাকলো। বাবা মা’কে দিয়ে আমাকে নিষেধ করলো তোকে যেনো এসব কিছুই না জানাই। তোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটুক বাবা তা চান না। সিদ্ধান্ত নেই এই কাজ ছেড়ে দেবো।
এর পরেই তুই বাসায় আসিস। বাহিরে যাওয়ার কথা বলিস। তোর আবদারে নাকোচ করতে বাবার কষ্ট হয় আমি তা দেখি। বাবার প্রিয় পুত্র যে তুই। তাই তো হাজার কষ্টের ছিটেফোটাও তোকে জানাতে দেয় নি। তাছাড়া তুই আমার একমাত্র ভাই তোর আবদার পূরণের ইচ্ছা আমারও জাগে। তবে আমার সাধ্য ছিলো না। বাবা টেনশনে পরে যান । আমার কাছে প্রথমবারের মত বাবা এসে বলেন,’সায়ান কিছু কি করা যাবে? বাড়িতে যে জমি আছে তা বিক্রি করলে লাখ খানেক পাওয়া যাবে। আমি হাসলাম লাখ খানেক টাকায় কিছুই হবে না। বাবাকে বুঝতে দিলাম না। বললাম তুমি জমি বিক্রির ব্যাবস্থা করো। বাকিটা আমি দেখছি। বাবা আমার কথায় কেমন ভরসা পেলেন। চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। মনে মনে বললাম শেষ বারের মত অন্যায় কাজটা করে ফেলবো । তারপরে এই পথ থেকে সরে আসবো।
কথাটা বলেই ভাই বিশ্রি ভাবে হাসে। যে হাসিটে ঠাট্টা কষ্ট উভয়ই লোকায়িত ছিলো।
ভাইকে বলি? তারমানে?
ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠে,
‘হ্যা আবারো ঐ লোকের কাছে যাই। তোর যাওয়া আসা মিলিয়ে আর বাবার চিকিৎসার কথা ভেবে আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা ধরে রেখে টাকা চাই তাদের কাছে। ম্যানেজার জানায় এতটাকা দেয়া সম্ভব না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে যেনো তাদের বসের সাথে কথা বলি। আমি রাজি হই। ওদের দলের লিডার খুব ধুরন্দর টাইপের লোক। মারাত্মক চালাক। আমাকে শর্ত দেয়। এতটাকা তো আর এমনি এমনি দিবে না। দুই বছরের এগ্রিমেন্ট চায়। এই দুই বছরে উনাদের কথামত সব ধরনের কাজ করতে হবে। আদারওয়াইস এর ফল ভালো হবে না। একটা এগ্রিমেন্ট প্যাপারে সাইন করায়। তাদের কথামত সাইন করি। এর পর থেকে শুরু হয় কাজ আর কাজ। তোর টাকাটা বাবাকে আর তোকে বুঝিয়ে দিয়ে ভাবি এর পরে বাবার চিকিৎসায় মন দিব। বাবার ব্যাথাটা দেখেছিলাম ক্রমশ বাড়ছে।
প্রায় প্রতিদিনই তারা আমায় এক ধরনের ইঞ্জেকশন পুশ করতো আমিও তাল মাতাল হয়ে পরে থাকতাম। বাধ্য ছিলাম। কিছুই করার ছিলো না আমার। গাঞ্জা সেবন করতাম।তাদের সাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে এসবে অভ্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
একদিন বসের ডাক পরে। একটা মেয়েকে কিডনাপ করে আনতে বলে। আমি নাকোচ করলে স্কিনে বাবা মার ছবি এনে বিশ্রি ভাবে হাসে। বুঝতে আর বাকি রইলো না উনি কি বুঝাতে চাইছেন। নানা ভাবে বুঝালেও শুনেন না। উল্টো আমাকে ভয় দেখান। বাধ্য হয়ে তাদের দলের লোকদের সাথে রৌনা দেই। কিডনাপ করি। কিন্তু এর পরের ঘটনাটা ছিলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাসিত। আমি কখনো এমনটা চাই নি। মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা ছিলো। বিশ্বাস কর আমার নিজের উপরই নিজের ভীষণ রকমের ঘৃনা হচ্ছে।
কথাটা বলেই ভাই দেয়ালে জোড়ে ঘুষি দিলো।কন্সটেবল এসে বললেন আর টাইম দেয়া সম্ভব না। চলে যেতে হবে। আমি বাকি কথাটাও শুনতে চাচ্ছিলাম। এর পরে কি হয়েছিলো। তাহলে কি ভাই নির্দোষ। আর বাবা কি ভাইয়ের কাজ কর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সব কিছুই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো কেবল। আচ্ছা রদু তারা আমাকে কিছু জানায় নি কেনো বলো তো? সংসারের হাল ধরার মত পর্যায়ে কি আমি গিয়েছিলাম না? কেনো রোদু কেনো? বলো? ‘
আমি কোনো রকমে বললাম, ‘তারপর , তারপর কি হলো?’
.
.
চলবে….