মেঘবিলাসী পর্ব-৩৬

0
755

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_36

বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে।শীতল ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝে জিসান দর দর করে ঘামছে।তার গায়ের টি শার্ট ঘামে ভিজে একাকার।বুকের বাপাসে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে।মনে হয় কেউ খামচে ধরে আছে।তার হাতের চিঠিটা আর পড়তে পারছেনা।কারণ সে সব ঝাপসা দেখছে।গলাটাও প্রচন্ড শুকিয়ে গেছে।পানি দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

জিসান একগ্লাস পানি পান করে ওয়াস রুমে যেয়ে মুখ ধুয়ে নিলো।মিররে নিজের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তার কি আসলেই তিন্নির হাসবেন্ড হওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে?এতো দিন পাশে থেকেও সে মেয়েটার মনের দুয়ার খোলা তো দূরে থাক,দরজার তালাটা অবধি খুলতে পারেনি।সে মনে কতটা যন্ত্রণা নিয়ে হাসি মুখে তার সামনে ঘুরে বেরিয়েছে।অথচ সে তার মনের যন্ত্রণার কোনো আভাস পায়নি।হঠাৎ জিসান হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে।সে জীবনে কবে এই ভাবে কেঁদেছে তা ঠিক মনে করতে পারছেনা।ছেলেদের মন নাকি শক্ত হয়।কই সে তো তিন্নির চাইতে বেশি শক্ত হতে পারছেনা।তার সব কিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সে আবার চিঠিটা হতে নিলো।চিঠিটার অনেক জায়গাতে কালি লেপ্টে গেছে।জিসানের আর বুঝতে বাকি নেই যে তিন্নি চোখের জল পড়ে কালি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই বিভৎস দিনটা মনে করতে নিশ্চয়ই তার প্রিয়তমার মনটা বার বার ভেঙে পড়েছে।জিসান আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

‘ টিভিতে নিউজ চলছে, বিশিষ্ট নেতা রফিকুল আজমীর ছেলে রাকিব আজমীরের গত রাতে আকর্ষিক মৃত্যু ঘটে।তার নিজ ফ্ল্যাটে সে এবং তার দুই বন্ধুর মৃত দেহ পাওয়া যায়।পুলিশ ধারণা করছে ড্রাগ এর ওভার ডোজের কারণে তাদের মৃত্যু হতে পারে।তারা নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ নিতো বলে জানা গেছে।’

এই খবরটা শুনে আমি প্রচন্ড ভাবে অবাক হই।পাশে মামনি ও অবাক চোখে দাড়িয়ে আছে।তার চোখ অশ্রু।সেটা ছিল আনন্দ অশ্রু।আমি দৌড়ে পাপার রুমে যাই।পাপা হসপিটাল থেকে ভোর রাতের দিকে বাসায় ফিরে ঘুমাচ্ছে।পাপাকে দেখে আমি অবাক হই।আজ অনেক দিন পর পাপকে ভীষণ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখেছি।

জানেন আমরা মেয়েরা প্রত্যেকে জীবনে একজন হিরোর অপেক্ষায় থাকি।হয়তো আমিও করতাম।যে আমাদের জীবনটাকে বদলে দিবে।যে আমাদের পদতলে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবে।তবে সেই সময়টায় আমার জীবনেও আমার সেই হিরোর দেখা পাই।সেটা আর কেউ না আমার পাপা। হে আমার পাপা।আমি ঘুমন্ত পাপকে ঝাপটে ধরি।আজ অনেকদিন পর পাপার বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছি।মনে আমার প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেছে।পাপার ঘুম ভেঙে যায়।আমাকে তার বুকে দেখে নিজেও আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠি।আর পাপা কে বলি

-“এই সব তুমি করেছো তাইনা পাপা?”

পাপা আমাকে কপালে চুমু খেয়ে বলে

-“আজ প্রায় আট মাস পর আমার মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।আমার কিযে ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না।”

-“কেনো করতে গেলে এইসব?যদি তোমার কিছু হয়ে যেত?”

-“আমার মায়ের জন্য আমি সব করতে পারি।আমার মেয়েকে কষ্টে রেখে তারা স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে তা হয়না।তুমি কোনো অপরাধ করনি,তবে কেনো তুমি ঘরের কোন পরে থাকবে?আমার মেয়ে এই সমাজে মাথা উচু করে বাঁচবে।কেউ তোমার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না।তারা তাদের অপরাধের সাজা পেয়েছে।আমাকে কথা দাও মা তুমি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবন টাকে উপভোগ করবে?কোনো অন্ধকারকে তুমি তোমার জীবনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে দিবে না?”

সেদিন পাপার বুকে মাথা রেখে আমি শেষ বারের মতো কেঁদেছিলাম।আমি ভয়ে যখন স্কুলে যেতে পারতাম না।তখন পাপা আমাকে নিজে নিয়ে যেতো।আমি ভয়ে রাস্তা পর্যন্ত পার হতে পারতাম না।মনে হতো এই বুঝি তারা আবার আসবে।আমার এই বিপর্যস্ত অবস্থা পাপা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।পাপা অনেকবার থানায় যায় রাকিবকে পুনরায় যাতে গ্রেফতার করে।কিন্তু পুলিশ ক্ষমতার আর টাকার কাছে বীকে গেছিলো।দিনের পর দিন থানার চক্কর কাটিয়েও আমরা কোনো বিচার পাইনি।তখন আমার চাইতে পাপাই বেশি ডিপ্রেসন চলে যায়।অনেক ভেবে চিন্তে পাপা ঠিক করে নিজেই তাদের শাস্তি দিবে।

পাপা রকিবদের বেশ কিছুদিন ফলো করে।তারা নিয়মিত ড্রাগ নিতো।সেইদিন তারা ড্রাগ নিয়ে বাসায় ফিরছিল।রাস্তায় পাপা তাদের গাড়ি দার করায়।রাকিব পাপা কে দেখে বিভিন্ন খারাপ কথা শুরু করে।আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলতে থাকে।আসলে সে ততটা সেন্সে ছিল না।যেই সুযোগে পাপা তাদের এক ধরনের ড্রাগ তাদের শরীরে পুষ করে দেয়।তারা কেউ কিছুই করতে পারেনি।তারা প্রচন্ড ড্রাংক ছিলো।পাপা সেখান থেকে চলে আসে।তারাও ড্রাংক অবস্থায় তাদের ফ্ল্যাটে চলে আসে।প্রায় ঘন্টা খানেক পর সেই ড্রাগ রিয়াকশন শুরু হয়।তারা তিনজনই ওভার ডোজের জন্য মারা যায়।একজন ডক্টর হওয়ার সুবাদে এই ধরনের ড্রাগ সম্পর্কে সব কিছুই জানতো।পাপা কে সন্দেহ করার কোনো উপায় ছিল না।

সেই দিনের পর থেকে আমার জীবনটা পুরো পুরো বদলাতে শুরু করে।রাকিবদের মৃত্যু আমার ভিতরে এক অদৃশ্য শক্তির সঞ্চার করে।আমি ভীষণ কনফিডেন্ট হতে শুরু করি। এর পরের যুদ্ধটা শুরু হয় আমার নিজের সাথে।জীবনে আমার তখন একটাই লক্ষ্য একজন ডক্টর হয়ে মানুষের সেবা করা।সে দিনের পর থেকে আমি আরো জেদি হয়ে উঠি।নিজের মনটাকে শক্ত করতে শুরু করি।সব সিচুয়েশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করি।কারণ আমাকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে হবে।পাপা আর মামনির জন্য।আমি লেখাপড়ার মাঝে ডুবে যেতে থাকি।তবে আমার জীবনের ওই অন্ধকার রাতকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা।

এই সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে আমার তিনটা বছর সময় লেগে যায়।এই তিন বছর পর নিজেকে আয়নায় দেখলে অনেক তফাৎ খুঁজে পাই।কোনো কষ্টই আমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না।আসলে অনুভূতি জিনিসটাকে নিজের মনের মাঝে মেরে ফেলেছিলাম।আজ আমি অন্য তিন্নি।তার ছোট খাটো কষ্টে চোখে জল চলে আসে না।নিজেকে সব দিকথেকে পারফেক্ট করতে যেয়ে কেমন অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি।

একদিন হঠাৎ পাপা আমার বিয়ের বিষয় বললো।আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার এই অন্ধকার জীবনের সাথে কাউকে জড়াব না।জীবনের বাকিটা সময় একাই কাটাতে চেয়েছি। ঐযে বললামনা আমি প্রচন্ড জেদি হয়ে গেছিলাম।পাপা আর মামনি আমাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলো না।তবে তারা এতো জলদি আমার বিয়ে নিয়ে ভাববে আমি চিন্তা করিনি।মূলত ফুপা আপনার কথা পাপা কে বলার পর থেকে পাপা আমাকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিতে থাকে।নিজের মেয়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে পাপা।আমি সবার সাথে যুদ্ধ করতে পারলেও পাপার সাথে পারিনা।

যেই দিন প্রথম আপনি আমাদের বাসায় আসেন,সেই দিন আমি আপনাকে সব সত্যি বলে দিবো বলে ঠিক করি।কিন্তু আপনাকে প্রথম দেখে আমি দ্বিতীয় বার চোখ তুলে দেখার সাহস পাইনি।কারণ কাউকে ভালোবাসার যোগ্যতা আমার নেই।করো স্ত্রী হবার যোগ্যতা নেই।আমি কিছুতেই দুর্বল হতে চাইনি।

যে দিন আমাদের একা কথা বলতে পাঠানো হয় সেই দিন পাপা আমাকে কোনো কিছু জানতে মানা করে।যদি আমি আপনাকে কিছু বলি তবে সে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে রাকিব ও তার বন্ধুদের মৃত্যুর কারণ বলে দিবে।পাপার এই হুমকি শুনে আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম ।বিশ্বাস করুন সেই দিন প্রথম আমার পাপা কে ভীষণ স্বার্থপর মানুষ মনে হয়।যে নিজের মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে অন্য কাউকে ঠকাতে পারছে।আমি আমার নিজের পাপাকেই চিনতে পারছিলামনা।

আমাদের বিয়ের দিন রাতে আপনি আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন কিন্তু আমি কিছুই বলিনি।আমি তখন আমার মাঝে ছিলামনা।নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছিলো।আমি কিছুতেই আপনার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলনা।তার পর বেশ কয়েক দিন আমি আপনার সামনে পর্যন্ত আসিনি।পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছি।আমি আপনাকে ঠকাতে চাইনি।পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি এমন করেছি।আমি সব সময় আপনার সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছি।যাতে আমি আপনার প্রতি দূর্বল না হয়ে পড়ি।

আমি নিজেকে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনি।তবুও জড়িয়ে গেছি।আর আপনাকে এতো ভালো হতে কে বলেছে?কেনো আমার এতো কেয়ার করেছেন?কেনো আমাকে এতো সম্মান দিয়েছেন?কেনো আমাকে কোনো কিছুতে জোর করেননি?কেনো আমার উপর কোনো অধিকার দেখাননি?এই সব না করাতে আমি আপনার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছি।আপনার পাশে আমি কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারিনা।কেমন চিপ মেন্টালিটির হয়ে পড়েছি।আমি যতবার এই সম্পর্কটাকে ঠিক করতে এক ধাপ আগাতে চেয়েছি ততবার আমার অতীত আমাকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিয়েছে।আমার ভীষণ ভয় হতে শুরু করে।আপনাকে হারাবার ভয়।আমার সাথেই কেনো এমন হয় বলতে পারেন?

সেদিন আমি খুব সুন্দর একটা সময় কাটিয়েছি।আপনার সেট কাটানো প্রতিটা সময়ই অমর জন্য সুন্দর।আমি সব যন্ত্রণা ভুলে যাই।কিন্তু সন্ধায় রেস্টুরেন্টে টিভিতে একটা নিউজ দেখে আমি আবার আমার অতীতে হারিয়ে যেতে থাকি।সেখানে রাকিবুল আজমীরের নির্বাচন প্রচারণা চলছিলো।এই মানুষটাকে দেখে রাকিব নামক জানোয়ারের মুখটা ভেসে উঠেছে।তাই আমি সেদিন চলে এসেছি।আপনার মুখোমুখি হতে চাইনি।আপনার সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চাইনি।তবে সেদিন আমার প্রচন্ড গিলটি ফিল হয়েছে।আমি স্বার্থপরের মত আপনাকে আমার মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছি।

আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।সেটা আমি আগেই বুঝেছি।আর সেটা বোঝার পর থেকে অপরাধবোধ আমাকে আরো ঘিরে ধরেছে।

তবে শত চেষ্টা করেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।আমার অন্ধকার অতীত জেনেও স্বার্থপর হয়ে আজ আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে , ACP সাহেব , I fall in love with you. কবে,কখন তা জানিনা।আপনাকে প্রথম দেখে আমার হৃদয় স্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছিলো।আর ধীরে ধীরে আমি না চাইতেও আপনাকে প্রচন্ড ভালোবসে ফেলেছি।আপনার স্ত্রী হতে পেরে আমার জীবন সার্থক।আমি সারা জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই।আপনার সাথে সংসার করতে চাই।

দেখেছেন আমি কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছি।আমি জানি আপনাকে ভালোবাসার কোনো যোগ্যতা আমার নেই ।আপনি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।তবে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার শক্তি আমার আছে।আপনি আমার অতীত জেনে যে ডিসিশন নিবেন আমি তার সম্মান করবো।আমি আমার জীবনে দুজন শুদ্ধতম পুরুষের সন্ধান পেয়েছি। এক আমার পাপা আর অন্য জন আপনি।আপনি সারাজীবন আমার মনের বিশেষ স্থানে থাকবেন।
ইতি
আপনার স্ত্রী

চিঠিটা পড়ে জিসানের কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা সে বলতে পারবে না।তিন্নির জীবনের দুর্ঘটনা তার মনকে ক্ষত বিক্ষত করছে।আর অন্য দিকে মনের কোন সুখ অনুভূতি হচ্ছে এটা জেনে তার সেই কাঙ্খিত মানুষটিও তাকে ভালোবাসে।