মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব-২৬

0
1352

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২৬

★আদিত্য অফিসে এসেই একটা মিটিং এ ঢুকেছিল। তাড়াহুড়ো করে মিটিং শেষ করেই কেবিনে চলে এসেছে আদিত্য। হঠাৎ করে কেমন যেন ওর খুব অস্থির লাগছিল। বারবার শুধু নূরের কথা মনে পরছিল। তাই তাড়াতাড়ি করে কেবিনে এসে ল্যাপটপ চালু করলো আদিত্য। নূরকে চোখের সামনে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবে না ওর।

আদিত্য ল্যাপটপে বাসার সিসি ক্যামেরা কানেক্ট করলো। ক্যামেরা চালু হতেই আদিত্য নূর কোথায় তাই খুজতে লাগলো। আদিত্য এক এক করে সবগুলো ক্যামেরা চেক করতে লাগলো। কিন্তু একি? নূর কোথায়? নূরকে তো বাসার কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। আদিত্য একটু ঘাবড়ে গেল। সব ক্যামেরা গুলো ভালো করে চেক করতে লাগলো। নাহ কোথাও নেই নূর। আদিত্যের এবার ভয় লাগতে শুরু করলো। কোথায় গেল ওর এঞ্জেল টা? আয়াত ফোন বের করে তাড়াতাড়ি নিলার নাম্বারে কল দিলো।

নিলা ওর এসাইনমেন্ট শেষ করে নিচে এলো নূরকে দেখতে। কিন্তু নিচে এসে নূরকে দেখতে পেল না। নিলা ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কোথাও নেই নূর। নিলা ভাবলো হয়তো নূর ওর রুমে গিয়েছে। তাই ও উপরে উঠে নূরের রুমে গেল। কিন্তু এখানেও নূর নেই। নিলার এবার একটু চিন্তা হতে লাগলো। আপু আবার কই গেল? নিলা বাইরে দেখার জন্য নিচে নেমে এলো। তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। নিলা দেখলো আদিত্য ফোন করেছে। নিলা ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই আদিত্য অস্থির কন্ঠে বললো।
–নূর কোথায় নিলা? হোয়্যার ইজ সি?

নিলা থতমত খেয়ে বললো।
–কি হয়েছে জিজু? আপনি এতো হাইপার হয়ে গেছেন কেন?

–নিলা আমি এইমাত্র সিসিটিভির সবগুলো ক্যামেরায় দেখলাম কিন্তু নূর কোথাও নেই। ওকে দেখতে পাচ্ছি না আমি। কোথায় ও?

নিলা আদিত্যকে আস্বস্ত করে বললো।
–রিলাক্স জিজু শান্ত হন। আমি আধাঘন্টা আগে আপুকে ড্রয়িং রুমেই খেলতে দেখে গিয়েছিলাম।আসলে আমার একটা এসাইনমেন্ট ছিল ওটাই করছিলাম। তাই আর নিচে আসা হয়নি।তবে আপনি চিন্তা করেন না, আপু আছে কোথাও হয়তো আশেপাশে। হয়তো সিসি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না। আপনি তো জানেনই আপু কেমন চঞ্চল। হয়তো কোন কোনায় বসে খেলছে। আমি এখুনি দেখছি।

–ওকে তাড়াতাড়ি দেখ। দেখে আমাকে জানাও।

–ঠিক আছে।
নিলা ফোন রেখে দিয়ে নূরকে খুঁজতে লাগলো। বাসার সব সার্ভেন্ট দেরও নূরকে খুঁজতে বললো। সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করেও নূরকে কোথাও পাচ্ছে না। এবার নিলাও অনেক ঘাবড়ে গেল। ভয় লাগছে প্রচুর। কোথায় গেল আপু? জিজুকে এখন কি জবাব দিবো আমি?

আদিত্যর এদিকে অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বুকটা প্রচন্ড ধড়ফড় করছে। সিসি ক্যামেরায় ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সবাই নূরকে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে খুঁজছে। তারমানে নূরকে ওরা পাচ্ছে না। এটা ভাবতেই আদিত্যর হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিল। গলা শুঁকিয়ে আসছে। ফুল এসি করা কেভিনেও ঘামতে শুরু করলো আদিত্য। দুই হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে অস্থির হয়ে ফ্লোরের সাথে পা গুতাতে লাগলো।

হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই আদিত্য ঝট করে মাথাটা তুললো। তারপর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ রিওয়াইন্ড করে আধাঘন্টা পূর্বের ফুটেজে গেল। টেনশনে ওর মাথায়ই ছিল না এই কথা। আদিত্য আধাঘন্টা আগের ফুটেজ দেখতে লাগলো। যেখানে নূর ড্রয়িং রুমে বসে খেলছে। নূরকে দেখে আদিত্যের ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখাটা ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণ পর দেখলো শায়না নূরের কাছে এসে বসলো। শায়না নূরের সাথে কি কি যেন কথা বলছে। ওরা কি বলছে তা শোনার যাচ্ছে না। তবে শায়নাকে নূরের সাথে কথা বলতে দেখে আদিত্যর কপালে ভাজ পরে গেল। এই মেয়েটা আবার কি কথা বলছে নূরের সাথে সেটাই ভাবছে আদিত্য।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর শায়না নূরের কাছ থেকে উঠে গেল। একটু পরে হঠাৎ নূর উঠে বাইরের দিকে যেতে লাগলো। এটা দেখে আদিত্যর ভ্রু কুঁচকে এলো। কোথায় যাচ্ছে নূর?
আদিত্য দেখলো নূর ধীরে ধীরে মেইন গেটের দিকে যাচ্ছে। আদিত্যের ভয় আরও বাড়তে লাগলো কোথায় যাচ্ছে নূর? কেউ ওকে ঠেকাচ্ছে না কেন?
নূর একসময় গেট পার হয়ে যেতে লাগলো। এটা দেখে আদিত্যের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। বুক কেঁপে উঠল আদিত্যের। আদিত্য ল্যাপটপের স্ক্রিনে হাত রেখে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
—নো নো নো, ডোন্ট গো ডোন্ট গো।ডোন্ট গো নূর, সামবাডি স্টপ হার। নূর,নূর,নূররররর,,,,

একসময় নূর বেড়িয়ে গেল। আদিত্য দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে পেছাতে লাগলো। মুহূর্তেই যেন আদিত্যের পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল।তারমানে নূর ওর এঞ্জেল বাসায় বাইরে চলে গেছে? নূর আধাঘন্টা ধরে বাসার বাইরে? আর আমি জানিই না? আমার নূর কোথায় আছে? কি করছে? ওতো রাস্তা ঘাট কিছুই চেনে না। কাওকে কিছু বলতেও পারবে না। ওর যদি কিছু হয়ে যায়? যদি কোন খারাপ মানুষের নজরে পরে তখন?আদিত্যর মনে পড়লো,যেদিন নূরের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিনও এক লোক ওকে খারাপ মতলবে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। না না আদিত্য আর ভাবতে পারছে না। আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে আদিত্য দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল। আদিত্যকে এভাবে দৌড়াতে দেখে অফিসের সব স্টাফরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

বিহান আদিত্যের অফিসের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রিসিপশনের সামনে বসে সিগারেট টানছিল।
হঠাৎ বিহান দেখলো আদিত্য পাগলের মতো দৌড়ে বাইরের দিকে যাচ্ছে। বিহান চমকে গিয়ে সিগারেট টা হাত থেকে ফেলে দিয়ে আদিত্যর পেছনে ছুটলো। আদিত্য গাড়ির কাছে এসে অস্থির ভাবে গাড়ি খোলার চেষ্টা করতে লাগলো।

তখনই বিহান দৌড়ে এসে আদিত্যকে ধরে চিন্তিত সুরে বললো।
–এই আদি কি ওইচে তোর? এমতে করতাছচ ক্যা?

আদিত্যের হাত পা প্রচুর কাঁপছে। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারছে না ও। আদিত্যের এমন অবস্থা দেখে বিহান আরও ভয় পেয়ে গেল। বিহান বলে উঠলো।
–কি হইচে? আমারে কবিতো?

আদিত্য বিহানের দুই কাঁধ ধরে কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–বিহান নূ নূর,আমার নূর,,,

বিহান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–নূর?নূরের আবার কি হইলো?

–নূর আধাঘন্টা আগে বাসা থেকে একা একাই বের হয়ে গেছে বিহান। এখনো বাসায় ফেরেনি।

বিহান চমকে গিয়ে বললো।
–কিহ? কি কছ এইছব? বাইত্তে এতগুলান মানুষ থাকতে নূর ক্যামনে বাইর হইয়া গেল?

–এতোকিছু বলার সময় নেই এখন।আমাকে আগে নূরকে খুঁজতে হবে যে করেই হোক।

–হ হ ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না আমরা নূরেরে অবশ্যই খুঁইজ্যা বাইর করমু।

দুজন তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
আদিত্যের পাগল প্রায় অবস্থা। মনে মনে শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, ওর নূর যেন ঠিক থাকে। ওর এঞ্জেল টার যেন কিছু না হয়।
বিহান গাড়ি চালাতে চালাতে বললো।
–কোনদিকে যাইবার চাস আগে?

আদিত্য নিজের ফোন বের করে একটা লোকেশন দেখিয়ে বললো।
–এই লোকেশন টাকে ফলো করে চল।

বিহান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এইডা কিসের লোকেশন?

–নূরের?

–মানে? তুই ক্যামতে জানলি নূর এইহানেই আছে?

–আমি নূরের জন্মদিনে একটা ব্রেসলেট গিফট করেছিলাম।নূরের সেফটির জন্য সেই ব্রেসলেটের সাথে আমি একটা ট্রাকার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে কখনো কোন বিপদ হলে আমি ওকে সহজেই খুঁজে বের করতে পারি।

–বাহ্ অনেক ভালো কাজ করছচ। এহন তো অনেক তাড়াতাড়ি আমার নূরেরে পাইয়া যামু।

তখনই আদিত্যের ফোনে নিলার ফোন এলো। আদিত্য রিসিভ করতেই নিলা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো নূরকে পাওয়া যাচ্ছে না। আদিত্য নিলাকে নূরের ব্যাপার টা খুলে বললো। নিলা সেটা শুনে আরও কান্নাকাটি করতে লাগলো।আবির ততক্ষণে বাসায় চলে এসেছে। নিলা গিয়ে আবিরকে নূরের কথা বলে কাঁদতে লাগলো। আবির কোনরকমে নিলাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

নিলার সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই হঠাৎ আদিত্যের ফোনে একটা ভিডিও ম্যাসেজ এলো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে ভিডিও টা চালু করলো। ভিডিও টাতে যা দেখলো তাতে আদিত্যের পায়ের তলা মাটি সরে গেল। ভিডিও টিতে নূরকে হাত পা বাঁধা মুখে টেপ লাগানো অবস্থায় ফ্লোরে ফেলে রাখা হয়েছে। নূর ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে আর কাঁদছে। মুখে টেপ লাগানোর জন্য শুধু গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
নূরের এই অবস্থা দেখে আদিত্যর হৃৎস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল। ফোন ধরে থাকা হাতটা শক্তি হারিয়ে ফেললো। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একসময় ফোনটা হাত থেকে পরে গেল। ফোন পরে যাওয়ার শব্দে বিহান আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি হয়ছে আদি?

আদিত্য কিছুই বলছে না। যেন একটা বোবা মূর্তি হয়ে গেছে। বিহান এবার আদিত্যের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো।
–কিরে কথা কসনা ক্যা?

আদিত্য হঠাৎ গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠলো।
–নূররররররর…..

বিহান সাথে সাথে গাড়ি ব্রেক করে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে অতি চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়ছে? এমন করতাছচ ক্যালা?

আদিত্য তড়িঘড়ি করে ফোনটা আবার নিচ থেকে তুলে নিল। ভিডিও টা আবারও চালু করলো। আবারও সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেল আদিত্য। যা ওর সহ্য সীমার বাইরে। আদিত্য বিহানের দিকে ফোনটা ঘুরিয়ে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বললো।
–বি বিহান নূর..

বিহানও ভিডিও টা দেখে প্রচুর ঘাবড়ে গেল। কে করতে পারে এই কাজ?

আদিত্য যেন উন্মাদ পাগল হয়ে গেল। ওর মাথায় এখন কোন কাজই করছে না। আদিত্য দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে শুধু জোরে জোরে চিল্লাতে লাগলো। গাড়ির কাচে হাত দিয়ে বাড়ি মারতে লাগলো। অবস্থা করুন হয়ে গেল আদিত্যর। আদিত্যের এমন পাগলামো দেখে বিহান আরও ঘাবড়ে গেল। কিছুতেই আদিত্যকে সামলাতে পারছেনা ও।

তখনই হঠাৎ আদিত্যের ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো। আদিত্য নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ সয়তানি হাসি দিয়ে বিদ্রুপ করে বললো।
–কেমন লাগলো ভিডিও টা মিঃ আদিত্য? আশা করি আপনাকে যথেষ্ট এন্টারটেইনমেন্ট করতে পেরেছি।

আদিত্য মাথায় আগুন ধরে গেল। চোখ দুটোয় লাল লালিমা ধারণ করে চোয়াল শক্ত করে, সিংহের মতো গর্জন দিয়ে উঠে বললো।
–রশিদ খানননন…

ফোনের ওপাশ থেকে রশিদ খান সয়তানি হেসে বললো।
–বাহ্ এতো সহজেই চিনে গেলেন? মনে হচ্ছে আমাকে সবসময় মনে করেন। আমিও আপনাকে অনেক মনে করি।তাইতো দেখেন আপনার বউকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। তাই তাকে এখানে সসম্মানে নিয়ে এসে মেহমান নওয়াজি করছি। তার খেদমতে আমরা কোন কমতি রাখছি না।

আদিত্যের শরীরের প্রতিটি রক্তকণা টগবগ করছে। ক্রোধে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। আদিত্য ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–খবরদার রশীদ খান, আমার নূরকে ছেড়ে দে।ওর গায়ে যদি একটা টোকাও লাগে। সত্যি বলছি এই দুনিয়াতে জন্ম নেওয়ার জন্যেও পস্তাবি তুই।

–বাহ্ এত্তো লাউউউভ, এত্তো ভালোবাসা। এখন তো আরও মজা হবে। এই ভিডিও টায় না তেমন মজা হয়নি। ভাবছি আরেকটা ভিডিও করবো। একদম সেনচুয়াল ভিডিও আর সেটা শুধু তোর ফোনে না। সবার হাতে হাতে পৌঁছে দেব। ভালো না আইডিটা বল?
কথাটা বলে আবারও বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগলো রশিদ খান।

আদিত্যের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে। ভয়ে ওর কলিজার পানি শুঁকিয়ে গেল। আদিত্য এবার দমে গিয়ে করুন কন্ঠে বললো।
–দে দেখ রশিদ খান,তোর দুশমনি আমার সাথে। তুই আমাকে যা খুশী তাই কর। তুই যেখানে বলবি আমি সেখানেই চলে আসবো। একদম একা। তবুও নূরকে কিছু করিস না প্লিজ।

–বাহ্ দ্যা গ্রেট গ্যাংস্টার আদিত্যর এমন করুন দশা দেখে সত্যিই অনেক মজা লাগছে। কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গেল একদম। ইউ নো হোয়াট? প্রথমে আমিও এটাই ভেবেছিলাম যে, তোর বউয়ের ভয় দেখিয়ে তোকে এখানে এনে শায়েস্তা করবো। তবে এখন আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছি। এখন আর তোকে কিছু করবোনা। যা করার তোর পরাণ পাখির সাথে করবো। আর এটাই হবে তোর সবচেয়ে হার।
কথাগুলো বলে রশিদ খান আবার হাসতে লাগলো।

আদিত্যর ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য অতি করুন কন্ঠে বললো।
–রশিদ খান আমি তোর পায়ে পড়ছি। দয়া করে আমার নূরকে ছেড়ে দে। আমি কথা দিচ্ছি আমি সারাজীবন তোর গোলাম হয়ে থাকবো,,,,
কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল।

আদিত্য এবার সব বোধশক্তি হারিয়ে ফেললো। কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে পড়লো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আদিত্যের। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। রশীদ খানের বলা নোংরা কথাগুলো শুধু কানে বাজছে ওর। আমার নূর,আমার এঞ্জেলের কিছু হয়ে গেলে কি করবো আমি? আদিত্য আর সহ্য করতে পারছে না। দুই হাতে মাথার চুল টেনে জোরে জোরে চিল্লাতে লাগলো।
বিহান দৌড়ে এসে আদিত্যকে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো।
—আদি শান্ত হ প্লিজ। এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না। তোকে শক্ত হতে হবে। নাহলে আমারা নূরকে কিভাবে বাঁচাব? আর আমাদের কাছে তো নূরের লোকেশন আছেই। তাই মাথা ঠান্ডা করে কাজ করলে আমরা দ্রুতই নূরকে বাঁচাতে পারবো।

আদিত্য একটু শান্ত হয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তুই ঠিকই বলেছিস। তাড়াতাড়ি চল আমাদের হাতে সময় নেই।

দুজন গাড়িতে উঠে দ্রুত গতিতে গাড়ি স্টার্ট দিল। আদিত্য ফোন করে ওর গ্যাংয়ের লোকদের লোকেশন অনুযায়ী চলে আসতে বললো।
____

হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে নূর । মুখে টেপ লাগিয়ে রাখায় কথাও বলতে পারছেনা। শুধু গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে। নূর মনে মনে শুধু ওর হিরোকে ডাকছে। ওর হিরো যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে আর এই পঁচা লোকগুলোর কাছ থেকে ওকে নিয়ে যায়। লোকগুলো খুবই পঁচা। ওকে এখানে এনে শুধু ব্যাথা দিচ্ছে। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে এখানে।

একটু পরে রুমের দরজা খুলে রশিদ খান আর লোকজন ভেতরে ঢুকলো। নূর ওদের দেখে ভয় পেয়ে জড়সড় হয়ে গেল। এই লোকগুলোই তো ওকে এভাবে বেঁধে রেখেছে।

রশিদ খান বিশ্রী হাসি দিয়ে নূরের সামনে এসে বসলো। তারপর ওর লোকজন দের উদ্দেশ্য করে বললো।
–আহ তোরা কি করেছিস এটা? আমাদের স্পেশাল গেস্ট কে কেও এভাবে বেঁধে রাখে?
কথাটা বলে রশিদ খান নূরের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে মুখের টেপও খুলে দিল।

মুখের টেপ খুলতেই নূর কেঁদে কেঁদে বললো।
–ছেড়ে দাও আমাকে। পঁচা তোমরা পঁচা। ছেড়ে দাও আমাকে।

–আরে আরে কি বলছো? আমাদের মতো ভালো মানুষ তো সারা দুনিয়াতে খুজেও পাবেনা। বুঝেছি আমরা বোধহয় তোমার ঠিক মতো খেদমত করতে পারিনি। তবে চিন্তা করোনা, এখন আমারা তোমার অনেক ভালো করে খেদমত করবো।
কথাটা বলে রশিদ খান আবারও বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগলো। তারপর ওর এক লোকের দিকে তাকিয়ে বললো।
–ওই রাকিব ক্যামেরা চালু কর।

ছেলেটা মাথা ঝাকিয়ে ক্যামেরা চালু করলো। আর রশিদ খান ধীরে ধীরে নূরের কাছে এগিয়ে যেতে লাগলো। নূর পুরোটা না বুঝলেও, লোকটা যে খারাপ সেটা ঠিকই বুঝতে পারছে। তাই লোকটা কাছে আসতেই নূর ওর হাত দিয়ে রশিদ খানকে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো। মুখে খামচি দিতে লাগলো। রশিদ খান এবার রেগে গিয়ে এক হাতে নূরের দুই হাত চেপে ধরে, আরেক হাতে নূরের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল। তারপর নূরের চুলের মুঠি ধরে বললো।
–মেয়েদের বেশি ত্যাড়ামি আমার একদম পছন্দ না। বেশি ত্যাড়ামী করলে হাত পা মটাস করে ভেঙ্গে ফেলবো বুঝেছিস?

একেতো চড় দেওয়ায় নূরের ঠোঁট ফেটে গেছে। তারওপর এভাবে চুল টেনে ধরায় নূর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। চোখের পানি বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
রশিদ খান ওভাবেই বিশ্রী দৃষ্টিতে তাকিয়ে নূরের মুখের দিকে ঝুঁকতে লাগলো।

তখনই হঠাৎ দরজা ভাঙার বিকট শব্দে সবাই চমকে দরজার দিকে তাকালো। দরজায় আদিত্যকে গান হাতে নিয়ে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রশিদ খানের ভয়ে আত্মা উড়ে গেল। ও ভেবে পাচ্ছে না আদিত্য এখানে কিভাবে এলো।

নূর আদিত্যকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে করুন সুরে ডাকলো।
–হিরোওওও…

নূরের এই ডাকটাই যেন আদিত্যর প্রাণ সঞ্চালন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আদিত্য মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নূরের দুই এগিয়ে যেতে নিলেই রশিদ খানের লোকজন ওকে বাঁধা দিতে এলো। তবে আদিত্যর কাছে যাওয়ার আগেই আদিত্যর লোকজন ওদের আটকে দিল। আদিত্যর লোকজন এতক্ষণে পুরো জায়গাটা ঘেরাও করে ফেলেছে। আদিত্য এগিয়ে গিয়ে রশিদ খানকে টেনে তুলে বুক বরাবর একটা লাথি মেরে ছিটকে দূরে ফেলে দিল।

তারপর নূরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুই হাতে নূরের মুখটা নিয়ে সারামুখে পাগলের চুমু খেতে লাগলো। চুমু খেয়ে নূরকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেন কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে নিতে পারলে শান্তি। আশেপাশের কোনকিছুরই আপাতত খেয়াল নেই আদিত্যর। ও ওর এঞ্জেল টাকে আগলে নিতে ব্যাস্ত। এতক্ষণ আদিত্যের ওপর দিয়ে কি বয়ে গেছে তা শুধু আদিত্যই জানে। জান প্রায় অর্ধেক টা বেরিয়ে গিয়েছিল ওর। এঞ্জেল টাকে পেয়ে এখন একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ও। আদিত্য নূরের মুখটা ধরে সামনে এনে মায়া ভরা গলায় বললো।
–আমার এঞ্জেল টা ঠিক আছে তো?কিছু হয়নি তো তোমার?

নূর কাঁদো কাঁদো গলায় হাত উঠিয়ে আঙুল দিয়ে রশিদ খানকে দেখিয়ে বললো।
–ও ওই পঁচা লোকটা আমাকে মেরেছে। আমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছে। এই দেখ এখানে মেরেছে, এখানে মেরেছে।
নূর গাল আর হাত পা দেখিয়ে দেখিয়ে আদিত্যকে কথাগুলো বলছে।

আদিত্য আদুরে গলায় বললো।
–ইশশ আমার কলিজাটাকে মেরেছে বুঝি?

নূর বাচ্চাদের মতো করে বললো।
–না না তোমার কলিজাকে মারেনি তো।আমাকে মেরেছে আমাকে।

এমন একটা কঠিন সিচুয়েশনেও আদিত্য নূরের বাচ্চামো কথায় হালকা হাসলো। তারপর বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে মেরেছে।

–হ্যাঁ আমাকে মেরেছে। তুমি পঁচা লোকটাকে অনেক গুলো ঢিসুম ঢিসুম করে দাও। পঁচা একটা।

–ঠিক আছে আমার এঞ্জেল যখন বলেছে তখন তো ঢিসুম ঢিসুম দিতেই হবে। তুমি এক কাজ করো। তুমি বিহান ভাইয়ার সাথে গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি ওকে ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে একটু পরেই আসছি। ঠিক আছে?

নূর ঘাড় কাত করে বললো।
–আচ্ছা।

আদিত্য বিহানকে ইশারা করতেই বিহান নূরকে ধরে আস্তে আস্তে করে ওখান থেকে নিয়ে গেল।
আদিত্য ওর লোকেদের কেও এখান থেকে যেতে বললো। এখন শুধু আদিত্য আর রশিদ খানই আছে এখানে।

আদিত্য হেঁটে গিয়ে রশিদ খানের সামনে দাঁড়াল। চোখ দিয়ে যেন ওর অগ্নিকুন্ডের লাভা গলে পড়ছে। আদিত্য রশিদ খানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তোর আমাকে মারার খুব শখ তাইনা? চল আজকে তোর আশা পূরণ করা যাক। আদিত্য সবাইকে একটা ফেয়ার চান্স দেয়। তাই তোকেও আজকে একটা সুযোগ দিচ্ছে। তুই আমাকে পরাস্ত করতে পারিস,তাহলে তুই আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারিস। আর যদি না পারিস তাহলে……. বাকিটা তখনই দেখতে পাবি। তো লেটস স্টার্ট দেন?

আদিত্য হাতের ঘড়ি খুলে পাশে রাখলো। তারপর হাতা গেটাতে লাগলো। রশিদ খান ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও উপরে উপরে সাহস দেখিয়ে সে নিজেও আদিত্যের সাথে লড়াই করতে রেডি হয়ে গেল। একসময় শুরু হয়ে গেল ওদের ফাইট। আর যথারীতি যেমন টা সবাই জানে তাই হলো। আদিত্যর বলিষ্ঠ শরীরের দক্ষতা আর ফাইটিং স্কিলের সামনে রশিদ খান পাঁচ মিনিটও টিকতে পারলো না। কপোকাত হয়ে নিচে চিত হয়ে পড়ে রইলো।

আদিত্য এবার রশিদ খানের বুকের ওপর এক হাঁটু ভর দিয়ে বসে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো।
–তুই আজ সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছিস।যার কোন মাফি নেই। আছে শুধু ভয়ংকর, দূর্বিষহ শাস্তি। যা দেখে মানুষের রুহ কেঁপে উঠবে। তোকে বলেছিলাম না? নূরকে ছেড়ে দে। নাহলে তুই দুনিয়াতে জন্ম নেওয়ার জন্যেও আপসোস করবি।

রশিদ খান আকুতি মিনতি করে বললো।
–আমার ভুল হয়ে গেছে আদিত্য। প্লিজ মাফ করে দাও। আর জীবনে কখনো এমন করবোনা।

আদিত্য বলে উঠলো।
–আদিত্যের জীবনে সবকিছুর জন্য মাফি আছে, তবে আদিত্যের কলিজায় হাত দেওয়ার কোন মাফি নেই। আর তুই তো আমার কলিজার দিকে কু নজর দিয়েছিস। আমার ফুলের মতো পবিত্র মাছুম পরিটাকে অপবিত্র করতে চেয়েছিস। তোকে তো কখনোই মাফ করা যাবে না।

আদিত্য ওর ব্লেজারের পেছন থেকে একটা ধারালো চাকু বের করলো। তারপর রশিদ খানের হাতটা ফ্লোরের সাথে চেপে ধরে ক্ষিপ্ত সুরে বললো।
–তোর এই নোংরা হাত দিয়ে আমার পরিকে ছুঁয়েছিস তুই তাইনা? আমার নূরকে আঘাত করেছিস তুই। তোর এই হাত রাখার কোন অধিকার নেই।
কথাটা বলেই আদিত্য চাকু দিয়ে একটানে রশিদ খানের কব্জি থেকে হাত কেটে ফেললো। এভাবে আরেক হাতও কেটে ফেললো। রশিদ খান গগনবিদারী আর্তনাদ করতে লাগলো।

আদিত্য এবার রশিদ খানের জিভ টেনে ধরে বললো।
–এই জিভ দিয়ে তুই আমার নূরকে নোংরা কথা বলেছিলি না?
কথাটা বলেই আদিত্য চাকু দিয়ে রশিদ খানের জিভ টা কেটে ফেললো। রশিদ খান শুধু কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলো।

আদিত্য এবার রশিদ খানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এই চোখ দিয়েই তুই আমার নূরের দিকে কু নজর দিয়েছিস তাইনা?
অতঃপর আদিত্য চাকু দিয়ে রশিদ খানের দুটো চোখই উপরে ফেললো। রশিদ খানের রক্ত দিয়ে পুরো মেঝে ভেসে গেল। আদিত্য এবার উঠে দাঁড়িয়ে রশিদ ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি তোকে জানে মারবো না। তুই নিজেই মৃত্যুর জন্য হাহাকার করবি।আর এটাই হবে তোর শাস্তি ।

তারপর আদিত্য নিজের ঘড়িটা নিয়ে ওখান থেকে বেড়িয়ে এলো।

চলবে……