আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-৩১

0
1233

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৩১।

২ দিন কেঁটে গেলো…
শ্যামার এই দুটো দিন কাঁটলো বাসা টু অফিস.. অফিস টু বাসা। এই দুদিনের মাঝে সব ঠিক থাকলেও? ঠিক ছিলো শ্যামা পুরো মন। সারাক্ষণ ঢুবে থাকতো তার ইজহান উরফ সুফিয়ানের ভাবনায়…! চুম্বক যেমন লোহাকে দূর থেকে আকর্ষণ করে? শ্যামার মনটা যেন সেই লোহার ন্যায়। ভাবনা গুলো সদা মেঘের তুলোর মতো। যা দূর থেকেই সুন্দর, কাছে গেলেই ভিজিয়ে দিবে আবেগী অনুভূতি-তে। কখনো কখনো ধাঁধা লাগলানো রংধনু উঠে উঁকি দেয় সুন্দর কিছু মুহূর্ত, তবু-ও ক্ষনিকের জন্য..! তারপর আবার সেই বিতৃষ্ণা, বিস্বাদ। শ্যামার এখনো স্বপ্ন মনে হয় সব। যাকে এত বছর না দেখে ভালোবেসে গেছে, বুকে আগলিয়ে রেখে গেছে, সেই তার অর্ধাঙ্গ, অথচ হাত বারিয়ে সে ছুঁতে পারছে, আদর মাখা কন্ঠে বলতে পারছে না,

” আমার আঁধারিয়া অম্বর… আমি… আমি তোমার সেই এক ফালি চাঁদ, যার এক চিলতে হাসি ছিলো তোমার ঠোঁটের হাসি, যার নিশ্বাসের শব্দ না শুনলে ঘুমতে পারতে না বলে দাবি করতে? তাহলে? তাহলে এত এত রাত কিভাবে কাঁটালে, এই নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া?”

শ্যামা আর ভাবতে পারলো না। আজ তৃতীয় দিন, আজ রাতেও ঘুম হলো না তার। এক রাশ কষ্ট বুকে জমিয়ে বিছনা থেকে নেমে রেডি হয়ে নিলো সে। অফিসে বের হবে ঠিক সেই সময়, দরজার মাঝে ধড়াম ধড়াম করে কড়া ঘাত করে যেতে লাগলো কেউ খুব জোরে। ভয়ে শ্যামার মুখ শুকিয়ে গেলো। সর্ব প্রথম দুটি নাম মাথায় এলো রিদ & শিফন? শ্যামার শুকনো ঢুক গিলার শব্দ যেন গুঞ্জন হলো তার ঘরের মাঝে। শ্যামা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” ক.. কে?

ঠক ঠক ঠক….। দরজার করাঘাতের তীক্ষ্ণ শব্দ ছাড়া আরো কোনো শব্দ ভেসে এলো না। শ্যামার নাভীর নিচ থেকে শিরশির করে কি যেন উঠে গেলো মাথায়। শ্যামার চোখ জড়িয়ে এক ফোঁটা জল-ও গড়িয়ে পড়লো।

“শ্যামা…!”

একটা চিকন মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো এবার। ব্যথাতুর, ভেঙ্গে পড়া, কান্নারত কন্ঠটা খুব পরিচিত লাগলো শ্যামার কাছে। শ্যামা দৌঁড়ে দরজা খুলতেই আলিয়া, অধিরাজ আর আয়ানাকে দেখতে পেলো তারা। শ্যামা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

” অ.. আপনারা?”

আলিয়া ফুপিয়ে উঠলো। আয়ানার চোখে জল, মুখ ভাড়। শ্যামার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো অজানা ভয়ে। শ্যামা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,

” ক.. কি হয়েছে?”

আলিয়া টলমল চোখে শ্যামার দু হাত জড়িয়ে ধরে বলল,

” ইজহান..!”

শ্যামার মাথা এবার ভাড়ী মনে হলো। বলল,

” ইজহান কি দাদিজান?”

আলিয়া কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। না পেরে শ্যামা অধিরাজের দিকে তাকালো। অধিরাজ দুঃখী মুখ নিয়ে বলল,

” ইজহান স্যার এক্সিডেন্ট করেছে গুরুতর ভাবে। আউট ওফ ডেঞ্জার হলেও ওনার অনেক ক্ষতি হয়েছে শরীর। ”

শ্যামার মাথায় যেন বাজ পড়ে গেলো। হাত পা যেন জমে গেলো। আধিরাজ বলতে থাকলো,

” দুটো দিন আপনার আশেপাশেই ঘুরেছিলেন শ্যার, ইনফ্যাক্ট যেদিন আপনি চলে এলেন, সেদিন আপনার বাসার সামনেই সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজেছেন এবং কি বাসায়-ও ফিরেন নি। আর সেই অবস্থা আপনাকে ফোলো করে গেছে রাত দিন। কিন্তু কাল আলিয়া মেডাম জোর করাতে উনি বাসায় যেতে বাধ্য হোন। লাষ্ট যখন উনার সাথে দেখা হয়, খুব জ্বর ছিলো শরীরে, আর রাতে বেড়ে গেছিলো খুব, ড্রাইভ করার সময় আর সামলাতে না পেরে এক ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়ে যায়.. আর স্যার…!”

শ্যামা ডুকরে উঠলো,,

” আমি যাবো।”

অধিরাজ মাথা নাড়লো। আয়ানা তখন মুখ খুললো। ভেজা গলায় বলল,

” তোমার জন্য আমান ভাইয়ের এ হাল আজ, তোমরা আমাদের জীবনের ধংস করতেই কি পৃথিবীতে এসেছো? ”

শ্যামা থম মেরে গেলো কথাটুকু শুনে, সত্যিকি তাই… ইজহানের পরিবারের ধংসের পিছনে যদিও শ্যামার বাবা-মা দুজনের হাত ছিলো, তাই বলেকি? শ্যামা কখনো তা চায় না। সে তো ইজহানকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষটিকে কি কষ্ট দেয়া যায়? তাই তো শ্যামা দূরে চলে এসেছিলো। ভেবেছিলো খুব দূরে চলে যাবে সে, যেন ইজহানের কোনো কষ্ট না হয়? তাহলে? শ্যামা সপ্তপর্ণ গোপন করলো শ্বাস টুকু। তারপর অধিরাজের পিছন পিছন চলতে লাগলো…।

হসপিটাল…

সদা চাদরে জড়ানো হৃষ্টপুষ্ট দীর্ঘকায় যুবকের দেহোটা জড়িয়ে আছে হসপিটালের নামি-দামি ইকুপমেন্টের সাথে। শ্যামার বুকের ব্যথাটা এবার খুব বেড়ে গেলো। শ্যামা ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করলো, ইজহানের ফর্সা রং ফিকে, এলো মেলো চুল মুখের এক পাশটায় কেঁটে গেছে অনেকটুকু। শ্যামা মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো। এই কি সেই তার সুফিয়ান? যাকে সুস্থ সবল দেখে এসে ছিলো। এতটা ভালোবাসে তার সুফিয়ান তাকে! এতটা? নিজের জীবন বিপন্ন করতে এক ফোঁটা ভেবেনি? কেন? শুধু শ্যামাকে ভালোবাসার জন্য? শ্যামা ইজহান কাছে গিয়ে বসলো। এক হাত বিচরণ করলো ইজহানের শরীর। আঘাতের জায়গা গুলো যতবার ছুলো? শ্যামার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। শ্যামা শইতে না পেরে ইজহানে লোমহীন বুকে মাথা রাখলো। বিড়বিড় করে বলল,

” সুফিয়ান? আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না, বাঁচতে চাই তোমার সাথে… হেঁটে যেতে চাই অনেক পথ! প্লিজ কাম ব্যাক! প্লিজ কাম ব্যাক, তোমার চাঁদ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ! ”

পিটপিট করে চোখ খুললো ইজহান। গত দুদিন তার হুঁশ ছিলো না। ভালোবাসার মানুষটির ছোঁয়া পেয়ে, সে যেন ফিরে এলো কোনো অদ্ভুত এক দুনিয়া থেকে। যেখানে একটি ছোট বাচ্চা ইজহানকে বাবা বলে ছুটোছুটি করছে তার সাথে। বাচ্চার মিষ্টিমুখ দেখে ইজহান যেন দুনিয়ার সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সারা জীবনের চলে বাচ্চাটির সাথে থাকতে চায়। শ্যামার মৃদুস্বরের কন্ঠ যখন ভেসে আসে ইজহানের তখনো যেন হুঁশ নেই, সে খেলে যাচ্ছে মেয়েটির সাথে। বাচ্চা মেয়ে শ্যামার কন্ঠ শুনে বলে উঠে ইজহানের উদ্দেশ্যে,

” বাবা… মা তোমাকে ডাকছে, তুমি চলে যাও। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে!”

ইজহানের মুখে অন্ধকার নেমে এলো, মুহূর্তেই বাচ্চা মেয়েটি হারিয়ে গেলো। ইজহান খুঁজতে লাগলো এদিক সেদিক। কিন্তু শ্যামার কান্নামাখা মুখটি ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না ইজহান। চট করে চোখ খুলে নিজের বুকে শ্যামাকে দেখতে পেয়ে ইজহান যে কথাটি প্রথম বলল,

” শ্যামা…! আমি আমার বাচ্চাকে মারি নি…! বিশ্বাস করো!”

শ্যামা সঙ্গে সঙ্গে মাথা উপরে তুলে ইজহানের চোখ খুলতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। ইজহানে কাঁপলে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,

” এখন কেমন লাগছে তোমার? ”

ইজহান তার বাম হাতে শ্যামার চোখের জল মুছে দিলো। বলল,

“কেঁদো না শ্যামা… আমি ঠিক আছি। তোমায় ছাড়া কোথা-ও যাবো না।”

শ্যামা হেসে বলল,

” আমি তোমাকে যেতে-ও দিবো না।”

দুজনেই হাসলো। শ্যামা আবার বলল,

” আমি ডাক্তারকে ডাকছি। তুমি রেস্ট করো?”

ইজহান হো বোঁধক মাথা নাড়লো। শ্যামা চোখ মুছে বাহিরে বেড়িয়ে গেলো। সবাইকে খবরটা দিতেই এক এক করে দেখা করতে লাগলো ইজহানের সাথে। শ্যামা তখন পা বাড়ালো ডাক্তারের ক্যাবিনে। শ্যামা যেতেই ডাক্তারকে বলল,

” স্যার ইজহানের জ্ঞান ফিরেছে। ”

শ্যামার কন্ঠ খুশিতে গদগদ হলেও। ডাক্তারকে একটু নার্ভাস দেখালো। শ্যামার দিকে একটি রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলল,

” উনার জ্ঞান ফিরেছে আলহামদুলিল্লাহ, চিন্তা মুক্ত আমরা। কিন্তু…!”

শ্যামা ডাক্তারের কঁপালের ভাজ স্পষ্ট দেখতে পেলো,

” কিন্তু কি স্যার?”

” উনার এক্সিডেন্টের ফোলে উনার কোমোরের নিচের অংশটুকু প্যারালাইজড হয়ে গেছে। যদিও তা ঠিক হয়ে যায়… তবু-ও হয়তো আর কখনো উনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন না….উনার সেক্সুয়্যালিটি হারিয়ে ফেলেছেন।

শ্যামা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে। কোথা-ও বাজ পড়লো এমন এক বিকট শব্দ হতে লাগলো শ্যামার ভিতর বাহিরে। ইজহানকে এসব কিভাবে বলবে শ্যামা? কি করবে ইজহান এসব জানার পরে? শ্যামা আবারো মুখ চেঁপে কাঁদতে লাগলো। ঠিক তখনি ডাক্তারের দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো একটা হাস্যউজ্জল মুখ। কেউ জানতে-ও পারলো না, কেউ দেখলোনা।
কিন্তু যখন ইজহানের কান পর্যন্ত কথাটুকু পৌছালো? ইজহান বেদনাদায়ক এক হাসি এসে বলল,

” আমি কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবো? না হাটতে পারবো, এই অচল শরীরটাতে প্রাণ কেনো রাখলেন উপর ওয়ালা? এইটা কি আমার কোনো শাস্তি? সারা জীবন এই কষ্টো দগ্ধ হতে হবে আমার!”

চলবে,