অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব-১৭+১৮

0
549

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১৭

‘ আয়ন্তিকা তুমি কি চাচ্ছো আমি আবার তোমায় রেখে চলে যাই?’

অহর্নিশ থমথমে কন্ঠে বলল। চোখমুখে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ। নিভৃতে জমেছে খানিক দুঃখ! লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে সে আয়ন্তিকার উত্তরের অপেক্ষা করে। প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ অহর্নিশ বহুবার চেষ্টা করেছে আয়ন্তিকার সাথে কথা বলার। কিন্তু সে ব্যার্থ প্রতিবারই। আয়ন্তিকা কথা বলছে না তার সাথে। থম মেরে চুপ করে বসে আছে। এভাবে মৌনতা পালন করার লজিক কারণ অহর্নিশ খুঁজে পেলো না।

অহর্নিশের অপেক্ষার প্রহরের ইতি টেনে আয়ন্তিকা মাথা তুলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার ওপর। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে অগোচরে অহর্নিশ। আশা জুটেছে এবার বুঝি আয়ন্তিকা তাকে বলবে, ‘ যাবেন না আপনি দয়া করে। গেলে আমাকেও নিয়ে যান আপনার সাথে। ‘ অহর্নিশ প্রায় ধরেই নিলো আয়ন্তিকা এই কথাটিই বলবে। সেই অনুসারে মনে মনে উত্তরও গুছিয়ে নিলো সে। কিন্তু আয়ন্তিকা এবার অহর্নিশ কে পুরোপুরি ভাবে ভুল প্রমানিত করে ফিচেল কন্ঠে বলল,

‘ তো যান না। আপনাকে কি আমি হাত পা বেঁধে আটকিয়ে রেখেছি? না তো! তাহলে যাচ্ছেন না কেনো। আধাঘন্টা যাবৎ একই কথা বলছেন শুধু। ‘

অহর্নিশ সুচালো ব্যাথা অনুভূত করে তার হৃদয়ে। তার মানে কি আয়ন্তিকা কে সে এখনো ঠিক মতোন চিনতে পারেনি?হয়তো তাই হবে। অহর্নিশ তো এক কোমল, নম্র এবং শান্ত স্বভাবের আয়ন্তিকা কে চিনতো। এই কঠোর আয়ন্তিকে তার তো চেনাই হয়নি। এতো শক্ত, কঠিন কথা অনায়াসে বলা ফেলা আয়ন্তিকা কে তার যে এখনো অচেনা। অহর্নিশ অপমান বোধে একবার ভাবলো এখনি ছুটে বের হয়ে যাবে বাসা থেকে। কিন্তু না! তা যে হলোনা। এইযে প্রেম নামক অনুভূতি। সেই অনুভূতি নিভৃত হতে চেঁচিয়ে বলল, তার আয়ন্তিকা কে চাই। তাকে ছাড়া এক মূর্হতও থাকতে পারবেনা সে।

অহর্নিশ নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর আয়ন্তিকার হাত থেকে কেমিস্ট্রি বইটাকে ছো মেরে কেঁড়ে নিয়ে পাশে রেখে দেয়। পরিশেষে সে এক মূর্হতও ব্যায় না করে ধপ করে আয়ন্তিকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। আঁখিযুগল বন্ধ করে নিয়ে বলল,

‘ যাবোনা আমি। তোমার কথাতেই নাকি?বিয়ে করেছি বউ ছাড়া থাকবো কেনো? ‘

আয়ন্তিকা নিঃশব্দে হাসে। তার অস্বস্তি হলোনা। বরং বিশাল এক ভালোলাগার হাওয়া তার মনে দোলা দিয়ে গেলো। এইযে হুটহাট করে অহর্নিশ তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো এই কাজে সে এক বিন্দুও ভীতি বা সংকোচের মাঝে জরীয়ে পড়েনি। মনেপ্রাণে সে এটাই চাইছিলো অহর্নিশ যেনো না যায়।
ভারী নিঃশ্বাস এর আস্তরণে আয়ন্তিকা বুঝতে পারলো অহর্নিশ ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝটপট আয়ন্তি তার একহাত গলিয়ে দেয় অহর্নিশের কুচকুচে কালো চুলে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলল,

‘ জীবনটা এতো সুন্দর কেনো?’
___________

‘ ভাই আপনি নাকি এবার এমপি পদে দাঁড়াইবেন?’

অহর্নিশ বাম হাতে পানির বোতলটা নিয়ে ভ্রু বাকিয়ে তাকায় নাহিদের দিকে। নাহিদের চোখমুখে আতংকের ছাপ। তা দেখে নিভৃতেই সে মলিন শ্বাস ফেলে। পানির বোতলে অধরের ছোঁয়া লাগানোর আগে অহর্নিশ থমথমে কন্ঠে বলল,

‘ হু! হটাৎ এই কথা বলস কেন?’

নাহিদ শুকনো ঢোক গিললো। চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ ভাই এমপি পদে না দাঁড়াইলে হয় না? মাসুদ ভাই আগে থেকেই আপনারে অনেক থ্রেট দিসে। কত আঘাত ও করছে তার লোক দিয়া। আপনার বাপের পা ভাঙসে। এখন এমপি পদে দাঁড়াইলে আপনিই জয়ী হবেন নিশ্চিত। তখন তো মাসুদ আপনারে মাইরা ফেলবে ভাই। এসব থেকে দূরে সরে যান ভাই, আপনার কিছু হলে আমাদের কি হবে?’

অহর্নিশ ঢগঢগ করে পানি খায় নিজের চাহিদা মতোন। অতঃপর হাতের পানির বোতলটা ছুঁড়ে মারে নাহিদের দিকে। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘামগুলো মুছে নিয়ে বলল,

‘ পানি খা আর আজাইরা টেনশন কমা। আমার কিছুই করতে পারবে না ও। আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো। ‘

‘ জানি ভাই কিন্তু ভাবীর কথা একটু ভেবে দেখেন। ‘

আয়ন্তিকার কথা মনে হতেই অহর্নিশের সাহস ফিকে পড়ে যায়। চোখ বন্ধ করে নিয়ে সে নতজানু হয়। উদাসীন মনে তপ্তশ্বাস ফেলে। আজ কেনো যেনো মনে হলো তার আয়ন্তিকা তার জীবনে প্রবেশ করে বড্ড বেশি ভুল করেছে। অহর্নিশ আয়ন্তিকার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এইযে তার জীবনের কোনো সিয়রিটি নেই। এখন হুট করে তার কিছু হয়ে গেলে আয়ন্তিকার কি হবে?এই সমাজে যে বিধবাদের প্রচুর কষ্ট বহন করতে হয়। তাদের বংশে মেয়েদের দ্বিতীয় বিয়েরও কোনো নিয়ম নেই। তার কিছু হলে আয়ন্তিকার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। চট করে চোখ খুলে অহর্নিশ! বুক ভর্তি শ্বাস টেনে সে সতেজতা নিয়ে বলল,

‘ না আমার কিছু হবে আর না আয়ন্তিকার কিছু হতে দিবো আমি নাহিদ। সো অযথা চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে যা। ‘

অহর্নিশ দ্রুত পায়ে সেখান হতে প্রস্থান করে। এখন আয়ন্তিকার স্কুলে যাওয়া দরকার। ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। বাইকে বসে ফুল স্প্রিডে শো শো করে চলে যায় অহর্নিশ!

.

স্কুলের বড় মাঠ পেরিয়ে গেটের সামনে আসার পর আয়ন্তিকা খেয়াল করে অহর্নিশ কে। বাইকে হেলান দিয়ে একমনে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকে। অহর্নিশের সামনে দাঁড়াতেই অহর্নিশ ‘পরে কথা বলছি ‘ বলে ফোন কেটে দেয়। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে অহর্নিশ নম্র কন্ঠে বলল,

‘ হেলমেট পড়ে বাইকে বসো। আমি আসছি। ‘

আয়ন্তিকা এবার কৌতূহল নিয়ে বলল,

‘ বাইক কার?’

অহর্নিশ বিরক্তি নিয়ে তাকায় আয়ন্তিকার পানে। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ অবশ্যই আমার! আমার ছাড়া অন্য মানুষের বাইকে তো আর উঠতে বলবো না তোমাকে। উঠে বসো। আসছি একটু। ‘

আয়ন্তিকা অকপটে জবাব দেয়, ‘ আচ্ছা। ‘

অহর্নিশ চলে যাওয়ার পর আয়ন্তিকা বাইকে উঠে বসে। কেমন ভয় ভয় লাগছে তার। আগে কখনো বাইকে ওঠা হয়নি। উঠে বসে চারপাশে দৃষ্টি দেয় সে, কিছু উৎসুক চোখ তার দিকে নিবদ্ধ। আশপাশের কিছু মানুষ কেমন অদ্ভুতুরে দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তাকে। এমনভাবে দেখার কারণটা খুঁজে পেলো না আয়ন্তিকা। ইতস্তত বোধ করে মাথা নুইয়ে নেয় সে। খানিকক্ষণ বাদে অহর্নিশ এসে বসে পড়লো বাইকে। হেলমেট পড়ে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,

‘ আগে কখনো বাইকে উঠেছো?’

‘ নাহ! ‘

‘ তাহলে আমাকে পেছন থেকে জরীয়ে ধরো নয়তো পড়ে যাবে। ‘

‘ সমস্যা নেই পারবো। ‘

অহর্নিশ ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয়। আয়ন্তিকার কথাটা তার মোটেই ভালো লাগল না। মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত জেদী! এখন পড়ে টরে গেলে যে আঘাত পাবে সেই আঘাতের মূল ব্যাথা তো অহর্নিশ অনুভব করবে তা কি এই মেয়ে বোঝে না? অহর্নিশ ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

‘ ত্যাড়ামো না করে যা করতে বলেছি তা করো। ‘

আয়ন্তিকা করলো না। ধরলো না অহর্নিশ কে। হাত গুটিয়ে ঠায় বসে রইল। অহর্নিশ দাঁতে দাঁত চেপে বাইক স্টার্ট দেয়। ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে তার আয়ন্তিকা। এমন উদ্ভট, লজিকহীন জেদের কি কোনো মানে হয়?নিজের জীবনের প্রতি ও কোনো দরদর দেই আয়ন্তিকার?রাগের বসে অহর্নিশ স্প্রিড বাড়িয়ে দিয়ে বাইক নিজ মতে চালানো শুরু করে। মাঝপথে এসে চোখমুখে খিঁচে বন্ধ করে নেয় আয়ন্তিকা। থরথর করে কাঁপার এক পর্যায়ে সে ধপ করে জরীয়ে ধরে অহর্নিশ কে। তাতে মুখ বাঁকিয়ে অহর্নিশ বলল,

‘ এখন জরীয়ে ধরলো কেন?’

আয়ন্তিকা জবাব দিলো না। ভয়ে সে এঁটে সেঁটে আছে অহর্নিশের সাথে। মনে মনে আটস্থ করলো আর কোনোদিনও সে অহর্নিশের সাথে বাইকে উঠবে না। কোনোদিনও না!
________________

রাত দশটা!
ফিজিক্স বইটা নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে আয়ন্তিকা। তার সামনেই অহর্নিশ ল্যাপটপ নিয়ে বসে। আঁড়চোখে বারংবার পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে আয়ন্তিকা কে! এক পর্যায়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বলল,

‘ বই নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছো কেনো?পড়ো! কি ভাবছো এতো?’

আয়ন্তিকা বই পাশে রেখে দিয়ে অহর্নিশের পাশে ব্যাবধান বজায় রেখে বসলো। হাত দিয়ে ওড়না নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

‘ আমি গ্রামে যেতে চাই একটু। ‘

অহর্নিশ সটান হয়ে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আগেও বলেছি আয়ন্তিকা এখন আমার হাতে টাইম নেই। তোমাকে আমি দিয়ে আসতে পারবো না। ‘

‘ আপনাকে দিয়ে আসতে হবেনা। আমি মামার সাথে চলে যাবো। মামা পরশু যাচ্ছে। ‘

অহর্নিশ ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় তৎক্ষনাৎ। গ্লাস হাতে নিয়ে গলা সিক্ত রূপে প্রদান করে বলল,

‘ কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমি ফ্রী হলে আমি নিজেই নিয়ে যাবো তোমাকে। এখন পড়তে বসো যাও। ‘

‘ অহর্নিশ প্লি..’

অহর্নিশ উঠে দাঁড়িয়ে আয়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে ধমকে বলল,

‘ আমি কি বলেছি শুনোনি তুমি? যাও পড়তে বসো।’

আয়ন্তিকা ঠোঁট কামড়ে কান্না দমন করার প্রয়াস চালায়। উঠে দাঁড়িয়ে চটজলদি রুম হতে বেড়িয়ে যায় সে। অহর্নিশ সেদিকে তাকিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। একটু বেশিই কি কড়া ব্যাবহার করে ফেললো সে? ভাবতে ভাবতেই রুম হতে বেড়িয়ে আসে। আয়ন্তিকার রুমে গিয়ে চারপাশে চোখ বুলায়! কোথাও আয়ন্তি নেই। চিন্তিত হয়ে বেলকনিতে যায় সে। রেলিঙ ধরে আয়ন্তিকা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে কিছু। অহর্নিশ তা স্পষ্টত বুঝতে পারেনা।আরেকটু সামনে আগাতে বুঝতে পারে তাকে গালাগাল করা হচ্ছে। উদ্ভট গালি শুনে সে থতমত খায়! আয়ন্তির পিছে দাঁড়িয়ে সে বলল,

‘ আয়ন্তি?’

আয়ন্তিকা পিছে তাকিয়ে একদম সন্নিকটে আবিষ্কার করে অহর্নিশ কে। পা উঁচু করে সে অহর্নিশের কলার চেপে ধরে বলল,

‘ এখন এসেছেন কেন হ্যা?যান এখান থেকে! অভদ্র লোক! আপনি একটা পাতিলের বাচ্চা। পোড়া পাতিলের কালি, ইদুরের বিষ তুই! ‘

আরেকদফা চমকে অহর্নিশ আয়ন্তিকার কোমড়ে হাত রাখে। আয়ন্তিকার থামার কোনো নাম নেই তাও। পরিশেষে অহর্নিশ আয়ন্তিকার খয়েরী বর্ণের কোমল ঠোঁটযুগলে চট করে নিজ ওষ্ঠের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।

চলবে…

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১৮

চোখের পলকে আয়ুরেখা হতে বিয়োজন হয়েছে প্রায় দেড় মাস। শরৎকালের লাবণ্যময়ী রূপে সাজতে প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি! শুভ্র সকালের আগমন ঘটতেই আয়ন্তিকা বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে। তার ডানপাশটা শূন্য পড়ে আছে। তা দেখে তপ্তশ্বাস ফেললো আয়ন্তিকা। এইত সপ্তাহ খানেক আগে তার ডান পাশটাতে ব্যবধান বজায় রেখে অহর্নিশ জায়গা দখল করে বেঘোরে ঘুমোতো। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে অহর্নিশের দেখাই নেই! নির্বাচনের কাজে এতটাই ব্যাস্ত সে আয়ন্তিকাকে এসে একবার দেখে যায় না। নির্বাচনের কাজ শুরু হতেই অহর্নিশ তাকে অহনার বাসায় দিয়ে গিয়েছে সেই যে.., আর আসেনি! এতে অভিমানীনি আয়ন্তিকা শুধু অভিমানে আঁখিপল্লব সিক্ত করে তোলে!

‘ আয়ু উঠেছিস? ‘

অহনার ভরাট কন্ঠস্বর। কল্প জগতে মগ্ন আয়ন্তিকা এবার দরজার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়। নিজেকে ধাতস্থ করে সে আলত হেঁসে বলল,

‘ জি মামি! কিছু বলবা?’

‘ হ্যা। যা ফ্রেশ হয়ে আয় জলদি। তোর স্কুলের সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে। নাহিদ এসে তোকে নিয়ে যাবে। ‘

‘ আসছি মামি। তুমি যাও। ‘

আয়ন্তিকা হাতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। হাতমুখ ধোঁয়ার এক পর্যায়ে তার সুক্ষ্ম দৃষ্টি আঁটকে যায় তার অধর কোণে! সেখানে কেটে গেছে একটু। লজ্জায় নুইয়ে যায় আয়ন্তিকা। সেই ঘটনার দেড় মাস কেটে গেলেও লজ্জার রেশ এখন পূর্ণ মতোন কাটেনি। সেদিন অহর্নিশ তার ঠোঁটে আদুরে স্পর্শ একে দেয়ার এক পর্যায়ে ছোট্ট করে কামড় দিয়ে বসেছিলো। ব্যাথায়, লজ্জায় সেদিন আয়ন্তিকা মনে মনে অহর্নিশ কে শ’খানেক গালি দিয়েছে নিভৃতে। ভাগ্যিস মামি বা আর্নিয়া আপু এই ঠোঁট কেটে যাওয়া নিয়ে কোনোরূপ প্রশ্ন তুলেনি। নয়তো সে লজ্জায় মারা পড়তো নিশ্চিত।

.
শুভ্র সকালের আবির্ভাব শেষে এখন চলছে দুপুরের রৌদ্দুরের পালা। তপ্তশ্বাস ফেলে ক্লাসরুম হতে বেড়িয়ে আয়ন্তিকা আগত হয় সামনে। নাহিদ গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখা মাত্রই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেঁসে সালাম দেয়। আয়ন্তিকা সালামের প্রতুত্তর করে গাড়িতে উঠে বসে। অহনার বাসায় আসার পর হতে নাহিদই তাকে সব জায়গায় নিয়ে যায়। অহর্নিশ কখনোই আসেনা। না কোনো ফোক করে তাকে! গাড়ি চলা শুরুর পর আয়ন্তিকার চোখ আঁটকে যায় হাস্যজ্বল অহর্নিশের দিকে। পোস্টারে অহর্নিশের ছবি। পুরো এলাকা নির্বাচনের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। লম্বা শ্বাস ফেললো সে।

গাড়ি অহনার বাসার রাস্তা হতে অন্যদিকে যাওয়া শুরু করতেই আয়ন্তিকা চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ নাহিদ ভাইয়া, ঐদিকে কোথায় যাচ্ছেন। বাসার রাস্তা তো এদিকে না?’

‘ জি ভাবী। কিন্তু এখন আমরা বাসায় যাচ্ছি না।’

‘ তাহলে কোথায় যাচ্ছি? ‘

‘ ভাইয়ের কাছে! ‘

আয়ন্তিকা থতমত খায়। হতভম্ব হয়ে বলল,

‘ ভাই মানে?অহর্নিশ? ‘

‘ জি ভাবী। ভাই আপনার সাথে দেখা করতে চায়। তাই একটা ঠিকানা দিয়া বলসে আপনারে সেখানে নিয়া যাইতে। ‘

আয়ন্তিকা মৃদু স্বরে বলল, ‘ অহ! ‘
অদ্ভুত প্রশান্তির হাওয়া তার সর্বত্রে এসে বাড়ি খায়।অহর্নিশের সাথে এতদিন পর দেখা হচ্ছে তার, তা ভাবলে জরোতা কাজ করে আবার তারই মধ্যে জেগে ওঠে একরাশ অভিমান। পর্বতসম অভিমান!

অহর্নিশের এমপি পদে দাঁড়ানোয় কেও খুশি নয় বললেই চলে। খুশি হবে কিভাবে? এতকিছু যে ঘটে গেলো এটাকে নিয়ে। অহর্নিশের বিপরীত পন্থীলোক মাসুদ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে অহর্নিশ কে এমপি পদ হতে সরে দাঁড়াতে। কারণ ও জানে অহর্নিশ এ পদে দাঁড়ালে তারই জয় নিশ্চিত। তাই তো মাসুদ বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছে। অহর্নিশের বাবা ইমান কে আঘাত করে একবার তার পা ভেঙে দিয়েছিলো। তার ব্যাবসায় লস ঘটিয়েছিলো। অহর্নিশকে মেরে ফেলার প্রয়াস চালিয়েছিলো। তবে মাসুদ ব্যার্থই! অহর্নিশ নিজ কর্মে অটল।

.
নির্জন এক খোলা মাঠে এসে থামে গাড়ি। নাহিদ ইশারায় নামতে বলল আয়ন্তিকা কে। অপেক্ষা করার জায়গাটি নাহিদ বলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কিছুটা দূরে চলে গেলো। অহর্নিশের নির্দেশ এটা। তাদের প্রাইভেসি চাই। তাই আয়ন্তিকা কে নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছে দিয়েই যেনো নাহিদ চলে যায় এমনটা বলেছে সে।

আয়ন্তিকা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকটাতে। সেখানে একটা ছাউনি রয়েছে। ওপরে টিন বাঁধানো। মাঝখানটায় বাশ আর তার চতুর্দিকে বসার জন্য বিন্যাস মতোন কয়েকটা সিট বসানো। সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাউনিতে উঠে আয়ন্তিকা। দু-হাতের তালুতে দু’হাত দিয়ে উত্তাপ করার চেষ্টা করে। হাত কেমন হীম ভাব টেনে নিয়েছে নিজের মাঝে। যেনো বরফ! চার মিনিট বাদে আয়ন্তিকা শুনতে পায় বাইকের কর্কশ শব্দ! তৎক্ষনাৎ সে বাম দিকে তাকায় ঘাড় বাকিয়ে নিয়ে। আকাঙ্খিত মানুষটাকে নজরে পড়ে তার চটজলদি সেই ক্ষনটাতেই।

অহর্নিশ নেভি ব্লু রঙের শার্ট পড়ে আছে। শার্টটা ঘামে ভিজে চুপচুপ হয়ে তার শরীরের সাথে একদম এঁটে সেঁটে মিশে রয়েছে। এতে তার ফিটফাট সুদর্শন দেহটা স্পষ্টত রূপে বোঝা যাচ্ছে। তবে আয়ন্তিকা খেয়াল করল অহর্নিশ আগের থেকে কেমন রোগা রোগা হয়ে গিয়েছে। মাথা হতে কালো রঙের হেলমেট টা খুলতেই নজরে আসে তার নির্জিব এক চেহারা। অহর্নিশের চোখের চারদিকে কালচে ভাব, গোলাপি পুরু ঠোঁটদুটো শুষ্কতায় মগ্ন, বড়সড় চোখ দুটো ছোট্ট হয়ে আছে। সর্বমুখে ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে এক প্রকার। আয়ন্তিকা কেঁপে ওঠে। ১ মাসের ব্যাবধানে এ কি হাল হয়েছে অহর্নিশের? এ অবস্থা কেনো এই লোকটার?

অহর্নিশ হেলমেট রেখে দিয়ে তড়িৎ বেগে ছাউনিতে এসে উঠলো! হেলতে দুলতে এগিয়ে এসে সে এক প্রকার ঝাপটে ধরলো আয়ন্তিকা কে। এইতো! তার বুকের ব্যাথা তো মিটে গেলো। ভেতরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় একদম শান্ত রূপে রূপান্তর হলো। এতক্ষণ, এতদিন যাবৎ রুখে থাকা স্বাভাবিক শ্বাস এবার ঠিকঠাক ভাবে চলছে! ইশশ! এতো প্রশান্তি মিলল হৃদয়ে। এমন একটা মূর্হত যদি সে হৃদয়ের ক্যানভাসে একে নিতে পারতো। তাহলে বড্ড বেশি ভালো লাগত।

সেকেন্ড, মিনিট, আধা ঘন্টা পার হওয়ার পর অহর্নিশ আয়ন্তিকার হতে সরে দাঁড়ায়। আয়ন্তিকা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটার হৃদ স্পন্দন গুনছিলো। আহা..!এত মধুর শুনতে ছিলো আয়ন্তিকা তা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পেলোনা।

অহর্নিশ সিটে বসে ইশারায় আয়ন্তিকা কে বসতে বলল। আয়ন্তিকা বিনাবাক্যে বসে পড়ে পাশে। অহর্নিশ এবার নম্র কন্ঠে বলল,

‘ কেমন আছো আয়ন্তিকা? ‘

আয়ন্তিকার এই মূর্হতে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘আমি ভালো নেই অহর্নিশ! একটুও ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া আমার কেমন যেনো দম বন্ধ লাগে এমন কেনো হয় জানা নেই। তবে আপনি পাশে থাকলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ব্যাক্তি হিসেবে নিজেকেই মনে করি। ‘

কিন্তু আয়ন্তিকা মুখে অভিমানী কন্ঠে বলল,

‘ ভালো আছি অবশ্যই। খুব বেশি ভালো আছি আমি বুঝলেন? ‘

অহর্নিশ হতাশার শ্বাস ফেললো। অতঃপর সে মলিন কন্ঠে বলল,

‘ অহ! তা আমায় জিজ্ঞেস করবেনা আমি কেমন আছি?’

‘ জিজ্ঞেস করার কি আছে?নিশ্চয়ই ভালো আছেন। ভালো থাকার জন্যই তো আমায় দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ‘

আয়ন্তিকার ঝাঁঝ মেশানো কন্ঠস্বর শুনে অহর্নিশ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো। পরবর্তীতে সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল,

‘ ভালো থাকার জন্য তোমায় আমি দূরে পাঠায়নি। পাঠিয়েছি তোমার নিজ নিরাপত্তার জন্য আয়ন্তিকা তুমি আমার সাথে থাকলে সেফ থাকবে না। এখানে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি অনেক ঝড় মিটিয়ে! আমি বিয়ে করেছি এটা সবাই জানলেও, কেও জানেনা কাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে কেও সন্দেহও করতে পারবেনা। কারণ তোমায় বয়স অল্প! এখানটাতে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়না তার ওপর আমি অল্প বয়সী কাওকে বিয়ে করবো এটাও কেও ভাবতে পারবে না। ‘

আয়ন্তিকা এবার কোমল কন্ঠে বলল,

‘ আপনি প্লিজ এসব থেকে দূরে সরে আসুন না। এমন কাজে যুক্ত হওয়ার মানে হয় যেখানে নিজের জীবনই সেফ না! না পরিবারের জীবনের কারো গ্যারান্টি আছে। ‘

‘ না থাকুক আমার জীবনের গ্যারান্টি। আমার প্রাণের বদলে যদি অন্য আর দশটা প্রাণ বাঁচে তাতেই চলবে। বর্তমান এমপি পদে থাকা কিছু মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ দেখে। আর পাঁচটা মানুষ না খেয়ে মারা গেলে তাদের কিছু না। আল্লাহ যদি রহম করেন তাহলে আমি বিজয়ী হলে আলাদা কিছু করতে চাই। ‘

‘ কিন্তু.. ‘

অহর্নিশ আয়ন্তিকার ঠোঁটে নিজের আঙুল রাখে। নিজের ঠোঁটযুগল গোল গোল করে নিয়ে বলল,

‘ হুঁশশ!নো মোর ওয়ার্ড’স। এখন বাসায় যাও। ‘

আয়ন্তিকা বিচলিত দৃষ্টিতে তাকায়। হতবাক হয়ে বলল,

‘ মাত্রই তো আসলাম আরেকটু থাকি?’

আয়ন্তিকার উত্তেজনা দেখে অহর্নিশ মৃদু হাসে ফের। পরিশেষে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

‘ না! আমার কাজ আছে যেতে হবে। বাসায় যাও। ‘

অহর্নিশ ফোন বের করে নাহিদকে কল দিয়ে বলল আয়ন্তিকা কে নিয়ে যেতে। আয়ন্তিকার বিষন্ন চাহনি। তার ইচ্ছে করছে না যেতে। আয়ন্তির মন বলছে অহর্নিশ ভালো নেই। একটুও ভালো নেই সে। আয়ন্তিকার দরকার তাকে। কিন্তু…

______________

বাসায় বিষন্ন চেহারা নিয়ে প্রবেশ করে আয়ন্তিকা। অহনা তা দেখে কষ্টে নিজের কান্না লুকায়। এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘ কিরে এমন মুখ করে আছিস কেন?অহর্নিশের সাথে দেখা করে এলি, এখন তো খুশি হওয়ার কথা।’

আয়ন্তিকা নিচু কন্ঠে বলল,

‘ মাত্র ৫ মিনিট ছিলাম তার কাছে মামি। তিনি খুব শুকিয়ে গিয়েছেন। ভালো নেই তিনি! আমাকে কেন নিচ্ছেন না তার সাথে। ‘

অহনা ধরা গলায় বলল,

‘ নিবে তো। মন খারাপ করিস না। যা এখন! ফ্রেশ হ জলদি। ‘

আয়ন্তিকা চলে যাওয়ার পর নিজের কান্না ধরে রাখতে পারল না অহনা। হু হু করে কেঁদে দেয় সে।

________

আয়ন্তিকার সাথে দেখার করে এসে অহর্নিশ ভেবেছিলে সে কাজে খুব জোর পাবে। কিন্তু না! হলো এর উল্টোটা। তার মন সে আয়ন্তিকার কাছে ফেলে এসেছে। চারিদিকে শুধু সে আয়ন্তিকা কে দেখে। বুকে জ্বালাপোড়া বেশি করে আজকাল। ইশ! আফসোস হচ্ছে তার। কেনো যে দেখা করতে গেলো মেয়েটার সাথে। ডিভানে শরীর এলিয়ে দেয় অহর্নিশ। ক্লান্ততা যাচ্ছেই না। যাবে না! আয়ন্তিকা কে সামনে না পেলে এই প্রেমের ক্লান্ততা কখনো যাবে না তার।

ফোন আসার শব্দে ধ্যান ভাঙে তার। অয়ন ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই অপাশ হতে অয়ন চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ তুই কি মাহিরকে তোর বাসায় যেতে বলেছিস?আজ দেখলাম আংকেল আন্টির বাসা হতে বের হচ্ছে মাহির! ‘

অহর্নিশ লাফ দিয়ে উঠে বসে বিস্মিত হয়ে বলল,

‘ স্ট্রেঞ্জ! আমি কেনো যেতে বলব মাহিরকে আমার বাসায়? তাও যেখানে আয়ন্তিকা আছে। ‘

‘ তাহলে মাহির গেলো কেনো দোস্ত? নিশ্চয়ই কোনো তালগোল পাকিয়েছে। ওর হাবভাব সুবিধার ছিলো না। ‘

‘ আচ্ছা রাখ আমি মা কে ফোন করে দেখছি। ‘

‘ ডান! আপডেট দিস। ‘

অহর্নিশ কল কাটতেই দেখে অহনার ১৪ টা কল এসেছে। অহর্নিশের মনে ভীতি জন্মালো। শুষ্ক ঢোক গিলে সে অহনার নাম্বারে ফোন দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হয়ে যায় ফোন। ওপাশ হতে অহনা ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,

‘ অহর্নিশ তুই জলদি বাসায় আয়! আয়ন্তিকা..’

টুট টুট টুট! কল হুট করে কেটে যাওয়াতে অহর্নিশ আরেকদফা চমকে যায়। হাজারো চিন্তা এসে ভর করে নিউরনে। অহনা কাঁদছিলো কেন?আয়ন্তিকার ব্যাপারেই বা কি বলতে নিয়েছিলো সে?

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)