অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব-২৫+২৬

0
570

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২৫

উসমানের সামনে স্তব্ধ রূপে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তিকা। যেখানে প্রায় ২ বছর যাবৎ আয়ন্তিকা শুনে এসেছে তার উসমান মৃত্য, আজ সেই লোকটাকেই নিজের সামনে জীবিত অবস্থায় দেখে সে নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে। বারংবার নিভৃতে সৃষ্টি হচ্ছে একটাই প্রশ্ন, ‘ তারা নানা মৃত্য হলে তার সামনে সুস্থ – স্বাভাবিক রূপে দাঁড়িয়ে আছে কি করে?’

অহর্নিশ কিছু দূর হতে পর্যবেক্ষণ করে আয়ন্তিকার বর্তমান অবস্থা। সে বুঝতে পারলো আয়ন্তিকার বর্তমান নিভৃতের ভয়ংকর প্রলয়কারী প্রশ্নবিদ্ধ গহীনকে। অয়নকে বলে নিয়ে সে সামনে এগিয়ে যায়। আয়ন্তিকার পাশে দাঁড়িয়ে খানিক নিচু হয়ে আয়ন্তিকার কানে ফিসফিস করে বলল,

‘ রিলেক্স আয়ন্তিকা! মাথায় প্রেশাড দিও না বেশি। নানা বেঁচে আছেন। তাকে এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। স্পষ্ট ভাষায় যাকে ‘কিডন্যাপ ‘ বলে। ‘

আয়ন্তিকা বিষ্ফোরিত চাহনি দিয়ে অহর্নিশের দিকে দৃষ্টি দেয়। আঁখিপল্লবের ভাষায় সে আকুতি সুরে অহর্নিশ কে সবকিছু খুলে বলার জন্য অনুরোধ করে। কন্ঠনালি দিয়ে তার কিছু বলার মতো শক্তি, সামর্থ্য নেই। কেমন থরথর করে কাঁপুনি দিচ্ছে শরীর। কন্ঠনালি যেনো জমে বরফ! অহর্নিশ তাকে চোখের ভাষায় আশ্বস্ত করে বলল শান্ত হতে। সে একে একে সব বলবে।

খানিক বাদে জমিদার বাড়ির অন্দরমহল হতে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয় নাহিয় আহমেদকে। মহিলা পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে টেনে টেনে নিয়ে আসছে। তারই পিছন আসছে আয়না। চিন্তায় তার চোখমুখে ঘাম জমেছে। চেঁচিয়ে সে বলল,

‘ এই, এই! আপনারা আম্মারে এইভাবে টেনে নিয়ে যাইতেছেন ক্যান?জানেন উনি কে?জমিদার বাড়ির কর্তী উনি! ছাড়েন আম্মারে। ‘

আয়নার কথাগুলো যেনো কানেই গেলো না মহিলা পুলিশ দু’জনের। নিজেদের ওপর আরোপ করা কাজ অনুসারে তারা নাহিয়া আহমেদ কে টেনে এনে জমিদার বাড়ির ঠিক মধ্যিখানে দাঁড় করায়। আয়ন্তিকা হতভম্ব! কি হচ্ছে এসব?অহর্নিশের দিকে চাহনি দিতেই অহর্নিশ তাকে বারংবার বলছে শান্ত হতে, অপেক্ষা করতে! কিন্তু এসব দেখে কি এগুলো পালন করা যায়?

আয়ন্তিকা মৌন রূপ ধরে রাখতে না পেরে সে এগিয়ে যায় অহর্নিশের সামনে। তেজি কন্ঠে বলল,

‘ কি করছেন এসব? পুলিশ ডেকে এনে নানুকে এভাবে হেনস্তা করছেন কেনো?কি সমস্যা আপনার?’

অহর্নিশ আয়ন্তিকার হাত ধরে হেঁচকা টানে তার নিজের পাশে এনে দাঁড় করায়। চোখ গরম করে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ একদম চুপ থাকবা। একদম!’

আয়ন্তিকা ফের চেষ্টা করে মৌনতা পালন করতে। কারণ এখনকার অহর্নিশ কে দেখতে তার বড্ড ভয় লাগছে। কেমন হিংস্র চাহনি! উদভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো তার দিকে।

অহর্নিশের আদেশ অনুসারে জমিদার বাড়িতে অলরেডি গ্রামের সবাই উপস্থিত হয়ে গেছে। সবাই কানাঘুসা করছে। কেও কেও তো ট্যারা চোখে নাহিয়া আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করছেন। পুরো ঘটনায় নাহিয়া একদম চুপ! উসমান গভীর দৃষ্টিতে তাই দেখছিলেন। নিজের করা কৃতকর্মে উসমানের ইচ্ছে হয় নাহিয়ার পা ধরে মাফ চেতে। আবার নাহিয়ার করা কৃতকর্ম মনে উঠলে তার রাগ তরতর করে বেড়ে যায়!

অহর্নিশ উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উঁচু কন্ঠে বলল,

‘ সবাই একটু আমার দিকে তাকান! আজ আপনাদের অতি একজন সম্মানিত ব্যাক্তি নাহিয়া আহমেদ এর করা কু – কর্মের বর্ণনা দিবো। সবাই একটু শুনবেন! ‘

অহর্নিশ বলা শুরু করে। নাহিয়ার করা সব কু-কর্ম একে একে বলতে থাকে। উসমানকে এতবছর আঁটকে রাখা সম্পত্তির জন্য। ছলে চাতুরে তার সাথে আয়ন্তিকার বিয়ে দেয়া বাচ্চার জন্য উইল অনুসারে। উজমার মৃত্যু কাহিনি। প্লেনের আরেক হোতা তার ছোট ভাই নুহিদ। আর্নিয়াকে ফাঁসানো! আর্নিয়ার এই প্লেনে সার্পোট করা। সবকিছু বলে ক্ষ্যান্ত হয় অহর্নিশ। কানাঘুষা করা সবাই এখন নির্বাক ভূমিকা পালন করছে। কারো মাথায় এতো প্যাচ থাকতে পারে এটা তাদের জানা ছিলোনা বোধহয়।

শাফিকেও হাতকড়া পড়িয়ে একপাশে দাঁড় করে রাখানো হয়েছে। উজমা দাঁড়িয়ে আয়ন্তিকার পাশে। শাফি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উজমার দিকে! উজমা উপেক্ষা করে সেই দৃষ্টি। উজমা আগে থেকেই চাতুরতার সাথে অহর্নিশের সাথে যোগাযোগ করে তার অবস্থান সম্পর্কে বলেছে। অহর্নিশ তাকে খুঁজে বের করেছিলো। অতঃপর তারা ফাঁদ ফেলে শাফির জন্য! উজমা তারই জন্য ঘনিষ্ঠ হতে চায় শাফির সাথে। শাফি তার প্রতি গলে পানি হওয়ার পর উজমা চুপিসারে অহর্নিশ কে সব খবরা – খবর দিতো। শাফি জানতো উসমান কে কোথায় আঁটকে রাখা হয়েছে।

.

পরিশেষে পুলিশ নুহিদ, নাহিয়া এবং শাফিকে নিয়ে যায়। অহর্নিশ এসে দাঁড়ায় আয়ন্তিকার পাশে। তার দৃষ্টি আয়ন্তিকার ফ্যাকাশে মুখশ্রীর প্রতি! কেমন মনমরা হয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তি! সবাইকে বলে অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে টেনে রুমে নিয়ে আসে। সে আয়ন্তিকার কোমল গালে তার বলিষ্ঠ হাত স্থাপন করে নম্র সুরে বলল,

‘ আয়ন্তি? এমন মনমরা হয়ে আছো কেনো? দাদির করা কৃতকর্মে কি তুমি খুব বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছো?’

আয়ন্তিকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে বলল,

‘ মানুষ এতো খারাপ হয় কেনো?লোভের বসে তিনি এমনটা করতে পারলেন কি করে?ছোট থেকে তাকে কতো সম্মান করতাম। কতটা ভালোবাসতাম আমি! নানুও তো আমায় আদর করতো, কিন্তু.. ‘

আয়ন্তিকা কেঁদে দেয় নিভৃতে। অহর্নিশ লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

‘ লোভ মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয়! পশুতে তৈরি করে। এমনটা দাদির ক্ষেত্রেও হয়েছে। লোভে পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া এখানে দাদার ও দোষ আছে। তিনি যদি দাদির প্রতি এতোটা অত্যাচার না করতো হয়তোবা এ দিন দেখতে হতো না আমাদের। ‘

আয়ন্তিকা নতজানু হয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। অহর্নিশ কাছে টেনে নেয় তাকে! নিজ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে থুতনি রাখে আয়ন্তিকার মাথার ওপর। পিঠে হাত রেখে চেষ্টা করে আয়ন্তিকার কান্না থামানোর। তবে সে বুঝি এবারও ব্যার্থ! আয়ন্তিকা অহর্নিশের বুকের কাছটার শার্ট আঁকড়ে নিয়ে নিভৃতে, বিনাশব্দে অশ্রুপাত করে।

_____________________________

রাতের দিকটায় নানার সাথে কথা বলে এসে আয়ন্তিকা রুমে আসে। রুমটা অন্ধকার! তবে পূর্ণিমা হওয়াতে পুরোপুরি আঁধার ছেয়ে যেতে পারেনি রুমটায়। রুম অন্ধকার দেখে ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয় সে।অহর্নিশ কি রুমে নেই?এতো রাতে এই মানব কোথায় গেলো?

আয়ন্তিকা চাপা সুরে বলল,

‘ অহর্নিশ? আপনি কি রুমে নেই? ‘

সঙ্গে সঙ্গে বেলকনি হতে ভরাট কন্ঠে অহর্নিশ বলল,

‘ বেলকনিতে আমি আয়ন্তিক! দরজা লাগিয়ে এখানে আসো। লাইট অন করবে না। ‘

আয়ন্তিকা অহর্নিশের বলা মতোন সব কাজ সম্পূর্ণ করে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় স্পষ্টরূপে সে দেখতে পেলো অহর্নিশ কে। তবে একটা ব্যাপার তাকে মূর্হতে ভারী লজ্জায় ফেললো। অহর্নিশ শার্টলেস! মাথা উঁচু করে রেলিং এ হাত রেখে সে আকাশের চাঁদটার মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। অহর্নিশ কে আজও আয়ন্তিকা লজ্জা পায় শার্টলেস দেখলে! অথচ গুনে গুনে তাদের সংসার জীবনের বয়স ১ বছর পার করে ফেলেছে।

‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো? কাছে আসো! ‘

আয়ন্তিকা খানিকটা অবাক হয় এগোয়। না তাকিয়ে অহর্নিশ বুঝলো কিভাবে সে দাঁড়িয়ে?তাও তার হতে দূরে?
আয়ন্তিকা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি বুঝলেন কি করে আমি আপনার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে?’

অহর্নিশ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আয়ন্তিকার পানে দৃষ্টি দেয়। আসক্তময়ী দৃষ্টি! চোখদুটো চাঁদের পূর্ণ আলোয় কেমন নেশাটে আভাসে পরিণত হয়েছে। আয়ন্তিকা কেঁপে উঠলো খানিকটা!

‘ এটা খুবই সিম্পল! তুমি আমায় শার্টলেস দেখে নিশ্চিত নিলজ্জদের মতো দরজায় দাঁড়িয়েই হা করে তাকিয়ে ছিলে। ‘

অহর্নিশের কথা শ্রবণ করা মাত্র আয়ন্তিকা রেগে গিয়ে চেচিয়ে বলল,

‘ এই আপনি কি সবাইকে নিজের মতো নিলজ্জ ব্যাক্তি মনে করেন হ্যা? আপনি নিলজ্জ! আমি নই! যথেষ্ট লজ্জা আছে আমার মাঝে। ‘

‘ হ্যা! এতোই লজ্জা আছে যে আমি শার্ট খুললেই তোমার গালদুটো আপেলের মতো লাল হয়ে যায়। নিজের লজ্জা সামলাও। দেখা যাবে কোনো একদিন তোমার গালকে আপেল মনে করে কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলেছি। তখন কিন্তু আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না। ‘

আয়ন্তিকা বিড়বিড় করে বলল, ‘ অসভ্য লোক! ‘

আয়ন্তিকা বিড়বিড় করে বললেও কথাটা ঠিকই অহর্নিশের কানে এসে পৌঁছে যায়। সে হাসে নিঃশব্দে। পরিশেষে শীতল কন্ঠে বলে,

‘ এই ‘ অসভ্য ‘ বলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না? বোরিং হয়ে গিয়েছি আমি এটা শুনতে শুনতে। কয়েকটা গালিও তো দিতে পারো নাকি?তোমার গালিগুলো খুব সুইট হয়! ইউনিক টাইপ। ‘ পাতিলের বাচ্চা ‘ হাউ সুইট গালি! না জাননন..?’

আয়ন্তিকা চোখ গরম করে বলল, ‘ চুপ থাকুন!’

অহর্নিশ চুপ হয়ে যায়। তবে সে এখনো মিটিমিটি হাসছে আয়ন্তিকা থতমত খাওয়া চেহারা দেখে। আয়ন্তিকা সামনে এগিয়ে দু’হাত রেলিং রেখে কিছু ভর তার ওপর ছেড়ে দেয়। তপ্তশ্বাস ফেলে আশপাশ দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তার চক্ষুযুগল! রাতের পরিবেশটা অজান্তেই তার মনের বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে।

ক্ষনিক বাদে আয়ন্তিকা অনুভব করে তার ঘাড়ে তপ্তশ্বাস। কিছুটা ধারলো পূর্ণ কিছু তার কাঁধে স্থাপন হয় ক্ষনমাত্র। নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিয়ে আয়ন্তি অনুভব করে অহর্নিশের অস্তিত্ব! সে তার কাঁধে থুতনি রেখেছে যার দরুণ অহর্নিশের গালে বহমান চাপ দাঁড়িয় সুচালো খোঁচা আয়ন্তিকা অনুভব করছে এ মূর্হতে! অহর্নিশ তার দুহাত রেলিং এর মাঝে আবদ্ধ থাকা আয়ন্তিকার দুহাতের ওপর সন্তপর্ণে রেখে নিবিড় হয় আয়ন্তিকার সাথে। ফিসফিস করে কানের কাছে সে বলল,

‘ বেঁচে থেকে অসম্ভবনীয় কিছু দেখতে পারলাম। একই সাথে দু’টি চাঁদ! তবে আমায় ভূমিতে অবস্থানকৃত চাঁদটা বেশি আকৃষ্ট করছে! খুব বেশি! ‘

আয়ন্তিকা অহর্নিশের মন্তব্যটি বুঝে যায় তৎক্ষনাৎ। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নুইয়ে পড়ে।কিন্তু অনুভূতিটা ফিল করতে দেয়না তার নিভৃতে গড়া কিছু প্রশ্ন! শেষে আয়ন্তিকা চুপ থাকতে না পেরে চটপট কন্ঠে বলল,

‘ আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। ‘

অহর্নিশ এই মূর্হতে আয়ন্তিকার হতে এমন কথা আশা করেনি তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘ কি বলবা বলো। ‘

আয়ন্তিকা শুকনো ঢোক গিলে নম্র কন্ঠে বলল,

‘ শুরুর দিকটায় আপনি আমায় বিয়ে করেছিলেন কারণ শুধুমাত্র নানার জন্য। তখন তো এসবের কিছু সম্পর্কেই আপনি অবগত ছিলেন না। নানাকে উদ্ধার করতে আমায় আপনার বিয়ে করা। তবে নানা তো এখন উদ্ধার হয়েছে। আপনি কি তবে আমায় এখন ডির্ভোস দিয়ে দিবেন অহর্নিশ?’

চলবে…

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২৬

আয়ন্তিকার করা প্রশ্নে অহর্নিশ পুরোপুরি শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে আয়ন্তিকার পিছন হতে সরে দাঁড়িয়ে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে। মুখশ্রীতে স্বাভাবিকতা বজায় আছে। দু’হাত দিয়ে অহর্নিশ নিজের চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে নেয়। সকল কিছু দেখার পরে আয়ন্তিকা শুষ্ক ঢোক গিলে। তার মনে হয়েছিলো প্রশ্নটা অহর্নিশ শোনার পরপরই তাকে তিন, চারটা থাপ্পড় লাগাবে! এবং সেই থাপ্পড়ে হয়তো তার চার পাঁচটা দাঁত ও পড়ে যেতো। তবে আয়ন্তিকার চিন্তার কিছুই না ঘটাতে সে পড়েছে বিপাকে! ব্যাকুলতা নিয়ে চেয়ে আছে সামনে। অহর্নিশ পরবর্তীতে আসলে কি করতে চাচ্ছে? তা বোঝার প্রয়াস চালায়।

অহর্নিশ মাথা উঁচু করে নেয় খানিক বাদে। লম্বা শ্বাস ফেলে নম্র কন্ঠে বলল,

‘ হটাৎ এই প্রশ্ন তোমার মনে জন্ম নিলো কেনো আয়ন্তিকা? তোমাকে কেও কি কিছু বলেছে?’

আয়ন্তিকা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,

‘ না! না! কে কি বলবে?’

‘ তাহলে সবকিছু ফেলে এই ডির্ভোসের কথাই তোমার মাথাতে কেনো আসলে একটু আমায় বর্ণণা করে বলো তো। ‘

আয়ন্তিকা নতজানু হয়! আঙুল নাড়াচাড়া করে নিজের অস্বস্তিটাকে নির্মূল করার চেষ্টা করে অহর্নিশের দৃষ্টি হতে! পরিশেষে দম নিয়ে বলল,

‘ আপনি অনেক স্মার্ট, দেখতে ভালো, উচ্চ সমাজের মাঝে আপনার যাতায়াত। সেখানে আমি উচ্চ পরিবারে যতই জন্ম গ্রহণ করিনা কেনো, হাই ক্লাস ফ্যামিলিদের মতে আমি ক্ষ্যাত! নরমালি চলাফেরা করি। ফোনও ঠিক মতে ইউজ করতে পারিনা। সবার সাথে মিশতে পারিনা। বয়স কম! এমন ওয়াইফ কে চায়? আপনার কাজ তো শেষ! আমাকে বিয়ে করার মূল কারণ, মূল সমস্যাটা মিটে গিয়েছে। তাই বলছিলাম ডির্ভোসের কথা। আমায় ডির্ভোস দিলে আপনি আপনার লেভেলের কাওকে বিয়ে করতে পারবেন। ‘

একনাগাড়ে বলল আয়ন্তিকা। শ্বাস টেনে নিয়ে পরিস্থিতি বোঝার জন্য সে মাথা উঁচু করতেই আঁতকে উঠলো যেনো! অহর্নিশ চোখদুটো বড়সড় করে রক্তিম বর্ণে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে যে নিজের রাগ দমন করার প্রয়াস চালাচ্ছে অহর্নিশ তা আয়ন্তিকা ক্ষনেই বুঝে যায়। ভয়ে শুষ্কতা প্রাপ্য গলদেশ ফের সিক্ত করার উদ্দেশ্যে ঢোক গিলে আয়ন্তি।তবে তেমন কোনো লাভ হলোনা।

অহর্নিশ হাত মুঠো করে বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে এসে ঠিক আয়ন্তিকার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে। ডান হাতের এক আঙুল উঁচু করে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,

‘ ফারদার যদি এসব কথা শুনি আমি তোমার মুখ থেকে আয়ন্তিকা…! ট্রাস্ট মি! তোমায় যে কি করবো ভাবতেও পারবে না। কার সাথে তুলনা করছো নিজেকে?হাহ্? পৃথিবীতে অনন্যতম সুন্দর বস্তু হচ্ছে চাঁদ! চাঁদকে কখনো মাটির সাথে তুলনা করতে নেই। প্রকৃতি সইবে না তবে! আই ওয়ার্ন ইউ, এসব কথা যদি চিন্তাও করো তোমায় আমি তুলে আছাড় দিবো। এটা কিন্তু আমার ক্ষেত্রে অসম্ভব কিছু না ইউ নো না?’

অহর্নিশ ফের গিয়ে বসে পড়লো বেতের চেয়ারে। দুই আঙুল দিয়ে ললাটে চেপে ধরে নিজেকে সংযত করার প্রয়াস করে। আয়ন্তিকা ফ্যাচফ্যাচ করে মিইয়ে সুরে কেঁদে দেয়। তার কান্না পাচ্ছে!অকারণেই! ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো আয়ন্তিকার নিকট তবে তার এই মূর্হতে কান্না করলে প্রশান্তি মিলবে বলে সে কান্না থামালো না। বরং সময়ের তালে কান্নার বেগ হুরহুর করে বাড়তে লাগলো। অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দেখলো আয়ন্তিকার কান্না! মূর্হতেই চোখমুখ কুঁচকে নেয় সে বিরক্তিতে। এই মেয়ে এতো কাঁদে কেনো?

অহর্নিশ বিদ্রুপ করে বলল,

‘ এই মেয়ে থামো থামো! আগে আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আসো যাও। কফি খেতে খেতে তোমার কান্না দেখবো! এভাবে খালি হাতে পানসা মুখে তোমার কান্না দেখার আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেষ্ট নেই, বুঝলে? ছিচকাদুনি একটা! বিরক্তিকর! ‘

আয়ন্তিকা কান্না থামিয়ে দেয়। পদচারণ শুরু করে বন্ধ করে ঠিক অহর্নিশের সম্মুখে! তেতে উঠে বলল,

‘ এই আপনি আমাকে কি মনে করেন হ্যা?সর্বদা আমার পিছে পড়ে থাকেন। আমার কান্না আপনাকে দেখতে বলেছে কে?যান! এখনি চলে যান! রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন। আমি কাঁদবো মানে কাদবোই!’

‘ ওকে কান্না করো। নিজের পেত্নী রূপটাকে যদি এতই শো অফ করানোর ইচ্ছে করে তাহলে আমি বলছি কি তুমি তোমার কান্না করার একটা ভিডিও আমায় দাও। আমি ফেসবুকে আপ দিয়ে দিবো।সবাই দেখবে! তোমার কান্নাও করা হবে। শো অফ ও হয়ে যাবে। আইডিয়াটা ভালো লাগলে বলিও। ‘

অহর্নিশ নিজের কথা সম্পূর্ণ করে দ্রুত রুমে চলে যায়। ওখানে থাকা মানেই বিপদ। দেখা যেতে পারে আয়ন্তিকা এখন রেগে তাকে দুই চারটা থাপ্পড় দিয়ে বসলো। শেষে কিনা এমপি বউয়ের হাতে চড় খাবে? ছিঃ! ছিঃ! কি বিশ্রী ব্যাপার!
রুমে এসে অন্ধকারে হাতিয়ে নিজের টিশার্ট খুঁজে পড়ে নেয় অহর্নিশ। বিছানায় গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে। ঘুমানো দরকার! আজ প্রচুর ধকল গিয়েছে। কিন্তু আয়ন্তিকা কে ছাড়া কি তার ঘুম আসবে?উঁহু! তবুও অহর্নিশ ঘুমানোর প্রয়াস চালায়। কারণ আয়ন্তিকা এখন রুমে আসবে না তা নিশ্চিত সে।

তবে খানিক বাদেই অহর্নিশের চিন্তাধারাকে মিথ্যাতে রূপান্তর করে আয়ন্তিকা রুমে আসে। রুমে আসার পর সে সরাসরি বিছানায় অহর্নিশ পাশ ঘেঁসে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো! অহর্নিশ কিছুক্ষণ চমকে তাকিয়ে এক সময় আয়ন্তিকা কে নিজ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। আয়ন্তিকা এতে বিশেষ বাঁধা প্রদান করেনা।

__________________________

আজ ঢাকা ফিরে যাওয়ার দিন আয়ন্তিকা এবং অহর্নিশের। যার ফলে সকাল হতেই মন খারাপ আয়ন্তিকার। অহর্নিশ তা দেখে চেষ্টা করেছিলো আর কিছুদিন থাকা যায় কিনা গ্রামে, কিন্তু তা বিফলে গিয়েছে। ঢাকায় তার প্রচুর কাজ জমে আছে। তাছাড়া আয়ন্তিকা কে কলেজেও ভর্তি করাতে হবে।

ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে অহর্নিশ পিছন ফিরে বলল,

‘ জলদি আসো আয়ন্তিকা। সময় নেই আমার। আজ তথ্যমন্ত্রীর সাথে মিটিং আছে। জলদি বের হও! ‘

আয়ন্তিকা গুটিগুটি পায়ে পদচারণ শুরু করে। বাড়ির বাহিরে এসে তারা থামে! গাড়িতে ড্রাইভার ব্যাগপত্র রাখার পর অহর্নিশ আয়ন্তিকার দিকে দৃষ্টি দেয়। আয়ন্তিকা মায়ের গলা জরীয়ে কান্না করছে। ইশ! এই মেয়েটা এতো কাঁদে কেনো?ভেবে পায়না অহর্নিশ। কথায় কথায় শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না! চোখের ভিতর কি সমুদ্র সেট করা আছে?হয়তো। নাহলে এতো পানি আসে কোথা থেকে?অহর্নিশের বেকুব, অযৌক্তিক চিন্তাধারা! এতে সে লজ্জিত বোধ করে নুইয়ে যায়। আয়ন্তিকার সাথে থেকে থেকে সে দিনদিন কেমন উদ্ভট চিন্তা করা শুরু করেছে। ছিহ্!

আয়না আয়ন্তিকার একহাত ধরে এগিয়ে এসে বলল,

‘ আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো অহর্নিশ। ও এখনো অবুঝ! ভুল হতেই পারে। ওর সাথে কখনল উঁচু কন্ঠে কথা বলো না। ‘

অহর্নিশ মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ জি ফুপি! ‘

আয়ন্তিকা গাড়িতে বসতেই অহর্নিশ ড্রাইভার কে নির্দেশ দেয় গাড়ি স্টার্ট দিতে। যতক্ষণ অব্দি মা, তারাকে দেখা যায় আয়ন্তিকা ততক্ষণ অব্দি তাকিয়ে থাকে বাহিরে জানালা দিয়ে। পরিশেষে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে সে!

‘ মন খারাপ করো না। আমরা আবারো আসবো ইনশাআল্লাহ! ‘

চট করে ডানে তাকায় আয়ন্তিকা। অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু স্নান হাসে সে। উত্তর দেয় না! অহর্নিশ টুপ করে আয়ন্তিকার কোমল হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে সে আয়ন্তিকার কোমল হাতটা নিজের বুকের বাম পাশটাতে চেপে ধরে। আয়ন্তিকা ততক্ষণে ঘুমে বিভোর। তাই সে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো না। জেগে থাকলে নিশ্চিত লজ্জায় কুকরে যেতো।

__________________________

কলেজে ওঠার পর আয়ন্তিকার ব্যাস্ততা যেনো হুড়মুড়িয়ে বেড়ে গিয়েছে। সাইন্স নিয়ে পড়তে গিয়ে বেহাল দশা তার। আফসোস হচ্ছে কেনো সে সাইন্স নিলো? পড়ালেখায় এমনিতেই সে ফাঁকিবাজ টাইপের স্টুডেন্ট।

কলেজ থেকে বাসায় এসে ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার বইটা নিয়ে বসেছিলো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না দেখে শেষে বিরক্ত হয়ে বইটা ঠাস করে টেবিলে ফেলে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। দুপুরের টাইমে অহর্নিশ সাধারণত আসে না বাসায়। বাহিরেই খেয়ে নেয়। যার দরুণ আয়ন্তিকা কে রাত অব্দি একা একা কাটাতে হয়। আশপাশ দেখায় মত্ত যখন সে তখন কিছু ‘ ধপ ‘ করে পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে চট করে পিছন ফিরে আয়ন্তিকা। অহর্নিশ কে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায় সে। বেলকনি থেকে এক প্রকার ছুটে রুমে আসে। অহর্নিশের নেত্রপল্লব বদ্ধ! আয়ন্তিকা কৌতূহল নিয়ে বলল,

‘ আপনিই..?’

আড়মোড়া ভেঙে অহর্নিশ উঠে বসে আয়ন্তির কন্ঠ শুনে। ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বলে,

‘ হু আমি! এতো অবাক হওয়ার কি আছে?’

‘ না মানে.., আপনি তো কখনো দুপুরের দিকে আসেন না। তাই আরকি! আজ এলেন যে?’

‘ ভাবলাম বাচ্চা বউ একা একা বাসায় কান্নাকাটি করছে তাই আমিও গিয়ে একটু সার্পোট দেই। তাই চলে আসলাম। ‘

কথা শেষে অহর্নিশ তার বাম চোখ টিপ দেয় আয়ন্তিকার পানে দৃষ্টি দিয়ে। আয়ন্তিকা গাল ফুলিয়ে চুপ করে থাকে। লোকটা সবসময় তাকে রাগানোর উছিলার কেনো থাকে? বিরক্তিকর! আয়ন্তিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,

‘ আপনি কি দুপুরে খেয়ে এসেছেন নাকি খাবেন?’

‘ খাবো! খেয়ে আসিনি তাড়াহুড়ো করে আসাতে। তুমি দুপুরে খেয়েছো?’

‘ না! ‘

অহর্নিশ আয়ন্তিকা করা প্রতুত্তরে রেগে যায় খানিকটা। কন্ঠে রাগী স্বর টেনে এনে সে বলল,

‘ বাসায় একা থাকো তুমি। আমার তোমাকে টাইম দেয়া হয়না। তার ওপর যদি খাওয়া দাওয়া নিয়ে অনিয়ম করো তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়তে বেশিদিন লাগবে না। নিজের প্রতি এতো কেয়ারলেস কেনো তুমি?এটলিষ্ট নিজের ভালোটা তো নিজে বুঝো। আর যেনো আমি কখনো না শুনি তুমি টাইমের খাবার টাইমলি খাওনি! মনে থাকবে?’

হাস্যরত অবস্থাতে থেকে হুট করে অহর্নিশ কে রেগে যেতে দেখে চমকে যায়! পরবর্তীতে নতজানু হয়ে মিনমিন সুরে বলল,

‘ মনে থাকবে। ‘

তৎক্ষনাৎ রুম হতে বেড়িয়ে গিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেললো আয়ন্তিকা। চটজলদি যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করে অহর্নিশ কে খাওয়ার জন্য ডাক দিয়ে এনে সে অহর্নিশের ডান পাশে বসে পড়ে। প্লেটে হাত দেয়া মাত্রই অহর্নিশ আড়ষ্ট হয়ে বলল,

‘ নিজে খাওয়ার সাথে আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে বউ! ‘

আয়ন্তিকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রতুত্তরে বলল, ‘কেনো?’

‘ কেনো মানে কি? স্বামীর আদেশ পালন করতে হয় ষ্টুপিড! যা বলেছি তা করো। ‘

অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আয়ন্তিকা দমে যায় খানিকটা। সে কিছুটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী! অগত্য নিজ হাতেই খাইয়ে দেয়া শুরু করে সে অহর্নিশ কে। খাওয়ার পর্বের মধ্যিতেই কলিংবেলের শব্দ কর্ণপাত হতে অহর্নিশ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার অপর পাশে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে মূর্হতেই তার মুখ পাংশুটে আকার ধারণ করে।

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

[রি-চেইক করা হয়নি! ]