সুখের সন্ধানে পর্ব-২৮+২৯

0
368

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২৮
মিথিলার বুদ্ধি দারুণ কাজে দিয়েছে। পরের দিন সকাল বেলা মিথিলা আবার ফোন দিলো বিন্দুর নাম্বারে। কিন্তু বিন্দুর নাম্বার বন্ধ। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া গেল না। মিথিলা বুঝতে পারলো যে বুদ্ধিতে কাজ তবে হয়েছে। তারপরেও প্রিয়কে পুরোপুরি নিশ্চিত করতে সে প্রিয়কে বলল,

– চাইলে আমরা একবার ওর বাসায় যেতে পারি।

কিন্তু প্রিয় রাজি হলো না। মিথিলা ওকে বোঝালো যে স্থায়ীভাবে সমাধান পেতে হলে ওকে বেশ ভালো করেই ভয় দিতে হবে না হলে কাজ হবে না।

– তোমাদের কমন বন্ধুবান্ধব যারা আছে তাদের সবার কাছে ওর খোঁজ-খবর নাও। এমনভাবে খোঁজখবর নিতে হবে যাতে সবাই বুঝে যে তুমি সত্যিই ওর জন্য খুবই কন্সার্ন। কারণ তুমি যে ওকে এভাবে বাটি চালান দিয়ে খুঁজেছে এ কথা ওর কানে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ পৌঁছাবে। তুমি নিশ্চিত থাকো ও গায়েব হয়ে গিয়েছে একদম। বিন্দু মোটেই প্রেগনেন্ট না। সে চেয়েছে প্রেগনেন্সির নাটক করে তোমাকে ফাঁদে ফেলার। আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো একথা শুনেই সে ভয় পেয়েছে। কারণ ডাক্তারের কাছে গেলেই তো সব গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।

মিথিলার এত চমৎকার বুদ্ধিতে প্রিয় কুপোকাত। সে ভীষণ খুশি মিথিলার উপর। চোখমুখের সেই বিষন্নতার ছাপ মুহূর্তেই গায়েব। মিথিলার বুদ্ধি মতোই সে মিথিলাকেসহ বিন্দুর বাসাতে গেল। বিন্দুর বাসা ছয় তলাতে। মিথিলা গেটেই রইল। সে দারোয়ানের কাছে বিন্দুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কোথায় গেছে, কখন গেছে, কখন ফিরবে এসব টাইপের কথাবার্তা। এমন ভাবে কথাগুলো জিজ্ঞেস করছে যেন সে বিন্দুকে ফিরে পাওয়ার জন্য খুব ব্যাকুল। সে আসামাত্র যেন দারোয়ান তাকে জানায় এ জন্য দারোয়ানকে সে নিজের নাম্বারটাও দিয়ে আসল।
আশানুরূপ ফলাফল নিয়েই ফিরল প্রিয়। বিন্দু গতকাল রাতে একটা হ্যান্ডব্যাগে হালকা কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে কোথায় গেছে ওর রুমমেটরা কেউই জানে না। এখান থেকে যাওয়ার পর থেকেই তার সেলফোন বন্ধ। প্রিয় তাদের কাছে খুব কাকুতি-মিনতি করে বিন্দুর কোনো খোঁজখবর পেলেই তাকে যাতে সাথে সাথে জানায় সেই অনুরোধ করে আসলো।

খুব হাসি হাসি মুখ নিয়ে প্রিয় ড্রাইভ করছে আর পাশে মিথিলা বসা।

– তোর কি মনে হয় বিন্দু কি আর ফিরে আসবে?

– ফিরবে না কেন? ওমা! ফিরবে তো অবশ্যই।

– তাহলে আবার কষ্ট করে এত এত নাটক করলি কেন? তুই না বললি…!

– হা হা হা! ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, ভাইয়া? সে ফিরবে কোথায়? সে তো ঢাকাতেই আছে। আছে হয়তো তার কোন বন্ধুবান্ধবের বাসায় দু-এক দিনের জন্য। গা ঢাকা দিয়েছে আমাদের ভয়ে। অথবা নতুন কোন মুরগির খোঁজে নেমেছে। একটা তো হাতছাড়া হয়েছে নতুন আরেকটা ম্যানেজ করতে হবে না।

– মুরগী বলছিস কেন? বল মোরগের খোঁজে নেমেছে। আমাকে কোন অ্যাঙ্গেলে তোর মুরগি মনে হয়?

– তুমিতো মুরগিই। নইলে এই সামান্য একটা বিষয়ে তুমি যেসব কান্ড করেছ, মাই গড!

– তুই এটাকে সামান্য বলছিস? আমার জীবন মরণের প্রশ্ন! তুইতো বিন্দুকে সামনাসামনি দেখিস নি। ওর খপ্পরে পড়লে তুই বুঝতি কত ধানে কত চাল।

– আমি তো দেখতেই চেয়েছিলাম কত ধানে কত চাল। কিন্তু তার আগেই তো তোমার বিন্দু লেজ গুটিয়ে পালাল।

– এটা ঠিক বলেছিস। কীভাবে যে আমি ফেঁসে গেলাম ওর জালে? সেসব ভাবলে এখন নিজেই অবাক হই।
আসল কথা কি জানিস কাউকে সত্যি ভালোবাসলে মানুষ বোকা হয়ে যায়। আমিও হয়েছিলাম।
বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস ব্যাপারটা আব্বু আম্মুর কানে পৌঁছানোর আগেই সব সহী সামলাতে শেষ হয়েছে। সবই তোর কারিশমায়। তোর বুদ্ধির প্রশংসা যত করব ততই কম পড়বে। এবার বল, কী চাস আমার কাছে?

– হা হা হা! মজুরি দিবে?

– মজুরি বলছিস কেন? পুরস্কার দিতে চাচ্ছি!

– কিছুই লাগবে না। তুমি সুস্থ থাকো , ভালো থাকো এটুকুই চাই।

– সে তো আমি থাকবই। বেয়াদবটা আমার জীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছিল এই ক’দিন। এবার ভালো কিছুই হবে আশা করছি।

– আচ্ছা, ঠিক আছে । এবার এক কাজ করো আমাকে একটু মেহরাবের স্কুলে নামিয়ে দাও। স্কুলে একটু কাজ আছে। ওর টিচারের সাথে কথা ছিল।

– ক’টার দিকে যেতে হবে?

– টাইম ফিক্সড নেই। ছুটির আগে যেকোনো সময় গেলেই হবে।

– বাসায় যাবি কি করে ড্রাইভারকে আসতে বলেছিস?

– হ্যা, উনি স্কুলেই আছে। মেহরাবকে নিয়ে এসে আর যায়নি।

– আচ্ছা, এক কাজ করি তবে! লাঞ্চের পরেই তবে স্কুলে যাই।

– তুমিও যাবে নাকি ? অবাক হয়ে বলল , মিথিলা।

– হ্যা! গেলে কি অসুবিধা?

– না , না! অসুবিধা হবে কেন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তাই অবাক হলাম আর কি! কখনো যাওনি তো! তাছাড়া মেহরাবের সাথে তো তুমি তেমন কথাবার্তাও বলো না ।

– আসলে ও অনেক ছোটো তাই ওর সাথে কথাবার্তা হয় না। এছাড়া আর কিছুই না। চল, আজ ওকে চমকে দেই।

– ওর জন্য একটা গ্রেট সারপ্রাইজ হবে ,ভাইয়া। তুমি ওর সাথে একটু কথাবার্তা বললে ও খুব খুশি হবে। আচ্ছা, তুমি যে আমার সাথে যাবে তোমার অফিস নেই?

– নাহ, আপাতত যাচ্ছি না। চল ,আজ একসাথে কোথাও লাঞ্চ করি। তোর পছন্দমতো লাঞ্চ হবে আজ। লাঞ্চের পরেই স্কুলে যাব। পরে সেখান থেকে মেহরাবের ছুটির পর কোথাও মুক্ত বাতাসে ঘুরে আসব তিনজন মিলে।

– কী বলছ? এত সময় হবে তোমার?

– আজকের জন্য সব মাফ! সময় হয়ে যাবে। চল, দিয়াবাড়ি ঘুরে আসি। খানিককাল লেকে নৌকায় ভেসে বেড়াব একসাথে।

– তাই ! নৌকা আমার কী যে পছন্দ! থ্যাংক ইউ সো মাচ , ভাইয়া। মেহরাবও ভীষণ লাইক করে বোটিং!

– দ্যাটস গ্রেট। বহুদিন পর নিজেকে মুক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে বিশাল বড় বোঝা নেমে গেছে মাথার উপর থেকে।

– হুম, এটা ঠিক বলেছ। খুব ভালো একটা সময় পার করব তিনজনে।

– হুম।।

ঢাকায় ফিরেছি তিন দিন হলো। ধীরেধীরে সিলেটের ওই ব্যাপারটা মাথা থেকে নেমে যাচ্ছে। নিজেকে কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। যত তাড়াতাড়ি ঐ আসিফ চ্যাপ্টার ভুলে যাব তত তাড়াতাড়িই নিজেকে ভারমুক্ত মনে হবে। বাসায় ফিরে যা দেখে খুব ভালো লাগছে সেটা হলো প্রিয়র ব্যবহারে ব্যাপক চেঞ্জ। আগের মতো মিথিলা আর মেহরাবের সাথে মুখ গোমড়া করে থাকে না। বেশ ফ্রী ওদের সাথে। একসাথে বসে আড্ডা দেয় , গল্পগুজব করে।
ব্যাপারটা সেলিমের কাছে যে বেশি ভালো লাগছে না সেটাও আমি টের পাচ্ছি। কিন্তু এ নিয়ে আর কথা তুলতে ইচ্ছে হলো না। ওর যা ভাবার ভাবুক।

পরেরদিন সকালবেলা নিচে নামতেই দেখি সাজিদ বসে আছে ড্রয়িং রুমে। এত সকালে ওকে দেখে খানিকটা অবাক হলাম। সেলিম আজ বেশ ভোরে বেরিয়ে গেছে। ওর সাথে কাজ থাকলে সাজিদ অফিসে যেতে পারত। আমি সাজিদের কাছে যেয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পরে জানলাম কী একটা জরুরী কাজে নাকি প্রিয়র কাছে এসেছে। আমি প্রিয়কে খবর পাঠিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম। কিচেনে যেয়ে দেখি মিথিলা গুণগুণ করে গান গাইছে আর চা বানাচ্ছে। কিছুটা অবাক হলাম। কুলসুমই এই কাজ করে। মিথিলা কেন করছে?

– কী রে কুলসুম কোথায়? তুই কিচেনে?

– না… মানে …রূম্পা মা! কুলসুম খালা অন্য কাজে ব্যস্ত তাই আমিই গেস্টের জন্য নাস্তা রেডি করছি।

– কুলসুমের তো এসময়ে কিচেনেই ব্যস্ত থাকার কথা । সে আবার কোথায় কী কাজে ব্যস্ত?

– আরে বাদ দাও না!

– বাদ দাও না মানে! বাসায় গেস্ট এসেছে আর সে উধাও! তোর না ক্লাস আছে?

– আছে তবে একটু দেরীতে। দেরী করে বেরুব। তাই সমস্যা হবে না। তোমার কিছু কী লাগবে?

এরমধ্যে কুলসুম এসে কিচেনে ঢুকল।

– কী রে! কই মরেছিস? বাসায় গেস্ট এসেছে চোখে পড়ছে না?

– আম্মা, আমি তো নাস্তা বানাইতেই চাইছি কিন্তু আফায়ই আমারে না করল। কইল সেই বানাইবে। আমি আর কী করতাম? এইহানে আমার কী দোষ কন?

মিথিলার চোখে চোখ পড়তেই আমি বুঝতে পারলাম ও মনে হচ্ছে কিছু লুকাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম।

– ও বুঝেছি। আচ্ছা , যাহ! টেবিলে আমার নাস্তা দে। আম্মা খেয়েছে?

– হ, আম্মা । ম্যাডামে খাইছে। আফনে তো আজ দেরী কইরা উঠছেন।

– হুম, একটু দেরি হয়ে গেল। গতকাল কিছু ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই উঠতে দেরি হলো। আচ্ছা , আম্মা ওষুধ তো খেয়েছে তাই না!

– হ। ওষুধ খাইতে কী আর ভুল হয়? মিথিলা আফায় আছে না।

– হুম, ও আছে বলেই নিশ্চিন্তমনে থাকি।

মিথিলা নাস্তার ট্রে হাতে সাজিদের কাছে গেল। সাজিদ এক পলকে তাকিয়ে আছে মিথিলার দিকে।

শ্যামবরণের মিথিলাকে চোখের নিচে পুরু কাজল আর হালকা গোলাপি লিপগ্লসে আজ অসাধারণ লাগছে। সাজিদ কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে কী এক মায়া যেন তাকে গ্রাস করে নিয়ে যাচ্ছে। কলেজ লাইফে তার সুদর্শন চেহারায় লাট্টু হয়ে কত মেয়ে ঘুরঘুর করেছে সেও অনেকের সাথে ফ্লার্ট করেছে কিন্তু কারো মায়ায় সে ডুব দিয়ে থাকতে পারেনি বেশিক্ষণ। আজকাল কী যেন হয়েছে তার? নিজেই বুঝতে পারছে না। এই নিয়ে তিন বার দেখল সে মিথিলা কে। অথচ তার কাছে মনে হয় যুগ যুগ ধরে সে মিথিলার কত কাছাকাছি, কত চেনাজানা! কাল রাতে প্রিয়র সাথে কোম্পানী অডিটিং এর ব্যাপারে নানান কথা বলতে বলতে প্রিয় যখন তাকে বলল, মিথিলা তাকে বাসায় এসে এক কাপ চা খাবার দাওয়াত দিয়েছে তখন সে আর ভালো মন্দ , উত্তর পশ্চিম কিছু না ভেবেই রাজী হয়ে গেল । একবার ভেবেছিল আসবে না। কিন্তু কী এক চৌম্বকীয় শক্তি তাকে এখানে টেনে নিয়ে এল।

মিথিলা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো সাজিদের দিকে। কিন্তু সাজিদের কোনো হুশ নেই। সে অপলক তাকিয়েই আছে মিথিলার দিকে।

– মিথিলা খানিকটা অবাক হয়ে বলল, আরে! ভয় পাচ্ছেন নাকি? ভয় নেই আমি এবার আর কোনো লবন মেশাইনি। একদম সবকিছু ঠিকঠাক দিয়েছি। আপনার রিকোয়্যারমেন্টস মতোই দু’চামচ চিনি , দু’চামচ দুধ দিয়ে বানিয়েছি। সেদিন যে বলেছিলেন আমি মনে রেখেছি। এক ভুল কী আর দ্বিতীয়বার করি? এবার আর ভাইয়ার কাছে নালিশের করার কোনো চান্স রাখিনি।

– সাজিদ এবার সতর্ক হলো। সে করছে টা কী? এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো সে ধরা পড়ে যাবে। ছিঃ ছিঃ ! কেমন একটা ব্যাপার হবে তখন?
সে মিথিলার হাত থেকে চায়ের কাপ নিলো।

চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বাহ! আপনি তো সত্যিই অনেক ভালো চা বানান। প্রিয় তবে ঠিকই বলেছে। ধন্যবাদ এত চমৎকার চায়ের জন্য।

– আমি কেমন চা বানাই এটা ভাইয়ার তো জানার কথা না। এ বাড়িতে চা শুধু কুলসুম বুয়াই বানায়। ভাইয়া তো আমার বানানো চা কখনো টেস্টই করেনি। এখন তো মনে হচ্ছে আমাকে খুশি করার জন্য আপনি বাড়িয়ে বলছেন!

– আরে নাহ! বাড়িয়ে বলব কেন? প্রিয় সতিই বলেছে। তবে আমি কিন্তু নিজেকে লাকি মনে করছি। প্রিয় টেস্ট করতে না পারলেও আমি ঠিকই দু’ দু’বার আপনার হাতের চা টেস্ট করার সুযোগ পেলাম।

– হা হা। এটা ঠিক বলেছেন। তবে আপনার বন্ধু বেশ একটা মিথ্যে বলেছে। ভাইয়া দেখছি আজকাল বেশ বড়সড় মিথ্যে বলে!

– তাই নাকি! আজ যে আপনি আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন এটাও কি তবে মিথ্যে ?

মিথিলা খানিকটা ঘাবড়ে যেয়ে বলল, না …না! মিথ্যে হতে যাবে কেন? সেদিন যে নুন চা খেয়ে গেলেন তার ভরপাই করতে হবে না। আমিই ভাইয়াকে বলেছিলাম সেদিন। বিশ্বাস করুন সেদিন আমি বুঝতেই পারিনি ওটা লবণের পট ছিল। আমি াপনি যাবার পরে ভুল করে নিজের জন্যও বানিয়ে ফেলেছিলাম। পরে চা মুখে দিতেই বুঝলাম ওটা লবণ ছিল। আচ্ছা, আপনি কেমন মানুষ বলুন তো! আমি না হয় তড়িঘড়ি করে করে ভুল করে ফেলেছি তাই বলে আপনিও আমাকে বলবেন না?

– না মানে! আমার কাছে ততটা খারাপ লাগেনি। ভালোই তো ছিল। নতুন টেস্টের সাথে পরিচিত হলাম। আপনি এত যত্ন করে বানিয়েছেন সেটাকে রেখে যাই কী করে বলুন! সবসময় স্বাদের দিকে খেয়াল করলে হয় বলুন! আপনি আমার জন্য কষ্ট করে বানিয়েছেন ! আমি যদি রেখে যেতাম তাতে আপনাকে অপমান করা হয় না, বলুন!

– মিথিলা এবার আর না হেসে পারল না। বেশ শব্দ করেই হাসল। হাসছে আর ভাবছে প্রিয় আবারও মিথ্যে কেন বলল? সে তো সাজিদিকে আজ আসার জন্য বলেনি। এমনকি সাজিদ প্রসঙ্গে কোনো কথাও হয়নি সেদিনের পর আর। কথা প্রসঙ্গে বাসায় আবার আসতে বলেছিল চায়ের দাওয়াতে তবে সেটা বেশ আগে। কিন্তু ব্যাপারটা প্রিয় যে সিরিয়াসভাবে নিয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি।

আমি ডাইনিং টেবিলে বসে আড়চোখে সবই খেয়াল করছিলাম। কিছু একটা আভাস ঠিকই টের পাচ্ছিলাম। সাজিদের চোখে আমি স্পষ্ট মিথিলার জন্য টান , অনুভূতি, ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। মিথিলাও দেখলাম ওর প্রতি বেশ সাবলীল। সাজিদকে ছেলেবেলা থাকে চিনি। খুবই ভালো ছেলে। ওর পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না জানলেও এটুকু বুঝি যে মোটামুটি এলিগ্যাণ্টই হবে। ওর মাকে দেখেছিলাম বেশ আগে। প্রিয়র থেকে আরেকটু খোঁজখবর নেয়ার তাগাদা অনুভব করলাম। আমি যেমনটা ভাবছি তেমনটা হলে মন্দ হবে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আগামীকালই যে কোনো অজুহাতে সাজিদদের বাড়িতে যাব। ওর আদ্যোপান্ত সব জেনে আসব।

দু’জনকে পাশাপাশি বেশ মানিয়েছে। মিথিলার গায়ের রঙ শ্যামলা আর সাজিদের দুধ সাদা। দারুণ কম্বিনেশান। পাশাপাশি যা লাগছে না! মাথার মধ্যে শুধু একটাই কথা ঘুরছে মেয়েটা তবে এবার পর হয়েই যাচ্ছে। তবে আমিও খুব সিলেক্টিভ এ ব্যাপারে। শুধু সাজিদিকে দেখেই আমি কোনো সিদ্ধান্তে যাব না! আমি পারিপার্শ্বিক সব দিক ভেবেচিন্তে তারপর এতিম মেয়েটাকে অন্য ঘরে পাঠাব। আমি চাই না আমার আর ওর মায়ের মত সারাজীবন সাফার করুক। সবদিক দেখেশুনে ওকে বিয়ে দিব।

মিনিট বিশেক পরে প্রিয় নিচে নামল। প্রিয় আসার পরে মিথিলা ওর রুমে চলে যায়। মিথিলার চলে যাওয়াটা খুব যে ভালো লাগেনি সাজিদের সে আমি দূর থেকেই ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম। কিছু যে চলছে সে আমি নিশ্চিত ।

রাতে প্রিয়র রুমে নক করলাম। প্রিয় সজাগই ছিল। আমি নানান কথার ছলে বারবার সাজিদকে তুলছি। আমি সরাসরি প্রিয়কে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম না। আমি চাইনি প্রিয় কিছু টের পাক। আগে আমি ইনভেস্টিগেশান করব তারপর সবাইকে জানাব। কিন্তু প্রিয় ঠিকই না বললেও আমার চালাকি ধরে ফেলল।

– কি ব্যাপার, আম্মু! তুমি কি সাজিদকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবছ?

– অন্য আবার কী ভাবব? তোমার যা কথা!

– হা হা হা! তুমি না বললেও তোমাকে কিছুটা তো বুঝি। আফটার অল আমি তোমার ছেলে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস না করে সোজা করে জিজ্ঞেস করো সাজিদকে জামাই করতে চাচ্ছ।

– কী যে বলছ! আচ্ছা, বুঝতেই যখন পেরেছ তবে বলি। হুম, ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন তু্মি তোমার মতামত দাও! কেমন হবে ব্যাপারটা?

– সাজিদ যে কেমন তা তো আমার মতো তুমিও জানো। নতুন করে কী বলব? হলে মনে হয় মন্দ হবে না।

– না মানে ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু কি জানো?

– ওর বাবা সচিব ছিলেন। মারা গেছেন দুই বছর আগে। একটা ছয়তলা বাড়ি আর নগদ পয়সাকড়ি ্মেই বি কিছু আছে। সাজিদরা দু ভাই এক বোন। ওই বড়। এরপরে বোন । বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে। আর একদম ছোটোটা এবার এইচ এস সি দিবে। এই তো ! আর ওর মা বেশ ধার্মিক মহিলা। আর কিছু জানতে চাও। অবশ্য চাইলেও লাভ নেই। আমার আর কিছু জানা নেই। এখন বলো হঠাৎ সাজিদকেই কেন টার্গেট করলে?

– আমার মনে হয় সাজিদ আর মিথিলা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে।

– তুমি শিওর?

– হুম! নাইনটি পার্সেন্ট। আমি চাই না আমার মতো একই ভুল আবার মিথিলাও করুক। তাই ভালো করে জেনেবুঝে আগাতে হবে।

– ঠিক বলেছ। দেখো , কি করবে!

– আচ্ছা। দেখি কী করা যায়। তুমি তবে ঘুমাও। গুড নাইট।

– গুড নাইট।

প্রিয় হঠাৎ যেন বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। সাজিদ যে মিথিলাকে পছন্দ করে এ কথা সে সেদিনই বুঝেছে। কিন্তু মিথিলার ব্যাপারটা ক্লিয়ার ছিল না। কাল যখন কথা প্রসঙ্গে সাজিদ মিথিলার কথা তুলেছিল তখন প্রিয় সাজিদকে মিথ্যে করে বলেছিল মিথিলা তাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে। সাজিদ যে এত তাড়াতাড়ি সেটা বিশ্বাস করে চলে আসবে সে ভাবেনি। কিন্তু সকালবেলা অফিসে যাওয়া বাদ দিয়ে তাদের বাসায় হাজির। সাজিদ এসেছে দেখে সে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে যে সাজিদ আসলেই মিথিলার প্রতি দুর্বল। মনে মনে খানিকটা হেসেছে সকালবেলা সাজিদ আসার খবর শুনেই।

সারাজীবন হাজার মেয়েদেরকে তার পেছনে ঘুরিয়ে এখন শেষমেষ এসে মিথিলার ঘাড়ে জুড়ল। কিন্তু মিথিলাও যে সাজিদকে পছন্দ করে এ কথা তার জানা ছিল না। তার মায়ের কাছে এ কথা শোনার পর থেকে সে খানিকটা অবাক হলো। তার আম্মুর সন্দেহ কখনো ভুল হয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। এবারও নিশ্চয়ই মিথ্যে প্রেডিকশান করেনি।

মিথিলা সাজিদকে পছন্দ করে এ কথা যতবারই সে ভাবছে ততবারই কেন যেন তার বুকের ভেতর চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠছে। কিন্তু কেন? এ কথা সে নিজেই জানে না। সারারাত আর ঘুম আসছে না তার। বিছানায় এ পাশ ওপাশ করছে। কেন এমন আজব অনুভূতি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।

চলবে…

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২৯

ওই মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদায় করো। আমি তোমার বৌমার সাথে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। কারণ আমি কথা বলতে গেলেই সে অন্য ভাবে নিবে।

– আচ্ছা, তুই এত চিন্তা করিস না। আমি রুম্পার সাথে কথা বলবো।

– মা, কথা একটু তাড়াতাড়ি বলো। কারণ বিয়ে নাম নিলেই হয়ে যায় না। ছেলে দেখা, মেয়ে দেখা। নানা ধরনের স্টেপ পার হয়েই বিয়েটা হবে। ততদিনে না দেরি হয়ে যায়? তাছাড়া ওর বাপ চাচাদের মতামতও জানতে হবে। যদিও এই আদিখ্যেতা না দেখালেও চলবে। জন্ম দিয়ে অন্যের ঘাড়ে বাচ্চাদের চাপিয়ে দিয়ে আরেক বউ নিয়ে আয়েশ করছে। ষ্টুপিড!

– যা করার খুব তাড়াতাড়ি হবে তুই একদম চিন্তা করিস না।

– এই ভয়টাই আমি শুরু থেকে পাচ্ছিলাম যে কারণে ওকে আমি এ বাড়িতে এলাও করতে চাইনি। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনলে তো!
পাশাপাশি একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে অনেকদিন ধরে থাকতে থাকতে এদের মধ্যে একটা ফিলিংস তৈরি হতেই পারে। যেটা স্বাভাবিকভাবে ওদের হয়েছে। এজন্য আমি ওদেরকে দায়ী বলব না, দায়ী আমরা।

– এটা ঠিক বলেছিস। এই কথাটা আমি মালিহাকেও বলেছি। মালিহা আজকে এসে বেশ কড়া করে আমাকে কয়েকটা কথা শোনালো।

– অবশ্য মন্দ করেনি। যদিও মালিহার এ ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই। কারণ আমার ছেলেকে আমি কোথায় বিয়ে দিব কোথায় না দিব এটা নিয়ে সে চর্চা করতে পারে না। সেইরকম চাচি হিসেবে সে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেনি। সে তো এক হিসাবে সজলকেও আমাদের পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলেছে। তার পরেও আমি বলব আমি মালিহার প্রতি কৃতজ্ঞ। মালিহাই তো ওদেরকে রেস্টুরেন্টে একসাথে খেতে দেখেছে। আবার নিজ গরজে ওদেরকে ফলো করে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। যদিও এটা সে মোটেই আমাদের ভালোর কথা চিন্তা করে করেনি। আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্যই করেছে। তারপরেও খবরটা জানানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিও আমার পক্ষ থেকে।

– মালিহাকে এত বছরে চিনতে তো আর ভুল করিনি। ব্যাপারটা আমিও বুঝেছি। ওর আসল মোটিভ হচ্ছে রুম্পাকে আমার চোখে ছোট করা। সে ইনিয়ে বিনিয়ে নানানভাবে যেটা বুঝিয়েছে তাতে বোঝা যায় মালিহা ওর দুই মেয়ে আর সজলকে নিয়ে আবার এই বাড়ীতে ফিরতে চায়। তুই যে ভুল করেছিলি মিডল ক্লাস ঘরের মেয়ে রুম্পাকে বিয়ে করে সেই একই ভুল যদি আবার তোর ছেলে করে তাহলে এ বাড়িতে আসার জন্য তার রাস্তা একটু ক্লিয়ার হয়ে গেল না! সে আসেই আমার কান ভরতে ।

– হতে পারে। আমি এসব মেয়েলি প্যাচপুচ বুঝি না। বুঝতে চাইও না। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো রুমপার সাথে কথা বলো। মিথিলার বিয়ে ঠিক করো।

– কিন্তু ততদিনে যদি দেরি হয়ে যায়? তুই কি একটু প্রিয়র সাথে কথা বলবি? নাকি প্রিয়র জন্যই মেয়ে খুঁজব?

– আমি কথা বলতে গেলে বেশি হয়ে যাবে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না আমি চাই না ওর সাথে কোন ধরনের সিনক্রিয়েট হোক! আর ওই
মেয়ের ভয়ে তড়িঘড়ি করে আমার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিতে চাই না।

– আচ্ছা। দেখি কী করা যায়! তুই আর ভাবিস না। ভয় পাস না একদম। আমি যেভাবেই হোক ব্যাপারটা দেখছি।

– ঠিক আছে, মা। যা করার করো। আমি কোন ধরনের দুঃসংবাদ শুনতে চাই না। যদি একান্তই কিছু করার মত রাস্তা না দেখো তাহলে মিথিলাকে ওর বাসায় পাঠিয়ে দাও। তবে আমার ডিসিশন ফাইনাল পনেরো দিন মানে পনেরো দিন। এর বেশি একদিনও যেন ওই মেয়েকে আমি এ বাসাতে না দেখি। উল্টাপাল্টা কিছু হলে এর দায় দায়িত্ব সব তোমার।

সেলিম রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পরে তার মা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। পনেরো দিনের মধ্যে বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট করা একটু কঠিনই হয়ে গেল। তাছাড়া এখন পর্যন্ত পাত্রের ঠিক নেই। তার উপর রুম্পা মিথিলাকে এই মুহূর্তে বিয়ে দিতে রাজি হবে কিনা এটাও একটা ব্যাপার। মিথিলাকে তার অপছন্দ নয়। খুবই লক্ষী মেয়ে। যে ঘরে যাবে আলো করে রাখবে কিন্তু মিথিলা তার ঘরের বউ হবার যোগ্য নয়। তার কোনো স্টাটাসের সাথেই তার নাতি প্রিয়র যায় না। তাই ছেলের মতো সেও চায় না মিথিলা এ বাড়ির বউ হোক।

সাজিদ আর মিথিলা একে অপরকে পছন্দ করে এই কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না, প্রিয়। কিন্তু কেন পারছে না এটাই সে বুঝতে পারছে না। এটা মেনে নিতে এত দ্বিধা কোথায় তার? সে নিজেই তো চেয়েছিল যে সাজিদ আর মিথিলার মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক। সাজিদ তার খুব ভালো বন্ধু! তার বিশ্বাস মিথিলাকে সে ভালো রাখবে। অথচ এখন তার মধ্যে কেমন যেন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে এদের সম্পর্কের কথা শুনে। সারাদিন অফিসে কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। কল্পনায় শুধু মিথিলা আর সাজিদের চেহারাই ভাসছে। কিছুক্ষণ আগে সাজিদ ফোন দিয়ে মিথিলার ফোন নাম্বারটা চেয়েছিল। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সে তাকে নাম্বার দেয়নি।

কিন্তু কেন? তবে কি সে মিথিলাকে সে? না, না। তা কি করে হয়! সেতো বিন্দুকে ভালোবেসেই পথের ফকির! তার কাছে আর কোন ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে কি? মিথিলাকে ওইভাবে সে কখনোই ভাবেনি। মিথিলাকে কখনোই নিজের লাইফের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কেউ বলে ভাবেনি সে। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুই ভাবতে পারছে না প্রিয়। আজ আবার সন্ধ্যার পরে তাদের বন্ধুদের একটা হ্যাংআউট প্রোগ্রাম আছে।

এতটা মন খারাপ তার যে মন চাচ্ছে না সেখানে যেতে আর। পরে আবার নানান ধরনের সাত-পাঁচ ভেবে যেতে রাজি হলো। হয়ত বন্ধুদের আড্ডাতে মনটা কিছুটা হলেও ফ্রেশ হবে।

কোনো রকম করে তড়িঘড়ি করে হাতের কাজ শেষ করে রাত আটটার দিকে বের হল প্রিয়। ক্যাফেতে পৌঁছাতে আধা ঘন্টার মত সময় লাগল।

দশ বারোজন বন্ধু মিলে এই হ্যাংআউট প্রোগ্রাম। প্রিয় পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি সবাই পৌঁছে গিয়েছে ততক্ষণে।

অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার পরে যে ধরনের উচছ্বাস কাজ করার কথা প্রিয়র মধ্যে সেটা করছে না। কেমন যেন সবকিছুতেই নিরামিষ ভাব। কোথাও কোনো নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছে না সে। এ ধরনের আচরণের জন্য সে বারবার তার অবচেতন মনকে দায়ী করছে। মিথিলা আর সাজিদের যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না সে। ব্যাপারটা তার বন্ধু অনিকেতের চোখ এড়ালো না।

অনিকেত নামকরা সাইকোলজিস্ট। বেশ কিছুদিন ধরে প্রিয়র সাথে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও এখানে দেখা হওয়ার পরে দুজনের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হলো। অনিকেত খেয়াল করে দেখল প্রিয়’র আচরণে কেমন একটা খাপছাড়া ভাব। কিছু একটা তো চলছে প্রিয়র মধ্যে যেটা আসলে প্রিয় চাচ্ছে না।

বন্ধুদের আড্ডার মধ্য থেকে হঠাৎ করে প্রিয়কে টেনে একটু আড়ালে নিয়ে এলো।

– কিরে বিজনেস ম্যাগনেট, সারাক্ষণ কি ভাবিস তুই? নাকি ব্যবসা করতে করতে মাথার তার সব আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে?

– কি যে বলিস না! আমি আবার বিজনেস ম্যাগনেট হলাম কোথায়? বাপ দাদার ব্যবসাতে জুড়ে বসেছি। এই আর কি।

– ওই হল, ঘুরেফিরে একই কথা! আচ্ছা দোস্ত, এনিথিং রং উইথ ইউ?

– নো নাথিং! কিছুটা অবাক হয়ে বলল, প্রিয়। এমন মনে হলো কেন?

– আই থিঙ্ক, তুই ভুলে গেছিস আমি একজন সাইকোলজিস্ট।

– উহু। একদমই ভুলিনি। এটাই তোদের সমস্যা। যাকে দেখিস তাকেই পেশেন্ট মনে করতে শুরু করিস।

– হা হা হা। এটা অবশ্য মন্দ বলিস নি। এমন একটা মানুষ দেখাতে পারিস যার মনের মধ্যে কোনো প্রবলেম নেই। প্রত্যেকটা মানুষের কোনো না কোনো প্রবলেম থাকে, পেইন থাকে যে কারণে সবাইকেই আমাদের কাছে পেশেন্ট মনে হয়।

– তাই নাকি! এত যদি বুঝিস তাহলে বল দেখি আমার কি সমস্যা?

– বন্ধু আমরা মন নিয়ে নাড়াচাড়া করি। মনের ভাষা যদি বুঝতে না পারতাম তাহলে তোরা পয়সা দিয়ে আমাদের কাছে চিকিৎসা করতে আসতি না।
তোর মধ্যে সমস্যা যে চলছে সেটা আমি তোকে দেখা মাত্রই বুঝে ফেলেছি। এই বয়সেই এতটা নাম ধাম নিশ্চয়ই আমার এই চেহারা দেখে হয়নি।

– হুম। তা তো ঠিক বলেছিস। যোগ্যতা না থাকলে যোগ্য স্থানে যাওয়া যায় না।

– আচ্ছা, এসব কথা বাদ দিয়ে এখন বল এত কনফিউশনে ভুগছিস কেন? মনে হচ্ছে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিস না।

– মাই গড! তুই দেখছি সত্যি সত্যি ধরে ফেলেছিস। আমি তো এতদিন ভেবেছিলাম তুই কোন হাতুড়ে ডাক্তার হবি হয়ত। এখন দেখছি না সত্যি সত্যি কিছু জানিস,
হা হা হা।

– হাতুড়ে ডাক্তারই বলতে পারিস। এখন পর্যন্ত বড় ডাক্তার হলাম কোথায়? বন্ধুর সমস্যার সমাধান করতে পারছি না আর বড় ডাক্তার।

– কথা না বের করে তুই ছাড়বি না। আচ্ছা চল, ওদিকটায় বসি না হলেও ওরাও চলে আসবে এখানে।

– দ্যাটস লাইক অ্যা গুড বয়। চল।

অনেকক্ষণ সামনাসামনি বসে আছে দু’জন কিন্তু কিছুই বলছে না প্রিয়.! এটা কি আদৌ বলার মতো কোনো ঘটনা না কিনা সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে।

– কাউকে ভালোবাসিস?

– না… মানে ভালবাসি না। তবে একজনকে বাসতাম। সে এক ফ্রডের কাহিনী । পরে একসময় শুনিস।

– সো স্যাড! নতুন করে কি কাউকে ভালবেসেছিস?

– বুঝতে পারছি না!

– ইন্টারেস্টিং! কাউকে পছন্দ করেছিস কিনা সেটা বুঝতে পারছিস না? ওকে ফাইন! আমাকে ডিটেইলস বল। আমি তোকে হেল্প করার চেষ্টা করব।

– আমার কাজিন। আমাদের বাসাতেই থাকে। তবে ছোটো থেকেই থাকছে না। ওর মা মারা যাবার পর থেকে ও এবং ওর ভাই এখানে থাকছে।

– হুম।

– ওকে নিয়ে কখনো এ ধরনের ফিলিংস হবে আমি ভাবতেও পারিনি। এজন্যই এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না যে আসলে আমার সাথে চলছে কী? ওদের দু’ভাইবোনকে আমি একদমই সহ্য করতে পারতাম না। আমার কাছে ওদের আশ্রিতা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। কিন্তু মেয়েটা আমার প্রতি এত কেয়ারিং যে নিজের মনোভাবকে আগের অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হই।
মাত্র কিছুদিন আগে আমাকে বেশ বড়সড় একটা বিপদে হাত থেকেও ও বাঁচিয়েছে। সেই থেকে আমি ওর প্রতি এতটা কৃতজ্ঞ যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

– তার মানে বোঝাচ্ছিস এরপর থেকে তোর ওকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। মানে তোর যে অসহ্য একটা ভাব ছিল সেটা কেটে গেছে, তাইতো। তাইলে আবার সমস্যা কই?

– হুম। কিন্তু সমস্যা হলো আমার কাজিন আমার অন্য একটা ফ্রেন্ডকে পছন্দ করে। আমি নিজেই বলতে গেলে ওদের মধ্যে রিলেশন বিল্ডআপ এ হেল্প করেছি। অথচ যখন থেকে জানলাম যে, দে আর লাভ ইচ আদার! আমি কেন যেন এটা মেনে নিতেই পারছি না। বুকের মাঝে কেমন একটা শূন্য শূন্য ভাব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কি যেন নেই, কি যেন নেই। কেন এমন হচ্ছে নিজেই জানি না।

– হু! জটিল কেইস। মানে হচ্ছে এখন কাজিন আর ফ্রেন্ডের রিলাশান নিয়ে ইনসিকিউরড তুই, তাই তো!

– হতে পারে আবার নাও পারে।

– মেয়েটা মানে তোর কাজিন কি খুব সুন্দরী?

– আহামরি তেমন কোনো সুন্দরী না। তবে প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী আর মেধাবী।

– আহামরি না তবে কেমন যদি বুঝিয়ে বলতি!

– মোটামুটি লম্বা, পাতলা আর গায়ের রং শ্যামবর্ণ। নাক, চোখমুখ, চোখের ভাষা বেশ তীক্ষ্ণ। কথা বলার ধরণও চমৎকার। অল্পতেই মনের কথা বুঝতে পারে। ওর সাথে কথা বলতে থাকলে বিরক্ত হচ্ছিস এমন মনে হবে না। তাতে যতক্ষণই লাগুক।

– সাজাগোজ করে খুব?

– একদমই না। বিনা সাজেই সে অপূর্ব। কোনো আর্টিফিশিয়াল রঙ চোং মেখে সং সাজার প্রয়োজনই পড়েনি কখনো।

– না, ওই যে মাত্র বললি শ্যাম বর্ণ! শ্যাম বর্ণ ঢাকতে পুরু ফাউন্ডেশন নিশ্চয়ই মাখতে হয়?

– নেভার! সে ওই শ্যাম বর্ণেই অপরূপা। ফাউন্ডেশনের আড়ালে নিজেকে কখনোই লুকাতে হয় না তার। চোখের নিচে পুরু কাজল আর ন্যুড লিপস্টিকেই সে অনন্যা।

– সো কিউট! আচ্ছা, দোস্ত! তুই না বললি দেখতে আহামরি সুন্দরী কেউ না। তবে তুই যেভাবে বর্ণনা দিলি তাতে আবার অন্য মিনিং দেখছি আমি।

– আমার কাছে ছবি আছে দেখবি তুই? বিশ্বাস করছিস না তাই তো!

– না, না। তা হবে কেন? বিশ্বাস করছি। ছবি দেখতে পারলে অবশ্য মন্দ হতো না।

প্রিয় পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওর আর মিথিলার কাশবনে তোলা বেশকিছু ছবি বের করে দেখাতে শুরু করল।

অনিকেত বেশ সময় নিয়ে ছবিগুলো দেখল।

– আচ্ছা, এবার বলতো তোর এই কাজিন তোর কাছাকাছি যতক্ষণ থাকে তখন কেমন লাগে তারপর যখন চলে যায় তখন কি খারাপ লাগে? সত্যি বলবি একদম।

– প্রিয় খানিকক্ষণ ভেবে বলল, মিথ্যে বলব না। আগে কাছাকাছি দেখলে বিরক্ত লাগত। কিন্তু এখন না আসলে বরং খারাপ লাগে। ও আমাকে কেয়ার করুক, আমাকে নিয়ে ভাবুক এটা এখন আমি সবসময় চাই।

– বুঝেছি চান্দু। তুমি প্রেমে মজেছ।

– তুই শিওর?

– দেখো দেখি কাণ্ড! সে প্রেমে পড়েছে আর বলতে হবে আমাকে? তুই এখনো বুঝতে পারছিস না। তুই ওকে নিয়ে যখন কথা বলিছিলি তখন তোর চোখের মাঝে তোর কাজিনকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। তুই বললি তোর কাজিন সুন্দরী না। অথচ অবচেতন মনে একটা মেয়েকে সুন্দরী হতে যেসব ক্রাইটেরিয়া পার করতে হয় সেসবের থেকে অনেক বেশিই বলে ফেলেছিস। প্রশংসা করতে করতে ডুবে গিয়েছিলি যেন অন্য জগতে। আর তারপরও যে ডাউট ছিল সেটা দূর করল এই ফটোগ্রাফস। প্রতিটি ছবিতে তুই ওকে যেভাবে দেখছিস, আর তুই যে কতটা প্রাণবন্ত লাগছিস ছবিতে সেটাও টের পাচ্ছি। আর আমার ভুল না হলে আমার মনে হয় তোর কাজিনও তোকে ভালোবাসে।

– আর ইউ শিওর?

– ডেফিনিটলি। দেখ, আমাদের মাঝে কাজিনকে নিয়ে এমন ফিলিংস আসবেই না। কারণ আমরা কাজিনদের সিবলিংসের মতোই মনে করি এর অতিরিক্ত একদমই না। কারণ আমাদের ধর্ম আর সামাজিকতা সেই অধিকার দেয়নি। কিন্তু তোদের মধ্যে এটাতে কোনো বাঁধা নেই। তাই সাব-কনশাস মাইন্ডে হোক আর যেভাবেই হোক তোদের মধ্যে ভালো লাগা তৈরি হতে পারে। যেটা অলরেডি তোদের মাঝে হয়েছে। তাই বলছি। আর দেরি না করে প্রকাশ করে দে তোর মনের কথা। না হলে বেশিই দেরি হয়ে যাবে।
আচ্ছা, এবার বলতো আমাদের সেই ফ্রেন্ডটা কে যাকে তোর কাজিন পছন্দ করে বলে মনে করছিস?

– তুই চিনবি না। আছে!

ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল প্রিয়। কারণ সে জানে নাম বলার সাথেই অনিকেত চিনে ফেলবে সাজিদকে। একসাথেই পড়েছে তারা। যদিও সাজিদের সাথে এই গ্রুপের খুব বেশি আন্তরিকতা নেই। তবুও।

– থ্যাংক ইউ, দোস্ত! অনেক বড় একটা জট খুলে দিলি। তবে তোর কথা যদি সত্যি হয় মানে মিথিলাও যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে তবে আমাদের বিয়ের প্রথম কার্ডটি তুই পাবি। প্রমিস!

– হা হা হা। অপেক্ষায় থাকলাম। আমার বিশ্বাস প্রথম কার্ডটি তবে আমিই পাচ্ছি। বেস্ট অফ লাক, ডিয়ার!

সাজিদদের ড্রয়িং রুমে বসে আছি আমি আর মিথিলা। সাজিদের মা আমাদের খাতিরযত্ন করতে খুব ব্যস্ত। সে একবার অনেক আগে আমাদের বাসাতে আসলেও আমি প্রথম তাদের বাসাতে। আমাদেরকে তাদের বাসাতে পেয়ে যেন ধন্য সাজিদের মা।

সাজিদের মা কথা বলার এক ফাঁকে সাজিদকে ডেকে বলল, কি রে! অমন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মিথিলাকে পুরো বাসা ঘুরিয়ে দেখা। ছাদে যে তোর বাগান আছে সেটাও দেখিয়ে আন।
যাও মা। তুমি ঘুরে এসো। দেখে এসো আমার পাগল ছেলের পাগলামি। ছাদ ভরা গাছ আর গাছ। আর কবুতরও আছে কিন্তু। নিজে তো সময় পায় না। সব করতে হয় আমার। অবশ্য পুচকে একটা ছেলে আছে দেখাশোনার জন্য। কবুতর এখন দেখতে না পেলেও বাগানের সৌন্দর্য দেখে আসতে পারবে।

আমিও চোখের ইশারায় সাজিদের সাথে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলাম তাকে। মিথিলা ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও উঠে গেল।

আমি ইচ্ছে করেই ভাইয়ার বাসা থেকে ফেরার পথে মিরপুর দশ নাম্বার গোল চত্বরে এসে সাজিদকে অডিট রিপোর্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ফোন করলাম । সাজিদ যখন কথাপ্রসঙ্গে জানল আমি আর মিথিলা দশ নাম্বারে সে অমনি পাগলের মতো হন্য হয়ে ছুটে এল আমাদের নিতে। আমিও এটাই আশা করছিলাম। একটা উদ্দেশ্য ছাড়া আসলে যাই কী করে কারো বাসায় ?

সাজিদ আজ অফিস থেকে ফিরেছে সন্ধ্যার আগেই এটা খবর পেয়েছিলাম আগেই। আর ওর বাসা গোল চত্বর থেকে বেশ কাছেই। এখানে আমরা এসেছি জানলে সে যে চুপ থাকবে না সে আমি জানি। আর মিথিলা আছে জানলে তো আরো না। আমি ইচ্ছে করেই মিথিলার নামটা তাই জুড়ে দেই। যাতে সে আরো আগ্রহ বোধ করে।।
ভাইয়ার বাসায় আসাটাও নিছক একটা বাহানা মাত্র।
যাক উদ্দেশ্য তবে সফল। এবার যা দেখতে এসেছি সেসব ভালোয় ভালোয় হলেই হয়। আমার মূল উদ্দেশ্য হলো সাজিদের মা এবং পারিপার্শ্বিক সব দিক অবজারভ করা।

চলবে….