প্রিয় প্রহর পর্ব-১৬

0
607

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৬
আরোহীর আর পড়া হলো না। ডিনারের সময়ও দুজনের কারো খাওয়ার ইচ্ছা নেই। সেদিন আর কোনো কথা হয় না দুজনের।
পরেরদিন শুভ্র আরোহীকে আরোহীর মেডিকেলে নামিয়ে দিয়ে নিজের কর্মক্ষেত্র মেডিকেলে চলে যায়। ক্যাম্পাসে যেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা আরোহী। এই প্রথম একা একা ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে সে। আয়ানা এখনো আসেনি। একটু পর ওর বান্ধবী সারা ও তানু আসে।

–কিরে আরু। তুই একা কেন?
তানুর এমন বোকা বোকা প্রশ্নে সারা একটা গুতা দেয় হাতে তারপর বলে,
–বলদি! আরুর বিয়ে হইছে। তাহলে এখন তো শ্বশুর বাড়ি থেকেই মেডিকেলে আসবে তাই না! আয়ুর সাথে তো আসতে পারবে না।

তানু দ্বিগুন বেগে সারাকে গুতা দিয়ে বলে,
–তুই বলদি। আমি জিজুকে বুঝাইছি। আয়ুকে না।

আরোহীর ওদের অহেতুক কথা ভালোলাগছে না। তাই সে বলে,
–থাম বইনেরা। এবার বল ইশু কই?
–ইশু দেখ ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কোথাও আছে।
তানু ব্যঙ্গ করে বলে।

তখনি আয়ানা আসে ওদের কাছে। ওরা চারজন ক্যান্টিনে যায়। ক্যান্টিনে ইশু আর ওর বয়ফ্রেন্ড অভ্র বসে আছে। অভ্র ইন্টার্ন স্টুডেন্ট। ওরা চারজন গিয়ে ওই টেবিলে বসে।

–কিরে শাঁকচুন্নি। আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করতি। সকাল আটটার ক্লাসের জন্য আমরাও না খেয়ে আসছি। আমাদের জন্য দাঁড়ালে কি হতো তোর?

তানুর কথায় ইশু বলে,
–তানু কি বাচ্চি! আমি এখনো খাই নি। তোদের জন্য বসে ছিলাম। আজকে অভ্র তোদের ব্রেকফাস্ট ট্রিট দিবে কারন নেক্সট মান্থ থেকে সে রেজিস্টার ডাক্তার হয়ে যাবে। কালকে এটা কনফার্ম হয়েছে।

সবাই মিলে অভ্রকে “শুভ কামনা” জানায়।
আরোহী বলে,
–ভাইয়া। আমাকে এনাটমির একটা টপিক বুঝায় দিতে পারবেন?

আরোহীর কথায় সবাই গোলগোল চোখে তাকায়। তাদের তাকানোর মানে হলো,
” আরোহী এনাটমি বুঝতে চাইছে! যেখানে ওরা আরোহীর থেকে এনাটমির প্রবলেম বুঝে। ”

–আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এই ক্লাস শেষ হলে ক্যান্টিনে বসো। আমি তখন বুঝিয়ে দিবো।

তানু অভ্রর কথা শুনে ইশুকে বারবার চোখ দিয়ে ইশারা করছে যাতে অভ্রকে মানা করতে বলে। সারাও মানা করতে বলছে। বেচারি ইশু এটা বুঝতে পারছে না যে সে কেনো মানা করতে বলবে!

নাস্তা শেষে সবাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তখন তানু ইশুকে টেনে একটু পেছোনে এনে বলে,
–ক্লাস শেষ হলে তুই অভ্র ভাইকে নিয়ে ডেটিংয়ে চলে যাবি।
ইশু অবাক হয়ে বলে,
–ছিহঃ। নাউজুবিল্লা মার্কা কথা বলবি না। আমি বিয়ের আগে এসব খারাপ কাজ করবো না আর না অভ্র এগুলোর পক্ষে।

তানু চোখ বন্ধ করে বিরক্তি লুকিয়ে বলে,
–তোমারে কি আমি রুমডেটের কথা বলছি? যে তুমি নাউজুবিল্লা, আসতাগফিরুল্লাহ পড়তেছো? ডেটিং মানে ঘুরতে যাবি বা ভাইয়াকে বিজি রাখবি যাতে সে আরুকে পড়া না বুঝাতে পারে।

ইশু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থেকে বলে,
–বুঝলাম। কিন্তু পড়া বুঝালে কি সমস্যা?

–তুই আসলেই বলদ। আরুর জামাই ডাক্তার। সেই তো আরুরে পড়া বুঝাইতে পারে! আর তাছাড়া আমরা তো সব কিছু জানি যে কি থেকে কি হইছে। তাই শুভ্র ভাইয়া যদি আরুরে পড়া বুঝায় তাহলে ওদের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা কমবে।

তানুর বুঝানোতে ইশু বুঝে। এরপর সে সায় দিয়ে একসাথে ক্লাসে যায়।
এরপর যথারিতি ক্লাসের পর ইশু অভ্রকে বিজি রাখে যার দরুন অভ্র আরুকে পড়া বুঝাতে আসতে পারে না। আরু আধ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর যখন দেখে অভ্র আসে না তখন সে বলে,

–মনে হয় অভ্র ভাইয়া ফ্রি টাইম পায়নি। আমি বরং স্যারের কাছে যাই।

আরোহীর এমন কথায় তানু ও সারার কাশি উঠে যায়। আয়ানা ওদের দুইজনের মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছে। ওরা দুজনে পানি খাচ্ছিল। সারা কাশি থামিয়ে বলে,

–আরু তুই তো শুভ্র ভাইয়ের কাছ থেকে পড়াটা বুঝে নিলে পারিস।
সারার কথায় আয়ু, তানু সায় দেয়।

আরোহীর মুখ কালো হয়ে যায়। শুভ্র ভাই কি তাকে পড়া বুঝিয়ে দিবে! এই নিয়ে এসে সন্ধিহান আছে। কালকে আবার শুভ জন্মদিন। ২৮ তম জন্মদিন। এখন যদি সে পড়া বুঝতে চায় আর শুভ্র রেগে যায় তাহলে কালকে জন্মদিন টাও শুভ্রর খারাপ কাটবে। তাই আরোহী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

–আরে না। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে উনাকে জড়ানোর দরকার আছে? আর তাছাড়া কালকে তো উনার জন্মদিন।

তানু ও সারা যেন একটা সুযোগ পেয়ে গেল। সারা বলে,
–ওয়াও! কালকে শুভ্র ভাইয়ের জন্মদিন। তাহলে তুই কি প্ল্যান করেছিস? মানে তাকে কিভাবে সারপ্রাইজ দিবি?

আরোহী বিরস মুখে বলে,
–আমি কোন প্ল্যান করিনি।
আরোহীর এমন কথা ওদের তিনজনের কারোই ভালো লাগেনা।
আয়ানা বলে,
–দেখ আরু। সামান্য পড়া বুঝানো নিয়ে ভাইয়া রাগ করবেন না। উনি নিজেও একজন ডাক্তার। কালকে ধ্রুব আমাকে বারোটা পরে ফোনে পড়া বুঝিয়ে দিছে। সারাদিন ফোন বন্ধ পেয়ে সে নাকি তোকেও ফোন করছিলো। শোন তুই শুভ্র ভাইয়ার কাছ থেকেই পড়া বুঝে নিস।

এরপর ওরা পরের ক্লাসে চলে যায়।
______
রাতের বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে শুভ্র এখনো বাসায় ফিরে নি। আরোহী শুভ্রর কাছ থেকে পড়া বুঝবে বলে বসে আছে। ঠিক পৌনে এগারোটার সময় শুভ্র বাড়িতে ফিরে। শুভ্র নিজের রুমে যেয়ে দেখে আরোহী বই বিছিয়ে বিছানায় বসে আছে। শুভ্র কালকের কারনে এখনো জড়তায় আছে। কালকে সব কিছু বলে ফেলেছে একদম।
শুভ্র ওয়াশরুম থেকে একবারে শাওয়ার নিয়ে ফিরে কারন আজকে দুইটা সার্জারি করেছে। আজকে শাওয়ার নেওয়ার সময় শুভ্রর টিশার্ট টা ওয়াশরুমের ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিল। তাই সে ভেজা টিশার্ট টা হাতে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসে ট্রাউজার পড়ে।

আরোহী এতক্ষণ ধরে শুভ্র বের হয়ে আসার অপেক্ষা করছিল। শুভ্রকে তাহলে পড়া বুঝিয়ে দিতে বলবে তাই। হঠাৎ শুভ্রকে খালি গায়ে ট্রাউজার পরিহিত অবস্থায় শুধু তোয়ালে গলায় ঝুলানো অবস্থায় দেখে আরোহী লজ্জা পায়। ফর্সা লোমহীন ভেজা বুকে পানির কণাগুলো জমে আছে। চুল থেকে পানি পরছে। শুভ্র ভেজা টিশার্ট একহাতে ও আরেক হাতে গলায় ঝুলানো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে।
আরোহী চোখ নামিয়ে নেয়। লজ্জায় তার গাল হালকা রক্তিম হচ্ছে। শুভ্র আরোহীকে চোখ নামিয়ে নিতে দেখে আগে কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করে পড়ে নেয় তারপর ব্যালকনিতে ভেজা টিশার্ট মেলে দিয়ে রুমে আসে। এখন ডিনার করবে তাই ডায়নিংয়ের উদ্দেশ্যে যেতে নিলে আরোহী তাকে হালকা স্বরে ডেকে বলে,

–আপনি যদি ডিনারের পর আমাকে এনাটমির টপিকটা বুঝিয়ে দিতেন!

শুভ্র ঘুরে তাকায়। তা দেখে আরোহী আবারো বলে,
–না মানে বেশি সময় লাগবে না। আধ ঘন্টার মতো লাগবে।

শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকায় এখন ১১.১০ বাজে। শুভ্র রাজী হয়। তারপর আরোহীকেও ডিনারের জন্য আসতে বলে চলে যায়। আরোহী খুব খুশি হয়।

সাড়ে এগারোটায় ডিনারের পর রুমে এসে শুভ্র আরোহীকে পড়াতে বসে। শুভ্র খুব সুন্দর করে পড়াটা বুঝিয়ে দেয় একদম সহজ করে। আরোহী মনে মনো খুশি হয়। পড়া বুঝাতে বুঝাতে বারোটার ঘন্টা বেজে যায় তারমানে শুভ্রর জন্মদিনের দিন শুরু হয়ে গেছে। আরোহী মন হুট করে চাইলো সে শুভ্রকে মনের মাধুরী দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। তাই আরোহী চট করে শুভ্রর হাত ধরে।

হুট করে হাত ধরায় শুভ্র চমকে যায়। আরোহী এতোক্ষন পড়ানোর মধ্যে শুভ্রর সাথে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। ঘরির কাঁটায় এখন ১২.০৪ বাজে। আরোহী শুভ্রর হাত ধরে ব্যালকনির খোলা অংশ যেখান দিয়ে আকাশ দেখা যায় সেখানে নিয়ে যায়। শীতের রাত। বাহিরে হিম শিতল হাওয়া বইছে। শুভ্র ও আরোহী দুজনোর গায়ে হালকা শিতের পোশাক। শুভ্র ফুল স্লিভসের গেঞ্জির টিশার্ট আর আরোহী শাল গায়ে দেওয়া।

শুভ্র বুঝতে পারছে না আরোহী কেনো তাকে এই ঠাণ্ডার মধ্যে ব্যালকনিতে নিয়ে এসেছে। গ্রিলে এক হাত রেখে আরোহী শুভ্রর আরেক হাত ধরে রেখেই আকাশপানে দৃষ্টি রেখে বলে,

” কোনো এক শুভ্রদ্বীপে একক শান বজায় রেখে এসেছেন আপনি। ধরণী তার বুকে এক শুভ্র সূচনা করছে আপনার প্রথম কান্নার ধ্বনিতে। মাতৃহিয়া শান্ত করছে আপনার অশান্ত স্বরে। সেই ধরণীতে আজ আপনার আঠাশ তম বসন্ত! শুভ জন্মদিন শুভ্রদ্বীপ মাহতাব শান! আল্লাহ আপনার হায়াত বর্ধন করুক।”

আরোহীর এতো মাধুরী মিশিয়ে শুভেচ্ছা বাত্রা যেনো শুভ্রর মনের দোঁলাচলে এক মিস্টি আলোড়ন তোলে। সিক্ত হয় তার মন।
আরোহী মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে শুভ্রর মুখের দিকে তাকায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।