প্রিয় প্রহর পর্ব-১৮

0
682

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৮
বিয়ের পর আজ আরোহীর প্রথম জন্মদিন। আজ সে তার শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে। ভেবেছিলো রাত ১২ টায় শুভ্র তাকে উইশ করবে কিন্তু শুভ্র নিজের ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করে ঘুমিয়ে গেলো।
আয়ানা, নীড়, মেঘ ও ওদের বাবা-মা সকালেই শুভ্রদের বাড়িতে এসেছে। রিয়ানা ও তার মেয়েও এসেছে। সারাদিন আনন্দে কেটে গেলো। সন্ধ্যে হতেই আয়ানারা তাদের বাড়ি ফিরে গেলো। রিয়ানা সন্ধ্যের সময় কথায় কথায় আরোহীর থেকে জানতে পারে যে, শুভ্র এখনো উইশ করে নি।

রিয়ানা ফোন করে শুভ্রকে। শুভ্র রিসিভ করে জলদির মধ্য বলে,
–হ্যাঁ আপি বল।

–ওই বলদ! আজকে যে তোর বউয়ের জন্মদিন তা কি তুই ভুলে গেছিস?

শুভ্র রোগী দেখার মাঝে একটু ব্রেক নিয়ে ফোন রিসিভ করেছে।
–আপি। আমি পরে কথা বলি? রোগীটাকে দেখেই কলব্যাক করি।

শুভ্র কল কেটে রোগীকে দেখে পাঁচ মিনিট পর আবার কল করে।
–হ্যাঁ আপি, কি বলতেছিলি?

–আজ আরুর জন্মদিন। তুই কি ওরো উইশ করছিস?

–না। আমার তো মনেই ছিলো না!

–তাহলে এখন ভাব! কিভাবে উইশ করবি। আর শোন কিছু গিফট করতে পারিস। তবে দামি জিনিস দিয়ে শুধু বাহ্যিক খুশি কিনা যায় মনের খুশি না! এমন কিছু গিফট কর যাতে আরু মন থেকে খুশি হয়।

শুভ্রর মনে নাড়া দেয় কথাটা। আজকের দিনে আট বছর আগে সে কারো মোহে আটকা পড়েছিলো। কিভাবে আজকের তারিখটা ভুললো! আট বছর আগে কারো ভালোবাসার মোহতে পড়ার সাথে সাথে আরেকটা মেয়ের সম্মান বাঁচিয়েছিল। আর আজ সে তারই অর্ধাঙ্গিনী!

–ঠিক আছে আপি।
–শোন ভাই, পারলে জলদি আসিস। সময়ের আগে। সময় থাকতে সময়ের কাজ করে ফেলা ভালো নাহলে তুইতো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ!

রিয়ানা ফোন রেখে দেয়। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়।

রাত সাড়ে দশটার সময় শুভ্র বাড়ি ফেরে। রুমে যেয়ে দেখে রুম ফাঁকা তবে ব্যালকনির থেকে গুনগুন গানের সুর আসছে।
” আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর, আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতো দূর! ”

শুভ্রর কাছে গলার স্বরটা বিষন্ন লাগে। সে ব্যাগ রেখে ব্যালকনিতে যায়। তারপর কোনো টু শব্দ না করে আরোহীর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। এরপর আরোহীর বাম পায়ে হাত দিয়ে পা টা নিজের হাঁটুতে রাখে।

আরোহী এরকম আচমকা পায়ে হাতের স্পর্শ পেয়ে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে। দাঁড়ানো থেক পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নেয় গ্রিলে ধরে।
শুভ্র আরোহীর বাম পায়ে একটা সাদা মুক্তা ও স্টোন খচিত পায়েল পড়িয়ে দেয়।
( কি ভাবছেন? শুভ্র প্রোপোজ করবে? এহ! এতো দ্রুত হলে তো পরে আপনারাই বলবেন খাঁপছারা।)

পায়ে পায়েল পড়িয়ে শুভ্র উঠে দাঁড়ায়। আরোহীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,

” এক সূর্যস্নানিত তেজস্বিনী দিনে!
রোদ্দুরের হালকা উষ্ণতা নিয়ে
কুয়াশার আদ্রতাকে গ্রাস করে তুমি
রোদের আদ্রতা ছড়াও। ”
______তিথি

শুভ্রর মুখের দিকে ক্রমশ পলকহীন তাকিয়ে আছে আরোহী। আরোহী এতোটাও আশা করেনি। পায়েল নিজ হাতে পড়িয়ো আবার ছন্দ মিলানো!
শুভ্র আরোহীর অবাক মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেও বুঝতে পারছে যে আরোহী এগুলো আশা করেনি।
শুভ্র চলে যেতে নিলে আরোহী বলে,

–ধন্যবাদ আপনাকে। সবকিছুর জন্য। এতো সুন্দর ছন্দ আর পায়েলটা।

শুভ্র মুচকি হেসে চলে যায়। কালকে তার ইংল্যান্ডের ফ্লাইট। কয়দিন ধরে কাজ কমিয়ে রেখেছে সে।

আরোহী শুভ্র যাওয়ার পর মুচকি হেসে শুভ্র বলা ছন্দটা আউরায়।
সে ভাবে নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে,

“একদিন আপনি এই রৌদ্রিতার মায়ায় পড়বেন। শুভ্র আকাশে রোদের আলোকে মানায়। আর রাতের আকাশে ধ্রুবতারা! রোদের আলো ছাড়া প্রকৃতি তার শুভ্রতা প্রকাশ করতে পারে না। ”

———এদিকে আজকে ধ্রুবের একটা পরিক্ষা আর সাথে প্র্যাকটিকেল। তাই পুরোটা সময় সে ব্যাস্ত। আয়ানার মন খারাপ তবে প্রকাশ করতে পারছে না। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ভাবনা পাশে রেখে দরজা খুলতে যায়। ভিতরের রুম থেকে ওর মাও এসেছে দরজা খুলতে। মা-মেয়ে দুজন দরজা খুলে।
দরজা খুলে দেখে পার্সেল এসেছে এতটা বক্সে। ডেলিভারি বয়কে বিদায় করে আয়ানা বক্সটাতে নজর বুলায়। বক্সে লেখা, “ধ্রুবতারা”

মিসেস নূর মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে যায়। আয়ানা মায়ের সামনে লজ্জা পেয়ে গেছিলো তাই দৌড়ে বক্সটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। রাত দশটার পর যে পার্সেল আসে তার জানা ছিলো না। বক্স খুলে দেখতে পায়,
একটা কালো রঙের সোনালি পাড়ের শাড়ি, কালো চুড়ি, বেলি ফুলের মালা আর একটা চিরকুট।

চিরকুটে লেখা,
” আমার রাতের আকাশের এক তারা,
শত সহস্র তারার মাঝে খুঁজে পাওয়া
এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা! ”
_____তিথি

আয়ানা সাথে সাথে ধ্রুবকে ফোন করে। অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে ধ্রুব বলে,
–অভিমাস কি বেশি করেছেন?

আয়ানা চুপ করে আছে। তার মনের খুশি সে ভাষায় বুঝাতে পারছে না।
–কথা বলবেন না? এখনো অভিমান করে আছেন?

–না। ঠিক আছে। আমি জানি তোমার পরিক্ষা ছিলো।

–তা মেম। একবার কি শাড়িটা পড়তে পারবেন? আর সবগুলো জিনিস দিয়ে চোখে শুধু কাজল দিয়ে সাজবেন। আমি কিছুক্ষন পর ভিডিও কল দিবো।

আয়ানা সায় জানিয়ে কল কেটে দিয়ে সাঁজতে বসে। শাড়ির সাথে চুল খোলা রাখে আর খোলা চুলে বেলি ফুলের মালাটা ক্লিপ দিযে এক সাইড করে লাগায়। চোখে কাজল দিয়ে অপেক্ষা করে ধ্রুবের ভিডিও কলের।

ভিডিও কলে এসে ধ্রুবের মুখ থেকে প্রথমেই বের হয়, “মাশাআল্লাহ”

ওদের কিছুক্ষণ কথা বাত্রার পর যে যার মতো ঘুমিয়ে পরে।

______
কেটে যায় এক মাস। শুভ্র হার্টসার্জন হয়ে গেছে। সেদিনের সার্জারিটা সাকসেসফুল হয়েছে। আর ধ্রুব সরোয়ার্দিতেই ইন্টার্নশিপ করছে। ঢামেকে হয়নি। আরোহী ও আয়ানাদেরও ফোর্থ ইয়ারের ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ বান্ধুবী খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।

আরুদের খালাতো ভাই ইফান ও তার বেস্টফ্রেন্ড আরাশ ঢামেকে রেজিস্টার ডাক্তার হিসেবে জব পেয়েছে। ইফানের জন্যই তার খালামুনিরা চট্টগ্রামে শিফট হয়েছিলো। সেখানে ফ্লাট কিনে থাকে আর ইফানের ছোট বোন এইচএসসি দিবে চচট্টগ্রাম থেকে তাই ইফানের ঢাকাতে আসার সময় পরিবার সহ আসতে পারেনি। দুইমাস পর তারা ঢাকাতে আসবে। আর ইফানের বাবা ঢাকাতে মেঘদের বাড়ির কাছেই বাড়ি করছে। সেটা পুরোপুরি কম্পিলিট হতে দেড়মাস লাগবে। তাই ইফানকে তার বড় খালার বাসায় মানে মেঘ-নীড়দের সাথে থাকতে বলেছে। ইফানের সাথে ইফানের বন্ধু আরাশও এসেছে। আরাশ চায়নি আসতে কিন্তু মিসেস নূরের জোরাজোরিতে এলো।

আরাশের বাড়ি রংপুর। এখন ঢাকা মেডিকেলে জবের সুযোগ তো হাত ছাড়া করা যায় না! আরাশ চেষ্টা করবে তার মা-বোনকে ঢাকা নিয়ে আসতে। তিন বছর আগে তার বাবা কিডনি ড্যামেজে মারা গেছে। রংপুরে তাদের একটা ধানি জমি আছে পাঁচ কাঠার মতো। আর যে বাড়িটা সেটা দুই কাঠার মধ্যে। বাবার চিকিৎসার জন্য আরেকটা তিন কাঠার জমি বিক্রি করেছে। ওর বাবা মারা যাবার পর ধানি জমিতে যা ফলন হয় তা দিয়ে ওর মা-বোন চলে। আর আরাশ চট্টগ্রামে এডমিশন কোচিং ও রেগুলার কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের খরচ চালিয়েছে। ইফানের পড়ালেখা জনিত সাহায্যে সে ভালো করে পড়তে পেরেছে।

আরাশ চায় ঢাকাতে নিজে সেটেল হয়ে মাকে এবং ক্লাস টেনে পড়ুয়া বোনকে ঢাকাতে এনে কলেজে ভর্তি করে দিবে। রংপুরের বসত বাড়িটা রেখে ধানি জমিটা বিক্রি করে দেবে।

আরাশ মিসেস নূরকে বলে দিয়েছে যাতে তাকে নিজের ছেলের মতো দেখে। কোনো দরকারে যেনো ডাকে। আরাশ যে এক মাস এখানে থাকবে আর তারপর মেস বা দুইরুমের ফ্লাট নিবে তাও জানিয়েছে।
মিসেস নূর আর দ্বিরুক্তি করে নি।

একমাস পর,,
আজ আরাশ চলে যাবে। সে একটা দুই রুমের ফ্লাট নিয়েছে। আরাশের সাথে ইফানও যাবে। অনেক জোর করে সে তার খালাকে রাজি করিয়েছে। তাছাড়া একমাস পর তো ইফানের পরিবার এখানে পাশেই শিফট হবে। ইফান এই একমাস আরাশের সাথে ফ্লাট শেয়ারে থাকবে। ঢামেকের পাশেই ফ্লাট নিয়েছে।

ওরা দুইজন চলে যাবে তাই মিসেস নূর আজকে ওদের জন্য ভালো-মন্দ রান্না করছে সাথে তার দুই মেয়ের বান্ধুবীদের, সাদিয়া, সাবিলাকে ও ধ্রুবকে আসতে বলে। শুভ্রর সার্জারি থাকায় সে আসতে পারে নি তবে আরোহী মেডিকেল কলেজ থেকেই চলে আসে। আজকে রাতে তারা পাঁচ বান্ধুবী, সাদিয়া ও সাবিলা একসাথে থাকবে। শুভ্র রাতে আসবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।