প্রিয় প্রহর পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
1252

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২০
আজ শুভ্র ও আরোহীর দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। আরোহীর বাবা-মা, ভাই-বোনরা, খালারা ও পুরো পরিবার, শুভ্রর ফুপির পুরো পরিবার, আরোহীর ফ্রেন্ডরা, আর শুভ্রর কিছু ফ্রেন্ডরা এসেছে। কারন আজকে শুভ্র নিজেই কি মনে করে সবাইকে আসতে বলেছে তা আরোহীরও অজানা।

শুভ্রদের ফ্লাটটা বিল্ডিংয়ের যেই ফ্লোরে সেখানে উপর নিচ দুই ফ্লোর মিলে দুইটা ফ্লাট বানিয়েছে। সেখান থেকেই একটা শুভ্রদের। যাইহোক! এতো মানুষের সমাগম বাড়ি এখন গিজগিজ করছে।
শুভ্র ওর বোনকে বলেছে, যেনো আরোহীকে লাল জামদানি শাড়িটা পড়িয়ে রেডি করায় সাথে সুন্দর করে সাঁজায়। ঢিলা করে চুলে খোপা করে বেলি ফুলের গাঁজরা লাগায়।

রিয়ানা তার ভাইয়ের এরকম সাঁজ সজ্জার বর্ণনা শুনে মুচকি হাসে। এরপর সে আরোহীকে ওইভাবেই সাঁজায়। আয়ানা, সাদিয়া, সাবিলা, ইশু, তানু, সারা সবাই আরোহীকে দেখে হা হয়ে আছে।

আরোহীর মেডিকেলে আরোহীর ব্যাচের কিছু ছেলে যেচে দাওয়াত নিয়েছে যখন শুভ্র আরোহীর বান্ধুবীদের বলার সময় দুই তিনজন ছেলে এসে নিজে থেকে দাওয়াত নিয়েছে। শুভ্র ওদেরকেও আসতে বলে। ওরা হচ্ছে সাদাদ, পলক ও রসিদ।

আরোহীকে নিচে নিয়ে আসে। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ছবি তোলার সময়। সাদাদ ও তার দুই বন্ধু হাতে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে। এক ফাঁকে দেখে একটা মেয়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেসে সোফাতে বসে আছে। মেয়েটির হাতে কোল্ড ড্রিংকস আর মেয়েটার দৃষ্টি আরোহী ও শুভ্রর উপর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।

আর এদিকে ওই মেয়েটিকে শুভ্রর ফুফাতো বোন সামিরাও লক্ষ্য করেছে। সামিরা এই মেয়েটাকে কাল থেকে নজরে রাখছে। কারণ মেয়েটা হচ্ছে শুভ্রর ইংল্যান্ডে পড়াশুনা কালিন এক ফ্রেন্ড। গতকাল সে বাংলাদেশে এসেছে। মেয়েটার পরিবার মেয়েটাকে নিয়ে ছোট থাকতেই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন। মেয়েটা বাংলাদেশে থাকবে কিছুদিন। শুভ্র মেয়েটাকে বাড়িতে এনেছে আজকের অনুষ্ঠানের জন্য। মেয়েটা কালকেই বাংলাদেশে এসেছে আর এসেই শুভ্রকে ফোন করেছে। শুভ্র জানতো না যে মেয়েটা বাংলাদেশে আসবে। দুইদিন আগে শুভ্রর মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিলো তখন কথায় কথায় বিবাহবার্ষিকীতে বড় কিছু প্ল্যানের কথা জানায়।

সাদাদ ও তার বন্ধুরা মেয়েটা মানে জেসিকার কাছে যায়।

–হ্যালো মিস!

মেয়েটা নজর সরিয়ে সাদাদদের দিকে তাকায়। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে.
–হ্যালো। মে আই নো ইউ?

–নো মিস। আপনাকে দেকে বাঙালি মনে হচ্ছে।

–ইয়েস। আমার জন্ম বাংলাদেশে।

–ওহো। তা মিস! আপনে একা কেনো বসে আছেন? সবাই ওখানে আর আপনি এখানে একা!

–এমনিতেই। আমার ভির ভালো লাগছে না তাই এখানে বসে আছি।

–ভির ভালো লাগছে না! নাকি ভিরের কারন মানুষগুলোকে একসাথে ভালো লাগছে না?

জেসিকা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। সে যে শুভ্রকে ভালোবাসে সেটা কি এই ছেলেগুলো জেনে গেলো?

হ্যাঁ, জেসিকা শুভ্রকে ভালোবাসে। আর শুভ্র সেটা ছয় বছর আগে রিজেক্ট করেছিলো। জেসিকার সাথে শুভ্র ফ্রেন্ডশিপ হয়েছিলো অনেকটা কাকতালীয় ভাবে!

★★★
” শুভ্র তখন ইংল্যান্ডে নতুন। আর জেসিকা তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে মানে শুভ্রর এক বছরের সিনিয়র। জেসিকা একদিন হসপিটালের এক ফাঁকা রুমে বসে কান্না করছিলো কারন সে তার বয়ফ্রেন্ডকে অন্য এক মেয়ে নার্সের সাথে একটু আগে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছে। তার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে ফার্স্ট রুমডেট করার পর থেকে তাকে এড়িয়ে চলছে। জেসিকার বয়ফ্রেন্ড এই মেডিকেলের ডাক্তার। জেসিকা ও তার বয়ফ্রেন্ড দুজনেই খ্রিষ্টান।

তখন শুভ্র সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় জেসিকাকে কান্না করতে দেখে কৌতুহল নিয়ে যায়। এরপর শান্তনা দেয় আর ওদের ফ্রেন্ডশিপ হয়। শুভ্র তাকে বড় আপুর মতোই দেখতো কিন্তু জেসিকা অন্য ধর্মের ও বয়সে বড় হবার পরেও শুভ্রকে প্রোপোজ করে পরে। তখন শুভ্র তা রিজেক্ট করে খুব ভদ্র ভাবে।
এরপর জেসিকা কখনো শুভ্রকে আর ভালোবাসার কথা বলেনি কিন্তু ভালোবেসেছে। জেসিকা সেদিন শুভ্র যে কাউকে ভালোবাসে তা জানতে পারে।
★★★

–ইউ আর গেটিং রং। আমি ও শুভ্র খুব ভালো বন্ধু।

–নো মিস! মুখে বললেও আপনার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে।

জেসিকা চুপ করে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তখন সামিরা আসে সেখানে।
–হেই গাইস। তোমরা কি শুভ্র ও আরোহীকে নিয়ে কথা বলছো?

সেখানে উপস্থিত চারজন হকচকিয়ে যায় কারন এই মেয়ে যে এই পরিবারের তা তারা জানে।

–আরে গাইস। কুল। আমার কাছে শেয়ার করতে পারো। আমি বরং তোমাদের কাজে আসতে পারি!

তখন সাদাদ বলে,
–কি রকম?

সামিরা মুচকি হেসে বলে,
–তোমরা যা চাও আমিও তাই চাই। আরোহীকে আমার পছন্দ না। আরোহী না থাকলে আয়ানার সাথে বিয়ে ভাঙার পর আমার সাথে শুভ্রর বিয়ে হতো। কিন্তু আরোহী মাঝে এসে সব নষ্ট করে দিলো।

জেসিকা এবার মুখ খুলে,
–ওয়েট, ওয়েট। আরোহীকেই তো শুভ্র ভালোবাসে!

সামিরা বাঁকা হেসে বলে,
–না। ওইযে ব্লু গাউন পরিহিত,মেয়েটাকে দেখছো ব্লু পাঞ্জাবি পরিহিত ছেলেটার হাত ধরে ছবি তুলছে। (আয়ানা ও ধ্রুবকে দেখিয়ে) সেই মেয়েটাকে শুভ্র ভালোবাসে কিন্তু মেয়েটা বাসে না। তাই মেয়েটার জমজ বোনের সাথে বিয়ে দেয়।

এতোক্ষনে জেসিকা খেয়াল করে দুইটা মেয়ের ও দুইটা ছেলের চেহারা একই। সাদাদ বলে,
–ওহো! তার মানে এখানেও প্যাঁচ। তাহলে তো খেলা জমে যাবে।

সাদাদের বাকি বন্ধুরা বাঁকা হাসে সাথে সামিরাও। জেসিকা ওদেরকে দেখছে। সে বুঝতে পারছে না কি করবে।

খাওয়া দাওয়ার পার্ট শেষ হলে শুভ্র স্টেজে উঠে। ড্রয়িংরুমে ছোট করেই মাইক্রোফোন সহ এরেঞ্জমেন্টে করা।

শুভ্র বলে,
–হ্যালো এভরিওয়ান। আই ওয়ান্ট টু সে সামথিং ভেরি প্রিসিয়াস!
আপনারা সবাই জানেন যে আজকে আমার ও ‘মুশায়রা আরোহী রৌদ্রিতার’ দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেনো প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে এতো জমকাল আয়োজন না করে দ্বিতীয় টাতে করলাম?
ওয়েল, এটাই মূল বিষয়। আমি আমার ওয়াইফ রৌদ্রিতাকে বিয়ে করেছিলাম বাবা-মায়ের চাপে পরে। এক প্রকার তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে। কারনটা পুরোটা বলতে চাচ্ছি না। তবে এই দুই বছরে আমি যা বলিনি বা করিনি আজ তা করার জন্য আমি মাইক হাতে নিয়েছি। আমি বলতে চাই,
” রৌদ্রিতা! তোমার আলো, তোমার তেজ, তোমার সবকিছু আমায় বাধ্য করেছে দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসতে। আমার প্রথম ভালোবাসা এসেছিলো বহু আগে। নয় বছর হতে চলল। সেটাও কোনো ঝাঁকঝমক ভাবে আসেনি। আর দ্বিতীয় ভালোবাসাটা এসেছে খুবই সুন্দর অনুভূতিকে একত্র করে। এক হালাল সম্পর্কের মাধ্যমে। প্রতিনিয়ত আমি তার প্রতি আসক্ত হয়েছি। প্রতিনিয়ত তার কাজ, কেয়ারিং, দুষ্টুমি গুলোর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। এপর্যন্ত সে আমাকে কোনো অভিযোগ করার অবকাশ দেয়নি। আমি ভালোবাসিনা জেনেও আমাকে ভালোবেসে গেছে। সেও কিন্তু বিয়েটা বাধ্য হয়ে এবং কারো ভালোবাসাকে রক্ষা করতে বিয়ে করেছে। এক জোরপূর্বক সম্পর্কে জড়িয়েও আমরা ভালোবেসে ফেলেছি দুইজনকে। হ্যাঁ, আমার মন বলে আমার তেজস্বীনিও আমাকে ভালোবাসে। আমি ছোট বেলা থেকেই সময়ের কাজ দেরি করে করি তাইতো জীবনে কিছু প্রিয় জিনিস হারিয়েছি। আর আজকে আমার নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা টাও দেরি করেই প্রকাশ করলাম। তবে এখেত্রে আমার দেরি করাতেও বেশি প্রভাব ফেলবে না। হয়তো তার অভিমান হবে। কিন্তু আমি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞ যে আমার জীবনের প্রিয়_প্রহরে এক ভালোবাসাময় নারীকে পাঠিয়েছেন।
যেই নারী আমাকে দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে শিখিয়েছে। তার রূপে আমি আগে মোহিত হইনি। কারন একই রূপের অন্য নারী একসময় আমার প্রিয়_প্রহরে ছিল! আমি রৌদ্রিতার সবকিছুতে মুগ্ধ। ধন্যবাদ আমার পরিবারকে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সাথে জোর করে আমায় জুড়ে দেওয়ার জন্য।
” ভালোবাসি রুহি। ভালোবাসি তেজস্বিনী রোদের আদ্রতাকে। ”

শুভ্র থামে এবার। সামনে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা আরোহীর দিকে তাকায়। সিন্গ্ধ হাসি দেয় আরোহীকে। উপস্থিত শুভাকাঙ্ক্ষীরা করতালি দেয়। আয়ানা ধ্রুবকে জড়িয়ে খুশিতে কেঁদে উঠে। আজ তার চঞ্চল বোনটা নিজের ভালোবাসা পেলো। মিসেস নূর, মিস্টার মুনতাসির, মিসেস কায়রা, মিস্টার রিয়াদ সকলে চোখের জল মুছে খুশিতে।

রিপ্তি রিয়ানার হাত ছেড়ে আরোহীর কাছে যেয়ে বলে,
–আরু মিমি। তুমি কাঁদছো কেনো?

বেখেয়ালে কখন আরোহীর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে তা সে বুঝতে পারেনি। রিয়ানা ও তার স্বামী মেয়ের (রিপ্তি) জহোরির নজর দেখে হেসে ফেলে। তারা গিয়ে রিপ্তিকে বুঝিয়ে নিয়ে আসে।

শুভ্র ও আরোহী একে অপরেন দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। শুভ্র আস্তে আস্তে হেঁটে আরোহীর কাছে আসে। তারপর হাঁটু ভেঙে বসে হাত বাড়িয়ে বলে,

” এক অস্তমিত আঁধার অম্বরে এসেছিলে তুমি,
নতুন ভোরের আলো নিয়ে।
ভোরের আদ্র রোদের তীব্রতায়,
ফুটিয়েছো শুভ্র সকাল। ”
_______তিথি

আরোহীর চোখ দিয়ে নোনাজল ধারা যেনো আরো বেড়ে গেছে। শুভ্রর হাতে হাত রাখতেই শুভ্র উঠে দাঁড়ায়। আরোহী ঝাঁপিয়ে পরে শুভ্রর বুকে। শীতল হয় শুভ্রর বক্ষস্থল।

সবাই অনেক খুশি হয় কিন্তু হাসি নেই পাঁচজনের মুখে। তারা পরবর্তীতে কি ভেবে রেখেছে তা তারাই জানে।

_____ফুলের সমারোহে পূর্ণতা পায় দুটি তৃষ্ণার্ত হৃদয়। এক ভালোবাসাময় রাত দিয়ে শুরু হয় তাদের প্রিয়_ প্রহরের যাত্রা।

~~~~~~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~~~
এই গল্পের প্রথম সিজন এখানেই শেষ। সিজন ২ নিয়ে আসবো। তাই কিছুটা সাসপেন্স রাখলাম।

প্রিয় প্রহর সিজন-০২ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।