#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২০
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
স্বর্ণা ধীরপায়ে এগোল ভেতরের দিকে। জুতোর টকটক শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজল দু’জনের। তল্লাটজুড়ে দুশ্ছেদ্য নীরবতা। পাশের ঝোপের আড়ালে কোনো বন্য প্রাণী ভেজা পাতার উপর খসখস আওয়াজে ছুটে পালাল। সোলারের লাইটটা ধিমে আলো ছড়াচ্ছে। স্বর্ণা এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা তুলে নিল মাটি থেকে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে লেখাগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করল কয়েক সেকেন্ড। একটু পরেই দু-হাত ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে বলল,” ঝুমুকে তুলে নিয়ে গেছে ওরা। কথাটা বলে ছেড়ে ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরের একটা চেয়ারে বসে পড়ল স্বর্ণা। এই অল্প সময়ে আমি মেয়েটার নাম জানতাম না। তথাপি ঠিকই বুঝে নিলাম স্বর্ণা কার কথা বলছে। টাকার এপিঠ-ওপিঠের মতোন স্বর্ণার আচরণেরও উল্টো পৃষ্ঠায় আমি। সেই ধারা বজায় রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বললাম,
— মানে? কারা নিয়ে যাবে? এই জায়গার কথা তো কারো জানার কথা নয়!
স্বর্ণা আমার কথার উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে আঙুল চালিয়ে ভ্রু’র লোম চুলকোতে লাগল। তার চোখজোড়া স্থির,ভাবুক। কিন্তু চিন্তার রেখামাত্র নেই পুরো আননে। একসময় চট করে উড়ে দাঁড়িয়ে দোতলায় যে ঘরে অস্ত্র-শস্ত্র রাখা ছিল সে ঘরে ছুটে গেল পটাপট সিঁড়ি বেয়ে। চিঠিটা চেয়ারের উপরেই রেখে গেল। আমি স্বর্ণার পিছনে ছুটেও অর্ধেক গিয়ে ফিরে এলাম। চিঠিটা হাতে নিয়ে দ্রুত একবার চোখ বোলালাম। যা বোঝা গেল, মেয়েটাকে অর্থাৎ ঝুমুকে দূরের একটা পাহাড়ে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। যেটা নদী পেরিয়ে আরো একটি পাহাড়ের পর অবস্থিত। স্বর্ণাকে ওখানে যাবার আহবান করা হয়েছে মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিতে। মিনিট দুই পরে স্বর্ণা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো কাঁধে একটা ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে। আমি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বললাম,
— কোথায় যাচ্ছ?
স্বর্ণা দুইহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যাগের ফিতা ধরে বলল,
— মানুষ চায় না আমি ভালো হই। ঝুমুকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি। আমি না গেলে অবলা মেয়েটার প্রাণ যাবে।
আমি এক পা এগিয়ে বললাম,
— ঠিকাছে চলো,আমিও যাচ্ছি।
স্বর্ণা হাত ছুঁড়ে বাঁধা দিল,
— তোমার গিয়ে কাজ নেই। মনে রাখবে তুমি থানায় কর্মরত।
— পুলিশ হিসেবে তো যেতেই পারি। মেয়েটাকে উদ্ধার করতে!
— উফফ্ উলুবনে মুক্তা ছাড়ানোর মতো অবস্থা। ঠিক আছে। এসো।… এটা নাও।
স্বর্ণা ফটাফট ব্যাগ খুলে mk12 একটা গান তুলে দিলো আমার হাতে। আমি অবাক হয়ে শুধালাম,
— এটা কোত্থেকে পেলে?
স্বর্ণা ঠোঁট সংকুচিত করে গজগজ করে বলল,
— এসব এখন জিজ্ঞেস করার সময়? গাধা! চলো…
পাহাড়ের স্যাঁতসেতে গাত্র বেয়ে সাবধানে নেমে আমরা কিছুক্ষণ মাঝির জন্য অপেক্ষা করলাম। স্বর্ণা বিরক্ত হয়ে বারংবার মুখে চ কারান্তের শব্দ করছিল আর ক্লেদাক্ত মাটিতে চপচপ শব্দে পাঁয়চারি করছিল। আমার ভেতরেও যে একটা চাপা বিরক্তি বুনছিল না তাও কিন্তু না! মাঝি বোধহয় আশেপাশে কোথাও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল। এরই মধ্যে আমরা যে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসব সেটা হয়তো-বা ভাবতে পারে নি। মাঝি ফিরল কালান্তক এক ঝুম বৃষ্টিকে সঙ্গে করে। ডিগডিগে শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে যখন মাঝি ফিরল; স্বর্ণা হাঁফ ছাড়ল। মনে হলো, ভবিতব্য যে অনিরুদ্ধ সমর বাঁধতে চলেছে তার একটা অংশই সে জয় করে নিয়েছে শুধু একটুখানি অপেক্ষা দ্বারা। স্বর্ণা অনুনয়-বিনয় করে বলল,
— মাঝি,তাড়াতাড়ি চলো পূবের পাহাড়ে। আমাদের মেয়েটাকে নিয়ে গেছে শত্রুরা। এখুনি যেতে হবে…
মাঝির হাতে একটা খর আলোর টর্চ লাইট। একটু সময় নিয়ে হাতড়ে সুইচটা দু’বার টিপে আলো কমাল সে। স্বর্ণার তাড়া উৎকণ্ঠা এবং ছলনাশূন্য চঞ্চলতা দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ল মাঝির। চোখদুটো অসহায় করে মিনমিনে গলায় বলল,
— এই ঝড়বিষ্টির রাত্তিরে? বড় সমস্যা হবে যে মা!
স্বর্ণা বেপরোয়া ঢং-এ হাত উঁচিয়ে বলল,
— আমি এতোকিছু বুঝি না। নৌকা টান দাও তুমি। সময় খুব কম।- বলে নৌকায় উঠে গেল স্বর্ণা। পেছনে আমিও বাকশূন্য হয়ে চুপি চুপি বসে গেলাম।
মাঝি যেন করাল গ্রাসে নিপতিত হলো। আশেপাশের পরিবেশটাতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মন্থর পায়ে নৌকায় উঠে এলো সে।
ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝড়ে চলেছে রাতের আঁধারে অদৃশ্য মেঘকে পরিক্ষীণ করে, সঙ্গে শনশনে বাতাসে নৌকা এপাশ-ওপাশ কোমর দুলিয়ে নাচছে বিদায়বেলার শেষনৃত্যের মতোন। মাঝির চতুর হাতের পানিতে দাঁড় টানার ঝুপুরঝাপুর শব্দ আর পানিতে বৃষ্টি বর্ষণে কিম্ভুত একটা সুর বাঁজছে কানে। এই সুর সদাশ্রুত না হলেও এই সময়ে মোটেও উপভোগ্য নয়। ক্ষণকাল পরপর বৃষ্টির জোর বাড়ছে আর নৌকার তলানি কিছুক্ষণ পরপরই বৃষ্টির পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। স্বর্ণা আর আমি রদবদল করে একটু পরপরই সেই পানি সেঁচে নিচ্ছি নৌকার তলানি থেকে। স্বর্ণা ছই থেকে পুঁটিমাছের মতো মাথাটা বের করে দূরত্বটা চোখে মেপে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
— আর মিনিট পনেরো লাগতে পারে।
আমি কথার একটা গোড়াপত্তনের সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করলাম,
— আচ্ছা কারা নিয়ে যাবে মেয়েটাকে? কোন আইডিয়া আছে তোমার?
অন্ধকারে স্বর্ণার চেহেরা অস্পষ্ট। তবুও মনে হলো সে দু’হাতে হাঁটু বেষ্টন করে বসে অদূরে ছইয়ের বাইরে অলক্ষ্যে নিজের দৃষ্টিসীমা আবদ্ধ করেছে। বলল,
— হ্যাঁ আছে। যাকে আমি তন্নতন্ন করে খুঁজছি তাদের মধ্যেই একজন। তুমি চিনবে। আমাদেরই ক্লাসমেট ছিল।
— যাক, পাখি তাহলে নিজেই খাঁচায় বন্দি হবার ডাক দিয়েছে।
— পাখির মন্দভাগ্য। নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনল।
আমি মাঝির কান লুকিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
— মাঝি কি তোমার পরিচিত? চাপে পড়ে যদি সব ফাঁস করে?
— হ্যাঁ, পরিচিত। অনেক আগের পরিচিত। ফাঁস… করবেনা আশা করা যায়। কিন্তু করলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে। আমার কিছু করার নেই।
— তা তো থাকবেই না! কিন্তু শত্রুপক্ষ যদি সংখ্যায় বেশি হয়? তাছাড়া শুনেছি ওরা দু’জনে আলাদা গ্যাং গঠন করেছে! দলবল তো থাকতেই পারে। তখন বাঁচাবে কে?
— উপরের আল্লাহ যদি আমার হায়াত রাখে তবে কিছুই হবে না।
— তাই যেন হয়।
আবহাওয়ার বৈরিতায় প্রায় আরো মিনিট বিশেক সময় লাগলো গন্তব্যে পৌঁছাতে। নৌকা ভিড়ল এককোণে। দূর থেকেই একটা ক্ষীণ আলোকচ্ছটা চোখ-গোচর হয়েছিল আমাদের। যতোই দূরত্বটা কমলো আনুপূর্বিক আলোর বিচ্ছুরণের আকারটা ক্রমেই চোখের পর্দায় বিশাল হতে লাগল। আমরা নিঃশব্দে পাহাড়ের কায়া দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরে বেয়ে উঠতে লাগলাম। পূর্ব অনভিজ্ঞ এই পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য ঝুরঝুরে পাথরের আদিবাস। যেগুলো আমাদের আনকোরা হাতের থাবার সংস্পর্শে এসে নিজেদের বাসভূমি থেকে চ্যুত হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পতিত হচ্ছে বুকভরা নিসীম বেদনা নিয়ে। বিশেষত স্বর্ণার কষ্টটা বেশি; কারণ, তার কাঁধে একটা অস্ত্রের ব্যাগ। ভারী ব্যাগসহ এমন ভঙ্গুর অসংলগ্ন পাথরের পাহাড়ের গা বেয়ে উঠা নিতান্তই সহজলভ্য কোন বিষয় নয়। আমাদের বর্তমান লক্ষ্য সেই আলোর উৎসটাকে ঘিরে। নিশ্চয় ওখানেই তাদের আস্তানা। অল্প কতটুক উঠার পর দু’জন থমকালাম। পাহাড়ের খাঁজে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে বন্ধুক হাতে। আমাদের নির্ভেজাল দৃষ্টিতে লোকদুটোর টহলের অবয়বটা পরিস্ফুট হয়েছে মাত্র। আমি নড়ার সুযোগ পেলান না। কোনমতে মাথাট ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাত ছুটলেই পাহাড়ে পাদদেশে মাঝির কাছে পগারপার হবো এতে সন্দেহ নেই। স্বর্ণার দেয়া পিস্তলটা আমার কোমরে গুঁজানো ছিল। স্বর্ণা অতিসাবধানে সেটা এক হাতে নিয়ে দুই দাঁতের পাটির মাঝখানে চেপে বুলেট সেট করল। পরক্ষণেই ঠাশঠাশ দুইবার শব্দ হলো। নিখাঁদ নিশানা স্বর্ণার। সঙ্গে সঙ্গেই লোকদু’টো চাপা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে কাটা মুরগির মতো তড়পাতে লাগল। মনে একটা অসংহত ভ্রমের সৃষ্টি হলো এই যে শত্রুরা গুলির আওয়াজ শুনে সতর্ক হয়ে পড়েছে। হলোও তাই। আলোক উৎসটার দিক থেকে একটা হুড়োহুড়ির শব্দ এলো। স্বর্ণা অস্ফুট বলল,
— দ্রুত এগোও। ওরা বুঝে গেছে যে আমি এসে গেছি।
আমি উত্তর না দিয়ে দ্রুত আগালাম। স্বর্ণাও সমান তালে এগোল। একটু পরেই খাঁজকাটা সিঁড়ির দেখা মিলল উপরের দিকে। এবার চলতে একটু সহজ হলো। এদিকটাতে গাছপালা-তরুলতার নিবিড়তম জড়াজড়ি। কোন খানাখন্দে কেউ বন্দুক হাতে লুকিয়ে আছে সেটা বোঝা ভারি শক্ত। ঠিক তা-ই! অজানা কারণে আজ আমার সকল কথা অবার্যতায় পদে পদে মিলে যাচ্ছে। আচমকাই একজন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমার দিকে সুবিশাল বন্দুক তাক করল। যেই বন্দুক ছুঁড়তে যাবে ঠিক তখনি আমি একটা গাছ দু’হাতে ধরে পেঁচিয়ে জাম্প করে সোজা কিক করলাম মুখে। ভিরমি খেয়ে পড়ল সে। পুরো ব্যাপারটা স্বর্ণার অগোচরেই মুহূর্তে ঘটে গেল। আচানক স্বর্ণা লোকটাকে উপুড় হয়ে যেতে দেখে তার একপা ধরে সজোরে ছুঁড়ে মারল নদীর পানিতে। ঝপ করে একটা ক্ষীণ শব্দ হলো এবং তীব্র আস্ফালন বারবার অনুরণিত হলো শুধু। নিবিড় গাছপালা আর পাথরহীন পথ হওয়ায় উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে বাকীটা পথ তেমন কসরত করতে হলো না। শুরুতেই পাথরগুলো যা একটু কষ্ট সহ্য করিয়েছিল, এই যা!
অবশেষে পৌঁছে গেলাম সেই আলো বিচ্ছুরিত হওয়ায় জায়গাটিতে। থরে থরে মশাল সাজানো জ্যান্ত গাছের কাণ্ডতে। বৃষ্টির পানিতে যাতে মশাল নিভে না যায় সেজন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। অল্প দূরে কয়েকটা পর্ণকুটির। এটাই হয়তো-বা সাময়িক কাণ্ড আখড়া। পরিবেশটা অভাবনীয় নিস্তব্ধ। স্বর্ণা চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত নিস্তব্ধতা এদের নতুন কোন চাল আমাদের ফাঁদে ফেলার। সুতরাং, সাবধান হও! তবে আমার মস্তিষ্কও অতোটা অবলুপ্ত নয় যে এঁদের দুর্বিনীত চাল ধরতে পারব না। শুরু থেকেই পুরোটা ঘোর চক্রান্ত বলে মনে হয়েছে আমার। শুধু বলার সুযোগটা মেলে নি। স্বর্ণা নতজানু হয়ে বসল আশপাশে তীক্ষ্ণ চোখ রাখতে রাখতে। চিঁ করে বেগের জিপার খুলে বের করল একটা বিশালাকার Rmg025 বের করল। গর্ত থেকে শত্রুকে কৌশলে টেনে আনার ঔষধ বোধহয় স্বর্ণার জানা ছিল। যে-ই স্বর্ণা বৃহদাকার বন্দুকটা হাতে নিল ঠিক তখনি চারপাশ থেকে পনের থেকে বিশজন লোক ছুটে এলো হুড়হুড় করে। কারো হাতে শর্ট গান আর কারো হাতে চাপাতি। অস্ত্রধারীরা ছুটে এলো আমাদের দিকে। কয়েকজনে গুলি চালাতে শুরু করল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। আমি দ্রুত জঙ্গলের দিকে সরে গেলাম। স্বর্ণা আপাততঃ এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আবডালে কারা ওঁৎ পেতে আছে সেটা দেখা যাক। স্বর্ণা একের পর এক নিখুঁত নিশানায় পাখির মারার মতো শুট করতে লাগল লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে। অস্ত্রধারীরা বুলেটের সামনে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে লুটিয়ে পড়ে তড়পাচ্ছে কাদামাটিতে। পেছন থেকে নিরস্ত্র দু’জন এলো স্বর্ণাকে আক্রমণের জন্য। শুরুতে স্বর্ণা এমন ভং ধরল যেন সে লোকগুলোকে সে দেখতে পায় নি। এরপর! এরপরই তাদের কাল নেমে এলো। দুর্বৃত্ত দু-জনেই সামন্য দুরত্ব বজায় রেখে এগুচ্ছিল। হঠাৎই স্বর্ণা কাদামাটিতে টার্ন নিয়ে কয়েক কদম পেছনে চলে গেল দু’জনের। লোকদু’টো মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য! হা বন্ধ করার সময় পেলোনা। স্বর্ণা দুটি গুলি খরচ করল। দু’জন সমান তালে তপতপ করে কর্দমাক্ত মাটির উপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গায়ের দেয়াল বেয়ে। স্বর্ণা কপট হেসে আপনমনে বলল, “কাপুরষের মতো পেছনে আঘাত আমার একদম পছন্দ না। ”
শিকারের খোয়াব’এ যখন চঞ্চল সরু চোখে চোখ বোলাচ্ছিলাম আশেপাশে ঠিক তখনি মাথার দু’পাশে দুটি বন্দুকের নল দৃষ্টি গোচর হলো। আমি ট্যারা চোখে তাকিয়ে বললাম,
— কে রে?
দুপাশ থেকে দু’জন লোক গমগম করে উঠে আমার মাথায় নলের গাঁট্টা মারল।
— তোর বাপ হালা।
আমি দ্রুত পকেট থেকে কার্ড আর একটা ব্লুটুথ বের করে বললাম,
— আমি পুলিশের লোক। আর এটা হলো জিপিএস। আমাকে মারলে তোরাই বিপদে পড়বি।
লোক দু’জন ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বৃষ্টির পানিসমেত ঢোল গিল। বন্দুকের টানটান নল হয়ে গেল ঢিমে। আমি জানি, এই মুহূর্তে তাদের মানসপটে যে দৃশ্যটি ভেসে উঠেছে তা হলো তাদের পরিবারের সদস্যদের। পুলিশের হাতে বন্দি হলে তারা খাবে কি! এদের প্রত্যেকের একটা পরিবার আছে, স্ত্রী-পুত্র আছে হয়তো-বা মা বাবাও আছে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশিকিছু করতে আমার ইচ্ছে হলনা। জায়গা বরাবর দুইটা লাগিয়ে দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লাম। স্বর্ণার অভীষ্ট শিকারগুলো এরিমধ্যে কুপোকাত। ব্যাগ থেকে বুলেট লোড করছে সে। আশপাশটা আবারো জনবিরল। বৃষ্টি ঝড়ে চলেছে পুরোদমে। বর্ষা আসে মেঘের বুকের সমস্ত জল ঢেলে পৃথিবীকে শান্ত করার জন্য। পুরোদস্তুরে শান্ত না করে হুট করে কেটে পড়াও তার ধর্ম নয়। পাহাড়ে গণ্ডি বেয়ে বৃষ্টির জল বিস্রুত হচ্ছে নিচের দিকে। আচমকা আধো আঁধারের বুক চিড়ে একটা ক্ষীণ কণ্ঠে চকিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম আমরা। আবার কণ্ঠটা ভেসে এলো,
— স্বর্ণা দিদি! স্বর্ণা দিদি! পরক্ষণেই গোঙানির শব্দ। স্বর্ণা একমুহূর্ত ব্যয় না করে ছুট দিল শব্দোৎস্য লক্ষ্য করে। দেখাদেখি আমিও ছুটলাম পিছু পিছু। ঘরে ঢোকামাত্রই মনে হলো কেউ আড়ালে সরে গেল দ্রুত। ঝুমুকে বেঁধে রাখা হয়েছে কুটিরের একটা বাঁশের সঙ্গে। তার মুখে কাপড় গুঁজানো। ঠোঁটের কাছ দিয়ে লালা ঝরছে টপটপ করে। আতঙ্কিত চোখজোড়া বিস্ফারিত। স্বর্ণা তড়িৎ ছুটে গিয়ে হাতের বাঁধন খুলে দিলো। সাথে সাথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ধাক্কায় ঝুমুকে সহ ভূলুণ্ঠিত হলো সে। এই দুই মূর্তি আমার চেনা। আমাদেরই ক্লাসমেট ছিল কোন একটা সময়। নাম আলতাফ। আমি আধো অন্ধকারে গুলি ছুঁড়লাম দু’জনের পা লক্ষ্য করে। একজন ককিয়ে উঠল এবং পরমুহূর্তেই কুটিরের একটা বেড়া বিদীর্ণ করে পালাল একজন। অন্যজনের পায়ে গুলি লাগেনি। সে আবছা আলোয় কোনমতে ঠাউর করে স্বর্ণার চুল মুঠো করে ধরে গানের নল ঠেকাল মাথায়। এরপর রাগে গনগন করে বলল,
— আর একটাও গুলি চালাবি না। চালালে একে উড়িয়ে দেব। তোর প্রাক্তন প্রেমিকা! বলে রাজ্যজয়ের হাসি হাসল সে।
তখুনি বিশ্রি জুতোর শব্দ করে কুটিরে প্রবেশ করো আরো গুটিকয়েক বন্দুকধারী। আমি চকিতে প্রতিশোধপ্রবণ হলাম। দাঁত খিঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম তাদেরদিকে। ফটাফট গুলি চালাল দুর্ধর্ষরা। আত্মরক্ষার্থে আমি ডাইভ দিয়ে আরো অন্তিকে পৌঁছে গেলাম তাদের। হাঁটু ছিলে গেল ফস করে। পরোয়া করলাম না। বিনা ওজরে মানুষ মারার সাহস আমি অর্জন করিনি। তাই নিজের কাছে পিস্তল থাকার সত্বেও সেগুলো কাজে লাগালাম না। ডাইভ দিয়ে কাঁকড়ার মতো দুজনের পা আঁকড়ে ধরে মিনিট আধ চারপাশে ঘুরিয়ে বাকীদের পরাস্ত করলাম নিমেষে। আচমকা আক্রমণে বন্দুকধারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
স্বর্ণার মাথায় এখনো পিস্তলের নল ঠেকানো দৃঢ়ভাবে। আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে। এবার সে গগনবিদারী হুমকিধামকি শুরু করল,
— খবরদার সামনে আসবি না। পেছনে দেখ।
আমি পিছনে তাকালাম। আরো দশ থেকে পনের জন অস্ত্রধারী আমার খুব কাছে অস্ত্র তাক করে আছে আমার দিকে। আমি দু-হাত কান বরবার তুলে হাঁটার গতি মন্থর করলাম। এবার হে দিগ্বিজয়ের মতো হেসে স্বর্ণার ঘাড়ের কাছে মাথা নিয়ে বলল,
— এবার? হা-হা-হা, যাক ভালোই। অনেকদিন ধরে ক্ষুদার্ত আমি। আগে তো বেশ কচিকাঁচা ছিলি। এখন পাকা।…আগে ছয়জন এখন একা।… বাহ মিলে গেল কথাটা।
সে ঘাড় তুলে আমার দিকে আমার দিকে তেরছাভাবে তাকিয়ে বলল,
— তুই কবিতা লিখতি না? কেমন হলো বলতো?
আমি কিছু বললাম না। জলন্ত উনুনের মতো চোখ করে তাকিয়ে রইলাম শুধু। স্বর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে সুযোগ খুঁজতে লাগল আক্রমণের জন্য। সে এবার স্বর্ণার উদর পেঁচিয়ে ধরে বলল,
— তুমি আর আমি পাহাড়ের চূড়ায়, এসো আবার মাতি আদিমখেলায়। এরপর লোকগুলোকে ইশারা দিয়ে বলল, “নিয়ে যা একে।”
ঠিক তখুনি এক বিষম কাণ্ড ঘটে গেল। ঝুমু এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে আলতাফের হাতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। আলতাফ স্বর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে নেড়ি কুকুরের মতো কেঁউকেঁউ করে উঠল ব্যথায়। সেই সুযোগেই স্বর্ণা অকাতরে মাটি থেকে নিজের বন্দুকটা কুড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার পিছনের লোকগুলোর ওপর। আমি এগোলাম অলতাফের দিকে। ঝুমু বিষচোখে তাকিয়ে আছে এখনো আলতাফের দিকে। আলতাফ ব্যাথায় হাতড়ে ঝাঁকাচ্ছে বারংবার আর কাঁপা হাতে পিস্তলটা হস্তগত করার চেষ্টা করছে। আমি পা দিয়ে ঠেলে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিলাম। এরপর তার মাথাটাকে মনে মনে ফুটবল এবং নিজেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো মনে করে একটা কিক করলাম নিজের সর্বশক্তি দিয়ে। ভিরমি খেয়ে পড়লো আলতাফ। অপরদিকে স্বর্ণার কাছে পর্যুদস্ত হয়ে লুটিয়ে আছে শত্রুপক্ষের সারমেয়রা। আমার পাশে এসে দাঁড়াল স্বর্ণা। আলতাফ সকাতরে একবার হাতজোড় করে স্বর্ণার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল,
— মারিস না ভাই আমাকে। আমি কিছু করি নাই। আমার ভুল হয়ে গেছে।
স্বর্ণা মুখ বাঁকিয়ে হেসে বলল,
— নাহ, তোকে এতো সহজে মারবনা আমি। এতোগুলা মারার পর তোকে মারলে আলাদা কোন অনুভূতি পাবনা। চল আমার সঙ্গে। তোকে জামাই আদর দিয়ে সুস্থ করে তবেই মারব।
আলতাফ তবুও কাঁইমাই করতে লাগলো উপুড় হয়ে। হঠাৎ সে পড়ে থাকা একটা পিস্তল কুড়িয়ে স্বর্ণার দিকে নিশানা করে চালাল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু গুলি চলল না। আলতাফ ট্রিগার চেপেই চলেছে, কিন্তু পিস্তল গুলিশূন্য। স্বর্ণা ফিচেল হেসে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বলল,
— ঢেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে।
নৌকা চলছে ঢিমেতেতালে। বাতাসে জোর নেই, পানিতে টান নেই। মন ব্যাজার করা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছে নদীর বুকে। ঝুমু ছইয়ের বাইরে বসে আছে আলতাফের কোমরে জড়ানো দড়িটা টানটান করে ধরে। একটু পরপর গরুর মতো টান দিয়ে রাগ মিটাচ্ছে ঝুমু। আলতাফ হাবুডুবু খেতে খেতে নিরন্তর সাঁতরে চলেছে নৌকার পিছুপিছু। মাঝে মধ্যে উল্টো দিকে পালিয়ে যেতে চাইলে ঝুমু জোরে টান দেয় দড়িতে। সে বোধহয় বুঝে গেছে জীবনের খাতাটা তার শেষ হতে চলেছে পূর্ববর্তী কঠিন পাপের ফল হিসেবে। এখন শত কাকুতি মিনতিতে কারো হৃদয়ের পাষাণ পাথর গলবে না সেটা তার বিলক্ষণ জানা। তবুও বাঁচার জন্য সে কি করুণ আকুতি! একই মিনতি স্বর্ণাও করেছিলে সেদিন স্ব সতীত্ব রক্ষায়। কিন্তু কেউ স্বর্ণার মুখের অসহায়ত্ব দেখেনি। কামুক চোখে দেখেছে। কথা শোনেনি কেউ! আজ সে মানুষটির ওপর উত্তরোত্তর আঘাতে হৃদয়টা যখন প্রস্তরীভূত তখন অনুনয় বিনয়ে কর্ণপাত করার প্রশ্নই আসে না। স্বর্ণা হেঁকে বলল,
— ঝুমু, বৃষ্টি পড়ছে। ভেতর চলে আয় দড়িটা বেঁধে।
ঝুমি গোঁ ধরে বলল,
— না দিদি যাবনা। ব্যাটা কত খারাপ কথা বলেছে আমাকে…
— তোকেও বলেছে? গায়ে হাত-টাত দেয় নি তো?
— সে সময় কি আর পেল? তোমরা চলে এলে যে!
স্বর্ণা অন্ধকারে নিশ্চিন্ত চিত্তে হাসল। দু’জনের শরীর ভিজে জবজব করছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,
— পুলিশ জানলে?
গ্যাড়াকলে পড়েও স্বর্ণা হাসল শব্দ করে। ঝুমু একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করল। আমি কপাল সংকুচিত করে জিজ্ঞেস করলাম,
— হাসছ কেন?
— কিছু না এমনেই। ঐ পাহাড়ে পুলিশ কী করতে আসবে? যদি-ও কোন ইনফরমেশন পায় তবে আসতে পারে। আর তুমি একটা বোকাসোকা ছেলে দেখি। পুলিশ আজ পর্যন্ত আমার কিছু করতে পারলনা। আল্লাহ না চাইলে পারবেও না। তবে সবকটাকে শেষ না করে ধরা আমি দিচ্ছি না।
— সে তো পুরোনো কথা। এখন যদি তোমাকে ধরে নিই আমি?
— তোমার সেই সাধ্য আপাতত নেই। কারণ আমি এখন তোমার থানার বাইরে অন্য একটা থানায় আছি।
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
— সব মাথায় থাকে দেখছি।
— রাখতে হয়।
আমি না বোঝার ভান করে বললাম,
— হু?
— রাখতে হয়…
ঘাটে পৌঁছুতে পৌঁছুতে আলতাফ মৃতকল্পের ন্যায় হাত পা ছড়িয়ে দিয়েছে। এতোদূর পথ পানি খেতে খেতে সাঁতরানোর ফলে পেট হয়েছে ফুলে ফেঁপে ডিম্বাকৃতির। ডাঙায় এসেই গলগল করে পেটের সব পানি উগরে দিলো সে। তবুও ছাড়াছাড়ি নেই। স্বর্ণা কোমনতে টেনেহিঁচড়ে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হাত পা বেঁধে ফেলল আলতাফের। আমি রুমের বাইরেই ছিলাম। ঝুমু নিজের ঘরে চলে গেল। বাঁধা শেষে স্বর্ণা ঘরে দরজা দিয়ে থেকে বেরিয়ে এলো। আলতাফ বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল আর ফুঁসফুঁস করল কিছুক্ষণ।
রাত্রি তখন বারোটা। গোসল করে কাপড় চেঞ্জ করতে করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। স্বর্ণা আলতাফকে শুকনো পাউরুটি খাইয়ে বেরিয়ে এলো এইমাত্র। আলতাফও নির্দ্বিধায় সবকিছু মেনে চলছে। কারণ তার বিশ্বাস তাদের দলের কেউ না কেউ বাঁচাতে আসবেই তাকে। একথা সে বাঁধার সময়ই দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে আওড়েছে বারবার। জবাবে স্বর্ণা একটুও প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। বরং কুটিল হেসেছিল শুধু। আমি দেখে বললাম,
— বাহ্ সত্যি সত্যিই দেখি জামাই আদর করছ।
স্বর্ণা খটোমটো করে হেসে বলল,
— হ্যাঁ, আধমরা মানুষকে মেরে কি খায়েশ মেটে? তাই খাইয়ে দাইয়ে তাজা করছি। বোলার যেমন ব্যাটসম্যানকে নার্ভাস করে দিয়ে আউট করতে ভালোবাসে। আমিও তেমন শিকারগুলো তরতাজা রেখে উপড়ে দিতে ভালোবাসি। নইতো রক্ত আমার টগবগ করতেই থাকবে।
আমি কিছু বললাম না এই নিয়ে। অনেক্ষণ চুপ করে রইলাম দু’জনে। পাশাপাশি হেঁটে স্বর্ণা চলে এলো আমাকে থাকতে দেওয়া রুমে। দু’জনে পাশাপাশি বসলাম সামন্য দূরত্বে। আমার মাথার ভিতর চিন্তার ঝড় বইছে। সেদিনের ঘটনা অর্থাৎ স্বর্ণার বাবা মা’র সঙ্গে দেখা করার কথা এখনো জানানো হয় নি স্বর্ণাকে। কীভাবে শুরু করব সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। একটা অনাহূত জড়িমা কাজ করছে নিজের ভেতর। আমার চিন্তিত মুখের ভাঁজ লক্ষ্য করে স্বর্ণা শুধালো,
— কী নিয়ে চিন্তা করছ?
আমি ফস্ করে বলে ফেললাম,
— তোমাকে কিছু কথা বলা হয় নি।
স্বর্ণা তাকালনা। ছোট করে বলল,
— কী কথা?
আমি একটু সময় নিয়ে বললাম,
— আমি যখন চট্টগ্রামে ছিলাম তখন তোমার বাবা মা এসেছিল আমার কাছে।
স্বর্ণা তাকাল। গভীরভাবে। এরপর লেফাফাদুরস্তের মতো কঠিন গলায় বলল,
— কেন এসেছিল ওরা?
আমি ডানহাত স্বর্ণাকে শান্ত করার প্রয়াসে উঁচিয়ে বললাম,
— বলছি…। ওনাদের আসলে ভুল বুঝানো হয়েছে। ঘটনার দিন সকালে এসে তোমার নামে নানা অপবাদ দিয়ে গেছে ওরা। যার ফলে তোমার বাবা মা তোমাকে ভুল বুঝেছিল। আমার কাছে এসে সব বলেছে ওনারা। যদিও আমি খুব একটা ভালো বিহেভ করি নি তখন। কারণ টা তুমি জানো। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পেরেছে যে তুমিই প্রতিশোধ নিচ্ছ এখন।
স্বর্ণা স্বপ্নাচ্ছন্নের আবিষ্ট হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। ধীরে ধীরে সেখান থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
— তো? তুমি তাদের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছ এখন? ভেবোনা… জানি ক্ষমা মহৎ গুণ। কিন্তু সেই গুণ আমার নেই। যেই নরকযন্ত্রণা আমাকে তারা ভোগ করিয়েছে এবার তারাও সেটা ভুগুক। তাদের উচিত ছিল বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস না করে হাতের পাঁচকে বিশ্বাস করা। তাদের হয়ে উমেদারি তুমি করতে এসো না। তবে নদীর একূল-ওকূল দুই-ই হারাবে।
আমি দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লাম না। চেপে নিয়ে বললাম,
—হারাবার শখ নেই।
স্বর্ণা খ্যাঁচম্যাচ করে বলল,
— তাহলে চুপ করে থাকো।
আমি পলকহীন তাকালাম স্বর্ণার সদ্যস্নাত স্নিগ্ধ মুখের দিকে। এরপর আলতো করে গালে একটা টোকা দিয়ে বললাম,
— মাঝে মাঝে এমন কুঁজড়ামি স্বভাবের হয়ে যাও কেন?
— খারাপ লাগে? ভ্রুকুটি করে টিপ্পনি কাটল স্বর্ণা।
— ভালো লাগে। – দুই ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে বললাম আমি।
স্বর্ণা চোখ ঘুরিয়ে নিল।
— জানি কেমন লাগে। নিজের চোখেই তো দেখলে কেমন বিনা সংকোচে মানুষ মারি আমি। আমার কোন নিশ্চয়তা নেই। তবু কেন পিছে পড়ে থাকো আমার? জানোই তো তোমার সংস্পর্শে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনা। কেন বারবার দুর্বল জায়গাটাতে আঘাত করো বলো? কিসের মোহে পড়ে আছ বলতে পার? কতদিন আর এভাবে? ওদের মতো? “খেয়ে ছেড়ে দেব “এমন ভাবনা না তো?
আমি চকিতে স্বর্ণার দুই ঠোঁটের মাঝখানে আঙুল ঠেকালাম। স্বর্ণা ছলছল চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকাল। চোখাচোখি তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ দুটি প্রাণ। আমি হালকা ঠোঁটদুটো নেড়ে বললাম,
— বাজে কথা কেন বলো?
— বাজে মেয়ের মুখে ভালো কথা কীভাবে প্রত্যাশা কর?
স্বর্ণার চোখের পক্ষ্মডৌল বারকয়েক কেঁপে ওঠে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল স্বচ্ছ জল। সঙ্গে সঙ্গে আবারো চক্ষুনদী জ্বলে ঢলঢল করে উঠল।
বাইরের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিটা আবারো ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে খানিক আগে। স্বভাবজাত শ্রাবণের মেঘ পৃথিবীকে হুংকার দিচ্ছে নিজের অহমিকায় সংক্ষুব্ধ হয়ে। অদূরে কোথাও বন্য শেয়ালের দল একতাবদ্ধভাবে ডাকতে শুরু করেছে। নিকটে অকৃত্রিম ঝর্ণার অনবরত সুমিষ্ট কলকল ধ্বনি আর প্রকৃতির কাছে আসার খেদহীন উদাত্ত আহ্বানে মুখরিত চতুষ্কোণ। আমার প্রশস্ত উরুতে নিজের সিক্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে স্বর্ণা। ঘননিবিড়ি চোখের পাপড়িগুলো অবাধ্য চোখের জ্বলে বিপন্ন। তা সত্ত্বেও আদুরে দেখাচ্ছে তাকে।
স্বর্ণার চোখে আরেকটি হত্যা, অতঃপর? অতঃপর বুকভরে ‘ভালোবাসি’ বলার অমোঘ আশা। আর আমি সেটি শোনার অপেক্ষায় উদগ্রীব। স্বর্ণা বোধকরি আমার মনের গুহ্য চাওয়াটা বুঝতে পেরেই ফিসফিসিয়ে বলল,
— যদি বলো আজীবন নিখাঁদ ভালোবাসায় আমায় ভরিয়ে দিতে পারবে তবে আমি তোমারই রবো। যদি একজন ধর্ষিতাকে সঙ্গিনী করার প্রস্তুতি তোমার থেকে থাকে তবে আমি বাঁধা দেবনা। কিন্তু অনেক কষ্ট সয়েছি, এরপর আর পারব না। কষ্টের পাল্লাটা ভারী থেকে হালকা করার দায়িত্ব তোমারই উহ্য। রাজি?
প্রতিত্তোরে আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম,
— রাজি!
চলবে…