#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৩
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
— কী ভাবছেন?- রহস্যজনক ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে জুহি।
আমি খানিক বিচলিত হয়ে বললাম,
— তেমন কিছু না। দু’দিন স্বর্ণার সঙ্গে কাটিয়েছি কে বলল তোমাকে?
জুহি ছদ্ম-বিস্ময়ে দুই হাত উল্টে বলল,
— কে আর বলবে? আপনি নিজেই তো বলেছিলেন? মনে নেই?
নিজের খ্যাপামিতে নিজেই লজ্জিত হয়ে বাঁ হাতে মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বললাম,
— তাইতো! তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য বলেছিলাম ছোট করে, মনেই নেই!
— হু, সেটা নিয়েই কথা বলছিলাম। আমাকে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন?
আমার চোখ খাবারের প্লেটে। জুহি কথাটা বলে গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে উপলব্ধি করতে পেরেও আপাতত গলাধঃকরণে মনোযোগী আমি। এ ক্ষেত্রে মেয়েলী হাতের মুখরোচক খাবার থেকে মুখ তোলা অসম্ভব। তবুও শিং মাছের দাঁড়াটা ফেলার সুযোগে সংক্ষেপে বললাম,
— নাহ।
জুহি বোধহয় আমার উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। ফট করে বলল,
— না? তাহলে আমাকে জেলাস করানো। মনে মনে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা! এসব কেন?
শুনেও আমি না শোনার ভান ধরে চুপ করে রইলাম। এবার যে খাবারের উৎকর্ষতায় মুখে তালা পড়েছে সেটা কিন্তু নয়। বলা যায়, যুক্তিযুক্ত জবাবের অভাবেই খাবার উদরসাৎ এর ছলে চুপচাপ স্বননহীন খেয়ে যাওয়া। বালির বাঁধের মতো অস্থায়ী জুহির ধৈর্যশক্তি। এবার সে খানিক চড়া গলায় অন্যদিকে ফিরে স্বগতোক্তি করল, কথা বলতে সমস্যা হয় বোধহয়!
অন্যদিকের কথা অন্যদিকে উড়ে যাবার প্রয়াস করতেই আমি সেটা নিজের গায়ে টেনে নিয়ে বললাম,
— যে গলা দিয়ে খাবার নামে সে গলা দিয়ে কথা বের হয় কী করে?
— এখন কীভাবে বেরোল?
— অনেক কষ্টে…
— ঠিক আছে, আগে খান। পরে কথা বলবেন।
খাওয়া শেষ করলাম একটু অতিরিক্ত সময় গচ্চা দিয়ে। যা আমি কস্মিনকালেও করার ফুরসত পাই না। আজ করতে হলো জুহির অহেতুক প্রশ্নের উত্তরগুলো আগে থেকেই তৈরি করে রাখতে রাখতে। এঁটো খাবার আর টিফিন ক্যারি গুছাতে গুছাতে জুহি বলল,
— এবার শোনেন আসল কথাটা।
আমি গভীর মনোযোগের ভঙ্গিতে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বললাম,
— হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, শুনছি।
টিফিনক্যারিটা বাঁধার ব্যস্ততায় জুহি ক্ষণকাল নিশ্চুপ রইল। এরপর গম্ভীর হয়ে বলল,
— আমি জানি আমার দেয়া চিঠিটা আপনি পড়েছেন। কিন্তু তখন আমি অন্ধকারে ছিলাম। এখন আলোর পথে এসেছি। চিঠি দেওয়ার পর থেকেই আমার সাথে আপনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন, এটাও আমি খেয়াল করেছি। তাই সবার ভালো জন্যই বলছি। চিঠির কথাটা আপনি ভুলে যান। চিঠি দেওয়ার সময় আমি স্বর্ণার কথা ভাবি নি। ভাবিনি আপনার একজন খুব কাছের কেউ আছে। পরে যখন আমার ভুল ভাঙল তখন আমার কিছু করার ছিল না। আজ সাহস করে বলছি, আপনি আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না। স্বর্ণাকে নিয়েই আপনি খুশি,সুখী থাকুন এটাই আমি সর্বান্তকরণে চাই। তবুও এভাবে বারবার এড়িয়ে আমাকে কষ্ট দিবেন না। কথা দিচ্ছি, আপনাদের মাঝে কখনো আমি কাটা হয়ে দাঁড়াব না। বরং আপনাদের সমস্ত বিপদ-আপদে নিজেকে উৎসর্গ করব। একটা কথা মনে রাখবেন, জুহি আত্মসংযম করতে জানে। আপনাদের ক্ষতি সে চাইবে না কখনো। ক্যাম্পে যে জুহিকে আপনি চিনতেন,জানতেন আজ থেকে সেই চোখেই আমাকে দেখবেন। উঠি আজ…।
এতোদিনে সবার অগোচরে বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটার যেন গড়গড়িয়ে নেমে বহুদূর চলে গেল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
— চিন্তা করো না। তুমি আমার কাছে আগের জুহি-ই রয়ে গেছ।
জুহি অনেক কষ্টে মুখ টিপে হাসল। এরপর হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখামাত্র মুখটা কালিবর্ণ হয়ে গেল তার। চট করে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— যাই। কাল দেখা হবে। অনেক সময় হয়ে গেছে।
ঘাড় বাঁকিয়ে দক্ষিণ পাশের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই। ইশশ্!নির্জন রাস্তায়-ঘাট পেরিয়ে বাসায় পৌঁছুবে কি করে জুহি! সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
— চলো পৌঁছে দিয়ে আসি তোমাকে।
জুহি ব্যস্ত হয়ে বলল,
— না না, লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব। কোন সমস্যা নেই।
আমি খসখসে গলায় ধমকি দিয়ে বললাম,
— আহঃ চুপ থাকো তো, চলো।
বলে দাঁড়ালাম না আমি। গটগট করে সামনে এগোলাম। নিরুপায় হয়ে জুহিও আমার পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দু’জনে।
জুহিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে পুনরায় ফিরে আসতে আসতে রাত প্রায় একটা বেজেছিল সেদিন। অবান্তর একটা চিন্তা হতে মাথা থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ায় সে রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়েছিল আমার। একেবারে গভীর নিশ্চিন্ত সুষুপ্তি।
দিনগুলো এখন গত। দিন গিয়ে রাত আসে রাত গিয়ে ভোর। পৃথিবী তাঁর আপন গতিতে আবহমান। সঙ্গে মানুষগুলোও নিজ নিজ অবস্থান হতে নিজস্ব কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে তাল মিলিয়ে।……………………।
আজ ডিউটি নেই। অর্থাৎ ছুটির দিন। চার কি পাঁচদিন হলো চট্টগ্রাম থেকে মা এসেছে সিলেটে। শরীর-তবিয়ত ঠিক নেই। ডায়বেটিসের মাত্রা ছাড়িয়ে বেহাল অবস্থা। সঙ্গে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। বাবা ঢাকায় ব্যাবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মাকে নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চাইলেও মা চট্টগ্রাম থেকে আমার কাছে আসার ইচ্ছে পোষণ করেছে বিধায় বাবা এসে দিয়ে গেল। আমার সিলেটে আসার শুরু থেকেই মা এখানে আসতে চেয়েছিল। থাকা-খাওয়ার অসুবিধে হবে বলে নিয়ে আসার সাহস, ইচ্ছে কোনটিই হয়নি। এবার আর না করা গেল না। গত পরশু ডাক্তার দেখানোর পর থেকে এখন কিছুটা সুস্থ তিনি। কিছুটা নয় বরং পুরোপুরি সুস্থ। দিব্যি খাচ্ছে, পরছে, ঘুমোচ্ছে। এধরণের রোগগুলোর চেহারা গিরগিটির মতো উগ্র। চোখের পলকেই রংবদল করে জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। মূল ফটকের উপর ঝুলানো বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে একখানা বই পড়ছিলাম পঞ্চইন্দ্রীয় এক করে দিয়ে। এরকম পরিবেশে বই পড়তে বেশ লাগে। গতকাল একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় আজ সকাল সকাল জেগে গেছি। এইতো কিছুদিন আগেই বর্ষা বিদায় নিল বিষণ্ণ মুখে। এর পরপরই শরৎ এসে আনন্দের মল বাজাচ্ছে প্রকৃতিজুড়ে। ঝিরিঝিরি ফিনফিনে বাসাতে আকাশের কোণে কোণে ভেসে বেড়াচ্ছে সারি সারি সফেদ মেঘের ভেলা। ঘিঞ্জি ঝোপঝাড়ে ঘেরা রাস্তার দুপাশের শেফালী ফুলের গাছ নুইয়ে আছে রাস্তার ওপর;রাস্তায় সারি সারি বিছানো সাদা শিউলি ফুল। আঁটসাঁট গড়নের একটা সাত কি আট বছরের মেয়েশিশু ঝুলিভরে সেই ফুল কুড়চ্ছে। দূর থেকেই রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াবার জন্য মেয়েকে ডাকাডাকি করছে তার মা। মাঝেমধ্যে আধঘুমন্ত রাস্তার বুকের ওপর শাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। অকস্মাৎ আমার চোখের তারায় বিকশিত হলো একটি চেনা মুখ। জুহি! সেও মেয়েটার সঙ্গে ফুল কুড়চ্ছে ঈষৎ ঝুঁকে। পরনে মার্জিত পোশাক। এরপরও হঠাৎ ফুল কুড়াতে নিচে নুইতে গিয়ে বুকপথ অসংবৃত হয়ে পড়েছে। আমি প্রথমে চোখ ফিরিয়ে নিলাম এবং পরক্ষণেই সতর্কসূচক হেঁকে বললাম,
— হেই,জুহি!
জুহি আমার কণ্ঠে নিহিত ধার বুঝতে পারল না ঠিক। তবে আপনিই বুঝতে পেরে সামলে নিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে আমার বারান্দার নিচে এসে দাঁড়াল হাসিমুখে।
— ডাকলেন যে!
আমি বইটা বন্ধ করে কোলের উপর রেখে বললাম,
— এমনিই, কোথাও যাচ্ছ নাকি?
জুহি হেসে বলল,
— আমিতো প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাই। কিছু ভালো লাগলে কিনলাম, নাহলে ঘুরে চলে এলাম। আমাকে তো কখনো এতো সকালে এই বারান্দায় দেখি না। ডুমুরের ফুলের মতো হঠাৎ দেখা দিলেন। কী ব্যাপার হে!
— ব্যাপার কিছু না। কাল একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার বেশি ঘুমোতে পারি না। তাই সকাল সকাল উঠে পড়েছি।
— ওহহ, নাশতা করেছ?
দুতলার বারান্দা থেকে নিচে বাক্য ছোঁড়াছুড়িতে কথাবার্তা বেশ জোরেই হচ্ছিল। বোধহয় আশেপাশের কয়েকটা বাসার মানুষদের সাতসকালে ঘুম ভাঙানোর মতো মহৎ কাজ এরি মধ্যে হয়ে গেছে। সেটা মুষ্টিমেয় ধারণা হলো হঠাৎ মায়ের উপস্থিতিতে। সাধারণ সকাল সকাল মা উঠলেও আমার ঘরে আসে না। মা’কে দেখে জুহি না পারল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে আর না পারল স্বাভাবিক থাকতে। মুখটা অস্বাভাবিক রকমের হাঁ করে উঁচিয়ে উপরে আমাদের দিকে বজ্রাহতের ন্যায় তাকিয়ে রইল। মনে হলো এই মাত্র ঝকঝকে সকালেও আকাশ ফুঁড়ে একটা বজ্র এসে হানা দিল তার সর্বাঙ্গে। মা খানিক ঝুঁকে জবাব দিল,
— নাশতা এখনো করা হয়নি। কেন মা? তোমার কাজ চাই বুঝি?
আমি মা’য়ের শাড়ির আঁচলে হালকা টান দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
— হচ্ছেটা কি মা! ও তো পুলিশ। কাজ লাগবে কেন?
— তুমি চুপ কর। এরপর আবার আগের মতো ঝুঁকে জুহির উদ্দেশ্যে বলল,
— তুমি পুলিশ? আসো তবে। আমার ছেলেও পুলিশ, পুলিশে পুলিশে মিলে যাবে। আগে থেকে পরিচয়?
জুহি অপ্রতিভ হেসে মাথা নেড়ে থেমে থেমে বলল,
— কো কো কোথায় আসব?
— ওপরে উঠে এসো।
জুহি তেলতেলে হেসে মাথা কাত করে বলল, — আচ্ছা!
বলে রাস্তার পাশ থেকে গেটে প্রবেশ করল সে।
সকালটা যেভাবে শুরু হয়েছে মনে হয়েছিল ভালোই কাটবে দিনটা। কিন্তু কোন কুলক্ষণে যে সেধে জুহিকে ডাকতে গিয়েছিলাম সেটাই মাথায় ধরছে না। ধ্যুর!
— কী হলো? মুখটা ডেকচির তলার মতো কালি করে আছ কেন? সুমুখের ছোট টেবিলটাতে বসতে বসতে সহর্ষে বলল মা।
আমি ইঙ্গিতে বাইরে দেখিয়ে দিয়ে রগরগে গলায় বললাম
— মেয়েটাকে ডাকলে কেন? পুরোই বিরক্তিকর!
— ভং ধরো না? বিরক্তিকর হলে ফুল কুড়ানোর সময় ডাকলে কেন?
আমি আর সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
— উফফ, সব দেখে ফেলল বুড়ি। কখন এসে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে।
মিনিট কয়েক পর জুহি ঘরে এসে ঢুকল। লক্ষ্য করে আমি পুনরায় বই পড়ার মনোযোগ দিলাম। মা মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল,
— নাম কী তোমার? ওভাবে ডেকেছি কিছু মনে করো না।
জুহি সবেগে মাথা নেড়ে জিভ কাটল। একচিলতে হেসে বলল,
— না না আন্টি কি মনে করব। ওনি আমার সিনিয়র অফিসার, ট্রেনিংএ আমরা একসাথেই ছিলাম। সেখান থেকে পরিচয়। ভাগ্যক্রমে দু’জনে একি জায়গায় আবার একি থানায় এসে পড়েছি।
মা এবার ঝকঝকে হেসে বলল,
— সবি ওপরওয়ালার ইচ্ছে। হয়তো ওনি চান তোমাদের মাঝে যোগাযোগ থাকুক। না-হয় এমন সৌভাগ্য কার মেলে!
আমি মুখের উপর থেকে বইটা কিঞ্চিৎ সরিয়ে চোখ পাকিয়ে মাকে বুঝিয়ে দিলাম যে,”তুমি বেশি কথা বলছ”
আমার মনের নিহিত আরশি যেন মা স্বচ্ছ চোখে দেখতে পেয়ে পুরোপুরি কথার বাঁক ঘুরিয়ে বলল,
— ঠিক আছে, তুমি বসো। আমি চা করে আনছি।
জুহি বাঁধ দিয়ে বলল,
— না আন্টি আমি চা খাব না। আপনি কষ্ট করবেন না। বরং আপনি বসুন আমি চা করে দিচ্ছি। মুখ দেখেই বোঝা যায় আপনাদের পেটে কিছু পড়েনি এখনো।
জোরাজুরির যুদ্ধে জুহিই জয়ী হলো। বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় একছুটে চা দিতে চলে গেল সে। মা অল্পক্ষণেই জুহির সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল আচরণে মুগ্ধ-অভিভূড হয়ে পড়লেন। জুহি চলে গেলে নিজে নিজে স্বগতোক্তি করলেন, “বাহ! মেয়েটা বেশ ভালো তো! এরপর অচিরাৎ আমার দিকে সরু দৃষ্টিপাত করে বলল,
— চালচলন দেখে মনে হচ্ছে এখানে আগেও অনেকবার এসেছে। পছন্দ করো নাকি?
আমার মন-মানসিকতা তখন কোন স্থূল রসিকতা কিংবা কোন খোয়াবে ছিল না। ক্যাটক্যাট করে বললাম,
— আমি স্বর্ণাকে পছন্দ করি মা! বিয়ে আমি ওকেই করব। অযথা যাকে তাকে পছন্দ করোনা পরে নিজেই কষ্ট পাবে।
মা বিস্ময়ে এবং ক্ষুন্ন হয়ে বলল,
— সে যে খুনি! পুরো দেশ না জানলেও ওর মা -বাবা আর আমি জানি। তুই আরো ভালো করে জানিস। এসব কী বলছিস তুই? এটা কখনো সম্ভব? কোনদিন না পুলিশের গুলিতে মরে সে!
শেষের কথাটা যেন শরবিদ্ধ তীরের ফলার মতো গিয়ে বিঁধল বুকে। কোনপ্রকার নিজেকে সংবরণ করে চাপা আর্ত স্বরে ডাকলাম, ‘মা!’
অন্যান্য সময়ের মা ডাকের সঙ্গে এই ‘মা’ ডাকের পার্থক্যটা বিস্তর! মা চমকিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকাল আমার দিকে। বোধহয় তাঁর শেষ কথাটার মতো আমার অনৈসর্গিক ‘মা’ ডাকটা তাকে বিঁধেছে। হয়তো-বা মনে মনে ভাবছে, মাত্র কয়েকদিন আগে ফিরে পাওয়া মা বেশি আপন নাকি বাল্যকালের সহচর স্বর্ণা বেশি আপন! মনে যাই থাকুক। মা কিন্তু নিশ্চুপ নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি বললাম,
— ধরো, আমি তোমার মেয়ে। ছেলে না হয়ে আমি মেয়ে হলাম মনে করো। তখন আমি যদি স্বর্ণার মতো পরিস্থিতিতে পড়তাম। আর আমিও একে একে ধর্ষকদের হত্যা করতাম তখন কি তুমি আমাকে খুনি বলতে পারতে? নাকি বাঘিনী বলে গৌরব করতে আমাকে নিয়ে? বলো।
মা নিশ্চুপ হয়ে রইল। একটু পর তাঁর দু-চোখের কোণায় লোনা জল চিকচিক করে উঠল প্রভাতের অদিব্য সূর্যকিরণে। মা দুই ফোঁটা চোখের পানি সযত্নে মুছে নিয়ে ভাঙা স্বরে বললেন,
— বুঝিরে সব বুঝি। কিন্তু সমাজ,দেশকে লুকিয়ে তোরা শান্তিতে সংসার গড়তে পারবি? দেশের অাইন তো সব অসময়ের জন্য। সুসময়ে আইনগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই আইন কি শান্তিতে থাকতে দেবে তোদের?
আমি শূন্য দৃষ্টি মেলে ধরলাম বারান্দার গ্রিলের লোহা ভেদ করে বহুদূরে। ভেতরে জমে থাকা কিছু বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে সফেন তুলে উড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— প্রয়োজনে রাতের আঁধারে লুকিয়ে নির্বাসিত হবো। সে যে সব ছেড়ে ভালো হবার আশ্বাস দিয়েছে মা!
মা আরেক ফোঁটা চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো জুহি চা নিয়ে ফেরার আগেই। এই যে জুহির সদম্ভ পদশব্দ শোনা গেল বলে…।
সেদিন সারাটাদিন জুহিকে ছাড়ল না মা। যখন শুনল জুহি একা থাকে তখন একপ্রকার বলেই বসল যে ‘আজ থেকে তুমি এখানে থেকো’। এতো আহ্লাদিপনা সহ্য হলো না আমার। সরাসরি বললাম,
— না মা সেটা হবে না। থানার অনেকেই থাকে এই রোডে। তারা যদি জানে আমাদের একেবারে বেইজ্জত করে ছাড়বে সে তাই না কি বল জুহি?
বলে জুহির উপার্থন প্রার্থনা করে তাকালাম তার দিকে।
জুহি কালক্ষেপণ না করে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলল,
— হ্যাঁ ঠিক তাই। লোকে নানান কথা বলবে আন্টি। আমি না-হয় কয়েকদিন পরপর এসে আপনাকে দেখে যাব। সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না।
এরপরই ঘটল দু’টি অসম কাণ্ড। প্রথমটা আগে উল্লেখ করি।
জুহি যখন মুড়ির ঠোঙ্গা কোলে করে নিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে মা’য়ের সঙ্গে কথা বলছিল এমন সময় হঠাৎ মা পৃষ্ঠা উল্টে বলল,
— তা বয়স তো অনেক হলো মা। বিয়েসাদী করছ কবে?
জুহি তখন সবে একমুঠো মুড়ি মুখে পুরেছিল কেবল। মা’য়ের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জুহি বিষম খেয়ে গেল। কাশতে কাশতে দুই নাকের শ্লেষ্মার সঙ্গে দিয়ে গোটা দুই মুড়ি বেড়িয়ে এলো গলগল করে। সেই দেখে আমার হাসি থামে না কোনমতে। এদিকে আমার কুমড়োগড়াগড়ি দিয়ে বাঁধ ভাঙা হাসি আর অপরদিকে জুহির নাকে মুখে পানি আর নিরবচ্ছিন্ন কাশি। এর মাঝখানে মা বসে রায়বাঘিনীর ন্যায় ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে তাকিয়ে আছে। আমি সেই অকৈতব রোষযুক্ত চাহনি উপেক্ষা করে হাসতে লাগলাম। অবশেষে যখন জল-পানি খেয়ে জুহির কাশি থামল তখন সে তার ক্লিষ্ট আনন আরো বিকৃত করে ধাওয়া করল আমাকে। আমি ধরা দেবার পাত্র নই মোটেও। পুরোনো কবি সাহিত্যকদের ভাষায় “উর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলাম” পুরো বাড়ি ছুটতে ছুটতে আমি যখন ফ্লাটের মূল দরজা দিয়ে বেরোলাম ঠিক সেই সময়ই দ্বিতীয় অসম কাণ্ডটি ঘটল। যেটির জন্য আমি কেন? আমার শরীরে একটা লোমকূপও প্রস্তুত ছিলনা।
সমুদ্দুর পাড়ের বালুকাবেলায় যেভাবে পানির উচ্ছ্বাসিত ঊর্মিতে পায়ের তলা থেকে শিরশির করে বালকা নিঃসৃত হতে থাকে দরজা খুলে কলিংবেল চাপতে উদ্যত স্বর্ণাকে দেখে ঠিক যেন সেভাবে আমার পায়ের তলা থেকে ফ্লোর গুড়ো হয়ে সরে যাচ্ছে। নিমেষেই আমার হাস্যরসাত্মক মুখখানা হাঁড়িপানা হয়ে গেল। পিছনে জুহি চাপা রাগে লেলিহান শিখার মতো গনগন করতে করতে পিঠের উপর ধুপধুপ করে অনবরত কিল বসাচ্ছে। সে এখনো স্বর্ণাকে খেয়াল করে নি। আমি যখন মৃদু বললাম,
— তুমি? এ-সময় কীভাবে?
স্বর্ণা কিন্তু আমার পিছনে কোনো মেয়েলোকের উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুখ বোধহয় তখনো স্পষ্ট হয় নি। সে থমথমে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দু’একপা করে পিছু হটে সিঁড়ি বেয়ে নামতে উদ্যত হলো। আমি খপ করে তাঁর ডান হাতটা ধরে বললাম,
— কোথায় যাচ্ছ। মা এসেছে। ও জুহি।
স্বর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— তুমি জুহির সাথেই থাকো।
আমি আরো কয়েক পা এগিয়ে বাঁ হাতটা তার ডান কাঁধে ঘিরে ধরে বললাম,
— আগে শোনে তো যাও কী হয়েছে!
— শোনার কি আর কিছু বাকি রেখেছ? ঘরে জুহিকে নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলছ। লাফালাফি করছ। আর না জানি কত কি! – ঘৃণায় নাক কুঁচকে বলল স্বর্ণা।
জুহি স্বর্ণার আগমনের যদৃচ্ছায় একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থেকে কথঞ্চিৎ আত্মসংবরণ করে বলল,
— আরে না স্বর্ণা। কি সব ভাবছ। আমি সকালে নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আন্টি আমাকে ডেকে নিল। তুমি প্লিজ রাগ করোনা। ভেতরে এসো।
স্বর্ণাকে দেখে মনে হলো বেশ অবাক হলো সে জুহির সাহস দেখে। আমার ঘরে স্বর্ণাকে ঢোকার জন্য অনুরোধ করছে জুহি! বিষয়টা কেমন বেখাপ্পা না! তবুও রগচটা স্বর্ণা আর বাগাড়ম্বর করার সুযোগ দিল না। ঠোঁট চেপে ধরে রাগকে শাসিয়ে স্বাভাবিকভাবে ভিতরে প্রবেশ করল সে।
দরজায় ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে আমি বললাম,
— তা হঠাৎ? খবর-টবর না দিয়েই?
— তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। অন্যরুমে এসো।
মাঝখান থেকে জুহি বলে উঠল।
— আমি যাই আন্টির কাছে। তোমরা এখানেই আলাপ সারতে পার।
স্বর্ণা জুহির কথায় কর্ণপাত করল না। দ্রুতপদে আমার রুমে ঢুকে দ্ব্যর্থহীন বলল,
— তাড়াতাড়ি এসো।
আমি একবার জুহির দিকে তাকিয়ে স্বর্ণাকে অনুসরণ করে নিজের রুমে ঢুকলাম। জুহি সেখানেই প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রুমের দরজা বন্ধ করতেই স্বর্ণা ম্রিয়মাণ গলায় বলল,
— বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে মিনহাজ। র্যাব জেনে গেছে যে আমার সঙ্গে তুমি যুক্ত আছ। এই দেখো…।
চলবে…