শেষ সূচনা পর্ব-২৪

0
294

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৪
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

রুমের দরজা বন্ধ করতেই স্বর্ণা ম্রিয়মাণ গলায় বলল,
— বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে মিনহাজ। র‌্যাব জেনে গেছে যে আমার সঙ্গে তুমি যুক্ত আছ। এই দেখো…।
শুনে আমার বুকের উদ্দাম রক্ত চলাচল ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অজান্তেই অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, “হুয়াট?” কীভাবে?
স্বর্ণা হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ পায়ে এগিয়ে খাটের উপর কাটা বস্তার মতো ধপ করে বসে পড়ে দুইহাত মাথার দুইপাশের চুলে সঞ্চালন করে ইচ্ছেমতো নিঃশব্দ রোদনে চোখের পানি ফেলল কিছুক্ষণ। অতলস্পর্শ রহস্যময় এই আচরণে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কারণ জিজ্ঞেস করার মতো অবস্থাও স্বর্ণার নেই। ঠাই দাঁড়িয়ে ডবডবে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম স্বর্ণার দিকে। একটু পর আত্মস্থ হয়ে অশ্রুবিবশ কণ্ঠে বলল,
— আমার বোকামির জন্য।
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। কেমন যেন ছন্নছাড়া ভাবে আশপাশের পরিবেশটা আচ্ছন্ন হয়ে এলো। যাক্ কোনো না কোনো দিন এই দেশ,এই জাতি,এই দেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধারার জনগণ আমাকে দেশদ্রোহী বলেই জানবে। কিন্তু পরে সত্যটা জেনে বাহবাও দিবে। আলোচনা সমালোচনার অনিরুদ্ধ ঝড়ও উঠবে। তবু এতে আমার কিছু যায় আসে না। চেয়েছিলাম স্বর্ণার মতির পূর্নবাসনের পর নিজ থেকেই চাকরি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হব। যেটা চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে ঠিক, কিন্তু একটু ভিন্নতর হচ্ছে। ভালোই, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। ধীরগতিতে হেঁটে এলাম স্বর্ণার পাশে, এরপর ঠিক স্বর্ণার অনুরূপ ধপ করে বসে গম্ভীরস্বরে বললাম,
— খুলে বল। কাঁদছ কেন? ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে তো তুমি না!
স্বর্ণার চোখ মেঝেতে আটকানো। তার কচু পাতার মতো মসৃণ গাল বেয়ে আরেক ফোঁটা নোনাপানি পিছলে পড়ল মেঝেতে; বিমর্ষ গলায় বলল,
— আমি চোখের পানি তোমার জন্য। আমার জন্য তোমার সব শেষ হল। সব। আমাদের দেখা হওয়াটাই উচিত হয় নি।
আমি বিরক্তির সুর তুলে বললাম,
— উফফ্ এক কথা হাজার বার বলতে হয়? মূল পয়েন্টে এসো না।
স্বর্ণা একটা শুকনো ঢোক গিলে সবিস্তারে বর্ণনা করা শুরু করল,
— র‌্যাব জেনে গিয়েছিল আমার অবস্থান। কিন্তু খবরটা আমিও জানতাম না। আমাকে আটক করার জন্য যখন জঙ্গলের বাড়িতে হানা দেয় তখন আমি হ্রদে ঝাপ মেরে পালিয়ে গেলাম। উপর থেকেই হয়তো নির্দেশ ছিল পালিয়ে গেলে গুলি করার জন্য। পানির উপর অনবরত গুলি করে ওরা। কিন্তু আমি বেঁচে যাই। এরপরে একটা ক্ষোভ কাজ করেছিল নিজের ওপর। তাই গতকাল DONT পেইজ থেকে একটা পোস্ট করেছিলাম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য যখন আমার হাতে তখন র‌্যাব আমার *****। খারাপ একটা গালি দিই। পরে যখন ভুল বুঝতে পারি তিরিশ মিনিট পরেই সেটা সরিয়ে নিই আমি। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। আলতাফ খুনের সময় কোন কোন থানার কে কে উপস্থিত ছিল না, এবং জঙ্গলের বাড়ির আশেপাশে সে ছিল কি না সেসব খতিয়ে দেখে তারা। তুমি হয়তো বলেছিলে তুমি বিছানাকান্দি ঘুরতে গিয়েছিলে।এজন্যই তোমাকে সন্দেহ করেছে এখন।
— হ্যাঁ আমি বলেছিলাম, আমি বিছানাকান্দি গিয়েছিলাম একটা কাজে। কিন্তু তুমি এসব কী করে জানলে?
— সাইট হ্যাক করে ‍‍‍র‌্য‌‌‌াব সদস্যদের কথোপকথন শুনে।
একাধারে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা মিশ্রিত ঘূর্ণির ঝাপটার সমস্ত গিয়ে জমল আমার পায়ের তলানিতে। সে-সমস্ত ঝেড়ে ফেলার অভিপ্রায়ে সজোরে মেঝেতে পা ঠুকিয়ে অস্ফুট উচ্চারণ করলাম,”ছ্যাহ্ঃ… এখন?”
স্বর্ণা ছায়াছন্ন চোখে লক্ষ্যহীন তাকিয়ে বলল,
— পালাতে হবে, নো আদার অপশন্স।
— কিন্তু…
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে বুকটা ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল। অনুচ্চারিত কথাটা মুখের কাছে এসে বিফল হয়ে ফিরে পুনরায়। মুহূর্তে সর্বাঙ্গের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল আমার। এই বুঝি আমাকে ধরে নিয়ে গেল সে ভয়ে ভীরু হয়ে। স্বর্ণাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। মাথার ইশারায় দরজা খুলে দেবার জন্য বলল সে।
দরজা খোলামাত্রই যেন আমার চঞ্চল রক্তকণিকাগুলোর গতি একটু মন্থর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে পরখ করল।
— আন্টি ডাকছে আপনাদের।
বলে আর দাঁড়াল না জুহি। শীতল মেঝেতে টিপটিপ করে পা ফেলে চলে গেল মায়ের রুমের দিকে৷
আমি দরজার গোড়া থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে স্বর্ণার দিকে তাকালাম। স্বর্ণা ডান হাতের আঙুল ঘুরিয়ে বলল,
— কী?
আমি মৃদুস্বরে বললাম,
— মা ডাকছে, এসো।
স্বর্ণা ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি বয়ে গেলেও বুঝতে না দিয়ে পিছু পিছু চলে এলো আমার।

খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিল মা। অবিদিত শঙ্কায় চোখ দু’টো বোজা। দুইহাত দু’পাশে গুঁজানো। নীমিলিত চোখের পাপড়ি টিপটিপ করে নড়ছে খানিক পরপর। মায়ের উরুর পাশ ঘেঁষেই অবনত মুখে কাঠের পুতুলের ন্যায় বসে আছে জুহি৷ আমাদের উপস্থিতিতে সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল,
— আমি বরং আজ যাই। আপনারা বোধহয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন!
মা চোখ খুলল সঙ্গে সঙ্গে। ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা তাকাল স্বর্ণার দিকে। এরপর পুনরায় চোখ নামিয়ে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল একদিকে। আমি মায়ের দিকে একবার কটাক্ষে তাকিয়ে জুহিকে বললাম,
— তুমি এখন যেও না। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আর এখানে থাকলেও থাকতে পার। কারণ এখানে যা জানবে, শুনবে। সব একটু পরই তোমাকে বলব।
জুহি জোরপূর্বক একটু মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ঠিক আছে, আমি সোফায় গিয়ে বসি। একসাথেই শুনব।
বলে নির্লিপ্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল জুহি৷ সঙ্গে নিয়ে গেল বুকভর্তি টলটলে ঔৎসুক্যতা আর অজানা কথাগুলো জানার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। জুহি চলে যাওয়ার পর পরিবেশটা হয়ে গেল থমথমে। কয়েক সেকেন্ড কাটল কোনপ্রকার বাক্যবিনিময় ছাড়াই।
মা ছোট একটা নিঃশ্বাস চেপে স্বর্ণাকে বলল,
— তারপর… কেমন আছ?
স্বর্ণা চিন্তিত মাথা নাড়ল,
— হ্যাঁ, ভালো,আপনি?
— এইতো চলছে অসুখে-বিসুখে। তোমার দিনকাল কেমন চলে? দেশটাকে তো একাই তুলে বসাচ্ছ শুনছি।
এই প্রশ্নে স্বর্ণা বিব্রত হয়ে ইতস্ততঃ করে আড়চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি নিরুত্তরে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার পথ পেলাম না। দেখে মা ঠোঁট টেনে শুকনো হেসে বলল,
— মেয়ে, ওমন করছ কেন? খারাপ কাজ তুমি করছ না আমি জানি। শুরুতে বুঝতে না পারলেও মিনহাজের একটা কথায় আমার ভিতরটা পুরো পাল্টে দেয়। এসো, বসো আমার পাশে।
বলে মা নিজে একটু সরে গিয়ে স্বর্ণাকে বসার জায়গা করে দিল। স্বর্ণা নির্দ্বিধায় মায়ের শরীরে উষ্মায় তপ্ত হওয়া জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল এক পা মেঝেতে রেখে। আমি খাটের পাশ থেকে ছোট টেবিলটা টেনে বসলাম। মায়ের বাঁ হাতটা স্বর্ণার বাম কাঁধের ওপর আলগোছে বসিয়ে বলল,
— জানি ভয় তুমি পাও না। তবুও বলছি,ভয় পেও না। নিজেদের অস্তিত্ব যখন বিলীনের পথে। পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন অস্ত্র-তরবারী হাতে যুদ্ধে নামাই ছিল রীতি। কিন্তু এখন যুদ্ধ মানেই মানুষ বুঝে নৃশংসতা,যুদ্ধ মানেই খারাপ। এজন্যই মানুষ নিজেদের অধিকার হারাতে বসেছে। তেমনি নারীজাতির সম্মান এখন রাস্তার পশুদের হাতে ধূলিসাৎ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শাস্তি না হওয়ার সুযোগে একই অপরাধ বারবার করছে তারা! আইনই যখন মরণাপন্ন তখন তোমার মতোই সাহসী মেয়ে দরকার৷ চালিয়ে যাও, শুধু একটা কথা মাথায় রাখবে, অন্যায় তুমি করছ না। তাহলেই মানসিক প্রশান্তি মিলবে।
অভয় পাওয়ার প্রবল আবেগে, উচ্ছ্বাসে
উদ্ধত ঝড়-ঝঞ্ঝায় ভাসানো পদ্মফুলের আকণ্ঠ ডুবে গেলে যেমন হয়,তেমনি অভয় পাওয়ার প্রবল আবেগে, উচ্ছ্বাসে স্বর্ণার গলা ধরে এলো। কোনমতে চোখের পানির বাঁধটা জোরদার করে বেঁধে ধরা গলাতেই বলল,
— এভাবে কেউ সাহস দেয় নি। এতো বড় পৃথিবীতে এক মিনহাজ ছাড়া আর কাউকে আপন ভাবি নি এই দুই বছরে। এর আগে তো ছিলই না! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিলেটের এই ঘরের কোণে আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছে।
— পৃথিবীতে আপন অনেকেই থাকে, কেউ ছিটকে যায় কেউ রয়ে যায়। কেউবা আসতে চেয়েও যোজন দূরত্বে সরে যায়। মিনহাজের বাবা আর আমার কথাই দেখো না। চব্বিশ বছর আগের ‘তালাক’ শব্দটি যে দূরত্ব সৃষ্টি করে আজও সেটা ঘুচে নি। অথচ ভালোবাসাটা এতো তীব্র ছিল যে অন্য কারো সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিয়ে পুনরায় বিয়ে করার মতো সাহসটা তার ছিল না। পাছে আমি হারিয়ে যাই! সবসময় কাছাকাছিই রেখেছিল। কিন্তু সেটার কোন দাম নেই। একবার যা হারায় তা কখনো পুরোপুরি আগের মতো ফিরে পাওয়া যায় না। রাগ বড়ো খারাপ জিনিস!
স্বর্ণার বোধহয় মনে ধরল কথাটি। সেও যে একি পথের পথিক। তৎক্ষনাৎ বলল,
— হুমম, আমারো রাগ বেশি। রাগ না হলে বোধহয় এইদিন দেখতে হতো না আমায়।
— থাক সেসব কথা৷ হঠাৎ এখানে এলে? কোন কাজে?
— হুম, মিনহাজের বড় বিপদ। সেদিন…
এরপর একে একে সব ঘটনা খুলে বলল স্বর্ণা। শুনে শিউরে উঠল মা। হঠাৎই ঘুরে বসে আতঙ্কে উদ্বেলিত হয়ে বলল,
— তোমরা এখনো বসে আছ কেন? ওরা যদি এসে পড়ে? বারবার করে বলেছিলাম, এই পুলিশের চাকরি করিস না। নাহ্ তিনি দেশ সেবা করবেন। এখন দেশব্যাপী দুর্নাম রটবে।
চট করে হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখল স্বর্ণা। এরপর উত্তেজক ভাবটা ধিমে করে মৃদু গলায় বলল,
— এখনি এসে পড়বে না। আপনি একদম চিন্তা করবেন না আন্টি। যেখানে আমি আছি সেখানে আপনার ছেলের কিছু হবে না। প্রয়োজনে নিজে প্রাণ দিব,তবুও মিনহাজকে নিরাপদে রাখব। কথা দিলাম। আপনি অসুস্থ, চাপ নিবেন না।
স্বর্ণার স্পষ্ট ভরসার সত্ত্বেও মায়ের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছাপটা অস্তমিত হল না। কপালের ভাঁজে, চোখের মন্দীভূত ছায়ায়, দাঁতের নিচে চাপানো অচঞ্চল ঠোঁটের আহাজারিতে যেন মায়ের মনটা উথাল-পাতাল করছে। মা’দের মূল মনের বাইরেও সন্তানদের জন্য নির্ধারিত একটা মন থাকে। মায়ের সেই মনটা বোধকরি ভয়ে ত্রস্ত হয়ে তড়পাতে শুরু করে এরিমধ্যে।
এবার আমিও মা’কে প্রবোধ দিয়ে বললাম,
— চিন্তা করো না মা। তুমি দোয়া করলে আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু আমি ভাবছি তুমি জুহির বাসায় থাকবে। এই বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তোমাকে পেলে সমস্যা হবে। তাছাড়া তুমি অসুস্থ!
মায়ের ঠোঁটের কোণে অকস্মাৎ কিঞ্চিৎ হাসির দেখা মিলে সঙ্গে সঙ্গে তা অদৃশ্য হয়ে গেল। চাপা আনন্দ উপচে পড়া গলায় বলল,
— জুহির বাসায়? আচ্ছা, মেয়েটাকে আমার বড়ো পছন্দ হয়েছে একদিনেই। পুলিশ হলেও লক্ষ্মী একটা মেয়ে।

জবাবে আমিও একটু অনুকূল হেসে স্বর্ণার দিকে তাকালাম। স্বর্ণার মুখে যেন কে কালি লেপ্টে দিল। দেখার মতো না! মা হয়তো এটা ভুলে গেছে যে, এক মেয়ের সামনে অন্য মেয়ের প্রশংসা করতে হয় না। এতে পাপ কিংবা অমঙ্গল না হলেও রেষারেষি শুরু হয় এতে সন্দেহ নেই। স্বর্ণার হাঁড়ির তলাসম মুখটায় এক টুকরো জোরপূর্বক হাসি এনে বলল,
— সেটাই ভালো হবে আন্টি। আপনি জুহির কাছেই নিরাপদে থাকবেন।
বলা বাহুল্য, সেই আট বছর আগে স্বর্ণা আর মায়ের মধ্যে ‘কেমন আছেন, ভালো আছেন’ ধরনের একটা সংস্রব ছিল যখন মা তিন কি চারদিনের জন্য দাদীর কাছে এসে থাকতো। আমাকে দেখে যেতো। সেই সময়ও স্বর্ণার সঙ্গে আমারে হৃদ্যতার কথা সকলেরই অবগত ছিল। কিন্তু আমার নিজেরই তখন মায়ের সকল ইতিবৃত্ত অজানা ছিল, যার কারণে দিনে দিনে ঘৃণা জমতে জমতে ঘৃণার পাহাড়ে পরিণত হয়েছিল। এখন সেই পাহাড়ের অস্তিত্ব হৃদয়ে একোণ-ওকোণ চষে বেড়ালেও সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। যাইহোক, তখনই আমাদের বাসায় বারকয়েক আনাগোনায় মায়ের সঙ্গে স্বর্ণার পরিচয়।
…………………………………………….

জুহি স্বর্ণার কথায় চমকে উঠে সন্দিহান গলায় বলল,
— হুয়াট? এতোগুলা খুন তাহলে তুমি করেছ?এটা কী করে সম্ভব?
আরো কিছু বলতে চাইল জুহি। তার পেলব দুই ঠোঁট শুধু বারকয়েক মিলিত হলো আর ছেড়ে দিল। কিন্তু কথা বেরোল না। আয়ত চোখ দিয়ে বিস্ময় যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে টিকরে পড়ছে।
স্বর্ণা টেবিলে উপর রাখা গ্লাসটা একমনে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
— বিশ্বাস না হলে আন্টির কাছে জিজ্ঞেস কর। আর, খুনগুলোর কারণও তুমি জানো। আমিই সেই।

মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে সোফায় এসে বসেছিলাম আমি আর স্বর্ণা। জুহি আগে থেকেই সোফায় বসে ছিল উদগ্রীব হয়ে।

— DONT?
— হ্যাঁ, DONT, এখন আমি চাই তুমি আমাদের হেল্প করো।
— নো নেভার। পুলিশ হয়ে আমি অপরাধকে প্রশ্রয় দিতে পারবনা।
স্বর্ণা কিছু বলার উদ্দেশ্য তাকাল আমার দিকে৷ আমি জুহির দিকে তাকিয়ে বললাম,
— দেখো জুহি, আমার কথায় কষ্ট পেও না, বা খারাপ ভেবো না। ধরো, একসঙ্গে ছয় জন তোমাকে রেপ করল। এবং তোমার আপন বাবা মা তোমাকে বিশ্বাস না করে রেপিস্টদের বিশ্বাস করে তোমাকে বেইশ্যা বলে গাল দিয়ে একপ্রকারে ঘরছাড়া করল। তুমি কি করবে? আত্মহত্যা?
আমার ধৃষ্টতায় জুহির চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা অপমানিত কান্নার ধারা। সে আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে শুধু বলল,
— নাহ্
— তাহলে?
স্বর্ণা আমার বাঁ হাতে আলতো চাপ দিয়ে বোঝাতে চাইল, একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে জুহির অবস্থাটা ঠিক ঠিক অনুধাবন করতে পারছে সে। জুহি টলমল করা চোখে একই ঢংয়ে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর দৃঢ় করে বলল,
— নাহ, আত্মহত্যা না। বিচার চাইতাম আইনের কাছে।
জুহি ঠায় নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে, এবং আমিও। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। জবর সম্মোহনে। বললাম,
— দেশের শতশত মেয়ের মতো যদি তুমিও বিচারহীনতায় ভুগতে? তাহলে ধর্ষকদের ছেড়ে দিতে মুক্ত আকাশে?
— নাহ, জানে মেরে দিতাম।
— তাই?কিভাবে?
— যেভাবেই হোক। অন্যায় করে তারা বাঁচবে কেন?
এবার আমি জোর গলায় বললাম,
— দ্যাট্স ইট। এটাই বোঝাতে চাইছিলাম। স্বর্ণাও ঠিক একই ঘটনার শিকার। তাহলে কি তার করা খুনগুলো অপরাধের কাতারে পড়ে?

জুহির চমক ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে নিরতিশয় বিস্ময়-বিদ্ধ চোখে তাকাল স্বর্ণার দিকে। সেই চোখে হাজারটা প্রশ্ন! স্বর্ণা সেই চাহনির মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব কষ্টে ডানদিকে ঠোঁট প্রশস্ত করে মৃদু হাসল।
— পুলিশে জানাও নি? জিজ্ঞেস করল জুহি
— হু, কিন্তু পুলিশ আমার কথাই আমলে নেয় নি। কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল বাবা মাকে নিয়ে আসতে। কিন্তু বাবা-মা’ই তো আমার বিরুদ্ধে ছিল। থাক সেসব কথা, তুমি এখন আমাদের হেল্প করতে পারলেই হয়।
জুহির মন গলে গেল। তার মনটা এখন আমার প্রথমদিকের মনের মতোই দোদুল্যমান। একদিকে নিজে পুলিশের সদস্য হওয়ায় যেমন সে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে। অপরদিকে তেমনি একজন মেয়ে হিসেবে মনে হচ্ছে স্বর্ণাই ঠিক। লোকগুলোর এমন মৃত্যুই পাওনা!

নিজস্ব ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জুহি বলল,
— ঠিক আছে, বলো কী করতে হবে?
আমি বললাম,
— বেশি কিছু না। মা’কে তোমার কাছে রাখতে হবে কিছুদিন। অসুস্থ মানুষ। একটু দেখেশুনে রাখবে এই।
— আপনি কোথায় যাবেন? – কপাল ভাঁজ করে প্রশ্ন করল জুহি।
আমার বুকের পাঁজর ঠেলে একটা বড় নিঃশ্বাস প্রস্রুত হল। বললাম,
— আমার আর এখানে থাকা হচ্ছে নাহ্। রিসেন্টলি আলতাফ খুনের সময় আমি স্বর্ণার সঙ্গে ছিলাম। সেটা র‌্যাব জেনে গেছে।
জুহি চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বোধহয় কি বলা উচিত খুঁজে পেল না। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল,
— আচ্ছা, তোমরা বেরিয়ে যাও। আমি আন্টিকে নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে তৈরি হয়ে চলে যাব আমার বাসায়।
আমি গোঁ ধরে বললাম,
— নাহ, আগে তুমি মা কে নিয়ে বেরোবে তারপরেই আমরা বেরোব।
জুহি মনে মনে ক্ষুন্ন হয়ে বলল,
— আমাকে বিশ্বাস করেন না?
— না, ঠিক তা নয়। আমি পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে যেতে চাইছি৷
জুহি বিশ্বস্ত গলায় বলল,
— আপনি পুরোপুরি আশ্বস্ত থাকতে পারেন। কেউ আসার আগেই আপনি বেরিয়ে পড়ুন।
স্বর্ণা চুপ মেরে বসে ছিল আমার পাশের সোফায়। জুহি তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— সাবধানে থেকো। আর আমাকে নিয়ে মনে কোন খেদ রেখো না।
স্বর্ণা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
— ওকে, তুমিও সাবধানে থেকো। আন্টিকে দেখে রেখো। আমরা ফোনে যোগাযোগ করব৷

বিদায়ের বেলায় মা মরা কান্না জুড়ে দিল আমাকে জাপটে ধরে। এতক্ষণ পরেও জুহির চোখের কোণেও কয়েক ফোঁটা জল সন্ধ্যায় শুকতারার আলোর ছটায় চকচক করে উঠল। হাজার হলেও একটা সময় তার বুকের সমস্তটা আমি বলতেই ঢিপঢিপ করে কেঁপেছিল। হয়তো কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে উচ্ছল যৌবনে আমি মানুষটার একটুখানি ছোঁয়া পাওয়ার অফুরন্ত তাড়নায়। আচমকা স্বর্ণার মধ্যস্থতায় হয়তো কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে কত এমন অনিন্দ্য সুন্দর সন্ধ্যাকাল। আজকের শঙ্কার দিনে দু’ফোঁটা চোখের জল তো নিমিষেই গড়িয়ে পড়বে! মনে মনে এটুকু আমার বিমৃষ্ট হতেই পারে!

অজানা কারণে র‌্যাব এখনো কোন সংবাদ মাধ্যমে আমাদের কথা প্রকাশ করে নি। অবশ্য র‌্যাব সন্দেহভাজনের কথা উল্লেখ করে দিয়ে সতর্ক করে দেয়ার মতোন বোকা কাজ করবে না। তাই মিডিয়া এবং লোক সাধারণের নেপথ্যেই অভিযান চালাচ্ছে তারা। আপাতত সিলেটে থাকা যথার্থ নয় বলেই কক্সবাজার চলে যাচ্ছি দু’জনে। রাতের ভ্রমণ। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে বহুকষ্টে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে কক্সবাজারের টিকিট কেটে নিলাম। টিকিট আমি নিই নি অবশ্য, এবারো পরিচিত একজনের সাহায্যে দু’টো টিকিটের বন্দোবস্ত করেছি। এতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বাসে উঠেই অনিককে ফোন করব বলে মনস্থির করলাম। বেশ কয়েকমাস হল তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। ব্যস্ততা আর সমাকুলতার দরুন আমার নিগড়িত জীবনযাপনে মৃদুমন্দ প্রভাব পড়েছে। যার একাংশ পড়েছে গুটিকয়েক পরিচিত মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া। মেহেনাজের সঙ্গেও কথা হয়েছে প্রায় মাসেরও বেশি। এরমধ্যে সে কয়েকবার ফোন করলেও কখনো বা ধরতে পারি নি আর কখনো বা ব্যস্ততায় ছিলাম।
দুইবার রিং পড়তেই অনিক ফোন রিসিভ করে পাক্কা কলকাতার টোনে বলল,
— সোহাগ চাঁদ যে, কতদিন পর ফোন আপনার। বলি, এতোদিন কোথায় ছিলেন হ্যাঁ?
আমি বললাম,
— ওরি বাবা। গলা দিয়ে এমন সুর উৎলে পড়ছে কেন? বুড়ো বয়সে বউ নিয়ে কলকাতা ঘুরতে গেলে নাকি?
ফোনের অপরপাশ থেকে বিস্ময়সূচক কণ্ঠের উল্টো টান শোনা গেল।
— মাইরি দাদা, তুমি তো দেকচি জ্যোতিষি হয়ে গেছো। এতোসব খবর পেলেন কী করে?
এবার আমিও ভড়কে গিয়ে বললাম,
— সত্যি তুমি কলকাতায় নাকি?
— হ্যাঁ, সত্যি। পিসির বাড়িতে এসেছিলাম। সেখান থেকে দার্জিলিং। দু-তিনদিন পরেই ফিরবো।
— যাঃ— এখন কী হবে?
— কেন কেন? – তিরবিরে গলায় বলল অনিক।
আমি মিয়ানো গলায় বললাম,
— আমি আর স্বর্ণা কক্সবাজার আসছি। ভাবলাম তোমাকে পাব। কিন্তু… হল না।
— আরে চিন্তা করছ কেন? দু’দিন পরেই ফ্লাইট। দেখা হবে। মামা বুড়া বয়স বলো আর যাই বলো থার্ড টাইম হানিমুনটা কিন্তু জোস হচ্ছে। আর তুমিতো বুড়া হয়েও বিয়া করতে পারলে না এখনো।
— বিয়া না করে থাকতে পারাটা ছেলেদের ক্রেডিট। ব্যর্থতা না।
অনিক সুর করে বলল,
—উহঃ সমস্যা আছে তাই বলো৷ না-হয় ছেলে মানুষ বিয়ে না করে থাকে কী করে?
— শালা, বাজে বকো না, আমার সমস্যা নাই। শুধু…
— শুধু?
— কিছু না, ছাড়ছি।পরে কথা হবে।
— ওকে,বাই।

আবছা অন্ধকারে স্বর্ণার ড্যাবড্যাব চোখ দেখে অনিকের সঙ্গে কথার ইতি টানলাম মাঝপথেই।
ফোনটা রাখতেই পাশ থেকে স্বর্ণা খ্যাঁকখ্যাঁক করে বলল,
— কার সাথে ফোন করেছ? ফোন যে অন করেছ, আমার অনুমতি নিয়েছ? ইচ্ছে করছে একটা চড় মারতে মারতে চ্যাপ্টা করে ফেলি। বেয়াদব!

বলে আর একমুহূর্ত অপেক্ষামাত্র না করে কটাস করে ফোনের ব্যাক পার্ট খুলে সিমটা জানালা দিয়ে ফেলে দিল।
আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে দেখলাম পুরো ব্যাপারটা৷ এরপর থেকেই স্বর্ণা অনবরত বকে চলেছে আমাকে গঞ্জনা করে। আমি সেসব কথায় নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে শুনে যাচ্ছি কেবল। এসব বিষয়ে শৌর্য দেখিয়ে পাল্টা কিছু বলতে গেলেই হিতে বিপরীত হবে।

সিলেট থেকে কক্সবাজার যাওয়া সবমিলিয়ে এগারো ঘন্টার পথ। যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা যানজটের ফাঁদে না পড়লেই নির্বিঘ্নে পৌঁছা যাবে গন্তব্যে।

রাত্রি বোধকরি এগারোটা। স্বর্ণার অবিরাম নীরস বকবকানি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই। শাঁ শাঁ করে বাতাস কেটে মহাসড়ক ধরে ছুটে চলেছে বিশালকার বাস। বাসের সকল যাত্রী বেঘোরে ঘুমোচ্ছে কয়েক যুবক ছেলে বাদে। যুবক ছেলেগুলো গুনগুন করে কথা বলছে আর মাঝেমধ্যে গিটারে করুণ সুর তুলে পরিবেশটাকে মোহনীয় করে তুলছে। যতটা পথ বাসটা ছুটছে ততটা পথেই যেন সেই নৈকষ্য করুণ,ঐন্দ্রজালিক সুরটি কৃত্রিম ছাঁচে ঢেলে দিয়ে আসছে তারা।
স্বর্ণা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। তার দুই হাত নিখুঁতভাবে বুকের দুইপাশে গুঁজানো। বাসে জ্বাজ্জল্যমান ধিমে আলোতে স্বর্ণার অবয়বী স্পষ্ট শুধু। আমি ঘুম জড়িত কণ্ঠে বললাম,
— ঘুমাও নি?
স্বর্ণা তাকাল না। ওভাবেই মুখের ভিতর শব্দ করল,
— উহু।
এরপর অনেক্ষণ কাটল নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দ্যতায়। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
— ওখানে গিয়ে কোথায় থাকবে?
— হোটেলে।
— ‍র‌্যাব যদি জেনে যায় আবার?
স্বর্ণা কাঁটাকাঁটা গলায় স্পষ্ট করে বলল,
— এখন ওসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না। একা থাকতে দাও। যখন জানবে তখন দেখা যাবে।
ঝাঁজালো গলার খরতায় আমি একটু মিইয়ে গেলাম বটে,কিন্তু আবার সাহস করে বললাম,
— স্বর্ণা তুমি কি জানো আমি তোমাকে ভয় পাই অনেক?
স্বর্ণা চোস্ত দৃষ্টি মেলে ফিরে তাকাল আবছা আঁধারে। বলল,
— মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজবে না। একা পেলেই তোমার এসব ঢং বেড়ে যায়। এবার আর ফাঁদে পা দিচ্ছি না।
স্বর্ণার কথাটা আমার মুখে কুলুপ এঁটে দেয়ার সম ঠেকল আমার কাছে। আমি ইচ্ছেকৃত খোঁটা দেয়া গলায় বললাম,
— উফফ্ কি সে বিপাকে পড়লাম, ফেসবুকে ওমন স্ট্যাটাস না দিলেই হতো।
বড় মাছকে যেমন ময়দার তৈরি টোপের প্রলোভন দেখিয়ে বিশেষ কাজ দেয় না তখন ছোটমাছ ধরে তবেই টোপ হিসেবে লাগাতে হয়। আমিও তাই করলাম। মিষ্টি কথায় চিড়া না ভিজলে একটু ট্যারা কথা বলে চেতিয়ে দেওয়াটা নেহাৎ অন্যায় নয়। স্বর্ণা টোপ গিলল সঙ্গে সঙ্গে। মুহূর্তে চড়াও হয়ে তীক্ষ্ণ গলায় আস্ফালন করে বলল,
— তো বললাম তো। সেই ভুলে মেরে কেটে ফেলে দাও। কিচ্ছু বলবনা। তবুও খোঁটা দাও কেন।
কয়েক সেকেন্ডেই বাসের ভিতর যেন একটা মিসাইল হামলা হল। স্বর্ণার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উগ্র ঝাঁজে ধড়মড় করে জেগে উঠল বাসের কয়েকজন বৃদ্ধ আর তরুণ। আমি দস্তুরমতো স্বর্ণাকে শান্ত করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছি। তথাপি তার তেজদীপ্ত কণ্ঠের জোর কোনক্রমেই থিতু হয় না। একের পর এক খটরমটর কথার ছোটছোট বাক্যের ছোট ছোট বোমা নিঃসৃত হচ্ছে যেন! এরমধ্যে আবার তুষের আগুনে ফুঁ দিয়ে একজন পেছন থেকে একটা অশিষ্ট কথা বলে ফেলল হুট করে। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল স্বর্ণা। চিৎকার করে বলল,
— কোন কুত্তারবাচ্চারে! সাহস থাকে তো সামনে আয়। যে গলা দিয়ে কথাটা বের হয়েছে সেই গলাটা আমি একটু দেখি।
পলকেই থমকে গেল পরিবেশটা। পেছন থেকে আর কোন উত্তর এলো না। গাড়ি চলছে নিজস্ব গতিতে। যেসব বৃদ্ধ এতক্ষণ গুঞ্জন তুলে সমালোচনা করছিল তারাও চুপ মেরে গুটিশুটি মেরে ঘুমের ভান ধরল। আর যাইহোক, এই রায়বাঘিনীর হাতে তারা বেইজ্জত হতে চায় না। অবস্থা বেগতিক উপলব্ধি করে আমি স্বর্ণার হাত ধরে সিটে বসিয়ে বাঁ হাতে তার স্কন্ধ চেপে ধরে বুকের কাছে দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ করলাম। পেছনের লোকটা আবার বলল,
— হ্যাঁ এবার ঠিক আছে।
স্বর্ণার প্রলয়ঙ্করী রোষানল পুনরায় আবর্তের সৃষ্টি করে ফুলে ফেঁপে উঠতে চাইল। আমি প্রাণপণে তাকে পরিবৃত করে রাগ বিতাড়িত করার চেষ্টা করলাম।
প্রায় আধঘন্টা পর স্বর্ণা কিছুটা আত্মস্থ হয়ে মাথা তুলতে চাইল। আমি আগের মতোই দৃঢ় করে আবদ্ধ করে বললাম,
— রাগ কমলো?
— হু।
— রেগে যাবে জানতাম,কিন্তু এতোটা ভাবি নি।
স্বর্ণা চুপ করে রইল। কোন কথা বলল না। আমি আবার বললাম,
— এবার ঘুমোও একটু।
—ছাড়ো তাহলে।
— উহু, ছাড়লেই তো কুরুক্ষেত্র চালাবে। এখানেই শোও।
স্বর্ণা বাচ্চামি স্বরে বলল,
— কাঠের মতো শরীর তোমার। কীভাবে শুই?
আমি ফচ করে একটু হেসে বললাম,
— একটু কষ্ট করো। আর জানালাটা বন্ধ করো।
— নাহ জানালা খোলা থাক।
আমি নাক কুঁচকে বললাম,
—চুল এসে পড়ছে তো!
— তুমিও একটু কষ্ট করো কষ্ট আমি একা করব কেন?
আরেকটু নড়চড়ে জড়সড়ো হয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে স্বর্ণা। রাত গভীর হয়। একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দে অভ্যস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বাসের প্রত্যেকটি যাত্রী। তিক্ত হলেও মানতে শক্ত যে এঁদের হয়তো-বা প্রত্যেকের নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। অথচ আমরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা দু’জনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। খুব মনে পড়ে,একটা সময় আমি এমব জীবন আশা করেছিলাম যখন আমার থেকেই কেউ ছিল না। ছিল শুধু মদ আর ঢাকার ঐ পিতৃ- অধিগত বিশাল অট্টালিকা। এখন সব থেকেও এভাবে উদ্দেশ্য, উদ্যমহীন ছুটে চলা।

ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেল বাসের কন্ডাক্টরের ডাকে। এর আগেও অবশ্য বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে। চলন্ত বাসে কি আর শান্তির ঘুম মিলে? কনডাক্টর লোকটি বলল,
— ভাই চলে আসছি। আপনারা নামেন।
— ঠিক আছে। তুমি যাও।
লোকটি চলে গেলে স্বর্ণাকে ডাক দিলাম। প্রথম ডাকেই জেগে গেল সে। জড়িত কণ্ঠে চোখ রগড়ে বলল,
— এতো তাড়াতাড়ি চলে এলাম!
— হুমম যেভাবে ভোস-ভোস করে ঘুমোলে খবর কি আর থাকে?

বাস থেকে নেমে একটা অটো করে স্বর্ণার কথামতো সৈকতের দিকে রওনা দিলাম। এই স্টেশনে অহোরাত্র গাড়ি-ঘোড়ার দেখা পাওয়া যায় পর্যটন এলাকা হওয়ার কারণে। কাজেই একটা অটো খানিক চড়া দামে একটা নির্জন সৈকতে পৌঁছে দিতে রাজি হয়ে গেল। বিশ কি পঁচিশ মিনিট পর আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সৈকতের দিকে এগোলাম আমরা।
ভোর পুরোদস্তুরে ফুটে নি এখনো। আকাশে চাঁদের আলোটা ক্রমে ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে নতুন দিবার সূর্যলোককে স্বাগত সম্ভাষণ জানাতে। একাধারে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সাগরপাড়ের হিমশীতল বাতাসে ঝিমিয়ে পড়ে রাতের নৈঃশব্দ্যতাকে আপন করে নিয়েছে নানান নিশাচর পোকা-পক্ষীকূল। ঘুম লেগে থাকা চোখে সকালের শিরশির হাওয়াতে মনটা দুলছে অনবরত। অনতিদূরের সাগরের গর্জনের নিনাদ বাতাসে ভেসে এসে কানে লেগে অদ্ভুত অবিমিশ্রিত সুখোল্লাস সৃষ্টি করছে। কিন্তু সেই সুখ শোকে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না। আচমকা ভারী কিছুর আঘাতে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। পরক্ষণেই বহুকষ্টে চোখ মেলে দেখলাম কিছু পাঁড় মাতাল স্বর্ণার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে।

চলবে…