শেষ সূচনা পর্ব-২৫

0
319

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৫
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

বহুকষ্টে চোখ মেলে দেখলাম কিছু পাঁড় মাতাল স্বর্ণার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। তবে এই স্বর্ণা এখন আর এলেবেলে কেউ নয়। দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় আর ক্রমাগত ঘামঝরা পরিশ্রমে এখন তার বজ্রকঠিন মনোবল আর ইস্পাতকঠিন নিয়ন্ত্রণ শক্তি। তার কাছে এসব হেঁজিপেঁজি গোছের মাতালগুলো কিছুই না বরং শিকারেরে অভাবে মিইয়ে পড়া শরীরটাকে একটু চাঙা করার খোরাকমাত্র। হলোও তাই। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যেই স্বর্ণা দুইহাতের বালুকা নিশ্চিন্তে ঝাড়তে ঝাড়তে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি শুধুমাত্র তার আসাটাই দেখলাম। এতক্ষণে ঘটিত কোন ঘটনাই আমার আঘাতপ্রাপ্ত মস্তিষ্কের উপলব্ধিতে এসে ঠেকল না। আমি তখন নতজানু হয়ে প্রকট যন্ত্রণায় ঝিম ধরে বসে আছি। স্বর্ণা কাছে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
— এই,ঠিক আছ তুমি?
আমার চোখ বন্ধ। নিঃশ্বাস পড়ছে ফোঁসফোঁস করে। মাথার পেছন দিকটায় যেন কেউ একজন নির্দ্বিধায় হাতুড়ির আঘাত করছে অনবরত। আমি শুধু মুখে অনুচ্চস্বরে বললাম,”হু!”
স্বর্ণা আমার পিঠে ঝুলানো ব্যাগ থেকে বোতল নিয়ে মুখ খুলে ছলাৎ করে ছিঁটাল আমার মুখে। আমি একটু সংবিৎ ফিরে পেলাম। চোখমুখ ঝাড়া দিয়ে ঠোঁট গোল করে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বর্ণার কাঁধে ভর করে উঠে দাঁড়ালাম কোনমতে। এরপর হেলেদুলে একটা বদ্ধ দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম দু’জনে। একেই বলে মড়ার উপর খরা। যেদিকেই যাই রাজ্যের অশান্তিরা হুহু করে ধেয়ে আসে আমাদের উচ্ছেদের নিমিত্তে।

ঘন্টা খানেক বেঞ্চিতে বসে কাটিয়ে দেবার পর আমি কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই লম্বা বেঞ্চিতে। আশেপাশে চোখ ঘুরালাম। স্বর্ণা খানিক দূরে বসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। মাথার টনটনে ব্যথাটা কমেছে বটে,তবে বদলে দিয়ে গেছে সুপারির মতো গোলগাল দগদগে অযাচিত মাংসপিণ্ড। এর চেয়ে বোধহয় ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেলে উত্তম হতো। মাথার পিছনে অপ্রয়োজনীয় ব্যথাহত মাংসপিণ্ডটি যেমনি ক্লেশকর তেমনি অস্বস্তিকর একটা বিষয়। স্বর্ণা চায়ের কাপ হাতে নিজের জায়গা থেকে সরে এসে আমার পাশে এসে বসল চুপিসারে। তার কাঁটা কাঁটা চাহনির চোখদুটো আশেপাশে ঘুরছে উদ্যত কোনো বিপদের আশঙ্কায়। আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
— এখন কেমন লাগছে?
— ভালোই তো লাগছে। কিন্তু তুমি এমন চোরের মতোন চোখ ঘুরাচ্ছ কেন?
স্বর্ণা আমার অহেতুক প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে না করে বলল,
— চা খাবে? ভালো লাগবে।
এবার আমি নিজেও একটু উদাসীন ভাব ধরে তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। দোকানিকে উচ্চস্বরে বললাম,
— একটা চা দিন তো!…
স্থূলকায় দোকানি আমার কথার প্রতিউত্তরে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চা বানাতে শুরু করল। মিনিট আধা পরে চা’টা হাতে নিয়ে সুড়ুৎ করে একটা চুমুক দিয়ে স্বর্ণার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা সমীহা আমার! আমি জানি স্বর্ণা শব্দ করে চা খাওয়া পছন্দ করে না। তবুও আজ সে আসক্তিহীন। কিছু সময়ে নিজে বেহায়া হতে দোষ নেই। বললাম,
— এখন কী করবে? এখানে বসে থাকলে তো দিন কাটবে না।
স্বর্ণা শ্লেষাত্মক মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— উহঃ মনে হচ্ছে হানিমুনে এসেছি। সাগরে ডুব দেবার জন্য তর সইছে না। চুপচাপ বসে থাকো। ভাবতে দাও কি করা যায়।
— এক ঘন্টা আগে থেকেই তো ভাবছ। এখনো ভাবা শেষ হয় নি?
— হয়ে গেছে। চলো আপাতত থাকার ব্যবস্থা করা যাক।
— ওয়েট, চা টা খেয়ে নিই।

দ্রুত কয়েকবার চুমুক দিয়ে খালি পেটে চা উদরসাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম থাকার জায়গা অনুসন্ধানে। মাকে একটা ফোন দেয়া দরকার। এতক্ষণে নিশ্চয় এটা-ওটা ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ফোনে সিম নেই। নতুন সিম কিনতে গেলেও আইডি কার্ড পুশ করতেই র‌্যাব আমাদের অবস্থান জেনে যাবে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্বর্ণাকে বললাম,
— তোমার ফোনটা দাও তো। বাসায় কথা বলব।
স্বর্ণা নিজের ফোন দিল না। তড়িৎ গতিতে পকেট ঘেঁটে একটা সিম বের করে বলল,
— এটা ইউজ করতে পার কিছুদিন।
আমি রহস্যভরে সিমটা ফোনে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম,
— এগুলো কার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা?
স্বর্ণা ঠোঁট টেনে বলল,
— আছে মানুষ। তবে নিশ্চিন্তে থাকতে পার।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের ফোনে কল দিলাম। রিসিভ হল না। একবার, দুইবার, তিনবার। নাহ্! কোথায় গেল! আস্তে আস্তে কপালে দুশ্চিন্তার প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল আমার। স্বর্ণা বলল,
— জুহির ফোনে ট্রাই কর।
আমার রক্ত তখন শঙ্কায় উদভ্রম। চনচনে গলায় বললাম,
— নাম্বার তো মুখস্থ নেই!
স্বর্ণা স্বাভাবিক গলায় বলল,
— আন্টির ফোনে আরো কয়েকবার ট্রাই করো। ভাবার কিছু নেই৷ যদি কোন বাহিনীর হাতে থাকে তাহলে তারা নিশ্চয় ফোন ধরতো।
আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পুনরায় ফোন দিলাম। আরো দু’বার রিসিভ না হওয়ার পর হঠাৎ রিসিভ হলো। শীতের খরতায় আমার শুষ্ক মনো- তটিনী যেন বসন্তের দোলায় প্রাণ ফিরে পেল।
— হ্যালো… জুহির কণ্ঠ।
আমি চাপা উচ্ছ্বসিত একটা শ্বাস গোপন করে তেজী গলায় বললাম,
— উফ্ কোথায় থাকো সব? কতবার ফোন দিয়েছি দেখো নি?
জুহি বোধকরি ভড়কে গেল অচেনা নাম্বার থেকে আচমকা এমন উগ্রবচন শুনে। একটু পর বলল,
— আপনি তো আমায় ফোন দেন নি। আমি ডিউটিতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। বারবার আন্টির ফোনে কল আসছে দেখে ছুটে এলাম।
— ওহহ।
এটুকু বলে আমি একটু আত্মসংবরণের চেষ্টা করলাম চোখমুখ বন্ধ করে।
— তা,ওইদিকের কী অবস্থা বলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে।
— অবস্থা আপাততঃ ভালোই। আজ ডিউটিতে গিয়ে দেখি কি হয়। আর শুনুন, বারবার ফোন করবেন না। আমি যেহেতু আপনার কাছাকাছি ছিলাম তাই আমাকে সন্দেহ করতে পারে।
— ঠিক আছে, মা কেমন আছে? ঔষধ চলছে ঠিকমতো?
— হ্যাঁ চলছে। ঘুমোচ্ছে এখন। আপনারা পৌঁছেছেন?
— হ্যাঁ পৌঁছার পর কত কিছু হয়ে গেল। ঠিক আছে রাখছি। মা’কে দেখো একটু।
— অবশ্যই দেখব, কিন্তু হয়েছে টা কি! থাকার ব্যবস্থা করেছেন?
— কী হয়েছে সেসব বলতে গেলে সময় লাগবে অনেক। থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রাখছি এখন।
— ঠিক আছে।

একটা সাদামাটা হোটেলে রুম বুক করলাম কোনমতে থাকার জন্য। শুরুতে আলাদা রুম ভাড়া করার ইচ্ছে দু’জনেরই ছিল। কিন্তু এই সময় সুখের পায়রা থেকে গেলে চলবে না। হাতের কাছে টাকা যা আছে তা-ই। আশেপাশে খোলা থাকলেও অন্তরালে বিশাল জালের ফাঁদ পেতে বসে আছে র‌্যাব। একটুমাত্র অবস্থান জানতে পারলে কেল্লাফতে! নিরুপায় হয়ে একটা রুমই ভাড়া করতে হল দু’জনকে। শুরুতে আমি গোসল করে নিলাম এরপরে স্বর্ণা। রুম সার্ভিস এসে খাবার দিয়ে গেলে দু’জনে কোনপ্রকার বাক্যবিনিময় ছাড়া তা উদরস্থ করলাম। এরপর কী করব ভেবে পেলাম না। বেকার বসে থাকার কোন মানে হয় না। স্বর্ণা অদূরবর্তী সোফায় বসে নিবিষ্ট মনে কি যেন চিন্তা করছে। আর আমি খাটে আধশোয়ায় আনমনে পা নাচাচ্ছি। স্বর্ণার গুম মুখ দেখে কিছু বলার সাহসও জোগাচ্ছে না। তবুও অকারণ চুপ করে থাকা চেয়ে অকারণ বকবক করা ভালো। ভয়ে ভয়ে বললাম,
— এখন কী করবে? ঘরে বসে থাকতে তো বোরিং লাগছে।
স্বর্ণা ধ্যানচ্যুত হয়ে বলল,
— ঘুমাও,রাতে তো ঘুম হয় নি মনে হয়।
আমি বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললাম,
— নাহ্ ঘুমও তো আসছে না।
— তাহলে আর কী করার! বসে থাকো।
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম,
— বাইরে একটু ঘুরে আসি চলো।
স্বর্ণা বাঁধা দিল।
— কড়া রোদ এখন। বিকালে যেও।

এরপর একপ্রকার কথার অভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম দু’জনে। নির্মোঘ কোনো বিপদের হাতছানিতে সশঙ্কিত হয়ে আছি দু’টি প্রাণ। হাজার সহজ কথাবার্তার সত্ত্বেও ভেতরে একটা ভীতি মাঝেমধ্যেই আঙলে দিচ্ছে। তবে আমি শতভাগ নিশ্চিত স্বর্ণার সকল ভয় শুধু আমাকে ঘিরে। নিজের একটা বোকামির ফলস্বরূপ এখন যে আমার মতোন একটা উটকো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে উদভ্রান্তের মতো। হঠাৎ নীরবতায় ইতি টেনে স্বর্ণা বলল,
—- রাজিবের খোঁজ পেয়েছি। সেদিন পাহাড়ে গুলি খেয়ে পালিয়েছিল। এখন নাকি ঢাকা মেডিকেলে আছে।
আমি অবাক হওয়া গলায় বললাম,
— তাই নাকি? কিন্তু ওকে ঢাকা মেডিকেলে রাখল কেন? এধরণের রোগী তো পুলিশ দেখে তারপর চিকিৎসা করে।
— বোকার মতো প্রশ্ন! ক্ষমতা থাকলে সব হয়। আমি যখন গুলি খেলাম তখন কেন রাখল আমাকে? ট্যাকেল দেয়ার ক্ষমতা আছে বলেই তো!
— আচ্ছা… তা এখন কী করতে বলো?
স্বর্ণা সোজা হয়ে ঈষৎ ঝুঁকে বসে ছিল। এবার নিরুদ্বেগে হেলান দিয়ে বলল,
— আগে সুস্থ হোক। তারপর ব্যবস্থা হবে।

বালুকাময় সমুদ্র সৈকতের রৌদ্র-চঞ্চল সোনা ঝরা বিকেল। শেষ বিকেলের রঙিন থালার মতো গোল সূর্যের ম্লান কনকপ্রভার বিচ্ছুরণে সুমুদ্দুরের রাশিরাশি জল ঝিকঝিক করে রৌদ্রস্নান করছে। জলের রৌদ্রস্নান! মাঝেমধ্যে নাম না জানা কিছু পাখি কিচকিচ করে উঠে যাচ্ছে সমুদ্র গর্জন উপেক্ষা করে। আরেকটু সময় পেরোলেই টকটকে লাল দিবাকর সমুদ্রের জলে অবগাহন করবে ধীরে ধীরে। তাঁর অবগাহনের মেয়াদ ফুরোবে আগত দিনের স্নিগ্ধ ভোরে। স্বর্ণা আর আমি পাশাপাশি হাঁটু গুঁজে বসে আছি সাগর তীরে। দু’জনেরই পরনে সদ্য কেনা ট্রাউজার আর টি-শার্ট । হুহু দমকা হাওয়ায় স্বর্ণার অবিন্যস্ত চুল উড়ছে। আলোকচ্ছটায় চোখ দু’টো কুঁচকানো। এই সৈকতে তেমন লোকের সমাগম নেই। গুটিকয়েক পর্যটক মহানন্দে লাফালাফি ও হুটোপুটি করছে সমুদ্রের ঢেউয়ে তাল মিলিয়ে। একটু পরপর নির্দিষ্ট সময়ে বিকট শব্দে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুর্দমনীয় জলরাশির লহরী। অনেক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বললাম,
— আমার বোধহয় পালিয়ে আসাটা উচিত হয় নি।
স্বর্ণা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় সুমুখে শূন্যে দৃষ্টি মেলে বলল,
— কেন এমন মনে হল?
— দেখ, তোমার সঙ্গে তো আমি জড়িত ছিলাম না। সো,চাইলেই আমি প্রমাণ করতে পারতাম যে আমি তোমার কোন সহযোগী নই।
—- হ্যাঁ তা পারতে। কিন্তু তারা তোমাকে ছাড়তো না। জেরা করতো আমার সমস্তকিছু জানার জন্য। কোনো মিথ্যা ছলনাও চলতো না,কারণ ঐ পাহাড় তোমার থানার বাইরে ছিল। কেন তুমি সেখানে যাবে! আমি জানি তুমি জীবন গেলেও কিছু বলতে না। এরপরে তারা তোমাকে ফাঁসাতো নানাভাবে। সবশেষে একুল ওকুল সবই হারাতে। জনসাধারণ আমার উপর প্রসন্ন হলেও আইন ছাড়বে না। এদেশের আইন শুধু এসব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়।
আরো কিছু বলতে চাইল স্বর্ণা। চাপা ক্রোধে ঠোঁটযুগল কেঁপে উঠল তার। এরপর আরো কিছুক্ষণ নীরবতা। আমি গভীরভাবে স্বর্ণার এই মাত্র বলা কথাগুলোর সঙ্গে পূর্ববর্তী কিছু ঘটনা মিলিয়ে দেখলাম, স্বর্ণাই সঠিক। এদেশের আইন অন্যসব ক্ষেত্রে মরা নদীর মতো হলেও লোকদেখানো আইনের বেলায় তাদের মরা নদী বর্ষার সময়ের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠে। দিনশেষে মানুষের মাথায় ঢুকানোর বৃথা সমীহা করে যে, আইন কাউকে ছাড় দেয় না! এ নিছক ছলনা বৈ কিছুই না। সাগর পাড়ের প্রাকৃতিক নিসর্গের সান্নিধ্যে এসে এমন এখন আর এই বিষয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি হল না আমার। জোর করেই নিজের জবড়ে ভাবনাগুলো চেপে নিয়ে স্বর্ণার হাত ধরে চট করে উঠে দাঁড়ালাম।
— কী হলো?
— ট্রাউজার কেন কিনেছি? চলো পানিতে নামি।
— নাহ্ তুমি যাও। স্বর্ণা জিদ ধরে বসে রইলো ঠায়। তার বলিষ্ঠ কোমল হাত আমার হাতের মুঠোয়। আরেকটা টান দিলাম আমি,
— আরে চলো না। দেখো সবাই কেমন মজা গোসল করছে।
স্বর্ণা নড়ল না। শুধু ঘাড় বাঁকা করে তাকিয়ে বলল,
— এখন মনে এতো মজা নেই।
— সে তো তোমার কোন কালেই থাকে না। মজা বের করে নিতে হয়। আসো।
এবার জোরপূর্বক দাঁড় করালাম তাকে। তবুও সে ত্যাঁদড় ছাগলের খুরের মতো পায়ের আঙুল গুটিয়ে শক্ত হয়ে রইল। আমার মনে একটা কুবুদ্ধি এলো। চোখের পলকেই স্বর্ণাকে পাঁজকোলা করে নিয়ে নিলাম। স্বর্ণা চেঁচাল,
— মুড ভালো নেই কিন্তু। নামাও এক্ষুনি। আমি শুনলাম না। ভেজা বালুতটে দ্রুত পা ফেলে নেমে গেলাম পানিতে। আশেপাশের পর্যটকরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। উরু সমান পানিতে নেমে বেগে আছড়ে পড়তে উন্মুখ এক ঢেউ এর উপর ঝুপ করে ছুঁড়ে মারলাম স্বর্ণাকে। দেখে থমকে থাকা পর্যটকেরা নয়া উদ্যমে হৈ-হুল্লোড় শুরু করল নিজেদের মধ্যে। খানিক বাদেই ভেসে উঠল স্বর্ণা। তার চোখে প্রশ্রয়। ঠোঁটের কোণে চাপা রাগের অহেতুক বাড়াবাড়ি। সে দ্রুত তেড়ে এসে আমার দুইহাত চেপে ধরে যতোদূর সম্ভব আলগা করে নোনা পানিতে ডোবাল আমাকে। আমি ডোবা অবস্থায় স্বর্ণার পায়ে টান দিলাম। ভারসাম্যহীন হয়ে স্বর্ণাও ঝপাশ করে পানিতে তলিয়ে গেল। এরপর আর কোন ধরাবাঁধা নেই। বালি ছোঁড়াছুঁড়ি ঝাঁপাঝাপি, লাফালাফি সব শেষে ক্লান্ত হয়ে পুনরায় তীরে এসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম দু’জনে। সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। তারই খানিক দূরে দীপ্ত রূপালি চাঁদ প্রসন্ন হেসে জ্যোৎস্না বিলাচ্ছে জলধিজুড়ে। স্বর্ণার ঠোঁটের কোণে খটমটে মিষ্টি হাসির ছটা। ডবডবে নিষ্পলক চোখদুটো সীমাহীন আকাশে বিস্তৃত। আমি বললাম,
— মনে লাড্ডু ফুটেছে বোধহয়। মুচকি মুচকি হাসছ। ঘটনা কী?
স্বর্ণার মুখে হাসিটা লেগেই রইল। বলল,
— ঘটনা তেমন কিছুই না।
— কেমন কিছু?
স্বর্ণা জবাব দিল না। আশেপাশে পর্যটকের ভিড় পাতলা এসেছে অনেকটাই। দু’য়েকজন যারা আছে তারাও ফেরার বন্দোবস্ত করছে। আমি বালিতে কনুই ঠেকিয়ে স্বর্ণার দিকে তাকালাম। খানিক কাছে ঘেঁষতেই স্বর্ণা চোখ রাঙিয়ে বলল,
— হুহ! দূরে সরো।
এরপরের ঘটনা বলাবাহুল্য। কুটুস করে স্বর্ণার গালে কামড় বসিয়ে দিলাম ছুট। ছোট থেকেই এই দুর্মতি আমার। বিশেষ করে বাচ্চাদের গালে কামড় বসিয়ে লাল করে ফেলাতে পৈশাচিক আনন্দ পাই আমি। স্বর্ণা ব্যথিত হয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে বসে রইল সেখানে। নড়ল না। ধাওয়াও করল না। আমি সশঙ্কিত চিত্তে পুনরায় ফিরে এলাম তার কাছে। আমি ভয়ে ভয়ে কাছে বসতেই সে তড়িৎ বালুকায় হাঁটু বসিয়ে দু’হাতে আমাকে টেনে নিল। কামড়ের বদলে আলতোভাবে স্পর্শ করালো তার নিটোল যুগ্মঠোঁট। হায়! অন্তর্যামী কি খেল!

তিনদিন পর অনিক ফিরল বটে কিন্তু আমার সিম নেই। ভাগ্য ভালো জিমেইলে সেইভ ছিল অনিকের নাম্বার। সকালে ফেরার খবর পেতেই বিকালে তার বাসায় গিয়ে দেখা করলাম আমরা।
অনিককে সমস্ত খুলে বলার পর সে খানিক চিন্তিত হয়ে বলল,
— দেখি কি করা যায়।
পুরো ঘটনাটা তার হজম করতে বেশ কসরত করতে হচ্ছে অনিককে। স্বর্ণার মতো শান্তশিষ্ট একটা প্রাণী যে পুরো দেশ উত্তাল করতে পারে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। এর আগে সে স্বর্ণার এতো বৃত্তান্ত জানতো না। আমি বললাম,
— জেলে যাওয়া ছাড়া আর কি করার আছে। পালিয়ে আর ক’দিন থাকব?
অনিক ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— চাকরি টা আর তোমার থাকছে না এটা ঠিক। যদি স্বর্ণাকে বলির পাঠা করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পার তবেই তোমার সব ঠিক থাকবে। কিন্তু জানি এটা তুমি পারবে না জানি। পুলিশকে বিশ্বাস করাতে হলে উপযুক্ত প্রমাণ লাগবে যেটা তোমার কাছে নেই। আছে শুধু স্বর্ণা, কিন্তু সেও আসামি!
আমি শুধু বললাম,
— অসম্ভব!
— হ্যাঁ অসম্ভব। জানি আপাতদৃষ্টিতে স্বর্ণার হত্যাযজ্ঞ সবার সমর্থনযোগ্য। কিন্তু ঐ যে আইনের চোখে সকলে সমান।
পাশে থাকা স্বর্ণা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
— বালের আইন।
অনিক দাঁত বের করে হাসতে ভুলল না এখানেই।
আমি বসা থেকে উঠতে উদ্যত হয়ে বললাম,
— ঠিক আছে, আসি আমরা। পরে আবার তুমিই বিপাকে পড়ে যাবে।
অনিক খলখল করে বলে উঠল,
— আরেহ বসো। এতো তাড়া কীসের? রাতে খেয়ে যেও। তোমার ভাবী রান্না করছে আজ।
দুশ্চিন্তার ভেতরেও আমার মনটা রসিক হয়ে উঠল। যা হবার হবে,তাই বলে জীবনে মজাটা থেমে থাকবে কেন? মাথার উপর থেকে দুশ্চিন্তার বোঝাটা নামালাম না বরং ছুঁড়ে মারলাম সর্বশক্তি দিয়ে। রগুড়ে গলায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বললাম,
— ভাবি কি জানে ওসব?
অনিক আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
— কোন সব?
— ক্যাম্পের কথা মনে নেই? তুমি যে মেয়ে পাগল সেটা তোমার বউয়ের জানা দরকার তো!
কথাটা একটু জোর গলাতেই বললাম যাতে তামসী (অনিকের স্ত্রী) শুনতে পায়। বাহ্ কিস্তিমাত! রান্নাঘরে ছিল তামসী। খুন্তি হাতে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে এলো সে। এরপর আচমকা তেলে পানির ছিঁটা পড়ার মতো ছ্যাঁত করে উঠে বলল ,
— আমিতো জানি সে মেয়ে পাগল। কোথায় কী করেছে বলোতো আমাকে মিনহাজ ভাই।
এটুকু বলে কপালে চাপড়ে বলল,– হায় ভগবান! কি লুইচ্চা স্বামী জুটালে আমার কপালে। ঝাটার বাড়ি মার!
আমি তুষের আগুন উসকে দিয়ে বললাম,
— আরে সেসব অনেক কথা ভাই। ক্যাম্পে কত কি করেছে সে! এসো, বস। শুনাচ্ছি।
তামসী নাকের পাটা ফুলাল। চোখ ধারণ করল রাতুল বর্ণ। একদৃষ্টিতে অনিকের দিকে তাকিয়ে কঠিন বলায় বলল,
— বল তাড়াতাড়ি কী করেছে সে!
অনিকের দিকে তাকালাম চোরা চোখে। বেচারা বউয়ের ভয়ে নাকাল। পরক্ষণেই আবার তাকালাম স্বর্ণার দিকে। স্বর্ণার মুখে রা নেই। কপালে নেই কিছুর উদব্যাক্তি। শুধু অনিমেষ চেয়ে আছে টাইলস করা মেঝেতে। আমি বললাম,
— কি আর করবে! ক্যাম্পে শুধু মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজতো। চুমকি নামে একটা মেয়ে ছিল ওটার পিছনে লাইন মারতো। তাই না অনিক?
অনিক ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বিজয়ীর মতো দৃঢ় গলায় বললাম,
— দেখলে। নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ।
তামসী চট করে উঠে দাঁড়াল। রাগে গনগন করতে করতে ধুপধুপ পা ফেলে পুনরায় রান্না ঘরে ফিরে বলল,
— চুমকি তাই না? আজ রাতে তোর খবর আছে। ওরা শান্তিতে খেয়ে যাক আগে।
এরপর শুরু হল অনবরত বকবক।
অনিক অধর সামনে প্রশস্ত করে হতাশাভরে দু-হাত উল্টাল শুধু।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম। বেশ জবর করে খাইয়েছে তামসী। নানা পদের দেখা-অদেখা, ঘ্রাত-অনাঘ্রাত, সামগ্রীতে ঠাঁসা ছিল খাবারের টেবিল। স্বর্ণা ভালো চেটেপুটে খেয়েছে। কিন্তু সে কেমন নিরুদ্বিগ্ন হয়ে ছিল পুরোটা সময়। রাস্তায় নেমেই একটা টং দোকান হতে এক প্যাকেট সিগারেট নিল সে। সঙ্গে একটা ম্যাচের বাক্স। আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম,
— এই রাতের বেলায় এটা কেন নিলে? যাক নিলেই যখন আমাকে একটা দাও।
স্বর্ণা কোনো কথা বলল না। একটা সিগারেট নিজের দুই ঠোঁটের মাঝখানে পুরে দিয়ে ফস্ করে কাঠি ঘষে আগুন ধরাল সে। আর একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ম্যাচের বাক্সসমেত। আমি সিগারেটের নেশায় প্রমত্ত দ্রুত ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিলাম সিগারেট। ঝুটঝামেলায় অনেকদিন এই জিনিস স্পর্শ করা হয় না। আজ পেয়েও ছাড়ব কেন!
— মিনহাজ!-ডাকল স্বর্ণা।
আমি কাঠি ঘষে আগুন ধরাতে ব্যস্ত হয়ে অস্ফুট বললাম,
— হু?
স্বর্ণা সিগারেটে একটানা কয়েকটা টান দিয়ে ঘোরলাগা গলায় বলল,
— আমি স্যারেন্ডার করব। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না এমন ব্যবস্থাই আমি করে যাব। আমি সাক্ষ্য দিব যে, তুমি ছিলে না আমার কোনকিছুতে। আমি তোমার ক্ষতি চাই না। সুখে থাকো এটাই চাই।
আমার হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল। আর থামল না। লাফাতেই লাগল। মুখ হয়ে গেল হতপ্রভ। ঠোঁট থেকে সিগারেট খসে পড়ল মাটিতে।

চলবে…