শেষ সূচনা পর্ব-২৬

0
301

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৬
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

ঠোঁট থেকে সিগারেট খসে পড়ল মাটিতে। অপার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। স্বর্ণা ফিরেও তাকাল না। দিঙমূঢ়ের ন্যায় আপনমনে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে সে। অনেক্ষণ পর আমার মুখে বাক্য জোগাল,
— নাহ্, এটা কোনভাবেই সম্ভব না।
— সম্ভব কি সম্ভব না সেটা সময় বলে দিবে।
বলে সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে শেষপ্রান্তটা বুটের তলায় পিষ্ট করে এগিয়ে গেল সামনে। এরপর মুখ ভর্তি সিগারেটের কুণ্ডলীগুলো নাকে মুখে সমান তালে উদগীরণ করল। সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন স্বর্ণার ভেতরের সমস্ত নৈরাশ্য,বিরাগ, বিতৃষ্ণার ভূধরগুলোকে কুহকী মায়ায় জড়িয়ে ধস নামিয়ে ভূলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। কিন্তু সেটা সাময়িক। পরক্ষণেই সেই ইন্দ্রজাল কেটে যায়। পাহাড়সম কষ্টগুলো আবারো পেয়ে বসে তাকে। আমি বুঝি৷ কিন্তু প্রকাশ করতে বাঁধা পাই। বললাম,
— এতদূর যখন এসেছি, তখন এভাবে পিছুপা হবার কোনো মানে হয় না স্বর্ণা!
— এটাকে পিছুপা হওয়া বলে না। মানুষ ভুল করে। একসময় গিয়েও বুঝতেও পারে। আজ সত্যি করে বলছি, প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় ঢাকায়। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে ঐ নাটক করি। তোমাকে সেদিন আমি দেখতে পেয়েছিলাম নাইট ক্লাবে। আমি গিয়েছিলাম একজনের ব্যাপারে ইনফরমেশন জানতে। সেখানেই হঠাৎ তোমাকে দেখি। তোমার বন্ধু নাহিদকেও চিনতে পারি। পরে গভীর রাতে তোমার পিছু পিছু ঐ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই৷ জানি না কিসে টেনেছিল আমাকে। শত চেষ্টা করেও আমি তোমার পিছু ছাড়তে পারি নি। ভুল হয়েছিল৷ বড় ভুল।
আমি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
— সেটা সেদিনই আমি বুঝেছিলাম। বলেছিলাম ও তোমাকে। কিন্তু তুমি অস্বীকার করেছিলে। যা—ইহোক, কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা না হলে আমি পুলিশের চাকরিটা করতাম না। মনে মনে শপথ করেছিলাম,তোমাকে আমি ফিরিয়ে আনবই ঐ পথ থেকে। এই সুযোগ তোমাকে ফিরিয়ে আনার। দেশের কাছে দশের কাছে শত্রুই না-হয় হলাম। ক’দিন আর এই জীবন? আজ মরলে কাল দু’দিন! আল্লাহর কাছে তো আমি আমার প্রতিদান অবশ্যই পাব। তিনি তো সমস্তই জানেন, বুঝেন। আইনের লোক হয়েও আইনের বুকে ছুরি বসানোর কারণটাও তাঁর অজানা নয়। এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে না।
— আমাকে ভুলিও না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়।
স্বর্ণার এই কথাটা একটু ঢিলে। তার কণ্ঠস্বরের অনিবিড়তা একথা স্বতঃসিদ্ধ যে সে ইতিমধ্যেই আমার কথায় নিজেকে ভুলিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা মূল সড়কে এসে পৌঁছালাম। এখানে ছোট একটা লোকাল সিএনজি স্টেশন। চাইলেই রিজার্ভ করে ঝামেলাহীন গন্তব্যে পৌঁছা যায়। আমি আপাতত হোটেলে ফেরার কথা ভাবছি না। পরিবেশটা বেশ উপভোগ্য আজ। তবে স্বর্ণার মত নেয়াটাও জরুরি। জিজ্ঞেস করলাম,
— কোথায় যাবে এখন?
স্বর্ণা অনুসন্ধিৎসু চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— যাওয়ার মতো তেমন জায়গা তো নেই। হোটেলেই তো ফিরব। আর কই?
হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখলাম,
— সবে সাড়ে ন’টা বাজে। ঘরে গিয়ে ঘুমানো ছাড়া আরো কী কাজ আছে! বিয়ে করা বউ হলে তাও একটা কথা ছিল, গল্পসল্প করা যেতো!
স্বর্ণা ফোঁড়ন কেটে বলল,
— এতোই যখন বিয়ে করার শখ, বিয়ে করে নিলেই পারো।
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,
— তুমিও রাজি, আমিও রাজি চলো ডাকি কাজি!
স্বর্ণা তাচ্ছিল্যের ঢংয়ে হাত নেড়ে বিদ্রুপের গলায় বলল,
— পুরান কথা! আমাকে না জুহিকে করো গিয়ে। রাজী থাকলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি!
— রাজি
স্বর্ণা কপট খুশির ভড়ং ধরে বলল,
— রাজি? আলহামদুলিল্লাহ!
আবারএকটু থেমে কণ্ঠস্বরে একশিসি নয়, এক গ্লাস নয়, পুরো এক বালতি বিষ ঠেলে খসখসে গলায় বলল,
— যাও দূর হও। মুক্তি দাও আমাকে।
পাশেই একটা সিএনজিতে একসঙ্গে চেপে কয়েকজন চালক মৃদু মৃদু কথা বলে আড্ডা দিচ্ছিল। স্বর্ণা তেজস্বী কণ্ঠে শুরুতে খানিক থ মেরে গিয়ে পরক্ষণেই আবার হো হো করে একসঙ্গে হেসে উঠে অট্টহাসির লহর বইয়ে দিল সেই জায়গায়। আমি একবার বিরক্তিমাখা চোখে তাকানোর পরও খলখল হাসি থামে না বরং সে বিষয়ে নানান টিপ্পনী কাটা শুরু করে। কখনো পুরুষ যা মাথা কুটেও পারে না নারী তা অবলীলায় পারে। এদের বেলায়ও ঠিক তাই। স্বর্ণা আগুনঝরা দৃষ্টি মেলে তাকায়ি গজগজ করে বলল,
— থাবড় চিনস? কান লাল করে ফেলব কুত্তার…
আর বলতে দিলাম না আমি। পুরো কথাটা মুখ থেকে উগরানোর আগেই ডান হাতে স্বর্ণাকে পেঁচিয়ে ধরে সেখান থেকে সরে এলাম। উফ্, এই মহিলার সর্বাঙ্গে এত বিষ কেন? খুঁত ধরে একজনের বিষ অন্যজনের ঘাড়ে যেকোনো উপায়ে নামাতে পারলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে! রগচটা!
……………………………………..

গোটা তিনদিন পর সমুদ্রপাড়ে এলাম। সেদিনের পর হতে এতাবৎ নানান উচাটনে এদিকটা আসার প্রয়োজন পড়ে নি। আজ এমুখো হতে হল তাও একপ্রকার অনিচ্ছা আর এক বিষম কাণ্ডের মুখে পড়ে। সংক্ষেপে বলি আপনাদেরঃ
সেই সি এন জি স্টেশন থেকে নিরুপায় হয়ে হোটেলে ফিরে রুমের অবস্থা দেখে দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অপ্রত্যাশিতভাবেই দু’জনের হৃদয়- তটে এক ভীতিপ্রদ আবহ বয়ে গেল। বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে চোখ বোলালাম ঘরের এধার-ওধার। রুমের প্রত্যেকটি জিনিস ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। বিছানা উল্টানো, কাপড়চোপড় আলুথালু মেঝেতে ছড়ানো। কে বা কারা এসব ওলট-পালট করে গেল সেটা চিন্তা করতে আমার সময় লাগলেও স্বর্ণার মাথায় মুহূর্তে খেলে গিয়েছিল পুরো ব্যাপারটা। আচমকা সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হোটেলের ছাদে। পাঁচতলা ছাদের প্যারাপেটের ওয়াল ধরে নিচে তাকানোর পর এবার পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পরলাম। নিচে র‌্যাব সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে পালানোর পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে তখন। এতক্ষণ নিশ্চয় আমরা হোটেলে ফেরার অপেক্ষায় ছিল। যেই আমরা হোটেলে ঢুকেছি ঠিক তখনি পরিকল্পনা মতো তারা হোটেল ঘিরে রেখেছে। নাকের ডগায় বিপদ টের পেয়েও স্বর্ণা ছিল নিশ্চল নিরংশু। ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে ঘুরে ঠাণ্ডা মাথায় মিনিট দুয়েক ভাবল সে। তারপর হঠাৎ একদাপটে ছুটে গিয়ে একটা দড়ি নিয়ে এলো। পঞ্চতলা ভবনের পিছনে দিকটা ছিল নোংরা এঁটো জিনিস ফেলবার স্থান। দড়িটা একটা কোমরসম পিলারের সঙ্গে গাঁট বেঁধে স্বর্ণা বিশেষ কৌশলে আমাকেসহ নিচে নেমে এলো। এরপর ঝোপঝাড় পেরিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চলে এলাম সমুদ্র পাড়ে। এই হল উক্ত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

সাগর তীরে আমরা দু’টি প্রাণী ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কারো মুখে রা নেই। পায়ের তলার মিহি বালি সুড়সুড়ি দিয়ে সরে যাচ্ছে দাপুটে হিল্লোলের তোড়ে। সঙ্গে প্রবল বাতাসে অসংবদ্ধ একটি মনের দু’টি প্রাণ। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ ফ্যাকাসে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে সাগরের চঞ্চল জলে। দূর দিগন্তে যেখানে সাগরে ডুবেছে আকাশ সেখানে আমাদের দৃষ্টি, আমাদের বর্তমান ভাবিত গন্তব্য, আমাদের ঈস্পিত স্থান। মনের অযাচিত ভাবনা সেখানে গেলে বোধহয় সূর্যের দেখা পাব, আকাশ ছুঁতে পারব,মেঘেদের জলশোষণ দেখতে পারব, অপার্থিব প্রাকৃতির সমীপে সকল কলুষতা ধুয়েমুছে নিষ্কলুষ হতে পারব। আবার মনে হয়, নিসীম দরিয়ার বিশালতার কাছে অসহায় আমরা যেন সাহায্যের নিবেদন করছি। অনেক সময় কেটে গেল এভাবে। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর স্বর্ণা বলল,
— এবার কোথায় যাবে? যেদিকেই যাই সেদিকেই তো ধরা পড়ে যাচ্ছি। আমি একা থাকলেও কথা ছিল।
আমি এক কথায় বললাম,
— আমাকে তোমার ভারী মনে হলে চলে যেতে পার একা। আমি আমার ব্যবস্থা করে নিব।
প্রথম একমিনিট স্বর্ণা নিশ্চুপ রইল। একটু পরেই আবার হতাশার সুরে বলল,
— তোমাকে আমার কখনোই ভারী মনে হয় নি। উল্টাপাল্টা ভাবো কেন?
— এটা বলার জন্য এতো সময় নিলে? আমি তো আরো ভাবলাম বড়সড় কোন কথা ভেঁজে নিচ্ছ ভিতরে ভিতরে। আর শোন, ভারী মনে না হলে ঐ কথা বলার কোন মানেই হয় না।
— এই সময় মিথ্যা অভিমান করারও মানে হয় না মিনহাজ।
— তা কী করতে বলো আমাকে?
— রেগে যেও না প্লিজ। দেখো এখন বিপদের সময়। ওরা জেনে গেছে যে আমরা কক্সবাজারে আছি। কিছু একটা ভাবতে হবে আমাদের!
আমাকে অবাক করে দিয়ে অকস্মাৎ স্বর্ণা নিজেই নিজের উদ্দীপ্ত কণ্ঠে জল ঢেলে দিল। আমি ভেবেছিলাম আরো কয়েকবার বাগ্বিতণ্ডা হয়ে শেষে আমাকেই পরাজয় স্বীকার করতে হতো। কিন্তু স্বর্ণা নিজেই পরাভূত হলে সে জায়গায় আমার কিছু করার নেই। আমি বললাম,
— কিন্তু কোথায় যাব! তারা তো উঠে পড়ে লেগেছে আমাদের পিছনে!
— লাগারই কথা। ৫ টা মার্ডার! যেটা তাদের পাওনা ছিল অনেক আগেই। বরং শাস্তিটা একটু দেরিতে হয়ে গেছে মাত্র। আট বছর আগেই যেটা হওয়া উচিত ছিল সেটা এখন হচ্ছে। এতেই ক্ষেপেছে। আমি ভেবেছিলাম সব মিশন শেষ করে ধরা দিব, শেষে তুমি এসে সব ওলটপালট করে দিলে।
একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে স্বর্ণা। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— এসে ভালো করেছি নাকি খারাপ?
— জানি নাহ্। শুধু জানি সব ওলটপালট করে দিয়েছ। পিছুটান তৈরি হয়ে গেছে। ধরা দেওয়ার কথা বললে বুকটা কেঁপে উঠে এখন।
বলতে বলতে ভেজা বালির ওপর বসে পড়ল স্বর্ণা। আমিও বসে পড়লাম স্বর্ণার পাশ ঘেঁষে। দূরপাল্লায় একটা বৃহৎ জলকল্লোল কলরব ভেঙে এগিয়ে আসছে তীরের কিনারায়। ধীরে ধীরে ঢেউয়ের দূরত্ব কমল গর্জনের নিবিড়তা বাড়ল এবং একসময় সেই ফেনিল জলরাশি আমাদের ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে পেরিয়ে গেল সামান্য দূরে। স্বর্ণা আমার হাতটা মুঠোয় নিয়ে কাঁধে মাথা রাখলো আলগোছে। জীবনের প্রথম! নাকি আটবছর পর? নাহ, এর আগেও সেই আটবছর আগে একবার রেখেছিল ঠিক এভাবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। চট্টগ্রামে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে। স্মৃতিগুলো ধূসর ঝাপসা হয়ে এসেছে। ঠিক মনে পড়ে না। আশেপাশে পর্যটক তেমন নেই। আমাদের মতো কয়েকটা জোড়া বসে আছে শুধু তারা নিজেদের খোশগল্পে মশগুল, কেউবা হালকা চালের অন্তরঙ্গ অবস্থায়, আর কেউ-বা একেবারে মাখামাখি অবস্থা। হঠাৎ! হঠাৎ দেখলাম সবাই হুড়মুড় করে ছেড়ে ছেড়ে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। স্বর্ণা কিন্তু স্বর্ণাতে নেই!আমি চমকে ওঠলাম আকস্মিক এই দৌড়াদৌড়িতে। চমকে উঠা দেখে স্বর্ণাও সংবিৎ ফিরে পেল। দ্রুত গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখে নিল সে। এরপর আচমকা সটান দাঁড়িয়ে পড়ল আমাকে সহ। উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম বুটের খটখট শব্দ। দু’জনেই বুঝে নিলাম অদূর ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে। সুমুখে সাগর পিছনে বন্দুক হাতে র‌্যাব। জলে ঝাপ দিলেও মরব। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেও ধরা পড়া নিশ্চিত,এ যেন শাঁখের করাত! শেষতক ডাঙায় আমাদের স্থান হল না। জীবন বাজি রেখে ধীরে ধীরে সমুদ্রের গভীরতম জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম। যেখানে বালির স্তর মেলে না। স্বর্ণা একহাতে ধরে আছে আমাকে। অন্য হাতে পানি কেটে সাঁতরাচ্ছে। আমিও একহাতেই চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার দম ডাঙায় তোলা পুঁটিমাছের মতোন৷ ঊর্মিমালার তোড়ে বারংবার আলাদা হয়েও আঁকড়ে ধরছি দু’জন দু’জনকে। ক্রমাগত ভাসছি আর ডুবছি আমরা। নিষ্ক্রিয় হয়ে আসছে আমার হাত পা। অসাড় হয়ে আসছে সর্বাঙ্গ। তবুও প্রাণপণে ভেসে রয়েছি আমি। অল্পদূর পাড়ি দেওয়ার পর ভাটার টানে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ভেতরের প্রাণটা আইঢাই করছে এই না গুপ্তখালে পড়ে গেলাম! তখন পুলিন থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি আমরা। পেছনে তাকালে ঝাউবনের মাথা ভিন্ন আর কিছুর দেখা মেলে না। এদিকে স্বর্ণা ভাটার স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলছে। আর অপরদিকে আমার নিঃশ্বাস যায় যায়! আমি জড়িত গলায় বললাম,
— এবার কী হবে? আমার পা তো চলে না আর।
স্বর্ণা তৎক্ষণাৎ বলল,
— মুখ বন্ধ রাখ। পানি ঢুকলে সমস্যা হবে। দেখি কি হয়। একটু পর ফিরে যাব আবার।
— কিন্তু কীভাবে? ভাটার টান পড়েছে। গুপ্তখালে পড়লে সব শেষ।
— পড়ব না ইন-শা-আল্লাহ, ভরসা হারাচ্ছ কেন।
আমি আর কথা বললাম না। সমুদ্র উত্তাল। কথা বলার কিংবা শোনার অবসর নেই। নিরবচ্ছিন্ন সুবিশাল ঠেউ ক্রমবর্ধমান। কি এক আক্রোশে ক্রমে ফুলে ফেঁপে উঠছে বারীশ। আচম্বিতে একটা বড় ঠেউ মাথার উপর দিয়ে কিনারা খোঁজায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে তেড়ে গেল। আমার নাকে মুখে প্রবল বেগে নোলা জল হানা দিল। বোধহয় পঞ্চইন্দ্রীয়ের পরতে পরতে সেই পানি বিগ্রহ চালিয়ে গেল। আমি ভারসাম্য হারালাম। এরপর? এরপর আর কিছু মনে নেই। শুধু অনুভব করলাম স্বর্ণা দ্রুত আমার হাত ছেড়ে পিঠ বেষ্টন করে ধরে আমাকে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে।

বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী শকুনের খর আস্ফালনে পড়িমরি করে উঠে বসলাম আমি। নিজেকে আবিষ্কার করলাম অচেনা,অজানা একটা জায়গায়। দু’চোখ যদ্দূর যায় শুধু দৃঢ়ীভূত স্বচ্ছ নীল পানি থৈথৈ করছে। অবান্তর ভাবনা খেলে গেল ক্লান্ত মস্তিষ্কে। কক্সবাজারের পানি তো ঘোলাটে হয়!তবে কি প্রশান্ত মহাসাগরে চলে এলাম ভাসতে ভাসতে! ধ্যূর! শুরুতে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল আমার। এরপর বুঝতে পারলাম নব্যগঠিত কোন চর-এ এসে ভিড়েছে আমাদের খেয়া। কিন্তু খেয়া তো ছিল না! স্বর্ণা ছিল। সে কোথায়? বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। রত্তি পরিমাণ শক্তি নেই পায়ে। সূর্যের প্রখর উত্তাপে চোখের আলো শেষ রাতের অন্ধকার ঘরের টিমটিমে কূপির মতো নিভু নিভু হয়ে এলো। ঘুরে ফিরে তাকানোর আগেই ধপাস করে বসে গেলাম আধভেজা চরের বেলেমাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে দৌড়ে এলো স্বর্ণা। কিন্তু হায়! অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়ে যায়। আমার কাছাকাছি আসতেই স্বর্ণা স্যাঁতসেতে বেলেমাটিতে পা পিছলে পড়ল। সহসা পদস্খলনে আশেপাশে ইতস্ততঃ পড়ে থাকা মরা সামুখের খোলসে হাঁটু আর পায়ের পাতার মধ্যখানের অংশে অনেকখানি কেটে গেল। চিরচির করে রক্ত বেরিয়ে এলো পা থেকে। স্বর্ণা সেদিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষণেই নিজের ক্ষতকে অগ্রাহ্য করে বলল,
— হঠাৎ পড়ে গেলে! তুমি ঠিক আছ?
আমি শুনলাম বটে, জবাব দিলাম না। স্বর্ণার রক্তক্ষরণে মনে হচ্ছে যেন আমার বুক থেকে কেউ শেষ রক্তবিন্দুটুকু নিংড়ে নিচ্ছে। ঝিম ধরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সব ক্লেশ সেই দীর্ঘশ্বাসে সবটুকু বিষাদ উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম। দ্রুত স্বর্ণার পা টা কাছে টেনে মরা শামুকের খোলস অতি সাবধানে উপড়ে নিলাম। রক্ত বন্ধ করার উদ্দেশ্য হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। এছাড়া উপায় নেই এই মুহূর্তে। স্বর্ণা এবার উদভ্রম হয়ে বলল,
— ওসব বাদ দাও। তোমার কেমন লাগছে এখন?
আমি মাথা নাড়লাম।
— ভালো।
মুখে ‘ভালো’ বললাম ঠিক। কিন্তু চোখের পাতা যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। স্বর্ণার পায়ে চেপে ধরা পাঁচ আঙুলের বাঁধন অজান্তে থিতু হয়ে আসতেই আমি চকিতে আবার চেপে ধরলাম। স্বর্ণা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ঈষৎ কাঁপল। খানিক পর রক্ত পড়া বন্ধ হল। আমি আবার গা এলিয়ে দিলাম আধসিক্ত মাটির বিছানায়। স্বর্ণা উদ্বেগ হয়ে বলল,
— আবার কী হলো? ঠিক আছ তো? এই…
স্বর্ণা দুই হাতে আমার মুখ নাড়াচাড়া করতে করতে বলল।
আমি খপ করে হাতটা ধরে বললাম,
— ঠিক আছি। কিন্তু ভীষণ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কী হচ্ছে বলোতো। এমন তো হবার কথা না!
স্বর্ণা চিন্তিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। তবে কিছু একটা হয়েছে অবশ্যই।
— হয়েছে তো বটেই।
বলে আবার শক্তি জুগিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
চরটা খুব একটা বড় নয়। এমাথা থেকে ওমাথা অনায়াসে চোখে ধরে। লম্বাটে চরের চারপাশে সাদা হয়ে আছে মরা ঝিনুক,শামুকের বিছানায়। হাঁটতে গেলে পায়ের তলায় মচমচ করে দুমড়ে যায় প্রাণত্যাগী ভঙ্গুর খোলস। চরের ঠিক মাঝখানে একটা বড় গাছ। নাহ্, ধারণা তবে ভুল। নব্যগঠিত চর নয় এটি। বহু পুরোনো। সমুদ্রের স্থির পানির উপর ভাসছে একটা বয়া। কোন কিছু দিয়ে আটকানো সেটি। রহস্য ভেদ করা আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও আপাতত শরীরের অক্ষমতায় নিশ্চুপ রইলাম। ঢুলুঢুলু পায়ে স্বর্ণার দোর্দণ্ড ধরে এগিয়ে গেলাম চরের কিনারায়। হাঁটু সমান পানিতে নেমে পানিতে নেমে ঝাড়া দিয়ে মুখে পানি দিলাম। লোনা পানি প্রবেশ করল মুখে। কেমন স্বাদহীন! তবুও আঁজলা ভরে পানি নিয়ে তৃষ্ণার্ত গলায় ঢেলে দিলাম৷ ঘুমঘুম রেশটা কেটেছে এবার। বোধহয় ঘুমপরীরা লবনাক্ত পানির ধৃষ্ট ছোঁয়ায় ডানা গুটিয়ে পালিয়েছে। দু’জনে ফিরে এলাম আবার ছোট্ট চরের মাঝখানের গাছটার নিচে। পুরো চরজুড়ে এইটুকুই মাত্র ছায়ার আশ্রয় নেবার স্থান। পা গুটিয়ে মুখোমুখি বসলাম আমরা। খিদেয় পেটের পোকাগুলোও মরি মরি অবস্থা। দীর্ঘদিন পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি বলে ভ্রম হচ্ছে। সংশয় দূর করতে স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এখানে এসেছি কতদিন হলো?
স্বর্ণার মুখটা বিরক্তিতে আটখানা হয়ে গেল। তবুও নরম স্বরে বলল,
— আজকেই তো এলাম কেবল!
— আজকেই? স্বগতোক্তি করলাম আমি। আবার বললাম, ক’টা বাজে?
স্বর্ণা খ্যাটখ্যাট করে উত্তর দেয়,
— আমি কি ঘড়ি নিয়ে বসে আছি? উফ্ আল্লাহ কেমন মানুষ দিলে আমার কপালে? এখন মরি মরি অবস্থা, আর সে জিজ্ঞেস করে কয়টা বাজে। আহাম্মক!
আমি পাণ্ডুর মুখে একটু হেসে বাক্যহীন চুপ করে রইলাম। একটু পর স্বর্ণা আবার শুরু করে,
— কই না একটু এখান থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজবে তা না! সে আছে যত্তসব ফালতু প্রশ্ন নিয়ে।
আমি নির্লজ্জের মতো বললাম,
— এখান থেকে বের হবার আগে এখানে আসার গল্পটা জানতে চাইছি। ঐ বয়াটা কোথায় পেলে?
স্বর্ণা বুঝল আমার সঙ্গে রাগ করা বৃথা। যেহেতু তার গণ্ডি এখন এই ক্ষীণকায় চরের মাটির ভিতরেই সীমাবদ্ধ তাই আমার সব কথার উত্তর দিতেও সে বাধ্য। বোধহয় আমার মতোন একটা অজাগতিক প্রাণীকে সহ্য করতে হবে ভেবে কতক চাপা রোষে স্বর্ণার ভ্রু, চোখ,ঠোঁট সব একসঙ্গে কুঞ্চিত হয়ে এলো। নিজেকে সংযত করার জন্য বড় বড় দুইটা নিঃশ্বাস ফেলল স্বর্ণা। এরপর তুলনামূলক শান্ত কণ্ঠে বলল,
— শোন তাহলে। তুমি যখন সামুদ্রিক কোন মাছের সুঁই ফোটাতে অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরি।
আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,
— কিন্তু কক্সবাজারে এমন প্রাণী আছে বলে তো জানতাম না!
— আরে ধুরর। তখন কক্সবাজার থেকে ভাটার টানে অনেক দূরে চলে এসেছিলাম আমরা। কিন্তু কিছু একটা কামড় দিয়েছে এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
আমি আমার পুরো পূর্ববৃত্তান্ত শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে বললাম,
— আচ্ছা, যাই—হোক। তারপর?
—— স্রোতের এতবেশি টান ছিল যে মনে হচ্ছে আমরা কোন ঘূর্নিঝড়ের মুখে চলে যাচ্ছি। এখন শরৎকাল। যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড় আসতে পারে। ভেবে গালাটা শুকিয়ে গেল আমার। ভীষণ ভয় পেলাম। কিন্তু ভয় থেকে উদ্ধার করে সঞ্জীবনী হিসেবে আল্লাহ দূত পাঠাল একটা বয়া’কে। ব্যাস সেটা জড়াজড়ি করে ধরে কোনমতে ভেসে রইলাম। এরপর সময়ের ব্যবধানে স্রোতের টানে এখানে এসে পড়লাম।
সব শুনে আমি টিপ্পনী কেটে বললাম,
— বাহ্ বাহ্ স্বর্ণা আবার ভয়ও পায়!
স্বর্ণা পুনশ্চ আগের রূপ ধরে চোখ রাতুল বর্ণ ধরে খ্যাঁকখ্যাঁক করে বলে উঠল,
— আমি ভয় পেয়েছিলাম তোর জন্য!
কয়েক সেকেন্ড বিষণ্ণবদনে চুপ করে রইল স্বর্ণা। পুনরায় মুখে একটা ম্লান হাসির রেখা টেনে বলল,
— আমার মরণ তো সেই আট বছর আগেই হয়ে গেছে। আমার সব ভয়ও সেদিন কেটে গেছে। পাথরের মতো শরীরটা নিয়ে বেঁচে থাকলেও প্রাণ নেই ভেতরে।
স্বর্ণার বিষাদভরা কণ্ঠ,অশ্রুসজল নিশ্চলা চাহনি, মুখে ঐ উদ্বেজক হাসি আমার মানসপটে গভীর রেখাপাত করল। রাজিত হৃৎপিণ্ডের তলানি হতে বারকয়েক হিল্লোলিত হয়ে ফেনিয়ে উঠল ওপরের দিকে। জানালো, ‘স্বর্ণার পিণ্ড কষ্টটাকে তুমি দলিত করে দিয়েছ’। নিজের মনের খচখচানিটা উপশম করতে আমি স্বর্ণার পাশে গিয়ে বসলাম দ্রুত। জোরপূর্বক তার মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে মৃদুস্বরে বললাম,
— এখনো কষ্ট পাচ্ছ কেন?
স্বর্ণা একইভাবে ক্লেশকর কণ্ঠে বলল,
— আরেকজন বেঁচে আছে বলে।
— তারও দিন ঘনিয়ে এসেছে। চিন্তা করো না। আমি আছি তোমার পাশে। আচ্ছা বলো না তারপর কী হল?
স্বর্ণা শুয়ে পড়ল আমার উরুর ওপর।
— কাল থেকেই ঘুমাচ্ছ। আমি ক্লান্ত, ঘুমাব একটু।
আমি সম্মতির হাসি দিয়ে বললাম,
— ঠিক আছে ঘুমাও।
স্বর্ণা কড়া গলায় হুঁশিয়ারি জারি করল,
— খবরদার তাকিয়ে থাকবে না আমার দিকে। ধরা পড়লে খবর আছে।
আমি তেলতেলে হাসলাম শুধু। সত্যি সত্যিই স্বর্ণা ঘুমিয়ে পড়ল এবং আমি তার কথার ঠিক উল্টো পিঠে বিচরণ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তার এলোমেলো বিধ্বস্ত মুখের দিকে।

ঘন্টাখানেক একধারায় বসে থাকার ফলস্বরূপ ডান উরু ব্যথায় নিসাড় হয়ে গেল সঙ্গে পায়ের পাতাও নীরক্ত হয়ে ঝিনঝিন করতে শুরু করল। না পারছি নড়তে আর না পারছি স্বর্ণাকে ডেকে তুলতে। সারারাত চেতনাহীন আমাকে নিয়ে কত কষ্ট যে সহ্য করেছে সেটা অনুভব করাও বাহুল্য। এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। মন যখন অনুকূলে থাকে প্রকৃতি তখন প্রতিকূলতা খুঁজে। বিপত্তি ঘটাল আবার সেই অবলুপ্ত প্রাণী শকুন। স্বর্ণা চমকিত হয়ে যন্ত্রের মতো চোখ মেলে পিটপিট করে তাকাল। সূর্যটা তখন পশ্চিম দিকে কিয়ৎপরিমাণ হেলে পড়েছে। তেজটাও সামান্য কমেছে। জোলো বাতাস বইছে। পুনশ্চ জোয়ারের সময় বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার ভিতর অনুমেয়। স্বর্ণা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলে আমি বললাম,
— দেখলে তোমার কত অনুরাগী আমি! তাকাতে না করেছ বলে তাকালাম না।
— হাহ্ তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করব? ব্যাঙের আবার সর্দি! ছাড়ো।
— হুমম ছাড়লাম।
স্বর্ণা চর ছেড়ে বহুদূর দৃষ্টি মেলে বলল,
— আশেপাশে চোখ রাখো। কোন জাহাজ কিংবা লঞ্চ ইস্টিমার যায় কি না। ওদের নজরে পড়লেই কাজ হয়ে যাবে।
— অনেক্ষণ তো দেখলাম কোন কিছু তো এলো না।
— তুমি যখন অচেতন ছিলে তখন একটা এসেছিল। কিন্তু ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো শক্তি আমার ছিল না। তবু চেষ্টা করেছিলাম। কাজ হয়নি৷
এরপর দু’জনের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আপনাআপনি। ভানুর উষ্মা ক্রমে ম্লান হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশটা ভারী হয়ে আসছে। নির্বাক চরের নির্বাক দু’টি ইনসান প্রস্তরীভূতের ন্যায় বসে আছেন হাঁটু গুঁজে। পেট পিঠের সঙ্গে লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা, নেই দানাপানি। মরা শামুক বিছানো চরের মতো অন্নশূন্য উদর খা খা করছে। বিকাল হয়ে এলো। কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ এলো না। স্বর্ণার ওয়াটারপ্রুফ ফোনটাও তলিয়ে সাগরের অতল গহ্বরে। শেষবার সাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে তার দলের লোকজনকে একটা ভয়েজ বার্তা পাঠিয়েছিল স্বর্ণা। সেটা পৌঁছেছে কি না জানা নেই। সে জায়গায় নেটওয়ার্ক ছিল কি না তাও অবিদিত। অর্ধেক কথাতেই প্রকাণ্ড ঢেউয়ে মোবাইলটা হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর সভ্য জগতের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সূর্য অবগাহন করল পশ্চিমের সাগরের শেষ দিগন্তে। জোয়ারের পানির উচ্ছ্বাসে সুশান্ত সাগর উত্তাল হতে শুরু করল। ছলাৎ ছলাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধারার ঊর্মি পর্যায়ক্রমে মস্ত বড় ঢেউয়ের রূপ ধরে চরের দিকবিদিকের কূলে কূলে আছড়ে পড়তে লাগল। আকাশের বুকে একিসাথে উদ্ভাসিত হল সন্ধ্যাতারা আর চাঁদ। ভ্রমণে এলে নির্ঘাত উপভোগ্য ছিল প্রকৃতির এই নিদারুণ রূপ। কিন্তু এখন নৈসর্গিক প্রকৃতির এই রূপের মুখে কালি লেপ্টে দিতে ইচ্ছে করছে। ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে আমার। দিনের আলোতে দিবাকরের আলোর ছটায় অনুরণিত লোহার পাতের স্ফুরণ চোখে আবদ্ধের চেষ্টা করলেও মলিন জোছনায় জাহাজের আলোর সন্ধানে আছি আমরা। কিন্তু নাহ্। ধীরে ধীরে আশাহত হয়ে পড়ছি। আসছে না কোন জাহাজ, জীবনে আসবেও না হয়তো। বার্তা বোধহয় পৌঁছায়নি তাদের কাছে। জীবনমৃত্যুর খেলায় আমাদের খাদ্যভাবে এখানেই হাড্ডিসার হয়ে মরে মরা শামুকের মতোই পড়ে থাকতে হবে ভেবে শিউরে উঠলাম আমি। তবে সেই শিহরনেও স্ফূর্তি নেই। একসময় স্বর্ণা পুনরায় শুয়ে পড়ল আমার উরুতে। আমি দুইহাতে তাকে উদরের কাছে আলিঙ্গন করে ধরলাম। স্বর্ণাও জাপটে ধরল আমাকে। খানিক পর অশ্রুজড়িত কণ্ঠে বলল
— কেন যে এলে আমার সাথে! এখন এখানেই বোধহয় আমাদের ধুকে ধুকে মরতে হবে।

চলবে…