#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৭
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
রাত ক্রমশ গভীর হয়। সমুদ্রতীরের নিশুতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধতা উত্তরোত্তর নিবিড় হয়। আপন হয়। শেষ রাতে চাঁদ ঢলে পড়ে পশ্চিমের আকাশে। সারারাত লুকোচুরি শেষে সলজ্জ হেসে চাঁদের আড়ালে শুকতারাও জেগে উঠে অদূরে। বোঝাতে চায়, তাদের মধ্যে কিচ্ছু নেই! তবে গভীর রাতে চাঁদের অন্তঃপটে শুকতারার আলো ম্লান হলো কিসে? কেনই বা শেষ রাত্তিরের হিম হাওয়ায় লজ্জাযুক্ত হেসে দূরে চলে গেল? সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে বোকা বানানো কি এতোই সোজা! স্বর্ণা নিশ্চুপ চোখ বন্ধ করে আছে আমার বুকের ওপর। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। শশধরের পাণ্ডুর আলোতো বোঝা বড় দায়। আমি মাথার পিছন থেকে ডান হাত টেনে এনে স্বর্ণার কপোল আলতো করে নেড়ে বললাম,
— ঘুমাচ্ছ?
স্বর্ণা জড়িত গলায় শুধু বলল,”হুঁ”
আমি একটু থেমে আবার বললাম,
— সকাল হয়ে এলো তো!
স্বর্ণা একটু সময় নিয়ে বলল,
— কিছু তো করার নেই৷ তোমার বুঝি ব্যথা লাগছে বুকে?
এই বলো উঠতে উদ্যত হল স্বর্ণা। আমি তড়তড়ে গলায় বাঁধা দিয়ে স্বর্ণাকে চেপে ধরলাম আগের জায়গায়। বললাম,
— না না, তুমি শুয়ে থাক। আমার কষ্ট হচ্ছে না।
স্বর্ণা কিছুটা নিরাশা দীর্ঘশ্বাসে বাতাসে উন্মুক্ত করে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা আবার এলিয়ে দেয় নীহারসিক্ত ঘেসো মাটিতে। ক্ষুদার্ত উদর যেন ধীরে ধীরে আমাদের বাকশক্তি শুষে নিয়ে সমাধি গড়ছে এই নিঃসঙ্গ চরে। এবার স্বর্ণা ডাকল,
— মিনহাজ!
আমি মুখের ভেতর শব্দ করলাম,
— হুমম?
— সকাল হলে আবার ভেসে যাবে ঐ বয়াটা নিয়ে?
— কোথায়?
স্বর্ণা একটু চুপ করল। বোধকরি খানিক বিরক্তও হলো। কিন্তু প্রকাশ করার শক্তি পেল না। বলল,
— নির্দিষ্ট কোন জায়গা তো নেই। ভাসতে ভাসতে যেদিকে যাই আরকি!
— রিস্ক আছে। তাছাড়া দেশের সীমানার বাইরে চলে গেলেও সমস্যা। সেখান থেকে আমরা সাহায্য পেলেও আমাদের দেশে ফিরিয়ে দেবার সময় পুলিশের হাতেই দেয়া হবে। ধরা পড়ব৷ মিডিয়ার মাধ্যমে সবাই জেনে যাবে এই ঘটনা। কী হবে ভাবতে পারছ?
স্বর্ণা মুখে দুশ্চিন্তার ‘চ’ অনুকার শব্দ করে বলল,
— দেখি…, দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করব। এরপর আর না। চেষ্টা অন্তত করতে হবে!
শেষ রাতের হিম হাওয়ায় ঈষৎ কাঁপুনি ধরেছে দু’জনের ক্লিষ্ট শরীরে। সঙ্গে শান্ত সুমুদ্দুর সকল নির্জনতা বিদীর্ণ করে জোয়ারের ঢেউ আছড়ে দিচ্ছে লম্বাটে চরের চতুর্কোণে।
আরো সময় গড়াল। কোন সাহায্যবার্তা এলো না এতাবৎ। ভেঙে পড়া স্বর্ণা এবার আত্মপ্রত্যয় নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এখান থেকে তার বেরোতেই হবে। মরলে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে মরব,ধুকে ধুকে মরার প্রশ্নই আসে না। স্বর্ণার মনের সহজ কথাটা আমিও অনায়াসে পড়ে ফেললাম। পরিকল্পনা মোতাবেক দু’জন চরের দু’মাথা দাঁড়িয়ে প্রকট সুক্ষ্ম দৃষ্টি বোলাতে শুরু করলাম। সূর্য তখন পুবের আকাশে লালিমা মেখে নব্যদিন উৎযাপনের আড়মোড়া ভেঙে উদয়াচল হচ্ছে। কুহেলিকার দল পালিয়ে যাচ্ছে সূর্যের সৈন্যদের গুলজার উপস্থিতিতে। গায়ের পাতলা টি-শার্ট ফুঁড়ে কামড় বসাচ্ছে হিমেল হাওয়া। সহজে ভেসে থাকতে শার্ট আগেই খুলে ফেলেছিলাম। পাথরে গড়া মূর্তির ন্যায় দু’জনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছি চরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ কোন ক্লান্তির ছাপ নেই দুটি প্রাণী মুখমণ্ডলে। এবার সূর্য তাঁর আসল রূপে এসে কড়া রোদ্দুর বিলিয়ে দিয়ে কিসের যেন আক্রোশ মিটাচ্ছে প্রাণভরে। ক্ষুদার্ত জঠরের পোকাগুলোও কামড়াতে কামড়াতে ক্লান্ত! কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটা পুলকিত আশার বাণীর কানে কানে শুনিয়ে দিয়ে গেল কোমল ভেজা হাওয়া। অতিমর্ত্য ভাবনা খাপে খাপ মিলে গেল।
হঠাৎই উল্লসিত গলায় তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল স্বর্ণা।
— মিনহাজ এদিকে আসো।
আমি ফিরে তাকালাম। স্বর্ণা উদব্যস্ত হয়ে আবার বলল,”তাড়াতাড়ি”
মচমচ করে মরা শামুকের খোলস জুতোর তলায় মাড়াতে মাড়াতে আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
— কী হলো?
স্বর্ণা ঠোঁটে-চোখে হাসিসমেত অশ্রুপ্লুত। ইশারায় দূরে আঙুল দেখিয়ে দিল স্বর্ণা। মূল ঘটনা জানতে আমি তাকালাম বিস্ময় নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম আমার চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। চোখে অপরিমেয় ভরসা আর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিমাখা হাসি। একটা যন্ত্রচালিত বড় নৌকা দুরাশাকে জয় করে আশার জয়ধ্বনি গেয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। আমি আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত টিশার্ট খুলে মাথার ওপর নেড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। স্বর্ণা তাদের উদ্দেশ্যে হাঁকতে শুরু করল দুইহাত মুখের দু’পাশে ধরে। কিন্তু তারা এই ছোট্ট চরের পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। আমাদের সতর্কীকরণ আরো জোরালোভাবে চালালাম। অনেক্ষণ পর তারা আমাদের দেখতে পেল এবং হাত নেড়ে তাদের এদিকে আসা নিশ্চিত করল। আশ্বাস পেয়ে দু’জনে তুষ্ট হেসে ধপ করে বসে পড়লাম চরের কিনারার বেলে মাটিতে। স্বর্ণা আপ্লুত হয়ে সহসা জাপটে গলা জড়িয়ে ধরল আমার। না দেখেও বুঝলাম স্বর্ণার মুখে হাসিটা লেগে আছে। আমিও পিঠে দু-হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিটা ঝুলিয়ে রাখলাম মুখে। অনেক্ষণ এভাবে দুটি শরীর একে মিশে যাওয়ার পর স্বর্ণা আনন্দ উচ্ছলিত কণ্ঠে জনান্তিক করল,” লাভ ইউ”
আকস্মিক এই অতিমানস দু’টো শব্দে আমি বিমোহিত হয়ে চট করে ছাড়িয়ে নিলাম স্বর্ণাকে। কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললাম,
— কী বললে?
স্বর্ণা যেন আচমকা আকাশ থেকে পড়ল। অচিরাৎ মুখ লুকাল সে, একটু তুলে বলল,
— কই? কিছু না তো!
বলে আবার লজ্জায় আরক্ত হয়ে মাথা নত করল। আমি খোঁটা দেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। ফোঁড়ন কেটে বললাম,
— কিছু না? কিছু তো শুনেছি বোধহয়।
— ভুল শুনেছ। মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
— ভুল শুনেছি আবার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে? একমুখে এতো কথা কেন?
স্বর্ণা আর জবাব দিল না আমার কথার। নৌকাটা তখন কাছাকাছি চলে এসেছে সেই সুবাদে অতন্দ্র হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। নৌকাটা ভিড়ল চরের বালি ঘেঁষে। জেলেদের মাছ ধরা নৌকা। মাছের বদলে এখন আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে হয়তো। নৌকায় একজন ষোড়শ বয়সের বালক আর দু’জন মধ্যবয়স্ক লোক। বালকটি নৌকাতেই অবস্থান করল আর বাকি দু’জন কৌতুহলী হয়ে বাঁকানো লোহার নোঙর ফেলে চরে নামল। আমাদের মুখে প্রীত হাসি। লোকগুলো আরো উৎসাহিত হয়ে আমাদের চোখে চোখ রেখে এগিয়ে এল। লোক দু’টো প্রায় একই চেহারায়। সম্পর্কে ‘ভাই’ হতে পারে। রোদে পোড়া তপ্তকাঞ্চন গায়ের রং। চোখেমুখে মরুভূমিসম রুক্ষতা।পরনে লুঙ্গি আর ফুলহাতা জীর্ণ-শীর্ণ শার্ট। দু’জনেরই লুঙ্গি উরু পর্যন্ত গোটানো। শুধু একজনের বয়স দু’চার বছর এদিক-ওদিক হবে এই যা! কাছে এগিয়ে এলে তাদের মধ্যে একজন কপাল কুঁচকে বলল,
— তোঁয়ারা এডে কেনে আইস্সু?
অর্থাৎ ‘তোমরা এখানে কীভাবে এলে?’ স্বর্ণা আর আমি সহজেই লোকটার হৃদয়ঙ্গম করে নিলাম। লোকগুলো চট্টগ্রামের ভাষাভাষীর মানুষ। হয়তো জীবীকার তাগিদে সমুদ্রে মাছ ধরে। কাছের মানুষ পেয়ে আমাদের আনন্দটা আরো দ্বিগুণ উছলে উঠলেও তৎক্ষণাৎ চেপে গেলাম। আমি চট্টগ্রামের ভাষাতেই লোকটাকে সমস্ত বুঝিয়ে দিলাম এই চরে আসার কাহিনি। শুধুমাত্র র্যাব, পুলিশের ঝঞ্ঝাটের কথাটা এড়িয়ে গেলাম। সব শুনে তারা আফসোস করল এবং আমাদের নিয়ে যেতে সম্মত হল সেন্টমার্টিনস দ্বীপে। তারা সেখানেই থাকে সপরিবারে। শুরুতে তারা আমাদের সঙ্গে করেই মাছ ধরার কাজ সমাধা করতে চাইলে স্বর্ণা বাতাসের গতিতে বাঁধা দিয়ে বলে,
— না না, আপনারা নিয়ে চলুন আমাদের। আজকের দিনে যা ‘লস’ হবে আমি সব দিয়ে দিব।
আমি স্বর্ণার জঠরে কনুই দিয়ে আঙলে ফিসফিস করে বললাম,
— টাকা কোথায় পাবে? সব তো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
স্বর্ণা আমাকে ধমকে বলল,
— আহ,তুমি চুপ থাকো। ফোন করলে কত টাকা আসবে তার হিসেব নেই। তুমি আছ টাকা নিয়ে!
বাঁচাল লোকটা বলল,
— কি অইয়্যি? টিঁয়া নাই? সমস্যে নাই… চলোন টিঁয়া লাইগদুনু। ( কী হয়েছে? টাকা নেই?… সমস্যা নেই চলুন টাকা লাগবে না)
অন্য লোকটিও মাথা নেড়ে মৃদু হেসে সম্মতি জ্ঞাপন করল।
বটবট শব্দ করে নৌকা ছুটে চলল সেন মার্টিনস্ দ্বীপের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব বেশি নয়। মুষ্টিমেয় এক ঘন্টার ভিতর আমরা দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। দেশি লোক পেয়ে জেলে আপন দুই ভাই আমাদের সঙ্গে জমপেশ আড্ডা জুড়ে দিয়েছিল। আমরাও সকল চিন্তা,দুশ্চিন্তাকে একপাশে রেখে সমানে কথাবার্তা চালিয়ে গেলাম। দ্বীপে এসে স্বর্ণার গুহ্য পকেট থেকে একটা সিম বের করে বাঁচাল লোকটার ফোনে ঢুকাল। এরপর একটা নাম্বারে ফোন করে পৌঢ় লোকটার বিকাশ একাউন্টে একটা এমাউন্ট দিয়ে দিতে বলল এবং আমাদের খরচার সুবিধার্থে পাশের বিকাশের দোকানেও কিছু টাকা ক্যাশআওটের জন্য পাঠাতে বলল। আমার অচেনা ফোনের ওপাশের লোকটা তাইরে নাইরে না করে সঙ্গে সঙ্গেই টাকা পাঠাল৷ জেলে দুই ভাই বড় খুশি হলো স্বর্ণার অনুষঙ্গ মহানুভবতায়। যদিও এই অর্থ গ্রহণ বিনামূল্যে নয়! এটা তাদের কর্তব্যের মধ্যেই ছিল। তবু তাদের চেহেরার অভূতপূর্ব উজ্জ্বলতা দেখে মনে হলো এই টাকা দুইভাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলে শান্তিতে দু’দিন ঘুমোতে পারবে। অবশ্যি ঘরে বসে থাকাটা তাদের ধাতে নেই। খেটে খাওয়া মানুষ তারা। ঘরে বসে থাকলে গা কুটকুট করে। অবশেষে দ্বীপের অল্পকিছু নিয়ম-কানুন বাতলে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিল দুই জেলে। আমরাও এ পর্যায়ে বিশাল আতান্তর হতে নিষ্ক্রান্ত হলাম।
দুই জেলে বিদায়ের পরের পর্বে আমরা শুরুতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এরপর আচ্ছামত গণ্ডেপিণ্ডে ভোজন শুরু করলাম৷ কোরাল, সুন্দরী পোয়া, ইলিশ, রূপচাঁদা, লবস্টার সহ নাম না জানা সামুদ্রিক খাবারের বিবিধ সমারোহে টেবিল ঠাসা। রেস্টুরেন্টের প্রায় সকল মানুষ একবারের জন্য হলেও আমাদের ‘পরে তির্যক দৃষ্টি পতিত করছে। তাতে কি? শকুনের দোয়ায় কি আর গরু মরে? আমরা আমাদের মতো খাবার উদরসাৎ করতে লাগলাম। প্রায় দেড়দিন পেটে খাবার না পড়ায় পেটও বোধহয় আমাদের বকাবকি করতে ভুলেনি। সভ্য জগতের খাই খাই করা মানুষের পক্ষে একবেলা না খেয়ে থাকা বড়ো দুষ্কর। সে যতোই বীর্যবান আর বীর্যবতী হোক না কেন খিদের সাগরে নাকানিচুবানি সে খাবেই। স্বর্ণার অবস্থাও অনেকটা তা-ই। বুভুক্ষুর মতোন খাবার গিলছে সে। কেউ কারোর দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। দু’জনেই নিজ পেটে খাবার পুরাতে ব্যস্ত। রেস্টুরেন্টে একপেট খাবার শেষে দাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এরপর চোখে পড়ল সেন্টমার্টিনস দ্বীপের বিখ্যাত সুপেয় ডাব। বিক্রেতার কাছ থেকে ডাবের মুখ কেটে পাইপ লাগিয়ে মনভরে চুমুক দিলাম আমরা। স্বর্ণা নিখুঁত ঢংয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল,
— উমম, জুস থেকে বেটার এখানকার ডাব। দারুণ মিষ্টি!
আমি বললাম,
— হ্যাঁ, একারণেই তো এজায়গার অন্য নাম নারিকেল জিঞ্জিরা।
— হুমমম। এখানে থেকে গেলেই ভালো হতো তাই-না?
আমি ডাব খেতে খেতে হাসলাম। বললাম,
— শুধু ডাব খাবার জন্য?
স্বর্ণা গম্ভীরভাবে বলল
— হুমমম, সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হয় না! তবে জায়গাটা সত্যিই চমৎকার।
ডাবের দাম দিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটে ফিরে এলাম পুনরায় সৈকতে। উদ্দেশ্য, এখান থেকেই কক্সবাজার নাহয় টেকনাফ হয়ে ঢাকা রওনা দেওয়া। যেখানে রয়েছে স্বর্ণার পরবর্তী শিকার। কিন্তু প্রকৃতির এই স্বর্গমর্ত্য আমাদের আঁটকে রাখল সৈকতের নান্দনিক সৌন্দর্যের কার্নিশে। বাস্তবিকই জায়গাটা অপ্রতিম দৃষ্টিনন্দন। বোধকরি নয়নাভিরাম প্রকৃতির আবড়ালে এখানেই সব অবসাদের বিসর্জন দেয়া হয়! ঝিরিঝিরি হিমশীতল পবনে দোলা দিচ্ছে সমস্ত অন্তঃকরণ। দিগন্তের শেষ প্রান্তভাগে স্বচ্চ নীল পানির সঙ্গে মিলেছে নীল আকাশ। আপাতদৃষ্টিতে নীল জল ফুঁড়েই নীল অম্বরের উদয়ান্ত হয়েছে বলে ভ্রম হয়। সাগর তীরে সারি সারি নারিকেল গাছের মাথায় ঝুলছে পরিপুষ্ট ডাব। গাছগুলোর পাতায় পাতায় কলতান তুলছে নানা প্রজাতির মুক্ত বিহঙ্গ। কাকচক্ষু পানিতে তিরবির করে খেলা করছে সুরম্য জেলিফিশ। দেখে স্বর্ণার ভেতরকার বাচ্চামি স্বভাবটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দৌড়ে ধরতে যায় সে। কিন্তু ধরতে ব্যর্থ হয়ে মন বেজার করে স্বর্ণা। কি যেন ভাবে। পুনরায় ফিরে আসে শুকনো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার পাশে। আমি হেসে বলি,
— কী ধরতে পারলে না?
— হেসো না তো। মাছগুলো কিন্তু সুন্দর।
আমি বিদ্বান ভাব ধরে বলি,
— সুন্দর জিনিস ধরতে নেই, একে চোখ দিয়ে দেখতে হয়।
— হয়েছে জ্ঞান দিও না। চলো।
— কোথায়?
— কোথায় আবার? ফিরে যাব। প্রথমে টেকনাফ। এরপর সেখান থেকে দেখা যাবে।
আমি স্বগতোক্তি করলাম,
— চলে যাবে এতো তাড়াতাড়ি?
স্বর্ণা এই প্রশ্নে খানিক দ্বিধায় পড়ে। তবুও জোর করে বলে,
— নয়তো কী? এখানে তো থাকতে আসিনি! ইচ্ছে থাকলেও তো থাকা যাবে না।
— তা ঠিক। কিন্তু আমার মনে হয় অন্যান্য জায়গা থেকে এই দ্বীপ অনেকটা নিরাপদ।
স্বর্ণা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুখ কড়কে বলে,
— কচু নিরাপদ! তুমি তো কিছুই জানো না দেখছি। ওরা প্রথমে ডুবুরি দিয়ে আমাদের খোঁজ করবে বেঁচে আছি কি মরে গেছি সেটা দেখার জন্য৷ না পেলে এর আশেপাশের এলাকা গুলোতে, দ্বীপপুঞ্জগুলোতে খোঁজ করবে। আর তোমার এখানেই নিরাপদ মনে হলো?
স্বর্ণার মননশীল গভীরতায় আমি এতোটুকু হয়ে গেলাম। জবাবের আর জায়গা রইল না। শুধু “ঠিক আছে, চলো। ” বলে ঘাটে যাবার জন্য উদ্যত হলাম।
কয়েক পা এগোতেই স্বর্ণা পিছন থেকে ডাকল,
— শোন,
আমি সরু তাকালাম,
— বলো…।
— আজকেই যাবার প্রয়োজন নেই। কাল যাই। অনেক ধকল গেছে এ কয়দিনে। একটা রিসোর্টে উঠে যাই চল।
আমি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,
— কিন্তু রিসোর্টের ভাড়া তো অনেক।
স্বর্ণা ঠোঁট সংকুচিত করে বলল,
— ভাড়া কি তোমাকে দিতে বলেছি?
আমি সামান্য থতমত খেয়ে বললাম,
— না।
এবার স্বর্ণা রোবটের মতো কপট হেসে বলল,
— তাহলে চলো। কলেজে ভ্রমণের সময় যেভাবে কিপ্টামি করতে এখনো সেই কিপ্টাই রয়ে গেছ।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে রইলাম। এই মেয়েটা অহর্নিশ আমাকে অপদস্ত করে চলেছে। নাহ্ আর ভালো লাগে না! মনে মনে হাসলাম আবার। মেয়েটার এই স্বভাব তো মজ্জাগত। এ সংশোধনের অযোগ্য। মাধ্যমিকের শেষ বর্ষে যেভাবে মার খেয়েছিলাম তা এখনো ভুলিনি। ভোলা সম্ভবই না! মনের হাসিটা কখন যে মনের দরজা দিয়ে পালিয়ে মুখজুড়ে এসে আস্তানা গেড়েছে ঠিক বুঝতে পারিনি। স্বর্ণা বলল,
— হাসছ যে?
আমি কথা ঘুরালাম। বললাম,
— তোমার যখন টাকা নিয়ে কিপ্টামি ভালো লাগে না। এতোই যখন দেশের আনাচে-কানাচেতে টাকা পাঠানোর মানুষ থাকে তাহলে কক্সবাজারে টাকা বাঁচাতে এক রুমে থাকলে কেন? কষ্ট করে আপনাকে খাটে ঘুমিয়ে নিজে ফ্লোরে বিছানা করে থাকলে কেন?
স্বর্ণা মুখ থেকে কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেল লজ্জার রক্ততে। সীমাহীন নীলাম্বুর দিকে তাকিয়ে নিজের সমস্ত লজ্জা যেন কবর দিয়ে চাইল। কিন্তু পারল না। মৃদু মৃদু হাসির ছটাযুক্ত মুখে দৃঢ়তা এনে বলল,
— আর কি, চারিদিকে বিপদ। তাই কাছাকাছি রেখেছি।
বলা শেষে আবার মুখ ঘুরিয়ে হাসল স্বর্ণা৷ এবার আমিও না হেসে পারলাম না। স্বর্ণা হাসির শব্দ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
— হাসছ কেন?
অথচ তার মুখেও হাসির দীপ্তি খেলে বেড়াচ্ছে প্রবল বেগে।
আজ আর যাওয়া হল না। আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভালো একটা রিসোর্টের খোঁজে। আধাঘন্টা খানেক খুঁজে একটা রিসোর্টে উটে গেলাম আমরা।দুপুর গড়িয়েছে তখন। হয়তো লজ্জায়, হয়তো কিছুটা ক্ষোভে স্বর্ণা এবার আমাকে আলাদা করে রাখল। আমি আমার রুমে এসে শুয়ে পড়েছি। ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসতেও খুব একটা সময় লাগল না। ঘুম ভাঙল পড়ন্ত বিকেলের জানালার পর্দা ভেদিয়ে আসা একটুকরো রোদ্দুরের মেদুর স্পর্শে। আমি আন্দোলিত হয়ে শোয়া থেকে উঠতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। শরীরটা কেমন দুর্বল হয়ে ভেঙে এলো। দুইহাত-পায়ে যেন শক্তির বালাই নেই। গা পুড়ে যাচ্ছে বিষম জ্বরে। একটা ভুট্টা রেখে দিলে খই হয়ে ফুটবে এমন উত্তাপ! কোনমতে দ্বারের দিকে মুখ করে শুলাম। স্বর্ণা এসে উঁকি দিলে ডাক দিতে পারব সেই বিশ্বাসে। আমি জানি সে মাঝেমধ্যেই উঁকি দেয় দরজার আড়ালে। গত কয়েকদিনের পানির সান্নিধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ঝক্কি-ঝামেলার পরিণাম এই। সেই প্রমাদ গুনছি এখন। কিন্তু স্বর্ণার দেখা নেই। আচ্ছা তারও কি জ্বর এসেছে? নাকি ক্লান্ত শরীরের ঘুম ভাঙছে না সহজে? এই মুহূর্তে ধরনীতে কি ঘটছে আমার ঠিক বোধ্য নয়। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। সূর্য অস্তমান হলো। তবু স্বর্ণা নিরুদ্দেশ। আমি আকুল হলাম। মনে মনে স্বর্ণাকে ডাকলাম আমি এবং অলৌকিকভাবে ঠিক সেই সময় কটাস করে দরজা খুলল স্বর্ণা। আমি তখনো তিমিত চোখে চেয়ে আছি দরজার দিকে। স্বর্ণা শুরুতে একবার উঁকি দিল। পরে কি মনে করে শঙ্কিত চোখে ঘরে ঢুকল ধীরে ধীরে।
— এখনো ঘুমোচ্ছ কেন? বলে বিছানার পাশে চেপে বসল স্বর্ণা।
আমি জ্বরের ঘোরে স্বর্ণার ডান হাত দুইহাতে ধরে বুকের মধ্যে পুরলাম। এরপর একটু ঘুমজড়িমা শব্দ করে চোখ বন্ধ করলাম। স্বর্ণা আঁতকে ওঠল। দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বলল,
— তোমার তো ভীষণ জ্বর! জ্বর কখন এল। ডাকলে না কেন?
বাস্তবিক এতো প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো শক্তি এবং সামর্থ্য কোনটাই আমার ছিল না। আমি কপালে ঠেকানো হাতটা টেনে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
— কিছু হয়নি। ঠিক আছি।
কথাটা কেন বললাম আমার জানা নেই।অথচ জ্বরে আমি মরণাপন্ন! জ্বরের বেঘোরে ভুলভাল বকছি নাকি অন্যকিছু নিজেরই বোধগম্য নয়। অনেকটা হুঁশ ঠিক মাথা খারাপের মতো অবস্থা।
স্বর্ণা ধমকে বলল,
— আরে কী বলছ কিছু হয়নি। জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। এসো ডাক্তার দেখাব। ওঠো।
আমি বললাম,
— উঠার তো শক্তি নেই। কোলে করে নিয়ে যাও।
স্বর্ণা ফিচেল হাসি দিয়ে টনটনে গলায় বলল,
— উঃ জ্বরে মুমূর্ষ সেখানেও অসভ্যতা ভুলে না।
একটু থেমে কণ্ঠস্বর অতিশয় মোলায়েম করে বলল,
— থাকো হ্যাঁ?আমি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি।
আমি হ্যাঁ সূচক চোখ টিপলাম।
খানিক পর স্বর্ণা ডাক্তার নিয়ে এল। ডাক্তার জানাল তেমন বেশি কিছু নয়। রক্তের পিএইচ কমে যাওয়ায় একটা স্যালাইন চালিয়ে দিয়ে গেল হাতের শিরা ফুঁড়ে। ঔষধ খেলেই জ্বর নামবে তরতর করে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ডাক্তার ফিঃ নিয়ে বিদায় নিল। স্বর্ণা জলপট্টি দিতে বসল পাশে একটি ইজিচেয়ারে বসে। আমি আবদার করলাম,
— পাশে এসে বসো , অতো দূরে কেন?
স্বর্ণা বসল না। আমি এবার ‘ইমোশনাল ব্লাকমেইল’র সহয়তা নিয়ে বললাম,
— মরে টরে গেলে পরে আফসোস করবে কিন্তু!
স্বর্ণা একবার কোপদৃষ্টিতে তাকাল। পরে কি মনে করে আমার কথানুযায়ী খাটের ওপর
এসে বসে জলসেঁক দিতে শুরু করল। আমিও গভীর তনিষ্টচিত্তে কর্মরত সুষমা স্বর্ণার মুখপানে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টে। স্বর্ণা আমার সেই চাহনিতে কখনো দাবড় দেয় আবার কখনো সলজ্জ হেসে জলপট্টি ঠেকানো কপালে মৃদু গাট্টা মারে। প্রখর দুর্দশার মধ্যেও গুটিকয়েক ঘটনায় আজকের দিনটা একটু ভিন্নতর মাত্রা। দিনশেষে ভালো একটি দিন।
একদিকে র্যাবসহ পুলিশ নীরবে আমাদের তন্নতন্ন করে খুঁজছে আর অপরদিকে আমরা তাদের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এমন লুকোচুরি খেলার মধ্যস্থতা করল আচমকা এই জ্বর। স্বর্ণা একটা দ্বিতীয়বার ব্যবহৃত ফোন কিনে এনেছে আপাতত ব্যবহারের জন্য। সমস্ত সোস্যাল মিডিয়া খুঁজে কোথাও আমাদের খবর পাওয়া গেল না। তারমানে এখনো সবকিছু নেপথ্যেই চলছে। যেই মাত্র ফাঁস করা হবে তখনই দু’জনের সভ্য জগতে টিকে থাকা দুষ্কর হবে। যতোই সাধারণ মানুষ আমাদের কর্মকাণ্ডের পক্ষপাতিত্ব করুক! রাত তখন দশটা পেরিয়েছে। আমার সামনে বসেই স্বর্ণা ‘DONT’ পেইজ থেকে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে একটা পোস্ট করল, পোস্টটি ঠিক এরকম
” নেক্সট মিশন কামিং সুন। জাতি একজন চরিত্রহীন ধর্ষকের বিকৃত লাশ দেখার অপেক্ষায় থাকুক।” এরপর একটি হাসির ইমুজি। সেই পোস্টও সঙ্গে সঙ্গে ভাইরালের তকমা পেল। গত দুইবারের মতো এবারো মানুষ স্বর্ণাকে শুভকামনা জানাচ্ছে! অনেকেই স্বর্ণাকে সমর্থন মন্তব্যে রচনা লিখে স্বর্ণার কার্যক্রম ইতিবাচক প্রমাণ করছে। এমন আরো কত কি! আমি তখন কিছুটা সুস্থ। স্যালাইনের উৎকর্ষতায় শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে অনেকটা। এবং জলসেকের ফলে জ্বরও নেমে গেছে কিছুটা। স্বর্ণাকে বললাম,
— এই পোস্টের মাধ্যমে তো র্যাব জেনে যাবে যে আমরা সাগরে ডুবে মারা যাইনি। তারা জল ছেড়ে স্থলভাগে আমাদের খোঁজতে শুরু করবে!
—- ওরা অলরেডি জেনে গেছে যে আমরা কোথাও উঠেছি। আমরা আর পানিতে নেই।
— কীভাবে?
— বলতে বাধ্য নই। তবে আমি শতভাগ নিশ্চিত। আর কিছু বলার আছে?
আমি “না” বলে চোখ বন্ধ করলাম। অদ্ভুত মেয়ে! হুটহাট চাপা রোষে আগুন হয়ে থাকে।একটু পর চোখ খুলে স্বর্ণার কাছে ফোন চাইলাম।
— ফোনটা দাও তো!
— কেন? জুহির সঙ্গে কথা বলবে? একটু রসিয়ে রসিয়ে বলল স্বর্ণা।
আমি স্বর্ণার কৌতুকে যোগ দিলাম না৷ নিজস্বতা বজার রেখে শক্ত গলায় বললাম,
— ফোনটা দাও! গত কয়েকদিন মায়ের খোঁজ নেয়া হয়নি।
আমার নিস্পৃহতা দেখে স্বর্ণার মধ্যকার কৌতুকটা নিমিষেই অন্তর্হিত হয়ে গেল। সেও শক্ত গলায় বলল,
— থাক,তোমার বলতে হবে না, আমিই ফোন দিচ্ছি। নাম্বারটা বল।
— ০১৭…
— এটা কার নাম্বার?
— মায়ের।
স্বর্ণা গঞ্জনা দিয়ে বলল,
— কেন? জুহিরটা বলো না!
অকারণ খচখচ করছিল আমার ভেতরটা৷ ভালো লাগছিল না স্বর্ণার এসব ভাঁড়ামি। আমি ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিজেই নাম্বার ডায়াল করতে শুরু করলাম। স্বর্ণাও ঠিক একইভাবে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে তির্যক শানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— নাম্বার বল।
নাম্বার বলা হয়ে গেলে স্বর্ণা মুখে প্রলম্বিত হাসিটা আরো চওড়া করে ফোন কানে দিল। কয়েক সেকেন্ড পর সে বলো ওঠল,
— আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। স্বর্ণা হাসিটা সামন্য ম্লান করে বলল,
— ওও জুহি? কেমন আছ?… হ্যাঁ আমিও ভালো। এরপরেই স্বর্ণার মুখ থেকে হাসিটা পুরোদস্তুর মিলিয়ে গেল। চিন্তাযুক্ত গলায় বলল,
— কী বলছ? সত্যি?
স্বর্ণার আকস্মিক স্বর পরিবর্তনে আমি সন্ত্রস্তচিত্তে উঠে বসলাম। ব্যাকুল দৃষ্টিপাত করলাম স্বর্ণার উপর। সে চিন্তিত হয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি অস্থির গলায় শুধালাম,
— কী হয়েছে?
স্বর্ণা অধোবদনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা তুলে বলল,
— আন্টির অবস্থা ভালো না। অসুস্থ!
আমি চোখমুখে অন্ধকার দেখলাম মুহূর্তেক। অনিচ্ছায় একটা শব্দ উৎরে এল আমার মুখ দিয়ে,
— মানে?
স্বর্ণা একটু অপ্রস্তুত হলো।
— কোন সমস্যা হবে না আশা করি। জুহি নিজের মায়ের অসুখ বলে ছুটি নিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসেছে তোমার মাকে। সিলেটে রাখেনি। তারা ঢাকা মেডিকেল সাজেস্ট করেছে। চট্টগ্রাম থেকে তোমার বাবা গেছে সেখানে। চিন্তা করো না আমরা…
স্বর্ণা আর কোন কথা ঢুকল না আমার কানে। মাথার মগজগুলো কেমন যেন টগবগ করে ওঠল। উদ্ভ্রম চিন্তায় অস্থিরতায়, মাথার দু’পাশের রগ দপদপ করতে লাগল অনবরত। সমস্তকিছু উপেক্ষা করে চট করে উঠে দাঁড়ালাম আমি। এরপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। পর্যায়ক্রমে রিসোর্ট থেকে। আমার নাজুক বিধ্বস্ত শরীরে কোত্থেকে যেন অশুরের ন্যায় শক্তি এসে ভর করল। গটগট করে হেঁটে চলেছি আমি অগন্তব্য নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে। স্বর্ণা ব্যস্তব্যকুল হয়ে পেছন থেকে ডেকে চলেছে আমাকে।
— মিনহাজ দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছ এই রাতের বেলা। শরীর খারাপ তোমার!
চিরকাল স্বর্ণার সকল কথা আমি গ্রাহ্য করে এসেছি। আজ অগ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হলো। তাই করলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম না। নিজের কাছে নিজেকে ব্যাপক শক্তিশালী মনে হলেও আদতে আমি অল্পতেই হাঁপিয়ে গেলাম। স্বর্ণা দৌড়ে আমার সামনে এসে বাঁধা দিল। চিৎকার করে বলল,
— এখন কোথায় কীভাবে কী করবে তুমি? না কোন জাহাজ পাওয়া যাবে না কোন স্পিট বোট? গায়ের জোর দেখালেই শুধু হয়?
আলোতে ভরপুর ছোট তল্লাট। পাশের অন্য একটা রিসোর্টের ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে নারকেল গাছে ফাঁক গলে। আমি স্তিমিত চোখে তাকালাম স্বর্ণার দিকে৷ এরপর আচমকা জাপটে ধরে ভেতরে জমে থাকা সকল দুঃখ নিংড়ে বের করে চোখ হয়ে স্বর্ণার ঘাড়ে উপুড় করে দিলাম। স্বর্ণা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
— আহা চুপ করো। কি বাচ্চাদের মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্না শুরু করলে? আন্টির কিছু হবে না। ওরকম অসুস্থ সবাই-ই হয়।
কথাটার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।বারবার নিজেকেই অপরাধী মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল বোধহয় আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী।
চলবে…