#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৮
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
কথঞ্চিৎ নিজেকে সংবরণ করে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলাম স্বর্ণাকে। ঘুরে হাঁটা শুরু করলাম ঢিমেতালে। স্বর্ণাও নির্বাক ইতিউতি করতে করতে হাঁটতে শুরু করল পাশাপাশি। মাঝে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল কি ভেবে! বেশ কিছুক্ষণ কাটল এভাবে। খানিক পর সাহস পুঞ্জীভূত করে বলল,
— চলো, রিসোর্টে ফিরে যাই। এখানে হাঁটলে তো সমস্যা সমাধান হবে না!
আমি হাঁটা থামিয়ে মৃদু বললাম,
— রিসোর্টে ফিরে গেলেও তো সমস্যা সমাধান হবে না!
স্বর্ণা ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আর কোন জবাব দিল না। গন্তব্যহীন হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাত্রির জলধির সৌন্দর্য শোষণ করতে চলে এলাম। মূলত অনাকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছে আমাদের ছিল না। তবু কিসের টানে যেন বুনো মোষের মতো ছুটে এলাম এই সমুদ্রতীরে। সেই থেকে স্বর্ণা মুখে আঠা লাগিয়ে বসে আছে, আর খুলেনি।
আমার দেখাদেখি স্বর্ণাও অল্প দূরত্বে বসে পড়ল একটা শ্বেত পাথরের উপর। নীলিমায় শরতের শুভ্র জ্যোৎস্না ত্যারচাভাবে পড়ে রূপোর আলো খেলছে ঈষৎ আলোড়িত নীল পানিতে। নারকেল গাছের সরু লম্বা পাতায় দুলছে দুইজোড়া বাদুড়। সাগরের কোল থেকে ধেয়ে আসছে মৃদু-মন্দ উষ্ণতাহীন হিম হাওয়া। গায়ের জ্বর ছাড়েনি পুরোপুরি। কারণেই সেই হিম হাওয়া আমার শরীরে কাঁটার মতো এসে বিঁধছে আর খানিক পরপর আপাদমস্তক ঝিরঝির কাঁপুনি দিয়ে সর্বাঙ্গের রোমকূপ ভীত হয়ে হিম হাওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু দুর্বল শরীরের উষ্ণতায় বারংবার পর্যুদস্ত হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বাক্যহীন বসে থাকার পর স্বর্ণা কথা বলল,
— মিনহাজ! এভাবে বসে থেকে কী হবে? তোমার জ্বর। একটু রেস্ট নিলে কাল আরামসে রওনা দিতে পারব আমরা।
অনেক্ষণ পর হঠাৎ স্বর্ণার কণ্ঠ শুনে ধ্যানচ্যুত হলাম। আমি না তাকিয়েই জবাব দিলাম,
— রেস্ট নিতে হবে না। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।
স্বর্ণা তর্ক করল,
— আমারটা তো আমি দেখব। কিন্তু এখানে বসে থাকার তো কোন মানে নেই।
— সবকিছুর মানে খুঁজতে নেই।
স্বর্ণা চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদ্ভুত অমর্ষে দাঁত কিড়মিড় করে চাপা গনগনে গলায় বলল,
— তাহলে, তুমি থাকো। আমি গেলাম।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য। নিদ্রিত বালুকার ‘পরে স্বর্ণা তপতপ সদম্ভ পা ফেলে চলে গেল। এই মেয়েটাকে আমি আজো বুঝি না। কোথায় অবসিতপ্রায় আমাকে সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবে তা না! উলটো সে রেগেমেগে আগুন হয়ে সেই আগুনের ফিনিকে ঝলসে দিয়ে গেল আমাকে। কিন্তু আমি অনড়। ডাঁট দেখিয়ে ঠিকি বসে রইলাম। মিনিট কয়েক পর রাগ পড়ে গেলে স্বর্ণা কোত্থেকে এসে আবার আমার পাশে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা শীতল হাত রাখল আমার স্কন্ধে। আমি ভূতগ্রস্তের মতো চমকে উঠে ধপাস করে পাথর থেকে বালুর উপর পড়ে গেলাম। দুইহাতের তালুতে ভর দিয়ে গাত্রস্তম্ভ খাড়া করলাম। রুগ্ন শরীরে সামান্য ব্যথার ইঙ্গিতও পেলাম। তবু চেপে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম,
— তোমার হাত এতো ঠাণ্ডা কেন? তুমি কি মানুষ?
স্বর্ণা আশ্চর্য হয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,
— ধ্যুর আবার রাগ তুলো না তো। এসো ওঠো।
আমি সন্দিহান হয়ে আবার শুধালাম,
— ভূত-প্রেত না তো? দেখি আয়াতুল কুরসি পড় তো!
স্বর্ণার ভেতরে ফুঁসে উঠা রাগকে ঠাস ঠাস দু’টো চপেটাঘাত করে দূরে ছুঁড়ে রাগ সংবরণ করল। এরপর গড়গড় করে আয়াতুল কুরসি পাঠ করল। শুনে আমার মুখে নিশ্চিতের হাসি ফুটল। স্বর্ণাও আমার হাসির অনুরূপ ভণিতা করে হেসে বলল,।
— এখন অনেক খুশি! এসো। সুন্দর করে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
অকস্মাৎ স্বর্ণার মতি পরিবর্তন দেখে আমি খোঁটা দেয়া গলায় বললাম,
— হুম,তুমিতো সুযোগ পেলেই মাথায় কাঠাল ভেঙে খেতে চাও।
আমাকে অবাক করে দিয়ে স্বর্ণা রাগও পর্যন্ত করল না! বদলে একটু মিষ্টি হেসে বলল,
— সত্যি?
— নয়তো কী?
— আচ্ছা।
অদ্ভুত!অদ্ভুত! অত্যধিক ঘনিষ্ঠতার সত্ত্বেও নারীর ভাব সাত জনমেও হৃদয়ঙ্গম করা মুশকিল। প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে কাছের মানুষটা। কখনো ইতিবাচক আর কখনো নেতিবাচক। এভাবে পরকালের টান পড়ে। শেষ অবধি বোঝাটা আর হয়ে উঠে না। আমিও সেই একই পাতিলের তরকারি। সেদিন রাতে সত্যিই স্বর্ণা শিয়রে আসন গেড়ে বসে মাথার এলোমেলো চুল নাড়তে নাড়তে ঘুম পাড়িয়ে দিল। শুরুতে বিশৃঙ্খল ভাবনায় অনেক্ষণ ঘুম এলো না। চোখ বন্ধ করে জেগে রইলাম। স্বর্ণা একটু পরপরই জিজ্ঞেস করছিল ঘুমিয়েছি কি না। আমি শুধু না সূচক মুখের ভেতর অস্ফুট বাক্য উচ্চারণ করেছি। পরে কখন যে সমস্তকে একপাশে ঠেলে ঘুমটাকে আপন করে নিয়েছি সেটা ঠিক মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই চারপাশে চপল চোখ বোলালাম। স্বর্ণা নেই। বোধহয় রাতেই চলে গেছে। গতরাত্রের কথা মনে পড়তেই আমি দ্রুত বিছানা ছাড়লাম। আধোয়া মুখেই স্বর্ণার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। দুইবার বেল টেপার পর স্বর্ণা ঘুমবিজড়িত চোখে দরজা খুলল। আমাকে কিছু বলতে হল না। স্বর্ণা নিজেই বলল,
— মুখ হাত ধুয়ে বেরোও, আমিও আসছি।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে এলাম। মিনিট পনের পর প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে এলাম। স্বর্ণা আগে থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমি সঙ্গ দিতেই হাঁটা শুরু করল। গতরাত্রের সেই সারি সারি নারিকেল গাছগুলো অতিক্রম করে আমরা ঘাটে চলে এলাম। ঘাট থেকে এসময় জাহাজ যায় না। ট্রলার অথবা স্পিড বোট ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই। ট্রলার বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় আমরা স্পিড বোট নিয়ে টেকনাফের পথে রওনা দিলাম।
নীল সাগরের পানির বুকে দাগ কেটে স্পিড বোট ছুটে চলল দ্রুত গতিতে। আজ সাগর কিয়ৎ উত্তাল। সমসাময়িক তুলনায় আজকের ঢেউয়ে আছে বাড়তি উচ্ছলতা। অতি শীঘ্রই চিরাচরিত নিয়মে শরতে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে জলোচ্ছ্বাস ধেয়ে আসবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে ভাগ্য ভালো যে দুর্যোগে আগেই এখান থেকে সরে পড়তে পারছি। পদে পদে বিপদ হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে দু’জনকে। অন্তত একটা বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারলে বাঁচি। কাঁটায় কাঁটায় আড়াই ঘন্টা পর আমরা টেকনাফ গিয়ে পৌঁছুলাম। ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে ন’টা। স্পিড বোট থেকে নেমে আমরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম বাস স্টেশনের দিকে। দশটায় একটা বাস ছাড়বে। এরপর একঘন্টা পর এগারোটায়। জনারণ্য এলাকায় একটা ঘন্টা কাটানো আমাদের জন্য মোটেও ফলপ্রসূ নয়। যতো তাড়াতাড়ি লোকচক্ষুর আড়ালে যাওয়া যায় ততোই আমাদের জন্য মঙ্গল।
সময় মতোই এসেছি আমরা। বাসের টিকিট পেতে বিলম্ব হল না। সুদীর্ঘ বারো ঘন্টা ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে দশটার বাসে আমরা টেকনাফ ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।
…………………………………………..
যানবাহনে চড়লে ঘুম আমাকে আলিঙ্গন করে নেয় সেই জন্মকাল থেকেই। এবারো তার ব্যতিক্রম হল না। উৎকট দুশ্চিন্তার মাঝেও এগারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমালাম আমি। সূর্য যখন মাথার ওপর ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটা দুঃসংবাদ দিল স্বর্ণা। ক্ষীণকণ্ঠে আমার নাম উচ্চারণ আর গায়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমি ধড়মড় করে সটান বসলাম। দুইহাতে চোখ রগড়ে মাতালের মতো হাতের আঙুল ঘুরিয়ে বললাম,
— কী?
স্বর্ণা চঞ্চলা হয়ে ইতস্তত তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— পুলিশ চেকপোস্ট বসেছে। গাড়িতে থামিয়ে চ্যাকিং চলছে। তুমি তাড়াতাড়ি বেরোও গাড়ি থেকে।
পলকে আমার আদুরে ঘুম পরীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিরোহিত হল। আমার চোখ হয়ে গেল ছানাবড়া। বিস্ময়ে কোমর অবধি প্রোথিত হয়ে বললাম,
— মানে? বেরিয়ে কোথায় যাব আমি?
স্বর্ণা সুমুখের সিটে দুই হাত রেখে গলা বাড়িয়ে অবস্থা অবলোকন করল একবার। পরক্ষণেই প্রায় আমাকে প্রায় টেনে তুলতে তুলতে বলল,
— প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। সব কি আমাকে বলে দিতে হবে? নিজের মাথা খাটাও একটু!
আমি তৎক্ষনাৎ করণীয় ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গেলাম বাসের দরজার দিকে। বাস কন্টাক্টর আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
— কই যান মিয়া? দেখেন না পুলিশ চেক দিতাছে!
আমি বর্তমানে পুলিশে আর নেই! তাতে কি? আমার কার্ড ঠিকি আমার কাছে রয়ে গেছে। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই,নিধিরাম সর্দারের মতো কার্ডের পাওয়ার তো আছে! প্যান্টের গুপ্ত পকেট হতে কার্ডটা দেখিয়ে দম্ভভরে বললাম,
— লুক, পুলিশ পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?
কন্টাক্টর একটা শুকনো ঢোক গিলে শুধু বলল,
— জানতাম না স্যার। ভুল হয়ে গেছে।
তার কথা পুরোপুরো শেষ হবার আগেই আমি বাস থেকে নেমে গেলাম। সতর্ক পায়ে গন্তব্যের উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলাম। অল্পদূর যাওয়ার পর রাস্তা পার হয়ে একটা টং দোকানে বসে চা অর্ডার করলাম। চা পান করতে করতে তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম পুলিশের দলটার ওপর। খানিক পর পুলিশ আমাদের বাস থেকে খালি হাতে নামতে দেখে বুকের ওপর থেকে বিশাল একটা পাথর নেমে গেল। আর সময় নেয়ার মানে হয় না। চায়ের বিল মিটিয়ে রাস্তার পাড় ধরে হেঁটে বাসের কাছাকাছি এলাম। এরপর আশেপাশে চোস্ত দৃষ্টি মেলে পুনরায় রাস্তা পার হয়ে বাসে ঢুকলাম নিরুদ্যমে। বিপদ কেটে গেল অতি সহজেই। স্বর্ণা এদিকটা ঠিকই ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে দিয়ে পুলিশ বিদেয় করেছে। আশ্চর্য হলেও অসার নয় যে, মুখোমুখি পুলিশ-আসামি নির্দ্বিধায় কথা বলার সত্ত্বেও পুলিশ একবারের নিমিত্তেও স্বর্ণাকে সন্দেহের তালিকাবদ্ধ করেনি। কি এক কুহকজালে তাদের বোধশক্তি লুপ্ত করে নিয়েছে স্বর্ণা, তা আমার অবিদিত।
বিকেলের দিকে স্বর্ণার মুঠোফোনে একটা ফোনকল এলো। আমরা তখন চট্টগ্রামের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। স্বর্ণা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। জুহির ফোন। আমি উৎকণ্ঠিত হলাম। এই অসময়ে স্বর্ণাকে জুহির ফোন করার কথা না!তবে? স্বর্ণা একটু দেরি করে নিজস্ব ভাবনায় মুহূর্তেক বুঁদ থেকে ফোন রিসিভ করে কানে দিল। লক্ষ্য করলাম স্বর্ণার ঋজুর দৃষ্টি ধীরে ধীরে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষণ্ণতায় ঋদ্ধ হচ্ছে। নিভাঁজ কপালে তিনটা গাঢ় চিন্তিত রেখা পড়েছে। হৃদয়গ্রাহী চোয়াল ঝুলে পড়েছে নিচে। দেখে আমি আরো উদগ্রীব হলাম। কাতর গলায় বললাম,
— কী হয়েছে স্বর্ণা?
স্বর্ণা ফোন কান থেকে নামিয়ে রাখল ধীরে ধীরে। আমার কথার জবাবে কিছু না বলে নিবিড়ভাবে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সুমুখের সিটের পেছনে। আমি আবার ডাকলাম,
— স্বর্ণা!
স্বর্ণা চমকে ফিরে তাকাল।
— হু?
— কী হয়েছে?- আমার চোখ বিস্ময়-ক্ষুদার্ত।
— আন্টি স্ট্রোক করেছে। নিরাকুল কণ্ঠে কঠিন একটা কথা আওড়ালো স্বর্ণা।
— মানে? কীভাবে? এখন কেমন আছে? আরো কিছু বলতে চাইলাম আমি। কিন্তু কে যেন আমার কথায় রোধন করল। বাকশক্তি গ্রাস করে নিল অল্প সময়ের জন্য।
স্বর্ণা এড়িয়া যাওয়া গলায় বলল,
— চলো, আমরা চট্টগ্রামে নেমে যাই। আমি বাবা মা’য়ের সঙ্গে দেখা করব।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। স্বর্ণা করবে নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা? যাকে আমি হাজারবার হাতে পায়ে ধরে বাবা-মার সঙ্গে একটিবারের জন্য দেখা করাতে সম্মত করাতে পারিনি সে আজ স্বেচ্ছায় দেখা করবে বলছে? কোথাও একটা গড়মিল তো অবশ্যই আছে। আমি অবিশ্বাসী গলায় বললাম,
— স্বর্ণা, সব ঠিক আছে তো? কিছু এড়িয়ে যেও না প্লিজ!
আমার কাতরোক্তিতে স্বর্ণা আর নিজেকে দাবিয়ে রাখতে পারল না। ভেজা গলায় বলল,
— আন্টি আর বেঁচে নেই। সকাল ন’টায় হাসপাতালেই ইন্তেকাল করে।
শুনে আমার শির-দাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বসে গেল। মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গেল। ফাঁকা ফাঁকা লাগল পুরো পৃথিবী। শানিত ছুরির সুচালো অগ্রভাগে কে যেন নিয়ম করে খচখচ করে খুঁচিয়ে মজা লুটছে। আমার মস্তিষ্ক কাজ করল না। মা’য়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ছেলের কী করা উচিত? হাউমাউ করে কাঁদা উচিত? নাকি আপন কাউকে জড়িয়ে ধরে দুঃখ ভাগাভাগি করে আহাজারি করা উচিত? মাতম? আমি কোনকিছুই করলাম না। নিঃশব্দ রোদনে দীর্ঘক্ষণ মাথার দু’পাশ চেপে ধরলাম দুই হাতের তালু দিয়ে। স্বর্ণা জোর করে মাথাটা চেপে ধরে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা শুরু করল।
আমরা ততক্ষণে চট্টগ্রাম পেরিয়ে ছাগলনাইয়াতে এসে পৌঁছেছি। অনন্যোপায় হয়ে আমরা সেখানে নেমে গেলাম। এবং পুনরায় বাসে করে ভাটিয়ারী হয়ে হাটহাজারী এসে পৌঁছালাম। ততক্ষণে আমি অনেকটাই আত্মস্থ হয়েছি। কিন্তু বুকের ভেতরকার যন্ত্রণা থেমে নেই একমুহূর্তের জন্যও। অনবরত বদখত ঢাকঢোল পিটিয়ে চলেছে আমার বিবাগী হৃদয়তটে। নানার বাড়িতে বাড়িতে এসে দেখলাম বাড়িভর্তি লোকের সমাগম। ধীরে ধীরে চেনা অচেনা লোকের আগমন বাড়ছে। আসার সময় একটা বোরকা কিনে গায়ে গড়িয়ে দিয়েছিল স্বর্ণা এবং আমার পাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যাতে গ্রামের লোকজন বুঝতে না পারে এই সেই স্বর্ণা। যার উপর তারা সেই বহু বছর আগে সুষ্ঠু বিচার উপহার দিতে পারেনি। অগণিত লোকসমাগমের ভেতর নিজেকে মিশিয়ে ফেলল স্বর্ণা।
বলা বাহুল্য, আমার নানার বাড়ি থেকে নিজ বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। চাইলে পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে গাড়িতে চড়া যায়। না-হয় হেঁটে দশ মিনিটের রাস্তা।
বাড়ির ভেতর কয়েকজন বয়োজীর্ণ মহিলা মাতম করছিল। আমাকে দেখেই একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিল। শুরুতে চিনতে না পারলেও পরে ঠিকই চিনলাম ইনি আমার মাতামহী। সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম,খেলেছিলাম,মজার গল্প শুনেছিলাম, আজ এই বয়সে এসে দেখা হল আবার। বয়সের ভারে কুঁজো হয়েছেন তিনি। মেয়ের শোকে মুহ্যমান হয়ে সুদীর্ঘ বছর পর নাতীকে জাপটে ধরে নানান প্রলাপ বকতে লাগলেন তিনি। জানা কথা, অজানা কথা সবকিছুর রুদ্ধ বাঁধ যেন ভেঙে খানখান হয়েছে। আমিও নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। এতোবছর পর মাকে ফিরে পেয়েও হারিয়েছি সেই শোকে ঝরঝর করে কাঁদলাম সন্তর্পণে। পুরুষ মানুষের নাকি শব্দ করে কাঁদতে নেই!
ঢাকা থেকে মায়ের মরদেহ এলো বিকাল চারটায়। সঙ্গে এলো জুহি আর বাবা। এয়ারপোর্টে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে করতে এতো সময় গচ্চা গেল। বাড়িতে মরদেহের গাড়ি আসা মাত্র আমার চেনা,অচেনা স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠল। অথচ এদের আমি ভালো চিনিও না। সুখে-দুখে, সুসময়-অসময়ে কখনো এক দণ্ড এঁদের দেখা মেলেনি। আজ মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কোন্ গর্ত থেকে উৎরে উঠল সেটাই আমার বোধ্য নয়। অনেকটা মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতো কথা! অনেক্ষণ পর জুহিকে কাছে পাওয়া মাত্রই একপ্রকার জেরা শুরু করলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়েছে মেয়েটি। সে বিষণ্ণমুখে সবিস্তারে বলতে শুরু করল,
— সমস্ত ঠিকই ছিল। পরশু সকাল আটটার দিকে নাশতা করে একটু ঘুমিয়েছিল। আমি ঔষধ খাইয়ে দিতে গিয়ে দেখি…।
একটু থামে জুহি। এরপর আবার বলে,
— স্ট্রোকের লক্ষণ দেখে আমি তৎক্ষনাৎ এ্যাম্নুলেন্স ফোন করি। সিলেটের উন্নত সব হসপিটালে গিয়েও কাজ হয়নি। তারা ঢাকা মেডিকেল সাজেস্ট করে। রিস্ক নেয়নি তারা। ঢাকায় নিয়ে আসি। কিন্তু অবস্থার অবনতি হয় ধীরে ধীরে। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ধমনী ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়। আটকে রাখা গেল না। চলে গেল।
আমার কথা বলার মানসিকতা তখন ছিল না। ধীরে ধীরে প্রস্থান করি জুহির সামনে থেকে। জনবিরল কোন তল্লাটে নির্বাসিত হয়ে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হল। কিন্তু পারিনি। সুযোগ মেলেনি। পারিনি মা’য়ের মৃতশয্যার পাশে নীরবে চোখের জলের বাঁধ মুক্ত করতে। স্তিমিত চোখে পাথরের মতো শরীর নিয়ে অপলক চেয়ে ছিলাম শুধু। ভেবেছি, আজীবন দুঃখ কষ্টের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েও শেষ মুহূর্তে একটা মুচকি হাসি মুখে কোত্থেকে ধার করে আনল মা? অতীতের সমস্ত ঘটনা ভূয়োঃভূয়ো মনের দরজায় দুমদুম আঘাত করতে লাগল। মানসপটে ভেসে উঠল মায়ের সঙ্গে আজীবন খারাপ ব্যবহারের চিত্রগুলো। বাড়িতে, বাজারে, যত্রতত্র অভক্তিভরে এড়িয়ে চলেছি তাঁকে। এমনকি দূরপাল্লার পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্যাম্পে পর্যন্ত মা’য়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। কটু কথা বলেছি। শেষে যখন মা-ছেলের সম্পর্কের সকল বিপত্তির অবসান ঘটল,ঘাটতিগুলো অভূতপূর্ব ভালোবাসায় ভরতুকি হল তখন কেন খোদা মা’কে কেড়ে নিল? সম্পর্কটা ঠিক না-ই হতো। সঠিক মা’টাকে আমি নাহয় না-ই চিনতাম!এর আগেই নিয়ে যেতো? ফিরিয়ে দিয়েও কেড়ে নেবার অধিকার কি সৃষ্টিকর্তাকে আছে? সবই সৃষ্টিকর্তার মর্জি? অসংখ্য এলেবেলে ভাবনায় মাথাটা ভারি হয়ে যায় আমার। যার কোনো আদ্যোপান্ত নেই। নেই কোনো সমাধান।
কবর খোঁড়ার কাজ শেষ করে গিয়েছে জনকল্যাণে নিয়োজিত এলাকার কিছু তরুণ সদস্যরা। এঁরা গ্রামে কেউ মারা গেলেই কবর খুঁড়ে দিয়ে যায়। মহিলারা মৃত গোসলের কাজ সেরে নিল এবং কাফন জুড়িয়ে দিল মৃতে মায়ের সর্বাঙ্গে। আমার পুরো জীবন আখ্যানের এই বর্ণনা দিতে গিয়ে কলম কেঁপে উঠছে বারবার। চোখ হয়ে যাচ্ছে অশ্রুসজল। সেদিন যে মরাকান্না আমি করতে পারিনি তা আজ পুষিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। যাইহোক,অকারণ মধ্যস্থতা পাঠকের মনে বিভ্রমের সৃষ্টি করবে।
বাঁশের বেড়া কিনে আনা হলো। কাঁচা বাঁশ কাটা হল। খেজুর গাছের ডাল কাটা হলো। কবরের চারপাশে পোঁতার জন্য জারুল গাছের চারটা ছোট বৃক্ষশাখাও নেয়া হল। আমাকে কিছুই করতে হল না। নানার বাড়ির লোকেরাই সব কাজ করে নিল। মসজিদের মাইকে এলার্ন করে জানিয়ে দেয়া হলো জানাযার সঠিক সময়। এরপর এশারের আযান হলে খাটিয়া করে লাশ নিয়ে আসা হল ঈদগাহ ময়দানে। লাশ নিয়ে বাড়ি হতে বেরোনোর সময় স্বজনরা পুনরায় উচ্চরোলে কান্নাকাটি শুরু করল। খাটিয়ার চারকোণার একটা কোণ পড়ল আমার ঘাড়ে। এটাই নিয়ম। এরপর রীতিমতো এশারের নামাজের পর জানাযা সম্পন্ন হল এবং দাফন কাজ শুরু হল। শেষ বারের মতো আমি চিরচেনা মা’য়ের মুখটা দেখলাম অন্ধকার কবরের মাটিতে শুইয়ে মুখ খুলে দেবার পর। সেই মুচকি হাসিটা লেগে আছে ঠোঁটের কোণে। নেই মৃত্যুযন্ত্রণার নিদারুণ উদব্যাক্তি। মনে হয়েছিল, ঘুমের মধ্যে কি যেন স্বপ্ন দেখে মিটিমিটি হাসছে মা। টলটলে অশ্রুতে ভরে এলো আমার চোখ। গড়িয়ে পড়ার আগেই দ্রুত মুছে নিলাম। কোথাও শুনেছিলাম, দাফনের সময় নাকি চোখের পানি ফেলতে নেই! ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দাফনকাজের নিষ্পত্তি হল। সকল বাঁধন অবারিত করে জনবহুল এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র পিছুটান আমাকে অকূলপাথারে ভাসিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নিল। সবাই চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বক্ষদেশ বিদীর্ণ করে প্রলয়ংকরী এক বাষ্পোচ্ছ্বাস আমার জমা হলো আমার দু-চোখের পর্দায়। ঝাপসা চোখে অশ্মীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম মায়ের কবরের পাশে। সেই সময় ব্যাগ কাঁধে নাহিদ(বন্ধু) এসে দাঁড়াল পাশে,
— সরি রে দোস্ত, শহরে ছিলাম। খবর শুনেই রওনা দিয়েছিলাম।ইশ্ জানাযাটা পেলাম না। তুই ভেঙে পড়িস না। সবাই তো আর চিরকাল বেঁচে থাকে না!…
আবার সেই চিরপ্রচলিত সান্ত্বনাবাণী!
……………………………….…………….…………………………………………….
তিনদিন পর পুকুরপাড়ের এক ছায়ানিবিড় সন্ধ্যাবেলা। পুকুরঘাটের বৈঠকখানায় হেলান দিয়ে বসে আছি। সূর্যের শেষ আবিরটুকু এখনো জবড়েভাবে লেপ্টে আছে পশ্চিমাকাশে। মাথার ওপর বহুদূর বিস্তৃত আম্রকানন। সেই কাননে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল কিচিরমিচির উল্লাসে নীড়ে ফিরে সন্ধ্যাযাপন করছে। কমবয়সী পক্ষীরাজিরা সঙ্গী-সঙ্গিনীর সঙ্গে নিবিড় সম্ভোগে প্রণোদিত হচ্ছে। বয়োবৃদ্ধ পক্ষীরা সারাদিনের ব্যস্ততার পর সন্তানসন্ততিকে নিয়ে আড্ডার আসর বসিয়েছে। একটু পরই নিস্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে সব৷ সুবিমল বাতাসে কামিনীফুলের মিহি গন্ধ।আকাশের কোলে শরতের শুভ্র মেঘের পাল ভেসে বেড়ালেও আমার মনের মেঘ সেই শ্রাবণের নিশিথনিবিড় কালো মেঘের মতোন। মা’য়ের আকস্মিক মৃত্যুর শোচনীয় শোকটা কাটবে না অতো সহজে। সেদিন রাতেই আমরা চলে আসি নিজ বাড়িতে। সঙ্গে জুহি আর স্বর্ণাও। বাবার মনে মা’কে নিজের জমিতে দাফনের সুপ্ত ইচ্ছে থাকলেও মুখের ওপর কথা বলার অধিকারটা তিনি হারিয়েছেন সেই তালাক দেয়ার পর থেকে। এমনকি শেষবারের মতো মায়ের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দেয়া হয়নি তাকে। চাইলেও সম্ভব ছিল না। কাজেই মা’কে দাফন করা হলো নানার বাড়িতে নানার কবরের পাশে।
হঠাৎ শুকনো পাতা ভাঙার খচখচ শব্দে চমকিত হয়ে পিছনে তাকালাম আমি। দু’টো ছায়ামূর্তি বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে এগিয়ে আসছে ভেতরের দিকে। বাড়ির পেছন গেট দিয়ে প্রবেশ করলে পুকুর ঘাট ডিঙিয়ে তবেই মূল বাড়িতে যেতে হয়। একটু কাছে আসতেই দুই মূর্তি আমার চোখে স্পষ্ট আবির্ভূত হল। স্বর্ণার বাবা-মা! আশ্চর্য! এঁরা কোন্ বাতাসে খবর পেল যে স্বর্ণা এই বাড়িতে আছে। জানাজানি হয়ে গেলে তো লঙ্কাকাণ্ড লাগবে এতে সন্দেহ নেই। ঘন অন্ধকারের আবরণে আমাকে দেখতে পেল না তাঁরা, পুকুরঘাট পেরিয়ে চলে গেল। আমি কথা বলার জন্য কোন প্রসঙ্গ না পেয়ে শব্দ করে ডেকে বললাম,
— এক্সকিউজ মি! কারা আপনারা?
বৃদ্ধ দম্পতি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তড়িৎ তাকাল পেছনে। আমি এবার কৃত্রিম চেনা গলায় বললাম,
— ওহহ আপনারা? আসুন।
আমি এগিয়ে গিয়ে হাতের টর্চ জ্বালিয়ে তাঁদের পথ দেখালাম। ঘন আম বাগানের সরু পথ হয়ে তাঁদের বাড়ির মূল দরজায় দিয়ে প্রবেশ করালাম। বিশাল ডাইনিং রুমের এককোণায় সোফায় এক পা তুলে বসে জুহি আর স্বর্ণা কি যেন আলাপ করছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হল গত কয়েকদিনেই জুহি আর স্বর্ণার মধ্যকার সম্পর্কটা ঠিক আগের মতো দা-কুমড়োর সম্পর্ক নেই। আজীবন শুনে এসেছি চোর-পুলিশ কখনো জমে না। এখন দেখি ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে। জমে ক্ষির হওয়া সেই আলোচনার মধ্যে জল ঢেলে দিল স্বর্ণার বাবা মায়ের উপস্থিতি। দীর্ঘ দশ বছর পর নিজের বাবা মাকে দেখতে পেয়ে আচমকা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল স্বর্ণা। জন্মদাতা বাবা এবং জন্মদাত্রী জননীর দিকে ফণাউদ্যত সাপের মতোন কঠোর দৃষ্টিপাত করল স্বর্ণা। ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টি ঠোঁটের কোণে একটুকরো বিদ্রুপের হাসি হয়ে মিলিয়ে গেল৷ এরপর সদর্পে পা ফেলে ঘরের ভিতরে চলে গেল সে। জুহিও তার পিছুপিছু হেঁটে গেল। স্বর্ণার বাবা-মা অসহায় হয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
— আপনারা বসুন, আমি নিয়ে আসছি ওকে।
বলে আমি দ্রুত স্বর্ণাকে অনুসরণ করলাম।
খাটের উপর বসে দুইপা এক করে মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে স্বর্ণা। পাশে জুহি বসে কি সব আগডুম বাগডুম বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমি রুমে প্রবেশ করতেই জুহি সরে বসল একটু৷ আমি এগিয়ে গিয়ে স্বর্ণার হাত ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম,
— স্বর্ণা! চলো ওনাদের সঙ্গে দেখা করে আসবে।
স্বর্ণার চোখ অস্বাভাবিক অগ্নিবর্ণ। চোখের সাদা অংশে লোহিত ছোপছোপ দাগ পড়েছে অকৃত্রিম ক্রোধের উন্মত্ততায়। ধরা হাতটা একটানে ছাড়িয়ে নিয়ে আস্ফালন করল সে,
— ওদের এক্ষুনি চলে যেতে বলো মিনহাজ। একমুহূর্তও সহ্য হচ্ছে না আমার।
আমি বললাম,
— একটিবার গিয়ে দেখো কী বলে তাঁরা! চলো…
স্বর্ণা রাগটা এবার আমার উপর চড়াও হল। দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
— ঠিক আছে চলো, তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করি।
বলে নিজেই গটগট করে হেঁটে ডাইনিং রুমের দিকে গেল সে। জুহি আর আমার একবার চোখাচোখি হল। দু’জনে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে স্বর্ণাকে অনুসরণ করে এগুলাম।
স্বর্ণা বসে আছে সিঙ্গেল সোফায়। তার পরনের বস্ত্র মায়ের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে কিছুটা সভ্য হয়েছে। কিন্তু বাবা-মায়ের সামনেই পায়ের ওপর পা তুলে উদ্ধত ভঙ্গিতে বসে আছে সে। তার বিপরীতে বড় সোফায় ঘেঁষে অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে স্বর্ণার বাবা-মা। একজন ভৃত্য এসে ট্রেতে করে নাশতা দিয়ে গেল। যাদের উদ্দেশ্য করে চা-নাশতা আনা তারা ট্রেতে হাত দেবার আগেই স্বর্ণা এককাপ চা হাতে নিয়ে বিস্কিট চুবিয়ে চিবোতে শুরু করল এবং স্বয়ং নিজের অপছন্দনুযায়ী চায়ের কাপে সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ করে চুমুক দিতে লাগল। স্বর্ণার মা প্রথমে কথা বলল,
— দেখ স্বর্ণা, আমরা তো আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি! তারপরও কেন এমন করছিস? মরলে কি শান্তি পাবি?
স্বর্ণার তুষের আগুনে নাড়া পড়ল। একপ্রকার রণমত্ত হয়ে বলল,
— ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছ? মর তো না! যেদিন মরবে সেদিন দেখা যাবে। দু’জনেই দূর হও চোখের সামনে থেকে।
বলে চোখের ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিল স্বর্ণা। প্রগল্ভ শরীরে কম্পনে হাতে ধরা চায়ের কাপ থেকে চায়ের রঙিন পানি উছলে পড়ল মেঝেতে।
চলবে…