ধ্রুবতারা পর্ব-১৭+১৮

0
736

#ধ্রুবতারা
#পর্ব_১৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা

প্রায় দশদিন পর
সকাল দশটার দিকে তাননা আহম্মেদ বাড়িতে পা রাখলো। সাথে ঈশান ও এসেছে। বাড়িতে পা রাখার পর সবার থমথমে মুখ দেখে তাননা বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। কিন্তু রাহাকে না দেখে সন্দেহ তীব্রতর হলো। সোরাকে জিজ্ঞেস করল
‘ রাহাকে কেন পাঠিয়েছ?
সোরা বলল
‘ বেড়াতে গিয়েছে।
তাননা বলল
‘ তা ঠিক আছে, কিন্তু বাবাই আমাকে এত তাড়া দিল কেন আসার জন্য। এখানে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
সোরা বলল
‘ না কিছু হয়নি। এমনি আসতে বলেছে।
তাননা কপট রাগ দেখিয়ে বলল
‘ মুননা কোথায়? সে তো আমি মরে গেলে ও যাবে না, আবার আমি না গেলে গরম কিভাবে দেখায়! ফোন বন্ধ কেন ওর?
সোরা বলল
‘ আসার সাথে সাথে কেউ এভাবে রাগ দেখায়? মুননা এমনিতে ও কোথাও যেতে চায় না। তোমার নানুর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কতবার ডাকতে হয়।
তাননা বলল
‘ ডাকতে হবে না। সো তো লাট সাহেব। নিজের মর্জিমতো চলবে সে। কার কথায় কি যায় আসে? বোন বলে কেউ আছে নাকি তার?
ঈশান বলল
‘ আচ্ছা এখন কি রোয়েন আছে? শুধু শুধু আন্টির উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন?
তাননা হনহনিয়ে চলে গেল।

রোয়েন হসপিটাল থেকে ফিরল দুপুর নাগাদ। তাননাকে দেখে সামান্য অবাক হলে তা তার চেহারায় দেখা গেল না। আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে হেঁটে গেল। জিশানকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ কেমন আছ মামা?
জিশান রোয়েনের কোলে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলল
‘ আম্মা মামার সাথে কথা বললে মারবে বলেছে।
রোয়েন যেতে যেতে বলল
‘ আসুক দেখি কিভাবে মারে? আমি মেরে বসিয়ে রাখবো।
জিশান দাঁত দেখিয়ে হাসলো। তাননা রোয়েনের পিছু পিছু আসলো। রোয়েন সাদা এপ্রোন তাননার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ তুননু ঝগড়া করিস না বোন। প্রচুর টায়ার্ড। একটু ফ্রেশ হতে দে আগে। তারপর ঝগড়া লাগাস।
তাননা নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইলো। এপ্রোনটা রোয়েনের মুখে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ তোর বউ কোথায়?
রোয়েন কান চুলকাতে চুলকাতে বলল
‘ জেনে ও আবার প্রশ্ন করার রোগ তোদের কোনোদিন যাবে না দেখছি।
তাননা বলল
‘ একদম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবি না মুননা। রাহাকে নিয়ে আসছিস না কেন? তুই কি কোনোদিন ঠিক হবিনা?
রোয়েন মুখ হাত ধুঁতে চলে গেল। তাননা জিশানকে বলল
‘ তোমাকে বলেছি এই হারামির কোলে উঠবে না?
জিশান বলল
‘ মামা ভালো। চকলেট দিছে।
তাননা বলল
‘ একদম চুপ। জিশান কেঁদে দিল। রোয়েন তাড়াহুড়ো করে এসে তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল
‘ তুই এত ঝগড়াটে কবে হলিরে?
তাননা নিশ্চুপ। রোয়েন জিশানকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতে করতে বলল
‘ পঁচা আম্মার সাথে কথা বলবে না ঠিক আছে?
জিশান মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। রোয়েন মৃদু হাসলো। তাননার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আয়।
তাননা মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো। রোয়েন বলল
‘ আয় আয়। কই এসে ভাইকে একটু জড়িয়ে ধরবি তা না করে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিস।
তাননা এসে দুম করে কিল বসালো রোয়েনের পিঠে। রোয়েন চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বলল
‘ মেয়ে মানুষের হাঁড় এত শক্ত কেন? লেগেছে ভীষণ।
তাননা নাক ফুলালো। রোয়েন এক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ তুই রাগ করলে আমার হাসি পাই। তুই রাগিস না। শুধু হাসবি।
তাননা বলল
‘ কথা বলবি না আমার সাথে। তোর সাথে কথা বলব না এই ভেবে এসেছি আমি। আমাকে দেখতে যাস না একবার ও। মামা আর বাবাই ছাড়া কেউ যায় না। তুই নাহ আমার ভাই?
রোয়েন বলল
‘ যাব যাব। কাঁদিস না।
তাননা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর ও কাঁদলো। রোয়েন বলল
‘ যেদিকে যাই সেদিকে জ্বালা। তুই আমাকে পীড়ার উপর পীড়ার দিতে এলি?
তাননা বলল
‘ হ্যা। রাহাকে নিয়ে আয়।
রোয়েন জিশানকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আমি কি যেতে বলেছি? আমার কিসের দায়?
তাননা রোয়েনের পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে বলল
‘ তুই চাচ্ছিসটা কি?
‘ আমার চাওয়া খুবই সীমিত। আর সেখানে রাহা সম্পর্কিত কোনোকিছু নেই।

রাতে নাহিল বাসায় ফিরেছে। তাননাকে দেখে খুশি হলো। তাননা থাকলে সে জোর পায়। সাপোর্ট পায়। কিন্তু রাহাকে নিয়ে তার সিদ্ধান্ত কি ভুল না ঠিক তা সে নির্ধারণ করতে পারছেনা। তাননা কি তাকে সমর্থন করবে?
খাওয়া দাওয়া শেষে নাহিল রুমেই ডেকে আনলো তাননাকে। যাতে রোয়েনের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলে দেখে। রোয়েন এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারেনা। হয়ত রাহাকে রাখতে হবে নয়ত ছাড়তে হবে। তাননা সবটা শুনে যেন বোকাবনে গেল। নাহিলকে বলল
‘ তুমি বাবা হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত অনায়াসে কি করে নিয়ে নিলে? রাহা মুননাকে ডিভোর্স দিতে চায়? ডিভোর্স কি সব সমস্যার সমাধান?
নাহিল বলল
‘ রাহা ও চায় ডিভোর্স হোক।
তাননা বলল
‘ আমি বিশ্বাস করি না।

নাহিল বলল
‘ তাননা,, মুননার মন নেই এই সম্পর্কে। তার উপর জোর কাটাতে পারিনা আমরা। তাছাড়া ওদের বিয়ের কথা তেমন কেউ জানেনা। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবেনা। আমি রাহাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেব। মুননা ও রাহার চাইতে ভালো কাউকে পেলে বিয়ে করে নেবে , আপত্তি নেই আমাদের। ছেলের বউ হিসেবে ঘরে তুলবো।
আমি চাই তারা দুজনই ভালো থাকুক। শান্তিতে থাকুক। রাহাকে চাপিয়ে দিয়ে মুননার সাথে জোরদবস্তি করতে চাই না আমি। দেখা যাবে মুননা মেনে নেবে রাহাকে কিন্তু ওর আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না আমার মেয়ে কারো আফসোসের কারণ হোক। রোয়েন বোধহয় তার পছন্দের কথা বলতে চাইনা আমাদের, হয়ত অন্যকোথাও পছন্দ আছে। কিংবা লজ্জায় বলতে পারেনা। তাই তো রাহাকে সবার সামনে নিজের স্ত্রী স্বীকার করতে বাঁধে তার। সে যাইহোক তেমন যদি হয়ে থাকে রোয়েন সে মেয়েটার সাথে ও অন্যায় করেছে সাথে রাহার সাথে। তবে আমি চাই এতটুকুতে ও সমাধানের পথ আছে। মুননাকে সুযোগ দেওয়া দরকার। তার মর্জিমাফিক চলার অধিকার তার আছে।
তাননা মাথা নিচু করে বসে রইলো। নাক টেনে বলল
‘ আমি জানি এসব তুমি রাগ অভিমান থেকে বলছো? কেন করছ এমন? তোমরা সবাই এরকম করলে সব শেষ হয়ে যাবে। তোমার সিদ্ধান্ত ভুল। রাহা কি’বা মুননার যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে ও যায় তাহলে তারা কি নতুন করে সব শুরু করতে পারবে? মানলাম পারবে। রাহাকে তুমি বিয়ে দিলে। রাহা ভালো মেয়ে। ভালো ছেলের হাতে যাবে ও। সংসার হবে ওর কিন্তু ওর মন পড়ে থাকবে ওই একজনের কাছে। হয়ত ভুলে যাবে ধীরেধীরে কিন্তু তা মৃত্যু যন্ত্রণার চাইতে যন্ত্রণার বাবাই। বাবাই রাগের উপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো না। ভুল তোমার সিদ্ধান্ত। রাহা হয়ত উপরে বলছে সে ডিভোর্স চায় কিন্তু ও মন থেকে কখনো চায়বেনা। আমি রাহাকে চিনি, জানি, বুঝি। হয়ত তুমি ও বুঝতে পারছো, কিন্তু না বুঝার ভান করছো।
নাহিল বলল
‘ আমি বুঝে কি হবে? তোমার ভাই ডিভোর্স পেপার রেডি করতে বলেছে। সে পিএইচডি নেবে, বলেছে তার আগে যেন সব মিটমাট করার ব্যবস্থা করি। রাহার জন্য সামান্যতম মায়া যদি ওর থাকতো তাহলে সে একথা বলতে পারতো না কখনো।
তাননার চোখ খসে জল পড়ে। এটা কিছুতেই হতে পারেনা। ভুল হচ্ছে সবার।
রোয়েনের কাছে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে তাননা। রোয়েন তাকে ব্যঙ্গ করে বলল
‘ রাহার হয়ে তুই কাঁদছিস নাকি? রাহা ও তো এতটা কখনো কাঁদেনি। আরেহ বাদ দে ভুলে যাহ এসব বিয়ে টিয়ে হয়েছে। মনে কর বিয়ে ও হয়নি। ডিভোর্স ও হয়নি। সব স্বাভাবিক। ভেবে নে রাহার বিয়ে অন্যকোথাও হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
তাছাড়া আমার কাছে সবকিছুর আগে আমার ক্যারিয়ার। আমি এই ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না।
তাননা ক্ষেপে গিয়ে বলল
‘ আমিই তাহলে ভুল ছিলাম। পাথরে কখনো ফুল ফুটেনা এটা ভুলে গিয়েছিলাম সাময়িকের জন্য। তোর যখন চলে যাওয়ার এতই তাড়া তাহলে রাহাকে বিয়ে করেছিলি কেন? তখন ভাবিসনি যে তোকে চলে যেতে হবে?
‘ ভাবিনি। আর সেটাই আমার জীবনে সবচাইতে বড় ভুল ছিল। যাইহোক রাহার আব্বাকে গিয়ে বলে আয় সব রেডি করতে, দেরী করলে ওনারই লস। ছাড়াছাড়ি না হলে মেয়েকে বিয়ে দেবে কি করে? যাহ।
তাননা দাঁড়িয়ে থাকলো শক্ত হয়ে, রোয়েন নিজেই বের হয়ে এল। সালেহা বেগম রোয়েনের পিছু পিছু যেতে যেতে বলে।

‘ ভাই এমনটা করিস না। আল্লাহ তোরা চাচা ভাইপো কি করছিস এসব? কেন করছিস?
সোরা নাহিলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। সোরা বলল
‘ আমি তো রাহাকে শুধু একটু দূরে রাখতে বলেছি। ছাড়াছাড়ি নয়।
নাহিল বলল
‘ দূরে রেখে কি বুঝলে? সে মর্ম বুঝল তোমার মেয়ের? সোরা পাগলামি করো না। যেখানে রাহা ফিরতে চায়না সেখানে তুমি আমি কে? রাহা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর সাথে কথা বলেছি আমি। ও ফিরবেনা মুননার কাছে। অবহেলা অবজ্ঞা ভালোবাসা নামক জিনিসটিকে ভেঙ্গে ছুরমার করে দেয় সোরা। তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি তো অবহেলা অবজ্ঞা এমনকি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ও আমি তোমাকে ছাড়িনি। হেলা করতে পারিনি। নির্লজ্জের মতো চেয়ে গিয়েছি তোমায়। সবাই আমার মতো না ও হতে পারে। আমার মতো সহ্যশক্তি রাহার নাও থাকতে পারে?

সোরা বিপুল বিস্ময় নিয়ে নাহিলের প্রত্যেকটা বিষবাক্য শ্রবণ করলো। শেষে বলল
‘ আপনি শাপ দিয়েছিলেন আমায় তখন? আর সেজন্য আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা?
নাহিল হাসলো। বলল
‘ সাবাশ সোরা। কোথায় আঘাত করতে হয় ভালো করেই জানো। ” আমার মেয়ে ” কথাটা বেশ ভালো শোনায় তোমার মুখে। আমারই ভুল হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। ভুলে আমি আমার মেয়ে বলে ফেলি। এবার থেকে সাথেসাথে শুধরে দিও।

এভাবে একমাস পার হলো টানাহেঁচড়ায়।
সন্ধ্যায় কফি হাতে নিয়ে ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়েছিল রোয়েন। ওই বাড়ির ছাদ থেকে জাহেদা ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ ভাই তোর বউ তো ফিটফাট। এবার ধুমধাম করে বিয়েটা সেড়ে নে ভাই। তোর বিয়েতে গান ধরবো আমি। কতদিন গাই না। জানিস আমি আমাদের পাড়ার মাস্টারের কাছে যখন অ আ শিখছিলাম তখন গান করতাম। সবাই আমার গানে প্রশংসা করতো। তোর নানাকে ও কতবার শুনিয়েছি।
রোয়েন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল
‘ গান পারো ভালো কথা। এভাবে বলে বেড়ানোর কি আছে? তোমার গান শুনে নানাভাই নির্ঘাত সেদিন হসপিটালের কাজে বআর মন বসাতে পারেনি।
জাহেদা বলল
‘ এ কেমন কথা বললি ভাই। আমার গানের প্রশংসা করতো তোর নানা। এভাবে বলতে পারলি?
রোয়েন হেসে ফেলল। বলল
‘ রাহা আমায় শুনিয়েছিল গান একবার। বিশ্বাস করো বমি পেয়েছে আমায়। এত বাজে লিরিক্স ও হয়?
জাহেদা বলল
‘ এতে রাহার কি দোষ? লিরিক্সের দোষ।
রোয়েন বলল
‘ নাহ নাহ। রাহার দোষ। রাহা দোষী। ভীষণ।
জাহেদার সাথে একপ্রকার ঝগড়া করে নিচে নেমে এল রোয়েন। আর মাত্র কটা দিন আছে সে এখানে। যেতে ও ইচ্ছে করছেনা। তবে সন্ধ্যার দিকে কালো কোর্ট পড়া একজন লোক এল সুখবর নিয়ে। হাতের কাগজটি রোয়েনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ স্যার আপনাকে কাল সকালে কোর্টে যেতে হবে।
রোয়েন কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে কপাল ভাঁজ করলো। বলল
‘ একটা স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য কোর্টে যাওয়ার কি দরকার? কাগজ আনবেন আমি সাইন দেব।
উকিল বলল
‘ সরি স্যার। যে লয়ার কেসটি নিয়েছেন উনি আপনাদের সামনাসামনি বসিয়ে স্বাক্ষর নিতে চাচ্ছেন। আপনাকে কাল সকালে যাওয়ার জন্য এই লেটারটি পাঠানো হয়েছে।
রোয়েন কাগজটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
সোরা এসে পেছনে দাঁড়ালো। বলল
‘ এটা কি মুননা?
রোয়েন বলল
‘ কই না। তেমন কিছু না।
সোরা বলল
‘ আচ্ছা।

সকাল আটটায় এডভোকেট হাশিম উদ্দীনের অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে না হতেই তাননা এসে ঝাপিয়ে পড়ে রোয়েনকে আটকালো। বলল
‘ এত বড় ভুল করিস না ভাই। আমার কথা শোন।
রোয়েন বলল
‘ ছাড়। এসব ভালো লাগছেনা। শান্তি চাই আমার।
তাননা বলল
‘ তুই ডিভোর্স দিয়ে দিবি?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা দেব। আর কি? কাগজে কলমের বিয়ে কাগজে কলমেই শেষ।
তাননা বলল
‘ কেয়া বলেছে আমায়। কাজী তোদের বিয়ে পড়িয়েছিল। কেন এমন করছিস?
রোয়েন গর্জে বলল
‘ পথ ছাড়।
তাননা টেবিল থেকে ফুলটব তুলে আঁছাড় মারলো ওয়ারড্রবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। দেয়ালে টানানো ছবিটা ধপ করে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। রোয়েন গর্জে বলল
‘ কি করেছিস এটা? আম্মা!
রোয়েন দৌড়ে গেল। ছবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ এটা আমাদের চারজনের ছবি। কি করলি এটা?.
তাননা বলল
‘ বেশ ভালো করেছি।
বলেই গটগট পায়ে হেঁটে কেঁদে চলে গেল তাননা। রোয়েন ছবিটা তুলে বুকে জড়ায়। এটি আবার বাঁধাতে দিতে হবে।
কোর্টে যাওয়ার পথে বাঁধাতে দিয়ে আসতে হবে।
রোয়েন ছবিটা বাঁধাতে দিয়ে কোর্টে গেল। এডভোকেট হাশিম উদ্দিনের অফিসে গিয়ে বসে থাকলো চেয়ারে।
হাশিম উদ্দিন এসে দেখলো চেয়ারে কালো শার্ট পড়া একজন যুবক বসে আছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন
‘ ওয়েলকাম টু মাই অফিস ডক্টর রোয়েন।
রোয়েন দাঁড়ালো। কিঞ্চিৎ হেসে বলল
‘ নাম ধরে ডাকতে পারেন। আপনি আমার আব্বার বয়সী।
হাশিম উদ্দিন বললেন
‘ ইটস ওকে। চা না কফি?.
‘ কিছুনা। আমাকে বেরোতে হবে, যা করার একটু তাড়াতাড়ি করুন।
হাশিম উদ্দিন বাইরে চোখ রেখে বলল
‘ রতন ম্যাডামকে আসতে বলো।
রোয়েন ঘড়ির কাটা দেখলো। তাননা কি করছে কে জানে?
রোয়েন টের পেল পাশের চেয়ারে এসে কেউ একজন বসেছে। মহিলা হয়ত। রোয়েন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো না।
তবে ফিরে দেখতে হলো যখন হাশিমউদ্দীন বললেন
‘ রাহা স্যারকে ঝটপট বলে ফেলো তোমাদের মাঝে কি সমস্যা?
রোয়েন সাথে সাথে পাশ ফিরে তাকালো। মাথায় সাদা ওড়না পরিহিতি রাহা ওড়না আরও একটু টেনে দিল। উসখুস করলো। হাশিমউদ্দীন বলল
‘ তোমার এত হেজিটেশন কেন রাহা? তুমি তো আমাকে চেনো। তাছাড়া তুমি ও লয়ার হবে শীঘ্রই।
রাহা খানিকটা রোয়েনের দিকে তাকাতেই রোয়েন উকিলের দিকে ফিরে ঝটপট বলল
‘ আমাদের মাঝে কোনো সমস্যা নেই।
কপাল কুঞ্চন করে চাইলো রাহা। হাশিম উদ্দীন বলল
‘ তাহলে ডিভোর্স হচ্ছে কেন?
রোয়েন বলল
‘ বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে তাই নামমাত্র সম্পর্কটা রেখে লাভ কি? তাড়াতাড়ি কাগজ দিন, সই করি।
হাশিমউদ্দীন বলল
‘ উপযুক্ত কারণ ছাড়া ডিভোর্স হতে পারবে না। তাছাড়া অনেক সময় যারা এখানে তাদের মাঝে এত কলহ হয় যে আমি নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু তোমাদের মাঝে এমনটা নেই। কারণ কি?

রোয়েন সচকিত চোখে তাকালো। বলল
‘ মুক্তি চাইছি আমি। তাই এতকিছু। তাড়াতাড়ি কাগজ বের করুন। তাড়াতাড়ি করুন। বসে থাকবেন না।

হাশিমউদ্দীন বলল
‘ এত ছটফটানি মুক্তি পাওয়ার জন্য। অবশ্য মুক্তি কে না চায়?

কাগজ বের করলেন তিনি । বুক ধুকপুক করে উঠলো রাহার। চোখজোড়া জ্বলে উঠলো। রোয়েন কাগজটির দিকে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। কি আশ্চর্য একটি কাগজের কারণে মানুষ একে অপরের কাছে থাকার অনুমতি পায়, আবার সেই একি কাগজের কারনেই বিচ্ছেদ হয়। মানুষ একে অপরের কাছ থেকে বহুদূরে হারিয়ে যায়। এত বিচ্ছিরি নিয়ম কেন?

হাশিমউদ্দীন রাহার দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আগে তুমি দাও তাহলে। নাও। এই জায়গায় স্বাক্ষর বসাও।
রাহা কলম হাতে নিয়ে এলোমেলো ছিন্নভিন্ন শব্দমালায় নিচু স্বরে বলল
‘ আ–মি দে–ব?
হাশিমউদ্দীন বলল
‘ হ্যা। মুক্তি তো তোমার হাতেই।
রাহা মাথা নামিয়ে ফেললো। কাঁপা-কাঁপা হাতে কলম হাতে নিল। কলমের ভর দিয়ে সাইন বসিয়ে দিল। রোয়েন শুধু স্বাক্ষরটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাশিমউদ্দীন দেখল রাহার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছে। তারপর ধীরেধীরে অশ্রুকণা ঝড়তে লাগলো কপোল বেয়ে যা রোয়েনের চক্ষুর অগোচরে।

হাশিমউদ্দীন রোয়েনকে বললেন। রোয়েন কলম হাতে নিল। খসখস করে স্বাক্ষর বসালো ডিভোর্স লেটার কাগজটিতে। তারপর চেয়ার ঠেলে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। নাহিল দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রোয়েন তার সামনাসামনি গিয়ে বলল
‘ মুক্তি পেয়ে গেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
নাহিল ব্যাথাতুর নয়নে তাকালো। রোয়েন তা উপেক্ষা করে চলে গেল।

রাহা অফিস থেকে দৌড়ে বের হলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল আওয়াজ করে। নাহিল দৌড়ে আসতেই রাহা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো নাহিলকে। বলল
‘ আব্বা আমি মুক্তি দিতে চাইনি। বিশ্বাস করো চাইনি।
উনি দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়নি আমাকে। তাই মুক্তি দিয়ে দিলাম আমি। আমার হাতে কিচ্ছু ছিলনা আব্বা। আম্মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি আমি। যে আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটপট করে সে কখনোই আমাকে চায় না আব্বা। আমি কেন এখনো প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারলাম না।
নাহিল মেয়েকে ধরে রাখে বুকের সাথে।
রাহা বলল
‘ আমি বাড়িতে ফিরব না আব্বা। আম্মাকে কি বলব আমি? আমি উনাকে আর দেখতে চাই না। নাহিল বলল
‘ ঠিক আছে। নোহার সাথে থাকবে।

রোয়েন বাড়ি ফিরতেই সোরা দৌড়ে আসে হাসিমুখে। রাহার আব্বা যে বলেছিল রাহা ডিভোর্স দেবে না। তারমানে দেয়নি! রোয়েন ও এব্রোড যাবেনা। রাহাও তো তাকে ফোনে একথা বলল। কিন্তু রোয়েনের মুখ দেখে কিছু বুঝার জোঁ নেই। সোরা রোয়েনের কাছে দৌড়ে গেল। বলল
‘ রাহা কোথায় আব্বা? রাহা? তোমার বাবাই? ওরা আসেনি? সব ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছ তো?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা, সব ঝামেলা চুকে গিয়েছে। আমি ও মুক্তি পেয়ে গেছি।
সোরা টলমলে চোখে তাকিয়ে থাকলো। চিল্লিয়ে বলল
‘ তাহলে আমাকে মিথ্যে বললো কেন ওরা? কেন বললো? ওরা বাপ মেয়ে মিথ্যুক। আমার সাজানো গোছানো সংসারটা এলোমেলো করে দিল ওরা।
রোয়েন বলল
‘ সব দোষ আমার।
সোরা কষে চড় বসালো রোয়েনের গালে। বসিয়ে বলল
‘ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। সবাই মিথ্যুক। সবাই মেতে উঠেছে আমার সাজানো সংসারটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। যাও তুমি। আমাকে জীবনেও মামুনি বলে ডাকবে না।
চলে যাও দূরদেশে। এখানে তোমার আপন বলতে কে আছে?
গাল একপাশে ফিরিয়ে ছলছল চোখে সোরার দিকে চেয়ে রইলো রোয়েন।
সালেহা বেগম আর তাননা চেয়ে রইল অপার বিস্ময় নিয়ে।
তাননা বলল
‘ এবার শান্তি হয়েছিস? এবার যাহ, যেখানে ইচ্ছে সেখানে। রাহার চাইতে বেশি তোকে কে ভালোবাসবে তার কাছে যাহ।
তাননা রোয়েনের হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। তারপর মুখের উপর দরজা টেনে দিতে দিতে বলল
‘ মরে গেছে আমার ভাই। আম্মা আব্বার মতো আজ ভাইটা ও মৃত হয়ে গেল আমার। মরে গেছে মুননা।

চলবে

#ধ্রুবতারা
#পর্ব_১৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

থানা থেকে মাত্রই ফিরলো জায়িদ। আনহার মুখে সবটা শুনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ডিভোর্সের কথা তার কানে এসেছে ঠিক কিন্তু এটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি জায়িদ। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। জাহেদা এসে মাথা চাপড়ে বলল
‘ শেষ করে দিল মুননু। সব শেষ করে দিল। ছোটবেলায় ভালো ছিল সে। কিছু করতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি খেত সে ভালো ছিল।

আনহা জায়িদকে বলল
‘ আমি মাত্রই এলাম। সোরার কান্নার জন্য ওখানে যাওয়া যাচ্ছে না। সোরা আঘাত পেয়েছে ভীষণ। ওরা এমন কেন করলো?

জায়িদ হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আহম্মেদ বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে সবাই তাকালো জায়িদের দিকে। জায়িদ নাহিলের সামনাসামনি গিয়ে বলল
‘ সব মিটমাট করেছিস?
নাহিল চুপ করে থাকলো। জায়িদ বলল
‘ মুননা কোথায়?
তাননা বলল
‘ বের করে দিয়েছি। কোথায় গিয়েছে জানি না। ফোন দাও।
জায়িদ ফোন দিল। ফোন কানে লাগিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাকে দেখলো। নাকমুখ ফুলে আছে রাহার। জায়িদ বলল
‘ ফোন তুলছে না মুননা। তুলবে ও না।
তাননা বলল
‘ থাক, আসবে সময় হলে। আর ফোন দিওনা মামা।
জায়িদ রাহাকে ডাকল। রাহা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো জায়িদের সামনে। মাথা নামানো অবস্থায় বললো
‘ জ্বি আঙ্কেল।
জায়িদ বলল
‘ তুমি রোয়েনের সাথে থাকতে চাওনি? সত্যি করে বলো। চাওনি? তাহলে ডিভোর্স লেটারে সাইন করলে কেন?
রাহার মাথা নামানো। জায়িদ ধমকাতেই মাথা তুললো রাহা।
‘ না চাইনি আঙ্কেল। তাই ডিভোর্স দিয়েছি।
জায়িদ নাহিলের দিকে তাকালো। বলল
‘ বাহ এই হচ্ছে তোমাদের ইয়াং জেনারেশনের ভালোবাসা?
রাহা চোখ তুলে তাকালো। বলল
‘ আমি আপনার বোনের ছেলেকে কখনো ভালোবাসিনি।
নাহিল ডাক দিল।
‘ রাহা মুখে মুখে তর্ক কোথা থেকে শিখেছ?
তাননা গিয়ে রাহাকে নিয়ে গেল। জায়িদ নাহিলকে বলল
‘ এইসব তাড়াতাড়ি মিটমাট কর ভাই। এত অশান্তি নিয়ে ঘুমাস কি করে? এই দুইজনকে দুই দিকে বিয়ে দে।
তাননা বলল
‘ মামা শান্ত হও।
জায়িদ বলল
‘ আরেহ কি শান্ত হবো? কি শুরু করেছে মুননা? আজ জুননু থাকলে এসব হতো কখনো? হতো? হতো না। তারমানে কি দাঁড়ায়?
নাহিল বলল
‘ রাগারাগি কেন করছ? ডিভোর্স হয়ে গেছে মানে হয়ে গেছে। থাকুক ওরা ওদের মতো। আমরা কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে পারিনা ওদের উপর।
জায়িদ নাহিলের দিকে কোণাচোখে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। নাহিল চলে গেল। সোরা জ্ঞান হারিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। তাননা ও চলে গেল। নোহা রিহান আর সালেহা সোরার জ্ঞান ফেরানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত। রাহা নরম পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। সোরার মুখের দিকে তাকাতেই বুক ভার হয়ে উঠলো। ওড়না টেনে মুখের কাছে দিল রাহা। আম্মার এই দশা তার জন্য। তার একটাই দোষ সে কেন বিয়ের দিন পালিয়ে গেল? কেন একটা গোঁয়ার মানুষকে মন দিল? এর প্রায়শ্চিত্ত সে করবে এবার। কিন্তু আম্মা ক্ষমা করবে তো তাকে?

জ্ঞান ফেরার সাথে দুহাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল সোরা। রিহান গিয়ে মায়ের পাশে বসে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে বসে থেকে বলল
‘ আম্মা প্লিজ কেঁদোনা। আম্মা!
সোরা কেঁদে উঠে দরজার কাছে রাহাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল
‘ ওই মেয়েকে সরতে বলো আমার চোখের সামনে থেকে। দূর হতে বলো। আমি তো ভাগ্যদোষে এক ঘর ছেড়ে এই ঘরে এসে সংসার পেতেছি। আর এই মেয়ে তো নিজ হাতে নিজের ঘর ভাঙলো। এখন লোকে ভালো করে বলতে পারবে মেয়ে ঠিক মায়ের মতো হয়েছে। ঘরভাঙা মেয়ে।

নোহা বলল
‘ আন্টি বকবক করা বন্ধ করো। পানি খাও। শান্ত হও।
সোরা পানির গ্লাস ফিরিয়ে দিল। বলল
‘ আমি থাকবনা এই বাড়িতে। চলে যাব। এদের সাথে একঘরে থাকবো না আমি। ও মেয়ে নয় আমার।

রাহা দরজা কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। সালেহা বেগম উঠে গেল। রাহার কাছে এসে বলল
‘ কাঁদিস না বোন। তোর আবার মাথায় আঘাত লাগবে। নিজের ঘরে যাহ।
রাহা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। তাকে লোকে ঘরভাঙা মেয়ে ডাকবে? সব দোষ ওই লোকটার। তাকে কেন বিয়ে করে দয়া দেখালো? আবার কেন ডিভোর্স দেওয়ার জন্য এত তাড়া?

সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলো রোয়েন। সোরার ঘরে গেল প্রথমেই। সোরা তাকে দেখে আঁড়চোখে তাকালো। রোয়েন সোরার দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর খাটের পাশে গিয়ে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসলো। সোরার হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো
‘ আমাকে ক্ষমা করো মামুনি। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি।। সোরা হাতটা নিয়ে ফেলে বলল
‘ ভালো কাজ করেছ। রাহাকে মানায় না তোমার পাশে। তোমার মতোই কাউকেই মানায়। নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করে নাও। রাহাকে ও বিয়ে দেব আমি।
রোয়েন চেয়ে রইলো। সোরার গাল বেয়ে জল পড়তে লাগলো। রোয়েন কিছু না বলে চলে এল।

রাতে সাদিদ এল। সোরা আসতে বলেছে। সকাল হতে না হতেই রিহানকে নিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তঃ নিল সোরা। নাহিল কত অনুনয়-বিনয় করলো। সোরা অনঢ় তার সিদ্ধান্তে। তার ছেলেকে নিয়ে চলে যাবে সে। সোরা বোরকা গায়ে দিয়ে লাগেজ নিয়ে চলে এল। সালেহা বলল
‘ তুই ও কি বাচ্চা হয়ে গেলিরে সোরা?
সোরা বলল
‘ আমাকে আটকিওনা বড় মা। আমি থাকব না।
রাহা দৌড়ে এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো সোরাকে। কেঁদে দিয়ে বলল
‘ আম্মা যেওনা। আমাকে ও নিয়ে যাও। আমি থাকবো না এই বাড়িতে।
সোরা দূরে ঠেলে দিয়ে ঠাসস করে চড় বসায় রাহার গালে। আঙুল দেখিয়ে বলে
‘ খবরদার আম্মা ডাকবি না আমায়। আর আমার সাথে যাওয়ার কথা ভুলে ও বলবি না। তুই মেয়ে নস আমার। মরে গেছে আমার মেয়ে।
রাহা আবার সোরার হাত থেকে লাগেজ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সোরা আরেকটা চড় বসিয়ে বলল
‘ যেতে বলেছি। আরেকবার বাঁধা দিতে আসলে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব।

আঁতকে উঠে সবাই।

সালেহা বেগম এসে রাহাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ কাঁদিস না বোন অসুস্থ হয়ে পড়বি। যেতে দে তোর মাকে।
রাহা বলল
‘ নাহ।
সোরা সাদিদের সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। রিহান সোরাকে বলল
‘ আপুকে ও নিয়ে আসো আম্মা।
সোরা বলল
‘ কে তোর আপু? কোনে আপু টাপু নেই। কারো কথা বলবি না আমাকে।
সাদিদ বলল
‘ আপা আর রাগারাগি করো না তো।
সোরা নাকমুখ মুছে গাড়িতে ভালো করে বসলো। রোয়েন এসে দেখলো সোরা গাড়িতে উঠে বসেছে। রোয়েন একপর্যায়ে দৌড়ে এল। সোরার হাতের লাগেজ ধরে ফেলে বলল
‘ কি হচ্ছে মামুনি? তুমি কোথায় যাচ্ছ?
সোরা বলল
‘ জাহান্নামে। এই বাড়ি থেকে ভালো অন্তত।
রোয়েন বলল
‘ তুমি চলে গেলে এই বাড়ি,,,
সোরা বেশি বলতে দিলনা রোয়েনকে। ধমকে বলল
‘ আমার কথার কোনো মূল্য নেই এই বাড়িতে। কার জন্য থাকব আমি? থাকুক সবাই সবার মতো। সোরাকে ছাড়া সবার দিনকাল ভালোই চলবে।
গাড়ি ছেড়ে দিল। রোয়েন হাজার চেষ্টা করে ও আটকাতে পারলো না। সোরা যেতে না যেতেই রাহা কান্নায় ভেঙে পড়লো। কেঁদে উঠে বলল
‘ আম্মাকে আঘাত করেছি আমি।

রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে রাহার কান্না দেখলো। সব কেমন যেন হয়ে গেল মুহূর্তে। তারমানে রাহাকে ডিভোর্স দেওয়া ঠিক হয়নি? অবশ্য সে দেওয়া না দেওয়ারই বা কে?

সোরা যাওয়ার তিন চারদিন পার হলো। রান্নাঘর সামলালো তাননা আর সালেহা বেগম। রাহা ও টুকটাক করে। সোরা না থাকায় সব এলোমেলো। রান্নাঘরটা সে সামলায়। রোয়েনের কফিটা ও সে বানায়। সে না থাকায় সবার আগে রোয়েনের বেশি অসুবিধা হলো। তাননা উল্টাপাল্টা বানায়। খাওয়া যায় না। রোয়েন বিরক্ত হয়ে তাই নিজেই কফি করে নিতে গেল। রান্নাঘরে ঢুকতেই থেমে গেল সে। রাহা গরম পানি নিয়েছে মগে। তার ঔষধটা গরম পানি মিক্স করে খেতে হয়। রোয়েন রান্নাঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। রাহা পানি নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই রোয়েনকে দেখলো। রোয়েন রান্নাঘরে ঢুকে কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রাহাকে উদ্দেশ্য করে বলল

‘ প্যাকেটা কোথায় রাখা?

রাহা পানির মগ রেখে প্যাকেট খুঁজে রেখে দিল রোয়েনের সামনে। তারপর হেঁটে বেরিয়ে গেল। রোয়েন রাহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঞ্চন করলো।

________

নোহার এক্সাম চলছে। এক্সাম তার উপর বিকেলে পড়েছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব চলে আসে চারপাশে। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে রাস্তার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। রিকশা নেই খালি। সব পাসেন্জারে ভর্তি। নোহাকে আর ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। রাস্তার ওপাশে বাইকের উপর বসা ছেলেটি হাত নাড়লো নোহাকে দেখে। নোহা মুখ ফিরিয়ে একটি খালি রিকশা দেখে ডাক দিল
‘ এই রিকশা?
রিকশাচালক ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
‘ আমার ভাড়া আছে আপা।
নোহা বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। সোয়েভ রাস্তা পার হয়ে হেঁটে এল। শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বলল
‘ রিকশাওয়ালাদের আজকাল আরেক ভাব। বাপরে বাপ পারা যায় না এদের সাথে।
নোহা দূরে সরে গেল হাঁটতে হাঁটতে। সোয়েভের মনে হলো এই মেয়ে তাকে এভয়ড করছে। সোয়েভ বলল
‘ রিকশাচালক সাথে এই ভার্সিটির মেয়েগুলো। এদের ভাব দেখে বাঁচিনা।
নোহা নাক ফুলিয়ে তাকালো। বলল
‘ সমস্যা কি আপনার?
সোয়েভ বলল
‘ সমস্যা কোথায়? সমস্যা নেই তো। আপনি কি রেগে আছেন আমার উপর?
নোহা বলল
‘ রাগ করার মতো কিছু করেছেন?
সোয়েভ তোতলালো।
‘ কই কিছু করিনি তো!
নোহা ধমক দিয়ে বলল
‘ ঘটক পাঠিয়েছেন বাড়িতে? কেন? আমার আব্বার মতো সৎ পুলিশ অফিসার পছন্দ আমার। অন্য প্রফেশন পছন্দ না।
সোয়েভ বলল
‘ প্রফেশন পছন্দ না সেটা বলছেন কেন? বলুন মানুষটা পছন্দ না।

বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল সোয়েভ। নোহা রিকশা ও পেয়ে গেল। রিকশায় উঠে বসলো। নোহা ভেবে পাইনা মানুষ কি পায় এসব করে? কেউ পাওয়ার জন্য পাগলামি করে? আবার কেউ ছাড়ার জন্য। রাহাপু আর রোয়েন ভাইয়ার বিচ্ছেদ দেখে ভালোবাসা শব্দটা আজকাল মিথ্যে ঠেকে নোহার কাছে। এ শব্দটা মানুষকে কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু দিতে পারে না। নোহা কখনো কাউকে ভালোবাসবে না। ভালো না বেসেই বিয়ে করবে। বিয়ের পর ও ভালোবাসবে না। ভালোবাসলেই বিচ্ছেদ হয়। ভালোবাসলেই ক্ষতি। ভালোবাসলেই ধ্বংস হয়।

বাড়ি ফিরে জায়িদের মুখোমুখি নোহা। জায়িদ বলল
‘ স্যার দেখতে চাইছে তোমাকে। উনি আর উনার ওয়াইফ আসবেন। তোমাকে দেখে চলে যাবে।
নোহা বলল
‘ আমাকে তো ওনারা অনেকবার দেখেছে আব্বা। আবার কি দরকার?
জায়িদ বলল
‘ সব কেন’র উত্তর হয় না। তুমি কি আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আছ? মন দিতে পারছো না?
নোহা বলল
‘ তেমন কিছু না।
জায়িদ বলল
‘ ঠিক আছে। তাহলে যা বলছি তা করো। তোমার অন্য কোথাও পছন্দের কেউ থাকলে বলতে পারো।
নোহা বলল
‘ নেই।
জায়িদ বলল
‘ ঠিক আছে। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আমি আব্বা তোমার। ভালো চাই সবসময়।
নোহা রুমের দিকে পা বাড়ালো। আনহা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নোহা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আম্মা বিয়ে হলেই কি বিচ্ছেদ হয়?
আনহা বলল
‘ নাহ। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দুপক্ষেরই স্যাক্রিফাইজ করা লাগে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকা লাগে। সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল থাকতে হয়। শ্রদ্ধা থাকতে হয়। নইলে বিচ্ছেদ ঘটে।

নোহা বলল
‘ আমার ভয় হয় আম্মা। রাহাপুর মতো যদি হয়?
আনহা বলল
‘ হবে না। কেউ ভালোবাসলে তার মর্যাদা দেবে। ভালোবাসতে না পারো আঘাত করবে না কখনো। মনে রেখো।
নোহা মাথা নাড়ালো।

সোয়েভের বাবা মা দেখতে এল নোহাকে। রাহা নিজ হাতে শাড়ি পড়িয়ে দিল নোহাকে। বলল
‘ তুই বউ সাজবি নোহা! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
নোহা রাহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বলে
‘ তুমি জানো এরা কেন এত তাড়াহুড়ো করছে বিয়েটা হওয়ার জন্য?
রাহা শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে দিতে বলল
‘ কেন?
নোহা বলল
‘ রোয়েন ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া শীঘ্রই পিএইচডি নিতে চলে যাবে। তার আগেই নিজের বন্ধুর সাথে আমাকে জড়িয়ে দিয়ে ফরজ কাজটা সেড়ে নিচ্ছে।
রাহা কুঁচি ঠিক করে দাঁড়িয়ে বলল
‘ এইবার ঠিক আছে। মুখটা একটু হাসিখুশি কর। পেঁচির মতো করে আছিস কেন? আমার মতো হাস।
নোহা বলল
‘ তোমার মতো অভিনয় পারিনা আমি। ঢং করবে না আমার সামনে। রাহা বলল
‘ চিল্লাস না নোহা। আমি ছাদে যাচ্ছি, আম্মাকে ফোন দিয়ে সুখবরটা জানায়। সে সুবাদে আম্মা কথা বলবে আমার সাথে। কতদিন কথা বলিনা।
নোহা বলল
‘ আমার প্রশ্ন এড়িয়ে চলে যাচ্ছ কেন? ভীতুরা এভাবে পালায়।
রাহা চলে গেল ছাদে। সোরার ফোনে ফোন লাগলো সাথে সাথে। সোরা রিসিভ ও করলো। রাহা কাঁদোকাঁদো গলায় ডাকল
‘ আম্মা? ফোন কেটোনা আম্মা।
সোরা শক্ত গলায় বলল
‘ কি জন্য ফোন দিয়েছ?
রাহা বলল
‘ আম্মা কবে ফিরবে তুমি? আমার উপর রেগে থেকোনা আম্মা।
সোরা বলল
‘ কারো উপর রেগে নেই আমি। মায়ের মতো কপাল নিয়ে জন্মেছ কি আর করার?
রাহা চুপ করে থাকলো। সোরা বলল
‘ আমি ফিরছিনা আপাতত। ফোন কম দেবে। আমার অত সময় কোথায় কথা বলার?
রাহা বলল
‘ নোহার বিয়ে। তুমি আসবে না?
সোরা চুপ করে থাকলো। কিছুক্ষণ পর বলল
‘ আসবো। বিয়ে খেয়ে আবার চলে আসবো। ওই বাড়িতে দমবন্ধ লাগে আমার।
রাহা গাল মুছলো নীরবে। সোরা বলল
‘ ফোন রাখো।
রাহা ফোন রাখার আগে সোরা নিজেই রেখে দিল। রাহা ডাকল
‘ আম্মা কথা শোনো।
সোরাকে ফোন দিতে গিয়ে ও দিল না রাহা। তবে ওই বাড়ির ছাদে এসে ফোনে কথা বলতে থাকা ছেলেটাকে দেখে কিছুটা সরে দাঁড়ালো রাহা।
ছেলেটা তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ও ফোনে বলতে লাগলো,

‘ আমি আপনাকে বারবার বলেছি হার্টের রোগীদের কোলেস্টরল এবং লিপিড নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সাধারণত ভাত এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য কম খেতে হয়। কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণের জন্য ফুলক্রিম দুধ, সর, ঘি, গরুর মাংস ইত্যাদি খাদ্য শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেখুন পেশেন্ট যদি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কিংবা রুলস গুলো ফলো না করে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের কি করা যেতে পারে?

অনেক্ষণ ধরে একপ্রকার কথা কাটাকাটি করে ফোন রাখলো রোয়েন। চোখ তুলে দৃষ্টি ফেললো তালুকদার বাড়ির ছাদে। রাহা ফোনে মনোযোগ দিয়ে চলে আসতেই নোহা চলে এল। রোয়েনকে না দেখেই জিজ্ঞেস করল
‘ ভালোবাসা কি রঙ বদলায় রাহাপু?
রাহা চমকালো এমন প্রশ্নে। রোয়েন থাকায় ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। নোহা রোয়েনকে দেখে চমকালো। উসখুস করতে করতে বলল
‘ ভাইয়া?
রোয়েন নোহাকে শাড়ি পড়া দেখে হাসলো কিঞ্চিৎ। বলল
‘ আনসারটা আমার কাছে আছে। শুনবে?
রাহা পিছু করে দাঁড়ানো। রোয়েন বলল
‘ এই যে বললে ভালোবাসা, এটার কোনো রঙই থাকে না। বদলাবে কি করে?
নোহা বলল
‘ সত্যি?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা। পিচ্চি নোহা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ভালো থেকো সবসময়।
নোহা বলল
‘ আচ্ছা।

চলবে,