ধ্রুবতারা পর্ব-২৫

0
826

#ধ্রুবতারা
#পর্ব_২৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙলো রোয়েনের। বালিশের উপর থেকে ফোন টেনে দেখলো ৬টা বাজে । ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। তাননা তখনি ঘরে এল। রোয়েনকে মুখ মুছতে দেখে বলল

‘ কোথাও যাবি? তুই তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ না।

রোয়েন ফটাফট জবাব দিল।

‘ পুরোপুরি সুস্থ কোনো মানুষই না। পুরোপুরি সুস্থ বলতে কি বুঝাতে চাইছিস?

তাননা বলল

‘ নাহ, তুই আবার ত্যাড়ামো শুরু করছিস। তোর সাথে কোনো কথা নেই। তোর জন্য মাইর জমা রেখেছি। কত কাঁদিয়েছিস তুই আমায়।

হাসলো রোয়েন।

‘ তুই তো পাগল। তাই কাঁদিস।

তাননা বলল

‘ রাগাস না।

রোয়েন আবার ও হাসলো। তাননা তেড়ে গেল। আবার দাঁড়িয়ে পড়ে বলল

‘ মুননু রাগাস না। তোর পিঠে মারলে ব্যাথা পাবি।

রোয়েন আওয়াজ করে হেসে দিল। বলল

‘ আহারে মারতে না পেরে কষ্ট লাগছে?

তাননা বলল

‘ মশকরা না। তোকে মারলে ব্যাথা পাবি। এদিকে আয় মলম লাগিয়ে দিই।

রোয়েন ঘাড়সহ মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বলল

‘ এখন নাহ। পরে৷ আমার পছন্দের শার্টে ওসব লেগে যাবে। দাগ পড়বে ৷

তাননা বলল

‘ এদিকে আয়। ফালতু কথা বলবি না। মলম না লাগালে শুকোবে কি করে?

‘ ঔষধে শুকোবে। ডাক্তার তুই নস। ডাক্তার আমি।

তাননা মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। রোয়েন এসে টেনে নিল তাকে। কপালে চুমু দিয়ে ঠেলে দিয়ে যেতে যেতে বলল

‘ রাগিস না তুননু। কাজে যাচ্ছি। চলে আসব৷

তাননা বলল
‘ না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? মামুনি বকবে।

রোয়েন বলল

‘ আজ বাইরে বন্ধুদের সাথে। টা টা।

তাননা বলল

‘ ধুরর বাবা। তুই একদম ঘরে থাকিস না। সারাদিন বাইরে বাইরে। একটা বিয়ে করায় দিলে তারপর বউয়ের শাড়ির আঁচল ধরে বসে থাকবি।

রোয়েন যেতে যেতে বলল

‘ ঈশান ভাই বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকে না কেন? তুই কি বউ নস? নাকি শাড়ি পড়িস না বলে ধরার মতো আঁচল নেই।

তাননা বলল

‘ সব কথা রেডি থাকে তোর মুখে।

রোয়েন গলা বড় করে যেতে যেতে বলল

‘ থাকবে না কেন?

রোয়েন নিচে আসতেই জুনিত আর রিহান তার মুখোমুখি পড়ে গেল। রোয়েন গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল
‘ পড়ালেখা কেমন চলছে? নাকি শুধু খেলাধুলা?
জুনিত আর রিহান মাথা নামিয়ে বলল
‘ ভালো।
সোরা এসে বলল
‘ একদম ফাঁকিবাজ দুইজন। পড়ালেখার ধারেকাছেও নেই। মিথ্যে বলছে মুননা৷
রোয়েন তাকালো তাদের দিকে । জুনিত আর রিহান মাথা একেবারে ঝুঁকিয়ে ফেলে বিড়বিড় করলো
‘ আর হবে না ভাইয়া। এখন থেকে পড়বো।
রোয়েন বলল
‘ ঠিক আছে। এইবার লাস্ট চান্স। রেজাল্ট খারাপ হলে খবর আছে।
দুজন কোনোমতে পালালো যেন। সোরা বলল
‘ কফি আনি?
রোয়েন সোফায় তাকালো। সালেহা বেগম অজিফা পড়ছেন।
রোয়েন বলল
‘ নাহ। কিচ্ছু খাব না। ব্রেকফাস্ট বাইরে করব।
সোরা বলল
‘ আবার বাইরের খাবার?
রোয়েন বলল
‘ একদিন। তাছাড়া বাইরের খাবার খেলে পেট খারাপ হয় এটা একদম ভুল কথা। তা না হলে এত এত রেস্টুরেন্টে দোকান এসব থাকতো না। আসলে যেদিন পেট খারাপ হয় ওইদিন কিছু না খেলেও পেট খারাপ হয়।
সোরা টিকতে পারলো না এত এত যুক্তির সামনে।
রোয়েন বেরোনোর আগে হাতের ঘড়ির দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে বসলো
‘ রাহা কোথায়? দেখা যাচ্ছেনা?
সোরা কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো রোয়েনের দিকে। রোয়েন বলল
‘ এভাবে তাকানোর কি আছে? কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
সোরা মাথা নাড়িয়ে আমতাআমতা করে বলল
‘ নেই। ও তো অনেকদিন বাড়ি নেই। এখানে কি করবে?
রোয়েন মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ তা ঠিক। কি করবে? সময় থাকতে সাধন করা উচিত। করুক। ক্ষতি কি? যাইহোক আসছি।
রোয়েন চলে গেল। সালেহা বেগম তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ হঠাৎ রাহার খোঁজ কেন?
সোরা বলল
‘ কে জানে?

_________

দুপুরের দিকে ফিরলো রোয়েন। শরীর অতটা ও সুস্থ না এখনো। ক্ষতস্থান কাঁচা রয়ে গেছে অনেকটা। আজকে মার্কো আর এলিজার এখানে আসার কথা। তারা এখনো সুইজারল্যান্ডে ফিরে যায়নি। কালকের দিকে ফিরবে। রোয়েন চায় মার্কো তার বাসায় একদিন খেয়ে যাক৷ মানুষটা তাকে বড্ড স্নেহ করে। সে হয়ত বেঁচে গেছে মানুষটার জন্য। উপরওয়ালা উছিলা হিসেবে যেন মানুষটাকে পাঠিয়েছে।

সোরা শুনে খুশি হলো মার্কো আর এলিজা আসছে শুনে। বিদেশিদের অ্যাপায়ন করবে তাই উত্তেজনার শেষ নেই তার। তার রান্না কি পছন্দ হবে তাদের?

সন্ধ্যার দিকে আসবে মার্কো আর এলিজা। সোরা হরেক রকম রান্না করেছে। তাননা ও হাতে হাত মিলিয়েছে। নোহা এসে বলল
‘ আন্টি তোমার রান্নার গন্ধে থাকা যায় না। খাব খাব৷
সোরা বলল
‘ তোর বর কোথায় রাক্ষসী?
নোহা বলল
‘ সিমেন্ট ওয়ালা আছে ফাইলপত্র নিয়ে। রাতে আসবে।
তাননা বলল
‘ সিমেন্ট ওয়ালা! এটা কোনো নাম হলো? সোয়েভকে সবসময় পঁচানোর তালে থাকিস তাই না?
নোহা বলল
‘ পঁচা মানুষকে আবার পঁচানোর কি আছে?
সোরা বলল
‘ তোর সাথে কথাই পারা যায় না।
নোহা বলল
‘ সে যাইহোক। সব ভালোই ভালোই মিটে গেল। এইবার বাড়িতে বিয়ে টিয়ে নামাও। এই এসবের ঝামেলায় পড়ে আমার হানিমুনটা মাটি৷
তাননা ডাক দিয়ে বলল
‘ তুই মামুনিকে ও লজ্জা পাচ্ছিস না নোহা? তুই গম্ভীর সম্ভীর হবি কবে? বাচ্চা কাচ্চার মা হবি কিছুদিন পর।
নোহা বলল
‘ তওবা তওবা কি বলো ওসব? রাহাপুর আগে বিয়ে করলাম ঠিকাছে কিন্তু মা টা নানি দাদি কিচ্ছু হবো না। আগে রাহাপু আণ্ডাবাচ্চার মা হোক। তারপর।
সোরা হেসে সরে পড়লো। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মুখে লাগাম নেই। নোহা বলল
‘ আপু একটা কথা বলি?
তাননা বলল
‘ বল।
নোহা বলল
‘ রাহাপুর উপর রেগে থাকার কোনো কারণ দেখছিনা আমি। তখনও দেখিনি। এখন ও না।
তাননা চুপ হয়ে গেল। নোহা বলল
‘ চুপ থাকবেনা। কিছু বলো। আমি বুঝতে পারছি তোমার তখনকার অবস্থা। কিন্তু এখন তোমার উচিত রাহাপুকে ফিরিয়ে আনা। নিজ থেকে কথা বলা। সবাই রাহাপুর সাথে যখন যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যবহার করে। তুমি ও বাদ যাওনি।
তাননা বলল
‘ আমি আসছি।
নোহা তাননার যাওয়ার দিকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

__________

মার্কোর সাথে বেশ ভালোই গল্প জমলো নাহিল আর জায়িদের। ইংরেজির উপর কনভারসেশন শুনে সালেহা বেগম ভাবলো
‘ এগুলো আবার কি ভাষা? চ্যাঙম্যাঙ।
নাতাশা বলল
‘ তুমি কিছু বুঝোনা আপা। এগুলো ইংরেজি ভাষা।
সালেহা বেগম
‘ আমি তোর মতো অত কিছু জানি নাকি?
নাতাশা বলল
‘ জানো না তো কি হয়েছে? এখন জানবে।

এলিজার সাথে ভাব হলো তাননা আর নোহার। বেশ প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি মেয়ে। খাওয়ার টেবিলে বেশ তৃপ্তিসহকারে খেল তারা। মার্কো বেশ প্রশংসা করলো। তবে মাছে পেঁয়াজ বেশি দেখায় বলল, সে পেয়াঁজ কম পছন্দ করে।
সোরা বলল
‘ পেঁয়াজ কম দিলে রান্না ভালো হয় না তেমন। এলিজা বলল
‘ আমার বেশ ভালো লেগেছে। একদম আলাদা তৃপ্তি।
রোয়েন চুপচাপ। এলিজা বলল
‘ ডক্টর আহামাদ আপনার ওয়াইফকে তো দেখলাম না।
সবাই সচকিত চোখে রোয়েনের দিকে তাকালো। তাননা ও তাকালো রোয়েনের দিকে। রোয়েন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল
‘ এক্সকিউজ মি!
এলিজা বলল
‘ আর ইউ ওকেই?
রোয়েন যেতে যেতে বলল
‘ খান। আমি এক্ষুণি আসছি।
সেই যে গেল আর এল মার্কো আর এলিজা যাওয়ার সময়। এলিজা যাওয়ার আগে আবার বলে বসলো
‘ ডক্টর আহামাদ আপনার ওয়াইফকে না দেখতে পেয়ে খারাপ লাগলো। ওনাকে বেড়াতে পাঠালেন কেন এসময়? ওনার এসময় আপনার পাশে থাকার দরকার ছিল।

রোয়েন তাননা আর নোহার দিকে তাকালো আঁড়চোখে। তারা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
এলিজা বলল
‘ নো প্রবলেম। আমরা আর সপ্তাহ খানেক আছি। আপনার ওয়াইফকে নিয়ে একদিন আমাদের রিসোর্টে ঘুরে আসবেন । ঠিক আছে?
রোয়েন এমনি এমনি মাথা নাড়ালো। সোরা রোয়েনের মাথা নাড়ানো দেখে চলে গেল। মার্কো আর এলিজা বিদায় হলো।

রোয়েন তাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আবার বাড়িতে চলে এল। হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই সালেহার গলা ভেসে আসলো।

‘ ভাই তোর বউ মানে কি বলতে চাইছিল ওই মেয়ে?

রোয়েন ঘাড় ঘুরালো। বলল

‘ আমি কি জানি?

তাননা বলল

‘ ওসব কথা থাক।

_____________

সপ্তাহের প্রেক্ষাপটে,,

~

কুয়াশা এবার ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা। বসন্ত আসার শুরু। চারদিকে কোকিলের কুহুকণ্ঠ। পাতাঝরার দিন। নতুন করে গাছের পাতা গজার দিন। কি সুন্দর চারপাশে! উত্তরী হাওয়া বইছে রূপসা নদীর কোল ঘেঁষে। নদীর চর শুকোনো। খেলা করছে অনেকে। জেলেদের হাতে মাছ ধরার জাল,লোহার বালতি। নদীতে চলছে ছোট্ট ছোট্ট পালতোলা নৌকা। দূরে কয়েকটা ট্রলার।

নদীর চরে এককোণায় খেলা করছে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা বাচ্চা। আরেককোণায় অল্পবয়সী কয়েকটা কুমারি। সবার গায়ে সেলোয়ার কামিজ৷ ওড়না গিট বাঁধা কাঁধ বেয়ে কোমরের সাথে। খেলছে কানামাছি। চোখ বাঁধা একটা মেয়েকে ঘিরে সবাই ঘুরছে। আর মুখে মুখে আওড়াচ্ছে

‘ কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যাকে পাবি তাকে ছো।

রাহার পেছনে এসে চোখবাঁধা পট্টি আস্তে করে টান দিল সামিরা। রাহা পেছনে ফিরে গিয়ে রেগে বলল

‘ কে এভাবে টানছে? এইরকম হলে আমি খেলবই না।

সামিরা খিলখিল সুরে হাসিতে ফেটে পড়লো। সামিরার সমবয়সী একজন বলল
‘ সামিরা, শহুরে কন্যাকে রাগাস কেন?
সামিরা বলল
‘ ঠিক আছে। আর রাগাবো না। আপু এবার তাড়াতাড়ি আমাদের খুঁজে বের করো তো৷
রাহা হাত বাড়িয়ে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল
‘ দাঁড়া তোকে ছুঁবো সবার আগে।
সামিরা দূরে দৌড়ে গিয়ে বলল
‘ পারবে না। পারবে না।
রাহা পা বাড়িয়ে বলল
‘ পারব। খুব পারব।

সবার ঘুরলো তার চারপাশে। তাদের মুখের বুলিতে বিরক্ত হলো জেলেরা। চরে বসে খেলা করা বাচ্চাগুলো। এক জেলে বিরক্ত হয়ে বলল

‘ এই মেয়পোগুনুর জ্বালায় মাছ ধরি সুবিধে নপের। হান ইয়েন যারগুর। প্যানপ্যান লাগেয়ি।
( এ মেয়েগুলোর জ্বালায় মাছ ধরে সুবিধা পাচ্ছি না। কানটা চলে যাচ্ছে। প্যানপ্যান শুরু করেছে)

খেলা চলছে নদীর চরে। সাদা খয়েরী রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটা সবার মাঝখানে হাত হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে পা বাড়াচ্ছে সাবধানে। নীল খোলা আকাশের বুকে উড়ছে নাম না জানা কয়েকটা পাখি।
উত্তরী হাওয়া বইছে শাঁ শাঁ করে। রাহার আলগোছে বাঁধা বেণুনির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েকটা চুল এসে পড়েছে চোখেমুখে। ওই যে নদীর পাড়। সেখানে দাঁড়িয়ে নীরব শান্ত চোখে একটি প্রাণী দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মাঝনদীর দিকে। এত সুন্দর নদীর দিকে না তাকিয়ে অন্যকোথাও তাকানোর সময় কোথায়? নদীর চাইতে সুন্দর আর কিছু আছে নাকি?
চারপাশের কোলাহল মিশে গেল নদীর কলকল ধ্বনির সাথে। পাখ-পাখালির কলতানে মুখর পরিবেশে অন্য শব্দগুলো তুচ্ছ। সেই শান্ত নীরব প্রাণিটি নরম পা বাড়ালো নদীর চরের কাছে। পা ডুবিয়ে রাখবে কিছুক্ষণ নদীর শান্ত জলে। এগোতেই মনে হলো চারপাশটা নীরব হয়ে যাচ্ছে।

তবে বেশিদূর এগোতেই প্রাণিটি নিজ থেকেই থেমে গেল। পা ডুবানো হলো না বোধহয়। যার খোঁজে এসেছে সে তো হা বাড়িয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাকিমেয়েগুলো মজা দেখছে। ফিসফিসিয়ে একে অপরকে বলছে
‘ শহুরে কন্যা ছুটে চলেছে শহুরে বাবুর খোঁজে।

উফফ এতক্ষণ পর কেউ একজনকে ধরতে পারলো রাহা। তবে চেঁচামেচি হৈ হুল্লোড় না শুনায় সন্দেহ তীব্রতর হলো। তার চাইতে খাটো সাইজের কেউ নাহ, বরং খাম্বার মতো এটা আবার কি? সেলোয়ার কামিজ তো এমন না। পাথরের মতো শক্ত বুক ও না।
রাহা জিজ্ঞেস করল

” কে?

ছেলেটি সরে পড়লো দ্রুত। নিজের বুকের কাছে শার্ট ঝেড়ে বলল

‘ শেষ করে দিলে আমার টিশার্ট। সব বালি। ইয়াকক।

রাহা হাত দিয়ে টেনে চোখের পট্টি খুলে নিল। চোখ বড় হওয়ায় বিপরীতে ছোট ছোট্ট হলো। সাদা কালো ফুলস্লিভ টিশার্ট গায়ে দাঁড়ানো পুরুষটির গায়ে তার বালিমাখা হাতের ছাপ। গম্ভীর সম্ভীর চেহারার গড়ন। স্থীর, শান্ত, অটল চোখের চাহনি।
রাহা চোখ নামিয়ে চোখ রাখলো চরের বালিতে৷

রাহার নিজেরই খেয়াল হলো তার নেত্রপল্লবে বসন্তের ফুল না ফোটে ভিজে উঠছে বর্ষার প্লাবনে। উপরওয়ালার লীলাখেলা বোধহয় একেই বলে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ফিরে আসা মানুষগুলোকে কি বলে সে জানেনা? তবে তার উপর থেকে কত বড় দোষারোপ সরে গেল মুহূর্তেই। যার হারিয়ে যাওয়ার কারণ সে হয়, যার মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছার কারণ সে হয়, সে আর যাইহোক কখনো শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না৷ শুভাশিষ হতে পারে না৷ হয়ত এরজন্য এত বিচ্ছেদ, বেদনা। যাইহোক সেই মানুষটা ফিরে এসেছে, বেঁচে আছে, ভালো আছে এই যথেষ্ট রাহার কাছে।
তবে ভাবনা অন্যরকম ছিল৷ এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো একটা সময় দেখা হয়ে গেলে ঝাপটে ধরার কথা ছিল৷ একদম হুট করে চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা ছিল! মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোকে অভ্যর্থনা জানাতে হয় চোখের জল দিয়ে। তবে সময় বলতে কিছু একটা আছে৷ সবসময় কি আর সবকিছু মানায়?

রাহা ওড়নার গিট খুলে গায়ে জড়ালো৷ দৌড়ে গিয়ে জুতো নিল পায়ে। ওড়না ভালো করে গায়ে জড়াতে জড়াতে দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল৷ তার পিছু পিছু গেল সবাই। সামিরা দৌড়ে আসলো রোয়েনের কাছে। সালাম দিয়ে বলল
‘ ভাইয়া আর কে কে এসেছে?
‘ তাননা, নোহা।
সামিরা খুশি হয়ে গেল। বলল
‘ আচ্ছা, আমি যাই?
‘ যাও।
সামিরা চলে গেল।

আহম্মেদ মঞ্জিলে পৌঁছালো রাহা হাঁপাতে হাঁপাতে। তাকে দেখে নোহা দৌড়ে এল। দৌড়ে এসে রাহাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ কেমন আছ রাহাপু? তোমায় কতদিন দেখিনা।
রাহা জবাব দিল না। টলমলে চোখের পাতা কাঁপলো ঘনঘন।
নোহা বলল
‘ রাহাপু তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তাননা আপু ও এসেছে।
রাহা চমকালো৷ তাননা আপ!
তার অস্ফুটস্বরে বলা কথাটা নোহা শুনলো৷ রাহাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল
‘ হ্যা। ভেতরে আছে৷ জিশানকে ঘুম পাড়াচ্ছে বোধহয়।
রাহা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। নোহা বলল
‘ কি হয়েছে রাহাপু?
রাহা মাথা নাড়ালো। নোহা বলল
‘ কি হয়েছে? বলো?
রাহা বলল
‘ আমি যাব না নোহা। তাননা আপুর সাথে রেগে নেই আমি। আমি এমনি যাব না৷ ও-ই বাড়িতে ভালো লাগেনা আমার। যাব না আমি।
নোহার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল
‘ তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে তাননা আপু। তুমি না গেলে আপু খুব কষ্ট পাবে।
রাহা বলল
‘ আমি যদি ওখানে যাই, তাহলে কারো হোঁচট খাওয়ার কারণ হবো। কারো হারিয়ে যাওয়ার কারণ হবো৷ কারো কারো বিরক্তির কারণ হবো। আমি এখানে ভালো আছি। আমি ফিরব না নোহা।
নোহা কোনো কথা বলতে পারলো না। রাহা ঘরে চলে গেল। তাননা দুপুরবেলা রাহাকে খুঁজলো না আর। সে জানে রাহা তার ঘরেই আছে। রাতে কথা হবে। আজ রাতটা থেকে যেতে হবে। কালকেই রওনা। রোয়েন বাড়িতে ফিরলো রাতে।
পুরোনো মাটির ঘরের জায়গায় পাকা দালানের বড় বাড়ি উঠেছে। আগের সেই বাড়িঘর নেই। বিপুল পরিবর্তন চারপাশে। রোয়েনকে থাকার ঘর দেওয়া হলো। রাতে খাওয়া দাওয়া হলো। ঝুমা আর সালমা বেগম কারো যত্নের ত্রুটি রাখলো না। খাওয়া দাওয়া শেষে তাননা রাহার রুমে যেতে চাইলো। কিন্ত রাহাকে খাওয়ার টেবিলে দেখলো সে। সালমা বেগম খাইয়ে দিচ্ছে রাহাকে। তাননাকে দেখে রাহা আর খেল না। দাঁড়িয়ে পড়লো। তাননা এগিয়ে আসলো। রাহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলে বলল
‘ রেগে আছিস আমার উপর?
রাহার কান্নার বাঁধ ভাঙলো। তাননা বলল
‘ ভাই কি জিনিস যদি হারায় সেদিন বুঝবি। তার আগে নয়। মাথা কি ঠিক ছিল তখন। কি বলতে কি বলেছি? সবসময় সবকিছু সিরিয়াসলি নিতে নেই রাহা। আমি তোর বড় বোন। আদর করব, বকা ও দেব। ভালো ও বাসব, শাসন ও করব।
রাহা চোখ চেপে ধরলো তাননার কাঁধে। তাননা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
‘ তোকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। যাবি না?
রাহা মুখ তুললো। বলল
‘ নাহ। সবাই আমাকে আবার বিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটছো না? আমি বিয়ে করব না আপু। এসবে আমাকে আর জড়িওনা।
তাননা বলল
‘ বিয়ে করিস না। তুই ও বিয়ে করবি না। রোয়েন ও বিয়ে করবে না। কেউ বিয়ে টিয়ে কিচ্ছু করবি না। কি দরকার বল?
রাহা বলল
‘ ইয়ার্কি করছ কেন?
তাননা হেসে ফেললো আওয়াজ করে।

চোখ কচলাতে কচলাতে রোয়েন এসে পড়লো। রুমে নাকি পানির জগ রাখা নেই। উফফ কি জ্বালা!
এখানে এত কান্না টান্নার বাহার দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলল
‘ হচ্ছেটা কি?
তাননা বলল
‘ তুই তো বিয়ে করবি না নাহ?
রোয়েন বলল
‘ নাহ। করব।
তাননা ভুরু কুঁচকে বলল
‘ করবি না বলেছিলি নাহ?
রোয়েন বলল
‘ কখন বলেছি? রুমে পানির জগ রাখার জন্য ও তো বউ লাগবে। আমার অত সময় কোথায় বাসি কাজ করার?
রাহার নাকটা অটোমেটিক ফুলে গেল। রোয়েনের হাতে পানিভর্তি জগ দিল সিহাব৷ রোয়েন জগ নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ ননসেন্স রাহা।
রাহা চোখ পাকিয়ে তাননার দিকে তাকালো।
তাননা বলল
‘ কাঁচা ঘুম ভেঙেছে তো, তাই উলটপালট বকছে।

পরদিন সবাই ফিরলো শহরে।

চলবে।