উমা পর্ব-৪৫+৪৬

0
347

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৫তম_পর্ব

উমার প্রশ্নে শ্রাবণ ধীর কন্ঠে বলে,
“জ্বী, উনার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু একটা খারাপ খবর ও আছে।”
“খোলশা করে বলুন তো”
“উনার জ্ঞান ফিরেছিলো গতকাল রাতে, কিন্তু আজ সকালেই উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি জানি আপনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু না করে উপায় ছিলো না। আপনি কি একটু থানায় আসতে পারবেন?”

শ্রাবণের কথায় চুপ করে গেলো উমা। লোকটিকে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে বারংবার ঝংকার তুলছে। লোকটিকে তিনদিন পূর্বে দেখতে গিয়েছিলো সে। ডাক্তার জানিয়েছিলো অবস্থা ভালো নেই, অন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে তার জ্ঞান ফিরছিলো না। ডাক্তারের ধারণা তিনি কোমায় চলে গিয়েছে। উমার জোড় করার কারণেই রুদ্র পুলিশে একটা রিপোর্ট লিখিয়েছিলো। লোকটির গত রাতে জ্ঞান ফিরেছিলো, সে কথা বলার চেষ্টা করছিলো। অথচ আজ সকাল থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতারাতি কোথায় চলে যেতে পারে সে। শ্রাবণের কন্ঠে উমার স্বম্বিত ফিরে, সে নিজেকে সামলে কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি সকালে থানায় এসে দেখা করে যাবো”
“ধন্যবাদ, এই অবস্থায় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী”
“না না, সমস্যা নেই। আপনি উনার পরিবারের খোঁজ পেয়েছেন?”
“জ্বী, খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উনি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। থাকেন শিবপুরের কাছাকাছি। লোকটি বিগত আটমাস থেকে গায়েব। পরিবারের লোক সদর থানায় কমপ্লেইন তো করেছে কিন্তু কাজ হয় নি। পুলিশ গা ছাড়া দিয়েছে। উনার স্ত্রী, বাচ্চা ঢাকা থাকে। লোকটির খোঁজ না পেয়ে স্ত্রী আসেন। ছয়মাস খোঁজ না পাওয়ায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। অথচ সেই কিছুদিন পূর্বে আপনার গাড়ির সামনে এসে পড়েছে। উনাকে কারা বেঁধে রেখেছিলো। কি উদ্দেশ্য জানা নেই। আমি তো সব কিছু রুদ্র সাহেবকে জানিয়েছিলাম, উনার সাথে আমার ফোনেও কথা হয়েছিলো”

উমা শ্রাবণের কথায় অবাক হয়। কারণ রুদ্র এমন কোনো কথাই তাকে জানায় নি। বরং উমা নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলেও সে চেপে গিয়েছে। উমা অবাক কন্ঠে বলে,
“উনি আমায় কিছু জানান নি”
“হয়তো আপনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে আপনাকে বলেন নি। আমি আজ উনাকেই ফোন করতাম। কিন্তু উনার ফোন বন্ধ তাই আপনাকে ফোন করেছি”
“হতে পারে, উনি আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করেন কি না। আচ্ছা আমি রাখছি। আগামীকাল দেখা হবে। আমার সাধ্যমত আপনাদের সাহায্য করবো।”

ফোনটি রেখে দেয় উমা। তার শরীরটা ভালো লাগছে না। লোকটির নিখোঁজ শুনেই মাথাটা ঝিম ধরে গিয়েছে। এককাপ চা হলে মন্দ হতো না। চায়ের মিনুকে হাক দেয় উমা। মিনু ছুটে আসে। ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“ফুলির মাকে একটু চা দিতে বলো তো মিনু”
“দুধ তো পুড়ে গেছে। এখন খালারে কইলে উনি আমারে দাবরাইবো”
“চা করতে দুধ লাগে কে বলেছে তোমায়। রঙ চা বলেও কিছু আছে সেটা কি জানা আছে?”

মিনু ঘাড় কাত করে। উমা তখন বলে,
“যাও, এক কাপ রঙ চা আদা আর লং দিয়ে দিতে বলো। আজ রাজী এসেছে?”
“না ছুটো দিদিমনি এখনো আয় নাই”
“আয় নাই কি? বলো আসে নি”
“আসে নি”

বাধ্য মেয়ের মতো উমার কথা আওড়ায় মিনু। উমা স্মিত হেসে বলে,
“আচ্ছা শোনো। চা টা দিতে বলে আবার আমার রুমে আসবে। মাথাটা দপদপ করছে তেল দিয়ে দিবে। পারবে?”
“জ্বে পারবো।”
“যাও, তবে”

মিনু চলে গেলে ঘড়ির দিকে চোখ দেয় উমা। রাজশ্বীর জন্যও চিন্তা হয় খুব, মেয়েটা রাত করে বাড়ি ফিরে। সে নাকি দুটো ছাত্র পড়ায়। পড়ানোতে আপত্তি নেই উমার। কিন্তু সময়টা তো দেখবে। এখন দিত ভালো না। এই কিছুদিন পূর্বে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হলো। ধরনী কল্যান সংগঠন থেকে আন্দোলন ও করেছে শিউলীরা। উমার শরীর ভালো নেই বলে শিউলী তাকে বাড়িতেই থাকতে বলেছে। তাদের আন্দোলনে পুলিশ একটু নড়ে চড়ে উঠেছে। আজকাল ধর্ষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আইন গা ছাড়া দিচ্ছে। মাঝ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেয়ের পিতামাতা। এটাই সমাজের কঠোর চিত্র। যা আমরা চাইলেও বদলাতে পারছি না। কারণ চাওয়ার পরিমাণটা খুব স্বল্প। আর বিকৃত মানসিকতার মানুষের পরিমাণ কল্পনাতীত।

রাজশ্বী ফিরলো সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ, রাজশ্বীর সাথে সাথে রুদ্র ও ঘরে প্রবেশ করলো। রাজশ্বীকে দেখে রুদ্র জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“তুমি এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে?”

রুদ্রের প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাজশ্বী। কাঁপা স্বরে বলে,
“আসলে আজ সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না। প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন ছাত্রীর পড়ানো শুরু করেছি তো”

রাজশ্বীর দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্র। ললাটে ঘাম জমেছে। কন্ঠ কাঁপছে। রুদ্র আন্দাজ করতে পারছে রাজশ্বী কিছু লুকাচ্ছে। মেয়েটির মুখখানা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। রুদ্র তখন নিজেকে স্বাভাবিক করে ধীর স্বরে বলে,
“দিদি জানে?”
“না, আজ বাঁচিয়ে দিয়েন জামাইবাবু। আর হবে না। মায়ের দিব্বি”
“বেশ, তাহলে যে ঘুষ দিতে হয়”
“কেমন?”
“দিদি থেকে বাঁচালে আমাকে সত্যিটা জানাবে এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে! আমি মিথ্যে ধরতে পারি, আর যাদের মিথ্যে বলার অভ্যেস নেই তাদের মিথ্যে সহজে ধরে ফেলি”

রাজশ্বী জমে যায় রুদ্রের শীতল কন্ঠে বলা কথায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
“ঠিক আছে”

রুদ্র এবার প্রসারিত হাসি আকে ঠোঁটে তারপর একত্রে বাড়িতে প্রবেশ করে। উমা তখন বসার ঘরে পেপারের পাতা উল্টাচ্ছিলো। রাজশ্বীকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“কটা বাজে?”

উমার গম্ভীর কন্ঠে রাজশ্বী শুকনো ঢোক গেলে। উমা যতই ভাই বোনকে ভালোবাসুক না কেনো বড্ড শাসনে রাখে তাদের। এবং মিথ্যে তার মোটেই পছন্দ হয় না। রাজশ্বী এই সাংবাদিকতার কাজটি শুরু করেছে উমার কাছ থেকে লুকিয়ে। উমাকে বললে হয়তো দ্বিমত করতো না। কিন্তু সাহস করে উঠে নি রাজশ্বী। কারণ পেশাটি খুব ই ভয়ংকর এবং ঝুকিপূর্ণ। বাবার মৃত্যুর পর উমা তার কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই উমার কাছ থেকে লুকিয়েই বিগত চারমাস যাবৎ কাজ করেছে রাজশ্বী। কিন্তু আর হয়তো লুকানো সম্ভব হবে না। রাজশ্বী কিছু বলার পূর্বে রুদ্র বলে উঠে,
“আমার সাথে ছিলো, আমি একটু কেনাকাটা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার এই অবস্থায় তোমাকে বের করাটা ভালো দেখায় না। তাই ওকে নিয়ে বের হলাম।”

উমা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালে রুদ্র তার হাতে রাখা ব্যাগটি এগিয়ে দেয়। উমা সেটি খুলতে একটি সুন্দর লাল পাড়ের শাড়ি দেখতে পায়। উমা রুদ্রের পানে প্রশ্নোবোধক দৃষ্টিতে তাকালে সে বলে,
“কি হলো? আমি বউ এর জন্য শাড়ি কিনতে পারি না?”

উমা রাজশ্বীর উদ্দেশ্যে বলে,
“যাও উপরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে নাও। চা পাঠাচ্ছি”

রাজশ্বী ঘাড় কাত করে উপরে চলে যায়। উমা শাড়ীটি সোফায় রেখে রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনার ফোন বন্ধ কেনো?”
“বন্ধ নাকি?”
“হ্যা, শ্রাবণ বাবু ফোন করেছিলেন। বন্ধ পেয়েছেন। আমিও ফোন করেছিলাম। পাই আপনাকে। আপনি বন্ধ করে রাখেন নি?”

উমার প্রশ্নে রুদ্র তার পকেটে হাত দেয়। কিন্তু ফোনটি পায় না। রুদ্রের কপালে ভাঁজ পড়ে, চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“আমার ফোন বোধ হয় চুরি গেছে।”
“সে কি কথা? চুরি যাবে কিভাবে?”

রুদ্র তখন বিরবির করে বলে,
“আমি বোধহয় ওখানে রেখে এসেছি”
“কোথায় রেখে এসেছেন?”
“একটা পার্টির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। হয়তো ওখানেই রেখে এসেছি। যাক গে, কাল নতুন একটা মোবাইল কিনে নিবো। শ্রাবণ কি বলছিলো?”
“ওই যে লোকটি, যে আমাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছিলো। উনি সকাল থেকে নিঁখোজ। কাল আমাদের থানায় যেতে হবে।”

উমার কথা শুনে রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি যাবো ক্ষন”
“কিন্তু”
“আমার ক্ষুধা লেগেছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি”

বলেই রুদ্র ভেতরে চলে যায়। উমা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না। রুদ্রের এরুপ বিরুপ আচারণে অবাক হয় উমা। রুদ্রের এতোটা এড়িয়ে যাবার কারণ বুঝে উঠে না সে। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় তার। কিন্তু উমা প্রশ্নগুলোকে পাত্তা দেয় না। শাড়িটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

তিনদিন পর,
শাশ্বতের মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহমুদ সরদার। তার ভারী মুখখানা শুকিয়ে রয়েছে। সে যাতাকলে পিসছে তা বুঝতে বাকি রইলো না শাশ্বতের। শাশ্বত তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন লিখেছে। যা তুমুল ঝড় তুলেছে। শাশ্বতের সাথে সাথে অন্যান্য সাংবাদিকরাও প্রতিবেদন লিখেছে। শাশ্বত চাপের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমাকে ডেকেছেন অথচ চুপ করে বসে আছেন, সরদার বাবু আমার তো সময়ের দাম আছে নাকি”
“আমার খবরটা ধামা চাপা দেবার কি উপায় নেই?”
“উপায় বলেছিলাম আপনি রাজী হন নি, বলি তো নিজেই হচ্ছেন”
“উত্তম বাবুকে আমি খুন করি নি”
“জানি, কিন্তু তার খুনের পেছনে কে ছিলো সেটাও তো বলছেন না।”
“বললে আমাকে জ্যান্ত রাখবে না।”

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে মাহমুদ সরদার। সরদারের ভয় দেখে শাশ্বত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কে? কে জ্যান্ত রাখবে না?”

সরদার আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনার মামা অভিনব সিংহ রায়………

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৬তম_পর্ব

শাশ্বতের মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহমুদ সরদার। তার ভারী মুখখানা শুকিয়ে রয়েছে। সে যাতাকলে পিসছে তা বুঝতে বাকি রইলো না শাশ্বতের। শাশ্বত তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন লিখেছে। যা তুমুল ঝড় তুলেছে। শাশ্বতের সাথে সাথে অন্যান্য সাংবাদিকরাও প্রতিবেদন লিখেছে। শাশ্বত চাপের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমাকে ডেকেছেন অথচ চুপ করে বসে আছেন, সরদার বাবু আমার তো সময়ের দাম আছে নাকি”
“আমার খবরটা ধামা চাপা দেবার কি উপায় নেই?”
“উপায় বলেছিলাম আপনি রাজী হন নি, বলি তো নিজেই হচ্ছেন”
“উত্তম বাবুকে আমি খুন করি নি”
“জানি, কিন্তু তার খুনের পেছনে কে ছিলো সেটাও তো বলছেন না।”
“বললে আমাকে জ্যান্ত রাখবে না।”

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে মাহমুদ সরদার। সরদারের ভয় দেখে শাশ্বত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কে? কে জ্যান্ত রাখবে না?”

সরদার আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনার মামা অভিনব সিংহ রায়, সব কিছুর কলকাঠি সেই নাড়ে। তার লোকেরা আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে। যদি আমি মুখ খুলি আমাকেও মেরে ফেলবে।”

মাহমুদ সরদারের ভয়ার্ত স্বীকারোক্তি শুনে অবিশ্বাসের কালো বাদল জড়ো হয় শাশ্বতের মনে। মস্তিষ্ক রীতিমতো ফাঁকা হয়ে যায়। দৃষ্টি সংকুচিত হয় দ্বিধার মায়াজালে। মাহমুদ সরদারের কথাগুলো যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার মামা ক্ষমতালোভী, কালোকারবারিতে পটু; কিন্তু খুনী হতে পারে না। শাশ্বত মুখশ্রী খিচিয়ে বললো,
“কাউকে বাঁচানোর জন্য অন্যের উপর দোষ দেওয়াটা বুঝি অভ্যেসে পরিণত হয়েছে?”
“আমি জানতাম বিশ্বাস বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই সত্যি, আপনার মামাই সবকিছুর মূলে। সেই খুন করেছে আপনার বাবাকে, কারণ আপনার মামার সকল বেআইনি কাজের প্রমাণ ছিলো আপনার বাবার কাছে। সে ফাঁস করে দিতো তার সকল রহস্য”

সালটি ১৯৭৮,
স্বাধীনতার সাত বছর পার হয়েছে। সাতক্ষীরার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় অন্যায়ের বীজ বুনেছে গভীরভাবে। নানা অস্ত্র, মাদকদ্রব্য বেআইনি পথে মায়ানমার এবং ভারত থেকে পাচার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বেনাপোলের বর্ডার এবং মংলা থেকে, কাস্টমস ও নিজের পকেট পুরে মুখ বন্ধ রাখছে। কালীগঞ্জ থানায় তখন নতুন অসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত উত্তম চ্যাটার্জির আন্ডারে নতুন একটি কেস আসলো। মাদকদ্রব্যের ব্যাবহার বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। অপরদিকে দশ পনেরো বছরের ছেলেদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে বেআইনি অস্ত্র, যার কোনো লাইসেন্স নেই। উত্তম চ্যাটার্জির ধারণা একটা র‍্যাকেট এই কাজ করছে। যদি এই র‍্যাকেটটাকে ধরতে পারা যেতো তাহলে তাদের মূল হর্তাকর্তারাও চলে আসতো হাতের ভেতর। সে সূক্ষ্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিলো। ধীরে ধীরে তার পরিকল্পনা সফল ও হচ্ছিলো। গোপনীয় মিশনে খুব চতুরতার সাথে সে মাহমুদ সরদারকে ধরে ফেলেন, মাহমুদ সরদারের দায়িত্ব ছিলো এসব পাচার কৃত দ্রব্য কাস্টমস থেকে ছোটানো। যা পরবর্তীতে রুদ্র করতো। মাহমুদ সরদারকে পুলিশ কাস্টেডিতে রাখা হয় সাত দিন, রিমান্ডে তার উপর প্রচুর মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার করা হয়। অবশেষে সে তার র‍্যাকেটের সব কিছু বলে উত্তম বাবুকে। তারা ভারত থেকে আসা পেয়াজ, ফল, চালের বস্তায় নানাধরণের মাদকদ্রব্য যেমন ফেন্সিডিল, গাজা, মদ, এবং হেরোইন পাচার করতো। সাথে কিছু বেআইনি অস্ত্র ও। অভিনব সিংহের কাজ ছিলো তার লোক দিয়ে জিনিসগুলো পাচার করে দিতো রাজধানীতে। একগ্রাম গাঁজার দাম ছিলো ১০ টাকা। ফলে তাদের লাভ হতো প্রচুর। অভিনব সিংহের ব্যাবসা বাহিরে থেকে চাল ডালের বড় দোকান। কিন্তু তার চালের আরোদে ভেতর এই গুলো লুকিয়ে রাখতো এই পাচারকৃত দ্রব্য। চালের বস্তা যখন দেশের নানা অঞ্চলে যেতো এই মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও পাঁচার হতো। উত্তম চ্যাটার্জির প্রথমে বিশ্বাস হয় নি তার শ্যালক এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে। কিন্তু প্রমান হাতে আসার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজ হাতে অভিনব সিংহকে গ্রেফতার করবেন। এদিকে মাহমুদ ধরা পড়ার পর সতর্ক হয়ে যায় অভিনব সিংহ। সে নিজ থেকে যোগাযোগ করে উত্তম বাবুর সাথে। উত্তম বাবুকে দমানোর জন্য বলে,
“দেখো উত্তম, আত্নীয়ের মাঝে এমন ভুলবোঝাবুঝি রাখতে নেই। আরে লুটে খায় তো সবাই, আমি না হয় একটু বেশি লুটছি। এতে এতো অবাক হবার কিছু নেই। আর আমি কিন্তু একা খাই না, অনেক বড় বড় নেতা গোতারাও এই অংশ পায়। তাই ভালোর জন্য বলছি চেপে যাও। প্রতিমাসে ভাগ চলে যাবে। শাশ্বত ছোট, এই পুলিশের চাকরি তে ক টাকা পাও দেখে?”
“উঠুন, উঠে দাঁড়ান”

রোষানলে কাঁপছে উত্তমবাবুর শরীর৷ সে হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমার চোখের সামনে থেকে বেড়িয়ে যাবেন। আপনার ওয়ারেন্ট বের হবার পর আমি নিজ হাতে আপনাকে হাতকড়া পড়াবো। ততদিন মন্ত্র যপুন, যম এলো বলে দোয়ারে”

অভিনব সিংহ অবিচল, ভয়ের এক চিলতে রেখাও দেখা গেলো না তার মুখে। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“ভালো করলে না উত্তম।”
“সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না”

সেই রাতেই বাড়ি ফেবার সময় এক দল মানুষ উঠিয়ে নিয়ে যায় উত্তম বাবুকে। গলা কেটে ফেলে আসে রেলস্টেশনে। উত্তম বাবুর মৃত্যু তদন্ত করে নতুন অসি। সে মোটা টাকা খায় অভিনব সিংহের কাছে। টাকার লোভে তার চোখ চকচক করে উঠে। তাই সে মুখ বন্ধ করে নেয়। এদিকে, বিধবা বোনকে নিজ ঘরে ঠায় দেয় অভিনব সিংহ। মালিনী জানতো তার দাদার চরিত্র। কিন্তু শাশ্বতের জন্য নিজের মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয় লেগেছে তার। নিজের ছেলের প্রাণ বাঁচাতে দাদা যেভাবে বলেছে সেটাই মেনে নেয় সে।

মাহমুদ সরদার সামনে থাকা জল ঢক ঢক করে পান করে। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। শাশ্বত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে এতো সময় পর অনুভব করলো তার গাল ভিজে এসেছে। চোখ ঝা ঝা করছে। মামার এমন কালো সত্যি মানতে বুক চিরে আসছে। এই লোকটিকে পিতৃতুল্য ভেবেছিলো সে। সম্মান করেছে মন দিয়ে। কিন্তু আজ তাকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে সব জেনেও কিছু করতে পারবে না। ত্রিশ বছর পূর্বের সত্যিটা সে চাইলেও প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু অভিনব সিংহকে ছেড়ে দিবে না সে। কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে সে। শাশ্বত উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদ সরদার তার হাত আকড়ে আকুল আবেদন করলো,
“আমাকে বাঁচান, শাশ্বত বাবু। প্লিজ আমাকে বাঁচান।”

শাশ্বত এক রাশ ঘৃণা নিয়ে রুঢ় হাসি হাসে। স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে,
“দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করুন, আপনার আযরাইল আর আমার যম আসলো বলে”

শাশ্বত কথা শুনে কলিজা শুকিয়ে আসে সরদারের। কপালে ভয়ের দরুন ঘাম জমতে লাগে। শাশ্বত এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না। বেড়িয়ে যায় সরদারের অফিস থেকে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখে আগুনের ফুলকি জ্বল জ্বল করছে। পারলে এখনি অসুর বধ করতো সে। কিন্তু আইনের কাছে বাঁধা। আইনি খেলা আইনের মাধ্যমেই রফা দফা করবে সে। এতোকাল মামাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে শুধু। কিন্তু আর নয় এবার মামা চিরতরে শেষ করার পালা। সে ক্ষমতার লোভে তার পিতাকে সে হত্যা করেছে। সেই ক্ষমতা কেড়ে নিবে সে, জেলের কালকুঠুরির ভেতর পঁচে মারবে অভিনব সিংহ কে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শাশ্বত___________

উমার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। উঠে বসতে গা গুলিয়ে এলো। ছুটলো স্নানঘরে। স্নানঘরে যাবার শব্দে রুদ্রের ও ঘুম ভেঙ্গে গেলো, তার দৃষ্টি গেলো ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাটা পাঁচটার ঘরে এসে ঠেকেছে। রুদ্র শালটা নিয়ে স্নানঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। উমা মুখটা ধুয়ে বের হয়ে রুদ্র গামছাটা এগিয়ে দিলো। তারপর উমাকে শাল দিয়ে ঘিরে দিলো। উমা লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম কি?”
“তুমি কষ্ট করবে আর আমি বেঘুরে ঘুমাবো তা কি হয়!”

বলে ধরে ধরে বসায় উমাকে। রুদ্র হাটু গেড়ে নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার ছোট বউটির দিকে।তার ষোড়শী এখন আর ষোড়শী নেই। একজন পূর্ণ নারী। কিছুদিন বাদে একজন সন্তানের মা হবে সে। সন্তান জন্ম দেওয়া কতোটা কঠিন তা উমার চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বমি করার দরুন চোখগুলো বসে গেছে উমার। খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। ঘুমটাও গত ল্রাতে ভালো হয় নি। উমার কোমড় জড়িয়ে ধীর স্বরে বলে,
“আমার উপর কখনো রাগ হয় না তোমার?”
“কেনো বলুন তো?”
“এই যে! আমি তোমাকে সময় নিতে পারি না, ব্যাস্ত থাকি নিজেকে নিয়ে। তোমার যত্ন নেই না।”

উমা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য যথেষ্ট। ভালোই তো আছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

রুদ্র জড়িয়ে ধরে উমাকে। গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো উমার ভেতরটা। তখন রুদ্র ধীর স্বরে বলে,
“তোমার এই উষ্ণ হৃদয়টা কখনো শীতল হবে না তো?”

রুদ্রের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় উমা। কিছু বলা আগেই………

চলবে।