মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-২০

0
581

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লেখা- ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২০
.
পৃথুলার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অভ্র হাত বাড়িয়ে স্বযত্নে পৃথুলার চোখ মুছে দিল। পৃথুলার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। পৃথুলার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। তারপর বলল,
“পৃথা, তোমাকে শক্ত হতে হবে। এই যে লোকেরা তোমাকে বাজে কথা বলতো আর তুমি চুপচাপ শুনে যেতে, মন খারাপ করতে, কাঁদতে, এতেই তারা তোমাকে পেয়ে বসেছে। আমাদের সমাজে মনামী আন্টির মত মুখোশধারী মানুষ অসংখ্য আছে, যারা প্রতিনিয়ত মুখরোচক টপিক খুঁজে বেড়ায় যেটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা যায়। অথচ তাদের নিজেদের চরিত্রই নোংরামিতে ভরপুর। এদের মুখের উপর জবাব দিয়ে দিতে হয় পৃথা। এদের কথা চুপচাপ হজম করা মানে এদের আশকারা দেওয়া। আগে যা হবার হয়েছে৷ কিন্তু এখন থেকে তুমি নিজেই নিজের জন্য লড়বে। নিজেকে গড়ে তোলো পৃথা। নিজের পায়ের তলার মাটিটাকে শক্ত করো। কেউ কিছু বললে তাকে পালটা জবাব দিতে শিখো। লোকে যখন দেখবে তুমি তোমার জায়গায় শক্ত আছো, তোমাকে কাবু করা সহজ না। তখন সবাই চুপ হয়ে যাবে। তোমাকে কিছু বলার সাহসও পাবে না৷ তুমি মাথা নিচু করে নয়, মাথা উঁচু করে বাঁচবে। বি স্ট্রং পৃথা, বি স্ট্রং।”

পৃথুলা চুপটি করে অভ্রর বলা কথাগুলো শুনলো। অভ্র পৃথুলার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,
“নিজেকে কখনো একা ভাববে না। জেনে রাখো, পুরো পৃথিবী উল্টেপাল্টে গেলেও আমি কখনোই তোমার হাত ছাড়ব না। তোমার পাশে সবসময় আছি, থাকব। বুঝেছো?”
পৃথুলা উপর নিচ মাথা নাড়ালো। অভ্র বলল,
“এনিওয়ে, রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো।”
বলে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল অভ্র৷

পৃথুলা বসে রইল। পৃথুলাকে বসে থাকতে দেখে অভ্র জিজ্ঞেস করল,
“বসে আছো কেন? ঘুমাবে না?”
পৃথুলার হঠাৎ কি হলো কে জানে! বলল,
“আমি আপনার বুকে মাথাটা রাখতে পারি?”
অভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো পৃথুলার দিকে। কথাটা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো অভ্রর। বুঝতে পেরে মৃদৃ হেসে হাত বাড়িয়ে পৃথুলাকে টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। আলতো করে পৃথুলার মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
“সব কিছুতে অনুমতি নিতে হয় পাগলি? এখানটায় তো কেবল তোমারই জায়গা। তুমি বুঝো না?”

পৃথুলা কিছু বলল না। গুটিশুটি মেরে রইল অভ্রর বুকে। অভ্র বলল,
“তুমি খুব সহজ সরল পৃথা। সবাই তোমার মত হলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো।”
প্রত্যুত্তরে পৃথুলা বলল,
“আর আপনি অনেক ভালো আর উদার মনের মানুষ৷ সবাই আপনার মত হলে পৃথিবীতে পৃথুলাদের সংখ্যা খুবই নগন্য থাকতো।”
অভ্র কিছু বলল না। কেবল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল পৃথুলাকে। এই মুহূর্তে পৃথুলার কাছে অভ্রর বুকটাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তি এবং নিরাপদ স্থান। আচ্ছা, বিধাতা আরো আগে কেন পাঠালো না অভ্রকে তার জীবনে?

উৎস বিছানায় শুয়ে ফেসবুকিং করছিল। হঠাৎ ‘প্রত্যাশা ইসলাম’ নামে একটা ফ্রেণ্ডরিকুয়েস্ট এলো তার আইডিতে। উৎস প্রফাইলে ঢুকে ঝটকা খেল। এতো পৃথুলার বোন প্রত্যাশা! প্রফাইল পিকচারে প্রত্যাশার নেভি ব্লু কালার শাড়ি পরিহিত একটা ছবি দেওয়া। প্রত্যাশা তাকে ফ্রেণ্ডরিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে! একটু অবাকই হলো উৎস। দ্রুত রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে মেসেজ দিল,
“মাই গড! এতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।”
প্রত্যাশা তখন অনলাইনেই ছিল। সে লিখল,
“কেন?”
“এইযে তুমি আমাকে ফ্রেণ্ডরিকুয়েস্ট পাঠিয়েছো!”
“কেন পাঠাতে পারি না? আসলে আপনাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম মনে হচ্ছে ততটা খারাপ আপনি না।”
“আচ্ছা? কটকটি আজ অন্য সুরে গাইছে। ব্যাপারটা কি?”
প্রত্যাশা কয়েকটা রাগি ইমুজি দিয়ে বলল,
“ফাজলামো করলে সোজা ব্লকলিস্টে পাঠিয়ে দেব।”
“এই না না।”
“থ্যাংকস!”
“কেন?”
“আজ আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি আপনাদের ব্যবহারে৷ আপি অভ্র ভাইয়াকে সবটা জানানোর পরেও অভ্র ভাইয়া যখন আপিকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে, তখন ভেবেছি অভ্র ভাইয়ার মত এত ভালো মানুষ কিভাবে হয়! আজ বুঝলাম, যার পুরো পরিবারটাই এত ভালো সেখানে অভ্র ভাইয়া তো ভালো হবেই। আমি তো ভেবেছিলাম আপনারা কেউই আপিকে মেনে নেবেন না। কিন্তু…. সত্যিই আপনাদের মত মানুষ হয় না।”
“শোনো প্রত্যাশা, আমাদের সোসাইটিতে এমন অসংখ্য ছেলে মেয়ে আছে যারা বিয়ের আগেই নিজ ইচ্ছায় ভার্জিনিটি হারায়। অথচ তাদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আর একটা মেয়ে রেপড হলে কিছু বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন মানুষ মেয়েটাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু করে দেয়। মনামী আন্টিও তাদের মধ্যে একজন৷ যার নিজের চরিত্রের ঠিক নেই সে অন্যকে নিয়ে নোংরা কথা বলে। আর এ ধরণের মানুষ হলো সমাজের কীট৷ এরা অসহায় মেয়েদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাদের নিয়ে মজা উড়ায়। আমরা যদি আজ ভাবির সাথে অন্যায় করতাম, ভাবিকে মেনে না নিতাম তাহলে এসব মনুষ্যত্বহীন মানুষদের সাথে আমাদের পার্থক্য থাকতো কোথায়? ভাবি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। কোনো পাপ তো সে করেনি।”

প্রত্যাশা মুগ্ধ উৎস’র কথায়। এ ধরণের মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই আজও পৃথিবীটা এত সুন্দর। প্রত্যাশা লিখল,
“আজ থেকে আমরা বন্ধু। ওকে?”
“আমি যখন তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলাম তখন তুমি নাকচ করেছো। হিসেব মতো আমারও এখন নাকচ করে দেওয়া উচিত। কি বলো?”
প্রত্যাশা আবার কয়েকটা রাগের ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,
“আপনার ঢং নিয়া আপনি থাকেন। দরকার নাই আপনার সাথে বন্ধুত্ব করার।”
উৎস কয়েকটা হাসির ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,
“ওকে, লেট’স ফ্রেণ্ডস।”

দিনকয়েক পর অভ্র পৃথুলাকে নিয়ে শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। চার বছর আগে এই কলেজেই পড়ত ও৷ ফার্স্ট টার্ম দেওয়ার পরই ওর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অভ্র প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে চার বছরের বেতন পরিশোধ করে দেয়। পৃথুলার পড়াশুনা আবার শুরু হয়। সে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশুনা শুরু করেছে। তাকে ডাক্তার হতে হবে। তার লক্ষ্য পূরণ করতেই হবে।

পৃথুলার বাবা মা টের পায়, তাদের মেয়ে আবার আগের মত স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মিইয়ে যাওয়া পৃথুলা হঠাৎ করেই আবার প্রাণবন্ত হচ্ছে।
অভ্রর জন্যই যে পৃথুলার এহেন পরিবর্তন, এটা বুঝতে বাকি নেই আনিসুল ইসলাম ও মাহিমা বেগমের।
.
পৃথুলা অর্থির রুমে উঁকি দিয়ে দেখল অর্থি মোবাইল চাপছে। মেয়েটার পরিক্ষা চলছে আর সে বসে বসে মোবাইল চাপছে। পুরাই ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে।

“কি করছে আমাদের অর্থি ম্যাডাম?”
অর্থি চমকে দরজার দিকে তাকাল। পৃথুলাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মোবাইলটা রেখে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে স্টাডি টেবিলে গিয়ে বসল।

পৃথুলা হেসে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“পড়ায় ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, তাই না?”
অর্থি জোরপূর্বক হেসে বলল,
“তুমি তো আমার লক্ষী ভাবি। প্লিজ বড় ভাইয়াকে কিছু বলো না।”
“সে না হয় বললাম না। কিন্তু তুমি যে পড়া বাদ দিয়ে মোবাইলে সময় কাটাচ্ছ সেটা কি ঠিক? এতে তো রেজাল্ট খারাপ হবে।”
অর্থি মন খারাপ করে বলল,
“সারাক্ষন পড়তে আমার ভালো লাগে না। খালি পড়া আর পড়া। বড় ভাইয়াটা পারলে চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখে। ধ্যাৎ।”
পৃথুলা হেসে বলল,
“তোমার বড় ভাইয়া পড়াশুনার ব্যাপারে আমাকে ছাড় দেয়? পারলে আমাকেও সারাক্ষন বইয়ের সামনে বসিয়ে রাখে। যাহোক, পড়ায় ফাঁকি দিও না। আর তো ক’টা দিন। পরিক্ষা শেষে তো তুমি একদম ফ্রি হয়ে যাবে। অন্তত এই কয়টা দিন ফাঁকি দিও না৷ নয়তো রেজাল্ট খারাপ হবে।”
অর্থি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা তুমি পড়ো। আমি গেলাম।”

পৃথুলা যেতে নিয়ে আবার অর্থির দিকে ফিরল।
“অর্থি!”
“হুম?”
“আচ্ছা, অভ্রর প্রিয় খাবার কি?”
অর্থি একটু ভেবে বলল,
“বড় ভাইয়ার বিশেষ কোনো প্রিয় খাবার নেই। তবে হ্যাঁ, ভাইয়া মাটন বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। পড়ো তুমি।”

পৃথুলা অর্থির রুম থেকে বেরিয়ে সোজা কিচেনে ঢুকে পড়ল। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে কাজে লেগে পড়ল। শুরু করল ‘মাটন বিরিয়ানি মিশন’।
.
চলবে___