#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৩
.
এরপর কেটে গেল কয়েকটা মাস। বাহ্যিক দিক দিয়ে পৃথুলার আচরণ অভ্রর প্রতি একই রকম আছে৷ কিন্তু মনের দিক দিয়ে পৃথুলা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে অভ্রর মাঝে। হয়তো পুরোপুরিই ডুবে গেছে।
সময় গড়িয়েছে, উৎস আর প্রত্যাশার বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হয়েছে। ওদের কথোপকথন ম্যাসেঞ্জার থেকে মুঠোফোনে এসেছে। উৎস প্রত্যাশার সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চাইতে আরেক ধাপ এগোতে চাইছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। এই একটা দিকে উৎস ভীষণ কাঁচা।
“পৃথুলা, তাড়াতাড়ি নাশতা করে রেডী হয়ে নাও। আমি অফিসে যাবার পথে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।”
নাশতা করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল অভ্র।
উৎস ব্রেড চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাবে ভাবি?”
“বাসায় যাব একটু।”
“তোমাদের বাসায়?”
“হুম।”
“ফিরবে কবে?”
“বিকেলেই চলে আসব।”
“বিকেলেই? এতটুকু সময়ের জন্য যাবে কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?”
“নাহ, সে রকম কিছু না৷ আসলে প্রত্যাশার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে। মা বলল, আমাকেও সেখানে থাকতে।”
উৎস’র হাত থেকে পাউরুটিটা পড়ে গেল। বিষ্মিত গলায় বলল,
“প্রত্যাশার বিয়ে?”
“হ্যাঁ। বিয়ে ঠিক হয়েছে আরো আগেই। আজ বড়রা কথাবার্তা বলে ডেইট ফিক্সড করবে।”
উৎস’র মাথায় অদৃশ্য বাজ পড়ল। বিয়ে আরো আগেই ঠিক হয়েছে অথচ প্রত্যাশা তাকে কিছুই বলল না। উৎস’র রাগে শরীর কাঁপছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহন করে নিজের বেড রুমে চলে গেল। পেছন থেকে পৃথুলা, আঞ্জুমান উৎসকে ডাকল। উৎস তাতে কর্ণপাত করল না৷
রুমে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করল প্রত্যাশার নাম্বারে। বারকয়েক রিং বাজার পর ফোন রিসিভ করল প্রত্যাশা।
“হ্যালো।”
উৎস কোনো ফর্মালিটির ধার ধারল না। বলল,
“হোয়াট ইজ দিজ প্রত্যাশা? কি শুরু করেছো তুমি এসব?”
“আমি আবার কি করলাম?”
“তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তুমি বলোনি কেন আমাকে?”
“জানলে কী করতে?”
“তুমি আমার কথার উত্তর দাও। প্রতিদিনই তোমার সাথে আমার কথা হয়। অথচ এই কথাটা আমাকে বলতে পারলে না?”
“এখন তো জানলে। আজকে বিয়ের ডেইট ফিক্সড হবে। আমি তোমাকে তারিখটা জানিয়ে দেব। আমার বিয়েতে দাওয়াত খেতে চলে এসো, কেমন?”
উৎস’র উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিল প্রত্যাশা। প্রত্যাশা যে রেগে আছে সেটা তার কণ্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে৷ উৎস অবাক। যেই রাগ এখন তার দেখানো উচিৎ, সেই রাগ প্রত্যাশা দেখাচ্ছে। আজব
.
“একটাই মাত্র ছেলে আমার। আমার যা কিছু আছে সবই তো ছেলেরই। আমাদের তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তবে আপনারা জামাইকে খুশী হয়ে একটা গাড়ি উপহার দিতে পারেন।”
চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন পাত্রের বাবা। আনিসুল ইসলাম আর মাহিমা বেগম একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন৷
পাশ থেকে পৃৃথুলা বলল,
“আমার বোনকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হলে আপনার ছেলেকে গাড়ি দিতে হবে?”
“আমার ছেলেকে দেবে কেন বলছো? গাড়ি তো তোমার বোনেরই থাকবে। ওই গাড়িতে তো তোমার বোনই চড়বে। আমার ছেলের যা সবই তো তোমার বোনের থাকবে।”
“মাফ করবেন। যৌতুক দিয়ে আমার বোনকে বিয়ে দেব না।”
ছেলের চাচা বললেন,
“যৌতুক কেন বলছো মা? এটা তো তোমরা উপহার দেবে জামাইকে।”
“আচ্ছা? উপহার বুঝি কেউ চেয়ে নেয়?”
জবাবে ছেলের বাবা বা চাচা কিছু বললেন না। পৃথুলা বলল,
“চা খাওয়া হয়ে গেছে?”
“হু?”
“বলছি চা টা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার আসতে পারেন। একটা গাড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ আমার বাবার আছে। কিন্তু দেবে না। বিয়ের আগেই যারা প্রত্যাশার বিনিময়ে গাড়ি চাইছে তারা বিয়ের পর আমার বোনকে কতটা সুখী রাখবে সেটা আমাদের ধারণা হয়ে গেছে।”
এরপর আনিসুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা অনুরোধ করছি, এমন একটা লোভী পরিবারের ছেলের সাথে প্রত্যাশার বিয়ে নিয়ে আর একবারও ভেবো না।”
আনিসুল ইসলাম সায় দিলেন পৃথুলার কথায়। অবশেষে গম্ভীর মুখে পৃথুলাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলের ছেলের বাবা আর চাচা।
বিকেলে প্রত্যাশার নাম্বারে ফোন দিল উৎস৷ প্রত্যাশার বিয়ে হয়ে যাবে এটা সে মানতেই পারছে না। প্রত্যাশা ওয়াশরুমে ছিল তাই শব্দ শুনতে পায়নি। পৃথুলা প্রত্যাশার রুমে ঢুকে দেখল ওর ফোন বাজছে। প্রত্যাশাকে ডেকে বলল,
“প্রত্যুষ তোর ফোন বাজছে।”
ওয়াশরুম থেকে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
“কে ফোন করেছে?”
ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। পৃথুলা ফোন হাতে নিয়ে দেখল ‘উৎস’ নাম দিয়ে সেভ করা। ভ্রু কুঁচকে নাম্বারটা দেখল। হ্যাঁ, তার দেবর উৎসই।
প্রত্যাশা তোয়ালে হাতে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পৃথুলা বলল,
“উৎস তোকে ফোন দিচ্ছে কেন?”
“তোর দেবর?”
“হুম।”
“তার সাথে তো প্রতিদিনই কথা হয়।”
পৃথুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“প্রতিদিনই?”
“হ্যাঁ, সে তো আমার বন্ধু।”
“বন্ধু! আচ্ছা যাই হোক, আজ তোর ব্যাপারে নেওয়া সিদ্ধান্তটা ভুল নেইনি তো?”
প্রত্যাশা বুঝল পৃথুলা কিসের কথা বলছে৷ সে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“না আপি। তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস।”
তৎক্ষণাৎ প্রত্যাশার ফোনটা আবার বেজে উঠল।
“এতবার ফোন দিচ্ছে কেন? দেখ তো কি বলে।”
পৃথুলা ফোনটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রত্যাশা ফোন রিসিভ করেই বলল,
“বিয়ের দাওয়াত নেওয়ার জন্য ফোন করেছো?”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ফাজলামি রাখো।”
তারপর নরম গলায় বলল,
“প্রত্যাশা বিয়েটা কি করতেই হবে? না করলে হয় না?”
“নাহ। করতেই হবে। না করার কারণ আছে কি?”
উৎস জবাব দিল না। প্রত্যাশা বলল,
“চুপ কেন? বলো।”
“আই লাভ ইউ প্রত্যাশা।”
এতদিনেও যে কথাটা বলতে পারল না সেটা আজ এক মুহুর্তেই বলে দিল। প্রত্যাশা টের পাচ্ছে, তার মনজুড়ে অদ্ভুত একটা ভালোলাগা দোল খেয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
“বুদ্ধু, এই কথাটা বলতে এত সময় লেগেছে! আগে বলতে পারোনি?”
“প্লিজ বিয়েটা করো না। আমি পাগল হয়ে যাব।”
প্রত্যাশা হেসে বলল,
“বিয়েটা হচ্ছে না।”
উৎস’র চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বলল,
“কিহ! সত্যি?”
“হুম। বিয়ে হবে না। তোমার দাওয়াত খাওয়ার ইচ্ছেও পূরণ হলো না৷ আহারে!”
“আ’ম সো হ্যাপী প্রত্যাশা।”
“বুঝেছি। আচ্ছা এখন রাখছি। পরে ফোন দেব।”
পৃথুলা এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল প্রত্যাশার দিকে৷ ফোন রাখতেই প্রশ্ন করল,
“তোদের মধ্যে কি চলছে বল তো?”
প্রত্যাশা ইতস্তত করে বলল,
“আসলে আপি, আমি উৎসকে পছন্দ করি।”
পৃথুলা বড় বড় চোখ করে তাকালো প্রত্যাশার দিকে৷
“কিহ? তুই তো আমাকে বলিস নি কখনো!”
“আরেহ, আমরা কি রিলেশনশীপে ছিলাম নাকি যে তোকে জানাব৷ তাছাড়া, আমি উৎসকে পছন্দ করতাম। উৎস আমাকে পছন্দ করে সেটাও জানতাম। কিন্তু বলদটা এতদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি।”
পৃথুলা অবাক হয়ে বলল,
“উৎসকে যেহেতু পছন্দ করিস তাহলে বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী হলি কেন?”
“বাবার মুখের উপর না করে দিলে বাবাকে কষ্ট দেওয়া হতো। বাবা এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে রাজী হয়েছি। তাছাড়া, উৎস তো এতদিন কিছু বলেনি। তবে আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম বিয়েটা যেন কোনোভাবে আটকে যায়। তাই হলো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আচ্ছা বাদ দে, চা খাবি?”
পৃথুলা বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“খাওয়া যায়।”
“একটু বস, আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
দু কাপ চা নিয়ে খোশ গল্পে মেতে উঠল দুই বোন। কথার মাঝে অভ্রর প্রসঙ্গ চলে আসল৷ প্রত্যাশা বলল,
“আচ্ছা আপি, একটা সত্যি কথা বলবি?”
“কী কথা?”
“তোর আর অভ্র ভাইয়ার সম্পর্কটা স্বাভাবিক তো?”
“হুম। কেন?”
“এমনি। আসলে তোদের মধ্যে কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব। তাই মনে প্রশ্ন জাগলো।”
.
চলবে___