ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩০+৩১

0
741

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ৩০
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
ভয়াবহ নিস্তব্ধতা গ্রাস করে আছে৷ পিনপতন নীরবতা ঠেলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আবেশ৷ মাধুর্যকে একহাতে টেনে নিয়ে বলল,

‘ কিছু হয় নি৷ শরীর দূর্বল থাকার জন্য সিড়ি থেকে পড়ে গেছেন উনি৷’

‘ জ্ঞান ফিরেছে? ‘ মাধুর্য নিমজ্জিত কন্ঠে বলল৷ আবেশ ক্লান্তিতে চোখ বোজে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনের দেয়ালে৷ চোখ বোজে থাকা অবস্থায় উত্তর দিলো,

‘ না ফেরে নি৷ বয়স হয়েছে এইজন্য সামলাতে পারে নি৷ ঘুমের প্রয়োজন উনার৷’

‘ আচ্ছা৷’

মাধুর্য উত্তর দিয়ে চুপ করে ঠাই বসে রইলো৷ হসপিটালের করিডর নিষ্প্রাণ৷ আবেশ নিজেও চুপচাপ বসে রইলো৷ সকালে তখন চিৎকার শুনে সবাই ছুটে যায় সিড়ি ঘরের দিকে৷ গিয়ে লতা বেগমকে,নীচে রক্তে মাখা অবস্থায় পায় ৷ রক্তে ভেসে ছিলো সর্বাঙ্গ জুড়ে৷ মাথা দেয়ালের পাশে রাখা ৷ বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছেন তিনি ৷ ছাদের সিড়ি থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছেন একদম৷ ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছিলেন ৷ মাধুর্য গিয়ে তাকে ধরতেই ভেঙ্গে আসা গলায় বলেছিলেন,

‘ অ..অ’ বলেই জ্ঞানহারা হয়েছিলেন৷ মাধুর্য সেই থেকে চিন্তায় বিভোর ‘অ’ মানে কী হতে পারে ! যতোক্ষণ লতা বেগমের জ্ঞান না ফিরছে মাধুর্যের মাথায় এই শব্দটা ঘুরেফিরে বেড়াবে৷
লতা বেগমকে গাড়িতে করেই হসপিটালে নিয়ে এসেছে,আবেশ,সে,নজরুল আর ইরা। মাধুর্যের প্রচন্ড খারাপ লাগছে লতা বেগমের অবস্থা দেখে । কতোটা রক্ত বের হয়ে গেছে।
সে আরো সচেতন হবে। যতই হোক,দায়িত্ব নিয়েছে সে।

‘ মাধুর্য..’ আবেশের ক্ষীণ স্বরের ডাকে সম্বিৎ ফেরে মাধুর্যের। ছোট করে জবাব দিলো,’ হু।’ মাধুর্যের জবাবে আবেশ নির্বিঘ্নে মাথা এলিয়ে দিলো তার কাধে। ক্লান্তিকর গলায় বলল,

‘ আর অল্প কিছু দিন। এরপরেই তুমি ঢাকা চলে যাবে।’

‘ ঢাকা কেন যাবো!’ মাধুর্য প্রশ্ন করতেই আবেশ তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলল,

‘ সিলেট থেকে ঢাকা প্রতিদিন যাওয়া আসা সম্ভব না। আমি ভেবেছি তোমার এডমিশনে সিলেকশন হলে হোস্টেলের সিটের জন্য আবেদন করে রাখবো।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

মাধুর্য স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিতেই আবেশ চট করে মাথা উঠিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

‘ ঠিক আছে মানে ! তোমার খারাপ লাগবে না আমাকে মানে আমাদের ছেড়ে থাকতে।’

মাধুর্য পিটপিট চোখ করে তাকিয়ে বলল,

‘ লাগবেই তো।’

‘ সমস্যা নেই । পড়াশোনার প্রতি ফোকাস করো।ছুটি হলেই বাসায় নিয়ে আসবো। আবার খারাপ লাগা শব্দ উচ্চারণ করলে বাসায় ফিরিয়ে আনবোই না।’ আবেশ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল। মাধুর্য ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি’ই তো আগে বলেছেন।’

‘ আমি বলেছি,তোমার খারাপ লাগা বাদ দিতে হবে।’

আবেশের কথা শুনে মাধুর্য ভাবুক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করলো,আবেশ কী বলেছিলো!
আবেশের চোখে তখন বিষাদ । নিজের করে পাওয়ার থেকে দূরে চলে যাওয়াটা বিষাদের। তার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে মাধুর্যকে দেখার। কিছুদিন বাদে,মাধুর্য ভর্তি হলে চলে যাবে ঢাকা। এই কথাগুলো ভাবলেই আবেশের দম বন্ধ অনুভূতি হয়। সিলেটের সব কাজ ফেলে মাধুর্যের সাথে যাওয়ার কোনো সুযোগ তার নেই। ভেবেই গোপন দীর্ঘশ্বাসে জর্জরিত হলো তার মনের কোঠা।

_____________

ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে সর্বত্র। শুভ্র চাদরে মুড়িয়ে আছে ধরণী তল । সূর্যের উত্তাপ যেন ঘুমিয়ে আছে নিরলস ভাবে। ঠান্ডায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে মানবকুল। মাধুর্য সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। শিশির জমে আছে গাছের ডগায় ডগায়। খোলা বারান্দায় হাড় হীম করা ঠান্ডা।
তবুও যেন মাধুর্য স্বস্তি লাগছে। ঠান্ডায় জমে থাকা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করেই শিউলির সুবাসে বিমোহিত হলো মৃদু বাতাসের সাথে প্রকৃতি । লম্বা শ্বাস টেনে নিতেই পেছন থেকে একজোড়া ঠান্ডা হাত মাধুর্যের পেট স্পর্শ করলো।
কেঁপে উঠলো সে। ঠান্ডার সাথে জমে গেলো হৃৎপিন্ডের গতি।
সেই স্পর্শ গভীর হতেই মাধুর্য মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

‘ আপ..আপনার হাত ঠান্ডা।’

‘ তো!’

‘ ছাড়ুন। আমার ঠান্ডা লাগছে।’

‘ লাগুক।’

আবেশের সোজাসুজিভাব বলা কথায় ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলো মাধুর্য। তবে আবেশ তাকে ঘুরতে না দিয়ে জাপটে ধরে রেখেই বলল,

‘ কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন !’

‘ কুয়াশা শরীরে ছুঁতেই শিহরণ বয়। সারা বছর আমি শীতের অপেক্ষা করি কুয়াশা নিজের মধ্যে বিলীন করার জন্য।’ মাধুর্য উৎফুল্ল চোখে বলতেই আবেশ তার কানের কাছে কিছু একটা বলতেই থতমত খেয়ে যায় সে। লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে মুখশ্রী। তবে কন্ঠে রাগ ধরে রেখে বলল,

‘ ছিঃ! আমাকে ছাড়ুন । নির্লজ্জ লোক।’

‘ তাহলে নির্লজ্জতার প্রমাণ করেই ফেলি।’ আবেশ নিমজ্জিত কন্ঠে বলতেই শীতের মাঝে উষ্ণতা বয়ে গেলো মাধুর্যের মাঝে।
সে লজ্জায় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আবেশের স্পর্শ তার কাছে দম বন্ধকারা অনুভূতি । মনে হয় ভেতর থেকে কেউ আটকে ধরে রেখেছে। বর্তমানের অবস্থা আরো শোচনীয় । আবেশ তার থুঁতনি ঠেকিয়েছে তার কাঁধে। মাধুর্য দম খিঁচে বলল,

‘ কো..চিং..কোচিং এর সময় হয়ে গেছে।’

‘ হোক।’ আবেশ ঘোরলাগা কন্ঠে বলতেই মাধুর্স বিমূর্ত হয়ে চাদর খামচে দাঁড়িয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ আজ পরীক্ষা আছে।’

আবেশ থেমে গেলো। ভ্রুকুটি করে বলল,

‘ মিথ্যা বলছো।’

‘ মিথ্যা কেন বলবো। আপনার ওই বান্ধবী কে ফোন করে জিগ্যেস করতে পারেন,যদি বিশ্বাস না হয়।’

মাধুর্যের কথায় আবেশের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। ভ্রু বাকিয়ে বলল,

‘ বান্ধবী ! ‘

‘ হ্যাঁ,আপনার বান্ধবী এশা মানে এশা ম্যামের কাছে জিগ্যেস করতে পারেন। তার সাথে তো আপনার প্রায়শই কথা হয় সে আমাকে বলে।’

আবেশ সরু চোখে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠেই বলল,

‘ ইউ ফিল জেলাস?’

মাধুর্য উত্তর না দিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বলল,

‘ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

আবেশ মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে হাসলো। মাধুর্যের রাগ তার চোখে পড়েছে। সেই অনুভূতি দারুন। সদ্য প্রেমে,পড়া অনুভূতির ন্যায়।

কোচিং থেকে ফেরার সময় মাধুর্য দাঁড়িতে আছে রাস্তায়। তার ইচ্ছা হচ্ছে,এশা নামক মেয়েটাকে মেরে দিতে। তার বায়োলজি পরীক্ষার সময় ,পরীক্ষা হলে ঢুকে তাকে বলে গিয়েছে,আজ সন্ধ্যা সময় এহসান বাড়িতে সে যাবে।

‘যাবি ভালো কথা ! আমাকে কেন বলবি।’

এই কথাটা মাধুর্যের জিহ্বায় এসেও ফিরে গিয়েছে। আজ নাজিফার জন্মদিন উপলক্ষেই ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । মাধুর্য সেটা একটু পূর্বেই এশার মুখে থেকে শুনেছে।
তার ভেতরে কেমন অস্থির লাগছে। বাসায় অনুষ্ঠার আর তাকে কেও বলেই নি। তবে কী সে পর !
এইদিকে লতা বেগমকে আজ হসপিটাল থেকে বাসায় নেওয়ার কথা। কাল তাকে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় রেখেই মাধুর্য বাসায় চলে এসেছিলো। হসপিটালে ইরা ছিলো তাই।
তবে এখন আবেশ তাকে নিয়ে হসপিটালে যাবে দেখেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ।
দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে মাধুর্যের। বারবার হাতঘড়ি দেখছে ।
প্রায় পনেরো মিনিট পর আবেশের গাড়ি মাধুর্যের সামনে দাঁড়াতেই কয়েক পা পিছিয়ে যায় সে। গাড়ি থেকে আবেশ নামতেই খানিকটা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। মাধুর্যের রাগ করার ধরণ দেখে আবেশ মুখ ফুলিয়ে হাসলো। সেই হাসির ঝংকার মাধুর্যের কর্ণগোচর হতে মাধুর্য মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ হাসবেন না।’

মাধুর্যের ধমক শুনে আবেশ হাসি থামালো না। মাধুর্যের রাগের ধরণ অদ্ভুত। গাল ফুলিয়ে থাকবে তবে চোখ হাসবে। এই ব্যাপার টা বাচ্চাদের মতো।
আবেশ হাসি থামিয়ে কোনোমতে বলল,

‘ আচ্ছা..বাবা..আচ্ছা হাসবো না।’

মাধুর্য সেই কথা শুনেও ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টো রাস্তায় পা বাড়ালো।

চলবে..

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ৩১
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
শূন্য রাস্তা।সূর্য তার কিরণ মোলায়েম ভাবে বিলীন করছে নিয়মমাফিক। ঠান্ডার শিহরণ যেন সিলেটের প্রতিটি প্রান্তে। মাধুর্যের পেছনে যেতে গরম লাগছে আবেশের। এতো দ্রুত হাটছে ! সে ভেবে পাচ্ছে না,এতো জোর কোথা থেকে এলো মাধুর্যের। তবে অভিমানের মাত্রা যে আকাশ ছুঁয়ে আছে বেশ বুঝতে আবেশ। গায়ে জড়িয়ে থাকা ব্লেজার টা হাটতে হাটতেই খুলে হাতে নিলো সে। সাদা শার্ট লেপ্টে আছে বলিষ্ঠ দেহে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ মহারাণী,আপনার পেছনে হাটতে গিয়ে আমার দম ফুরিয়ে যাচ্ছে তো।’

‘ ফুরাক।’ আবেশের কথা পেছন থেকে মাধুর্যের কর্ণকুহরে পৌছাতেই মিনমিন করে বলল। বাড়ির সবাই নাজিফার জন্মদিনের কথা তাকে বলতে ভুলে যেতে পারে। কিন্তু আবেশ কেন ভুলবে ! তার উপর এশাকে বিকেলে নিতেও আসবে। কেন আসবে! সে মনস্থির করলো কথাই বলবে না আবেশের সাথে।
চারপাশে জন-মানবহীন। আবেশ একছুটেই মাধুর্যকে ধরে ফেলতে পারবে। তবুও,সে ধীরেই হাটছে। অভিমানী পেছনে ছুটার এক শিহরণ আছে,যা সকল প্রেমিক পুরুষ উপলব্ধি করতে পারে না। মাধুর্য রাগে ফোঁসফোঁস করছে।
আবেশ পেছন থেকেই আবার বলল,

‘ দিনশেষে আমার কাছেই তো ফিরতে হবে।’

‘ আমার ফেরার অপেক্ষা করতে হবে না কারো।এশা ম্যামে কাছে যান। তাকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে তো।’

মাধুর্য হাটার গতি থামিয়ে দিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল। শ্বাস-প্রশ্বসের গতি তীব্র হয়েছে তার। মুখ ধারণ করেছে রক্তিম বর্ণ। আবেশের ইচ্ছা হচ্ছে,সেই গালে ঝপাৎ করে একটা চুমু এঁকে দিতে। ইষৎ রাগান্বিত হয়ে আবার বলল,

‘ দেখুন,আপনি আপনার রাস্তায় যান আমাকে আমার রাস্তায় যেতে দিন।’

‘ তোমার রাস্তা তো আমার রাস্তাতেই।’

‘ শুনেন,আপনার সাথে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।আমাকে যেতে দিন।’

‘ কথা বলতে হবে না শুধু আমার পাশে থাকলেই হবে।’

আবেশ মুচকি হেসে উত্তর দিলো। মাধুর্যের ভেতর কেমন খুশির জোয়ার বইছে। শরীরে জড়িয়ে থাকা চাদর টা খুলে দিতেই হীমেল হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তাকে।
আবেশ তার থেকে কয়েকহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাসছে। মাথার ঝাঁকড়া চুল গুলো মৃদু বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। গালে থাকা চাপ দাঁড়ি যেন আবেশের ব্যক্তিত্ব দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। জোড়া ভ্রু সচারচর ছেলেদের দেখা যায় না তবে আবেশের এই ভ্রু’ই যেম মাধুর্যের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে রোধ করে দেয়। শ্যাম বর্ণের কাটা কাটা চেহারা উজ্জ্বল হয়ে আছে আবেশের সূর্যের রশ্মির দরুন। মাধুর্য থমকে তাকিয়ে আছে। নির্জন রাস্তায় তার বুকের কম্পনের মাত্রা যেন তীব্র গতিতে ছড়িয়ে ঝড় তুলছে। আবেশ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

‘ এইভাবে তাকিয়ে থেকো না রমণী,প্রেমে পড়ে যাবে।’

মাধুর্য দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। ইতস্ততভাবে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। আবেশ মাথা দুলিয়ে হাসতেই সেই দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে শাড়ি খাঁমচে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
আবেশ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মাধুর্যের দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো তার গাল। মাধুর্য পিছিয়ে যেতে চেয়েও গেলো না । শুধু অস্ফুটভাবে বলল,

‘ বাসায় যাবো।’

আবেশের সেই কথা কর্ণকুহরে পৌছালেও দুইহাতে মাধুর্যের গালে হাত রেখে তার ললাটে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

‘ কিছু রাগ ভালোবাসা বাড়ায়,কিছু অভিমান কাছে টানে। তবে দূরত্ব দুমড়ে মুচড়ে দেয়।আমি চাই আমার অভিমানিনী কে। যে রাগ করবে,অভিমান করবে তবে দিনশেষে আমার কাছেই,আমার হৃদমাঝারে আশ্রয় খুজবে।’

মাধুর্য দৃষ্টিনত করেই মাথা গুজলো আবেশের বুক পিঞ্জরের মাঝে। আবেশ আলতো হাতে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ সবাই দেখছে।’

আবেশের কথা শুনে ভরকে গেলো মাধুর্য । চটজলদি মাথা উঠিয়ে নিতেই আবেশ শক্ত করে ধরে বলল,

‘ এতো বোকা কেন তুমি ! এইভাবেই থাকো। সারা দুনিয়া দেখুক,তুমি আমার।’

মাধুর্য লজ্জায় বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই শীতের প্রকোপেও তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো। নিশীন বিভোর প্রগাঢ় অনুভূতি গ্রাস করলো। কেমন সুখকর অনুভূতি !

___________

‘ ভালো আছেন।’ মাধুর্যের প্রশ্ন শুনে উল্টোদিক ফিরে থাকা লতা বেগম তাকালো তার দিকে। চোখের নীচে গাঢ় কালীর রেখা পড়েছে। মুখে ক্লান্তি আর ভয়ের ছাপ। মাধুর্যের কথার প্রতিত্ত্যুর না করে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।
মাধুর্য বেশ অবাক হলো তার এমন ব্যবহারে। তবুও,মুখে লম্বা হাসির রেখা টেনে বলল,

‘ হসপিটালে থাকতে হবে না আর। আজকে না..না এই মুহূর্তে আমরা বাসায় ফিরে যাবো। উনি ফর্মালিটি শেষ করতে গিয়েছেন।’

মাধুর্যের উক্ত কথায় ও ভাবান্তর হলো না লতা বেগমের। ঘুরে তাকিয়ে বসে রইলো সে।
মাধুর্য অবাকচিত্তে তাকিয়ে রইলো। গত পরশু দিন ও লতা বেগম তার সাথে হেসে কথা বলেছে। তার মাথায় বিলি কেটে দিয়ে কতশত গল্প করেছে। কিন্তু আজ ! তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
মাধুর্য গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, ‘ অ।’ শব্দটি। যা লতা বেগম জ্ঞান হারানোর আগে তাকে বলতে চেয়েছিলেন।
মাধুর্য তার পাশে বসে নম্র কন্ঠে আবার বলল,

‘ আম্মা।’

মাধুর্যের ডাকে তরতর করে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়লো লতা বেগমের। তবে সে ডাক উপেক্ষা করেই বসে রইলো। মাধুর্য তার গায়ে হাত দিয়ে বলল,

‘ আমরা বাসায় ফিরবো আম্মা।’

‘ আমি কোথাও যাবো না।’

লতা বেগম কিছুটা গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে উত্তর দিলো। মাধুর্য অবাক হয়ে বলল,

‘ হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়েছে। এখানে আর থাকত্ব দিবে না। আপনার ভয় নেই আমি সব সময় আপনার সাথে থাকবো এখন থেকে।’

‘ হাসপাতালে থাকবো কে বলেছে ?’

‘ তাহলে কোথায় যাবেন।’

‘ আমার ছেলের বাড়িতে যাবো। তোমাদের বাসায় থাকতে আমার দম বন্ধ লাগে।’ লতা বেগমের সহজ স্বীকারোক্তি যেন মাধুর্যকে বেশ কষ্ট দিলো। তবুও সে,মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

‘ আমরা সবাই মিলে কালকে বেড়াতে যাবো ওখানে। তারপর আবার বাসায় ফিরে আসবো।’

‘ আমি ওই বাসায় যাবো না। তোমার যদি আমাকে দিয়ে আসতে সমস্যা হয়,তাহলে বলো আমি একাই চলে যাচ্ছি।’

‘ আপনি অসুস্থ। এই অবস্থায় আপনার একা থাকা ঠিক হবে না।’

আবেশ রুমে ঢুকে বলল। আবেশের কথা শোনে মাধুর্য উঠে দাঁড়িয়ে লতা বেগমকে বুঝাতে বলল৷ মাধুর্যের কথা শোনে লতা বেগম বললেন,

‘ চিন্তা করো না৷ আমি কিছুদিন থেকে আবার ফিরে আসবো৷’

‘ সুস্থ হয়েই না হয় যাবেন সেখানে৷’ আবেশ লতা বেগমের কথার পৃষ্ঠে বলল৷ লতা বেগম খানিক হাসলেন৷ জবাব দিলেন,

‘ বাধা দিয়ো না আবেশ৷ আমি কিছুদিন থেকে ফিরে আসবো৷ আর মাধুর্যকে দেখে রেখো৷’

বলেই উঠে দাঁড়িয়ে মাধুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ভাঙ্গার জন্য অনেকে আসবে,তবে গড়ার জন্য কেউ না৷ তাই নিজেকে নিজে গড়তে শেখো মা৷’

মাধুর্য উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইলো৷ লতা বেগম চোখের কিনারায় জমে থাকা পানিটুকু মুছে বললেন,

‘ আমাকে একটু নামিয়ে দিয়ে আসো বাড়ির সামনে৷’

‘ অবশ্যই৷ আপনি চলুন৷’ আবেশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল৷ মাধুর্যের দৃষ্টি লতা বেগমের দিকে৷ মানুষটার মায়া পড়ে গেছে সে৷ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করতে গেলেও থেমে গেলো সে৷

______________

গোধূলির রঙ ছড়াচ্ছে৷ কুয়াশাজড়ানো সুন্দর বিকেলবেলা ৷ এহসান বাড়ি কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে সেজে উঠেছে ফুল দিয়ে ৷ মাধুর্য কাওকে কিছু জিগ্যেস করছে না৷ তার মন বিষাদে আবার ছেয়ে আছে৷ লতা বেগমের চলে যাওয়া নিয়ে আর এই অনুষ্ঠানের কথা তাকে না জানানোর জন্য ৷ হসপিটাল থেকে ফিরেই সে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে বারান্দায়৷
এর মাঝে ইরা খাবারের জন্য ডেকেছিলো একবার তবুও সে যায় নি৷ অন্যসব দিন সবাই বারবার জোফ করে আজ করছে না দেখে আবারো মন খারাপের রেশ ছুটে এলো তার দিকে ৷
বাসার পেছনে বাগান সেখান থেকে কিছুটা হই-হল্লা ভেসে আসলেও সে পাত্তা দিচ্ছে না ৷
হসপিটাল থেকে আসার পর আবেশকেও তার নজরে পড়ে নি আর ৷ সে তীব্র রাগ নিয়েই বসে রইলো শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের একটা বই হাতে৷
খুদায় পেট চোঁচোঁ শব্দ করছে তবুও সে দাঁত কামড়ে বসে আছে। বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেও পারা যাচ্ছে না।বই হাতে উঠে দাঁড়ালো সে। সাথে সাথেই,নাজিফা রুমে ঢুকে তাড়াহুড়ো করে বলল,

‘ ভাবী দ্রুত আমার সাথে আসো।’

‘ কোথায় যাবো।’ মাধুর্য গম্ভীর স্বরেই বলল। নাজিফা রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘ উফফ,ভাবী লেট হয়ে যাচ্ছে।ভাইয়া রাগ করবে তো।’

মাধুর্য বই রাখতে রাখতে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার প্রচন্ড রাগ লাগছে। নাজিফার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা মেজাজেই বলল,

‘ আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা নাজিফা। তুমি যাও সবার কাছে।তোমাকে সবাই খুজছে।’

নাজিফা হিজাব ঠিক করতে করতে বলল,

‘ আমাকে কেন খুজবে।আমি তো মেইন পার্ট না অনুষ্ঠানের।’

‘ বলতে হবে না নাজিফা। আমি বুঝেছি,আর হ্যাঁ,শুভ জন্মদিন।’

মাধুর্যের কথা শুনে অবাক হলো নাজিফা। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তাদের প্ল্যান সাকসেসফুল।
আজকে যে মাধুর্য আর আবেশের হলুদ সন্ধ্যা সে সেটা জানে না ভেবে নাজিফার বেশ হাসি পেলেও মুখ চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।

চলবে..