ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩৭

0
898

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৭
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি

নিরস ধরণীর বুক ভেদ করে সূর্যালোক বিদায়ের বেলা গুটি গুটি পায়ে দ্বার প্রান্তে কড়া নাড়তেই আবেশ অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। শরীরে জড়ানো কালো ব্লেজার টা খুলে বা হাতের মাঝে ফেলে বা হাতের ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে আফসোসের শিষ তুললো। ইদানীং কালে কাজের মাত্রা বেড়েছে। সময় জ্ঞান যেন ধরা ছোঁয়ার বাহির। কাল মাধুর্য চলে যাবে তাকে আজকের দিনটা দেওয়াটা বড্ড প্রয়োজন থাকলেও কাজ যেন পিছু ছাড়ছে না।
মনের কোটরে খানিক মন খারাপের মেঘের জমা হলো। যতোই সে বুঝাক সে মাধুর্যের অনুপস্থিতে ভালো আছে। তবে সে জানে খুব ভালো করে তার না থাকাটা ভীষণ ভাবে উপলব্ধি করে। শূন্যের দিকে মুখমণ্ডল তাক করে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিয়ৎ হাসি ফুঁটিয়ে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলল,

‘ আমার ছোট মাধবীলতা আরেকটা বাচ্চার আবদার করে। ভাবা যায় ! সে কতোটা বড় হয়ে উঠেছে।’

_____________

অন্ধকারাবৃত রুমের এককোণে টেবিল ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোয় বইয়ের প্রতিটা অক্ষরে নজর বুলালেও পড়ার ছিটেফোঁটাও মনোযোগ আনতে পারলো না মাধুর্য। মনের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছে,আবেশ বাসায় ফেরার পর নিশ্চয় রাগারাগি করেছে। উক্ত কথা ভাবতেই লজ্জা আর ভয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো সে। আবেশকে প্রেরণ করা সেই বার্তাটার রেশ ধরেই সে এখন হলে।
ভাগ্যিস ফয়েজ বাসায় ছিলো। না’হলে কী’করে আসতো সে ঢাকায়। উক্ত বার্তার পর মাধুর্যের মাঝে হাজারো লজ্জা ভ্রমরের মতো উড়ে এসে বসেছে। আবেশের সামনে দাঁড়ানোর অবস্থায় সে নেই। ইশ ! কী ভাবে পারলো সে ওমন ছেলেমানুষি করতে।

‘ আমি তো ভেবেছিলাম আজ ফিরবি না তুই।’

প্রভাতীর কথায় মুখ ঘুরিয়ে তাকালো মাধুর্য। খানিক হাসির রেখা টেনে বলল,

‘ অনেক দিন ছিলাম আর ভালো লাগছিলো না।’

প্রভাতী ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জোরে জোরে হেসে উঠলো। প্রভাতীর হাসি শুনে খানিক চমকে উঠলো মাধুর্য। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ভাবলো,প্রভাতীও কি তার বোকামোর কথা জেনে গেলো। পরমূহুর্তেই নিজেকেই নিজে শাসিয়ে বলল,’কাম অন মাধুর্য। প্রভাতী জানবে কি করে।’

‘ তা বাচ্চাকাচ্চা কবে আমায় আন্টি ডাকবে মাধুর্য?’

প্রভাতীর কথা শুনে খানিক মিইয়ে গেলো মাধুর্য। পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলো খানিক সময়। প্রভাতী এখনো হেসেই চলেছে। হাসতে হাসতেই বলল,

‘ রাত একটা তোমার বর মহাশয় হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রেমিকের ন্যায়।’

প্রভাতীর কথায় অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাধুর্য। প্রভাতী হাই তুলতে তুলতে বলল,

‘ তোর বর তো হেব্বি রোম্যান্টিক। হোস্টেল সুপারের সাথে তুলকালাম কান্ড করে স্পেশাল পার্মিশন নিয়ে নীচে রোমিও হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’

‘ সিলেট থেকে ঢাকা উনাকে কে আসতে বলেছে। পাগল হয়ে গেছে না’কী।’

‘ হ্যাঁ তোর প্রেমে।’

প্রভাতী বলে আবারো হাসলো। মাধুর্য রাগ্বানীত নয়নে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে নীচে ছুটে গেলো।

সম্পূর্ণ ব্যস্ত নগরী খানিকটা ঝিমিয়ে আছে। থেকে থেকে কয়েকটা গাড়ি হাই স্পিডে ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। ল্যাম্পপোস্টের আলো সম্পূর্ণ রাস্তা আলোকিত করে রেখেছে। হলদে আলোর নীচে গুটি কয়েক নাম না জানা পোকা উড়োউড়ি করছে। ঝিঁঝিঁ ডাক ব্যস্ত নগরীতে খুব একটা শোনা না গেলেও কোথাও কোনো গাছ থেকে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ভেসে আসছে। ক্লান্ত শরীর গাড়ির উপর এলিয়ে দিয়ে নির্বাকচিত্তে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আবেশ। হোস্টেলের টিমটিমে হলদে বাতির নিভু নিভু প্রত্যেকটা কদম স্থির দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।
মাধুর্যের সাহসের তারিফ কর‍তে হয়। তাকে না জানিয়ে হলে চলে আসার সাহস কোথা থেকে জোগাড় করেছে সে !
বাসায় ফিরে তাকে না দেখে কতোটা উদাসীন হয়ে উঠেছিল সে জানে? রাগে আবেশের মাথার রগ দপদপ করছে। গাড়িতে হেলে থাকা অবস্থাতেই আধবোজা চোখে রইলো সে।
মাধুর্য গেটের দারোয়ানের সাথে বাকবিতণ্ডা করে বেরিয়ে আসলো। ফাঁকা রাস্তা ধরে ভয়ে ভয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে খানিকটা রাগ প্রকাশ পেলো নিজের প্রতি। প্রভাতী নিশ্চয় তাকে বোকা বানিয়ে মজা নিচ্ছে। ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ডানদিকের মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের নীভু আলোয় সাদা শার্টে গাড়ির উপর হেলে থাকা আবেশকে দেখে চিনতে ভুল হলো না তার।
ক্লান্তি ছেয়ে আছে মুখমণ্ডলে। উষ্কখুষ্ক চুল গুলো কপালে ছেয়ে আছে নির্বিঘ্নে। হাতের কালো বেল্টের ঘড়িটা সযত্নে মালিকের হাতের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাধুর্য চোখ ফিরিয়ে খানিকটা ভীতু পায়েই এগিয়ে গেলো। আবেশের রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা রয়েছে তার। আবেশ তাকে বকবে এখানে বিন্দুমাত্র ভুল নেই।
ধীরগতিতে এগিয়ে যেতেই আবেশ আধবোজা চোখেই বলল,

‘ আমার শার্টের বোতাম খুলে দে তো।’

আবেশের মুখে ‘তুই’ শুনে আরেকদফা ভয়ে মুচড়ে গেলো মাধুর্য। আজ আর তার রক্ষা নেই।
তবুও সে নম্র পায়ে এগিয়ে কাঁপা হাতে বোতাম খুলতে থাকে আবেশ তখনো চোখ বোজেই আছে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ কার অনুমতি নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিস তুই।’

‘ আম্মু…মা..মা।’ মাধুর্যের ভয় মিশ্রিত কম্পিত কন্ঠধ্বনি যেন চারদিক ঘুরে বারবার বাজতে লাগলো। অর্ধচন্দ্র আকাশের ঠিক মাঝে রয়েছে। আবেশ একদম চুপ হয়ে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। খানিকবাদে মাধুর্যকে ধমকের স্বরে বলল,

‘ আমার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়া।’

আবেশের উক্ত কথা যেন মাধুর্যের সমস্ত ইন্দ্রিয় অবশ করার ক্ষমতা রাখে। একদলা কষ্ট গলার কাছে এসে আটকে রইলো তার। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। আবেশ আবারো হুমকি,দিয়ে সেই কথা বলতে মাধুর্য শক্ত করে আবেশকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিয়ে বলল,

‘ আমাকে দূরে ঠেলে কেন দিচ্ছো। আমি লজ্জা পেয়ে চলে এসেছি। তাই বলে এমন ভাবে বলবে তুমি।’

‘ লজ্জা কেন পেয়েছিস।’

‘ ওইযে তোমাকে টেক্সট দিয়ে বলেছি,আমার বাবু চাই।’

‘ চেয়েছিস ঠিক আছে। তবে সেটার জন্য তো আমায় সুযোগ দিতে হবে। সুযোগ না দিয়েই লজ্জায় পালিয়ে আসলে হবে কি ভাবে বাবু।’

আবেশ হাসি দমিয়ে বলল। মাধুর্য কান্নারত অবস্থাতেই বলল,

‘ আমার লজ্জা লাগে বুঝো না কেন।’

‘ লজ্জা ভাঙ্গাতে আমি আছি তো।’

আবেশের কথা শুনে মাধুর্যের কান্না থেমে গেলো। আবেশের কাছে থেকে সরে আসতে গেলেই আবেশ মাধুর্যকে টেনে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ বাবু চাই তাই না তোমার!’

‘ না.না.. ভুলে বলে ফেলেছি।’ মাধুর্যের ভয়ার্ত বাণী। আবেশ সশব্দে হেসে উঠলো।মাধুর্য লজ্জা চোখ নামিয়ে আবেশের বুকেই মুখ গুজে দাঁড়িয়ে রইলো।

পূর্ণিমা চাদের ন্যায় আলো না থাকলেও আবছা আলোয় স্নান করাচ্ছে চাঁদ প্রকৃতিকে। মৃদুমন্দ বাতাসের গুন গুন আওয়াজে মুখরিত চারিপাশ। মাধুর্যের হাতে হাত রেখে ঘাসের উপর বসে আছে আবেশ পাশে মাধুর্য। আজ সিলেট ফেরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই বলেই ঢাকার অদূরে ফাঁকা স্থানে মাধুর্যকে নিয়ে চন্দ্রবিলাস করার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে চলে এসেছে সে।
মাঠ প্রান্তরে বসে আছে দুইজনে। আবেশ ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ তোমার ভয়,লজ্জা আমার সামনেই প্রকাশ পাবে তবুও আজকের মতো ভুল কখনো করবে না।’

মাধুর্য উত্তরে কিছু বলল না। সে বুঝতে পারে নি তাই চলে এসেছিলো। আবেশ আবার বলল,

‘ তোমাকে এক মুহূর্ত না দেখে আজ বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিলো। এ যেন দম বদ্ধকর অবস্থা।’

‘ আর কখনো হবে না এমন।’

মাধুর্যের কন্ঠে আশ্বাসের আভাস। আবেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলল,

‘ একটা সত্যি শুনবে মাধুর্য !’

মাধুর্য উঠে বসে সরাসরি তাকালো আবেশের মুখের দিকে। আবেশ নিজেও উঠে বসে বলল,

‘ যদি জানতে পারো তোমার একটা বোন আছে। এবং সে তোমার নিজের আপন বোন।’

চলবে….