তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-২০+২১

0
2207

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে অন্য কারো বুকে দেখে অভ্রের নিজের রাগকে সংযত করা বড্ড কঠিন লাগছে। যতই হোক মেহেভীন তার স্ত্রী ছিলো,একদিন মেহেভীনও ত এইভাবে ভয় পেলে জড়িয়ে তাকে ধরতো,কিন্তু আজ মেহেভীন অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছে, তা মেনে নিতে পারছে না অভ্র। মেহেভীন ঠিক কাকে জড়িয়ে ধরে আছে তা বুঝতে পারছে না অভ্র। কেননা আরহামের মুখটা অন্যদিকে ঘুড়ানো বলে, অভ্র আরহামের মুখ দেখতে ব্যর্থ। অভ্র গাড়ি থেকে বেড়োতে নিলে,তার ফোন হঠাৎ বেজে উঠে। অভ্র ফোনে তাকিয়ে দেখে তার মায়ের ফোন। সে ফোনটা কাটতে নিলে, অভ্রের মা পুনরায় ফোন করে তার ছেলেকে। বাধ্য হয়ে অভ্র তার মায়ের ফোন ধরার সাথে সাথেই, অভ্রের মা নিজের কন্ঠে কাঠিন্য নিয়ে এসে বলে, ‘অভ্র তুমি কোথায়? ‘
অভ্র মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘একটা জরুরী কাজে এসেছি। ‘

‘যেখানেই থেকে থাকো না। এখুনি ফিরে এসো বাড়িতে। ‘

‘কিন্তু মা। ‘

‘আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইনা অভ্র। বাড়িতে অনেক কান্ড ঘটে গেছে। এখুনি তুমি আসবে বাড়িতে। ‘

কথাটি বলার সাথে সাথেই ইশরা বেগম কলটা কেটে দিলেন। অভ্র বুঝতে পারছে না তার মা হঠাৎ এইভাবে তাকে ফোন করলো কেন? বাড়িতে হঠাৎ কি এমন হলো? অভ্রের মেহেভীনের কাছে যেতে ইচ্ছে হলেও, সে তা পারলো না। সে গাড়ি ঘুড়িয়ে নিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। অভ্র চলে যেতেই, মেহেভীন তৎক্ষনাক আরহামকে ছেড়ে দিলো। বাইরের দিকে একপলক তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো। আরহাম এই রহস্য হাসির মানে বুঝতে না পেরে বললো,

‘ হে আর ইউ ওকে নাও?’

‘ইয়াহ। ‘

আরহাম খেয়াল করে দেখলো তার ঘড়িটা মেহেভীনের ওড়নার সাথে বেজে গেছে। আরহাম মেহেভীনের দিকে এগিয়ে, নিজের ঘড়ি খুলতে লাগলো। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকিয়ে আছে।আরহাম কাছে আসলেই,মেহেভীনের বুকের ভিতরটা জোড়ে জোড়ে কেঁপে উঠে। আচ্ছা সে যখন আরহামকে জড়িয়ে ধরেছিলো, তখন আরহামের অনুভুতি কেমন ছিলো? অবশ্যই খুবই নরমালভাবে ব্যাপারটা নিয়েছে আরহাম,কিন্তু মেহেভীনের হঠাৎ এইরকম অদ্ভুদ অনুভুতি কেন হয়?

‘ কি এতো ভাবছো? ‘

শান্ত কন্ঠে প্রশ্নে করে বসে আরহাম।

‘অনুভুতি অদ্ভুদ এক জিনিস আরহাম সাহেব। হুটহাট চলে আসে। কিন্তু এই অনুভুতিগুলো যে বড্ড ভয়ংকর।আস্তে আস্তে আমাদের সর্বনাশের দিকে ধাবিত করে।’

আরহাম মুচকি হেসে মেহেভীনের দিকে আরেকটু এগিয়ে মেহেভীনের সিট বেলটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে বললো,

‘অনুভুতিগুলো সর্বদা সুন্দর হয়। ভূল মানুষের প্রতি অনুভুতি আসলে, তা ভয়ংকরে পরিনত হয় কিন্তু সঠিক মানুষের জন্যে মনের কুঠিরে অনুভুতি জমা হলে, তা আমাদের সুখের রাজ্যে নিয়ে যায়।’

আরহাম কথাটি বলেই গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দেয়। মেহেভীন কথাগুলো আপনমনে বিরবির করতে থাকে। এই লোকটার প্রতিটা কথাই অত্যন্ত যুক্তিগত।লোকটা এতো কথা পায় কোথায়? লোকটাকী কারো প্রতি মন হারিয়েছে? কার প্রতি? কে সেই সৌভাগ্যবতী? যে নিজের দায়িত্বপালনের জন্যে, অচেনা মেয়েটাকে এতোটা আগলে রাখে,সে তার প্রেয়সীকে ঠিক কতটা আগলে রাখবে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই, মেহেভীন ভার্সিটি পৌঁছে যায়।

________

অভ্র বাড়িতে ঢুকতেই দেখে বাড়ির পরিবেশ কেমন নিষ্চুপ রয়েছে। অভ্রের মা সোফার এক কোনে বসে আছে। মায়রা মাঝখানে বসে আছে। হাতে তার রিপোর্ট। অভ্র বুঝলো মায়রা ডক্টরের চেম্বার থেকে এসেছে নিজের রিপোর্ট নিয়ে। ছেলেকে দেখেই, অভ্রের মা উঠে দাড়িয়ে বললেন,

‘অভ্র এসেছিস? ‘

‘কি হয়েছে মা? তোমরা এতো নিষ্চুপ যে। আমাকেই বা এতো তাড়াহুড়ো কর ডাকলে কেন? ‘

অভ্রের মা মায়রার দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আমি বলবো নাকি তুমি বলবে? ‘

মায়রার নামক রমনীর মুখশ্রীতে একরাশ লজ্জামিশ্রিত এসে ধরা দিয়েছে। অভ্রের মা মুচকি হেসে বলে, ‘বেশ আমি এখন উপরে যাই। তুমিই বরং অভ্রকে বলে দাও।’

অভ্রের মা উপরে চলে গেলেন। অভ্র মায়রার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘কি হয়েছে মায়রা? মা কি বলে গেলো? রিপোর্টেই বা কি এসেছে?’

মায়রা কিছু বললো না। অভ্রের বুকে নিজের মাথা রেখে,একপ্রকার ঝাপটে ধরলো অভ্রকে। তারপর লজ্জামাখা কন্ঠে বললো,

‘আমরা বাবা-মা হতে চলেছি অভ্র। আমার গর্ভে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠছে। যদিও প্রথমে খবরটি পেয়ে, আমার খারাপ লেগেছিলো। এখনি মা হতে চাইনি আমি।তবুও আমি যে মা হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করতে চলেছি এইটাই অনেক আমার জন্যে। ‘

[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
অভ্র কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কানে শুধু বেজে চলেছে সে বাবা হতে চলেছে। অভ্রের জায়গায় অন্য কেউ হলে, খুশিতে পাগল হয়ে যেত হয়তো মায়রাকে কোলে তুলে ঘুড়ত, কিন্তু কেন যেন অভ্র বাকিদের মতো বাবা হওয়ার সংবাদ পেয়ে, খুশি হতে পারলো না। অভ্র কোনরুপ পতিক্রিয়া না করে নিজের ঘরে চলে গেলো। অভ্রের থেকে এইরকম অস্বাভাবিক আচরন একদমই আশা করেনি মায়রা।
সে তো ভেবেছিলো, বাবা হওয়ার খবর শুনে, অভ্র ঠিক তাকে আগের মতো ভালোবাসবে। তাহলে মায়রার অনাগত সন্তান ও কি মায়রা ও অভ্রের মাঝের দূরত্বের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ?

______

আরহাম অফিসে এখনো। মেহেভীন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ অভ্রকে সে দেখেছিলো, সে বুঝতে পারছিলো অভ্র তার উপর নজর রাখছে। তাই সে ইচ্ছে করেই আরহামকে জড়িয়ে ধরিয়ে রেখেছিলো, যেন অভ্র ভূল বুঝে মেহেভীনের সাথে আর যেন যোগযোগ করার চেস্টা না করে। মেহেভীন চাইনা অভ্রের আর কোন ছায়া তার এবং তার সন্তানের জীবনে পড়ুক,কিন্তু মেহেভীন অভ্রের চোখে একপ্রকার রাগ ক্ষোভ দেখতে পেয়েছে। মেহেভীনকে অন্য কারো বুকে দেখতে পেয়ে অভ্রেরও কেন যেন বড্ড খারাপ লাগছিলো। মেহেভীন তা বুঝতে পেরে,আপনমনেই বড্ড আনন্দ পেয়েছিলো। কেননা মেহেভীনও একসময় এই পরিস্হিতিটাকে সহ্য করেছিলো, যখন অভ্রের বুকে মায়রা ছিলো। ঘরে আরিয়ানের উপস্হিতি টের পেয়ে, মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে বলে, ‘ আরিয়ান তুই? ‘

আরিয়ান একটা ব্যাগ মেহেভীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ দেখ তো কেমন হয়েছে? ‘

মেহেভীন প্যাকেটটা খুলে দেখে তাতে তাঁতের সাদা রংয়ের একটি সাদা শাড়ি। শাড়িটা বেশ সুন্দর সিম্পলের মধ্যে অন্যরকম সৌন্দর্য রয়েছে, তা হলো শাড়িটা একেবারে ধপধপে সাদা তার মধ্যে হাল্কা নীল রং। মেহেভীন আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ শাড়িটা হঠাৎ কিসের জন্যে? ‘

‘কালকে তোর ভার্সিটির একটা ফাংশন আছে না? রংয়ের উৎসব। রং নিয়ে সবাই নিজেদের রঙ্গিন করে তুলবে। তোর তো কোন শাড়ি নেই তাই ভাবলাম এই শাড়িটা তোকে কিনে দেই।’

‘ এইসবের কি দরকার ছিলো? শাড়িটাও অনেক সুন্দর। তোর চুজ কবে থেকে সুন্দর হলো এতো? ‘

‘আমি না ভাইয়া করেছে চুজ। আমি তো অন্যটা চুজ করেছিলাম। কিন্তু ভাইয়া বললো এইটাতেও তোকে মানাবে। ‘

মেহেভীন অবাক হয়ে বললো, ‘উনি করেছেন মানে?’

আরিয়ান তোতলিয়ে বলে, ‘না মানে তুই তো জানিস আমি একদম কিছু চুজ করতে পারি না। তাই ভাইয়াকে নিয়ে চুজ করতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ‘

মেহেভীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তু্ই যখন নিয়ে আছিস আমি অবশ্যই পড়বো কিন্তু অইসব রং খেলতে পারবো না। ‘

আরিয়ান উঠে বলে, ‘কেন? তুই তো আগে রং খেলতে ভালোবাসতি। ‘

মেহেভীন শুকনো হাসি দিয়ে বললো, ‘আগে আর এখনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যার জীবনটাই রংহীন হয়ে গিয়েছে। যার জীবনকে অতীতের কালো রং গ্রাস করে ফেলেছে,তাকে রং খেলায় মানায় না। ‘

আরিয়ান চুপ হয়ে যায়।

সকালে মেহেভীনকে আরিয়ান ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। আজকে মেহেভীনের সাথে আরহাম আসেনি। আরহামের নাকি অফিসে আজকে অনেক কাজের চাপ। মেহেভীনকে আজকে আরহামের পছন্দ করে দেওয়া শাড়িতে বড্ড মোহনীয় লাগছে। মেহেভীনের হলুদ ফর্সা গায়ের রংয়ে শাড়িটা বড্ড মানিয়েছে। মেহেভীন শাড়ির সাথে মেচিং করে মাথায় হিজাব পড়েছে। আরহামের মা মেহেভীনকে দেখেই কাজল দিয়ে দিয়েছেন, যেন মেহেভীনের নজর লেগে না যায়। আরিয়ানও মেহেভীনের প্রশংসা করেছিলো,কিন্তুআরহাম কোনরুপ পতিক্রিয়া করেনি। সে শুধু নিজের ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে মনোযোগ দিয়ে রেখেছিলো, এতে যেন মনটা ক্ষুন্ন হয়েছিলো মেহেভীনের, কিন্তু কেন কে জানে?

মেহেভীন ভার্সিটি ঢুকেই দেখে ইতিমধ্যে রংখেলা শুরু হয়ে গেছে। মেহেভীন একটা কোনায় গিয়ে শুধু দাড়িয়ে থাকে। তখনি একজন ছোট্ট বাচ্ছা কাদতে কাদতে মেহেভীনের কাছে এসে বলে,

‘আন্টি আন্টি। আমার বলটা না পড়ে গেছে। ‘

‘কোথায় পড়ে গেছে সোনা? ‘

ছেলেটি স্টোর রুমের দিকে ইশারা করে বলে,

‘অইযে ওই রুমটায়। ‘

‘আচ্ছা তুমি বসো। আমি আসছি। ‘

মেহেভীন স্টোর রুমের সামনে গিয়ে দেখে বলটা দরজায় পড়ে আছে। মেহেভীন ঝুঁকতেই, কেউ মেহেভীনকে টেনে ধরে স্টোর রুমে নিয়ে যায়। মেহেভীন কিছু বুঝে উঠার আগেই, অচেনা যুবকটি দরজাটা আটকিয়ে দিয়ে, মেহেভীনের চোখ বেঁধে দেয়। মেহেভীন চিল্লিয়ে বলে উঠে,

‘কে কে আপনি? ‘

সঙ্গে সঙ্গে অচেনা যুবকটি মেহেভীনের ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে নেশাক্ত কন্ঠে বলে,

‘কোন কথা নয়। একদম চুপ করে থাকবে। ‘

যুবকটির কন্ঠের নেশাক্তের প্রখরতা এতোটাই ছিলো যে, মেহেভীন জমে বরফ হয়ে গেলো। কন্ঠটা সে চিনতে গিয়েও ঠিক কার কন্ঠ বুঝে উঠতে পারছে না।
যুবকটা মেহেভীনের কোমর আলতো করে চেপে ধরে। কেপে উঠে মেহেভীন। ছুটাছুটির চেস্টা করতে গেলে,তাতে বাঁধ সাঁধে যুবক। পুনরায় গলাতে নেশাক্ত সুর এনে বলে,

‘বড্স ছটফটে তুমি। এতো ছটফট করলে, আমি যা করতে এসেছিলাম। তা করতে পারবো না। আজ তুমি চাইলেও পালাতে পারবে না তুমি প্রেয়সী। তোমার রংহীন জীবনকে আমার এক মুঠো ভালোবাসার রং দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিতে চলে এসেছি আমি। ‘

মেহেভীন……….

চলবে ইনশা-আল্লাহ 💖

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-২১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
নিজেরগালে কারো গালের স্পর্শ পেতেই,মেহেভীন জমে বরফ হয়ে যায়। তার প্রতিটা শীরায় শীরায় বয়ে যাচ্ছে অস্হীরতা। এতোটা গভীর স্পর্শ অজানা যুবকটির। যুবকটি নিজের গালে রং মাখিয়ে, মেহেভীনের গালের সাথে নিজের গালের স্পর্শ করিয়ে, মেহেভীনকে নিজের ভালোবাসার রংয়ের রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে। যুবকটি নীচে বসে পড়ে। মেহেভীন স্হীর দাঁড়িয়ে থাকে। যুবকটি মেহেভীনের পায়ে লাল রংটা লাগিয়ে দিয়ে, পায়ে আলতো করে চুমু খায়। মেহেভীন নিজের শাড়িটা খামচে ধরে। মেহেভীন এতোটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে যে, চিৎকারটুকুও তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। যুবকটি উঠে দাড়িয়ে মেহেভীনের চোখের বাঁধন খুলে দেয়। মেহেভীন চোখ খুলে তাকায়।

_______

আরিয়ান নিজের চেম্বারে বসে আছে। আজকে অনেক রোগির চাপ। একজনের পর একজন চলেই আসছে। আরিয়ান একটা ব্রেড মুখে নিতে নিলে, কেউ বলে উঠে,

‘মে আই কামিন।’

আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখের ব্রেডটা রেখে দিলো। আজকে আর তার খাওয়াটা হলো না। আরিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

‘ ইয়েস কাম। ‘

সঙ্গে সঙ্গে একটি থ্রি পিচ পরিহিতা রমনী চেম্বারে প্রবেশ করলো। তাকে দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আরিয়ান। গোলা-গাল চেহারা। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। মাথা ঝুটি করে রেখেছে। মুখটায় কিছুটা বাচ্ছাদের ছাপ রয়েছে। মেয়েটা আরিয়ানের সামনের চেয়ারটা বসে বললো,,

‘কি হলো মিঃ ডক্টর? এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন? ‘

মেয়েটার কথায় ঘোর ভাঙ্গলো আরিয়ানের। মেয়েটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে কলেজে পড়ুয়া মেয়ে হবে। বয়স যতটুকু বুঝা যায় ১৭-১৮ হবে। আরিয়ান কিছুটা ভাব নিয়ে বললো,

‘ আমি যার তার দিকে তাকাই না হুহ। আমার দিকে মেয়েরা তাকিয়ে থাকে। কলেজের ক্রাশ বয় ছিলাম আমি।’

মেয়েটা নিজের চশমটা ঠিক করে বললো,
‘ আমি তো স্পষ্ট দেখলাম। আপনি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন। মিথ্যে বলছেন কেন? একজন ছেলের একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখলে তার চোখ অটোমেটিক আটকে যাবে। এই বিষয়টা নরমাল। শুধু শুধু মিথ্যে বলে, নিজের পাপের বোঁঝা ভারি করছেন কেন? ‘

আরিয়ান ভরকে গেলো। মেয়েটা যথেষ্ট বকবক করে্। মেয়েটাকে দেখলে সরল-সোজা মেয়ে মনে হলেও, মেয়েটা ততটা সরল নয়। মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী।একেবারে অতি চালাক যাকে বলে।

আরিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো, ‘নিজেকে কী আপনি সুন্দর মনে করেন? ‘

‘অবশ্যই আমি সুন্দরী। আমি স্বরং আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছে। আমার আল্লাহর সৃষ্টি কখনোই কুৎসিত হতে পারে। অন্যরা আমাকে সুন্দর মনে করুক কিংবা না করুক।আমি জানি আমি অত্যন্ত সুন্দর। আমার সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি সৃষ্টি অত্যন্ত নিপুন এবং সুন্দর।
তাই আমি মনে করি আমি সত্যি খুবই সুন্দর। কেননা আমাকে আমার রব সৃষ্টি করেছে। ‘

মেয়েটার কথা শুনে মুচকি হাঁসলো আরিয়ান। মেয়েটার প্রতিটা কথায় নিজের করা যুক্তি দিয়ে, অপরজনকে খুব সহজেই অন্যের মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। মেয়েটা আরিয়ানের হাসির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ এইযে দেখুন আপনার হাসিটাও কত সুন্দর। আমার রবের সৃষ্টি আপনি বুঝেছেন তাই এতো সুন্দর। ‘

আরিয়ান নিজের হাসি থামিয়ে দিলো।

‘ আরে হাসি থামালেন কেন? আরেকটু হাসুন। বেশ লাগছিলো। ‘
আরিয়ান কথাকে ঘুড়িয়ে বললো,

‘ আপনি এখন আমার কাছে কিসের জন্যে এসেছেন তা জানতে পারে কি? ‘

মেয়েটি কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিমায় বললো, ‘আসলে আমি মানুষটা সুন্দর, কিন্তু মাথায় প্রচন্ড গবর ভরা।
পড়া কিছুতেই মাথায় ঢুকে না। টানা তিনবার ফেল করেছি,এইবার করলে বাবা আমাকে বিয়ে দিবে। আমি আবার এখুনি বিয়ে করতে চাইনা। এখনো আমার পুরো পাড়া জুড়ে সবার শান্তির ঘুম হারাম করতে হবে। এখুনি বিয়ে করে ফেললে, সবার ঘুম হারাম করবো কীভাবে। ‘
তাই বলছি কি এমন কোন চিকিৎসা নেই যাতে আমার মাথাটা একেবারে ঝাকাঝাক হয়ে যায়। ‘

মেয়েটার এমন অদ্ভুদ কথাতে আরিয়ান চুপ হয়ে যায়। তার ধআরিয়ান বিড়বির করে বলে, ‘এই মেয়েকে বিয়ে করবে যে বিয়ে করবে, সে নিশ্চিত স্বইচ্ছায় নিজের জন্যে কবর কুড়বে। ‘

‘কি বললেন? ‘

‘না মানে কিছু না। আপনার নামটা জানতে পারি? ‘

‘ফারিয়া তাবাসসুম। এইবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ‘

‘ আপনার নাম্বার টা দিন। ‘

‘ অ্যা? ‘

‘হ্যা নাম্বার দিন। আপনার যা জটিল রোগ যাতে
চিকিৎসা করার জন্যে আপনার ফোন নাম্বারটাই প্রয়োজন। ‘

‘অদ্ভুদ লোক আপনি মশাই। চিকিৎসা করার জন্যে নাম্বার লাগে? ‘

‘ডক্টর কে আমি নাকি আপনি? ‘

‘জ্বী আপনি। ‘

‘অতএব আমি এখন যা বলছি তাই করুন। ‘

ফারিয়া তার নাম্বার টা দিয়ে, মুখ বেকিয়ে চলে গেলো। ফারিয়া চলে যেতেই,আরিয়ান আরেকদফা হেসে উঠে। তার মাথায় হঠাৎ করেই একটা শয়তানী বুদ্ধি চলে আসলো। ফারিয়াকে একটু জব্দ করতে হবে। মেয়েটা নিজেকে প্রচন্ড বুদ্ধিমতী মনে করে।

_______

মেহেভীন সামনের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না। কেননা রুমটা বেশ অন্ধকার। কিন্তু মেহেভীন অনুভব করতে পারছে তার সামনে কেউ দাড়িয়ে আছে। যুবকটি মেহেভীনের দিকে ঝুঁকে নিজের অধরজোড়া এগিয়ে নিয়ে যায় মেহেভীনের দিকে। মেহেভীন তা বুঝতে পেরে, নিজের আখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে। মেহেভীনের ভয়ার্থ মুখখানি দেখে,যুবকটির বড্ড ইচ্ছে করলো এই মোহনীয় মুখটাকে আদরে ভরিতে দিতে। কিন্ত কিছু একটা ভেবে যুবক নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলো। মেহেভীনের কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিতে দিতে মেহেভীনের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস সুরে বললো
, ‘ তোমার চেহারাতে একপ্রকার মুগ্ধতা আছে প্রেয়সী।
যখন তুমি নিজের আখিজোড়া বন্ধ করে রাখো,তখন কি ভয়ংকরভাবে তুমি মোহনীয় হয়ে উঠো। আজ হাজারো নারীর মাঝে আমার চোখ শুধুমাত্র তোমাতে সীমাবদ্ধ ছিলো। এতোটাই মুগ্ধ হয়েছি আমি। তোমাতে নিজেকে বার বার হারিয়ে ফেলি। ‘

যুবকটা কথাটি বলে, আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে মেহেভীনের কোমড়। মেহেভীন ঠায় দাড়িয়ে থাকে। সে আসলে বুঝতে পারছে না, তার সাথে আপাতত হচ্ছে টা কি?

যুবকটি মেহেভীনের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, ‘ তুমি আমার জীবনের প্রতিটা রংয়ের উৎস। তাই আমি তোমাকে আজ আমার ভালোবাসার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিলাম। তোমার জীবনে কোন অতীতের কালো রংয়ের প্রবেশ আমি করতে দিবো না। আজ আমি তোমায় প্রমিস করলাম।’

মেহেভীন কিছু বলার আগেই, যুবকটি আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলো অন্ধকারের মাঝে। মেহেভীন আর একসাথে এতোকিছু সহ্য করতে পারলো না। সে অনেকটা ঘোরের মাঝে আছে। তার মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে। কে সেই যুবক? যে এতো অদ্ভুদ কান্ড ঘটিয়ে গেলো তার সাথে। মেহেভীন মাটিতে পুনরায় লুটিয়ে পড়লো।

অভ্র নিজের রুমের রকিং চেয়ারে বসে আছে। মায়রার গর্ভে তার সন্তান বেডে উঠছে। কথাটি যতটা সহজ তার থেকেও বেশি কঠিন। অভ্র এক দুটানায় পড়ে যাচ্ছে। মায়রাকে এখন সে সহ্য করতে পারছে না। অপরদিকে মেহেভীনের স্মৃতি সে ভূলতে পারছে না। মেহেভীন নামটি মাথায় আসতেই অভ্রের মনে পড়ে যায় কালকের ঘটনাটি। মেহেভীন অন্য একজনকে জড়িয়ে ধরেছিলো। এইসব কথা ভাবতে গেলেও, রাগে মাথায় আগুন ধরে যায়। অভ্র ভাঙ্গা গ্লাসটি রাগে চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে অভ্রের হাত থেকে ফিনকি রক্ত গডিয়ে পড়ে। মায়রা রুমে এসে দেখে, অভ্রের হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।মায়রা সঙ্গে সঙ্গে অভ্রের কাছে গিয়ে, অভ্রের হাত টা ধরে বলে,

‘ অভ্র তোমার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে। কীভাবে কাটলো? চলো তোমার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দেই। ‘

অভ্র নিজের হাতটা সরিয়ে বললো, ‘ মায়রা তুমি এখন আমার চোখের সামনে যাও। একদম ন্যাকামি করবে না। আমার এখন কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ‘

কথাটি তীরের মতো বিধে যায় মায়রার মনের ভিতরে। সে তো শুধু ওষুধ লাগাতে এসেছিলো, তবে তাকে কেন শুনতে হলো অভ্রের কটু বানী?

_________

টিপ টিপ করে নিজের চোখের পাতা খুললো মেহেভীন। আরহামের ঘরে নিজেকে দেখে, সে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। মেহেভীন আস্তে ধীরে উঠে বসলো। তার সামনে আরিয়ান এবং আরহাম দাড়িয়ে আছে। আরহাম মেহেভীনকে উঠতে দেখেই,গলাতে গম্ভীর সুর এনে বললো, ‘ আমি বুঝে উঠতে পারিনা। এই মেয়ের কি স্টুপিডের মতো কাজ না করলে কী হয় না? ‘

মেহেভীন বলে উঠলো, ‘ আমি আবার কি করলাম? ‘

‘কি করেছো তুমি? আমাকে জিজ্ঞাসা করছো স্টুপিড মেয়ে। তুমি ভার্সিটির স্টোর রুমে কি করছিলে? কিছু স্টুডেন্ট সেখানে তোমাকে অজ্ঞান পেয়ে, আমাদের ইনফর্ম করছে। নাহলে ওরা না দেখলে আজকে অজ্ঞান হয়েই সারারাত স্টোর রুমে পড়ে থাকতে। ‘

‘ আরে আমি কী ইচ্ছে করে করেছি নাকি? আমাকেই তো জোড় করে ওই… ‘

মেহেভীন বাকি কথাটি বলতে পারলো না, তার আগেই আরহাম রামধমক দিয়ে বললো,

‘ এখন তুমি তোমার স্টুপিড কাজের জন্যে সাফাই দিতে যেও না। ‘

কথাটি বলে আরহাম মেহেভীনের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ এইবার থেকে তোমার উপর দ্বিগুন নজর দিবো আমি। তোমার মতো স্টুপিড মেয়েকে একা ছাড়াটাই ভূল। ‘

আরিয়ানের দিকে কাদু চেহারা করে মেহেভীন বলে,

‘ দেখছিস আরিয়ান কেমন করে তোর ভাই আমার সাথে। ‘

‘সত্যি ভাই এইভাবে বকিস না তো আমার লিটেল সিসকে।প্রেগ্ন্যাসির সময় একটু–আকটু মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।’

মেহেভীন ঢগঢগ করে তাড়াতাড়ি করে পানিটা খেয়ে ফেলে। তাড়াতাড়ি পানি খাওয়া ফলে,সঙ্গে সঙ্গে তার কাশি উঠে যায়। আরহাম মেহেভীনের কাছে গিয়ে, মেহেভীনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

‘ এমনি এমনি স্টুপিড বলি আমি? সামান্য পানিটুকুও খেতে পারো। ‘

মেহেভীন ঠোট ফুলিয়ে থাকে। আরিয়ান হেসে উঠে।

______

চলবে…ইনশা-আল্লাহ।