তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-৫৯ এবং শেষ পর্ব

0
3120

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ঘাড়ে কারো উষ্ম স্পর্শ পেতেই কেপে উঠে মেহেভীন।
আড়মোড়া হয়ে অপরপাশে ঘুমিয়ে পড়ে তবুও সেই স্পর্শ প্রখর হয়ে চলছে সময়ের সাথে। মেহেভীন চাইলেও ঘুমাতে পারেনা। ছটফট হয়প উঠে পড়ে। আরহাম তা দেখে বাকা হাঁসে। মেহেভীন বিরক্ত নিয়ে বললো,
‘ আপনি বার বার ডির্স্টাব করছেন কেন আরহাম সাহেব? রাতে তো ঘুমাতেই পারিনি। এখনোও কি ঘুমাতে পারবো না?’

‘ কেন গো? রাতে কি এমন হয়েছিলো? যে তুমি ঘুমাতেই পারলে না। ‘

আরহামের বেশরমমার্কা কথা শুনে, মেহেভীন নাক পূনরায় লাল আকার ধারণ করলো। রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় কুকড়ে উঠে সে। মাঝে মাঝে তার মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়ে বসে,
‘ এতো ভালোবাসা এতো প্রেম আরহাম সাহেব কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন এতোদিন? ‘
মেহেভীন কথাটি ভেবে আরেকদফা লজ্জা পায়।
তা দেখে ক্ষীন্ন হাঁসলো আরহাম। মেহেভীনের কাছে গিয়ে মেহেভীনের গলায় ঠোট ছুইয়ে কন্ঠে মাদকতা এনে বললো,

‘ ম্যাডাম ফ্রেশ হয়ে আসুন। আর হ্যা একটা শাড়ি পড়ে আসবেন। গোসল সেরে যখন ভেজা চুলে আপনি শাড়ি পড়ে আমার সামনে দাঁড়াবেন তখন কিছুক্ষন প্রান জুড়িয়ে দেখবো। ‘

মেহেভীন নইয়ে পড়লো লজ্জায়। তা দেখে আরহাম আবারোও বললো,

‘ দ্রুত পা চালিয়ে যান। আপনি এখন যেই অবস্হাতে আছেন তাতে আমার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা দায় হয়ে পড়েছে। আমি কিন্তু অতো ভালো হই। ‘

আরহামের কথা শুনে নিজের দিকে চোখ গেলো মেহেভীন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে আরহামকে অসভ্য উপাধী দিয়ে দ্রুত পা বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)

মেহেভীনের চুল বেশ বড় না হলেও বেশ ঘন। পিঠ ছুইছুই করে সেই চুলগুলো। আরহাম মেহেভীনকে বেড়োতে দেখে কিছুক্ষন নিষ্প্রান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার প্রেয়সীর দিকে। অন্যদিনের তুলনায় আজকে তার প্রেয়সীকে একটু বেশিই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। আরহাম এগিয়ে গেলো। মেহেভীন সবুজ রংয়ের শাড়ি পড়ে সাদা তোয়েলে দিয়ে চুল মুছার প্রয়াশ করছিলো। আরহাম তাতে বিঘ্ন ঘটালো। অত্যন্ত নিবিড় শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বললো,

‘ আমি মুছিয়ে দেই মেহেভীন? তুমি বসো থাকো।’

আরহাম শীতল কন্ঠে বলা অনুরোধকে নাখোচ করার সাধ্যি কি আদোও মেহেভীনের আছে? সে চুপচাপ বসে পড়ে শান্তভাবে। আরহাম পরম যত্নে আয়নার দিকে তাকিয়ে তার প্রেয়সী চুল মুছে দিতে থাকে।

_____________

শাড়ি পড়ে বিছানার কোণে বসে আছে ফারিয়া। নাক ফুলিয়ে কাঁদছে। কান্না তার থামছেই না। আজকে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। একেবারে নাকি আন্টিই পড়িয়ে চলে যাবে। কথাটি শুনার পর থেকে
ফারিয়ার মাথা কাজ করছে না। ইচ্ছে করছে আরিয়ানের কাছে ছুটে চলে যেতে এবং শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,

‘ ডাক্তার সাহেব শুনছেন? আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি। আমার জন্যে কি আপনার কিকোন ফিলিংস নেই? থাকলে বলুন। আমার যে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অন্য কাউকে কীভাবে বিয়ে করবো আমি?’

আফসোস ফারিয়া চাইলেও বলতে পারছে না। ভিতরের কষ্ট তাকে ভিতরেও চেপে রাখতে হচ্ছে। সে কি দম বন্ধ করা কষ্ট! এই কষ্টের তো শুরু কেবলমাত্র। এই মরনব্যাধী কষ্ট বোধহয় তাকে আজীবন সহ্যই করে যেতে হবে। দরজার অপাশ থেকে দরজায় কড়া নাড়লো ফারিয়ার মা। অস্হিরতার সুরে বললেন,

‘ কিরে ফারিয়া আর কতদূর বল তো? এইবার তো আয় মা। পাত্রপক্ষ তো চলে এসেছে। ‘

‘ পাত্রপক্ষ’ চলে এসেছে শুনে বুকটা ধক করে উঠলো ফারিয়ার। কোনরকম পা চালিয়ে দরজা খুললো। মেয়েকে দেখে খুশি হয়ে ফারিয়ার মা ফারিয়ার থুত্নি ধরে বললেন,

‘ বাহ আমার মেয়েকে লাল শাড়িতে তো বেশ মানিয়েছে। কারো নজর না লাগুক। মাশা-আল্লাহ। ‘

ফারিয়া শুকনো হাঁসলো। ড্রইং রুম থেকে ফারিয়ার বাবা উচু গলায় হাক ছেড়ে বললেন,

‘ কই গো ফারিয়ার মা? মেয়েকে নিয়ে আসো। ‘

ফারিয়ার মা ফারিয়াকে নিয়ে আসলেন। ফারিয়া
এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়াকে ছেলের পাশে বসানো হলো। ফারিয়া খানিক্টা দূরুত্ব বজায় রেখে বসে আছে। ছেলেটা বার বার ফারিয়ার কাছে আসার চেস্টা করছে, বরাবরই ফারিয়া মাথা নিচু করেই সরে যাচ্ছে। ছেলেটাকে তার চরম অসভ্য মনে হচ্ছে। এখনো ছেলেটাকে সে এক পলকের জন্যে দেখিই নি।

‘ আমার দেবর অরফে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর জন্যে কিন্তু ফারিয়াকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে।’

পরিচিত কারো গলা পেয়ে চমকে যায় ফারিয়া। উচু হয়ে দেখতে পায় সামনের সোফায় মেহেভীন,আরহাম এবং আরহামের বাবা-মা। এই মুহুর্তে তাদের দেখে বেশ অবাক হয় ফারিয়া। যেন সে তাদের আশাই করেনি।

তখনি কেউ ফিসফিস করে বলে,

‘ আমার শোকে এতেটা কাতর হয়ে গিয়েছিলে যে,
আমার বাড়ির লোকেদের দিকে তাকালে তো নাই আমাকেও দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। ‘

(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)

ফারিয়া আরিয়ানের দিকে অবাক পানে তাকায়।
আরিয়ান এইবার সবার অগোচরে ফারিয়ার কোমড় জড়িয়ে, ঠান্ডা গলায় বলে,

‘ কি ভেবেছিলে? এই আরিয়ান হাসান তালুকদার তার ভালোবাসাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবে?উহু ম্যাডাম এতো সহজ নয়। একবার যখন আপনি নিজের মায়ায় আরিয়ান হাসান তালুকদারকে জড়িয়ে ফেলেছেন। সেই মায়ার জাল থেকে আপনি চাইলেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।’

‘ তাহলে আমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়েছেন তাইনা?’

অভিমানের সুরে ফারিয়া কথাটি বলে। আরিয়ান
বাঁকা হেসে বলে,

‘ সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে একটু কষ্ট দিতে হয়েছে। বুঝলে মিস? ‘

ফারিয়াও সকলের আগোচরে আরিয়ানের কলার চেপে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ একটু কষ্ট? জানেন কতটা কষ্ট পেয়েছি আমি? ওকে বিয়েটা জাস্ট হোক তখন আমিও বুঝিয়ে দিবো। শাস্তির জন্যের রেডিও হোন মিঃ আরিয়ান হাসান তালুকদার। ‘

আরিয়ান ও দুষ্টু হেঁসে বলে,

‘ ঠিক আছে আমিও প্রস্তুত হবু মিসেস আরিয়ান হাসান তালুকদার। ‘

ফারিয়া হেঁসে ফেললো। অতঃপর আরিয়ান ফারিয়াকে আংটি পড়িয়ে দিলো। সবাই একসাথে ‘আলহামদুল্লিলাহ। ‘ বললো। পূর্নতা পেলো আরেকটি ভালোবাসা।

__________

সুখে শান্তিতে বেশ আনন্দের সাথেই পাড় হচ্ছে মেহেভীন এবং আরহামের সুখের সংসার। অভ্র এবং মায়রার সাথেও তারা আস্তে আস্তে করে মিশে যাচ্ছে পুরোনো অতীত ভুলে।

একদিন আরহাম তার অফিসে বসে কাজ করছিলো তখনি তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোন রিসিভ করে শুনতে পায়। ফোনের ওপাশ থেকে মেহেভীন নিশব্দে কাঁদছে। সঙ্গে সঙ্গে আরহামের বুক মোচর দিয়ে উঠে। আরহাম দুশ্চিন্তার গলায় বলে,

‘ মেহেভীন কি হয়েছে? আমাকে বলো?’

ফোনের ওপাশ থেকে মেহেভীন নিশ্চুপ। আরহামের ভিতরে ভয় ঢুকে যায়। সে আর কিছু না ভেবে, নিজের ব্লেজার হাতে নিয়ে এক মুহুর্তও দেরী করেনা।ছুটে যায় নিজের বাসার উদ্দেশ্য।

বাসায় এসে দ্রুত নিজের রুমে এসে দেখে,মেহেভীন খাটের কিনারে হাতে কিছু রিপোর্ট নিয়ে চুপচাপ বসে নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আরহাম মেহেভীনের কাছে গিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে করুন গলায় বলে,

‘ মেহেভীন কি হয়েছে আমাকে একবার বলো? কেউ কিছু বলেছে? কাঁদছো কেন? আমাকে খুলে বলো।’

মেহেভীন আরহামের দিকে রিপোর্টটা আরহামের দিকে এগিয়ে দেয়। আরহাম খুলে দেখে কিছু মুহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। রিপোর্টে স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে,

‘ মেহেভীন মা হতে চলেছে। ‘

আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই,মেহেভীন ভেজা গলায় বলে,

‘ আমি আবারোও মা হতে চলেছি আরহাম সাহেব। আমাদের ভালোবাসার প্রতীক পৃথিবীতে আসতে চলেছে। ‘

সঙ্গে সঙ্গে আরহাম মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে। দুজনেই আজ নিরবে কাঁদছে। সুখের কান্না। দুজনের মুখেই আজ যেন কোন ভাষা নেই।

____________________

সময় স্রোতের ন্যায়। সে কখনোই কারো জন্যে অপেক্ষা করেনা। হাঁসি-কান্না সুখ- দুঃখে পাড় হয়ে গেলো মেহেভীন এবং আরহামের সংসার জীবনের ছয়টি বছর। এই ছয় বছরে অনেককিছু বদলেও গেলেও, মেহেভীনের প্রতি আরহামের অসীম ভালোবাসা আগের থেকেও দ্বিগুনভাবে বেড়ে চলেছে। গাড়ির হর্নের শব্দে মেহেভীন বুঝতে পারে এতোক্ষনে আরহাম চলে এসেছে অফিস থেকে। আরহাম গাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিসের ফাইল দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। আরহাম
এখন আগের থেকেও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে এতোবছরে নিজের প্রচেষ্টায় নিজের স্বপ্নের কম্পানি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। শহরে সবাই তাকে এখন এক নামে চিনে।
আরহাম বাসায় ঢুকতেই, তার পাঁচ বছরের ছেলে আরভীন দৌড়ে আসে। আরহাম তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো,

‘ আমার ছেলেটা বুঝি আমায় মিস করছিলো?’

‘ হুম ড্যাড অনেক। বাট তার আগেও একটা নিউজ আছে।’

‘ কি নিউজ? ‘

‘ আমি আজকে ক্লাসে টপ করেছি। তুমি বলেছিলে টপ করলে তুমি ফ্রাইডে তে আমার সাথে সারাদিন ক্রিকেট খেলবে। প্রমিজ করেছিলে কিন্তু। ‘

আরহাম তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

‘ আমার প্রিন্স আমার কথা রেখেছে এখন তো আমাকেও আমার কথা রাখতে হবে তাইনা? ডোন্ট ওয়ারি তোমার ড্যাড তার প্রমিজ রাখবে। ‘

আরভীন আরহামের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ রেইলি ড্যাড আই লাভ ইউ জাস্ট।’

‘ আরভীন তোমার চাচ্চু ফোন করেছে। ‘

‘ সত্যি মাম্মাম? ‘

‘ হুম। ‘

মেহেভীন কথাটি বলে আরভীনের হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। আরিয়ান ফোন করেছে শুনে আরভীন দ্রুত কোল থেকে নেমে ফোন নিয়ে দ্রুত উপরে চলে যায়।
চাচ্চুর কাছে সে এখন আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসবে।
আরিয়ান বর্তমানে তার কাজের সূত্রে অস্ট্রেলিয়ায় তিন মাসের জন্যে গিয়েছে। ফারিয়াও আরিয়ানের সাথে গিয়েছে। তাদের দুজনের ঘর আলো করে
মেয়ে এসেছে। যার বয়স এখন এক বছর। নাম আলো।
আরভীনের সব আবদার তো তার ড্যাড এবং তার চাচ্চুর কাছেই। শুধু তাই নয় অভ্রের কাছেও সে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসে। আরভীন সকলেরই নয়নের মণি। এইসবকিছু দেখে মেহেভীন একদিন আরহামকে উদ্দেশ্য করে বলেই ফেলেছিলো,

‘ আরহাম সাহেব আপনার তিন ভাইয়ের অতি আদরে আমার ছেলেটা আবার যেন বাদর না হয়ে যায়।’

আরভীন চলে যেতেই, আরহাম মেহেভীনের কোমড় জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,

‘ ইচ্ছে করে ছেলেকে ফোন ধরিয়ে দিলে তাইনা? যেন
আমার আদর পেতে পারো। আসলে ছেলেকে দেখে আজকাল তুমি জেলাসি হচ্ছো প্রেয়সী। ইটস নট গুড। ‘

মেহেভীন আরহামের বুকে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে বলে,

‘ হয়েছে আপনার কথা শেষ? কি শুরু করেছেন?
বাবা-মা বাইরে গিয়েছেন। এসে দেখলে কি ভাব্বে?’

আরহাম কথার জবাব দেয়না বরং মেহেভীনের দিকে আরেকটু ঝু্ঁকে যেতেই,মেহেভীন আরহামের ঠোটে হাত দিয়ে, কিছুটা গম্ভীর সুরে বলে,

‘ আপনি কী জানেন আরহাম সাহেব? আপনি দিনের পর দিন অসভ্যের কাতারে নাম লিখাচ্ছেন। ‘

আরহাম স্মিত হেসে শীতল গলায় জবাব দিলো,

‘ নিজের বউয়ের সাথে রোমান্স করাটা যদি অসভ্যতামি হয়, তাহলে আমি তা বার বার করতে রাজি। ‘

মেহেভীন হেসে ফেলে। আরহাম ও আরেকদফা হাসে। তখনি ফোন বেজে উঠে মেহেভীনের। মেহেভীন ফোন রিসিভ করে এমন কিছু যা শুনে মুহুর্তেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত আরহামকে বলে তাকে এবং আরভীনকে নিয়ে অভ্রের বাড়িতে নিয়ে যেতে।

(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)

_____________

অভ্র মায়রাকে পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
সে আজ প্রচন্ড পরিমানে খুশি। হওয়ারই কথা। কেননা মায়রা আবারোও কনসিভ করেছে। মায়রার স্হীর হয়ে বসে আছে। তার মুখে কোন খুশির ঝলকের দেখা নেই। অভ্র মায়রার মুখ দেখে বললো,

‘ তুমি কী এখনো একটুও হাঁসবে না মায়রা? ‘

মায়রা জবাব দেয়ন। চুপ হয়ে বসে থাকে। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে মায়রা এতো বড় খুশির সংবাদ পেয়েও চুপ হয়ে থাকবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজকের দিনে প্রতিবছরই মায়রার মুখের হাসি উধাও হয়ে যায়। আজকে তাদের প্রথম সন্তানের জন্মদিন। অভ্র এবং মায়রার ঘর আলো করে তাদের ছোট্ট মেয়ে জন্ম নিয়েছিলো, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেই বাচ্চা মেয়েটি অভ্রদের বাসা থেকেই ছয় মাস বয়সে চুরি হয়ে যায়। অভ্র অনেক চেষ্টা করেও তাদের মেয়ের কোন খবর পায়নি। আজ প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো তবুও সেই ক্ষতটি অভ্র এবং মায়রা দুজনেই বয়ে চলেছে। আজ তাদের মেয়ের জন্মদিন ছিলো। আজকেই তারা জানতে পারলো তাদের মাঝে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।

আরভীন, মেহেভীন এবং আরহাম অভ্রের রুমে আসলো। আরভীন এসেই

‘ অভ্র পাপাই। ‘ বলে
অভ্রের কোলে বসে পড়লো। আরভীনকে দেখে অভ্র আরভীনকে জড়িয়ে ধরলো। আরভীন অভ্রের পরম আদরের। মায়রাও আরভীনকে অনেক ভালোবাসে। আরভীনের মাঝেই যেন তারা তাদের সন্তান হারানোর কষ্টটা কিছু হলেও ভুলতে পারে। মেহেভীন আরভীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘ বাবাহ তুমি আপাতত বাইরে গিয়ে খেলা করো।’

আরভীন বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘ ঠিক আছে মাম্মাম। ‘

আরভীন বাইরে চলে যেতেই, মেহেভীন মায়রার কাছে এসে বললো,

‘ মায়রা আপু এইবার একটু স্বাভাবিক হও। এতো বড় খুশির সংবাদ পেলে। ‘

মায়রা অনুতাপের গলায় বলে,

‘কীভাবে স্বাভাবিক হবো মেহেভীন? তোমাকে আমি বলে বুঝাতে পারবো না আমি কতটা অপরাধবোধে
রয়েছি। শুধু মনে হয় আমাদের মেয়েটা হয়তো আমাদের করা পাপের জন্যেই আজ আমাদের সাথে নেই। ‘

মায়রার কথা শুনে অভ্র মাথা নিচু করে বলে,

‘ মায়রা তো ঠিকই বলেছে। আমাদের পাপির শাস্তি আমরা হয়তো আজীবনই পেয়ে যাবো। যেমন আমার মা টাও শেষ বয়সে কতটা যন্ত্রনা নিয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। আমরা আমাদের মেয়েকেও হারিয়ে ফেললাম। ‘

আরহাম অভ্রের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

‘ অনেকসময় মানুষ পরিস্হিতির স্বাকীর হয়ে অনেক ভুল অনেক অন্যায় করে ফেলে। কিন্তু সেই পুরনো অন্যায়ের করা কথা ভেবে জীবনটাকে থমকে রাখা কী ঠিক অভ্র? ‘

অভ্র সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

মায়রা আবারোও মেহেভীনকে বলে,

‘ যে যাই বলুক আমি তো জানি আমার জন্যে আমার বাবা তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো। আমি তোমাকে পথের কাটা মনে করতাম বলে আমার বাবা তোমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছিলো। তোমার কষ্টটা আজ আমি এই ছয়বছরে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। তাছাডা আমি এবং অভ্র তো কম অন্যায় করেনি। ‘

মায়রা কথাটি বলেই কেঁদে দিলো। মেহেভীন মায়রার হাত ধরে কান্নার সুরে বলে,

‘ নিজেকে সামলাও মায়রা আপু। অতীতকে পিছনে ফেলে জীবনে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। অতীত শুধু আমাদেরকেই কষ্টই দেয়। অতীতকে আকড়ে ধরে থাকা মানে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়কে নতুনভাবে আগমন করা। তাই বলছি মায়রাপু মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদের আরেকটি সুযোগ দিয়েছে। নতুনভাবে সব শুরু করো। ‘

মায়রা মেহেভীন কথা মনোযোগ সহকারে শুনে, মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

_____________________

রাত প্রায় ২টো বাজে। আরহাম এখনো অফিস থেকে ফিরেনি। আরভীন তার দাদু এবং দিদার ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহেভীন আরহামের জন্যে টেবিলে খাবার রেখে,টেবিলেই আরহামের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ নিজেকে হাওয়ায় ভাসতে দেখে, নিজের আখিজোড়া খুলে মেহেভীন নিজেকে আরহামের কোলে আবিষ্কার করে। মেহেভীন চিৎকার করতে নিলে, আরহাম মেহেভীনের ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে বলে,

‘ ডোন্ট সাউট। ‘

আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে উপরের রুমে নিয়ে যায়। অতঃপর সাদা কিছুটা লালের মধ্যে একটি কাতান শাড়ি নিয়ে আসে। মেহেভীন শাড়িটির দিকে কিছুক্ষন স্হীর হয়ে তাকিয়ে থাকে। অসম্ভব সুন্দর কাতান শাড়িটি। মেহেভীন শাড়িটি নিয়ে চেঞ্জিং রুমে চলে যেতে নিলে, আরহাম তাতে বাধা দিয়ে বলে,

‘ উহু। আজকে আমি আমার প্রেয়সীকে নিজ হাতে সাজাবো। ‘

কথাটি বলে আরহাম নিজে মেহেভীনকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। অতঃপর নিজ হাতে মেহেভীনকে সাঁজিয়ে দেয় একদম ছবির মতো। সাঁজানোর পর আরহাম কিছুক্ষন তার প্রেয়সীর দিকে মুগ্ধ পানে তাকিয়ে থাকে। লাল টকটকে শাড়িতে মেহেভীনকে আজ নতুন নববধুর মতো লাগছে। চিকন ঠোটজোড়া গোলাপী আকাড় ধারণ রয়েছে। ফর্সা মুখটাও রক্তিম হয়ে রয়েছে। লজ্জার ছাপ রয়েছে তাতে। আরহাম কিছুক্ষন চেয়ে থাকে আনমনে বলে,

‘ প্রেয়সী তোমাকে হাজারোবার দেখলেও আমার চোখের তৃষ্ণা নিবারণ হবে না। এতোটাই অদ্ভুদ সুন্দর তুমি। ‘

অতঃপর মেহেভীনকে নিয়ে গাড়ি করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন বুঝতে পারছে না আরহাম হঠাৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে মেহেভীনের লক্ষ্য করে দেখলো বাতাসে তার বরের চুলগুলো সামান্য উড়ছে। আরহামের উজ্জ্বল ফর্সা মুখে চমৎকার হাঁসি বিরাজমান। আরহাম আগের থেকেও সুদর্শন হয়ে উঠেছে।আরহাম নিজের গাড়ি থামিয়ে দেয়। প্রথমে আরহাম এবং অতঃপর মেহেভীন গাড়ি থেকে বেডিয়ে পড়ে। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে মেহেভীন অবাকের শীর্ষে পৌছে যায়। সামনে থাকা পুকুরের দিকে তার চোখ আটকে যায়। সামনে রয়েছে পদ্মফুলে ভরপুর পুকুর। চারিদিকে অন্ধকারকে আলোকিত করছে জোনাকি পোকা উড়ে চলেছে।
এতো সুন্দর মনোরম দৃশ্য দেখে মেহেভীন আবেগ্লুত হয়ে, আরহামকে জডিয়ে ধরে বলে,

‘ ধন্যবাদ আরহাম সাহেব এতো সুন্দর জায়গায় আমাকে নিয়ে আসার জন্যে। ‘

আরহাম মুচকি হেসে বলে,

‘ তোমার পছন্দ হয়েছে প্রেয়সী। ‘

‘ একদম। ‘

এইবার আরহাম পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। পুকুরের থেকে পদ্মফুল নিয়ে এসে, মেহেভীনের কাছে এসে আবদারের সুরে বলে,

‘ প্রেয়সী আজ তোমার ঘন কালো চুলগুলোকে ছেড়ে দেও। আমি তাতে পদ্মফুল গুজে দিবো। ‘

মেহেভীনের উত্তরের অপেক্ষা করলো না আরহাম। নিজেই মেহেভীনের চুলগুলো খুলে দিয়ে, মেহেভীনের কানে পরম যত্নে ফুল গুজে দিয়ে, মেহেভীনকে পুনরায় কোলে নিয়ে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়ে। অতঃপর প্রেন্টিং খাতায় রং তুলি দিয়ে আরহাম নিজের নিঁখুত
শিল্পীর হাত নিয়ে, নিজের প্রেয়সীর ছবি একেঁ ফেললো। পদ্মদুলে লাল টুকটকে শাড়ি পরিহিতা মেহেভীন। মেহেভীন আরহামের বুকে মাথা গুজে বলে,

‘ এতো ভালোবাসেন কেন আরহাম সাহেব? জানেন? মাঝে মাঝে খুব ভয় করে। মনে হয় এই ভালোবাসা আমি হয়তো হারিয়ে ফেলবো। আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না তো?’

আরহাম অত্যন্ত শীতল গলায় জবাব দেয়,

‘ তোমাকে কী করে ভুলবো প্রেয়সী? তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে তো নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া। তুমি আমার মনে ঠিক কোথায় আছো জানো? তুমি_আছো_মনের_গহীনে। মনের অত্যান্ত গহীনে যার বসবাস তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় এই জন্মে।
ভালোবাসি প্রেয়সী। ‘

‘ ভালোবাসি আরহাম সাহেব। ধন্যবাদ আরহাম সাহেব আমার জীবনের আসার জন্যে। আমার অন্ধকারে আচ্ছাদিত জীবনে এক মুঠো ভালোবাসা রং নিয়ে এসে, রঙ্গিন করে তুলার জন্যে।’

আরহাম শক্ত করে তার প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে আনমনে গাইতে থাকে,

চেয়েছি পেয়েছি থেকো মন গহিনে

পারে না বাঁচে না মন তুমি বিহনে

চেয়েছি পেয়েছি থেকো মন গহিনে

পারে না বাঁচে না মন তুমি বিহনে

সমাপ্ত।।
আরহাম এবং মেহেভীন সারাজীবন সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দিকে এইটাই কাম্য 💖।

লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি