অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-১২+১৩

0
808

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১২

— “শুভ্র, এই তুই ইশরার দায়িত্ব নিতে হসপিটালে থেকেছিস! মেয়েটার হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে আর তুই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছিস? আমারই ভুল হয়েছে..

কর্কট কন্ঠে কথন গুলো উচ্চারণ করতে করতে কেবিনের ভেতরে এগিয়ে এলেন তিথি। সেদিকে তাকালো ইশরা। পুরো মহল ছুটে এসেছে। সাথে খাবার ব্যাগ। শুভ্র নামটা মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই। বিরবির করে শব্দহীন দুবার উচ্চারণ করলো ইশরা। — “শু-শুভ্র! শুভ্র।” এই নামে প্রায়ই তিথি আয়ানকে ডেকে থাকে।

ভারী ভারী কার্টুন বক্স হাতের উপর পড়াতে ক্যানেল তার অবস্থান পরিবর্তন করে সরে গেছে শিরার উপর থেকে। ডানহাত সরানোর চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ কিন্তু সক্ষম হলো না তার প্রচেষ্টা। তার বাহুডোর সম্পুর্ণ টা জুড়ে আয়ান গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন। প্রত্তুর্যের সোনালী আভা এসে আয়ানের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সে নড়েচড়ে ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। এদিকে এক হাতে স্যালাইনের ক্যানেল ছাড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে ইশরার কাছে। স্বার্থপরের মতো আয়ানের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক দেওয়ার মতো ক্ষমতা হলো না তার।

তিথি এগিয়ে এসে একটানে স্যালাইনের ক্যানেল খুলে ফেলে দিলো। রক্তে পুরো স্যালাইনের বর্ণ পাল্টে গেছে। ঘর কাঁপানো চিৎকার করে উঠলেন তিথি। সেই চিৎকারের শব্দ কর্ণপথে যেতেই বেসামাল হয়ে পড়লো আয়ান। নিভু নিভু দৃষ্টিপাত করতেই উল্টিয়ে পড়ে গেল নিচে। নয়ন যুগল তখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। ঘুমন্ত ছাপ স্পষ্ট মুখশ্রীতে। নিসুপ্তি উগ্রে বুঝতে সমস্যা হলো আয়ানের। তবে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে তাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই তার। তার ঘুমন্ত নজর গেল বেডের উপরের দিকে। সেখানে আরো কিছু কার্টনের বক্স রাখা। হাওয়ার তালে তালে দুলছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে গড়িয়ে পড়লো নিচে। তড়িৎ গতিতে ইশরার উপর ঝুঁকে পড়লো আয়ান। আংশিক শব্দে কার্টুন বক্স গুলো আয়ানের শরীরে আছড়ে পড়েছে। ভাড়ে খানিকটা ঝুঁকে পড়লো সে। অধরে গিয়ে অধর ঠেকলো দুজনার। একজোড়া নয়ন থেকে অন্য একজোড়া নয়নে কথা আদান প্রদান হলো। কার্টুন বক্স গুলো শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মেডিসিন যুক্ত ফ্লোরে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সকলে। উঠে দাঁড়ালো আয়ান।

তদানীং ভয়ে গুজো হয়ে গেছে ইশরা। চোখজোড়া বন্ধ তখন ভীতিকর পরিস্থিতিতে। হার্ট সাউন্ড বেড়ে গেল কয়েকগুণ। হাই পেসার রোগীদের মতো পালস রেট বেড়ে গেছে।

ইশরার মাথাটা নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আয়ান। আশ্বাসে জড়ানো মলিন কন্ঠে বলল..

— “ইশু ওপেন ইউর আইস। তাকা আমার দিকে কিছু হয়নি তোর।”

নিভু নিভু আঁখিপাত করলো আয়ানের দিকে। চোখে ভয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ইশরার। ইশরার করুনতা মেশানো মুখটা আয়ানের চোখে অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়লো মুহুর্তে। ডাক্তার তখন এসে পৌঁছেছে দরজার দ্বারপ্রান্তে। তেড়ে উঠলো আয়ান। কার্টুন বক্স গুলো ছুঁড়ে মারলো ডাক্তারের মুখের উপর। ধাক্কা লেগে গড়িয়ে পড়লো নিচে। এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারে কলার চেপে ধরলো সে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল..

— “কেমন হসপিটাল এটা। প্যাসেন্টের প্রোপার সেফটি নেই। এই হসপিটালের নামে আমি অভিযোগ করবো। আমি দেখতে চাই, এই হসপিটাল কিভাবে চলে।”

আয়ানের মূলতুবি থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলে তার পরিবার। ক্রমশ তর্কের মাত্রা বেড়ে গেল। ছাড়িয়ে গেল রুমের বাইরে। চেঁচামেচির ধ্বনি ছড়িয়ে গেল হসপিটালের প্রতিটি কোণে। তর্ক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে উপলব্ধি করতে পেরে ছুটে এলো ম্যানেজার। উপস্থিত হয়ে সামলে নিলেন পরিবেশ। নত কন্ঠে বলল..

— “স্যার; এই সমস্যার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সামান্য হাওয়ায় এতো বাড়ি বাড়ি কার্টুনের বক্স পড়তে পারে। বুঝতে পারি না। এরপর আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করব। (হাত জোড় করে বলল) প্লীজ চেঁচাবেন না স্যার। আমাদের হসপিটালের রেপুটেশন খারাপ হবে।”

দুহাত মাথায় চেপে ধপ করে বসে পড়লো সে! অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..– “তোমরা ইশরাকে তৈরি করো। আমি রিসেপশনে বিল পে করে আসছি।”

— “আসছি মানে কি আয়ান! ইশরা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থ।”

প্রতিউত্তর দেওয়ার মতো ভাবাবেগ খুঁজে পাওয়া গেল না আয়ানের ভেতরে। সবার দিকে কপাট চোখে তাকালো সে। সবাই পূর্বের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে‌। ইশরার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে গেল আয়ান। ঈষৎ ঝুঁকে কোলে তুলে নিলো ইশরাকে। গতিহীন পা জোড়া চলনশীল করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার আগেই রাগ দেখিয়ে বলে গেছে, “হসপিটালের বিল পে করে আসতে।”

_________________
বৃষ্টি একধরনের তরল, যা আকাশ থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে পড়ে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই ফোঁটাগুলি যথেষ্ট পরিমাণে ভারি হলে তা পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে – একেই বলে বৃষ্টি। বর্তমানে বর্ষাকাল বিরাজ করায়, বৃষ্টি নিত্তদিনের সঙ্গি। তবে দিনে বৃষ্টির থেকে রাতের বৃষ্টিগুলো আকর্ষণীয় হয়। অন্ধকারে বৃষ্টির বিন্দু কণা দেখা না গেলেও। ছমছম শব্দ উপলব্ধি করা যায়। শীতলতা যতোটা ঘন হচ্ছে তত তন্দ্রালগ্ন হচ্ছে ইশরা। সারাদিন ঘুমের পর এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন সে। আয়ান ব্যস্ত মনে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। মাঝে মাঝে ল্যাপটপ থেকে দশ সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করছে সে। কখনো চোখ ঢাকা চিকন চশমা-টা খুলে চোখ পরিষ্কার করে পরিধান করছে, আবার মাথায় হাত রাখতে দেখা যাচ্ছে।

আয়ানের ব্যস্ততা যখন সর্বোত্তম পর্যায়ে তখন তন্দ্রা ভঙ্গ হলো ইশরার। বড়সড় হাই তুলে উঠে বসলো সে। থাই টানা কাচটা খুলে দিলো। সাথে সাথে দমকা হিম শীতল হাওয়া প্রবেশ করলো ঘরে। মুহুর্তের মাঝে আদ্রতাময় তাপমাত্রা ছড়িয়ে পড়লো ঘরে। গ্ৰিলে পানির ফোঁটা পড়ে ছিটকে আসছে ইশরার শরীরে। কেঁপে উঠলো ইশরা। ওরনা দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিলো সে। ইশরার কান্ড দেখে মুচকি হাসলো আয়ান। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশরার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর স্ক্রিনে দৃষ্টি বন্দী করে বলল..

— “জানালা বন্ধ করে দে! ভিজে যাচ্ছিস তো,”

জানালা বন্ধ করলো না ইশরা। হাতের করতল মেলে দিলো জানালার ফোকট দিয়ে। বৃষ্টির ফোঁটা বন্দী হলো হাতের ভাজে। কিছুক্ষণ পর সেই বন্দী পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছিটকে যাচ্ছে। আবেগিত কন্ঠে বলল..

— “জানিস আয়ান; এই বৃষ্টির দিনে আমার ছোট একটা ইচ্ছে ছিলো। ‘হুমায়ূন আহমেদ’ রচিত ‘এই শুভ্র এই’ গল্পের মতো বাবার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো। হাতে থাকবে গরম গরম কফি। কফির কাপে চুমুক দিবো আর বৃষ্টির ছোঁয়া উপলব্ধি করবো। বাবা ছোট বেলা থেকেই ব্যস্ত থাকতেন। তাকে এই ইচ্ছেটার কথায় বলতে পারিনি। মায়ের সাথে ভিজে সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মায়ের ঠান্ডা লাগার ধাত। সামান্য ঠান্ডা পানি শরীরে পড়লে ঠান্ডায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।”

শব্দময় ল্যাপটপ বন্ধ করে বসলো আয়ান। চশমা খুলে ল্যাপটপের উপরে রেখে বলল..

— “আমার মা কি বলে জানিস, আমি না-কি ‘হুমায়ূন আহমেদ’ এর রচিত শুভ্রের মতো। মায়ের রাজকুমার, তাই ভালোবেসে আমাকে শুভ্র বলে ডাকে।”

থাই লাগিয়ে পর্দাগুলো টেনে দিলো জানালার। আয়ানের সামনে বসে বলল..

— ” ‘আন্টি হুমায়ূন আহমেদ’এর বই পড়ে?”

কদাচিৎ হাসলো আয়ান। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল..

— “হুমায়ূন আহমেদ’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আরো বেশ কয়েকটা রাইটারের উপন্যাস পড়েছে। তার ভেতরে শুভ্রকে অনেক পছন্দ ছিলো। গ্ৰামের মানুষজন বলে, গর্ভে থাকা কালীন মা যেসব করে, সেইসব ছেলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মা চাইতো আমি কাল্পনিক শুভ্রের মতো হই, তাই গর্ভে আসার পর শুভ্র সম্পর্কিত গল্প পড়ত। আর মায়ের ধারণা আমি শুভ্রের চেয়ে বেশি সুন্দর। তবে আমি তা মনে করি না।”

গভীর দৃষ্টিতে আয়ানকে অবলোকন করলো ইশরা। দীর্ঘক্ষণ চশমা ব্যবহার করার ফলে নাকের কোণে লালচে হয়ে আছে। সেটা শুভ্রের সাথে বেশি মিল। শুভ্রের মতো দেখতে কি-না জানা নেই। তবে স্যারের ব্যাখা অনুযায়ী শুভ্রের প্রতিচ্ছবি আয়ান।

ইশরার মনে বইছে অজানা হাওয়া। তীব্রতর ভাবে চাইছে যখন আয়ানের অস্তিত্ব তার গর্ভে বড় হবে তখন সেও শুভ্র সমগ্র পড়বে। আচ্ছা তার ছোট ছেলেটা তো আয়ানের অংশ হবে। সেক্ষেত্রে সেই পুচকু-টাও চোখ ধাঁধানো সুন্দর হবে। হঠাৎ করে মুখ ফসকে বলে ফেলল..

— “আয়ান আমার সেই অপূর্ণ ইচ্ছেটা পূরন করবি। আমি তোর সাথে এই অন্ধকার রাতে ভিজতে চাই‌‌।”

দি-মুহুর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগে নাকোচ করলো আয়ান। এমনিতেই ইশরা অসুস্থ, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে আরো অসুস্থ করে তুলতে চাইছে না। তেড়ে উঠলো ইশরা। মুখশ্রী ঘুড়িয়ে নিল। ছলছল নেত্রে বলল..
— “লাগবে না ভেজা।”

বেরিয়ে গেল আয়ান। মিনিট পনেরো পর ফিরে এলো সে। ততক্ষণে ইশরা মুখ ভাড় করে শুয়ে পড়েছে। ব্লাঙ্কেট ছাড়িয়ে কোলে তুলে নিল সে। চলমান পা জোড়া দিয়ে এগিয়ে গেল বৃষ্টি উপভোগ করতে।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৩

বৃষ্টির জলধারায় ইতিমধ্যে ভিজে একাকার হয়ে গেছে দুটো মানব। মোটা হাত-পা, মাথার ব্যান্ডেজ ভিজে গেছে বহুক্ষন পূর্বে। ধীরে ধীরে কপির কাপ ঠান্ডা হয়ে আসছে। আয়ান মৃদু উষ্ণময় কাপে চুমুক দিতেই ভেসে এলো, মনোমুগ্ধকর গানের সুর..

🎶 আগে কতো বৃষ্টি যে, দেখেছি শ্রাবণে!
জাগে নি-তো এতো আশা, ভালোবাসা এ-মনে।
আগে কতো বৃষ্টি যে, দেখেছি শ্রাবণে!
জাগে নি-তো এতো আশা, ভালোবাসা এ-মনে।

এই বৃষ্টি ভেজা পায়ে, সামনে এলে হায় ফোঁটে কামিনী.
আজ ভিজতে ভালো লাগে,শুণ্য মনে জাগে
প্রেমের কাহিনী।🎶🎶

রিমঝিম ধারাতে, চায় মন হারাতে…
রিমঝিম ধারাতে, চায় মন হারাতে…

ইশরার মনোমুগ্ধকর সুরে নিজেকে উতলার সর্বস্তর মনে হলো আয়ানের। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো কপির কাপের মাঝে। উঠে দাঁড়ালো সে। এক কদম ফেলতেই ঝাপসা হয়ে এলো আঁখি জোড়া। বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাঁপসা হয়ে এসেছে চশমার কাঁচ। অন্ধকারে কিছু দেখার মতো ক্ষমতা অবকাশ রইলো না তার মাঝে। চশমা খুলে নিল হাতের ভাঁজে। টি শার্টের নিম্নাংশ দিয়ে মুছে নিল চশমার কাঁচ। চোখে পরিধান করার আগেই হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল প্রয়োজনীয় জিনিসটা। বসে পড়লো আয়ান। হাতরাতে লাগল ছাদের মেঝে। সংস্পর্শে এলো না সেই কাঙ্খিত জিনিসটা। এলো ছাদের জমে থাকা পানিগুলো। ততক্ষণে ইশরার গলার সুর ভারী হয়ে এসেছে। সেই সুর অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সেদিকে। ইশরার কাছে পৌঁছানোর পূর্ব মুহুর্তে পিচ্ছিল যায়গায় পা লেগে উল্টে পড়ে গেল আয়ান। হাত দিয়ে কিছু ধরে ব্যালেজ করার চেষ্টা করলে ইশরার শরীর স্পর্শ করলো। দুজনে ছিটকে পড়লো নিচে। জমে থাকা পানিগুলো ছিটকে পড়লো আয়ানের মুখে। থেমে গেল হৃদয় কাঁপানো সুর ধ্বনিগুলো। বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা বিন্দু কণা আয়ানের চুলের মাঝে পড়লো। মাথার অগ্ৰভাগ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে মুখশ্রী অতিবাহিত করে চিবুক বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়লো ইশরার মুখে। টানা টানা নেত্র যুগল কুঁচকে নিভু নিভু হয়ে আয়ানের চোখে বন্দী করলো।

কিছুক্ষণ সময় চললো সেই অন্যরকম লগ্ন। ধাক্কা দিয়ে আয়ানকে সরিয়ে বসলো ইশরা। হাত পা চেক করলো, পুরাতন ব্যাথার সাথে নতুন কোনো ব্যাথা সংযুক্ত হলো কি-না। পেল না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..

— “তুই কোনো কাজ ভালো ভাবে করতে পারিস না, ইডিয়েট।”

— “আমি কিছু দেখতে পারছি নি। চশমাটা হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না।”

অসন্তুষ্ট হয়ে গেল ইশরা। উঠে দাঁড়ালো নিজে নিজে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছাদের অপর প্রান্ত থেকে চশমা খানা খুঁজে নিয়ে এলো। আয়ানের হাত না দিয়ে নিজেই পরিয়ে দিল প্রয়োজনীয় জায়গায়। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল..

— “নিজেকে শুভ্র বলে দাবী করিস। কই শুভ্র-তো কারো সাহায্য নেয় না। তার দৃষ্টি শক্তি কম থাকলেও স্মৃতি শক্তি, চলন শক্তি, শ্রবণশক্তি অঢেল।”

নয়ন গ্ৰথণ করলো আয়ান। এগুলো তার শারীরিক ত্রুটি ইরেকটাইল ডিসফাংশন রোগের ওষুধের পার্স প্রতিক্রিয়া। কিছুদিন ধরে সে মেডিসিন নেওয়া শুরু করেছে। যার ফলশ্রুতিতে চোখে দেখতে পারছে না। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বলল..

— “শুভ্রের সাথে আমার যথেষ্ট মিল রয়েছে। ইভেন্ট চোখে সমস্যা টাও। প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরে এই সমস্যা। তবে বেশ জড়ালো নয়। মাঝে মাঝে দেখতে পাই না। তখন চশমা ব্যবহার করি। মা আমাকে চশমা ব্যবহার করতে দেয় না।”

আয়ানের বাক্যগুলো মিথ্যা নয়। এর আগে কখনো তাকে চশমা পরিধান করতে দেখিনি সে। মাথা কাত করে মোহনীয় চোখে তাকালো আয়ানের দিকে। হাত মেলে দিলো শূন্যতায়। ঝিরিঝিরি পানিতে পূর্ণ হলো হাতের মুঠো। আয়ান হাত রাখলো ইশরার মেলে দেওয়া হাতের উপর। হাতের পরশে সেই পানিগুলো আংশিক শব্দে নিচে পড়ে গেল। ঠোঁট চেপে একগাল হাসলো ইশরা। দৃষ্টি গোচর হলো না সেই মাতাল করা হাঁসি। চপল পা ফেলে দোলনার দিকে এগিয়ে গেল ইশরা। বসিয়ে দিল আয়ানকে। নিজেও বসলো তার পাশে। কাপ হাতে নিলো। বৃষ্টির শিতল পানিতে ডুবে গেছে কপির অবশিষ্ট অংশ। সেই হাড় কাঁপানো শিতল পানি ঢেলে দিলো আয়ানের মাথায়।
.
.
ইশরাকে কোলে তুলে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো আয়ান। বসিয়ে দিল বেডের কিনারে। ভেজা জামা থেকে ছুপছুপ পানিতে ভিজে গেল বেডে সহ মেঝের অনেকটা। শার্টের কলার চেপে কাছে নিয়ে এলো আয়ানকে। হাত সরিয়ে গলায় বন্দী করে নিল। নেশাগ্ৰস্থ দের মতো টেনে টেনে বলল..

— “ছেলেরা না-কি মেয়েদের এই অবস্থায় দেখলে নিজেদের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। আমি তো তোর বউ। তাহলে এভেয়েট করছিস কেন?”

পিছিয়ে গেল আয়ান। ছড়িয়ে নিল নিজের। অপ্রস্তুত স্বরে বলল..

— “ইশু জেদ ধরে ছিলি, তাই বৃষ্টিতে ভিজতে রাজি হয়েছি। এখন যা জামা কাপড় পাল্টে নে, ঠান্ডা লেগে যাবে!”

শুনলো না ইশরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এগিয়ে গেল আয়ানের দিকে। নিজের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে নিজের পায়ের ভাড় ছেড়ে দিলো আয়ানের উপর। আয়ানের পায়ের পাতায় পা রেখে উঁচু করে চুলের ভাঁজে হাত ঠেকানো ইশরা। দ্বি-মুহূর্ত অপেক্ষা না করে নিজের অধরের ছোঁয়ায় আয়ানের অধর নিজের আয়ত্তে করে নিল। পিছিয়ে গেল আয়ান। নিজের ভারসাম্য বজায় রাখলো জড়িয়ে নিল ইশরাকে। বেশ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল অনুভূতিময় স্পর্শে।

শরীরের প্রতিটি কোষ যেন সচল হয়ে উঠেছে। অস্বস্তিতে ছেড়ে গেল সবটা। নিজের অক্ষমতা জানিয়ে দিয়েছে সে ব্যর্থ। স্বযত্নে নিজের থেকে বিছিন্ন করে নিল ইশরাকে। এতোটা আশা করে নি ইশরা। ঘনঘন পলক ফেলে বলল..
— “কি হয়েছে আয়ান তোর।”

উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে জামা কাপড় বের করলো আয়ান। চপল পা ফেলে প্রস্থান করলো রুম। যেন কোনো বিড়াল মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
____________________

আজকের দিনটা আর পাঁচটা দিনের চেয়ে ভিন্নতর। কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে তমোনার। সকাল সকাল একটা কালো রঙের কাক এসে রুমের ভেতর প্রবেশ করেছে। তমোনার পায়ের কাছে তিনবার কা কা করে জানালা বেধ করে বেরিয়ে গেল অজানায়। সেই থেকে অস্তিরতায় ভুগছে তমোনা। তার মনের অনন্ত কোনো ধারণা জন্মেছে, অজানা বিপদ অত-পেতে রয়েছে। ইশরার চিন্তা করতে করতে খাবারের প্লেটে আঁকি ঝুঁকি করছে। রৌদ্র জুবায়ের তাকালেন তমোনার দিকে। তমোনার এমন উদ্ভর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হলেন তিনি। খাবার সময় কথা বলা, খাবার না খেয়ে নাড়াচাড়া করাটা সুবিধার চোখে দেখেন না তিনি। খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন..

— তমু, কি হয়েছে তোমার? এতো কি ভাবছ?

রৌদ্র জুবায়ের এর ধ্বনিগুলো হয়তো কর্ণপথে গেলো না তমোনার। তিনি নিম্ন দৃষ্টিতে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। আশাহত হয়ে কাঁধে হাত রেখে বেশ কয়েকবার ঝাকুনি দিলেন রৌদ্র জুবায়ের। তটস্থ কন্ঠে বলল..

— “খেয়ে ইচ্ছে না করলে রেখে দাও। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করো না। এতে শরীর খারাপ হবে।”

ভাবনার ছেদ ঘটল তমোনার। পানি ঢেলে ঝুটো হাত ধুয়ে নিলেন। ইতিমধ্যে রৌদ্র জুবায়ের এর খাবার শেষ হয়ে গেছে। প্লেট দু’টো হাতে নিয়ে বেসিনে রেখে এলেন। বসে পড়লো পূর্বের আসনে। অন্য মনস্ক হয়ে গেলেন পুনরায়।

তমোনার এমন হুটহাট অন্য মনস্ক হয়ে যাওয়া ভালো নজরে দেখলেন না তিনি। কিছু বিচলিত কন্ঠে বললেন..

— “কি নিয়ে এতো গভীর চিন্তা কর তুমি? আমাকে বলো, আমিও একটু চিন্তা করি।”

মন খারাপ হয়ে গেল তমোনার। আঁচলে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলেন তিনি। এবার যেন রৌদ্রের ধৈর্য বাঁধ ভেঙে গেল। রাগ দেখিয়ে বললেন..

— “কি হয়েছে বলবে তো? এবারে কাঁদলে সমস্যা সমাধান হবে?”

— “আমার মনটা সেই সকাল থেকে ভালো নেই। কাক-টা এসে অশুভ সংকেত দিয়ে গেছে। মন ইশরার জন্য আকুল হয়ে আছে। কতো গুলো দিন হয়েছে মেয়েটাকে দেখি না।”

এতোক্ষণে বুঝতে সক্ষম হলেন তিনি। তবে কাকের ব্যাপার-টা যুক্তিসংগত মনে হলো না তার কাছে। কাক যখন খুশি উড়তে পারে, ঘুরতে পারে, তার কন্ঠে কাকা করে ডাকতে পারে। সেটা অশুভ হবে কেন? ইচ্ছে করছে তমোনাকে দুটো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে। কিন্তু তা করলেন না তিনি। উঠে দাঁড়ালেন নিজের চেয়ার ছেড়ে। বসে পড়লেন তমোনার পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাসের কন্ঠে বলল..

— “এতো চিন্তা করছ কেন? কাল সকালে একবার মেয়ের বাড়িতে গিয়ে না-হয় স্ব-চোখে দেখে এসো।”

মায়ের অবুঝ মন তাই হয়তো ভরসা পেলেন না তমোনা। ল্যান্ডফোন দিয়ে কল লাগালেন ইশরার ফোনে। মেয়ের ভালো আছে, কথাটা শুনেই তিনি শান্ত হবেন। তার আগে নয়।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)