অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-১৮+১৯

0
687

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৮

বেলকেনির গ্ৰিলে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ইশরা। হাজার বার চাইলেও সহ্য করতে পারছে না। যতোবারই মুছার চেষ্টা করছে ততবারই পূর্ণ হচ্ছে অশ্রুতে। তাই না মুছেই রেখে দিল। আয়ানের বারবার অবহেলা তার সহ্য হচ্ছে না। নিজের কষ্টগুলো দূর করার বৃথা চেষ্টায় মগ্ন ছিল যখন ইশরা। তদানীং ডাক পড়ল তমোনার। বেলকেনিতে প্রবেশ না করে, বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন..

— “ইশু তোর বাবা দরজা খুলেছেন। তোকে ডাকছে। তুই গেলেই জানতে পারব কি হয়েছে তার। তাড়াতাড়ি আয়..

ফিরে তাকালো না ইশরা। দৃষ্টিকে বাইরেই বন্দী করে বলল..– “মা তুমি যাও, আমি আসছি।”

তমোনা চলে গেলেন। মায়ের অনুপস্থিত অনুভব করে উঠে দাড়ালো ইশরা। তাকে এভাবে দেখলে কষ্ট পেতেন তমোনা। তাই মায়ের যাওয়ার অপেক্ষা করলো সে। মুখে পানি ছিটিয়ে মুছে নিল। সাধারণ ব্যবহৃত ক্রিমটা মুখে মেখে নিলো। চুলগুলো ঠিক করে বাবার রুমে পা বাড়ালো ইশরা। সকালে বাড়িতে ফিরে রৌদ্র জুবায়ের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। মাত্র খুলেছে, সারাদিন কিছু খায়নি। কারো সাথে কথা বলেনি। একটা কথাই উচ্চারণ করেছেন,– “আমি এখন একা থাকতে চাই।”

খাবার টেবিলের উপর রেখে বাবার দিকে এগিয়ে গেল ইশরা। মাটিতে বসে বাবার কোলে মাথা রেখে নয়ন গ্ৰথণ করে নিল। মৃদু শব্দ বলল..

— “বাবা কি হয়েছে তোমার? কি বলবে তাড়াতাড়ি বলে খাবারটা খেয়ে নাও, নাহলে খাবার খেয়ে বল। না খেয়ে থাকতে অসুস্থ হয়ে যাবে তুমি!”

রৌদ্র জুবায়ের মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মেয়ের কষ্টটা তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। নয়ন থেকে চশমা খুলে বললেন..– “ইশু মা আমার, তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি। তাই না।”

চমকালো ইশরা। তট জলদি বাবার মুখশ্রীর দিকে তাকালো। ইশরা ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু উচ্চারণ করার আগেই মুখ খুললেন রৌদ্র জুবায়ের..

— “কিছু লুকাতে হবে না তোর। আমি সব জেনে গেছি, আজাদ আমাকে সবটা খুলে বলেছে! আমাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ তোর জীবনটা নষ্ট হতে বসেছে। চিন্তা করিস না মা, আমি তোর ভালো জায়গায় বিয়ে দিবো। খুব ভালো থাকবি তুই।”

— বাবা এখানে তোমাদের কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার ভাগ্যের। তাছাড়া আমি আর আয়ান পালিয়ে বিয়ে করেছি।

রৌদ্র জুবায়ের মেয়েকে থামিয়ে দিলেন। তিনি যদি আয়ানের সাথে ইশরার বিয়ে ঠিক না করতেন তাহলে এমন কিছু আদোও হতো না। হঠাৎ মাথার ভেতরে বজ্র বিদ্যুৎ খেয়ে গেল। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন তিনি। সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মৃদু স্বরে বললেন.. — “দো-ষ তোর ন..
বাক্য শেষ করতে পারলেন না। দুহাতে মাথা চেপে নুইয়ে পড়তেন। দ্বি-মুহুর্ত অতিক্রম হওয়ার আগেই বসা থেকে চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়লেন তিনি। চোখ উল্টে গেল তার। শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলেন। দ্রুত এগিয়ে গেলেন তমোনা। আংশিক শব্দে গালে আঘাত করে বলতে লাগলেন..

— “এই শুনছো? কি হয়েছে তোমাকে? এমন করছো কেন? কথা বলো!”
রৌদ্র জুবায়ের যেন আরো শক্তহীন হয়ে পড়লেন। বাবার এমন অবস্থায় ইশরা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে তার বাবাকে ধরা উচিত না-কি ডাক্তারকে ফোন করা উচিত, হসপিটালে নেওয়া উচিত না-কি আশে পাশের কাউকে ডাকা উচিত। কিছুক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে সামান্য শক্তি সঞ্চয় করলো সে। দ্রুত পানি ভর্তি গ্লাস টা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। বাবার মাথার নিচে হাত রেখে দুই ওষ্ঠের মাঝ দিয়ে এলিয়ে দিলো পানি। খেলেন না রৌদ্র জুবায়ের। মুখের ফাঁক দিয়ে অধর গড়িয়ে গড়িয়ে পানিটুকু নিয়ে পড়ে গেল।

এই মুহূর্তে নিজেকে সবচেয়ে বেশী অসহায় লাগছে তার। তমোনার দিকে তাকালে ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। বাম হাত সামান্য উঁচুতে উঠিয়ে পাল্স রেট চেক করে নিলো ইশরা। পাল্স দ্রুত গতিতে বিট করছে।

________________

হসপিটালের করিডোরে বসে আছে ইশরা। হাত নিজের মাথায় বন্দী। নয়নজোড়া বন্দী গভীর অন্ধকারে। চোখ মেললেই গড়িয়ে পড়বে না চাওয়া অম্বুধারা। নিজেকে যথাসাধ্য শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই ভেঙ্গে পড়ছে। তারপাশে কিছুটা দূরে বসে তমোনা কাঁদছে। তাকে সামলানোর শক্তিটুকু নেই। আইসিইউর অবাধে সাধারণ কেবিনের ভেতরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সাহায্যে রৌদ্র জুবায়ের এর চিকিৎসা হচ্ছে।

উঠে দাঁড়ালো ইশরা। এগিয়ে গেল কিছুটা দূরে। হাতের মুঠোয় রাখা ফোনটা বের করে তিথির নাম্বারে ডায়াল করলো। তমোনাকে সামলানোর জন্য হলেও তিথিকে প্রয়োজন। গভীর রাত্রি হওয়াতে তিনি হয়তো নিদ্রাচ্ছন্ন। দ্বিতীয়বার রিংটোন বাজতেই রিসিভ হলো। কথা বলার শক্তিটুকু খুঁজে পেল না ইশরা। ভেতরের কান্নাগুলো‌ দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে‌। বিরবির করে দুবার উচ্চারণ করলো..– “বা-বা, বা-বা।”

বুঝতে সক্ষম হলো সে পারবে না। ফোনটা নিয়ে এগিয়ে এলো। ড্রাইভার চাচার কাছে দিয়ে ইশরায় বাবার কথা জানাতে বললো ইশরা। তিনি সবটা তমোনাকে জানিয়ে দিলেন।
মিনিট ত্রিশেক পরে হসপিটালে হাজির হলেন তিথিসহ সবাই। তিথিকে দেখে তমোনা আর হালকা হয়ে পড়লেন। তবে ইশরার নয়ন এদিক সেদিক আয়ানকে খুঁজতে লাগল। এই দুঃখ প্রাচীর সময় তার আয়ানকে প্রয়োজন। তার শান্ত্রনা প্রয়োজন। কিন্তু চোখের সেই তৃষ্ণা মিটলো না। আয়ান আসেনি। অভিমানে পাহাড় জমে গেল ইশরার। ইতিমধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সবুজ রঙের জামা পরিহিতা নার্স। মুখের মাক্স খুলে বললেন..

— “৩ নং আইসিইউর ভেতরে রেহানা নামের একজন নার্স আছে। তাকে আসতে বলবেন।”

বলেই আবার ভেতরে চলে গেল সে। ইশরা বেরিয়ে এলো নার্সকে খুঁজতে। রিসেপশন থেকে কক্ষের অবস্থান জেনে এগিয়েছে গেল সেদিকে।

প্রবেশদ্বারের বাইরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো একজন নার্স। এসে জিজ্ঞাসা করলেন..
— “কি চাই এখানে!”

— “রেহানা নামের একজন নার্সকে ওখানে খুঁজছি।”

নার্সকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় এগিয়ে গেল বাবার কেবিনের সামনে‌। মাঝপথে থেমে গেল তার চরণ। একটু আগের দেখা দৃশ্যগুলো মস্তিষ্কে সচল হয়ে উঠলো। আইসিইউর ভেতরে কাকে দেখেছে সে। এক মুহুর্ত সময় অবিলম্ব না করে একপ্রকার দৌড় ছুটে গেল সেদিকে। কাঁচের সামনে দাঁড়াতেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নজরে এলো তার। এবার অম্বুধারা আঁটকে রাখতে ব্যর্থ হলো সে। গড়িয়ে পড়লো গাল বেড়ে নিচে। বিরবির করে অধর নাড়িয়ে শব্দহীন উচ্চারণ করলো সে.. — “আ-য়া-ন।”
পর মুহুর্তেই চোখ মুছে একই জায়গায় বন্দী করে নিল সে। না তার দেখা ভুল ছিল না। ওরনার শেষপ্রান্ত দিয়ে মুছতে লাগলো কাঁচটা। বিনিময়ে গ্লাসটা আরো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। কিন্তু দৃষ্টিভোম হলো না। প্রবেশদ্বারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়লো সে। আর সহ্য করতে পারছে না। সবকিছু অগোছালো, এলোমেলো লাগছে তার কাছে।

নার্স এগিয়ে এলো ইশরার দিকে। একহাটুতে ভড় দিয়ে ইশরার দিকে ঝুঁকে বললেন..

— “ম্যাম কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?”

মাথা তুলে অবলোকন করলো ইশরাত। আঙুল তুলে আইসিইউর ভেতরে উদ্দেশ্য করে বলল..

— “আয়ান, এখানে কি করছে? কি হয়েছে ওর?”

— “উনি তো ইরেকটাইল ডিসফাংশন রোগে আক্রান্ত! তার চিকিৎসা চলছে! ছেলেটার আর তার ওয়াইফের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বিয়ের পরেরদিন ছেলেটা জানতে পারে সে ইরেকটাইল ডিসফাংশন রোগে আক্রান্ত। ভাবতে পারছেন? ছেলেটা মেয়েটাকে না জানিয়ে ট্রিটমেন্ট নিতে থাকে। লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছিলো। সাইড ইফেক্ট এর জন্য দুজনের মাঝে দুরত্ব ক্রমশ বাড়ছিলো। অবশেষে ছেলেটা সিদ্ধান্ত নেয়,পেনাইল ইনজেকশন নিবে। সেই প্রসেসটাই ভেতরে চলছে।”

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ইশরা। আয়ান এতো বড় একটা সমস্যায় জর্জরিত আর সেখানে ইশরা কিছুই জানে। তার জন্য ছেলেটা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল..– “এটা কিভাবে করা হয়?”

— “পেনাইল ইনজেকশন যেমন আলপ্রোস্টাডিল স্ব-ইনজেকশন:
এই পদ্ধতিতে, আলপ্রোস্টাডিল একটি সূক্ষ্ম সূঁচ দ্বারা পুরুষাঙ্গের গোড়ায় বা পাশে ইনজেক্ট করা হয় এবং এটি প্রায় এক ঘন্টার জন্য ইমারত বজায় রাখতে সাহায্য করে। স্ব-ইনজেকশন পাঠ প্রথমে অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের দ্বারা দেওয়া উচিত। চিকিৎসার এই পদ্ধতির সাফল্যের হার 85%হিসাবে উচ্চ। আলপ্রোস্টাডিল দুই বা ততোধিক ওষুধের সাথে মিশে যেতে পারে যা “বিমিক্স” বা “ট্রিমিক্স” সংমিশ্রণ হিসাবে পরিচিত যা একা অ্যালপ্রোস্টাডিলের চেয়ে শক্তিশালী এবং ইরেকটাইল ডিসফাংশনের জন্য আদর্শ চিকিৎসা হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতির সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে রয়েছে হালকা রক্তপাত এবং দীর্ঘায়িত ইরেক্শন (প্রিয়াপিজম)।”

আর শোনার ক্ষমতা রইলো না ইশরার মাঝে। ক্রমশ নয়নজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে তার। শরীরের ভারসাম্য হারিয়েছে জ্ঞান হারালো সেখানে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক তলিয়ে গেল অতল গভীর অন্ধকারে।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓[২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::১৯

— “মিসেস ইশরা, আমাদের পক্ষে আপনার বাবাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু..! উই আর স্যরি।”

ডাক্তার কথা শুনে বাজ পড়ল ইশরা মাথায়। শূন্য শূন্য লাগছে তার। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলল..
— “আর ঐ কেবিনের পেসেন্ট আয়ান! সে কেমন আছে?”

— “আর অবস্থাও ভালো নয়।”

মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরানো ইশরা। তমোনা ইতিমধ্যে ভেঙ্গে পড়ছে অনেকটা। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। মায়ের পাশে বসতেই উঠে পড়লেন তিনি। দমফাটা কন্ঠে বললেন..

— “ইশু শেষ করে দিলি তো, তোর বাবাকে। নিঃস্ব করে দিয়েছিস আমাকে। আমার কিছু করার থাকলে করে নে..! মেরে ফেল আমাকে। একটু শান্তিতে থাকতে চাই।”

কথাগুলো বলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছুটলেন তমোনা। ইশরা ছুটল তার পিছু পিছু। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ইশরা তার মায়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই একটা চলন্ত ট্রাক চাপা দিয়ে দিলো তমোনাকে। সাথে সাথে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিল ইশরা। দ্বি মুহূর্তে অতিবাহিত হওয়ার পর বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে তাকালো সে। এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মায়ের নিথর দেহটা রক্তে রক্তিম হয়ে আছে। বাক রুদ্ধ হয়ে গেল সে।

পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠে বসলো সে। এমন ভয়ংকর স্বপ্ন এর আগে কখনো দেখে নি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। পাল্স রেট দ্রুত গড়িতে বেড়ে চলেছে। বাম হাতের তর্জনী নিয়ে দ্রুত মুছে নিল সেই ঘামগুলো। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। স্বপ্নে দেখা ভয়ংকর দৃশ্য গুলো ভাবতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। ইশরাকে এমন বিচলিত হতে দেখে পাশে অবস্থান করে লোকটি বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো ইশরাকে। এতেও শান্ত হতে দেখা গেল না ইশরাকে। লোকটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইশরা। যতোটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরা সম্ভব ততোটা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। হাতের নখগুলো গাঢ়তম হয়ে উঠলো লোকটা পিঠে। কিন্তু সেই হাত জোড়া সরালো না সে। উল্টো নিজের দুহাত রাখলো ইশরার পিঠে। শান্তনা দিয়ে বলল..

— “কি হয়েছে, কাঁদছো কেন তুমি?”

নিজেকে সামলানোর বদলে আরো গুটিয়ে গেল সে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো এবার। টেনে টেনে বলল..

— “আমি বাঁচতে পারছি না, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমার বা-বা, আয়ান..
প্লীজ ওদের ফিরিয়ে এনে দাও। স্বাভাবিক করে দাও। প্লীজ..

এবার শোনা গেল অতিপরিচিত কষ্ঠস্বর। ইশরার পিঠে বিচরণ করে শান্তণাদায়ক কন্ঠে বলছে..

— “ইশু, এই ইশুপাখি। কি হয়েছে তোমার? কে ফিরিয়ে এনে দেবে আয়ানকে? চোখ মেলে দেখো, তোমার আয়ান তোমার কাছে আছে। তোমার বাহুডোরে। কেউ নিয়ে যায়নি তাকে। শুধু একবার আমার দিকে চোখ মেলে তাকাও।”

চিরচেনা কন্ঠস্বর যেন বুকের গহীনে কম্পন তৈরি করে দিল ইশরার। ভয়টা নিমেষেই দূর হয়ে গেল। এতোক্ষণ সে এই ডাকটার অপেক্ষাই করেছিল। ধীরে ধীরে বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে অবলোকন করলো সে। নজরে এলো আয়ানের চিবুক। সরে গেল খানিকটা। ভেজা চোখের মাঝে হাসি ফুটে উঠল তার। অসংখ্য ঠোঁটের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ করে দিল তাকে। আয়ানের জামা টেনে ঝাঁপিয়ে পড়লো বক্ষমাঝারে। ভেতরে থেকে ক্রমাগত বলে চলেছে.. — “আয়ান! আমার আয়ান।”
ঠোঁট হেলিয়ে হাঁসলো আয়ান। তার পাগলীটা তাকে ছাড়া অপূর্ণ। বলল..

— “সেটা তো বুঝতে পারলাম ইশুপাখি! কিন্তু তুমি এখানে কি করছো?”

পরক্ষণেই ঠোঁটের মিষ্টি হাসিটা মিলিয়ে গেল অজানায়। হাতজোড়া খসে পড়লো আয়ানের কাঁধ থেকে। বাবার কথা ভুলে গেল কিভাবে। অধর দুটি স্বল্প নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো.. — “বা-বা! বাবা কোথায়?”

— “ইশু কি হয়েছে আঙ্কেলের?”

আয়ানকে ছেড়ে দৌড়ে বাবার কেবিনের দিকে ছুটল ইশরা। অবশেষে পৌঁছালো সেখানে। করিডোর একদম ফাঁকা। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া ঠেকালো বাবার কেবিনের দরজায়। তখনকার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো চোখের কিনারায়। গুটিয়ে নিল হাতজোড়া। ভয়ে ভয়ে পুনরায় হাত রাখলো দরজায়। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে খুলে ফেললো। সবাই ভেতরে। ভারী ভারী পা জোড়া টেনে ভেতরে প্রবেশ করলো ইশরা। তার বাবা বেডের মাঝ বরাবর ঘুমিয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে। ডাক্তার পাশেই তার চেক আপ করছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো সে। মুখের কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর হাঁসি। ধীরে ধীরে বাবার বেডের উপর, মাথার কাছে বসে পড়লো। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মাথায়।

ডাক্তারে কথায় ধ্যান ভাঙলো তার। এপ্রোন টা খুলে ডান হাত থেকে বাম হাতে নিয়ে বললেন..– “আপনি নিশ্চয়ই তার মেয়ে?”

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো ইশরা। সাথে সাথে তিনি বললেন,..– “একটু আমার সাথে আসুন।”
বলেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন তিনি। ইশরা কেবিনে সবার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারে পিছু নিলেন।
.
চেম্বারে বসে আছে ইশরা। তিনি মন দিয়ে রিপোর্ট দেখছেন। কিছুক্ষণ রিপোর্টগুলো ভালোভাবে দেখে বলতে শুরু করলেন..

— “আপনার বাবার ব্রেন স্টোক হয়েছে। সারারণতো.. ধমনীতে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। আর মস্তিষ্কে রক্তের জোগান কমলে হয় ব্রেন স্ট্রোক। কোনো ধমনী আচমকা ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়। এই ‘সেরিব্রাল হেমারেজ’ই ব্রেন স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।
কখনো দেখা যায় কোনো কারণে ধমনী সরু হয়ে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলেও ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে, ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ‘সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস’।
প্রায় সকল রোগেরই কিছু বৈশিষ্ট্য আগে থেকেই প্রকাশ পায়। ওনারও পেয়েছিল। আপনারা হয়তো খেয়াল করেন নি। তবে তার ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়। আমার ধারণা তিনি বিগত কিছুদিন ধরে মস্তিষ্কে প্রসার দিচ্ছেন। কোনো বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করছেন।”

একশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। মাথা নিচু করে নিল ইশরা। তার বাবা তার চিন্তায় নিজের এমন অবস্থা করছেন। আর কখনো এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে তার বাবা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার বলতে শুরু করলেন..

— “গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, একবার স্ট্রোকের পর যারা বেঁচে যাচ্ছে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ।এছাড়া এক বছরের মধ্যে আরো একবার স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারেন তারা।শরীরের কোন অংশ নাড়াতে না পারা, সাধারণত তাকে পক্ষাঘাত বলা হয়।
– শরীরে যে কোনও অংশে দুর্বলতা
– অসাড়তা
– কথা বলতে বা বোঝার অক্ষমতা
– মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা
– খাবার গিলতে অসুবিধা
– দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া
– স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বিভ্রান্তি ও দুর্বল বিচারবুদ্ধি
– ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, মানসিক সমস্যা।
মিঃ রৌদ্র জুবায়ের নিজের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন বলে আমার ধারণা। বাকিটা জ্ঞান ফিরলে বলা যাবে।”

ইশরা এতোক্ষণ টু শব্দটি উচ্চারণ করলো না। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।

______________
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে অনেকটা। তমোনা মাত্র ফিরেছে হসপিটালে। মাঝখানে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তমোনাকে‌। টিফিন ক্যারিয়ার-টা পাশে রেখে ইশরার কাছে বসলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন..

— “ইশু তোর আর তোর বাবার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি! খাবার খেয়ে বাড়িতে চলে যা! একটু ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে নিস। কাল থেকে ঘুমাস নি। অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

বাধ সাধল ইশরা। ইশরা খাবার বের করতে করতে বলল..
— “মা আমি একবার বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলে তুমি বাড়িতে চলে যেও। একটু যত্ন নাও।”

নিজের খাবার বেড়ে হাঁটা দিলো আয়ানের রুমের দিকে। পেছন থেকে ডেকে উঠলেন তমোনা..

— “ইশু খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

— “এই তো এখানেই আছি।”

তমোনাসহ বাড়ির কাউকে আয়ানের ব্যাপার-টা জানতে দেয়নি ইশরা। সেও চায় না, কেউ আয়ানের দূর্বলতা সম্পর্কে জানুক।
.
.
একা একা বসে আছে আয়ান। দৃষ্টি তার জানালার বাইরে অদূরে গাছের ডালে বন্দী। একজোড়া পাখি সেখানে বসে। তাদের সাথে ছোট ছোট কয়েকটা ছানাও রয়েছে। হয়তো দিন কয়েক হয়েছে তাদের বয়স। তাদের দেখে মৃদু হাসলো আয়ান। একদিন তারও এমন একটা সংসার হবে। অনেকগুলো বেবী থাকবে। সারাদিন অতিষ্ঠ করে তুলবে তাকে। সে সবকিছু সহ্য করে নিবে। কারণ, সে সেই মুহূর্তটাকে উপলব্ধি করতে চায়। তখনই রুমে প্রবেশ করলো ইশরা। হাতে খাবারের থালা। প্লেট সাইডে রেখে ধীরে ধীরে আয়ানকে উঠে বসানো চেষ্টা করলো। সক্ষম হলো না সে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল..

— “ব্যাথা করছে, কষ্ট হচ্ছে?”

দৃষ্টি সরিয়ে নিল আয়ান। সবে কালকে অপারেশন হলো একটু সমস্যা তো হবেই। তবে ইশরা কথায় লজ্জা পেল সে। তারচেয়ে বেশি লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো ইশরা। দুহাতে মুখ ঢেকে স্মিত হাঁসলো। আয়ান বুঝতে সক্ষম হলো। দুহাত সরিয়ে নিল ইশরার মুখ থেকে! ভ্রু নাচিয়ে বলল..

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)