অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-২২+২৩

0
752

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓[২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২২

আয়ানের বুকে আঁকি ঝুঁকি করতে ব্যস্ত ইশরা। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই আঁকি ঝুঁকি করে চলেছে। আয়ান ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর তার কান্ড দেখছে। ইশরাল কাজে একগাল হেসে বলল..
— “ইশুপাখি বাচ্চাদের মতো আঁকি বুকি শেষ হলে উঠে ফ্রেস হয়ে নাও।”

এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো ইশরা। ফট করে উঠে বসলো সে। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল– “হ্যাঁ, এখন তো আমি বাচ্চাই।”
নাকে কেঁদে উঠলো ইশরা। আয়ান থামানোর চেষ্টা করলে আরো খেপে উঠলো সে। এক ঝাটকা দিয়ে নেমে গেল সে।
মিনিট ত্রিশেক পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। পড়নে মিষ্টি রঙের শাড়ি। চুলগুলো ভেজা টাওয়ালে পেঁচানো। আয়নার সামনে এসে দাড়ালো সে। চুলগুলো ভালোভাবে মুছে, টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল আয়ানের মুখের উপর। চুলগুলো আঁচরাতে চাইলে পারল না। গলায় রক্ষিত লকেটের সাথে আঁটকে গেল। আয়নাতে থাকা নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে। তার গলায় একটা চেইন টানা লকেট ঝূলছে। কানে ছোট ছোট ইয়ার রিং। হাতের অনামিকা আঙ্গুলের গোড়ায় একটা ছোট রিং। চমকে পেছনে তাকালো সে। আয়ান মোহনীয় দিকে তাকিয়ে আছে। ইশরাকে তাকাতে দেখে একদফা এগিয়ে এলো। পেছন থেকে গলার লকেট-টায় টান দিয়ে বলল..

— “আমার তরফ থেকে প্রথমবার তোর জন্য। পছন্দ হয়েছে”।

— “হম। কিন্তু পড়ালি কখন? দেখলাম না তো?”

— “তুই সারাদিন যে কুন্ম-কর্মের মতো ঘুমাস, তোকে চৌরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলেও বলতে পারবি না।”

কপাট চোখে তাকালো ইশরা। এই চাওনি অতি পরিচিত আয়ানের কাছে। এক সেকেন্ড সময় পেরুবার আগেই ইশরাকে ছেড়ে দৌড় আয়ান। ইশরা ছুটল তার পিছু পিছু। হেয়ার ব্রাশ হাতে তার। দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে..

— “একবার পাই তোকে আয়ানের বাচ্চা, তারপরে আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলব।”

— “পাগল নাকি, চিবিয়ে খেলে আস্ত থাকবো কিভাবে কিভাবে?”

_____________________
ট্রেনের আওয়াজে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম ইশরা। সাথে চরম বিরক্ত সে। ট্রেন স্টেশনে আসার সময় সন্ধ্যা ৬টা পঁয়তাল্লিশে, এখন ৭ টা ১৫। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই বললেই চলে। কিছু ক্রুটিজনিত কারণে আজকে ট্রেন সাতটা বিশে স্টেশনে আসবে এবং সাথে সাথে চট্টগ্রামে উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে।

মাথার চুলগুলো কর্ণপথের পেছনে হেলিয়ে দিল সে। আশেপাশে অবলোকন করলো, প্রথমবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসেছে সে। পড়নে তার গাঢ় সবুজ রঙের থ্রী পিছ। তার উপরে জিন্সের জ্যাকেট। তার পাশে বসে শান্ত হৃদয়ে ফোনের স্ক্রিনে টাইপিং করে চলেছে তনয়া। তার দেখে বেশ খানিকটা দূরে দুয়ানকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ দুজনে লেখনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করছে। আজকে তারা বিয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়তে চলেছে।

একদম ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় যখন সাতটা বিশ তখনই ট্রেন এসে থামলো স্টেশনে। ভিড় ভাট্টা দিয়ে এগিয়ে গেল সবাই ট্রেনের দিকে। চতুর্থ বগিতে তাদের কেবিন বুক করা রয়েছে। আঙুলের ইশারায় গুনে গুনে সেদিকে এগিয়ে গেল ইশরা। আয়ানসহ বাকিরা মালবাহী বগিতে অতিরিক্ত মাল তোলার ব্যবস্থা করছে।

ইশরা ভিড় ঠেলে ট্রেনের কাছাকাছি এসে পৌঁছালো। ট্রেনে উঠার আগেই কেউ তার শরীর ঘেঁষে ভেতরে ঢুকে গেল। আহত হলো সে। থেমে গেল চরণ। নড়ার নূন্যতম শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে সে। ওরনা টেনে শরীর ঢেকে নিল সে। অন্যদের যাওয়া জন্য উপযুক্ত জায়গা করে দিয়ে পাশে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে স্টেশন ফাঁকা হতে লাগল। ট্রেন গতিশীল হয়ে উঠল। কিন্তু ইশরা, সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ট্রেনের উঠার কোনো হেলেদুলে নেই তার মাঝে। তদানীং তার পাশে এসে দাঁড়ালো কেউ। কোমড় পেঁচিয়ে নিল শক্ত হাতে। পুরুষালি হাতের স্পর্শে নেতিয়ে গেল সে। পরক্ষণেই ভয় দূর হয়ে গেল তার। ফিরে চাইলো তার পাশে। কাঁধে মাথা রাখল সে। আয়ান আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল তাকে। আশ্বাসের কন্ঠে বলল..

— “ইশু কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? একটু কষ্ট করে উঠো,, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।”

ইশরা নড়লো না। যেন শক্ত বরফের নির্মিত কোনো পুতুল হয়ে আছে সে। আয়ান অসহায় হয়ে পড়লো‌। ট্রেন আগের তুলনায় তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন না উঠলে, আর উঠতে পারবে না। বর্তমানে ট্রেনে ওঠাতেও কিছুটা ঝুঁকি। তবুও সে এই ঝুঁকিটা নিবে। কোনো কিছু ভাবল না সে। তৎক্ষণাৎ জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লো। ইশরার কোমর ছেড়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। দৌড়ে ট্রেনের নিম্ন সিড়িয়ে পা রেখে উপরে উঠে পড়লো। সিটির আওয়াজ ভেসে এসেছিলো চলন্ত ট্রেনের বহির্ভূত থেকে। কিছুটা দূরে গিয়ে কোল থেকে নামালো তাকে। বসিয়ে দিল পাশের সিটে। নিজেও দখল করে নিল পাশের সিটটা। ইশরার মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে বলল..

— “কি হয়েছে ইশু? এমন নেতিয়ে আছো কেন? একটু আগে তো এমন ছিলে না।”

ইশরা আয়ানের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে নিল। নত স্বরে বলল..– “ঐ ছেলেটা আমার..! ব্যাড টার্স করেছে।”

মুহুর্তেই আয়ানের চোখ মুখের অবস্থা পাল্টে গেছে। কিছুক্ষণ দম মেরে চুপ করে রইলো সে। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল..– “কোন ছেলেটা?”

— “জানি না। তবে খুব বাজে ভাবে..

আর বলতে পারল না সে। ভাষা হারিয়ে গেল তার। আয়ান চুপ করে রইলো। মেয়েটাকে তার শান্তনা দেওয়া উচিত।‌ ইশরার দুগালে হাত রেখে বলল..

— “ইশু, উনি হয়তো ভিড়ের মাঝে খেয়াল করে নি। ভুলবশত এমন হয়ে গেছে।”

— “তাই বলে, প্রত্যেকবার ভিড়ের সময় আমাকে এমন বিহেবিয়ার সহ্য করতে হবে। তাও অচেনা একটা পুরুষের।”

— “আমি কখন বললাম, প্রত্যেকবার ভিড়ের সময় তোমাকে এমন বিহেবিয়ার সহ্য করতে হবে। আমি বলেছি, ভিড়ের ভেতরে এমন হয়ে থাকে। পরের বার তুমি আমার সাথে চলাচল করবে। আমি তোমাকে আগলে রাখব নিজের সাথে। যাতে কেউ ছোঁয়া তো দূরের কথা, বাজে ভাবে তাকাবেও না।”

ইশরার মুখে তৃপ্তিকর হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তার জীবনে সবচেয়ে বড় সত্য দিলো বিয়েটা। আয়ান তাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে। যত্ন নেয়। এরচেয়ে বেশি আর কি চাই তার। এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে।
.
.
ঝকঝক করে দ্রুত গতিতে ট্রেন ছুটে চলছে। চার বেডের কামড়া। জানালা দরজা বন্ধ। মধ্যে রাত তখন। ইশরা আয়ান, তনয়া আর দুয়ান। একসাথে যাচ্ছে। ইশরা মন এখন ভাড় হয়ে আছে। দরজা নক করলো কেউ। আয়ান উঠে দরজা খুলে দিল। ড্রাইভার চাচা এসেছে, রাতের জন্য হালকা খাবার দিয়ে যেতে। খাবার নিয়ে বেডের উপর রাখল আয়ান। মাথা তুলে বলল..

— “এবার ছয়তলা দিয়ে নেমে আয়।”

দুজনে নেমে এলো। রাতের খাবার খেয়ে নিলো সকলে। পূর্ণরায় উপরে উঠে গেল দুজনে। বাকি কেবিনের বাতিগুলো বন্ধ। সাথে তাদের কেবিনের বাতিও। একদম শুনশান নিরিবিলি লাগল ভেতরটা। ইশরা শব্দ করে জানালা খুলে নিল। হিম শীতল হাওয়া প্রবেশ করলো। ভ্রু কুঁচকালো আয়ান। বলল..

— “ইশু জানালা বন্ধ করে দাও, বাইরের ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

বিকট শব্দে জানালা বন্ধ করে দিল ইশরা। আয়ানের দিকে না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল সে। গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে। বন্ধ দরজা খুলে দাঁড়ালো সে। শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে ঠান্ডায় তবুও সরলো না। আরো একপা এগিয়ে গেল সেদিকে। এটাই তার প্রথম দূরের ট্রেন জার্নি। বাইরের পরিবেশটা দেখতে চাইছে সে। গাছপালা গুলো সর্বশক্তি দিয়ে পেছনের দিকে দৌড়াচ্ছে। বড় বড় ঘর বাড়িগুলোও যোগ দিয়েছে সাথে।

পেছন থেকে আয়ান এসে কোলে তুলে নিল তাকে। দরজার সিড়িতে পা দুলিয়ে বসে পড়লো সে। ভয় পেয়ে গেল ইশরা। খিঁচে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। সামান্য সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে অবলোকন করল সে। ব্যাথার্থ কন্ঠে বলল..– পড়ে যাবো আমরা।

— “পড়বো না। বিশ্বাস নেই আমার উপর।”

সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো আয়ান। মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো সে। চোখ মুখ ছোট করে বলল..

— “কোথায় যাচ্ছি আমরা।”

এবারও ঠোঁট চেপে রইল আয়ান। সে কিছুতেই বলবে না। এখন পর্যন্ত একবারও বলে নি। বলল..
— তোর স্বপ্নের রাজ্যে। যেখানে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিলি, আন্টির কাছে।

স্বনন্দে দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো ইশরা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল সে। — “থাকবো কোথায় আমরা?”

— “সিক্রেট, আর সিক্রেট বলতে নেই।”

বাইরে দেখতে মন স্থাপন করলো সে। জোনাকি পোকারা এসে অন্ধকারের মাঝে কৃত্রিম আলোর দেখা দিয়ে গেল। সেই জোনাকি পোকা এসে ধরা দিলো ইশরার হাতের করতলে। এবার তার আনন্দ যেন আকাশ ছুঁই ছুঁই। অনাকাঙ্ক্ষিত সকল ইচ্ছেরা একে একে প্রাপ্তি পেতে চলেছে। সব যেন স্বপ্নের গোলক ধাঁধা মনে হচ্ছে তার কাছে। ভেতরের দুঃখগুলো নিমিত্তে হারিয়ে গেল অজানায়।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓[২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২৩

রবির প্রথম আলো গাছগাছালি বেধ করে দিগন্তর থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আলোতে আলোতে আরো একবার সেজে উঠেছে দিনের পৃথিবী। পাখিরা কিচিরমিচির ডেকে চলেছে। সেই প্রথম কিরণ আর কিচিরমিচির শব্দ চলন্ত ট্রেনের ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। অতিশয় মিষ্টি সেই ধ্বনি। এখনো এক ধ্যানে বসে আছে আয়ান। তার কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রাচ্চন্ন হয়ে আছে ইশরা। ইশরাত নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না সে। সারারাত এমন ভাবে বসে থাকার কারণে বাম পাশ টা ব্যাথায় টনটন করছে। আয়ান সেই ব্যাথাকে আনন্দে পরিণত করে নিয়েছে। সেই রাতটা ঘুমন্ত মুখশ্রী দিকে তাকিয়ে মায়াতে কাটিয়ে দিয়েছে। আয়ান একহাত উঁচু করে হাই তুললো। ট্রেন হন দিচ্ছি। বেশিদূর পথ বাকি নেই। ধীরে ধীরে মানুষ জন জেগে উঠছে। এখন এখানে এভাবে বসে থাকা একদম নিরাপদ নয়। ইশরার গালে হাতে রেখে মৃদু আওয়াজে ডাক দিলো তাকে।– ইশু, এই ইশু।

— প্লীজ ডেকো না, ঘুমাতে দাও।
ইশরা হাই তুলে আয়ানের গলা পেঁচিয়ে আবার নিদ্রায় তলিয়ে গেল। আয়ান আবার ডাক দিলো। ইশরা এবার বেশ নড়েচড়ে উঠলো। পাশ ফেরার চেষ্টা করতেই পড়ে যেতে নিলো। আয়ান চট জলদি ইশরার কোমর জড়িয়ে সামলে নিলো তাকে। ইশরা ভয় পেয়ে গেল। নিদ্রা ভঙ্গ হলেও নয়ন এখনো অতিশয় ভীতিতে আয়ানের শার্ট খামচে ধরে আছে। আয়ান ইশরাকে নিয়ে ট্রেনের ভেতরে প্রবেশ করলো। সারারাত ঠান্ডা বাসাতে বসে থাকার কারণে শরীর হিম হয়ে আছে। সেই হিম শীতল হাতটা গালে রেখে বলল..

— “ভয় পেয়ো না ইশু, আমি যতক্ষণ তোমার পাশে আছি। তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। আই প্রমিস।”

এবার ভেতরকার সাহসে মেলে তাকালো আঁখি যুগল। এক চিলতে হাসলো সে। ততক্ষণে সূর্য আলো একটু উপরে উঠে গেছে। দুজনে দুজনার হাত ধরে এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে।
.
.
ট্রেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে থেমেছেন মিনিট বিশেক আগে। ট্রেন থেকে নামার জন্য সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছে। প্রায় যাত্রীরা নেমেও পড়ছে। শুধু আয়ানরাই নামে নি। তার কথা, ট্রেন এখন ছেড়ে দিচ্ছে না। তাই জনশূন্য হওয়ার পড়েই নামবে। কেটে গেল আরো কিছুক্ষণ। জনশূন্য হয়ে পড়লো স্টেশন। নামতে শুরু করলো তারা। একে একে মালপত্র সব নামানো হলো। স্টেশন থেকে নেমে কিছুদূর গিয়ে মাইক্রো বাসে উঠলো তারা। আয়ান আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল। স্বনন্দের এগিয়ে গেল তারা। মাইক্রো বাস এসে থামলো মাঝারী সাইজের রেস্তোরাঁর সামনে। বেরিয়ে গেল তারা। স্বল্প পরিমাণে নাস্তা করে আবার যাত্রা শুরু করলো।

আয়ানের পাশে জানালার কাছে ইশরা বসে আছে। কাঁচ খোলা থাকায় বাইরের আবহাওয়া অনুভব করা যাচ্ছে। কাঁচের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে দিল বাইরে। একটু পর মাথা বের করে দিল। বাঁধ সাধল আয়ান। ফোনে টাইম দেখতে দেখতে বলল..

— “ইশু, বাইরে মাথা দিও না। এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।” মাথা ভেতরে এনে মুখ ফুলিয়ে রইলো। কাঁচ বন্ধ করে দিল। একে একে শরীর থেকে শাল, জ্যাকেট খুলে আয়ানের হাত ধরিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকালো আয়ান। ওরনাটাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল..

— “এটা রেখেছ কেন? এটাও দাও..

বিরাগী হলো ইশরা। তীক্ষ্ম নয়নে আয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আয়ান উপরে তাকালো। বলল..

— “প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে এখান থেকে উপভোগ করো। তবুও মাথা বের করো না। তুমি যতবার এমন করো, আমার হার্ট বিট ততবার বেড়ে যায়।”

মুচকি হাসলো ইশরা। আয়ান দৃষ্টি সরিয়ে পাশে দিলো। তনয়া ইশরার মতো একই কাজ করে চলেছে। ঠাস করে চপল মারল মাথায়। ফলস্বরূপ মাথাটা আরেকটু বাইরে চলে গেল। পরক্ষণে আয়ান কান টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। তবু কান ছাড়ল না। তনয়া কান ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আয়ান না ছেড়ে বলল..

— “এদিকে একজনকে বারণ করছি শুনতে পারছিস না।
আয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগে তনয়া মুখ খুললো.. — কই তাকে তো আমার মতো মাথায় চড় মেরে, শেয়ালের মতো কান টেনে ভেতরে নিয়ে আসিস নি। যখন আমি শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবো তখন কার সাথে এমন করবি?”

আয়ান কান ছেড়ে দিলো। হাতটা তনয়ার পেছন থেকে এনে বোনকে জড়িয়ে নিল। তনয়া ভাইয়ের বুকে মাথা রাখল। চুলের ভাঁজে হাত রেখে বুলিয়ে দিল। আয়ানের ভাবতেই অবাক লাগছে, তার ছোট পুঁচকি বোনটার বিয়ে হচ্ছে। যে সারাদিন ভাইয়া ভাইয়া বলে তাকে মাতিয়ে রাখত। বোনের ক্রুটির জন্য সে মার খেতে মায়ের হাতে। ভাই বোনের মাঝে খুনসুটি হলেও কখনো কোনো চাওয়া অপূর্ন রাখে নি। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো হেঁসে উঠে। তনয়ার তখন পনেরো তম জন্মদিন ছিলো। আয়ান তার জন্য গিফ্ট কিনে এনেছিলো। একটা দামী সেল-ফোন। লুকিয়ে দিয়েছিলো। তার সেই ফোনটা তনয়ার ব্যাগ থেকে টাকা চুড়ি করে কিনেছিল। বাবা মায়ের কাছে ভয়ে বলতে পারেনি। আর আয়ানকেও কিছু বলতে পারেনি।

কথাগুলো ভাবতেই ছলছলিয়ে উঠলো আয়ানের লোচন যুগল। মাথা নিচু হয়ে এলো। তনয়া তা লক্ষ্য করলো। মুছিয়ে দিলো আয়ানের অশ্রু। সেও ভাইয়ের সাথে কেঁদে উঠলো। শব্দ করে কেঁদে উঠল দুজনে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল..

— “আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না ভাইয়া!”
ইশরা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সুন্দর উপভোগ করছে। কান্নার শব্দ কানে আসতেই নেমে গেল সে। দুই ভাই বোনকে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। সামনের সিটে বসা দুয়ানও দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কৌতূহলী কন্ঠে বলল..– “কি হয়েছে?”

— “দুই ভাই বোনের সম্পর্কটা ভাঙতেই বসছে যে,”

দুয়ানের কথা শেষ হতেই আয়ানের কাঁধে হাত রাখল। ইশারায় শান্ত হতে বলল।‌ কান্নার গতি কমে এসেছে অনেকটা। তবে এখনো তনয়া আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। আয়ান আঙুলে চুল পেঁচিয়ে টান দিলো। তনয়া কপাট লোচনে তাকালো। আয়ান আবার টান দিলো তনয়ার চুলে। তনয়া এবার চুলগুলো একহাতে ধরে আয়ানের শার্টের বোতাম ধরে টান দিলো। ছিড়লো না, তবে কিছুটা ঝুলে পড়লো।‌ আবার আরেকটা বোতাম ধরে টান দিলো। এটারও একই অবস্থা। শুধু হয়ে গেল দুই ভাই বোনের মারামারি। চুল ধরে টান দিচ্ছে এই আবার বোতাম ধরে টান দিচ্ছে। ফাঁকে আবার চিমটিও দিচ্ছে। তবে ঝগড়া শেষে আবার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে‌। দুজনের কান্ডে মুখ চেপে হাসলো তারা। আয়ানের অপর বাহুতে ইশরা মাথা রাখল। তবে একটা আফসোস হয়েই গেল। বড় ভাইয়ের অভাব। যদি তার একটা ভাই থাকতো, তাহলে এতো খুনসুটি করতে পারত।
থাকুন না একটা ভাই, যে বাবার পরের স্থানটা দখল করে নিবে। যার কাছে সকল আবদার, হাজির হয়ে যায়।

__________________ভাই ছোট হোক কিংবা বড়, আগলে রাখার দায়িত্ব তারই…
প্রতিটি ভাই তার বোনের জন্য ছায়া।
— ইফা 🌿

______________________

আটলান্টিক প্রজারের ঘাট অতিক্রম ছেড়ে আগে আরো আগে। উদ্দেশ্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সীপের তিন তলায় জায়গা হয়েছে তাদের। যে যার মতো নদী দেখায় ব্যস্ত। কেউ ছবি তুলছে। গাঙচিল ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে। কেউ আবার তাদের খাবার‌ ছুঁয়ে দিতে ব্যস্ত। নাফ নদীর উপর দিয়ে চলাচল করছে সীল। মিয়ানমারের গাছগাছারী দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এতো সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও মনটা বিষাদময় তমোনার কাছে। তার প্রিয় মানুষটি যে তার কথা সাথে বলছে না। তিনি স্বজ্ঞনে থাকলে এতো কিছুর প্রয়োজন পড়তো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। এদিকে আসার ইচ্ছে ছিলো না তার। কিন্তু ইশরার জন্য তা সম্ভব হয়নি। সে চাইছে না, তার বাবা মাকে ছাড়ে কোথায় যেতে। রৌদ্র জুবায়ের মাথা নড়তে দেখা গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে লাগলেন। তমোনা বুঝতে সক্ষম হলো রৌদ্র জুবায়ের এর পানির তৃষ্ণার লেগেছে। তিনি পানির বোতল খুলে সামান্য পানি পান করালেন তাকে। আবার পূর্বের স্থানে রেখে দিলেন। রৌদ্র জুবায়ের এর এমন অবস্থা হওয়ার পর আর হাসতে দেখা যায় নি তাকে। একটু ঝুঁকে বললেন..

— “ক্ষুধা লেখেছে কিছু খাবে?”

মাথা নাড়ালেন তিনি। তার অর্থ তিনি যাবে না। হঠাৎ করেই রংময় হয়ে উঠলেন তমোনা। ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল দু’জনের। মানুষটা বাকশক্তি হীন। তাতে কি প্রাণহীন তো নয়। তাকে দিয়েই না-হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। আচ্ছা, তার ভালোবাসার মানুষটি কি আর কখনো আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারবে না।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)