আমার হৃদয়ে সে পর্ব-০৩

0
1171

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৩

দলা পাঁকিয়ে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসতে চায়। মুখ চেপে কান্না থামাই।তারপর প্যাড বন্ধ করে প্যাডটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ওয়াড্রব থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড়গুলো বের করে তা ট্রলিতে ঢুকাই। ট্রলি হাতে নিয়ে নিচে নামি। নিচে আমার শাশুড়ি এবং রিমি আপু বসে সোফায় কথা বলতেছেন। আর টিপি পাশে বসে একা একা নিজ মনে খেলা করতেছে।কথার মাঝে শাশুড়ী মা আমার দিকে তাকান।আমার হাতে ট্রলি দেখে বলেন,

“বউমা,কোথাও যাচ্ছ?”

আমি সদৃঢ় কন্ঠে জবাব দিই,
“মা,আপনাকে কালরাত বললাম না আমি আজ একটু আমাদের বাড়িতে যাবো ওই যে ভার্সিটি থেকে আমার সার্টিফিকেটটা তুলতে…?”
“ওহ হ্যাঁ,হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে তুমিতো কালরাতই আমাকে বললে।আহারে বয়স!বয়স বেড়ে গিয়েছে তাই কিছুই মনে রাখতে পারছি না দেখছো?”

পাশ থেকে রিমি আপু বলে উঠেন,
“তোমাদের মতন বয়স্কদের এই একটা জাতীয় সমস্যা।একশোবার কোনোকিছু বললে তার খানিক পরই সব ভুলে যাও।এমনভাবে ভুলে যাও যেন ওই বিষয় নিয়ে কোনো একটা শব্দ কেন অক্ষর পর্যন্ত তুলি নি।আমার শাশুড়ি মাও তাই।রাগ লাগে।প্রচন্ড রাগ লাগে।”

“রাগ লাগার কি আছে রিমি?এটা সব বয়স্ক মানুষেরই হয়।তোরা যখন বৃদ্ধ হবি তোদেরও হবে।”
“হ্যাঁ,হবে তো জানি।তখন আবার আমরাও আমাদের ছেলেপুলেদের রাগী রাগী কথা শুনবো।তাদের রাগী লুক দেখবো।তাদের বিরক্তিতে মুখটা তেঁতো হওয়া দেখবো।ওসব ভেবে এখন ত আমার নিজের নিজেরই উপর রাগ লাগতেছে!বৃদ্ধ না হওয়ার যদি একটা পদ থাকতো ইস!”

রিমি আপুর কথায় মনের অজান্তে একটা ফিকে হাসি চলে আসে।তা দেখে,

“ভাবী হেসে না।হেসো না।দুঃখ হয় খুব!”
“দুঃখ করে লাভ নেই, আপু।জীবন এরকমই।পৃথিবীর সব জীবনই একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে।”
“রাইট স্যা।যাইহোক, তোমার লেইট হয়ে যাচ্ছে।সাবধানে যেও ভাবী।”
“আচ্ছা।”
“বউমা?”
“জ্বী,মা?”
“তোমাকে বললাম না অভিকে বলতে সে তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসতো।এখন একা এক যাবে।একা একা কীভাবে যাবে!আল্লাহর না করুক বিপদেরও ত আবার হাতপা নেই।”
“মা টেনশন করবেন না।ইনসাল্লাহ আমি ঠিকমতো যেতে পারবো।”
“আচ্ছা তাহলে যাও।রাস্তা থেকে বেরুলেই রিক্সা নিয়ে নিবে।”
“জ্বী,আচ্ছা।”

তারপর শাশুড়ী মা এবং রিমি আপুকে সালাম করে বাসার সদর পার হয়ে বাইরে এলেই আবারো আমার অক্ষিযুগল জলেতো ভিঁজে যায়।পেছনে ফিরে তাকাবার একটা টান অনুভব হয়। পেছন ফিরে তাকাই।তাকিয়ে দীর্ঘকায় বাড়িটার দিকে তাঁকিয়ে থাকি। মনের যেই আশা,স্বপ্ন,ভরসা নিয়ে এই বাড়িতে পদার্পণ করেছিলাম আজ সেসব কিছুকে মিইয়ে ফেরত আবার বাপের বাড়ি।আসলে মেয়েদের কোনো স্থায়ী বাড়ি নেই।তারা বাউন্ডুলে। বড়ই অদ্ভুত তাদের জীবন।বড়ই অদ্ভুত তাদের নিয়তি!বুকটা প্রশস্ত ভার হয়ে গেল।আর পারলাম না দাঁড়িয়ে থাকতে।তরহর আবার ঘুরে রিক্সার খোঁজে সামনে কিছুটা হেঁটে গেলাম।কয়েক কদম যেতে একটা রিক্সা পেলাম।উঠে গেলাম রিক্সাতে।

৫.
কলিংবেল চাপতে ভেতর থেকে মা এসে দরজা খুলে দেন।
ট্রলি হাতে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মার চোখমুখে একরাশ আনন্দ চিকচিক করে উঠে।আহ্লাদিত গলায় বলে উঠেন,
“আরে পারিসা?”

আমি মার এ’কথার কোনো জবাব দিলাম না।মাকে সোঁজা পাশ কেঁটে ট্রলি নিয়ে ভেতরে চলে এলাম।মা আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বলেন,
“এসেছিস অভিকে নিয়ে আসিস নি কেন সাথে?অভিকেও নিয়ে আসতিস।”

আমি এবার মার দিকে ঘুরে দাঁড়াই।চোখমুখ শক্ত করে বলি,

“মা আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না।”
“ওই বাড়িতে যাবি না মানে?কি বলতেছিস এসব তুই?”
“হ্যাঁ,আমি যাবো না!বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকেও তাই বলে দিও ”
“কিন্তু কেন?কেন যাবি না?কি হয়েছে সেটা ত বলবি!”
“কিছু না।তবে এটুকু শুনে রাখো ওই অভির সাথে সংসার করাটা আমার আর হবে না।কিছুতেই হবে না।বহুৎ সহ্য করেছি আমি।সহ্য করতে করতে আমি শেষ হয়ে গেছি।আর পারবো না।”
“কি শেষ হয়ে গেছিস?কি সহ্য করতে পারছিস না?কি বলতেছিস এসব তুই?আসলে হলোটা টা কী বলতো আমাকে?”

বললাম না।জানি মাকে বললে লাভ হবে না।এখন হয়তো আমার কথায় একটু কষ্ট পাবেনও পরে বাবা অফিস থেকে ফিরে যা বলনবেন মাও তখন বাবার তালে তালে তাই বলবেন।রুমে এলাম আমার।দরজা বন্ধ করলাম।মা দরজার ওপাশ থেকে বারকয়েক খটখট করে পরে আর লাভ না হয়ে আশা ছেড়ে দেন।আমি ট্রলি ব্যাগটা টেবিলের পাশে রেখে বিছানার উপর যেয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসি।খুব অস্বস্তি হচ্ছে জানি না বাবা অফিস থেকে ফিরে কেমন রিয়েক্ট করেন।আমার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা।
৬.
রাত আঁটটার দিকে বাবা বাসায় ফিরেন।মা যেয়ে দরজা খুলে দেন।আমি জানি এখন বাবা আমার রুমে আসবেন।বাবা বাসায় ফেরা মাত্রই মা যে আমার কথাটা না তুলে থাকবেন না তা আমি নিঃসন্দিহান।হলোও তাই।কিছুক্ষণ পরই বাবা দরজায় করাঘাত করে।আমি নেমে দরজা খুলে দিই।দরজা খোলামাত্রই বাবা ঘর্মাক্ত মুখে বলে উঠেন,

“তোমার মা বললেন তুমি নাকি অভির ঘরে আর যাবে না।তোমার মা কি ঠিক বললেন তা?”

আমি একফোঁড় মার দিকে তাঁকিয়ে নিয়ে মাথা নুইয়ে এবার বাবাকে জবাব দিই,
“হ্যাঁ।”
“কেন?”

চাইলাম বাবার সামনে নিজেকে খুব শক্ত রাখতে চোখের পানি তা আর দিলো না।পানিতে ভরে উঠলো চোখজোড়া।তা দেখে বাবা বলেন,
“তোমাকে কাঁদতে বলিনি।তোমাকে আমার কথার জবাব দিতে বলেছি!”

শাড়ির আঁচল খাঁমচে শক্ত করে ধরে বার কয়েক জোরে শ্বাস নিই।তারপর নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিয়ে বলি,

“বাবা,অভিকে তোমরা যেরকমটা ভেবেছো অভি সেরকম নয়।অভির সাথে আজ আমার সাংসারিক জীবনের আঁটমাস শেষ হলো এই আঁটমাসের মধ্যে সে আমার সাথে কখনো ভালোমতো কথা বলেনি।আমাকে ইগনোর করে চলেছে।যদি প্রয়োজন হয় নিজের প্রয়োজনে আমার সাথে কথা বলে।আর না হলে বলে না।বলতে গেলে সে আমার সাথে কোনো কথা বলতেই চায়না।আবার যদি কোনো ভুল করি ওমনি আঙ্গুল তুলে কটু কথা বলে।চিল্লাপাল্লা করে।এমনকি পরসু রাতে আমার গাঁয়ে সে হাত পর্যন্ত তুলেছে।আমি তার সাথে কখনো ই মিসবিহভ করিনি।সবসময় তার কথা মতনই চলেছি।এতকিছুর পরও সে আমার সাথে এরকম করে আসতেছে।সে আমাকে কখনো তার স্ত্রীর অধিকার দেয়নি ।আমি যে তার স্ত্রী।তার উপর যে আমার অধিকার আছে তা সে ভুলেই গেছে।বলতে পারো তার যে স্ত্রী আছে সে তা মনে করতেই চায়না।”

আমার কথাগুলো শুনার পর চোখমুুখ শক্ত করে ফেলেন।ঢগায় এসে পড়া চশমা টা চোখ থেকে খুলে হাতে নেন।চোখের কিণার কাণার তীব্র কুঁচকে এনে বলেন,

“বিয়ের আজ আঁটমাস শেষ হলো।এতটা মাস পর তুমি আজ আমাকে বলতে এসেছো অভি তোমার সাথে মিসবিহেভ করেছে?সে কখনো তোমাকে স্ত্রীর অধিকার দেয় নি?তুমি এখন তার বাসায় আর ফেরত যাবে না!তুমি কি ভেবেছো?তোমার এসব কথা আমরা বিশ্বাস করবো, পারিসা?অভিকে আমি হান্ড্রেডে হান্ড্রেডে চিনি।অভি ওরকম ছেলের মধ্যেই পড়ে না।তুমি নাটক সাঁজাচ্ছো সব!কারণ তুমি বিয়ের সময় আমাকে দমাতে পারো নি।তাই এখন বিয়ের পর চেয়েছো কীভাবে অভির দোষগুলো ধরে অভিকে দমিয়ে তার ঘর থেকে ভার্সিটির ওই হ্যাং ছেলেটার হাত ধরে তারসাথে আবার ফষ্টিনষ্টি করতে পারো।তাই না?”
“বাবা বিশ্বাস করো সেরকন কিছু না।আমি সত্যি বলছি।বিশ্বাস করো বাবা।”
“বিশ্বাস করতাম।কিন্তু তুমি আঁটমাস পরে এসে আমাকে অভির দোষ দেখাচ্ছ তা শুধু অবিশ্বাস নয় তোমার কথাশুনে ত হাসি আসতেছে।আমি আর কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।যেভাবে এসেছো সেভাবে ভদ্র মেয়ের মতন ফিরে যাও।অভির যাতে আমাকে কল না দিতে হয়।অভি যদি তোমার ব্যাপারে আমাকে কল দেয় তাহলে আমার রাগ সম্পর্কে ত তোমার ধারণা আছে তাই না?”
“আমাকে বিশ্বাস করলে না,না?এই জন্যেই ত তোমাদের আঁটমাস ধরে অভির ওইরকম ব্যবহারের কথা তোমাদের বলিনি।কারণ আমি জানি তোমরা কখনো আমার কথা বিশ্বাস করতে না!”
“শেষ হয়েছে তোমার কথা?শেষ হলে তাড়াতাড়ি ফিরে যাও।”

মা পাশ থেকে বলেন,
“যাবে ঠিক আছে এখন ত রাত।মেয়ে এতরাতে একা একা কীভাবে যাবে।আজ থাকুক।কাল যাক।”

বাবা মার কথার পিঠে আর কিছু বললেন না।অগ্নিশর্মা চোখ মার দিকে তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিজের রুমের দিকে চলে যান।বাবা চলে যাওয়ার পর মা বলেন,
“তোর বাবা রাগ করলে করুক,পারিসা।তুই কাল যাস।”
“আমি আর কখনোই যাবো না।ওই আশা ছেড়ে দাও।”

বলে আমার রুমে চলে এলাম।

চলবে…