#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৭
“বিয়েটা পুতুল খেলা নয়!”
“জীবনটাও!”
আমার কথা শুনে অভি যেন কিছুটা অবাক হবার মতন তাকালো।পরক্ষণে চোখমুখ স্বাভাবিক করে বাম পাশের ভ্রু টা উঁচিয়ে আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে বললো,
“জীবনটা কি আমার সাথে ডিভোর্স করার পর বুঝবে!”
এ’কথার পিঠে হালকা হাসলাম।এই ছন্নছাড়া হাসির মাঝে লুকিয়ে রাখলাম আকাশসম বিস্ময়ের আঁশ।অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললাম,
“জীবন কারো জন্যে থেমে থাকে না!”
২৪.
দুইদিন পার শেষ হলো আজ!আমি অন্যদিনের মতন আজও চুপচাপ বসে আছি চারকোণা রুমের কোণার বিছানাটায়।দুপুরের শেষ লগ্নে খালামণি শেষ করে রুমে ঢুকেন। আমার কাছে আসেন!মাথায় হাত রাখেন।বলেন,
“মন খারাপ?”
আমি এবার নড়ে উঠলাম।এতক্ষণে খেয়াল হলো খালমণি আমার রুমে।হালকা হেসে বললাম,
“নাহ।মন খারাপ কেন হবে?”
খালামণি আর ঘাটলেন না।যদিও বুঝেছেন আমি মিথ্যে বলেছি।সারা রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এবার আবার দিকে তাঁকিয়ে বলেন,
“ডিসিশন নেওয়া শেষ?”
“কিসের ডিসিশন?”
খালামণি একটু ধাতস্থতা হলেন।তারপর আবার স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললেন,
“নাহ মানে,ওদিন অভির বাবা যে আসলো উনাকে ডেট …!”
খালামণির পুরো কথা শেষ না করতে দিয়ে বলে উঠলাম,
“তা টেবিলের উপরেই আছে।”
“বুঝলাম না।”
“মানে টেবিলের কাছে গেলেই দেখবে একটা কাগজ।আর সাথে একটা চিঠিও আছে।”
খালামণি আমার কথা যেন বুঝতে পারলেন না।কাপল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন।পরক্ষণে কুঁচকে ভাবটা মসৃণ করে আমাকে আর কিছু না জিজ্ঞেস করে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন!টেবিলের কাছে যেতে দেখলেন টেবিলের উপর একটা কাগজ পড়ে আছে।তিনি কাগজটা হাতে নিলেন।কাগমের মোড়কটা সরালেন।কাগজের উপর চোখ বুলাতেই চোখজোড়া মার্বেলের মতন বড় করে ফেললেন।বললেন,
“ডিভোর্স পেপার!তোর সই!অতঃপর অভিকে ডিভোর্স দিয়ে ফেলবি?”
আমি আবারো হাসলাম।বললাম,
“খালামণি,তুমিও শেষে চাইছিলে অভিকে ক্ষমা করে দিতে, তাই না?হ্যাঁ,আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম অভিকে আর একটাবার সুযোগ দিব।কিন্তু দুইদিন আগে অভি সন্ধে শেষবার আমার সাথে দেখা করার পর তার একটা কথায় তাকে ক্ষমা করার ভাবনটা আমার মাথা থেকক সাথে সাথে উবে গেলো!তার আসল চরিত্রটা তখনই সামনে চলে এলো!”
“মানে?কী বলেছে সে?”
“উত্তর চিঠিতে!”
খালামণি ডিভোর্স পেপারটা নিচে নামিয়ে তরতর করে চিরকুটটা হাতে তুলে নেন,
“মিস্টার অভি?এতক্ষণে নিশ্চয়ই ডিভোর্স পেপারটা হাতে পেয়ে গেছেন!আপনি আমার সাথে আপনাদের বাসায় যে বিহেভ করেছিলেন তারথেকে সবথেকে নিকৃষ্ট বিহেভ হলো আমার গাঁয়ে হাত তুলেছেন!আপনার ওই অবিশ্বাসের ব্যাপারটাতে আমি ওতটা চাপ ক্রিয়েট করি নি।জানেন কেন?আপনার সেদিন ওকথাগুলে আমি পুরোপুরি না হলেও কিছুটা বিশ্বাস করেছি। আপনি বলেছিলেন আপনি আমাকে ভালোভাবে জানেন না।শুনেন না।সেই তাকে নিয়েই খারাপ ইস্যু শুনেছেন।এটা সাডেন একজন নতুন বউয়ের প্রতি নতুন বরের মনে কতটা আশানুরূপ হতে পারে তা খুবই কষ্টকর!হ্যাঁ, আমি আপনার ওই কথাগুলো আপনার জায়গা থেকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।তাই বলে এই নয় যে আপনি ওই একই কথাতে নেচে যাবেন।নেচে তো গেলেন ই।আপনি পরে আবার সেই কথার জাস্টিফাই করার চেষ্টাই করেননি!মানুষের এত রাগ কীভাবে হয়,মিস্টার অভি?এই যে সেই অবিশ্বাসে আমার সাথে কখনো প্রয়োজনতিরিক্ত কথা বলেননি।আবার গাঁয়ে হাত পর্যন্ত তুলেছেন।গাঁয়ে হাত তুলে কত টা যে নিকৃষ্ট পশুর পরচয় দিয়েছেন তা নিজেও জানেন না!যাক ওসব বাদ!আপনি অতঃপর সত্যটা সব জানলেন!তারপর আবার বিশ্বাস করলেন।।ছুটে চলে এলেন ক্ষমা চাইত!আমি ক্ষমা করিনি।এই নিয়ে আপনার মা,বাবা,বোন এবং বাবাকে একে একে আমার কাছে পাঠানো শেষ করেছেন!এরসাথে আপনার আমাকে অসংখ্য”সরি সরির” মেসেজ তো আছেই এবং ফোনকলও!জানেন আপনার এসবেতে আমি তখন কিছুটা নরম হয়েছিলাম।বার বার ভেবেছিলাম আপনাকে আসলেই একবার সুযোগ দেওয়া যায় কি না।কারণ মানুষ মাত্রই ভুল।মানুষ ভুল করতেই পারে।তাই বলে পরে আবার ভুল করবে এটা তো কোনো কথা না!নাহ অভি সেরকম না।সে ভুল করবে না।সে যতটা নরম,যতটা তার আত্মসমর্পণ,যতটা আত্মাসম্মাম হীন হয়ে গেছে সত্যিই সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে!কিন্তু আমার ভাবনাকে আপনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে শেষবার আমার সাথে আপনার বাবা বাসায় ফিরে যাবার পর সন্ধে যে আমার সাথে দেখা করলেন, সেই সাক্ষাৎকারে আপনার সবথেকে “জীবনটা কী ডিভোর্স করার বুঝবে!”এই একটা কথাই আপনার সবকিছু প্রমাণ হয়ে গেলো।আপনি সেই আগের অমানুষটা অমানুষই।কখনোই আর ঠিক হবেন না!সংসারে আবার গেলেও আপনার সেই ইগো,সেই এটিটিউড থাকবেই। তাই বলে এটা বলবেন না যে আমি এই কারণে আপনাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছি।ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছি এই কারণে আপনি মানুষটা আসলে ই মনের দিক দিয়ে একদমই ভালো নেই।আর যে মনের দিক দিয়ে ভালো না তার সাথে সংসার করার কথা পারসা ভাবতেই পারে না!আপনার যেমন ইগো,ভাব,মুড আছে।মিস্টার অভি?এই পারিসা খুব ছোট্ট?নাকি এই পারিসা খুব তাচ্ছিল্যকর আপনার কাছে?”
খালামণি পুরো চিঠিটা পড়া শেষ করে আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকলেন!কি বলবেন নিজেই বুঝতে পারছেন না!নিজেকে শান্ত করতে খানিকক্ষণ সময় লাগলো।শান্ত হলে ডিভোর্স পেপার এবং চিঠিটা আবার আগের জায়গা রেখে আমার কাছে এলেন।বললেন,
“ভেরী আপসেট!শেষপর্যন্তও ও তার আসল রূপটা দেখিয়ে দিলো?বুঝি না এরা কীভাবে পারে সব পরিস্থিতিতে নিজেদের এটিটিউড টানতে?টানার আগে একবারও ভাবে না এইতো তার আসল রূপ বেরিয়ে এলো?তবে অভি তোর কোনোদিক দিয়েই যোগ্য না!যাইহোক,এ নিয়ে আর মন খারাপ নয়।ইনশাআল্লাহ! সামনে যা হবে ভালোই হবে।আল্লাহর উপর ভরসা রাখ মা।আর একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে আই হোপ সেই কনফিডেন্সটা তোর আছে।”
বলে খালামণি এবার থামেন।তারপর দুই তিন সেকেন্ডস চুপ থেকে বলেন,
“তোর মা-বাবাকে জানিয়েছিস এই ব্যাপারটা?”
দুই পাশে মাথা নাড়লাম!
“কেনো জানাস নি?জানিয়ে দে।”
“দিব।আজ রাতের মধ্যেই জানিয়ে দিয়ে কাল সকালে পাঠিয়ে দিব।”
“যেটা ভালো মনে হয় তোর।’
বলে তাকিয়ে থাকেন।তারপর ব্যস্ত হয়ে বলেন,
“থাক উঠলাম।”
আমি খালামণির হাতটা ধরে রাখলাম।খালামণি হাতের দিকে তাঁকিয়ে আবার মুখের দিকে তাকালেন।আমার চোখমুখ ক্রমশ কুঁচকে আসতে থাকে।এই বুঝি কেঁদে ফেললাম।আমি এক সপাটে খালামণিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম।মনপ্রাণ উজাড় করে কাঁদতে থাকলাম।খালামণি আমাকে শান্ত করতে উঠে পড়তে লাগলেন।কিন্তু আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারলাম না।ভেতরের সবকিছুকে দমিয়ে উচ্চ আওয়াজে কান্নামুখরে
শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এলো,
“খালামণি,আমিতে আগে স্বপ্ন দেখতাম আমার এক ভাত,এক কাপড়ে যেতে।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এটা আজ কী হলো?!কী হলো?!
২৫.
ডিভোর্স লেটার পাঠানোর একঘন্টা বাদেই অভির মার কল!কল দিয়েই কেঁদে উঠলেন।
“এটা কী করলে,পারিসা?কী করলে?আমাকে পর করে দিলে?তোমাকে ছাড়া যে আর ভালো থাকতে পারবো না।”
বলে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।নিজেকে শক্ত করলাম।চোখখিঁচে বললাম,
“আই’ম সরি,মা!আমার আর কিছুই করার ছিল না।”
অভির মা আর কিছু বললেন না।শুধু কেঁদে চললেন।অভির মার থেকে মনে হয় অভির বাবা ফোন কেঁটে নেয়।বলে,
“একদম ঠিক করেছো পারিসা!সত্যি কথা জানো কি
এ তোমার কোনোকালেই যোগ্য না!ও এর এটিটিউডের জন্যে দেখবে একদিন সব হারিয়ে ফেলবে!সব।ইভেন আমাদেরও !”
বলে আঙ্কেল চুপসে যান।অভির মারও ওপাশ থেকে আর কান্নাকাটির আওয়াজ পাই নি।ফোনটা আমি কানের কাছে ওভাবে ধরেই রাখি!ধরে রাখতে রাখতে কলটা কেঁটে যায়!কল কেঁটে যাওয়ার আধা ঘন্টা পর সেই নাম্বার থেকে আবার কল আসে।তবে এবারের কলার অভির মা এবং বাবা নয়।স্বয়ং অভি নিজেই,
“ডিভোর্স দিয়ে খুব বড় হয়ে গিয়েছো!”
চলবে…..