সুখের পাখি পর্ব-৫৫

0
768

#সুখের_পাখি

৫৫
শো শেষ করে ইহান গাড়িতে এসে বসল। হারুন ওর পাশে বসে ওকে লক্ষ করছে। ইহান বলল,

–‘পানির বোতলটা দাও তো।’

হারুন এগিয়ে দিল। ইহানকে সে কিছু বলতে চাচ্ছে।

–‘স্যার!’

–‘স্যার স্যার না করে কথাটা বলে ফেলো হারুন।’

–‘আজ আপনি এত সুন্দর করে সবার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। কারো কোন কথায় একটুও রাগলেন না। ধৈর্য ধরে পুরোটা সময় মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনলেন…’

–‘হারুন, আজকে যে আমি এইখানে আসতে পেরেছি তা কাদের জন্য? আমাকে স্টার বানানোর পেছনে কাদের হাত আছে? ওরা আমাকে কেন এত ভালোবাসে বলো তো? আমি কি ওদের কাউকে চিনি? না, না? তারপরও ওরা কেন পাগলের মতো আমাকে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে? যে মানুষ গুলো কোন স্বার্থ ছাড়াই আমাকে ভালোবাসা দিচ্ছে। আমাকে পছন্দ করছে। ওদের জন্য যতটুকু সম্ভব আমি করব। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কিছু মানুষের আচরণে আমি বিরক্ত হই। তাই বলে সবাইকে তো এক কাতারে ফেলতে পারি না। হাতেগোনা কিছু সংখ্যক মানুষ হয়তো আমাকে পছন্দ করে না। তাদের জন্য আমি আমার বাকি ফ্যানদের দূরে ঠেলে দিতে পারব না।’

ইহানের কথা শুনে হারুন মুগ্ধ হয়ে গেল। স্যারকে সে চার বছরেও চিনতে পারেনি। স্যারের বাইরেটা যতই কঠিন হোক। বুকের ভেতর মনটা ভীষণ কোমল।

–‘স্যার আপনার বন্ধু সৌরভ, উনার কন্টাক্ট নাম্বার পেয়েছি। এখন কথা বলবেন?’

–‘না। নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ করে রাখো। সৌরভ ছাড়াও আরও দু’জন আছে। আরাফাত, নাফিজ। কারো সাথেই আজকাল যোগাযোগ নেই।’

ইহান বাড়ি যাচ্ছে। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেলে ইহান সোজা হয়ে বসল,

–‘তোমাকে একটা কারের কথা বলেছিলাম। ব্যবস্থা হয়েছে?’

–‘জি স্যার। আপনার কথামতো উনার পছন্দের বিএমডব্লিউ। এতক্ষণে হয়তো বাড়িও পৌঁছে গেছে।’

ইহান হাসল। অ্যাক্সিডেন্ট করে আহানের বাইক ভাঙ্গারি বানিয়ে ফেলেছিল ও। মা’কে কথা দিয়েছিল, তার টাকা হলে একদিন আহানকে বাইক ফিরিয়ে দিবে। তার কথা রাখছে সে। বাইকের বদলে কার দিচ্ছে। শোধে আসলে ফেরত।
ইহান বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া অনুভব করছে। গাড়িটা পেয়ে আহানের কী প্রতিক্রিয়া হয় দেখতে চায় সে। আহানের মুখটা চোখের সামনে ভাসতেই হাসি পাচ্ছে ওর।

আহান বাড়ির সামনে বেরিয়ে হতভম্ব। মিডিয়ার লোকেরা নতুন একটা গাড়িতে ঘিরে ধরে নানান নিউজ করছে। তাকে বের হতে দেখতে পেয়ে এক ঝাঁক মৌমাছি যেন মধু খাওয়ার জন্য ছুটে আসছে এদিকে। আহান ভয় পেয়ে গেল। ভেতরে দৌড় দিবে নাকি সে?
ক্যামেরা ম্যানের সাথে রিপোর্টার নিউজ করছে,

–‘দর্শক আপনারা দেখতে পাচ্ছেন কিছুক্ষণ আগেই ইহান তার বড় ভাই আহানকে একটা বিএমডব্লিউ কার গিফট করেছে। আপনারা বুঝতেই পারছেন ইহান ওর ভাইকে কতটা ভালোবাসে। যার কারণে ভাইকে খুশি করতে…

আহানের কপাল কুঁচকে গেল। কে কাকে গিফট করেছে? কিসের গাড়ির কথা বলছে ওরা। ইহান তাকে গিফট করেছে? কই সে তো কিছুই জানত না।

–‘দর্শক আমরা এখন মিস্টার আহানের কাছে চলে যাব। আপনাদের সাথে উনার অনুভূতি শেয়ার করব। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, মিস্টার আহান এই মুহূর্তে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সো মিস্টার আহান, ছোট ভাইয়ের থেকে একরকম একটা গিফট পেয়ে আপনার কেমন লাগছে?’

ঘুসি মেরে মহিলার মুখ ভেঙে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে আহানের। এদের যতসব ফালতু নিউজ। আহান রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই গেট দিয়ে ইহানের গাড়ি এসে ঢুকে। ইহানের গাড়ি দেখে সবাই ওকে ছেড়ে ওদিকে ছুটতে থাকে। আহান হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে ইহান মুখে হাসি নিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে গাড়ি থেকে নামলো। সবাই ওকে ঝেঁকে ধরেছে। সে মহা আনন্দে হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে। আহান অবাক হয়ে গেল। ইহানটা কীভাবে পারছে! ওর এত ধৈর্য কোত্থেকে এলো? আগে তো ছোট থেকে ছোট কথাতেও ওদের হাতাহাতি লেগে যেত। ইহানটা সত্যিই পাল্টে গেছে। আহান যেন নতুন কোন ইহানকে দেখছে।
হারুন ভিড় ঠেলে ইহানকে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু মানুষ গুলো জায়গা দিলে তো! পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

–‘ইহান একটু আগে আমরা জানতে পেরেছি আপনি আপনার ভাইকে একটি গাড়ি গিফট করেছেন। তা কী উপলক্ষে এই গিফটটি দেওয়া? আজ কি উনার জন্মদিন? বা বিশেষ কিছু।’

ইহান হেসে জবাব দিল,

–‘না। সেরকম কিছুই না। ওর জন্মদিন ফেব্রুয়ারিতে। আজ কোন বিশেষ দিন না।’

–‘তাহলে?’

–‘ও আমার ভাই। ভাইকে সারপ্রাইজ দিতে কোন বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় নাকি?’

–‘ না। তা অবশ্য অন্য কথা। দর্শন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ইহান তার বড় ভাইকে কতটা বেশি ভালোবাসে। যার কারণে কোন উপলক্ষ ছাড়াই। শুধুমাত্র ভাইকে খুশি করার জন্য…

ইহান মনে মনে গালি দিল। ‘গাধা!’ ভালোবাসা! তার আর আহানের মাঝে? কবে ছিল? বা কখন জন্মদিন এই ভালোবাসা?
ইহান ওদের সবাইকে ছাড়িয়ে মেন ডোরের সামনে এসে আহানের সামনে পড়ল। আহান কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,

–‘এইবার এটা কোন নতুন নাটক?’

–‘নাটক হবে কেন? আমি তো মুভি বানানোর কথা ভাবছি। ওসব ছোট বাজেটের নাটক আমাকে মানাবে না।’

–‘কিসের গাড়ির কথা বল…

–‘গিফট।’

–‘কার জন্য? আমি তোর কাছে গিফট চেয়েছি?’

–‘ও মা! চাইবি কেন? গিফট কি কেউ চেয়ে নেয়? এটা আমি খুশি হয়ে তোকে দিয়েছি।’

–‘তোর দেওয়া কোন জিনিস আমার লাগবে না।’

–‘রেখে দে। এটা তোর ওই খাটাড়া বাইকের বদলে। যেটা ভেঙে ফেলেছিলাম বলে বিদেশে বসেও তুই চিল্লাপাল্লা করেছিলি। পাঁচ বছর পর দিলাম বলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বেড়েছে।’

আহান কিড়মিড় করে বলল,

–‘আমাকে টাকা দেখাচ্ছিস তুই? তোর টাকার গরম সবার সাথে চললেও আমার সাথে দেখাতে আসিস না।’

ইহান বাঁকা হেসে বলল,

–‘জেলাস ফিল করছিস নাকি?’

বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল ইহান। মা’কে ডাকতে লাগল ও।

–‘মা। ও মা… এদিকে এসো না। পুরো ছয়টা দিন তোমাকে দেখিনি। কোথায় গেলে।’

আহান ইহানের নাটক দেখছে। পাঁচ বছরে এটার নাটক পাঁচশো গুণ বেড়েছে। এটার তো সিঙ্গার না হয়ে অ্যাক্টর হওয়া উচিত ছিল। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ওভার এক্টিংয়ে ঠাসা।
মায়ের হাতের রান্না খেতে খেতে ইহান বলল,

–‘মা, তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। তোমার রান্নাটা বড় মিস করি।’

সাবিনা শক্ত গলায় বলল,

–‘আমি কোথাও যাব না। এটা আমার বাড়ি।’

ইহান মায়ের দিকে দেখল। হেসে বলল,

–‘ঠিক আছে। তোমার বাড়িতে চলে আসব তাহলে। জায়গা দিবে তো আমাকে?’

সাবিনা খুশিতে ঝলমলিয়ে ইহানের দিকে তাকাল।
ইহান সত্যি বলছে নাকি মজা করছে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

–‘কী দেখছ অমন করে? তুমি না করে দিলে আসব না।’

ছেলের উপর থেকে সাবিনার সব রাগ চলে গেল। ইহান বাড়ি ছেড়ে থাকে বলে সে রাগ করে ইহানের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিল।

–‘আমি তোকে না করব! বলতে পারলি তুই!’

মায়ের অভিমান ভাঙাতে নিশ্চুপ হাসল ইহান।

–‘হ্যাঁ রে, বাড়ির সামনে থেকে তোর এই মৌমাছি গুলোকে তাড়া না বাবা। আমার তো আর ভালো লাগে না। সারাক্ষণ একঝাঁক মানুষ সামনে পেছনে নিয়ে ঘোরা আমার মাথা যন্ত্রণা করে।’

–‘হু। ওদের কোন ব্যবস্থা করতে হবে। দেখি, কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে দেখছি আমি।’

–‘তুই কক্সবাজার যাবি কেন? কবে যাবি?’

–‘আজ যাব মা। প্রোগ্রাম আছে। এখান থেকে ফিরেই এয়ারপোর্টে ছুটতে হবে। রাতে ফ্লাইট।’

সাবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

–‘তনুটা চলে যাবার পর আমার সংসারটাও কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। আহান ফিরেছে ঠিকই। তুই বাড়ি থাকিস না। ফুলিটাও চলে গেল। বাড়িতে একটা মেয়ে মানুষ নেই। একা এই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’

তনুর কথা উঠতেই ইহান কেমন হয়ে গেল। মা’র সাথে নিশ্চয় তনুর কথা হয়? তনু তার কথা মা’কে জিজ্ঞেস করে? কবে ফিরবে ও? মা হয়তো জানে। ইহান নিজেকে কঠিন করল।

–‘ কাল রাতেও তনুর সাথে আমার কথা হয়েছে। ও আ…

–‘মা, আমি উঠব।’

–‘খাওয়া শেষ তোর! কিছুই তো খেলি না।’

–‘অনেক খেয়ে ফেলেছি মা।’

–‘খাওয়ও মা। ভালো করে খাওয়াও। ছেলেকে খাওয়াতে না পেরে তুমি তো কষ্টে মরে যাচ্ছিলে।’

আহান ওদের কথার মাঝে এসে টিপনি কাটল। ইহানকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

–‘তোমাকে নিয়ে একটু বের হবো মা। তোমার ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করো।’

–‘কোথায় যাবি?’

–‘মা ছেলেতে মিলে ঘুরব। তোমার না একা একা বাড়িতে ভাল লাগে না।’

আহান ইহানকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করেই ওর সামনে কথাগুলো বলছে। ইহান এখানে থাকে না। মা’র সাথে আহানের বেশি ভাব ইহানকে এটাই বোঝাতে চায় সে।

–‘তনু যেন কবে ফিরবে মা?’

আহানের মুখে তনুর নাম শুনে ইহানের রাগ হচ্ছে। তনুকে তো দেখিসও নি তুই। তাহলে এত ভালোবেসে তনু নামটা মুখে নিচ্ছিস কেন?

–‘আসার কথাই বলছিল। কবে আসবে…

–‘মা আমি যাই।’

ইহান তাড়াতাড়ি কথাটা বলে দাঁড়িয়ে গেল। আহানের প্রতিক্রিয়া দেখে মজা নিতে এসেছিল ও। এখন নিজের প্রতিক্রিয়া সামলে রাখতেই কষ্ট হচ্ছে।
সন্ধ্যায় ইহান এয়ারপোর্টে পৌঁছুলো। ও আর হারুন কক্সবাজারের জন্য রাতের ফ্লাইট ধরল।

তনু ট্রলি হাতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো। পাঁচটা বছর পর নিজের দেশে ফিরেছে ও। দেশে ফিরায় যেমন খুশি খুশি লাগছে তেমনই ইহান ভাইয়ের সামনে যেতে হবে ভেবে বুক পুড়ছে। পাঁচ বছরে সে নিজেকে অনেকটা শক্ত করেছে। তবে যতই সে ইহান ভাইয়ের খোঁজ না নিক, এত বছর পর মানুষটাকে চোখের সামনে দেখলে তার সবকিছু উলটপালট হয়ে যাবে না? এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সে কি এক মুহূর্তের জন্য ইহান ভাইকে ভুলতে পেরেছে? ফুপু আম্মার বাড়ি ছাড়া যাওয়ার মত তো তার আর কোন জায়গাও নেই। এই শহরটা অনেক বড়। এখানে অনেক মানুষের বাস। কিন্তু তাদের মাঝে তার আপন কেউ নেই। ওই কয়েকজন মানুষই তার আপন। তনু ফুপুকে জানিয়ে আসেনি। বলেছিল সে আসবে। কিন্তু আজ যে আসবে এটা বলেনি। যাক একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। ফুপু আম্মা নিশ্চয় তাকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলবে। তার উপর এই মানুষটার অনেক দয়া। ফুপু আম্মার ঋণ তনু কখনও শোধ করতে পারবে না। বাবা মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিল, তোর ফুপুকে কখনও কষ্ট দিস না মা। এমন কোন কাজ করিস না যাতে এই মানুষটা কষ্ট হয়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আনমনে তনু হেঁটে যাচ্ছিল। পেছন থেকে একটা গলা শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। পরিচিত একটা কন্ঠস্বর তার নাম ধরে ডাকছে।

–‘তনু! এই তনু! তুমি তনু না? হ্যাঁ তনুই তো…

তনু কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেও অতি দ্রুত নিজেকে সামনে নিল। না এখানে দাঁড়ানোর কোন মানেই হয় না। আবার হাঁটতে লাগল সে।

–‘আরে এই, তনু! আমাকে চিনতে পারছ না তুমি? আমি…

চলবে🍂
#জেরিন_আক্তার_নিপা