সুখের পাখি পর্ব-৫৬

0
751

#সুখের_পাখি

৫৬
তনু কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেও অতি দ্রুত নিজেকে সামনে নিল। না এখানে দাঁড়ানোর কোন মানেই হয় না। আবার হাঁটতে লাগল সে।

–‘আরে এই, তনু! আমাকে চিনতে পারছ না তুমি? আমি শান্তি।’

শান্তি ছুটে এসে তনুর হাতের কনুইয়ের কাছটা ধরে টান দিল। হঠাৎ এভাবে তনুর সাথে দেখা হবে ভাবতেই পারেনি সে। তনুকে দেখে এই মুহূর্তে শান্তি ভীষণ খুশি হয়েছে। তার ছেলেটা মা’কে ওরকম ছুটতে দেখে নিজেও দৌড়ে এলো। শান্তি খুশি খুশি গলায় জিজ্ঞেস করল,

–‘চিনতে পারোনি আমাকে, না? অনেক মোটা হয়ে গেছি তাই না?’

তনু নিরুত্তর রইল। সেদিন শান্তিকে বলা ইহান ভাইয়ের কথাগুলো ভুলেনি সে। শান্তি ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল,

–‘ওকে চিনেছ? দূর আমি যে কী বোকা! তুমি তো আমাকেই চিনতে পারোনি। ওকে কীভাবে চিনবে! ও আমার ছেলে। সেবার আমাদের দেখা হয়েছিল যখন তখন ওর বয়স ছয় মাস ছিল। এইতো কয়দিন আগে পাঁচে পা দিল।’

তনু লক্ষ করছে শান্তি কতটা আন্তরিকতার সাথে তার সাথে কথা বলছে। অথচ তনু সহজ হতে পারছে না।

–‘তুমি কি আজই দেশে ফিরেছ? দেখো তো কী ভাগ্য আমার! যাবার আগে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।’

তনু শান্তির ছেলেকে দেখছে। কতটা বড় হয়ে গেছে! আচ্ছা, শান্তির সাথে কি ইহান ভাইয়ের সম্পর্ক আছে?

–‘ইহান আসেনি?’

প্রশ্নটা তনু বুঝতে পারল না। তাকে কিছু বলতে না দেখে শান্তিই আবার বলল,

–‘ইহান তোমাকে নিতে আসেনি?’

আশেপাশে তাকাল ও। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলল,

–‘আসেনি মনে হচ্ছে। ও কি সত্যিই আসেনি? অবশ্য আসবে কীভাবে বলো? ও এয়ারপোর্টে এলে রক্ষে থাকত? ওকে দেখে এতক্ষণে একটা হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে যেত না! না এসে ভালোই করেছে।’

তনু শান্তির কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। ইহান ভাইয়ের কথা বলার সময় শান্তির চোখ মুখ ঝলমল করতে দেখছে তনু। তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

–‘ইহানটা যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতেই পারিনি। আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না। এটাই কি সেই ইহান? ওকে এভাবে দেখে খুশিও লাগে। বিশ্বাস করো ওর জন্য আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হতে পারবে না।’

এই কথাগুলো শুনে তনুর এখন সত্যিই কান্না পাচ্ছে। যাদের সামনা করার ভয়ে সে দেশ ছেড়েছিল। পাঁচটা বছর দেশের কোন খোঁজ খবর রাখেনি। আজ এত বছর পর ফিরে সবার আগে সেই অতীতের সামনেই দাঁড়াতে হলো। একটা লোক এসে শান্তিকে কিছু বললে শান্তি বলল,

–‘তুমি ছেলেকে নিয়ে যাও। আমি ওর সাথে একটু কথা বলে আসি। ওকে তুমি চিনবে না। আমার পরিচিত। শান পাপার সাথে যাও বাবা। আমি আন্টির সাথে কথা বলে আসছি।’

তনু বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। ইনি শান্তির স্বামী! এখনও একসাথে আছে ওরা! তার মানে শান্তি ইহান ভাইয়ের কাছে ফিরে যায়নি! তাহলে ওই দিন যে ইহান ভাই শান্তিকে ফিরে আসতে বলছিল! তনু এই প্রথম কথা বলল,

–‘উনি তোমার হাজবেন্ড?’

–‘হ্যাঁ। কোনোদিন দেখোনি তো। তাই চিনো না। হ্যাঁ গো তনু, তোমাদের বিয়ে কবে? এবার তো ফিরে এসেছ। বিয়েটা যত জলদি পারো সেরে নাও। আমি কিন্তু পাঁচ বছর আগেই দাওয়াত পেয়ে গেছি। আমি যেখানেই থাকি তোমাদের বিয়েতে অবশ্যই আসব।’

তনুর এবার সত্যিই সবকিছু ধোঁয়াটে লাগছে। শান্তি কী বলছে এসব! কাদের বিয়ে? শান্তি কি জানে না সে ইহান ভাইয়ের সাথে নেই। ইহান ভাই ওকে জানায়নি! তাহলে কি তনু ভুল ছিল। না,না। তনুর ভাবতেও ইচ্ছে করছে না, সে ইহানকে ভুল বুঝে এতগুলো বছর দূরে থেকেছে। প্রতিটা মুহূর্ত নিজেও কষ্ট পেয়েছে আর ইহান ভাইকেও কষ্ট দিয়েছে। এরকমটা যেন না হয়। তনুর দ্বারা কোনোমতেই যেন এত বড় ভুল না হয়ে থাকে।
কাঁপা কাঁপা গলায় তনু বলল,

–‘ইহান ভাইয়ের সাথে তোমার কথা হয় না?’

–‘না। আমি ছেলে সংসার নিয়ে মহা ব্যস্ত। ইহান তো আমার থেকেও বেশি ব্যস্ত। যোগাযোগ ঠিক নেই। তবুও তোমাদের বিয়েতে আসব আমি।’

তনু শান্তিকে দেখে বুঝতে পারছে না এটা ওর অভিনয়? নাকি শান্তি সত্যিই বলছে। শান্তি কিছু জানে না বলেই বারবার ওদের বিয়ের কথা বলছে। যাবার আগে শান্তি কেমন অন্যমনস্ক গলায় তনুকে বলল,

–‘ইহান তোমাকে অনেক ভালোবাসে তনু। সেটা তুমিও জানো। তুমি ওকে কোনোদিনও কষ্ট দিও না। সারাজীবন ওর পাশে থেকো। অবশ্য তুমি ছিলে বলেই তো ইহান আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছে। তুমি জানো তনু, তুমি খুব ভাগ্যবতী। সবার ভাগ্যে প্রিয় মানুষটার ভালোবাসা সয় না। তুমি যা পেয়েছ তার যথাযথ মূল দিও। ইহানকে তোমার অলঙ্কার বানিয়ে নিও।’

শান্তি চলে গেলে তনু স্তব্ধ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কার ভুল ছিল? তার নিজের! সে বিনা কারণেই ইহান ভাইকে ভুল বুঝেছিল! মানুষটা তাকেই ভালোবাসতো। অথচ মানুষটার উপর তার বিশ্বাসটাই ছিল নড়বড়ে। নইলে সেদিন ওভাবে চলে যেতে পারত না। তনুর এই ভুলের কি কোন ক্ষমা আছে? ইহান ভাই তাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবে? ও ইহান ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ইহান ভাই তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে? কেন নিবে? তনুর অপরাধটা কি চট করে ক্ষমা করে দেওয়ার মত! ঝরঝর করে দু-চোখ উপচে পানি পড়ছে তনুর। পা দু’টো অবশ হয়ে গেছে।

–‘আমি কোনো কালেই আপনার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না, ইহান ভাই। আমি সত্যিই আপনার যোগ্য না। আপনি কোনোদিনও আমাকে ঠকাবেন না, এতটুকু বিশ্বাস কীভাবে রাখতে পারলাম না আমি। আমার অপরাধের কি কোন শাস্তি আছে? আপনি আমার মুখও দেখতে চাইবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। এত অভিমান! আপনার সাথে তো যোগাযোগ রাখিই নি। আপনার সাথে কথা বলা তো দূর। পাঁচ বছরে একটা বার ফুপুর কাছেও আপনার কথা জানতে চাইনি। দোষ তো আমার। আপনার জায়গার তো আপনি সঠিক। আপনার রাগ জায়েজ।’

তনুকে কাঁদতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে অনেকেই ওকে
দেখছে। তনু ইহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না। তার ভুলের জন্য পাঁচটা বছর দু’জন মানুষ দুই দেশে পড়ে কষ্ট পেয়েছে। তনুর মনে পড়ল, এই জায়গাতেই ইহান ভাই তার হাত ধরে ওর রাগের কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। তনু সেদিন হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল।

–‘কেন আমি সেদিনই আপনাকে বলিনি? রাগ দেখিয়ে বললেও তো এই ভুল বোঝাবুঝি মিটে যেত। আপনার জীবন থেকে আমি এতগুলো বছর নষ্ট করতাম না।’

বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে তনু দোটানায় পড়ে গেল। কার বাড়িতে চলে এসেছে সে? এটা কোন জায়গা? পাঁচ বছরে এখানের ঘরবাড়ির চেহারা এতটা পাল্টে গেছে নাকি? ফুপাদের বাড়ি কোনটা?
ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ হাতে তনু এগিয়ে আসছে। এটাই তো ইহান ভাইদের বাড়ি। কিন্তু বাড়ির সামনে এত মানুষ কেন? ক্যামেরাম্যান! প্রেসের লোক নাকি ওরা? তনুর বুক দুরুদুরু করতে লাগল। বাড়িতে কারো কিছু হয়েছে? দ্রুত পায়ে বাড়ি ঢুলতে গেলে লোকগুলো তাকে ঘিরে ধরল। তনু কিছুই বুঝতে পারছে না। এদের কোন প্রশ্নও তার কানে ঢুকছে না। সে ভয় পাচ্ছে বাড়িতে কার কী হলো? গেট দিয়ে ঢোকার সময়ও মহা ঝামেলা দেখা দিল। গার্ড দু’জন তনুকে ভেতরে যেতেই দিচ্ছে না। তনু হতবুদ্ধি হয়ে ভাবছে, গার্ড রাখার কী এমন প্রয়োজন পড়ল! পাঁচ বছরে ফুপা মন্ত্রী মিনিস্টার হয়ে গেল নাকি? এত কড়া পাহারা! তার উপর আবার বাইরে সাংবাদিকের ভিড়।

–‘আমি বলছি তো। আমি এই বাড়িরই মেয়ে। প্লিজ আমাকে ভেতরে যেতে দিন।’

–‘নো ম্যাম এভাবে কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়ার পারমিশন নেই।’

–‘আজব তো! নিজের বাড়িতে ঢুকতে এখন আমার পারমিশন লাগবে নাকি? বলছি তো আমি এই বাড়ির মেয়ে। ফুপু আম্মা যদি জানতে পারে না, দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে ফেরা ওর ভাইঝিকে আপনারা দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে হাজারো প্রশ্ন করছেন। কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তাহলে আজই আপনার চাকরি শেষ।’

লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তায় পড়ে গেল। তনু অস্থির হয়ে বলল,

–‘এখন যেতে দিবেন তো নাকি?’

–‘ম্যাম আসলে… আপনার ফুপু না মানে, আমি ভেতরে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।’

তনুর রাগ হয়ে গেল। তাকে দেখে কি চোর ডাকাত মনে হচ্ছে? লোকটার তার মুখের কথায় বিশ্বাস করছে না কেন? ঝাঁঝিয়ে উঠল তনু।

–‘কোনো দরকার নেই। আমি ভেতরে যাচ্ছি। দেখি আমাকে কে আটকায়।’

রেগেমেগে কথাগুলো বলে গটগটিয়ে লোকটার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে তনু। গার্ড ভয়ে তনুকে আটকাতে পারল না। সত্যিই যদি এই বাড়িরই মেয়ে হয় এটা! তখন?
দীর্ঘদিন পর ফুপু আম্মা তনুকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছেন। তার কান্না থামছে না। তনুও ফুপুর সাথে কাঁদতে লাগল।

–‘তুই আসবি আমাকে জানাসনি কেন? আমি নিজে গিয়ে তোকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসতাম। কতদিন পর আমার তনুটা আমার কাছে ফিরে এসেছে। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

–‘ফুপু আম্মা বাড়ির সামনে এত রিপোর্টার্স কেন? গেটেও গার্ড দেখলাম। ওরা আমাকে ভেতরে ঢুকতেই দিচ্ছিল না। আমি জোর করে ওদের সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছি।’

সাবিনা হাসল। তনুকে দেখছে ও। তনুটা আগেও সুন্দর ছিল। এখন তো মেমসাহেবদের মতো সাদা চামড়ার হয়ে এসেছে।

–‘ফুপা কোথায়? আর গার্ড কেন বললে না যে!’

তনু সরাসরি ইহানের কথা জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। ইহান ভাইয়ের কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার। যেভাবেই হোক তনু ইহানের মান ভাঙাবে। ইহান ভাই তাকে ছুড়ে ফেললেও তনু সয়ে নিবে।

–‘সব বলব। তার আগে তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ। এতটা পথ জার্নি করে এসেছিস। তোকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’

তনু ঘরে যাওয়ার নাম করে উপরে চলে এলেও ঘরে গেল না সে। বারান্দায় ব্যাগ লাগেজ ফেলে ইহানের ঘরের দিকে দৌড় লাগাল। ইহানের ঘর বাইরে থেকে বন্ধ দেখে আহত হলো ও।

–‘ইহান ভাই কি বাড়িতে নেই? ছাদে আছে নিশ্চয়।’

চট করে তনুর মনে পড়ে গেল ইহান ভাই তো ছাদের চিলেকোঠায় থাকে। সে এক দৌড়ে ছাদের সিঁড়ি গুলো পার হয়ে গেল। ফুপু বলত, ইহান ভাইয়ের কবুতরের খোপ এটা। দরজা খোলা দেখে তনু সোজা ঢুকে গেল। ইহান ভাই ওপাশ ফিরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কিছু করছে। তনু কিছু বলল না। শব্দও করল না। দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ইহান ভাই ভেবে যাকে জড়িয়ে ধরেছে সে যে অন্য একজন হতে পারে তা তনুর বোধগম্য হয়নি। যে মানুষটাকে সে ইহান ভাই ভেবেছে, সে যে আহান ভাইও হতে পারে এটা তনু কল্পনাও করেনি হয়তো।

চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা