সূখতারার খোজে পর্ব-১৭+১৮

0
512

#সূখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ১৭

ছলছল চোখে বধু তারার দিকে তাকিয়ে তূর৷ নয়নাক্ষি তার দাউদাউ করে জ্বলছে। গাঢ় খয়েরি রঙের লেহেঙ্গা পড়া তারাকে আজ কতই না সুন্দর লাগছে,সে তার অর্ধাঙ্গিনি হলে কি খুব খারাপ হতো? হতো হয়তো! সে’ই তো ভেঙেছে প্রথমে। ধরিয়েছে তারা আর অভ্রের সম্পর্কে ফাটল। এই ফাটল আজ তার বুক দীখন্ডিত করতে ভাবছে না। বুক ধু ধু করছে তার। ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্যের। অপরাধ?, তারার জিবনে দাগ দেয়া। হয়তো এটুকু কুকর্ম না করলে আজ তারা তার’ই হতো। ভালোবাসতো তাকে! এই আসরে তার বিয়ে হতো।

তূর কাঠশুকনো গলায় একটি ঠোগ গিললো। গলা শুকিয়ে আসছে। শ্বাস ভার! গলায় দলা পাকাচ্ছে কষ্টগুলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দু বার আড়াল করলো চোখের পানি তূর। জানালা হাতল শক্ত করে খিচে নিলো। বউ সাজানো হচ্ছে তারাকে। লুকিয়ে তা দেখছিলো তূর। কিন্তু তার কর্মফল সম্মুখে বুঝতে পেরে সে নরক যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্হান ত্যাগ করলো তূর।

আশেপাশের মেয়েরা সকলে ঘরে হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত। ঠেস দিয়ে কথা বলছে তারা। তারা অপলক চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে। আজ তার বিয়ে। পুরো বাড়ি লোকে ভর্তি। নিশ্বাস ছাড়ার জায়গা নেই পর্যন্ত। দু’দিনে এখতেয়ার জাকজমক আয়োজন করেছে। লাল,হলুদ গাধা ফুলে সজ্জিত আজ এখতেয়ারের কুটির। লাল টকটকে চান্দোয়া পুরো উঠোনে টাঙানো। তারার ঘরে ভির নেই। ইলিমা নিজ হাতে সবটার খেয়াল রেখেছে। মেয়েটা গায়ে হলুদের পর থেকে চুপচাপ থাকে,তাই তিনি ভির করতে দেননি ও ঘরে।

ঘরের মেয়েগুলো উচ্চস্বরে হাসছে। কেউ কেউ তারাকে এদিক ওদিক দিয়ে গুতোচ্ছে আর ফাজলামো করছে। প্রতিত্তোরে শুধুই হাসছে তারা।

বিকেল চারটেতে গড়ালো। ইলিমার দম ফেলার সময় নেই। এই এদিকে ছুটছে, তো আরেকদিকে ছুটছে! কাজ যেন তাকেই পেয়েছে। তিনি তারাদের ঘরে গেলেন। তারার সাজা হয়ে গেছে। তিনি শেষ জিজ্ঞেস করলেন,

-তোদের সব হলো?

মেয়েরা একস্বরে আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো,

-হয়ে গেছে। দেখ, কেমন সুন্দর লাগছে তারাকে।

ইলিমা এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো তারার কাছে। এঁটো হাত আঁচলের শেষপ্রান্ত দ্বারা মুছে বসলেন তারার পাশে। তারা তাকালো না একবারও। ইলিমা বললেন,

-মন খারাপ?

তারা নিচুস্বরে বললো,

-না।

-সায়নের পরিবার তোকে রানির মতো রাখবে দেখিস। কপালে সুখের বন্যা বইবে। মন খারাপ হয় কি করে তোর? আমি হলে তো মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ জপতাম। বেঁচে গেছি যে! আর তুই?

-আমিতো বলিনি আমার মন খারাপ।

-চাচী হই তোর। এটুকু বুঝবো না? জানিস? তোর মা লতিফা বেঁচে থাকাকালীন যখন প্রথম তোর চাচার বাড়িতে পা ফেললাম। বেশ ঝগড়া হতো আমাদের মাঝে। তোর দাদী কাজে কম বেশি করাতেন। কোনদিন আমি খুব কাজ করতাম আর কোনদিন তোর মা। এতে অবশ্য লতিফার কোন মাথাব্যথা ছিলো না। ছিলো আমার, যেদিন খুব বেশি কাজ আমার ভাগ্যে পড়তো সেদিন খুব খাটুনি হতো,কমরে ব্যথা ধরতো। তাই ঝগড়া হতো। তোর মা কখনোই বলেনি আমার ব্যাথা হয় কাজ করলে। আমি তো প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম,আপা তোর ব্যাথা করে না? সে তো খিলখিল করে হাসতো। বলতো,-না কেন রে? আমি কোন কথা না বলে চলে আসতাম। যেদিন তোর দাদী মারা গেলো,সেদিনের পর থেকে একের পর এক অশান্তি সৃষ্টি করতেন তোর চাচা। কথায় কথায় খালি বলতেন,জমি ভাগ চাই। ভাগ করে দাও। তোর বাবা এমন কুশ্রী প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। একদিন তর্কাতর্কিতে লেগে গেলো তুমুল ঝগড়া। মেয়ে মানুষ,স্বামির সাথে তাল না দিয়ে পারিনি! তোর বাবার সাথে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছিলাম। লতু আপা আমায় আর তোর বাবা কে আটকাতে চেয়ে ঘাই গুতা খেয়ে ফিরেছে। ভালো মানুষ ছিলেন উনি!

তারা মায়ের নাম শুনতেই ইলিমার দিকে তাকিয়ে সবটা শুনলো। মুখ দিয়ে একাএকাই বেড়োলো তারার,

-তারপর?

-তারপর? আচ্ছা কেন বলতো তোকে শেষে বললাম উনি ভালো মানুষ ছিলেন?

তারা অস্ফুটস্বরে বললো,

-কেন?

-কারন,একটা মানুষের কতটা সহ্যশক্তি থাকতে পারে আমি সেদিনই বুঝেছি। সত্যি বলতে তোর মায়ের বিয়ের পর থেকেই রোগ ছিলো। তুই পেটে থাকাকালীন সময়েও রোগ পিছু ছাড়েনি লতুর। মূল কথায় ফিরি, সেদিন ঝগড়ার এক পর্যায় বসার পিড়ে আমি ছুড়ে মাড়ি লতু আফার মুখে। তা সরাসরি ঠোঁটে লাগে। সে কি রক্ত! ঝগড়া থেমে যায়, অথচ রক্ত বন্ধ হয় না। পরদিন সে ঠোঁট ফুলে ডোল হয়। পানি এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে খেতো আপা। জানিস? এ ব্যাথা পুরো একমাস সহ্য করেছে। খেতে পারতো না,ঘুমোতে পারতো না। সবসময় শুধু চোখে পানি টইটই করতো লতু আফার। জেনে অবাকই হবি আমায় একটা গালিগালাজ করেনি তোর মা। অথচ আমি তাকে কতই না বেদনা দিয়েছিলাম। সংসার আলাদা হলো। আমরা এখানে ঘর তুললাম। যেদিনই ভালো কিছু রান্না করতো সবার আগে এক বাটি এ বাড়িতে দিয়ে যেত আপা। তুই পেটে থাকতেই তখন তূরের চারবছর বয়স কিংবা তার কম। সবসময় তোদের বাড়িতে সে ছেলে থাকতো। আমি দুঃখে,আর নিজের প্রতি ঘৃনা ছুড়ে আর যায়নি কখনো। কিন্তু আমার মন খালি তোর মায়ের কথা ভাবাতো। লজ্জায় আর সম্মুখে দাড়াতে পারিনি আমি।

তারার চোখ চিকচিক করে ওঠে। এই বুঝি টুপ করে পানি গড়ায় এমন অবস্থা। তারার হেঁচকি উঠছে খানিক পর পর।

-২০২০ সাল মর্মান্তিক একটি সাল! করোনার আক্রোশে আক্রান্ত হলেন তোর বাবা। একমাসে এতটা কাবু হলেন যে মৃত্যুই হলো ওনার। তুই দেখলাম ঠিক তোর মায়ের মতন! নিজের কাজ নিজে করতে শিখে গেলি বড্ড তাড়াতাড়ি। আরও ঘৃনা বাড়লো নিজের প্রতি। কিন্তু যখন তোর মায়ের আগ মুহুর্তে আগত তখন ছুটে গেলাম ও বাড়িতে আমি। পারিনি নিজেকে আটকাতে। অনেকবার করে লতুআফার কাছে মাফ চাইলাম। উনি কোন সারাই দিলো না। ভাবলাম একটু শাস্তি পাওয়া দরকার আমার। আমিই তূরকে বলে কয়ে ঝগড়ায় মাতালাম যাতে তোকে নিয়ে না যায় তোর বন্ধবী।হ্য া রে। আমিই তূরকে ঝগড়া করতে বলেছিলাম!কাছে রেখে একটু আদর করতে পারি যেন তোকে। তার আগেই কয়েক বিষাক্ত ছোবল তোকে কেটেছে।এটাতো আজানাই ছিলো আমার। যখন জানলাম তখন আমিই তূরকে তোর অযোগ্য ভাবতে লাগলাম। একজন ভাঙ্গক নিষ্চই তুই কামনা করিস না? আজ সায়নের সাথে তোর বিয়ে হলে ভাববো তুই তোর সুখের সামনে গিয়েছিস। এখন হাতে পেলেই তুই ভালো থাকবি রে! ভালো থাকিবি।

টুপটুপ করে পানি ঝড়তে লাগলো ইলিমার চোখ বেয়ে। তিনি তারার চোখের কোনের পানিটুকু নিজ আঁচলে মুছলেন। মাথায় আদুরে হাত বুলালেন কয়েকবার। তারা পারলো না নিজেকে সংযোত করতে। মাথা হেলিয়ে জাপটে ধরে বাধ ভাঙা নদির মতো কাদঁতে লাগলো । ইলিমার মাথা তুলিয়ে চোখ মুছিয়ে রাগি কন্ঠে বললেন,

-পাগলা মেয়ে, মেকাপটা নষ্ট হচ্ছে তো। কাঁদছিস কেন তুই?

নাক টেনে বললো তারা,

-আজ আমি আরেক মা’কে হারাবো।

-হারাবি মানে? আমি তো আছিই,তুই বল,আরো একটি মা পাবি সাথে পরিবার। সবার সাথে মানিয়ে নিস রে মা। নিজেই কারো চোখের আড়াল হোস না। ভুল বুঝতে সময় লাগে না, তার থেকে ভালো না,তুই ভুল বুঝতেই দিবি না?

-ঠিক আছে চাচী।

ইলিমা সকল কাজ ভুলে নীরব ভাবে বসে রইলো তারার পাশে। ইলিমার কোলে মাথা রেখে বারবার নাক টানছে তারা। নিজেকে যথাসম্ভব চেষ্টায় রেখেছে যেন নোনাজল আর না গড়ায়। দেড় ঘন্টা পর পুরো বাড়ি চিৎকারে ভরে উঠলো। একে একে সকলে উচ্চকন্ঠে সারা দিলো,

-বর এসেছে,বর এসেছে!

ইলিমা আদুরে হাতে মাথা তুলিয়ে একটা গাঢ় চুম্বন করলেন তারার মাথায়। বললেন,

-আসছি।

ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো ইলিমা।সাথে মেয়েগুলোও। বরকে নামানো হলো গাড়ি থেকে। কোলপাজা করে আনার নিয়ম সেখানে। আংটি পড়িয়ে আসরে এনে বসানো হলো তাকে। নেমে এলো সায়নের মা, বাবা আর সায়নের ছোটবোন। আত্নীয় স্বজন ও এসেছে। কাজি এসেছেন বহুত আগে। তার একবার খাওয়াও শেষ। এখতেয়ার খাওয়ার আয়োজন জমজমাট ভাবে করেছে। নিজের সার্থের বাইরে গিয়ে। ডাক পড়লো পত্রীর। ইলিমা নিজে আরও একজনকে নিয়ে তারাকে আনতে গেলেন। সায়ন অনেক্ষন যাবৎ উঁকিঝুকি দিচ্ছে। পাশ থেকে ছোট বোন খোঁচা দিলো,

-ভাইয়ুর তো দেখি বউকে দেখার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। আমাদের হবু ভাবিকে আজ না’হয় আমাদের কাছেই রেখে দেবো রাত্রিরে।

সায়নের কপালে ভাজ পড়লো। বোনকে কড়া গলায় দমিয়ে দিলো,

-এমন পাকা পাকা কথা ফের শুনলে কানের গোড়ায় মারবো বলে দিলাম।

দমে গেলো সাবিহা। সায়ন একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো।পাশ থেকে ছোট মামা লজ্জিত স্বরে বললেন,

-রুমাল দে মুখে।

সয়তানির ছলে বললেও সায়ন ঠিক তাই করলো। হাসলো সায়নের ছোটমামা। এরিমধ্য তারাকে আনা হলো সেখানে। কাজি বিয়ের খুৎবা পড়তে আরম্ভ করলেন। ইলিমা আর তনয়া এক কোনে দাড়িয়ে রইলো আধারের দিকটায়। তারাকে সায়নের সাথে বেশ লাগছে। ভয়ে,লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে বেচারি। এদিকে সায়ন উশখুশ করছে তারাকে কিছু বলার। পারছে না! খুব ফিসফিস করে বললেও যেন শুনে ফেলবে পাশের লোকগুলো। তার বলতে ইচ্ছে হয় ‘সুখতারা’ সম্মোধন করে।

#চলবে…

#সূখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ১৮

-‘মেয়ে দেখলেই কি চুলকায় নাকি আপনাদের? হুটহাট ধাক্কা মারেন? সুন্দরী মেয়ে দেখলে বুক নিশপিশ করে ধাক্কাধাক্কি করবার জন্য না?’

কবিতা একটানে বলে উঠলো সামনের সুট-বুট পড়া লোকটাকে। তজ্জব বনে তাকিয়েই রইলো অপরিচিত লোকটি। এদিকে কবিতা রাগে দুঃখে নিজের চেয়াল নিজেই চাবিয়ে খাচ্ছে। ধাক্কা মারার পর নিষ্পাপ মুখ বানিয়ে রেখেছে। মনে মনে ‘বেয়াদপ’ বললো কবিতা। লোকটি ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুচঁকে বললো,

-এক্সকিউজ মি…

-ওয়াট এক্সকিউজ?নো এক্সকিউজ মাই সামনে। সং এর মতো দাড়িয়ে না থেকে সাইড কাটুন। যেতে মি, ইয়ে মানে লিভ মি!

লোকটি হাত উঁচিয়ে নিজের চাপদাড়ির কোনা ঝাড়লো। অতঃপর বললো,

-আপনার জানা আছে আমি কে?

উত্তরে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো কবিতা। বললো,

-ইউ জানো আমি হু?

-হু? হাহ্! হু আর ইউ?

বলেই এক পা একপা করে এগোতে লাগলো লোকটি। কবিতা ভরকে গিয়ে পেছোতে লাগলো। আটকানো গলায় বললো,

-এ..এটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু মিস্টার।

এগোতে এগোতেই বললো লোকটি,

-তো?তো কোনটা ঠিক শুনি? না জেনে না বুঝে কাউকে কুশ্রী ভাষায় গালি গালাজ করা? ইডিয়ট!

‘ইডিয়ট’ শব্দিটি কানের তালুতে পৌছাতেই মুখে কিংকর্তব্যমিঢ় এর ছাপ ফেলতে হা হয়ে উঠলো কবিতার। চোখদুটি ডিমের মতো বড় বড় করে বললো,

-আমি ইডিয়ট? আপনি আমায়…

একপা সটাং জোরে এগিয়ে থেমে গেলো লোকটি। কবিতা ভরকে গিয়ে পিছিয়ে দাড়ালো দু’পা। চেয়াল খিচে কোমরে হাত গুজে মনেমনে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো। লোকটি বুঝতে পারলো তাকে বিরবির করে গালি দিচ্ছে মেয়েটি। সে দু হাত কোলে গুজে আয়েশের স্বরে বললো,

-শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।

এতে যেন আগুনে ঘি ঢাললো লোকটি। কবিতা জোরপায়ে হেটে সামনে এলো লোকটার। বললো,

-কোন সাহসে আমায় শকুন বললেন আপনি?

-আমি না জানি আপনার নাম আর নাই’বা আপনাকে সম্মোধন করে বলেছি। আপনার গায়ে কেন লাগলো বুঝলাম না।

-তাইইই বুঝি? যেই দেখলেন আমায় পটাতে পারছেন না অমনি না? শুনে…

কথা বলার আগেই পাশের সাদা গাড়িতে দু হাত চেপে ধরলো লোকটি। রাগে কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। ঠোঁটে ঠোঁট চেঁপে বললো,

-অর্নব ইরফানের জন্য মেয়ের লাইন পড়ে আছে ইউ বাস্কেট! এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট ছিলো। কাউকে হঠাৎ ধাক্কা লাগতেই পারে। ইউ নো? আমার আজ মুড ঠিক আছে দেখে ছেড়ে দিলাম। পরের বার…

বলেই হাত ছেড়ে দিলো অর্নব। কবিতা কোনমতে নিজেকে সামলে অর্নবের থেকে দু পা পিছিয়ে গেলো। ভয়ক্লিষ্ট কন্ঠে বললো,

-আ..আজ আমারো তাড়া আছে। মোর বান্ধুবী বিয়ের দাওয়াত দেয় নাই। তাই ছ..ছেড়ে দিলাম।

কিছুটা দম নিলো কবিতা। হাতের বক্সটি সর্বশক্তি দিয়ে খিচে নিলো। এবার তাকে দৌড়োতে হতে পারে।নিজেকে আগলে নিয়ে সশব্দে ‘জর্কশ মিয়া’ বলে দিলো ছুট। অর্নব শুনতেই দু পা এগিয়েও এগোলানা। মনে মনে বললো,

-আরেকবার খালি পাই।

___________

সায়নের মুখে যেন কেউ লাল মরিচ ঘষেছে। টকটকে লাল বর্ন ধারন করেছে লজ্জায়। কাজির এক কথায় ‘কবুল কবুল কবুল’ বলার পর যখন সকলে হাসলো তখনি সে বুঝলো সে কতটা নির্লজ্জের মতো কাজ সে করেছে। কাজিও হাসলো ফিক করে। তিনি এতটা তড়িঘড়ি করে আর হাসি ফুটিয়ে কাউকে কবুল বলতে দেখেছেন কিনা ভাবলে কয়েক মুহুর্ত! না! দেখেন নি। সায়নের মনে হচ্ছে বিয়ে মানেই লজ্জা,আর লজ্জা মনেই বোধহয় বিয়ে। লজ্জা কত প্রকারের তা ঠাউর করলো সে।এদিকে তারা নিজের হাসি দমিয়ে রেখেছে খুব কষ্টে। গাল ফেটে হাসি আসছে তারার। কাজি এবারে তাকালো তারার দিকে। বললো,

-এবার কন্যা কবুল বলবে।

তারা এখন মুখ খুললেই হাসির বিশ্রী শব্দের রহুরি খেলবে। দমালো অবশেষে নিজেকে। সকলে ভাবলো হয়তো কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু তারার কষ্ট তো তখনি মুছরালো যখন লাল টুকটুকে বর’কে পাশে দেখলো। ছেলে মানুষের অতটা লজ্জাই এখন হাসির কারন তারার।

-কবুল,কবুল,কবুল!

কাজি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে বিয়ে সম্পন্ন করলেন। দোয়া ও হয়ে গেলো। শেষ সময়ে হাজির হলো কবিতা। ভির ঠেলে হুমড়ে গিয়ে দাড়ালো বৈঠকের সামনে। তারা মাথা নত করে থাকায় বুঝলো না। মুরব্বিরা খেতে চলে গেলো। চেঁচিয়ে বললো কবিতা,

-তুই আমায় রেখে রোমান্টিক মৌশুমে বিয়ে করে নিলি?একটি বারও বললি না?

কবিতার আওয়াজ পেতেই চোখ তুলে তাকায় তারা। মেয়েটা ঘেমে গেছে, হয়তো বড্ড তাড়াহুড়ো করেছে। সাবিহা পাশেই ছিলো। উঠে গিয়ে বললো,

-কবিতা ভাবি না? অভ্র ভাইয়া কোথায়?

তেজ যেন ফুরিয়ে এলো ‘ভাবি’ ডাকটি শুনে। কিন্তু এখন মুড খারাপ করবে না বলেই সাবিয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বসে পড়লো ছোট্ট স্টেজটায়। পাশেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বসে সায়ন। তারা কবিতাকে দেখেই চলেছে। কবিতা রাগি কন্ঠে আরোপ করলো,

-তুই এত হিংসুটে হীনমন্য তারা?

তারা আকুল কন্ঠে বললো,

-আমি তো নিজেই…

-হ্যা তোর তো নিজেরই বিয়ে না? আমি কি নাক্ষসী? সব গান্ডে পিন্ডে গিলবো?

-আমি সেভাবে বলছি না তুই..

-না না না। তুই সেভাবে মানে? বল সেটাই মনে করে ইনভাইট করিসনি। আর এইযে দুলাভাই, আপনি তো পারতেন একটা ইনভাইট করতে।একটা কল করতে? করেননি কেন?

শেষের বাক্যটুকু বেশ রেগেই বললো কবিতা। উত্তরে সায়ন করুন কন্ঠে বললো,

-সবটা খুব’ই তারাতাড়ি হয়েছে। তাই আর…

-তাই,না বলে বিয়ে করে নিবেন? তাও এই গুলুমুলু টার সাথে?

গুলুমুলু তারার আদুড়ে ডাক। স্কুল লাইফে তারাকে এই নামে ক্ষেপাতো কবিতা। আজ অনেকদিন পর সে ডাকলো সেই নামে। আজ মোটেই ক্ষেপলো না তারা। ভালো লাগে বেশ।

-তাহলে জানলে কিভাবে?

কবিতা নিজের চুলগুলো স্টাইল করে বললো,

-সাবিহা বলেছে। বেস্টফ্রেন্ড ডাকলো না, আজ আমার দুঃখের সাথি এই বনুটাই।

সাবিহা ফিক করে হেঁসে ফেললো।

__________

‘নিজের মেয়ে নয়তো কি? আজ তারাকে নিয়ে যাওয়া হবে অন্য বাড়িতে। কলিজা চিনচিন করছে ইলিমার। যেন বুকের এক খন্ড কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যাবে খানিক বাদে। মুখ ভরে গাঢ় চুম্বনে ভরিয়ে ফেললেন ইলিমা। তারা হু হু করে কেঁদে ফেললো। না পেরে সশব্দে কেঁদে ফেললেন ইলিমা। পাশে তনয়া ও কাদঁছে নিঃশব্দে। পাশে কবিতা ছলছল নয়নে তাকিয়ে।’

ইলিমা শীতল স্পর্শ করলেন তারার গালে। চোখের কাজল একটু ছড়িয়েছে।তিনি আঁচল দিয়ে গাল মুছে দিলেন। এরপর কাজল ঠিক করে বললেন,

-ভালো থাকিস কেমন? সবার কথা শুনবি।

বলেই মুখে কাপড় গুজলেন ইলিমা। তার বুক কেউ ফালাফালা করে দিচ্ছে যেন। তিনি নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বললেন,

-বাধ্য হয়ে থাকিস! সায়নের সমস্ত কথা মানবি।

তারা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো তারা। এরপর ধির পায়ে হেঁটে গেলো তনয়ার কাছে। বললো,

-চাচীর সমস্ত কথা শুনবি কেমন? কাপড়গুলো নিয়ম করে তুলবি। কাজে সাহায্য করিস। সাথে সাথে কাজও করবি বলে দিলাম।

তনয়া চিৎকার ছেড়ে কেঁদে দিলো। বুক হুমড়ি খেয়ে পড়লো তারার। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

-আপা আমায় মাফ করে দিবি না? ও আপা মাফ করবি না আমায়?

তারা চোখ এদিক ওদিক করে পানিটুকু আটকালো চোখের। আদুরে গলায় বলে,

-যাহ্ পাগলি। তোকে তো সেদিনই মাফ করে দিয়েছি মনেমনে। এখনো এসব মনে পুষে রেখেছিস তুই?

তারা বলেই তাকালো এখতেয়ারের দিকে। এখতেয়ার অস্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে তারার দিকে। তারা তনয়াকে ছেড়ে এগিয়ে গেলো এখতেয়ারের কাছে। এখতেয়ার ও এগিয়ে এসে বললেন,

-ভালো থাকিস কেমন?

-জ্বি চাচা।

চোখের পানি মুছে ফেললো তারা।একটু এগিয়েই দেখলো কবিতা মুখ বাঁকিয়ে রয়েছে। হয়তো রাগ করে আছে। তারা বললো,

-তুই দানী বুড়ী হয়ে যাবি না?

ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বললো কবিতা,

-আমি??

-হু।

-সরি। আমি পারবো না।

তারা এগিয়ে কবিতার হাত ধরে বললো,

-দেখা হবে কেমন?

কবিতা সায়নের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,

-দেখা হবে না মানে? যে আটকাবে তাকে খালি আমায় দেখিয়ে দিবি। তার ব্যাবস্হা আমি করবো।

দূর থেকে তাকিয়ে দেখলেন সবটা সায়নের মা। আজকাল এমন দৃশ্য আর দেখা যায় না সহজে।

গাড়িতে উঠে পড়লো সকলে। মোট তিনখানা গাড়ি এসেছিলো ও বাড়ি থেকে। তারা গাড়ির জানালা দিয়ে সকলের কান্নারত মুখখানা দেখলো। তার বুক ঝলসে খাক হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি চলতে লাগলো। বেশ কিছুটা যেতেই তারার বুক ভার হয়ে আসতে লাগলো। আখি পানিতে টইটুম্বুর।

কারো উষ্ঞ ছোয়া পেতেই তারা তড়িৎ গতিতে চোখের পানি আড়াল করে তাকালো তার দিকে। সায়ন তার হাত স্পর্শ করেছে।

-খারাপ লাগছে?

ঠোঁট কামড়ে বললো তারা,

-হুম!

____

আধঘন্টা হলো ফুলে সজ্জিত বাসর ঘরে বসে আছে তারা। সায়নের মা দুধ হাতে একটিবার এসেছিলো। এরপর আর সায়নের কোন দেখা নেই। হঠাৎ দরজা বন্ধের আওয়াজ কানে আসতেই বুক ধুক করে উঠলো তারার। চকিত দৃষ্টিতে সায়নের দিকে তাকাতেই উদয় হলো জম কঠিন প্রশ্ন। সায়ন হাসিমুখে এগিয়ে আসতেই উদিত প্রশ্ন বলে উঠলো তারা,

-আপনার বাবাকে দেখলাম না? তিনি কোথায়?

#চলবে…