সাঁঝক বাতি পর্ব-১৫+১৬

0
322

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৫]

শিফা বিস্মিত! অবাক দৃষ্টিতে সে স্কিণের দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
এই সেই ব্যাক্তি! কীভাবে সম্ভব? উনি এমন কিছু করবে; শিফার কল্পনাও অতীত। শিফা হতবাক হয়ে পুনরায় দেখল। না, ওর দেখার ভুলে নেই।
তাহলে এটাই সত্যি! উনি সেই বেইমান! সাফার
খুনী! শিফা তাৎক্ষণিক হাসিবকে ফোন দিলো। হাসিব তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হলো ঘুমিয়েছে। শিফার কল পেয়ে হাসিব দ্রুত রিসিভ করল। শিফা যা যা বলল মন দিয়ে শুনল।আর
প্রয়োজনে হুম, হ্যাঁ, না, এসবে উত্তর দিচ্ছে।সেও শুনে হতভম্ব! শিফা প্রয়োজনীয় কথা বলে কল কাটল। রাগে ওর শরীরটা কাঁপছে। যেন এখনই উনাকে জীবন্ত কবর দিলে শান্তি মিলবে। তবে এ ভুলটা করা যাবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। নয়তো সব হিসাব গড়বড় হয়ে যাবে। আর এই
পরিস্থিতিতে হিসাব গড়বড় করা যাবে না। কারণ এটাই হিসাব চুকানোর মোক্ষম সময়।শিফা উঠে পাশের রুমে গিয়ে সাফার আম্মুকে দেখল। উনি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এমনি ঘুমান নি। কড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। নয়তো না ঘুমিয়ে সারা দিন-রাত কাঁদতেন। শিফা উনার শরীরের চাদর ঠিক করে বেরিয়ে গেল। ওর অশ্রু ঝরছে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। উনাকে দেখলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। অথচ ওর হাতেও কিছু করার নেই।সেও এই পরিস্থিতির
শিকার!

শিফা তোয়ালে নিয়ে ওর ওয়াশরুমে চলে গেল। গোসল দেওয়া দরকার। এতে মন ও মস্তিষ্ক যদি
শান্ত হয়। যদি কিঞ্চিৎ প্রশান্তি মিলে। প্রশান্তিটা এখন খুব দরকার। নয়তো খুব অস্থির লাগছে।এই মূহুর্তেই সব চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে ইচ্ছে করছে।
শিফা পানির সুইচ চেপে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাৎক্ষণিক উপর থেকে ঝরঝরিয়ে ঠান্ডা পানি পড়তে লাগল। কয়েকসেকেন্ডে পুরো শরীর ভিজেও গেছে। পানি একটু বেশিই ঠান্ডা! যদিও সে ইচ্ছে করে ঠান্ডা পানি নিয়েছে। পাশের সুইচে লিখা, জেনারেল, হট, কোল্ড। সে কোল্ড সুইচটা চেপেছে। তখন গভীর রাত। নিশাচর পাখি বাদে সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। তবে মানুষরুপী নিশাচর পাখিও আছে। যাদের নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে নির্ঘুম রাত কাটে। দিনের আলোতে তারা কৃত্রিম হাসি মুখে ফুটিয়ে তোলে। আর বোঝায়; তারা সর্বসুখী। পুনরায় সেই রাতের উপস্থিতিতে একাকীত্বে ডুব দেয়। আঁধারে ডুবে সুখ-দুঃখের হিসাব কষতে থাকে। এর ফলও আসে শূন্যতা!
শিফাও তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত। সেও এক যুদ্ধে নেমেছে। অঘোষিত যুদ্ধ।এই যুদ্ধে মৃত্যু নিশ্চিত।
তবে ভয় নেই! আছে প্রবল মনোবল। সব পাপ এবং পাপীকে নিঃশেষ করার আত্মবিশ্বাস। তবে
পূর্বে নিশানা ঠিক থাকলেও ওর পথ ভুল ছিল। সে ভুল পথে হাঁটছিল। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছিলও। এবং তাতে কখনো সফল হতো না।
তাই ভুলটা শুধরে বর্তমানে সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে। তাই ওর খেলা পরিবর্তন করার সময়ও এসেছে।

আর দিগন্ত কিডনি ব্যবসায়ী এটা সত্য।মানুষের প্রাণ তার কাছে অতীবও তুচ্ছ। সেই সাথে এটাও সত্য ; সাফার মৃত্যুতে ওর হাত নেই। সাফাকে সে ফাঁসায়ও নি।সাফার রক্তে একধরনের মেডিসিন পাওয়া গেছে। যেটার প্রভাবে, চোখে কম দেখত, মাথা ঘুরাত, সব ভুলেও যেতো। ওই মেডিসিনটা
নিয়মমাফিক ওর শরীরে প্রবেশ করত। প্রত্যেকটা দিন! এজন্য দিন দিন সাফার অবস্থাও বেগতিক হচ্ছিল। কিছুদিন আগে দিগন্ত বলেছিল,

-‘পাপকর্ম স্বীকার করার সাহস আমি রাখি। ওই সাফার মৃত্যুতে আমার হাত নেই। তবে আগে যদি জানতাম, ওই শালী মরেও এই প্যারা দিবে। সত্যি বলছি, আমি নিজে ওকে খুন করতাম।’

শিফা চুপ করে শুনেছিল। তাছাড়া কথাতে কথা বাড়ে। অন্যদিন সাফার ছবি দেখে দিগন্ত মুখটা
বিকৃত করে বলেছিল,

-‘সাফাকে পছন্দ করব? তাও আমি! বাহ,দারুন জোক্স। তাছাড়া আকৃষ্ট হওয়ার কিচ্ছু ছিল না। যা ছিল খালি, ওই তেল চুপচুপে লম্বা বেনুনি।’

দিগন্ত আবসিক হোটেল রাত কাটালেও ওর রুচি হাই লেভেলের। আর শর্ত জারি তো থাকেই। সে
যা বলেছিল; এতদিন ভাবলে এই সমস্যা হতো না। আর সাফা ছিল খুব সাধারণ। চুল তেল না দিলে শান্তি পেতো না। রোজ তেল দিবেই দিবে।
সাজগোজ ও স্টাইলিশ ব্যাপারগুলো সত্যিই ওর
মধ্যে ছিল না। তবে মার্জিত পোশাকে নিজেকে
ফুটিয়ে তুলতো। আর ওর মন ছিল খুব পবিত্র।
অল্প কষ্টে ভেঙে পড়তো। সাফা সাধারণের মধ্যে অসাধারণ একটা মেয়ে। যার ভেতরে কলুষতা বলে কিছু ছিল না। হয়তো সেটা দিগন্তের চোখে পড়ে নি। আর পড়বেও না। কারণ সব ভালোর মর্ম সবাই বুঝে না।

শিফা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সময়টা দেখল। ভোর চারটা বাজে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। শিফা কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। চোখে পাতাও বুজে আসছে। ঘুম দরকার। শরীরটা আর সাঁই দিচ্ছে না। একটু বিশ্রাম চাচ্ছে। গতকাল সাফার আম্মুকে দিগন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কেন, অজানা!
নার্সের ভাষ্যমতে, দিগন্ত’ই ছিল সুদর্শন পুরুষ। উনাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেবল দিগন্তেরই জানা। শিফা গা ঢাকা দিলেও খবরটা ওর কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে নি। শুনে সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ
নিয়েছিল। আর দিগন্ত সাফার আম্মুর মাধ্যমেই শিফাকে খুঁজে বের করল। ওর চতুরতা ধরা বেশ মুশকিল। ধূর্ত ব্যাক্তির ধূর্ত বুদ্ধি। সেও জানত, শিফা এবার নিজেই যোগাযোগ করতে আসবে। কারণ সাফার আম্মু ওর দায়িত্বে। উনার ক্ষতি সে হতে দিবে না। রেস্টুরেন্টে দেখা করে, সাফার আম্মুকে দিগন্ত ফিরিয়ে দিয়েছিল। ওর শর্ত ছিল শিফাকে ফেসবুকের পোষ্ট ডিলিট দিতে হবে। ওর কথা অনুযায়ী শিফা তাই করেছে। তবে ততক্ষণে অনেক শেয়ার এবং কপি হয়ে গেছে। অনলাইনে কেউ সত্য মিথ্যার তফাত খুঁজে না। একটা বিষয় পেলেই হয়। কপি আর শেয়ার হতে দেখেই শিফা
ডিলিট করেছে। নয়তো এত বোকা সে নয়।আর
সাফার আম্মুকে ছাড়ার পরপর’ই শিফা নিহাকে অপহরণ করেছে। নিহা এখনো বন্দি। ওর মুক্তি
এত সহজে মিলবে না। নিহার কথা দিগন্ত পরে জেনেছে। তবে জেনেও ওর হেলদোল দেখা যায় নি। হাবভাব এমন, যেন এতে ওর আসবে যাবে না। হাসিবও নিহার ভালোই আদর-যত্ন করছে। শিফার কথাতে কয়েক ডোজ নাকি বাড়িয়েছেও।

যার বোধ নেই। বিবেক ও বুদ্ধি অচল। যে মেয়ে অন্য পুরুষের কাছে শুতে দু’বার ভাবে না।তাকে মেয়ে বলাও যায় না। এরা হচ্ছে; টাকার পোকা।
টাকার জন্য এরা বিবেক বিসর্জন দিতেও ভাবে না। বোকা সেজে কার্যসিদ্ধি করা, নিহার মূখ্য কাজ। সে আবার আরেকটা কীট। দেখতে মেয়ে হলেও মনটা নোংরায় পূর্ণ। কুরুচিপূর্ণও বটে। বিবেক, মনুষ্যত্ব, লজ্জাবোধ বলতে কিছু নেইও। তবে শিফার কাছে ধরা পড়ে গেছে। জারিজুরিও শেষ। এমনকি প্রশান্তের সঙ্গে ওর বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারও মিথ্যা। ওদের ইসলাম ধর্ম মোতাবেক বিয়েও হয় নি। ওদের রেজিস্ট্রিটা হয়েছিল, নিহার আনার উকিলের কাছে। উকিলও ওর কথামতো মিথ্যা রেজিস্ট্রি পেপার দিয়েছিল। প্রশান্ত সাইনও করেছিল তাও না দেখে। তাছাড়া শিফারই এক
গুপ্তচরের মাধ্যমে জানা গেছে, নিহার এটা চতুর্থ বিয়ে। পূর্বের তিনজন স্বামীই মারা গেছে। এতেও
যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মারা গেছে নাকি মেরেছে?
দিগন্তের পরিবারের কেউ’ই সাধু নয়। অভ্যন্তরে
সবার একটা করে জঘন্য রুপ আছে। সময়ের প্রেক্ষিতে তাদের রুপটাও বেরিয়ে আসছে। তবে নিহা এখন তুরুপের তাশ। ওর থেকেই অজানা তথ্য জানা যাবে। দেখার পালা, আগামীতে কি হয়!

সকাল সাড়ে দশটা! রিংটোনে শব্দে শিফার ঘুম হালকা হলো। কলটা রিসিভ করে হাসিবের কথা শুনল। তারপর ঝটপট উঠে সাফার আম্মুকে একবার দেখে বেরিয়ে গেল। উনাকে দেখার জন্য নার্স আসবে। অনেক বিশ্বস্ত নার্স। ওদিকে নিহা কালকে থেকে বাসায় নেই। প্রশান্ত রাতে ফিরেও পায় নি। ফোন বন্ধ। এই চিন্তায় সারারাত ঘুমও হয়নি। নিহার কাছের মানুষদের ফোন করেছে। তারা সন্ধান দিতে পারে নি। বাংলাদেশে নিহার আত্মীয় নেই। তাই আত্মীয়দের বাসাতে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিহা আমেরিকার মেয়ে। ওখানেই তার জন্ম। বাবা- মা নেই। প্রশান্ত ওকে খোঁজার চেষ্টা করছে। বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানতে পারল না। দিগন্তের কথা মনে হতেই সে সেদিকে ছুটল। দিগন্ত বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কালকে খুব চিন্তাতে ছিল। অতিরিক্ত চিন্তাতে স্কিণ নষ্ট হওয়ার সম্ভবণা থাকে।মুখে ব্রণ বের হয়। চোখের নিচে বিশ্রীভাবে কালি জমে। তখন নিজেকে দেখতে নিজেরই ঘৃণা লাগে। তাই গতরাতে চিন্তা ঝেড়ে সে নিশ্চিন্তে ঘুমের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সফলও হয়েছে। ঘুমালে মস্তিষ্কও ঠান্ডা থাকবে ও দুঃচিন্তা কম হবে। এতে স্কিণের সমস্যাও হবে না।
যেসব কাজ করে ঝামেলা তো আসবেই। গর্বের কাজ করলে নাহয় সবাই বাহবা দিতো। প্রশান্ত দিগন্তের দরজাতে জোরে জোরে নক করল। কিন্তু সাড়াশব্দ নেই। নামধরে ডেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে। একটুপরে ঢুলুঢুল চোখে আর ঊদাম গায়ে দিগন্ত দরজা খুলে দিলো। ওর মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তখন প্রশান্ত বলল,

-‘ভাই, নিহার খোঁজ জানিস?’
-‘উফ, ওই বালের জন্য ঘুমটা ভাঙালে?’
-‘সরি ভাই। বল না নিহা কোথায়?’
-‘শিফার কাছে। হয়তো আর বেঁচে ফিরবে না।’
-‘শিফাকেও আমি ছেড়ে কথা বলব না, দিগন্ত। অনেক হয়েছে আর না।’
-‘আচ্ছা।’

প্রশান্ত রেগে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
শিফাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মেয়েটা বড্ড বার বেড়েছে। তখন দিগন্ত আড়মোড়া ভেঙ্গে খুব শান্ত কন্ঠে বলল,

-‘তনয়ের হাতটা তুমি কেটেছিল, তাই না? আর রাফিকে এক্সিডেন্ট করানোর পরিকল্পনাও ডান? নিহা তোমার জারিজুরি ফাঁস করলে কী করবে? যাই হোক; শিফা তোমাকেও ছাড়বে কি না ভেবে নিও। আর হ্যাঁ,আমি কিন্তু কিচ্ছু জানিনা।আমি নিষ্পাপ। তুমি বেঁচে ফিরলে কথা হবে, বেস্ট অফ লাক। এখন যাও, আমি ঘুমাব।’

কথাটা বলে দিগন্ত কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। ওর ঘুম পুরো হয় নি। আরো ঘুমের দরকার। নয়তো স্কিণ চকচক করবে না। জেনে শুনে স্কিণের ক্ষতি করার মানেই হয় না। তাছাড়া বউ আর ভাইয়ের যুদ্ধ দেখা বাকি। যুদ্ধ না ঠিক; মহাযুদ্ধ। সে হবে দর্শক। দু’চোখ ভরে এদের যুদ্ধ উপভোগ করবে। আহা, ভিন্ন এক সাদৃশ্য। এটা নিশ্চয়ই ভালো কাজ হবে? ওর জীবনে সৎকর্মের সংখ্যাটা খুবই কম। তাই সৎকর্ম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে এমন পূর্ণের কাজে কোটি কোটি টাকার ডিল ওর হাতে আসে!

(থ্রিলার গল্প প্রচুর ভেবে চিন্তে লিখতে হয়।আমি
সময় নিয়ে লিখি তাই আপনাদের পড়ার আগ্রহ জাগে। কারণ আমি অন্যরকম কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করি।আর সারাদিন গল্প নিয়ে বসে থাকার সময়ও আমার নেই। আমার ব্যাক্তিগত জীবনে ব্যস্ততা আছে। সামনে পরীক্ষা। রাতজেগে গল্প লিখলে পড়ব কখন? দিনের বেলাতেও লিখার
সময় নেই। এজন্য একদিন পর পর গল্প দিচ্ছি।
আর যারা গল্প বাদেও আমাকে নিয়ে কটু কথা বলেন, তারা একটাবার ম্মরণ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ নই। বা আমি আপনার টাকায় খাইও না পড়িও না। তাই ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। আর গল্প ভালো না লাগলে ভুলগুলো ধরিয়ে দেন, শুধরে নিবো। তবে আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বললে আমিও ছেড়ে কথা বলব না।
ভুলে যাবো আপনি কে? যারা গল্প পড়ে গল্পের লেখিকাকে জাজ করে তাদের মন- মানসিকতা কেমন বলার অপেক্ষা রাখে না, ধন্যবাদ। )

শিফা ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়তেই নিহা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ওর শরীর লালবর্ণ হয়ে জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, প্রাণটা বুঝি বেরিয়েই যাবে।
তবুও মুখ খুলছে না। শিফা নিহার হাতে ছুরির আঘাত করে মরিচের গুঁড়ো ডলে দিলো। নিহা এবার দাপড়াতে লাগল। চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়
কেঁদে ছেড়ে দেওয়ার আঁকুতিও করছে। শিফাকে কোটি টাকার অফারও করেছে। আমেরিকায় ওর বাড়ি, গাড়ি যা আছে সবকিছুর ভাগ সে দিবে।
শিফা নিশ্চুপ হয়ে ওর ডান হাতের বাহুও কেটে মরিচের গুঁড়ো লাগিয়ে দিলো। প্রচন্ড জ্বলছে।
নিহা কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগল। শিফার মুখে হাসি ফুটল। এতক্ষণে ওর মনে সুখ
সুখ অনুভব হচ্ছে। শিফা নিহাকে বলল,

-‘প্রশান্ত সাফাকে কেন মেরেছে?’
-‘জানি না। তবে আমি ওদের ইন্টিমেট হতে সাহায্য করেছি।’

To be continue………..!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৬]

-‘প্রশান্ত, সাফাকে কেন মেরেছে?’
-‘জানি না। তবে আমি ওদের ইন্টিমেট হতে সাহায্য করেছি।’

শিফা সর্বশক্তি দিয়ে নিহার গালে থাপ্পড় দিলো।
ওর ধৈর্য্যের বাঁধ আর মানছে না। সবাই’ই পশু।
মানুষ হলে বিবেকবোধ বলে কিছু থাকত। পাপ ও পূর্ণ্যের পার্থক্য বুঝত। নিহার এই কথা শুনে,
হাসিবও এগিয়ে এসে চার থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
সাফা ও শিফাকে সে বোনের মতো ভালোবাসে।
অথচ এরা! মৃত সাফার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ছিল; প্রেগনেন্ট। তাও আড়াই মাসের। রিপোর্ট আগে শিফা দেখে হাসিবকে দিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়েছিল। যাতে ব্যাপারটা পাঁচকান না হয়। নয়তো সাফার আব্বু-আম্মু সহ্য করতে পারতেন না। স্বপ্নীলও ভেঙ্গে পড়ত। সবার ভালোর জন্য শিফা একাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। এজন্য কেউ
একথা জানে না। নাহলে সন্মান নিয়ে টানাটানি হয়ে যেতো। সাফার বাবা-মাকেও সমাজের লোক বাঁচতে দিতো না। কথার খোঁচা মেরে। এতকিছু শিফা নিজ হাতে সামলেছে। ওর মধ্যেও কেমন ঝড় বইছিল, কেবল সেই জানে! আর সবকিছু হয়েছে এই নরপশুদের জন্য। সাফা মারা গেল, আর পাপীরা বেঁচে রইল। তবে, তাদেরও পতন
হবে, হতেই হবে! সময় কথা বলবে। তবে নিদির্ষ্ট এক পরিস্থিতিতে। পাপ এবং পাপীদের পতন না ঘটলে পৃথিবী আগেই রসাতলে চলে যেতো। না, এবারও পাপ ও পাপিষ্ঠের বরাবর হবে। তখন হাসিব নিহাকে বলল,

-‘এখনো সময় আছে সত্য প্রকাশ করো। নয়তো ফল ভালো হবে না।’

-‘আমি কিছু করি নি। আমাকে ছেড়ে দাও।’

হাসিব মারতে গেলে শিফা আঁটকে দিলো। ওকে
ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা বের করার সময় নেই। যা করতে হবে ঝটপট। শিফা হাতের ছুরি রেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,

-প্রশান্ত সাফাকে কেন মেরেছে? আর কে কে ওর সঙ্গে জাড়িত?’

-‘জানিনা।’

ওর এই মিথ্যা কথাটা সহ্য করার মতো না। তাই
শিফা পাশে থাকা ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়ে দিলো।
নিহা আতর্নাদ করে উঠল। পুনরায় গরম পানি
দিতে গেলে নিহা বলার জন্য উদ্ধত হলো। তবে
বলতে পারল না, কান্নার জন্য।শিফা ওকে একটু সময় দিলো। যাতে পুরো ঘটনা এখনই জানতে পারে। আর ওর জানাও খুব জুরুরি। নিহা বেশ কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল। পানি পেলে বেশ হতো। তবে ভয়ে পানির কথা বলতে পারল না। যদি টগটগে গরম পানি দেয়। গরম পানিতে পিপাসা মিটবে না। বরং ঝলসে যাবে। শরীরটা যেমন ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু গলাও শুকিয়ে গেছে। ভয়ে বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। পূর্বে কাউকে এতটা ভয় পায় নি সে। অথচ আজ পাচ্ছে! তাও ছোট্ট মেয়েটাকে। শিফার চোখে ধারালো চাহনি। যেন নিমিষেই ভষ্ম করে দিবে। ক্ষুধার্ত বাঘিনী যেন অবশেষে শিকারকে হাতে পেয়েছে। শিকার শেষ।
শিফা এত কঠোর নিহার জানা ছিল না।কীভাবে হলো? তাও হঠাৎ! নিহা এবার একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করল।

প্রথম থেকেই প্রশান্তর নজর ছিল, সাফার দিকে। মেয়েটার শারীরিক গঠন বেশ আকষর্ণীয়। ওর নাকি ছুঁইয়ে দেখার বাসনা জাগে। প্রশান্ত নারীর দেহের পাগল। দিগন্তের পছন্দ উচ্চমানের হলেও প্রশান্ত এমন নয়। একটা হলেই হয়। তবে চাই-ই চাই! আর ভালো সর্বদা ভালোকে আকষর্ণ করে আর খারাপ খারাপকে। ওদের পরিবারের সবাই এমন। কারো চক্ষুলজ্জাও নেই। প্রশান্ত বাবা-মা ও দিগন্তের সামনে মেয়ে নিয়ে রুমে ঢুকে। বাবাও তাই। বড়রা করলে ছোটটা বাদ যাবে কেন? তাই
দিগন্তও। সেও পুরুষ। তারও তো চাহিদা আছে।
আর নিহা বিয়ে ছাড়া বান্ধবীর পরিচয়ে বাসায় আসত, থাকত। কেউ কিছু বলতো না। বাঙালী কার ভেতরে কি আছে খোঁজ করে না। এরা মিষ্টি কথাতে মজে বেশি। সেও প্রশান্তদের ভাড়াটিয়ার
সাথে যেভাবেই মিশতো। বোকা এবং সহজসরল সেজে। এজন্য সবাই খুব সুনামও করতো। নিহা
বিয়ে ছাড়াই প্রশান্তের সঙ্গে অসংখ্যবার ইন্টিমেট হয়েছে। ব্যাপারটা ওদের কাছে খুবই স্বাভাবিক।
একদিন দু’জনে অর্ধনগ্ন হয়ে শুয়ে ছিল। তখন প্রশান্ত গদগদ হয়ে বলেছিল,

-‘নিহা ডালিং নিচের তলার মেয়েটাকে বিছানার আনার ব্যবস্থা করো, প্লিজ!’

তখন নিহা ভাব দেখিয়ে মুখ ভেঙিয়েছিল। এর কারণও আছে। সে প্রশান্তের নাক টেনে আহ্লাদী হয়ে বলেছিল,

-‘এর বিনিময়ে আমি কি পাবো, হুম?’
-‘আমার জানপাখিটার কী চায়, শুনি?’
-‘তোমার ভাইকে। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও।’
-‘একথা শুনলে তোমাকে গুম তো করবেই; সঙ্গে আমাকেও।’
-‘তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করো?’
-‘করবো জান। আগে ওই পাখিটাকে খাওয়ার
ব্যবস্থা করো।’

সেদিন থেকেই নিহা সাফার সঙ্গে বেশি মিশতো।দু’দিনে এত আপন হয়, যে সাফারও ওর পেটের কথা সব নিহাকে বলেও দেয়। সব বলতে সব’ই।
এমনকি দিগন্তকে পছন্দ করার কথাও। ওর দূর্বল পয়েন্ট জেনে নিহা আর প্রশান্ত পরিকল্পনা করে।
নিহা সাফাকে বোঝাতে থাকে সে নিজের সাফার কথা দিগন্তকে জানাবে। ওদের একজোড়া করেই ছাড়বে। তার দুইদিন পর, নিহা জানায় দিগন্তকে সে সাফার কথা জানিয়েছে। দিগন্ত নাকি রাজি।
সেও সাফাকে পছন্দ করে।সাফা খুশিতে গদগদ।
প্রশান্ত দিগন্তের নামে আইডিও খোলে ‘ওয়াসিম আহমাদ দিগন্ত।’ পরে ওই আইডি দিয়ে সাফাকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। এসব এত দ্রুত হওয়াতে সাফা নিহাকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে থাকে।শিফাকে কম সময় দিতে থাকে। ওদের তেমন কথাও হতো না। শিফা ফোনে দিলে কাজের ব্যস্ততা দেখাত।আর শিফা বাসায় আসলে; ওকে বসিয়ে রেখে সাফা
নিহার কাছে চলে যেতো। শিফা তখনো নিহাকে চিনত না। সে আবার আগ বাড়িয়ে কারো সঙ্গে মিশতে পারে না। সাফারও নিহার সম্পর্কে কিছু বলেছিল না। তারপর থেকেই প্রশান্তর সঙ্গে ওর কথা বলা আরম্ভ হয়েছিল। একদিন প্রশান্ত ওকে বলেছিল,

-‘সাফা, বাইরে আমাকে দেখলেও ঢং করবে না। কেউ যেন না বুঝে আমাদের সম্পর্ক আছে।মনে রোখো! আর তোমার ওই বান্ধবীকেও কিছু বলবা না। আমরা ওকে সারপ্রাইজ দিবো।’

-‘শিফাকে কিছু না বললে আমার শান্তি লাগে না। ওকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। সে কলিজার বান্ধবী।’
-আর আমি? আমাকে বাসো না?’

সাফা লজ্জায় রাঙাবতী হয়ে রিপ্লাই করেছিল,
-‘খুব৷’
-‘তাহলে আমার কথা রাখতে হবে মানে, হবেই।’
তোমার ভালোবাসার কসম!’
-আচ্ছা।’

এভাবেই ওদের সম্পর্ক চলছিল। এরপর দিগন্তও অফিসের কাজে অন্য জেলাতে চলে গেল। এটা খুব ভালো হয়েছিল। এরপর সাফা রোজ ওদের বাসাতে আসত। নিহার সঙ্গে গল্প করে ওর সময় কাটত। নিহাও সাফাকে কিছু না কিছু রান্না করে খাওয়াত। আর খাবারের সাথে একটা মেডিসিন মিশিয়ে দিতো। প্রতিদিন। কারণ ওদের অজানা নয়, সাফার সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু। তাই তখন থেকে সেই পরিকল্পনা। নয়তো ফেঁসে যাবে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। তারপরে, সাফা প্রশান্তদের বাসাতে কিছু খেলেই ঘুমিয়ে যেতো। কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে। আর প্রশান্তও ফায়দা উঠাতো।ওর কাজ হয়ে গেলে চলে যেতো। আর সাফাকে ঠিকঠাক করে নিহা ওর পাশে শুয়ে পড়ত। সাফা জেগে নিহাকে ঘুমাতে দেখে আস্তে করে উঠে চলে যেতো। আর নিহা হাসত। মেয়েটা খু্ব’ই বোকা!
এভাবে দিনগুলোও চলত লাগল। আর সাফার অবস্থাও খারাপ হতে লাগল। প্রশান্ত প্রথমদিকে প্রোট্রেকশন ব্যবহার করলেও, পরে করতো না।
সাফা নিজেও বুঝতো ওর সঙ্গে কিছু ঘটছে।তবে লজ্জায় জিজ্ঞাসা করতে পারত না। আবার কি ঘটছে মনে করতে পারত না। ততদিনে ওষুধে ওর অনুভূতিশক্তি অকেজো করতে সক্ষমও হয়েছে।
সাফা একদিন বলেছিল,

-‘নিহা আপু, আমি ঘুমালে কেউ আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়?’

-‘তোমার উনি খুব আবেগী হয়ে লিপ্ত হয়েছিল।
পরে এখন আফসোস করছে।’

সেদিন দিগন্ত দুইদিনের জন্য বাসায় এসেছিল।
তাই নিহাও বুদ্ধি করে দিগন্তের নামটা বলেছিল।
পরে প্রশান্ত ইনবক্সে অভিনয় করে বারবার ক্ষমা চেয়েছিল। আর দিগন্ত পাতালঘরে কাজের জন্য একসপ্তাহ ছিলো। তখন দিগন্তের নামে প্রশান্ত’ই সঙ্গমে লিপ্ত হতো। বেচারা অবচেতন সাফা। সে
ক্ষুণাক্ষরে টেরও পায় নি। মৃত্যু আগ পর্যন্ত সাফা জেনেছিল, দিগন্ত ওর কাছে এসেছিল। একথাটা কাউকে বলতেও পারত না। ততদিনে নিহা ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। প্রশান্তও কার্যশেষে কম কথা বলতো। সাফারও বেগতিক অবস্থা।
কারো সাথে শেয়ার করবে এটাও মস্তিষ্কে আসত না। চোখে কম দেখা, বমি আসা, ভুলে যাওয়া, মস্তিস্ক কাজ করাও বন্ধ করে দিতো। সে খেতেও
পারত না। ওকে হসপিটালে ভর্তি করাও হলো। তখনো ওর সঙ্গে ফোনও ছিল। প্রশান্ত’ই ফোনটা সরিয়েছিল। যাতে প্রমাণ না থাকে। তবে প্রশান্ত এটা জানত না, সাফার আইডিটা শিফাই খুলে দিয়েছিল। পরে সাফাও নিজের প্রতি অকারণে বিরক্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর শিফাকে শেষবার বলেছিল,

-‘প্রিয় আমার প্রাণ নিয়েছে। হ্যাঁ ওই, ওই প্রিয়’ই প্রাণ নিয়েছে।’

শিফা আর শুনতে পারল না। সে মাটিতে বসেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সাফার মৃত্যুর পর;সে এই প্রথম চিৎকার করে কাঁদছে। শিফা সবাইকে সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাঁদতেও পারত না। কষ্টগুলো আর বুক ঠিঁকতে বেরিয়ে আসতে চাইতো। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখত। সে
কলিজার বান্ধবীকে হারানোর ব্যথা মানতে পারে না। কষ্ট হয়! দম আটকে আসে। অদূরে দাঁড়িয়ে হাসিবও কাঁদছে। একটুপরে, শিফা উঠে নিহাকে এসিডে ঝলসানোর ইশারা করল। ওর কঙ্কালটা
প্রশান্তের নামে পার্সেল করে পাঠাতে বলল। যেন সেও কিছুটা আঁচ করে। নিহার আঁকুতিতে কারো মন গলল না। দিনশেষ হাসিবও তাই’ই করল।

দুইদিন পর,

শিফা আর প্রশান্ত মুখোমুখি বসে আছে। কোনো এক নামীদামি রেস্টুরেন্টে। দু’জনের মুখে কুটিল
হাসি। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি! অপ্রকাশিত কথা হচ্ছে; তাও চোখে চোখে। নিহার কঙ্কালটা পেয়ে প্রশান্ত খুব হেসেছে। ওর চাল ওকে’ই দেখাচ্ছে। মেয়েটা
সত্যিই বোকা। নয়তো এইরকম বোকামিটা কেউ করে? আর নিহাকে খুঁজছিল, একটা পাসওয়ার্ড জানতে। কারণ ওর মনে পড়ছিল না। তাছাড়া কিছু নয়। নিহা মরলেই কি আর বাঁচলে কী? সে কেবল খেলার ঘুঁটি ছিল। তখন প্রশান্ত শিফার শরীরে চোখ বুলিয়ে বলল,

-‘তোমার ওই ঠোঁটজোড়া আমাকে খেতে দাও। যতক্ষণ না আমার তৃপ্তি মিটবে। নয়তো….!’

পাশের টেবিলে থেকে দিগন্ত ফোনে গেম খেলতে খেলতে উত্তর দিলো,

-‘হজম করতে পারবে? ভেবে নিও। বেস্ট অফ লাক।’

To be continue………!!