সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১৫+১৬

0
347

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৫

(৩৩)

কিছুক্ষণ আগে পিয়ন এসে স্মরণের চেম্বারে একটা চিঠির খাম রেখে গেছে। স্মরণ অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে সোজা নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলো। পর পর তিনটা ও.টি শেষ করে নিজের চেম্বারে এসে চেয়ার দখল করে বসতে বসতে চোখ পড়লো টেবিলের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা খামের উপর। স্মরণ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিতেই দেখতে পেলো নিশ্চিন্দপুর থেকে রমিজ নামের একজন তার নামে চিঠিটা পাঠিয়েছে। স্মরণ কিছু সময় চিঠির খামের দিকে দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে বসে রইলো অজান্তে তার মনের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। নিশ্চিন্দপুর থেকে বিদায় নেয়ার পর পুরো একটা মাস কেঁটে গেছে আর এই একমাসে সে একটিবারের জন্যও রুমাইসাকে মন থেকে সরাতে পারে নি। চলে আসার দিন রুমাইসা কেনো এইভাবে তার কাছে ছুটে এসেছিলো? কেনই বা তাকে এতটা ভরসা করে ভর সন্ধ্যে বেলায় কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া একজন অপরিচিত যুবকের কাছে এসে অনুরোধ করছিলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও খুঁজে পায় নি সে।

চিটির ভাঁজ খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে স্মরণ আজ থেকে দুমাস আগের কথা ভাবতে লাগলো। রমিজের হাতে করে একটুকরো চিঠি পাঠিয়েছিলো রুমাইসা যার আগাগোড়া জুড়ে শুধু বাবার অসুস্থতার কথাই বর্ণনা করে গিয়েছিলো মেয়েটা। সেদিন চিঠির ভাঁজ খুলতেই স্মরণ শিউলি ফুলের কড়া গন্ধ পেয়েছিলো। আশ্চর্য রকমের মাধকতা ছড়িয়েছিলো সে গন্ধে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে কেমন অনুভূতি শুন্য একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো স্মরণের। অজানা কারণেই চিটির আড়ালে থাকা মেয়েটি প্রতি তার মনে কৌতুহল জাগ্রত হয়। রুমাইসার কথা ভাবতে ভাবতে স্মরণের বুক ছিঁড়ে প্রশস্ত নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। হয় তো সেদিন রুমাইসার আকুতি মিশ্রিত অনুরোধ সে ফেলতে পারতো না যদি না শেহ্ওয়ার রুমাইসার আগেই সেখানে না এসে পৌঁছাতো। কিন্তু কি আর করা ভাগ্যে লিখন কেই বা বদলাতে পারে তবে হ্যাঁ কিছুটা চেষ্টা সে করেছিলো তবে সেটা আড়ালে থেকে। হয় তো মেয়েটা জানতে পারবে না তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ স্মরণের হাত ধরেই হয়েছিলো।

টেবিলের একপাশে রমিজের লিখা চিঠিটা অনাদরে পড়ে আছে। স্মরণ এক মগ কফি হাতে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। সামনে যত দূর চোখ পড়ে শুধু ইট পাথরে গড়া বিশাল বিশাল দালান। যার আগাগোড়া জুড়ে শুধুই চাকচিক্যের ছড়াছড়ি কোথাও এতটুকু সজীবতার ছোঁয়া নেই।
স্মরণ গোধূলির মুক্ত অম্বরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

“কি ভাবছো এতো স্মরণ?”
পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠস্বর কানে এলেও ফিরে তাকালো না স্মরণ আগের ভঙ্গিমায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো সে।

“হোয়াট হ্যাপেন্ড? তুমি আমার কথার উত্তর কেনো করছো না? তুমি কি আমায় ইগ্নোর করছো?”

“মিস মোনালিসা আপনি হয় তো ভুলে যাচ্ছেন আমি আপনার সমবয়সী নয়। আর এটাও ভুলে যাচ্ছেন যে আপনার সাথে আমার ইগ্নোর করা কিংবা না করার মতো কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। বাই দ্যা ওয়ে আপনি আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করবেন।”
মোনালিসার দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বলল স্মরণ।

“সরি স্যার।”

“ইট’স ওকে। পরের বার যেনো এমন ভুল না হয়। এখন বলুন কি কাজে এসেছেন?”

“স্যার দশ নাম্বার কেবিনের একজন রুগীর এডমিট হয়েছেন। হার্টের প্রব্লেম আপনি কি একবার ভিজিট করে আসবেন?”

“ডা.ফায়াজ উনাকে দেখছেন। আপনার আর কিছু বলার আছে?”

“স্যার আসলে আমি চাইছিলাম আপনি যদি ফ্রি থেকেন তো,,,।”

“আপনি এখন আসতে পারেন মিস মোনালিসা। আমি একটুপর বের হবো।”

স্মরণের এমন কঠিনতা দেখে মনে মনে হতাশ হলো মোনালিসা। সে কোনো ভাবেই স্মরণকে তার মনের কথা বুঝাতে পারছে না, এমনকি যতবার সে সেটা বুঝাতে চাইছে ততবারই স্মরণ তাকে অপমান করছে। বার বার স্মরণের কাছে অবহেলিত হওয়ায় নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগলো তার।

“কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?”

স্মরণের গম্ভীর গলা কানে পৌঁছাতে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো মোনালিসা। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্মরণ নামক যুবকটির উপর দৃষ্টি পড়তেই যেনো সে মনে মনে আরেক দপা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেলো। এই যুবকটিকে সে বিষন ভাবে ভালোবাসে তবুও যে কেনো সে তাকে তার ভালোবাসার কথাটি বুঝাতে পারে না।

মোনালিসা এক দৃষ্টিতে স্মরণের দিকে তাকিয়ে আছে। স্মরণ এবার প্রচন্ড বিরক্তিতে ভ্রুযুগল কুচকে নিলো তারপর কন্ঠে কাঠিন্যতা ধারণ করে বলল,

“মিস মোনালিসা আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারেন নি?”

“ইয়েয়েস স-স্যার।”

” তবে এবার জান। দরজা ওই দিকে।”

বলেই স্মরণ এসে চেয়ার দখল করে বসলো। মোনালিসা চলে গেলে ফায়াজ এসে চেম্বারে ডুকলো।

” মেয়েটাকে তুই অকারণেই একটু বেশি বকিস।”

“অকারণে আমি কাউকে কিছু বলি না ফায়াজ সেটা নিশ্চই তোর অজানা নয়।”

“মেয়েটার সাথে তো একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারিস।”

ফায়াজের কথায় এবার ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকালো স্মরণ।

“না মানে মেয়েটা যে তোকে ভালোবাসে সেটা তো তুই বুঝতে পারিস।”

” তুই কি এগুলো বলতে এসেছিস এখানে?”

“আচ্ছা তুই এমন কেনো বলতো? তুই কি কাউকে বুঝতে পারিস না?”

“কাকে বুঝার কথা বলছিস? ”

“ওই যে গ্রামে যে মেয়েটা তোর,,,।”

স্মরণ মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখায় ব্যস্ত ছিলো ফায়াজের কথায় সে কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো।

“কি হলো?”

“রমিজ চিঠি পাঠিয়েছে নিশ্চিন্দপুর থেকে।”

“কি বললো সে?”

স্মরণ মুখে কিছু না বলে ফায়াজের দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দিলো। ফায়াজ কিছুটা অবাক হয়ে সেটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। রমিজ চিঠিতে খুব একটা বেশি কিছু লিখে নি শুধু এতটুকুই লিখেছে আগামী মাসের তেরো তারিখ রুমাইসার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটা বিয়ে করতে চাইছে না কিন্তু বাবার কথা ফেলতে না পেরে বিয়েতে সে মত দিয়েছে। করিম সাহেবের শরীরটা আগের থেকে ভেঙে পড়েছে। স্মরণ যাবার আগে যদিও বলে গেছে আবার ফিরে এসে তাকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে কিন্তু সেটা আর সে করে নি। আত্নসম্মানের দিকে চেয়ে করিম সাহেবও স্মরণকে কিছু বলতে পারেন নি, তবে বেশ কয়েকবার চিঠি লিখবেন ভেবেও পুরোবর্তীতে তা আর লিখা হয় নি। অবশ্যই শেহ্ওয়ার কয়েকজন ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে করিম সাহেবকে কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় নি। এখন তিনি চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে।

চিঠি পড়ে বেশ কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো ফায়াজ। স্মরণের মাঝে সে এখন পর্যন্ত এতটুকু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে না অথচ সে রুমাইসার জন্য এখানে বসেও অনেক কিছু করে গেছে যেটার একমাত্র সাক্ষী ফায়াজ নিজে। একটা মানুষ কখন একটা মেয়ের জন্য এতটুকু করতে পারে সেটা সে জানে না তবে শুধু মানবতা থেকে যে স্মরণ রুমাইসার জন্য এতটুকু করছে তা একেবারেই নয়।

(৩৪)

বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে আছে রুমাইসা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ফোঁটা টপ টপ করে ঝড়ে পড়ছে। তার এলোমেলো জীবনটা যেনো আরো এলোমেলো অগোছালো হয়ে পড়ছে। কোথাও কেউ নেই যে তার সমস্যা গুলো বুঝবে এই বিপদ থেকে কেউ তাকে রক্ষা করবে। সামনে তার মেট্রিক পরিক্ষা এর আগেই তাকে শেহ্ওয়ারকে বিয়ে করতে হচ্ছে। সে জানে না শেহ্ওয়ার হঠাৎ করেই কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিলো। তবে একটা ব্যাপারে সে খুব খুশি যে তাকে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে পরিক্ষা দিতে হবে না। শেহ্ওয়ার চেয়েছিলো যে রুমাইসাকে যেনো তাদের সাথে শহরে চলে যায় এমনকি পরীক্ষাও যেনো শহরেই দিতে পারে তার সব ব্যাবস্থাও সে করে ফেলেছিলো কিন্তু কি যেনো এক কারণে সেটা হয়ে উঠে নি, তাই সে পরীক্ষার আগেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেদিক রুমাইসা স্কুলে যাবার পর প্রধান শিক্ষক তাকে অফিস কক্ষে ডেকে পাঠান। আর তখনি রুমাইসা জানতে পারে তাকে এখান থেকে শহরের স্কুলে ট্রান্সফার করা হবে না সে এখান থেকেই পরিক্ষা দিতে পারবে। শেহওয়ার যদিও বোর্ড থেকে সবরকম ব্যবস্থা করে ফেলেছিলো কিন্তু কেউ একজন চেষ্টা করে সেটা বাতিল করেছে।

“আপা আম্মা তোমারে ডাকে।”
রিমা ডাক দিতেই রুমাইসা চোখের জল মুচে নিলো। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে সে রিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“হ্যাঁ রে রিমা তুই কি বলতে পারিস আমার ট্রান্সফার হওয়ার ব্যাপারটা কি ভাবে আটকে গেলো?”

“না তো আপা আমি তো জানি।”

“বাবা জানেন এই ব্যাপারে?”

“উহু।”

তবে কে এমন আছে যে অজান্তেই তার এত বড় উপকার করলো ভাবতে ভাবতে রুনাইসা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলে রিমা পেছন থেকে ডেকে বলল,

“আপা,,!”

“হু?”

“একখান কথা কই তুমি রাগ করবা না তো?”

“উহু বল কি কথা।”

“শেহওয়ার ভাইরে তুমি বিয়া কইরো না।”

রিমা ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললো। রুমাইসা চলে যেয়ে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো ভ্রু কুচকে রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুই হঠাৎ এই কথা বলছিস কেনো রিমা?”

“আমার মনে হইলো তাই কইলাম। উনার চাইতে স্মরণ ভাই অনেক ভালা তুমি তারে বিয়া কইরা নাও। আচ্ছা তুমি কি স্মরণ ভাইরে পছন্দ করো?”

স্মরণের কথা মনে পড়তেই রুমাইসার বুকের ভেতর ধুমড়ে মুচড়ে উঠলো। সে জানে না স্মরণকে সে পছন্দ করে কিনা তবে বাবার পর যদি চোখ বুজে সে কাউকে ভরসা করে সে হলো স্মরণ। যে মানুষটাকে সে খুব ভালো করে জানে না, চেনে না, যার সাথে তার অল্পকিছু সময়ের আলাপ তবুও কেনো সে তাকে চোখ বুঝে বিশ্বাস করতে পারে? ভরসা করতে পারে? অনেক ভেবেছে রুমাইসা কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যার্থ হয়েছে। এই অদ্ভুত প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তরই সে পায় নি।

চলবে,,,,।

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৬

(৩৪)

প্রহেলিকা ঘাঢ় আবরণে ঢাকা অলকানন্দপুরের বিস্তর ধানের খেত। চারদিক সাঁইসাঁই করে বইছে উত্তরী সমীরণ। হাঁড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচতে গ্রামের লোকজন রাস্তার পাশে খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। রুমাইসা তাদের পাশ কাটিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা তাকে পেছন থেকে ডাকপাড়ল। রুমাইসা ঘুরে তাঁকাতে মহিলা আগুনের পাশ থেকে সরে এসে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলো।

“ও রুমাইসা হুনলাম তোমার নাকি বিয়ার দিন ঠিক হইছে সামনের শুক্কুরবার? শুধু কি কলেমা পড়ায় বিয়া হইবো?”

মহিলা বেশ আগ্রহ নিয়ে কথাটা জিজ্ঞাস করলেও রুমাইসা একেবারেই উত্তর দিতে আগ্রহবোধ করলো না। সে নিছক মাথা দুলালো আর এতেই যেনো মহিলাটি দ্বিগুণ উৎসাহ পেলেন, তিনি আরেকটু আগ্রহী হয়ে বললেন,

“জামাই নাকি তোমার আপন মামতো ভাই? বিদেশ থেইকা আইছে, মেলা টাকা পয়সার মালিক। যাক তুমি মা মরা মাইয়া নিজের মামাতো ভাই তোমারে বিয়া করতে রাজী হইছে এইডা তো তোমার সৌভাগ্য।”

রুমাইসা প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে মাথা দুলিয়ে জবাব দিলে মহিলা এক গাল হেসে রুমাইসার চিবুক স্পর্শ করে বললেন,

“সুখী হ মা, সুখী হ। সারাটা জীবন তো সৎ মার লাথি ঝাঁটা খাইয়া দিন পার করছো, এইবার যদি আল্লাহ তোমার কপালে সুখ লেইখা রাখে।”

রুমাইসা চুপচাপ মহিলার কথা শ্রাবণ করছে। তার পরিবারের মতো গ্রামের কিছু মানুষ একি কথা মনে করে। তারা বিয়েটাকে সুখ বলে ভাবে। আচ্ছা, মা মরা মেয়ে হয়েছে বলে কি তার জীবনে বিয়ে ছাড়া সুখের অন্য কোনো পথ আর বাকি নেই, নাকি বিয়েই একমাত্র সুখের দ্বারপ্রান্ত?

“তা কোন দিকে যাইতে নিছিলা?”

“স্কুলে।”
অন্যমনষ্ক হয়ে জবাব দিলো রুমাইসা আর তাতেই মহিলা অবাক হবার ভঙ্গিতে কপালে ভাঁজ তুললেন। কিছুটা ভ্রুকুঞ্চন করে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“এইডা আবার কেমন কথা, দুই দিন পর বিয়া আর আইজ তুমি ইশকুলে যাও? এমন কথা তো বাপের জন্মে হুনি নাই। তা মাইয়া মানুষ এত ইশকুলে যাইয়া কি হইবো, সেই তো বিয়া কইরা ঘর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা পালতে হইবো। এত পড়ালেহা কইরা কোনো লাভ কিছু হইবো?”

মহিলার কথায় খানিকটা বিরিক্ত হলো রুমাইসা। ইচ্ছে করছিলো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এই মুহূর্তের তার তর্ক করতে ইচ্ছে করলো না। যে যেটা বুঝে না তার সাথে সে বিষয় নিয়ে তর্ক করা অনর্থক বলে মনে করলো সে। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খেতের আইল ধরে হাঁটা লাগালো সে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে রমিজের বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে হবে। নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু সে করবে। আর তাতে যা হবার হোক তবুও সে হার মানবে না। নিজের আপন লোকদের কাছ থেকে ঠকে যাবার মতো ভুল সে আর দ্বিতীয় বার করবে না।

(৩৫)

বিছানার এক কোণে তিনটি ছেড়া খাম অবহেলায় পড়ে আছে। স্মরণ ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তোয়ালে চুল মুছতে মুছতে বিছানার একপাশটায় এসে বসলো। নিশ্চিন্দপুর থেকে রমিজ চিঠি পাঠিয়েছে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দিন আগে আসা চিঠি আর খুলে পড়া হয় নি স্মরণের। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় সুযোগ করে উঠতে পারে নি চিঠিগুলো পড়ে দেখার।

হাত থেকে তোয়ালে রেখে চিঠির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বেশ কিছু সময় বসে থেকে পরে সেখান থেকে একটা চিঠি তুলে তা পড়তে আরম্ভ করলো স্মরণ।
বরাবরের মতো এবারো রমিজ তাকে গ্রামে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছে, সাথে গ্রামের নানান সমস্যার কথাও সে জানিয়েছে। স্মরণ চিঠিতে চোখ বুলিয়ে স্মিত হাসলো তারপর দ্বিতীয় চিঠি হাতে তুলে নিলো। এই চিঠিটা আজ থেকে চারদিন আগে এসেছে। খামের উপর রমিজের নাম থাকলেও চিঠির শেষাংশে রুমাইসার নাম দেখে কিছুটা অবাক হলো স্মরণ। নিশ্চিন্দপুর ছেড়ে আসার পর রুমাইসা কখনো তাকে চিঠি লিখে পাঠায় নি, হয় তো অনেকটা অভিমান থেকে নয় তো লজ্জায়। অবশ্য রুমাইসা থেকে চিঠি পাওয়ার আশা কখনো সে করে নি। তবে মনের কোথাও না কোথাও থেকে সে চেয়েছিলো রুমাইসা তাকে চিঠি দিক।

রুমাইসার টানা হাতে লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই স্মরণের বুকের বা পাশটা চিন চিন করে উঠলো। তার নামে লিখা এটাই রুমাইসার প্রথম চিঠি, যদিও এর আগে একটি চিঠি সে রুমাইসার কাছ থেকে পেয়েছিলো তবে সেটা সে একান্ত তাকেই উদ্দেশ্য করে লিখে নি। একটুকরো খোলা চিঠি যার আগাগোড়া জুড়ে শুধু প্রিয় মানুষটির অসুখের কথা লিখা ছিলো, ভাগ্যক্রমে সে চিঠি স্মরণের হাতে এসেই ধরা দিয়েছিলো। অবশ্য চিঠিটা পাওয়ার পেছনে পুরো অবদান ছিলো রমিজের। রমিজ মেডিকেল ক্যাম্পে শুধু একজন ডাক্তারকেই ভালোভাবে চিনতো আর সে হলো স্মরণ। তাই তো রুমাইসার দেয়া চিঠিখানা সে স্মরণের হাতেই দিয়েছিলো।

প্রথম দিনের মতো আজও চিঠির ভাঁজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে শিউলি ফুলের মৃদু সুবাস এসে স্মরণের নাকে তীব্রভাবে লাগলো। অজান্তেই স্মরণের অন্তঃকরণে এক অন্যরকম অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো। ঠিক প্রথম দিনের মতো নাম না জানা কিছু শিহরণ চারদিকে নিজেদের আলাদা একটা জগৎ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। স্মরণ চোখ বুজে যেনো রুমাইসার অস্তিত্ব অনুভব করলো। মেয়েটাকে সে কোনোভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না।

রুমাইসার লিখা চিঠিতে খুব একটা বেশি কিছু লিখা নেই, তবে যতটুকু লিখা তাতে একজন পুরুষ মানুষের হৃদয়ে অসারতা অনুভব করানোর জন্য যথেষ্ট।

“ভরসা করার মতো একটা হাত সবার কপালে জুটে না, হয় তো আমি সেই সৌভাগ্যবতী যে তার বিপরীতমেরুতে অবস্থান করা একজন অপরিচিত পুরুষের বাড়িয়ে দেয়া ভরসার হাত মাথার উপর পেয়েছি। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করতে পারবো না, তবে আপনার এই উপকার কখনো ভুলবো না।”

ইতি, রুমাইসা

রুমাইসার চিঠি একপাশে ফেলে রেখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল স্মরণ। নিশুতি রাতের আঁধারে তলিয়ে গেছে রাতের শহর। একাকীত্বরা এসে ঝেঁকে ধরেছে চারদিক থেকে, কোথাও যেনো এতটুকু নিশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবন আর রাতে একটুকরো আঁধার আজকাল তার সঙ্গি হয়ে উঠেছে। পরিবার থেকে দূরে অচেনা অজানা নিশ্চিন্দপুর থেকে চার কোশ দূরবর্তীতে ছোট্ট একটি মফস্বল শহরে এসে ঠাঁই নিয়েছে সে। কিসের আশায় আর কিসের মোহে সে এতদূর পর্যন্ত ছুটে এসেছে। শুধুই কি ওই ষোড়শীর ভরসার একটি জায়গা হয়ে উঠার জন্য, নাকি অন্তঃকরণে ষোড়শীর প্রতি অজানা কোনো টান থেকে।

স্মরণ দশ দিন আগে শুভ্রনগর নামে এক মফস্বল শহরের একটি হাসপাতালে জয়েন করেছে। এখান থেকে অলকানন্দপুর কিংবা নিশ্চিন্দপুর যেতে প্রায় ঘন্টা দুইয়েক সময় লাগে। এখানে আসার কথা তেমন কেউ জানতে না পারলেও রমিজ জানে যে স্মরণ এখন শুভ্রনগর অবস্থান করছে। মাত্র তিন মাসের জন্য সে এখানে জয়েন করেছে তাও কতৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা খাইয়ে। বেঁটেখাটো রমিজ স্মরণের এমন আচরণ বুঝতে পারে না। শহরের এত বড় ডাক্তার হয়ে কেনো সে শুভ্রনগরের ছোটোখাটো হাসপাতালে টাকা খাইয়ে জয়েন করেছে, অবশ্য তাতে তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই রমিজের। সে শুধু স্মরণের কথা অনুযায়ী রুমাইসার পরিবারের খোঁজ খবর এনে দেয়।

(৩৬)

রিমা এবং রুমাইসা এক কম্বলের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। রুমাইসা আধবোজা চোখে সামনের মিটমিট করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমা কিছু সময় এপাশ ওপাশ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। রিমাকে উঠতে দেখে রুমাইসা বলল,

“উঠে পড়েছিস কেনো?”

“ঘুম আসে না আপা।”

“চোখ বুজে শুয়ে থাক তাহলেই ঘুম আসবে।”

রুমাইসার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না রিমা। চুপচাপ জায়গায় বসে কিছু ভাবতে লাগলো।

“কি ভাবছিস এতো?”

“একখান কথা কমু আপা?”

“হু।”

“শেহ্ওয়ার ভাইর সাথে সত্যিই তোমার বিয়া হইবো?”

“হু।”

“তুমি বাবারে না কইয়া দাও, তুমি এখন বিয়া করবা না বইলা দেও।”

“কেউ এখন আমার কথা শুনবে না রিমা। তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না ঘুমিয়ে পড়।”

“কিন্তু আপা শেহ্ওয়ার ভাই,,,।”

হঠাৎ ঘরের বাহিরে কারো চলার শব্দ পেয়ে চুপ হয়ে গেলো রিমা। নিলুফার বেগম ঘরে দরজা আলগা করে মাথা গলিয়ে দেখলেন মেয়েরা কি করছে। রিমা কম্বলের নিচ থেকে উঁকি মেরে দেখলো নিলুফার বেগম গেছেন কিনা। নিলুফার বেগম চলে গেলে রিমা আবার উঠে বসে রুমাইসা চুপচাপ শুয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে তাই হয় তো সেও চাইছে না শেহওয়ারের সাথে তার বিয়ে টা হোক।

চলবে,,,,