সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২৭+২৮

0
376

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৭

(৬৪)

শ্মশানঘাটের কাছে বড় বট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রুমাইসা আসার অপেক্ষা করছে স্মরণ। চারপাশে ফাগুনের মাতাল হাওয়া এলোমেলো হয়ে বইছে। স্মরণের দুহাত দূরে একটা বড় শিমুলগাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। গাছটার একেবারে মগডালে একটা কোকিল চুপচাপ বসে আছে। স্মরণ সে দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো। ফাল্গুনের আরেকটি নতুন ভোর। হাল্কা শীত শীত ভাব আর চারপাশে ফুলের মিষ্টি সুবাস সব মিলিয়ে আজকের সকালটা বড্ড বেশি ভালো লাগছে তার। দেখতে দেখতে চার চারটা মাস কেটে গেলো অথচ মনে হয় যেনো এই তো সেদিন হেমন্তের কুয়াশা ঝড়া নিস্তব্ধ রাতে একফালি চাঁদের শুভ্র আলো সঙ্গে করে সে অলকানন্দপুর হয়ে নিশ্চিন্দপুর গ্রামে গিয়েছিলো। অথচ সেদিন কি সে জানতো যে গ্রামটা সে অতিক্রম করে যাচ্ছে সেটাই তার বড্ড প্রিয় আর কাছের হয়ে উঠবে। কে জানতো এই ছোট্ট গ্রামটিতে এসেই সে তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

বাড়ির পেছনের গেইটে এসে রুমাইসা চারপাশটা একটু ভালো করে দেখলো। এত সকাল কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। নিঃশব্দে গেইট খুলে রাস্তায় নামলো সে, কিছুটা দূর এগিয়ে আসতেই স্মরণকে বট গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগোতে থাকলো। রুমাইসাকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে স্মরণ নিজেও কয়েক পা এগিয়ে সামনে গেলো।

স্মরণকে দেখতে পেয়ে রুমাইসা মনে মনে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো কিন্তু স্মরণের সামনে তা একেবারেই প্রকাশ করলো না। ঠোঁট দুটো মৃদু প্রসারিত করে মাথায় আধগোমটা টেনে স্মরণের সামনে এসে দাঁড়াল। সে ভাবে নি স্মরণ এত সকাল তার জন্য এখানে অপেক্ষা করবে তাছাড়া স্মরণ যে গতকাল রাতে নিশ্চিন্দপুর এসেছিলো সেটাও তার অজানা। ফজরের সময় যখন সে নামাজ আদায় করতে কলপাড়ে অজু করতে গেলো তখন রমিজের স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে তাদের কলপাড়ের এসে উপস্থিত হয়। তখনো চারদিকে ভোরের আলো ফোটেনি। পূর্বাকাশ সবেমাত্র বাদামী রঙ ধারণ করেছে, এত সকালে রমিজের স্ত্রী জমিলাকে কলপাড়ে দেখে কিছুটা অবাক হয় রুমাইসা।
সে ইতিউতি তাকিয়ে শেষে জমিলার দিকে নজর দিলো। জমিলার গায়ে অর্ধ ছেঁড়া চাদর, কোনোভাবে গায়ে পেঁচিয়ে পড়েছে। পায়ে জুতা জোড়াও নেই, শীতে তার ঠোঁট দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। যদিও এখন বসন্তকাল তবু শীত যেনো প্রকৃতিকে ছেড়ে যেতে চায় না। শেষ রাত থেকে সকালে সূর্য উঠা পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা পড়ে। জমিলাকে শীতে এভাবে কাঁপতে দেখে রুমাইসার বড্ড মায়া হলো। জমিলা রুমাইসাকে তার দিকে গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলো। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে রুমাইসাকে বলল,

“অবাক হইছো বইন?”

“জমিলা ভাবি আপনি এসময় আমাদের বাড়ি?”

“হ, বইন তোমার লগে কথা আছে। একটু সইরা আইবা?”

রুমাইসা এবার পুরোপুরিভাবে অবাক হলো। জমিলার মুখ দেখে মনে হলো সে খুব জরুরী কিছু তাকে বলতে এসেছে। জমিলা ইতিউতি করে দেখে গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“খুব জরুরী কথা বইন, নয় তো কি এই সময় শীতের ভিতরে এতটা পথ পাড় হইয়া তোমাগো বাড়ি আই?”

“কি হয়েছে জমিলা ভাবী কোনো খারাপ খবর।”

“খারাপ না তয় এহানে কন যাইবো না।”

“আচ্ছা ওই দিকটায় চলো।”

কলপাড় থেকে সরে এসে দুজনে আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। জমিলা তখনো শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। জমিলার এমন অবস্থা দেখে রুমাইসা নিজের গায়ে জড়ানো চাদর খুলে জমিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“কি এমন কথা ভাবি যে তোমাকে এখনি বলতে হবে। ঠান্ডায় তো ঠকঠক করে কাঁপছো সে খেয়াল আছে?”

“এই ঠান্ডায় আমার কিছু হইবো না বইন।”

“তোমার না হোক তোমার ছেলেটা তো এখনো বুকের দুধ ছাড়ে নি তার তো ঠান্ডা লাগার ঝুঁকি রয়েছে।”

“কি আর করমু বইন রোজই তো এমন বেইন্নাবেলা উইঠা কাম কাইজ করতে অয়। তা যাউকগা এইসব কথা আসল কথা যেইডা কইতে আইছি ওইডা হুনো।”

“কি কথা?”

“তোমার ভাই গত রাইতে বাড়িত ফিরে নাই, সারা রাইত চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতা। পাই নাই বইন। শেষ রাইতে যখন মানুষটা বাড়িত ফিরলো হুনলাম সারা রাইত নাকি ডাক্তার সাহাবের লগে আছিলো।”

জমিলার মুখে ডাক্তার সাহাব কথাটা শুনে রুনাইসার বুক ধক করে উঠলো। বুকের বা পাশটা তৎক্ষণাৎ খালি খালি লাগতে শুরু করলো। স্মরণের শূন্যতা তাকে কম কষ্ট দেয় নি এতদিন। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত আহত করেছে। প্রতিরাতে একরাশ বিষণ্ণতাকে সঙ্গে করে কাটিয়েছে সে। স্মরণের অনুপস্থিতি তাকে পুড়িয়েছে খুব। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেছে কতবার স্মরণের কথা ভেবে। প্রতিনিয়ত অপেক্ষা প্রহর গুনেছে রুমাইসা স্মরণের পথ চেয়ে।

“ডাক্তার সাহেব মানে? উনি কি,,,? ”

“হ বইন কাল রাইতে চেয়ারম্যান বাড়িত আছিলো দুইজন। তয় একখান খবর আছে তোমার লাইগা। ডাক্তার সাহাব তোমারে কইতে কইলো।”

জমিলার কথার প্রতিউত্তরে কোনো জবাব দিতে পারলো না রুমাইসা। তার হৃদপিন্ড দ্রুত উঠানামা করতে শুরু করেছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। স্মরণ গ্রামে এসেছে এটা যেনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। সে হয় তো এতটা আশা করে নি স্মরণের কাছ থেকে তাই সহসা তার চোখ দুটো ভিজে উঠলো। এই পৃথিবীতে এখন সে একমাত্র স্মরণকেই চোখ বুজে ভরসা করতে পারে। যার হাতে হাত রেখে সে অনায়াসে চলতে পারে। বাবার পর হয় তো স্মরণই তাকে এতটা আগলে রাখছে। নিজের সবটা দিয়ে সে তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছে।

“কি হইলো বইন কি ভাবতাছো?”

জমিলার কথায় ঘোর ভেঙে গেলো রুমাইসার। চোখের কার্ণিশে লেগে থাকা একফোঁটা পানি ওড়নার কোণে মুছে বলল,

“কখন এসেছেন তিনি?”

“কাইল রাইতের শেষ ট্রেইনে কইরা নাকি আইলো। স্টেশনেই তোমার ভাইর লগে দেখা হইলো।”

“রমিজ ভাই জানতেন উনি আসবেন?”

“না হেইডা তো জানি না, তয় একখান কথা ডাক্তার সাহাব তোমারে ভোর বেলা বটগাছের তলায় দেখা করতে কইছে। কেউ যেনো না জানবার পারে।”

রুমাইসা ভ্রুকুচকে নিলো। তারপর কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,

“উনি এসেছেন এটা কেউ জানে?”

“আমি এতসব কইতে পারমু না, আমারে তোমার ভাই এদ্দুর কইয়া পাঠাইছে। নামাজ শেষ কইরা বট তলায় আইসো তুমি ডাক্তার সাহাব অপেক্ষা করবো।”

“ঠিক আছে ভাবী, আপনি তাহলে যান আর শুনুন এই চাদর টা আমি আপনাকে দিলাম এটা রেখে দিন।”

“না না বইন এইডা আমি নিতে পারমু না, এত দামী চাদর দিয়া আমি কি করুম।”

“চাদর দিয়ে মানুষ কি করে? এটা আপনি পড়বেন। আর এক মিনিট দাঁড়ান এখানে আমি এক্ষুনি আসছি।”
বলে রুমাইসা ঘরের দিকে চলে গেলো আর মিনিট দুইএক এর মাঝেই এক জোড়া জুতা হতে করে ফিরে এলো।

“এই জুতা জোড়াও রাখেন, ঠান্ডায় এভাবে খালি পায়ে হাঁটবেন না।”

রুমাইসার কাছ থেকে চাদর আর জুতা পেয়ে খুশিতে জমিলার চোখ চিক চিক করে উঠলো তবে মুখে সে কিছু বলতে পারলো না। হয় তো রুমাইসার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ তার চোখে জল এসে দিয়েছিলো।

স্মরণের সামনে মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইসা। সে চাইছে একটিবার তাকিয়ে স্মরণকে দেখতে কিন্তু লজ্জায় সে মাথা তুলতে পারলো না। স্মরণ অবশ্য সেটা বুঝতে পেরেছে তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

“মিস রুমাইসা আপনার শরীর ঠিক আছে?”

রুমাইসা জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়াল।

“পড়াশুনা ঠিক ঠাক তো?”

“হু।”

“কাল আপনার পরীক্ষা। বলেছিলাম আসবো আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি।”

রুমাইসা এবার মাথা তুলে সরাসরি স্মরণের চোখে চোখ রাখলো। স্মরণ লক্ষ্য করলো ইতিমধ্যে রুমাইসার চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল হয়ে উঠেছে। স্বচ্ছ সরোবরের টলটলে জলরাশি তার দুচোখের কোণে এসে জমেছে। পলক পেলতেই তারা শ্রাবণের বারিধারা হয়ে ঝড়ে পড়বে।

“এবার কিন্তু আপনার কথা রাখার পালা মিস রুমাইসা। পরীক্ষা কিন্তু ভালো করা চাই।”

“হু।”

“হু!”

রুমাইসা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে কিছুটা হাসলো পরক্ষণে আবার হুহু করে কেঁদে ফেললো। স্মরণ কয়েক পা এগিয়ে রুমাইসার আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল, বাহুতে দুহাত গুঁজে রাশভারী গলায় বলল,

“কাঁদছেন কেনো আপনি?”

রুমাইসা কাতর স্বরে বলল,

“বাবার কথা মনে পড়ছে খুব।”

“দেখুন মিস রুমাইসা কারো বাবা মা সারা জীবন বেঁচে থাকেন না। তবে তাদের ভালোবাসা সারাজীবন সন্তানের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকে। আপনার বাবা চেয়েছিলেন আপনি অনেক দূর পড়াশুনা করে এগিয়ে যান আর তাই আপনাকে এতটা ভেঙে পড়লে চলবে না নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আপনাকে পেছনে টেনে নামানোর জন্য অনেকেই আছে তবে উপরে উঠানোর জন্য এই স্মরণ সব সময় আপনার সিঁড়ি হয়ে থাকবে। আপনি যত উপরে উঠতে চান সে আপনাকে তত উপর অবদি নিয়ে যাবে, তবে এই সিঁড়িটা কিন্তু আপনাকে একাই বেয়ে উঠতে হবে মনে রাখবেন সেটা।”

স্মরণের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করছে রুমাইসা। স্মরণকে যত দেখছে ততোই সে অবাক হচ্ছে। এই কঠিন মানুষটা তাকে মানসিক ভাবে কতটা শক্তি দেয় সেটা সে নিজেই জানে না। গম্ভীরতার ভেতরেও যে তার এতবড় একটা মন আছে সেটা হয় তো তাকে না দেখলে বুঝা যেত না।

(৬৫)

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর এগিয়ে এলো স্মরণ আর রুমাইসা। আজকাল স্মরণ তার সাথে অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করছে ঠিক প্রথমদিকের মতো। রুমাইসা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুধু স্মরণকেই দেখছে। এই মানুষটাকে যে সে কখন এতটা ভালোবেসে ফেলেছে নিজেও জানে না।

হাঁটতে হাঁটতে একটা পুকুর পাড়ে এসে থামলো দুজন। পূর্বাকাশে রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়েছে। একটুপর সূর্যোদয় ঘটবে। বেশ খানিকটা সময় তারা নিশ্চুপে কাটিয়ে দিলো। রুমাইসা পুকুরের ঠান্ডা জলের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো যা স্মরণের নজর এড়াল না। স্থির চাহনিতে কিছুটা সময় রুমাইসাকে পরখ করে স্মরণ এবার বলল,

“কিছু নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন বুঝতে পারছি। কি হয়েছে বললে খুশি হবো।”

রুমাইসা কয়েক মুহূর্ত মৌন থেকে পড়ে বলল,

“মাকে কয়েকদিন ধরে অন্যরক লাগছে।”

“যেমন?”

“বাবার শোকে তিনি যে এতটা কাতর তিনি হন নি সেটা সবাই না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি। তবে উনার আচরণ আমার খুব একটা সুবিধার মনে হয় না।”

“কিছু ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে?”

“হু। দিনি সারাদিন একটা ঘরে নিজেকে ঘর বন্ধি করে রাখেন, ঠিক করে কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলেন না কিন্তু,,,।”

“কিন্তু?”

“গভীর রাতে তিনি নিজেই নিজের সাথে কথা বলতে শুনেছি বেশ কয়দিন ধরে। তাছাড়া কাল রাতে যখন আমার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাউকে কথা বলতে শুনলাম তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে জানেন তো?”

“নিশ্চই ঘর থেকে বেড়িয়েছিন কে কথা বলছে দেখতে।”
ভ্রুবিলাস করতে করতে বলল স্মরণ।

রুমাইসা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” আপনি কি করে জানলেন?”

“সেটা আপনাকে না জানলেও চলবে।”

“একটা লোককে দেখলাম বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে বেড়িয়ে যেতে। তারপর আমি মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে দেখে মাকে দেখতে যাবো ভাবলাম আর তখনি দেখি মা ঘরে নেই বাহিরে।”

“এটাই তো হওয়ার ছিলো মিস রুমাইসা। আর আপনি যাকে বেড়িয়ে যেতে দেখেছেন সে আপনার মামা আজমল আহমেদ।”

স্মরণের মুখের দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে রুমাইসা। স্মরণ তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বিলাশ করতে করতে সয়তানি হাসি হেসে বলল,

“ঘরে গিয়ে চেক করেছিলেন এডমিট কার্ডটা আছে কিনা?”

“মানে?”

“মানে আপনার মামা আপনার এডমিট কার্ড সরাতে এসেছিলেন যাতে আপনি পরীক্ষা না দিতে পারেন, তবে তাতে তিনি খুব একট্য সফল হননি। এর আগেই অন্য কেউ সেটা সরিয়ে নিয়েছে।”

রুমাইসা তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারলো। সে জানে তার মামা খারাপ তবে এতটা খারাপ হবে সেটা সে কল্পনা করতে পারে নি।

” মিস রুমাইসা এতে এতটা অবাক হবার কিছু নেই। আমি আগেই ধারণা করতে পেরেছি সব তাই তো রমিজকে দিয়ে আগেই সেটা আপনার ঘর থেকে সরিয়ে এনেছিলাম। তবে হ্যাঁ আপনার শেহওয়ার ও কিন্তু কম যায় না। বাপকে ব্যার্থ হতে দেখে সে নিজেই আমার ঘরে এসেছিলো সেটা খুঁজতে ব্যাটা খুব চালাক তবে আমিও কিছু কম যাই না। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কেউ জানুক বা না জানুক শেহওয়ার নিশ্চই জানবে আমি রাতেই নিশ্চিন্দপুর এসেছি। কিন্তু কি হলো শেষ পর্যন্ত তার পরিশ্রম বৃথা গেলো।”

রুমাইসা আর কিছু বলতে পারলো না। তার আপন মানুষগুলোই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে শেহওয়ারকে সে একটা সময় ভালোবেসেছিলো সেই শেহওয়ার তাকে দিনের পর দিন ঠকিয়েছে আর আজ সে কতটা নিচে নেমে গেছে তার ধারণা নেই।

“আচ্ছা একটা মানুষ যখন জানতে পারে তার সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো তাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে তখন তার কি করার উচিত?”

স্মরন প্রশস্ত নিশ্বাস ছেড়ে এক কথায় উত্তর দিলো,

“এমন মানুষকে আপন কিংবা প্রিয়ের খাতা থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত।”

“সব কিছু কি এতটা সহজ।”

“চাইলেই সম্ভব। তবে সহজ বলবো না।”

রুমাইসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আর সেটা স্মরণের বুকের গিয়ে লাগলো। সে ছাড়া হয় তো মেয়েটার এখন আর আপন বলতে নেই। নিজের আপন মানুষগুলোই প্রতিনিয়ত তার ক্ষতি করার জন্য সুযোগ খুঁজছে।

চলবে,,

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৮

(৬৬)

পরীক্ষার হল থেকে বেড়িয়ে রাত্রির সাথে দেখা হলো রুমাইসার। পরীক্ষা শেষে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের এক কোণে এসে দাড়াল দুজন। অনেক দিন পর তারা দুজন এক সাথে কিছুটা সময় কাঁটাবে বলে একটা গাছের নিচে এসে বসলো। পরীক্ষা শেষ, গ্রাম থেকে বিদায় নেয়ার সময় হয়ে এদেছে রুমাইসার। পরীক্ষার দিন গুলো বেশ টেনশনে কাটাতে হয়েছে তাকে। আজ অনেকদিন পর নিজেকে মুক্ত লাগছে তার। প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় নানান বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। নিলুফার বেগম নানান ভাবে তাকে আটকাতে চেয়েছিলেন তবে স্মরণের প্রচেষ্টা সে ভালোয় ভালোয় পরীক্ষাগুলো শেষ করতে পেরেছে।

“এখানে বসবি?”
কিছুটা ইতস্তত করে রাত্রিকে কথাটা বলল রুমাইসা।

“হ্যাঁ সব সময় তো এখানে বসতাম মনে নাই তোর?”

“হু।”

“তয় আর জিজ্ঞাস করিস ক্যান?”

“না মানে উনি বাহিরে অপেক্ষা করছেন তো। দেরি হচ্ছে দেখলে চিন্তা করবেন।”

“আচ্ছা একখান কথা ক তো, ডাক্তার সাহেব কি তোর লাইগা নিজের কাজ কর্ম রাইখা এখানে পইড়া আছেন?”

“পড়ে থাকবেন কেনো? উনি শুভ্রনগর জয়েন কিরেছেন বলেছিলাম না।”

“ওইটা তো আরো মাস খানেক আগে, যখন তোর বিয়া ঠিক হইছিল। তারপর তো শুনলাম ছাইড়া দিছে এখন কি আবার ওইখানে জয়েন করছে?”

“আমি জানি না অতসব। তিনি সব কিছু বলেন না আমাকে, এখন চল যাই।”

“আইজ ই কি চইলা যাবি?”

“হু।”

“আর আইবি না গ্রামে।”

“একেবারে তো ছেড়ে যাচ্ছি না আর কি করেই বা যাই বল এ গ্রামটা যে আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। তাছাড়া বাবা মা, শিউলিতলা সব তো এখানেই রেখে যাচ্ছি।”

“ওই মহিলা জানে যে তুই আজ রাতে চলে যাচ্ছিস?”

“উঁহু।”

“জানলে কিন্তু তোরে যাইবার দিবো না। আর তোর মামা বেটা খাটাশ লোক সে তো চায় না তুই শহরে গিয়া পড়াশুনা কর। বেটা তুই পরীক্ষা না দিতে পারার জন্য কত কি না করলো। আর ওই শেহওয়ার সেও তো কম চেষ্টা করে নাই ডাক্তার সাহেব থেইকা তোরে সরানোর লাইগা।”

“উনার সাথে আমার ওই রকম কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি রাত্রি যার জন্য আমাকে উনার কাছ থেকে কেউ সরাতে আসবে। উনি আমাকে কখনো ওই চোখে দেখেন নি, তিনি শুধু আমায় সাহায্য করছেন। শেহওয়ার ভাই সেটা বুঝতে পারেন না কারণ তিনি সবাইকে নিজের মতোই মনে করেন।”

“সেদিন রাইতে তো উনিই তোর এডমিট কার্ড চুরি করতে আইছিলো।”

“হুম কিন্তু এডমিট কার্ড তো আমার কাছেই ছিলো না। পরীক্ষা শেষে উনি সেটা নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিলেন। ”

“শেহওয়ার ভাই ক্যান এমন করতাছেন?”

“অন্যকে হারানোর নেশা যখন নিজের মাঝে কাজ করে তখন আর সে ভালো খারাপের বিভেদ বুঝতে পারে না। শেহওয়ার ভাইর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শুনেছি দুজনই একটা সময় খুব ভালো বন্ধু ছিলো।”

“বন্ধুত্ব নষ্ট হইলো ক্যামনে?”

“সে অনেক কথা অন্য একদিন বলব। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে উনি এবার সত্যি চিন্তা করবেন।”

“আচ্ছা রুমাইসা তুই তো কইলি উনার মা তোরে পছন্দ করে না, তবে তুই কি করে উনার বাড়ি গিয়ে উঠবি?”

“জানি না। তবে জীবন আমায় অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এইবারো হয় তো করবে কিন্তু আমি চেষ্টা করবো নিজেকে মানিয়ে নেয়ার, জানি না কতটুকু পারবো। তবে আমার খুব ইচ্ছে জানার যে তিনি কেনো আমাকে পছন্দ করেন না।”

কথা বলতে বলতে দুজন স্কুল থেকে বেড়িয়ে এলো। স্কুল থেকে বের হতেই রুমাইসা দেখলো স্মরণ গাছতলায় দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

রুমাইসাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল স্মরণ। কালো সেলোয়ার কামিজ মাথায় আধ গোমটা দেয়া রুমাইসাকে দূর থেকে দেখে স্মরণের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। রুমাইসাকে যত তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো ততোই যেনো তার নিশ্বাস আটকে আসতে চায়। কিছুদিন আগেও স্মরণ রুমাইসার প্রতি এই অনুভূতির কারণ খুঁজে পেতো না, তবে সময় আর রুমাইসার সঙ্গ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে গ্রামের সহজ সরল ছোট্ট মেয়েটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিতে নিতে যে কখন সে নিজের অজান্তে তার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।

(৬৭)

গ্রামের কাঁচা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে স্মরণ এবং রুমাইসা। আজ রাতেই তারা গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। রুমাইসার পরীক্ষা চলাকালীন পুরোটা সময় স্মরণ গ্রামে অবস্থান করেছে। সব সময় রুমাইসাকে আগলে রেখেছে, যে কোনো বিপদে তার পাশে থেকেছে সে। এই গ্রামটার প্রতি তার অজানা কারণেই বিশেষ একটা মায়া পড়ে গেছে। গ্রামের মেঠো পথ, সারি সারি ধানের ক্ষেত সব কিছুর প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা কাজ করে তার। বিশেষ করে রমিজের প্রতি তার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দুটোই খুব বেশি। কারণ যে কোনো সময় যে কোনো বিপদে রমিজই তাকে বেশি সঙ্গ দিয়েছে। রমিজ না থাকলে হয় তো সব কিছু এত সহজে সমাধান করতে পারতো না সে।

ওই তো সেদিন যখন আজমল আহমেদ রুমাইসার এডমিট কার্ড সরাতে এসেছিলেন তার ঠিক ঘন্টা দুইয়েক আগে স্মরণ নিশ্চিন্দপুর আসে। আজমল সাহেব এবং নিলুফার বেগম দুজনে মিলে রুমাইসার ঘর থেকে এডমিট কার্ড চুরি করে পুড়িয়ে ফেলার প্লান করে যাতে সে পরদিন পরীক্ষা দিতে না পারে। কিন্তু স্মরণ সব কিছু আগেই বুঝতে পেরেছিলো তাই তো সে ট্রেন স্টেশন থেকে সোজা রাতের আধারে রুমাইসাদের বাড়ি এসে পৌঁছায়। তার সাথে করে রমিজও সেখানে যায়। রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে চারপাশ যখন নিস্তব্ধ হয়ে উঠে তখন রমিজ চুপিসারে রুমাইসার ঘরে ডুকে। রিমা আর সমীর তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। রুমাইসা পড়ার ফাঁকে একবার মনোয়ারা বেগমের ঘরে যায় আর ঠিক সে সময় রমিজ তার ঘর থেকে এডমিট কার্ডটা সরিয়ে আনে।

রমিজ যখন ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে তখন একজন মাত্র ব্যাক্তি তাকে বেড়িয়ে যেতে দেখেছিল আর সে ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় শেহওয়ার নিজে। রমিজসহ স্মরণকে অন্ধকারে বেড়িয়ে যেতে দেখে সে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হয় যে রুমাইসার ঘরে আর কেউ নয় রমিজই এসেছিল। স্মরণ তাকে দিয়েই নিজের কার্যসিদ্ধি করেছে। সে রাতে শেহওয়ার তিন কোশ রাস্তা পাড়ি দিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিঘরের পেছনে গিয়ে উপস্থিত হয়। বারান্দায় বসে থাকা স্মরণ রমিজ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলো না সে। বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হলে স্মরণের চোখজোড়া যখন লেগে আসে সে সময়ই শেহওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। কিন্তু ভাগ্য সেরাতে তার সঙ্গ দেয় নি। কিছু একটার শব্দে রমিজ জেগে উঠেছিলো।

গ্রামের কাঁচা রাস্তায় দুজন নর নারী পাশাপাশি হাঁটছে অথচ কারো মুখে কথা নেই। রুমাইসা মাটির দিকে তাকিয়ে সামনে পা চালাচ্ছে। স্মরণ পকেটে হাত গুঁজে চারপাশটা দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। বেশ খানিকটা পথ পেড়িয়ে এসে স্মরণ একটা গাছের নিচে থামলো। স্মরণকে থামতে দেখে রুমাইসা চলার গতি কমিয়ে আনলো। চারপাশে মৃদু সমীরণ বইছে। রাস্তার দুই ধারে সরিষা খেত গুলো হলুদে ভরে উঠেছে। দুপুরের কড়া রোদ তাদের গায়ে মাখামাখি করছে মাঝেমধ্যে আবার মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে তারা। স্মরণ সেদিকে দৃষ্টি ফেলে রুমাইসাকে বলল,

“মিস রুমাইসা গ্রাম ছাড়ার আগে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে আর সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।”

স্মরণের কথায় রুমাইসা কোনো জবাব করল না তবে মনোযোগ দিয়ে তার কথা সে শ্রাবণ করলো।

“আপনার পরীক্ষা শেষ সে সাথে আমারো গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় হয়ে এসেছে। আপনার সাথে আমার পরিচয়টা ঠিক কিভাবে গড়ে উঠেছিলো সেটা নিশ্চই আপনার আমার অজানা নয়। সেদিন আপনি আপনার বাবাকে একটুকরো চিঠি সমেত ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন। রমিজ সাহেব সহ আপনার বাবা আমার চেম্বারের উল্টো পাশে একটা টুলে বসে ছিলেন। সেখানে অবশ্য তারা দুজন ছাড়া আরো অনেক রুগীই ছিলেন তবে অজানা কারণের তাদের সকলকে ছাড়িয়ে আমার দৃষ্টি প্রথম উনার উপর গিয়ে পড়ে। লোকটাকে দেখে আমার অন্য সবার থেকে কিছুটা আলাদা মনে হলো কেনো জানি না সেদিন উনাকে দেখেই আমার উনার প্রতি একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল।”

“আপনি সেদিন বাবার চিকিৎসা করিয়েছলেন।”

“তার আগে রমিজ সাহেব একবার আমার চেম্বারে আসেন। রমিজের সাথে আমার পরিচয় আগের দিন রাতে। আমাকে মেডিকেল ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা বোধ হয় তার উপরই পড়েছিলো। এখানে আসার আগে মেডিকেল অর্গানাইজেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা ঠিঠি পাঠানো হয় আমাকে। আর তাতে রমিজের ঠিকানাটা দেয়া ছিলো। চাঁদের আলোয় হেমন্তের কুয়াশা ঝড়া রাতে সারিসারি ধান খেতের আইল ধরে চলতে বেশ লাগছিল, উপভোগ করছিলাম খুব কিন্তু সে ভালোলাগা আর উপভোগময় মুহূর্তটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বাতাসের সাথে বিন্নি ধানের বিচ্ছিরী গন্ধটা নাকে এসে লাগলো।”

স্মরণের কথার মাঝখানে রুমাইসা ভ্রুকুঞ্চিত করে প্রতিবাদ করে বলল,

“মোটেই সেটা বিচ্ছিরী না। আপনার নাকে নিশ্চই সমস্যা আছে তাই ধানের গন্ধটা আপনার কাছে বিচ্ছিরী বলে মনে হয়েছে।”

রুমাইসার এমন প্রতিবাদী কন্ঠস্বর শুনে হেসে ফেললো স্মরণ তারপর বলল,

“সে রাতে রমিজের সাথে তিন ক্রোশ রাস্তা হেঁটে পাড় করে নিশ্চিন্দপুর পৌঁছাই। চাঁদের আলো আর গ্রামের কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে চলতে খুব একটা খারাপ লাগছিলো না। রমিজের সাথে কথায় কথায় গ্রামের নানান বিষয় জানা হলো। ঘন্টা খানেকের মাঝেই তার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।”

“তারপর কি হলো?”

” পরদিন সকালে সে একটুকরো চিঠি হাতে করে আমার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। কি একটা কাজে আমি চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এলাম আর তখন রমিজ আমাকে সালাম দিয়ে চিঠিটা দিয়ে পড়তে বলল। যেহেতু গতরাতে লোকটা আমাকে সাহায্য করেছিলো তাই তার কথা ফেলতে পারলাম না, পুনরায় চেম্বারে ফিরে গিয়ে চিঠির ভাঁজ খুলি আর ঠিক তখন,,,।”
কথাটা শেষ করার আগে স্মরণ থেমে গেলো। পরবর্তী কথাটা সে রুমাইসাকে বলতে পারলো না। তবে বলতে পারলো না যে এমনটা নয় সে বলতে চাইলো না কারণ নিজের ভালোলাগা কিংবা দূর্বলতা কোনোটাই রুমাইসার কাছে প্রকাশ করতে চায় না স্মরণ। অন্যের কাছে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করাটা তার স্বভাববিরুদ্ধ তাই সেটা সে এড়িয়ে গিয়ে বলল,

“করিম সাহেবের অসুস্থতার কথা জানিয়েছিলেন। চিঠি পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম বাবাকে খুব ভালোবাসেন, তার অসুস্থতা নিয়ে যে আপনি খুব বেশিই চিন্তিত সে বিষয়ে সন্দেহ রইলো না। চিঠি পড়ে রমিজকে বললাম উনাকে চেম্বারে নিয়ে আসতে। আর তখনি দেখলাম ভিড়ের মাঝে যে ভদ্রলোকটির উপর আমার সর্বপ্রথম নজর পড়েছিলো ওই লোকটিই চিঠিতে লিখা মেয়েটির বাবা। মাঝে মাঝে জানেন তো আমাদের সাথে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাই না। অজানা কারণেই সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনকে আমাদের অকারণে ভালো লাগে আবার সেই একই রকম অচেনা অজানা কোনো ব্যাক্তিকে খুব করে বিরক্ত লাগে। অথচ দেখুন আমরা তাকে চিনি না, জানি না, তার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই তবুও চোখের দেখায় কাউকে ভালো লাগে কাউকে বা মন্দ। আমারো তাই হয়েছে আপনার বাবার প্রতি অকারণেই শুরুতে একটা মায়া পড়ে গিয়েছিলো আর যখন চিঠিটা পড়ে দেখলাম আর জানতে পারলাম চিঠির মানুষটা ওই একই ব্যাক্তি তখন তার প্রতি মায়াটা বিষন ভাবে কাজ করেছিলো।”
বলে থামলো স্মরণ। রুমাইসা মনোযোগ দিয়ে তার প্রতিটি কথা শ্রাবণ করছিলো। বাবাকে নিয়ে স্মরণের বলা প্রতিটি কথা তাকে পুলকিত করছিলো। সে জানতো স্মরণ তার বাবাকে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে কিন্তু এতটা সে আশা করে নি।
স্মরণকে সে যত দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে। তবে মানুষটাকে দেখে তার যতটা কঠিন বলে মনে হতো আজকাল সেটা আর মনে হয় না তবে হ্যাঁ তার কড়া ব্যাক্তিত্বের কাছে রুমাইসা কখনো ঘেঁষার চেষ্টা করে নি, সাহস করে নি কখনো। তবে দূর থেকে সে যত স্মরণকে দেখছে ততোই যেনো তার প্রতি মনে কোণে লুকিয়ে থাকা দূর্বলতাটা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে।

ক্ষণকাল বিরতি নিয়ে স্মরণ প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো তারপর আবার বলল,

“প্রথম যেদিন আপনার বাবাকে নিয়ে আপনাদের বাড়ি গেলাম সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম জানেন তো? দ্বিতীয়বারের মতো আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল, তবে সেটা ভিন্নভাবে। আপনাকে প্রথম দেখায় যতটা তেজি আর রাগী বলে মনে হয়েছিলো সেদিন দেখার পর পুরো ধারণাটাই পালটে যায়। তবে আরেকটা ব্যাপারে খুব অবাক হয়েছিলাম, চিঠির মেয়েটা আর কেউ নয় আপনিই ছিলেন।”

“আমিও কম অবাক হইনি বাবার সাথে আপনাকে দেখে। তবে বাবার এই অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম।”

“ছুটে আসেন নি তো বাবার কাছে। এমনকি বাবার আশেপাশেও আপনাকে খুব একটা দেখা যায় নি অবশ্য পড়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম।”

“মা,,,।”

“বুঝতে পেরেছি। তবে উনি এতটা খারাপ হবে ধারণা ছিলো না। অবশ্য হবেই কি করে প্রথম দেখায় তো আর একজন মানুষকে চেনা সম্ভব নয়।”

“পরে তো বুঝেছেন।”

“আপনার বই ছিঁড়ে ফেলেছিলেন দেখে আপনার বাবা সেদিন অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার চেম্বারে যান দেখা করতে। সেখানে তিনি নিজের পরিবারের কিছু কথা আমাকে জানান আর আমাকে অনুরোধ করেন একসেট বই যাতে ব্যবস্থা করে দেই আপনার জন্য। তিনি স্কুলে দেখেছিলেন কিন্তু সেখানে তেমন কোনো বই ছিলো না তাই নিরুপায় হয়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তবে একটা বিষয় আমাকে আজও অবাক করে, উনি কেনো আমাকে এতটা ভরসা করেছিলেন আর কেনোই বা ভেবেছেন যে আমাকে অনুরোধ করলে সেটা আমি ফেলবো না।”

“বাবা যে কাউর উপর ভরসা করতেন না, হয় তো আপনাকে তার ভরসা যোগ্য বলে মনে করেছেন তাই।”

“হুম, তা হতে পারে। তবে সেদিন উনার কথা রাখতেই আপনাকে বইগুলো দেয়া।”

রুমাইসা এবার লজ্জা পেলো। লজ্জায় তার দুকান গরম হয়ে গেলো। ওই একটা কারণেই যে সে স্মরণকে এতটা ভরসা করেছিল। তাই হয় তো বার বার সে স্মরণের কাছে ছুটে গিয়েছিলো। আচ্ছা শুধু কি এই একটা কারণেই সে স্মরণের কাছে ছুটে গিয়েছিলো নাকি মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি আড়ালে অন্যকিছু ছিলো, যা তাকে দিশেহারা করে টেনে নিয়েছিলো অজানা গন্তব্যের পথে।

চলবে,,,।