#আমার_সংসার
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৪
বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। উনি ল্যাপটপে বিজি! ঘৃনায় চোখমুখ উল্টে আসছে আমার। মাথা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। উনি হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তবুও তাকিয়ে রইলাম। সন্তানটা ওনার এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। বুক ফাটা আর্তনাৎ করে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ কেন এমন করলেন? সবার চোখে ভালোমানুষীর মুখোশ পড়ে আপনি এত বড় অন্যায় করলেন? মামা মামীর মুখটা মনে পড়েনি আপনার? এতটা খারাপ আপনি? নিজের সন্তানকে এভাবে শেষ করতে হাত কাঁপলো না? ‘ মুখ ফুটে বলতে পারছি না! শরীর অসহনীয় যন্ত্রনায় ছারখার করে দিচ্ছে। আবার একটু পর যখন আব্বু আর মামীর কথা মনে পড়ছে তখন আরও বুক বিষিয়ে উঠছে! আমান মন বলছে উনি নির্দোষ! কিন্তু পরিস্থিতি বলছে সব দোষ ওনার!
‘ কিছু ভাবছিস? ‘
টনক নড়লো আমার। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালাম ওনার দিকে। টুপ করে চোখের জল গালে এসে পড়লো। অথচ আজ ওনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! যে মানুষটা আমার চোখের কোনে পানি দেখলেও ছুটে আসতো আজ এলো না। দৃষ্টি সরিয়ে বিছানায় চুপ করে বসে রইলাম। উনি ফের বললেন,
‘ কিছু বলেছি তোকে। ‘ কন্ঠ কেমন শোনালো। চোখের পানি মুছে বললাম,
‘ ভালো লাগছে না। ‘
‘ শরীর খারাপ? ‘ কন্ঠ একদম স্বাভাবিক! অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে।
‘ তেমন কিছু নয়। ‘
‘ আজ কই গিয়েছিলিস? ‘
কি বলবো আমি? সত্যি বলবো? নাকি আগে আগে থেকেই উনি জানেন সবটা?
‘ মা বললো তুই নাকি বেড়িয়েছিলি। ‘
কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, ‘ একটু দরকার ছিলো।’
‘ সবকিছু লুকাস কেন তুই? ‘
চমকে উঠলাম। কপালে ঘাম জমছে। তারমানে উনি জানেন সবটা? উনি এবার তাকালেন আমার দিকে। ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বললেন,
‘ কিছু প্রয়োজন হলে বলিস না কেন তুই? টাকা লাগলেও মুখ ফুটে বলিস না। হোয়াই? এটা কিন্তু দায়িত্ব আমার সিয়া! ‘
সস্তির শ্বাস ছাড়লাম। বুক থেকে যেন বড় এটকা পাথর কমে গেলো। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে বললাম,
‘ নেক্সট টাইম বলবো৷ ‘
‘ হয়তো….’ বিরক্ত কন্ঠে বললেন কথাটুকু উনি। চুপ রইলাম। কিছু ভালো লাগছে না! কিছুই না!
_____
রাত আটটা! সিয়াম ভাইয়া বেড়িয়েছে কোথাও। বেলকনির গ্রিলে হাত রাখতেই দমকা হওয়ায় মাথার চাদর ঘারে এসে ঠেকলো। তাকিয়ে রইলাম আকাশ পানে। কাল জানিনা কিসের সম্মুখীন হতে হবে। মানুষ কতটা শিওর হলে প্রমান দেখাতে চাইবে? কিন্তু বুক খচখচ করছে। দেখতে দেখতে সময় কেটে গেলো। মামী খুব জোরাজুরি করলো খেতে, ইচ্ছেই জাগেনি! উনিও একটি বারও বলেননি খেতে আসতে। ভাইয়া এসে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। বলছিলো কাল খুব ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে। খুব তারাতাড়ি আমিও শুয়ে পড়লাম। রাতটা আনচান করতে করতে কাটলো। সকালে প্রতিদিনের মতো আজও ওনার বুকে থাকবো ভেবেছিলাম, কিন্তু নিজেকে একপ্রান্তে আবিষ্কার করলাম। উনি অপরপ্রান্তে কাত হয়ে শুয়ে। উঠে পড়লাম! শুয়ে থাকতে এতটুকু ভালো লাগছে না। আজ একটু তারাতাড়ি অফিসে বেড়িয়ে গেলো সিয়াম ভাইয়া। কোন কথা বলেনি সকালে একটিবারও। সকালের নাস্তা খুব কষ্ট করে খেলাম। দুপুর গড়াতেই আজ মামীকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। শরীরে মনে হচ্ছে শক্তি নেই! একজন মৃত মানুষ লাগছে নিজেকে। কি হবে? ভাবতেই শরীরে কাটা দিচ্ছে। কালকের কফি সপে নেমে পড়লাম আমি। রিকশাওয়ালাকে ভারা মিটিয়ে ভেতরে ডুকতেই ভূমন্ডল কেঁপে উঠলো আমার। রগে রগে শিতল কিছু বয়ে যায়। একই টেবিলে তিনটে ছেলে সাথে ত্রিধা! অবাক করার বিষয় এটি নয়! সাথে সয়ং সিয়াম ভাইয়া বসে। নিশ্বাস আটকে আসছে। উনি মাথা নিচু করে বসে। একপা একপা করে এগিয়ে গেলাম। পাশের ছেলেদের মধ্যে একজনকে চিনি আমি! ছেলেটাকে ভাইয়ার সাথে দেখেছি বহুবার। ত্রিধা আপু থমথমে মুখে বসে আছে। কেউ একজন বলে উঠলো,
‘ এতটা ফার্স্ট? ওকে, আসুন। ‘
কথা বলা ছেলেটা ফরসা ধবধবে। উনি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন বসতে। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলাম। বসার আর ইচ্ছে হলো না। সিয়াম ভাইয়া মাথা নিচু করে রয়েছেন। আকম্মিক বললেন,
‘ ত্রিধা, কি যেন বলবে ওকে বলেছিলে? ‘
ত্রিধা আপু মুখের ভঙ্গি পাল্টে না। সেভাবেই বসে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। ভাইয়া মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মুখপানে। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘ বল, কি বলবি বলেছিলি? চুপ কেন? ‘
কেঁপে উঠলো ত্রিধা। কপালে ছোপ ছোপ ঘাম। মুখে আঁধার। তবুও তার কোন হেলদোল দেখা গেলো না। ফরসা গড়নের ছেলেটা ধারালো গলায় বললো,
‘ কি রে বল! চুপ কেন? বল কি কি বলবি বলছিলি? সিয়ামের জিবনে আর কত ঝড় তুলবি তুই? এখন চুপ কেন? ‘
একটানে কথাগুলো বলে দম ফেললো ছেলেটি। কিছু বুঝছি না আমি! সিয়াম ভাইয়া এখানে কেন? কে বলেছে আমরা এখানে মিট করছি? তাহলে কালকে সবটাই জানতেন উনি! মিছিমিছি নাটক করে গেছেন? আর আমায় বইতে হয়েছে এত এত মিথ্যা! হাত মুঠো হয়ে আসছে আমার। ত্রিধা আপুর সামনে গিয়ে শান্ত গলায় বললাম,
‘ বলছেন না যে? বলুন! ‘
‘ তোর আজ সকল প্রশ্নের উত্তর আমি দেই সিয়া? ‘
মাথা উঁচিয়ে বললেন ভাইয়া। ওনার ঠিক সামনেই বসে ত্রিধা। নির্বাক হয়ে বসে। উনি উঠে বলতে লাগলেন,
‘ ত্রিধা কাল তোকে ঠিক কি বলেছিলো? কোন একটা বাচ্চা ওর আর আমার! তাইনা? ‘ সাথেসাথে মুখ নিচু করে নিলাম। উনি ফের বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ ত্রিধা আমার সাথে খুব বাজে একটি গেম খেলতে চেয়েছিলো। কুড়ি লক্ষ টাকা আমার নামে এখনো ব্যাঙ্কে রয়েছে। আর সেগুলোই চেয়েছিলো এই মেয়েটা। আমার নিজেরও জানা নেই একে ভালোবেসে কতগুলো টাকা খরচ করেছি আমি। ওর ড্যাড, অরফে নজিব উদ্দিনের ছিলো এতসব প্লান। কি রে ত্রিধা,তাইনা? ‘
মাথা তোলে ত্রিধা। তার চোখ দুটি শূন্য। হয়তো সে নিজেও জানে না এতকিছু সিয়াম জানলো কি করে। এবার আমার দিকে তাকালেন উনি। ফিক করে হেঁসে বলতে লাগলেন,
‘ পদে পদে আমি বুঝেছি, এই মেয়েটা শুধু টাকাকে ভালোবাসে। সেদিনিই বুকে পাথর জমিয়ে এ রিলেশন শেষ করতে বাধ্য হই আমি। অবশ্য সেদিন ত্রিধা আমার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলো। আমাদের বিয়েটাও কিছুদিন পর! ওর আব্বুর সামনে ভেঙে এসেছি বিয়ে। এসব জেনেছি আমার বন্ধ আসিফের সাহায্য! প্রমান অব্ধি ছিলো। কিন্তু আমাদের তো পুরো বাড়িই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে আমার বিয়ে নিয়ে! সকলে কত খুশি। রিসোর্ড পর্যন্ত বুক করা! অনেক ভেবে দেখলাম যদি এ বিয়ে হয় তাহলে সিয়ার সাথেই হবে! ওর আব্বুকে বলতেই উনি সরাসরি না বলে দিলেন। কিছুতেই রাজি হবেন না উনি। বারবার বলেছেন আমার সিয়াকে অনেক দূর যেতে হবে। খুব বড় পদে চাকরি করতে হবে। আমি আশাহত হই। হঠাৎ ই তার পরেরদিন হাজির হয় সিয়ার আব্বু। উনি নাকি রাজি এ বিয়েতে। তবে শর্তসাপেক্ষে! সিয়ার পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত করাতে হবে, চাকরি করতে হবে ওকে, ওর যেকোনো কিছুর প্রয়োজন হলে যেন সবটা সামনে থাকে ওর। হঠাৎ ওনার মত পাল্টানোয় কিছুটা অবাক হলেও আমি রাজি হয়ে যাই! বিয়ের দিন সবাই মিলে রাজি করায় সিয়াকে এ বিয়ে করার জন্য। তখন আবারো নোংরা চাল চালে এই মেয়েটা! মিথ্যে চিঠি লিখে আমার জিবন থেকে সিয়া কে বের করতে উদ্ধত হয়! যে মেয়েটার সাথে দু মিনিটের বেশি কফিশপে গল্প পর্যন্ত করিনি আর সে আমায় তার মিথ্যে সন্তানের পিতা এবং তার’ই খুনি বানিয়ে দিলো। আমি ওই চিঠিটা প্রথম দিন’ই দেখেছি। কিন্তু পড়তে পারিনি। বিয়ের দিন যখন ত্রিধা নিজে এসে চিঠিটা সিয়ার হাতে গুজলো, তখনি খেয়াল করেছি আমি সবটা! তারপর কিছুদিন চুপচাপ! আমি হয়তো বিশ্বাসও করে নিয়েছিলাম সিয়া ওই চিঠিটাতে লেখা কথাগুলো বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ও আমায় ভুল প্রমান করে সবটা বিশ্বাস করে নিলো। দূরত্ব বাড়লো! আমি নিজের বেস্টটা দিয়েছিলাম ওর কাছে থাকার। কোথাও হয়তো ভালো লাগতো আমার ওকে। ওর কান্নাও সহ্য হতো না আমার। আসিফের মাধ্যমেই জানতে পারি সিয়া কাল দেখা করেছে ত্রিধার সাথে। ভাবলাম আজকেই ওর সব ভুল ধারনাগুলো শেষ করে দেই? তাই এসেছি নিজে। ‘
থামলেন উনি। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। চোখ জলে ভরে উঠলো আমার। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। ত্রিধার সামনে গেলেন উনি। স্বাভাবিক ভাবে বললেন,
‘ আর যেটুকু কনফিউশান আছে তুই দূর কর! বল আমার বলা প্রতিটা কথা আদেও সত্য কি’না। ‘
হাত কচলাতে শুরু করলো ত্রিধা। ভাইয়া আবারো বললেন,
‘ পুরো রিসোর্ডে কিন্তু সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিলো ত্রিধা। অল ফুটেজ আমার কাছে আছে। রিসোর্ডে বোরখা পড়ে শুধু একজনকেই ডুকতে দেখা গেছে। আর বাইরে এসে যে তুই বোরখা খুলে ব্যাগে ডুকিয়ে নিয়েছিলিস এটাও দেখা গেছে ত্রিধা! ‘
ত্রিধা চমকে তাকালো। খানিক পর আমাকে বললো,
‘ সিয়াম যা বলছে সব সত্য। আমি ওসব বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। আর আজ যেগুলো প্রমান দেখাবো বলেছিলাম সেটাও মিথ্যে ছিলো। নেট থেকে বের করা একটি শিশুর ছবি ছিলো আমার কাছে। সেটাই…..
কথা থামার আগেই ছুটে গেলাম ওর কাছে। সবটা শক্তি দিয়ে কষে থাপ্পড় দিলাম। টাল সামলাতে না পেরে ত্রিধা বসে পড়লো চেয়ারে। কফিসপের সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে। এই কুশ্রী মেয়েটাকে আমি বিশ্বাস করেছি ভাবলেই নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করছে। ঘুরে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। উনি সহ সবাই চলে গেলেন। বড্ড একলা লাগছে। নিঃস লাগছে নিজেকে। মেঝেতে বসে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আব্বু, মামী কতবার করে বলেছে যেন আমি বিশ্বাস না হাড়াই ভাইয়ার প্রতি! সেখানে আমি….
সব ছন্নছাড়া লাগছে। অসহ্য জ্বলায় ফেটে আসছে বুক।
#চলবে….