#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
৩৭.
#WriterঃMousumi_Akter
পরের দিন ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বিহান ভাই উনার রুমে নেই উনি কখন বেরিয়ে গিয়েছেন তা কেউ জানেনা।আমি নিরবে উনাকে খুজে চলেছি কোথায় আছে এদিক ওদিক খুজছি।উনাকে যতই না পাচ্ছি ততই বুকের ব্যাথা বেড়ে চলেছে।ঘড়ির কাটা যেনো সরতেই চাইছে না।ঘড়ির কাটা কি আজ ঘুরছে না।প্রতিটা সেকেন্ড যেনো হাজার বছরের সময় এর মতো পার হচ্ছে।ভোর পাঁচটা থেকে সকাল সাত টা পর্যন্ত ঘড়ি দেখেছি অসংখ্যবার।মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকালেই দেখছি দশ মিনিট ও সময় অতিক্রম করে নি।মন খারাপ হলে সময় গুলো যেনো আরো ঘাড়ে চেপে ধরে।ভালো সময় নিমিষেই ফুরিয়ে যায় আমার,আর এই বিষাক্ত সময় যেনো অতিবাহিত হতেই চাইছে না।
–মামা এবং মামি দুজন ই জানেন বিহান ভাই এর সাথে আমার কি নিয়ে ঝামেলা।এটা বিভোর ভাই দের ফ্যামিলির কাউকে বুঝতে দিতে নিষেধ করেছেন।তারা কষ্ট পেতে পারে ব্যাপার টা জানলে।বিহান ভাই তো তাদের সাথে যাওয়ার জন্য রাগ করেন নি আমার মিথ্যা বলার জন্য রাগ করেছেন।তবুও ব্যাপার টা তাদের কানে না যাওয়ায় ভালো।
মন খারাপ হলে পৃথিবীর কোনো কিছুই ভাল লাগেনা আমার।খেতেও পারিনা,হাসতেও পারিনা,সারাদিন সুয়ে থাকি।সকাল থেকে বিছানা ছেড়ে আর উঠিনি আমি।মন খারাপ আর টেনশনে ছোট বেলা থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি।নিজে নিজে কল্পনায় হাজার বার ভেবেছি এই বুঝি উনি এসে বলবেন কাল রাতে খুব রেগে গিয়েছিলাম মাথা ঠিক ছিলো না,তুই মিথ্যা বললি কেনো?আমার এই ভাবনা সত্যি হবে কখন।
–দুপুরের খানিক টা আগে কড়া রোদ, উত্তপ্ত চারদিক,ভ্যাপসা গরম।মামা খালি গায়ে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন টেবিল ফ্যান চালিয়ে আর মামিকে বলছেন,দিয়াকে উঠিয়ে জোর করে হলেও খাইয়ে দাও।গরমে না খেয়ে থাকলে পিত্ত গরম হয়ে শরীর খারাপ হবে।মামি আজ আগে আগেই দুপুরের রান্না শেষ করেছে।আগুনের তাপে মুখ কেমন রক্তবর্ন হয়ে আছে মামির।হাতে এক গাদা কাপড় মামার মনে হয় ধুয়ে দিবে।মামাকে বললো,আচ্ছা দিয়া যে ছোট মানুষ তোমার ছেলে কি তা জানেনা।কোথায় একটু কি বলেছে তাই নিয়ে রাগ দেখাচ্ছে।তোমার ছেলের এই অতিরিক্ত রাগ দিয়া বলেই সহ্য করে আর কেউ হলে করতো না।আমি দেখেছি দিয়ার সাথে রাগ একটু বেশী দেখায় বিহান।মামা হেসে বললেন,এইজন্য তো আমার দিয়া মা কে এনেছি।ছেলে তো একটু রাগি আছেই, তবে রাগ বেশীক্ষণ থাকবে না।মামি মামার পাশে ফ্লোরে পাটিতে বসে বললেন,তোমার ছেলে আমাকে রুশার বিয়ের রাগে বলেছিলো বাবাকে বলো তার বোনের মেয়ে এনে দিতে।না এনে দিলে আমি এমন কান্ড করবো ফুপ্পি দিয়াকে বিয়ে দিতে বাধ্য হবে।আমাকে সরাসরি বললো,আম্মু আমি বিয়ে করতে চাই।এখন আমাকে বিয়ে না দিলে জীবনেও বিয়ে করবোনা।ছেলের কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম ভেবেছিলাম আমার যে রাগী ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলে না আমার কপালে বোধহয় ছেলের বউ দেখা নেই।কিন্তু ছেলে আমাকে অবাক করে বলেছিলো আমি বিয়ে করতেই চাই মানে চাই।তাও সেটা দিয়াকেই, আমি ছোট বেলা থেকে ভেবে রেখেছি বড় হয়ে দিয়াকে বিয়ে করবো।তোমার ছেলে দিয়া ছাড়া কিছুই বোঝে না আবার রাগ দেখালে দিয়ার সাথেই দেখাবে।মামা হেসে বললেন,ওরা নিজেরাই মিটিয়ে নিবে তুমি ভেবো না।মামি বললেন,ছেলে না খেয়ে থাকলে আমি খেতে পারিনা কিছুই।ওই একটায় ছেলে আমার।মামা বললেন,বাড়ি এসে খেয়ে নিবে আমি যাচ্ছি গিয়ে বোঝাচ্ছি।এই দো-তলা বিশিষ্ট বাড়িটায় উপরে চাররুম আর নিচে চাররুম
।বিহান ভাই আর আমি উপরে থাকি বলে মামা মামি নিচে থাকেন।উনারা চান আমাদের স্পেস দিতে।আমাদের ফ্রি ভাবে সময় কাটাতে দেওয়ার জন্য মামা মামি বিহান ভাই এর বিয়ের পর থেকে নিচে থাকেন।রান্না খাওয়া সব নিচেই হয় উপরে শুধু আমরা দুজনে থাকি।মামা মামি অনেক অনুরোধ করার পরেও আমি খাই নি।
–সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে,এমন সময় রিয়া এসেছে আমাদের বাড়িতে।রিয়া নিচে থেকে সবার সাথে কথা বলে সোজা আমার কাছে চলে এসছে।মলিন মুখে হাসলে পৃথিবীর যেকোনো মানুষ ই বুঝতে পারে।অনিচ্ছাকৃত হাসি দিয়ে রিয়াকে বললাম,কখন এসছিস।
–রিয়া আমাকে দেখেই বললো,তোর কি শরীর খারাপ দিয়া।
–হ্যাঁ একটু খারাপ,মাথায় প্রচন্ড পেইন তো তাই।
–ওষুধ খাস নি দিয়া।চোখ মুখ একদম ই শুকিয়ে গিয়েছে। একজন ডাক্তারের বউ এর এমন অসুস্থতা মেনে নেওয়া যায় না।
–ডাক্তারের পেসক্রিপশন অসুস্থ রোগিকে সুস্থ করতে পারে।কিন্তু ডাক্তার নিজেই তো কারো না কারো মেডিসিন তাইনা রিয়া।মাঝে মাঝে বিহান নামক মেডিসিন এর অভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে দিয়া।
–ইস রে!এই কথাটা যদি বিহান ভাই শুনতে পেতো এই শহরে ভালবাসার কার্ফু জারী করতো।এই কথাটা বিহান ভাইকে নিজ দায়িত্বে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।দাঁড়া ফোন দিয়ে নেই বিহান ভাই কে।রিয়া উনাকে ফোন দিলে উনি ফোন টা তুলে বললেন,রিয়া বলো।
–উনার কন্ঠ শুনে যেনো মনের মাঝে তোলপাড় শুরু হলো।
–রিয়া বললো,বিহান ভাই আপনাদের বাড়ি৷ এসছি কোথায় আপনি?
–এইতো একটু বাইরে আছি। তুমি থাকো খেয়ে যেও বাসায়।
–আপনি ছাড়া আপনাদের বাসা ভাল লাগে না।
–আমার আসতে একটু লেট হবে রিয়া,তুমি থাকো যেও না।
–আপনাকে একটা গ্রেট নিউজ দিতে ফোন দিলাম।একটা অনেক সুখের আর একটা দুঃখের।কোনটা আগে শুনবেন বলুন।
–বিহান ভাই এর মাঝে তেমন একটা গুরুত্ব নেই।আমরা যে কেউ এমন কেউ নিউজ দিতে চাইলে পাগল হয়ে যায়, দ্রুত বলতে বলি।কিন্তু উনি কিছুই বললেন না।ফোন কানে নিয়েই সাইডে যেনো কার সাথে কথা বলছেন।
–রিয়া আবার বললো,বিহান ভাই শুনবেন না।
–উনি শান্ত কন্ঠেই বললেন,হ্যাঁ বলো শুনছি।
–একটা হলো দিয়া খুব অসুস্থ আমি জানি আপনার জন্য এটা অনেক বড় ব্যাড নিউজ।অন্যটা হলো দিয়া আপনাকে নিয়ে অনেক গুলো ভালবাসার বুলি আউড়িয়েছে।
-উনি কোনো রিয়াকশন না দেখিয়ে বললেন,তোমাকে কি এগুলা শিখিয়ে দিয়েছে বলার জন্য।নিজের মিথ্যা বলতে বাধে না আবার তোমাকেও মিথ্যা বলানোর জন্য ফোর্স করছে।রিয়া অন্যর কথায় কখনো মিথ্যা বলোনা তাহলে নিজের দাম থাকবে না।তোমাকে আমি খুব ভাল মেয়ে বলে জানি।আশা করবো সারাজীবন আমার চোখে এমন ই থাকবে তুমি।
–কসম না বিহান ভাই কেউ আমায় কিছু শিখায় নি।
–ফোনটা কেটে গেলো ওপাস থেকে।রিয়া বললো,কি নিয়ে মান অভিমান চলে দিয়া।
–এমনি,তেমন কিছুই না।
–লুকাচ্ছিস কেনো?বলনা কি নিয়ে।
–আমি কি তোকে কিছু শিখিয়েছি বলার জন্য।আমাকে নিয়ে উনার ধারনা এমন ই বুঝলি।
–ভালবাসা জমে ক্ষীর দেখছি।এখুনি বাড়ি গিয়ে কাকিমনিকে বলতে হচ্ছে।কাকিমনি অনেক চিন্তা করতো তোদের নিয়া।ইয়াহু।ব্যাগ থেকে কয়েক টা শীট বের করে দিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,এই নে ধর তুই আজ ক্লাসে যাস নি তোর টা নিয়ে এসছি।আমি এখন উঠি।রিয়া উঠতেই বিভোর ভাই আমার ঘরে ঢুকে রিয়ার সামনে দাঁড়ালো।আমি বিছানায় সুয়ে থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম দুজন মানব মানবী যখন প্রেমে পড়ে তখন তাদের চোখ যেনো কথা বলে,ঠোঁট যেনো কথা বলে।রিয়া আর বিভোর ভাই দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনের ওষ্টদ্বয়ে নির্মল হাসি।এই হাসিতে কোনো শব্দ নেই তবে আছে দুজনের নিরব গভীর অনুভূতি। এ অনুভূতির মানে ওরা দুজন ছাড়া পৃথিবীর কেউ বুঝবে না।প্রেমে পড়ার মুহুর্ত টা এতটায় চমৎকার দুজন ভালবাসার মানুষ যখন প্রথম অনুভব করে একে অপরকে ভালবেসেছে তখন পৃথিবীর সব সুখ তাদের কাছে এসে ধরা দেয়।এই সুন্দর অনুভূতি বলে বোঝাতে পারে না কেউ।বিভোর ভাই রিয়া এই সুন্দর অনুভূতির মাঝে বিরাজমান আছে দুজনে এখন।বিভোর ভাই রিয়াকে চোখের ইশারা করে কিছু বোঝাচ্ছেন,রিয়া লাজুক চাহনিতে উনার ভাষা বুঝার চেষ্টা করছে।রিয়া মুখে হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেলো বিভোর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে রিয়ার পিছ পিছ চলে গেলো।
সারাদিন অতিক্রম করার পর গম্ভীর মুডেই ফিরে এলেন বাসায় বিহান ভাই।প্রায় দুইদিন যে কিছু খান না তার জন্য মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে উনার।উনি ভীষণ রাগ করলে কারো সাথে টোটাল কথা বলেন না, উনার সাথেও কেউ ভয়ে কথা বলে না।কেননা উনি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেন এই অভ্যাস টা উনার আছে।বিহান ভাই বাড়িতে এসে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচতলার রুমেই গিয়ে বসলেন।মামি আস্তে করে গিয়ে বললেন,খাবার নিয়ে আসছি তোমার জন্য এখানে।তুমি খাও নি বলে তোমার বাবা আমি দিয়া কেউ খাই নি।বিহান ভাই শান্ত কন্ঠেই বললো,আমি ডায়নিং এ আসছি আম্মু এখানে কষ্ট করে আনতে হবে আনতে হবে না।তোমরা খাও নি কেনো?না খেয়ে একদম ঠিক করো নি।
–ডায়নিং বসে চুপচাপ বিহান ভাই খাবার খাচ্ছেন।
–মামি বললেন,বাবা দিয়া ও খাই নি কিন্তু।
–উনার মাঝে নিরবতা।
–মামি আবার বললেন,রাগ করো না বাবা। বিভার কথা ভেবেই দিয়া মিথ্যা বলেছে।
–বিহান ভাই কোনো কথা না বলে খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে গেলেন।
কেটে গেছে চারদিন এর মাঝে একবার ও বিহান ভাই আমার দিকে তাকান নি কথা ও বলেন নি।এমন কি দো’তলায় ও যান নি।সময় মতো গিয়ে চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠে গিয়েছেন।আমি উনার সাথে অসংখ্যবার কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু উনি একদম ই পাত্তা দেন নি আমায়।উনি ছাড়া জীবন টা এত ভয়ংকর হতে পারে ভাবতেও পারিনি আমি।আমি উনার কাছে যেভাবেই হোক ক্ষমা চাইবো। যত ইচ্ছা বকুক যা ইচ্ছা বলুক।কিন্তু উনি তো কথায় বলছেন না।ভীষণ বকুক তবুও কথা বলুক।কথা না বলার মতো শাস্তি কি এই পৃথিবীতে আর কিছুতে আছে?আছে বলে মনে হয়না।অন্য সময়ে তো বকেন সাহস হলো কিভাবে মিথ্যা বলার আরো কত কিছু বলেন কিন্তু এবারে একদম ই নিশ্চুপ। কষ্ট কি আমাকে দিচ্ছেন নাকি নিজেকে দিচ্ছেন।কারণ উনার রাগ হলে ভাঙাচুরা করেন,চিল্লান ভয়ানক কিছু করেন কিন্তু এবার রাগ নিজের ভেতরে চেপে আছেন।চারদিন পরে মামি জোর করে রাতে আমাকে ডিনারের জন্য নিয়ে আসলেন।বিহান ভাই আর আমি পাশাপাশি চেয়ারে বসেছি।প্লেটে ভাত নিয়ে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছি আর আড় চোখে বার বার উনার দিকে তাকাচ্ছি।এক বার ভাত মুখে নিতেই নাকে উঠে কাশি শুরু হলো।উনি এই চারদিন পরে মনে হয় সরাসরি আমার দিকে তাকালেন।আমিও উনার দিকে তাকিয়ে কেশে যাচ্ছি।ঝাল নাকে মুখে উঠে গিয়েছে।দীর্ঘদিন পরে চোখ চোখ পড়লো দুজনের।উনার চোখে রাগ নেই কোনো তবে এক সমুদ্র সমান কষ্ট দেখতে পেলাম।দ্রুত আমার মাথায় হাত দিলেন আর সাথে সাথে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়লো।চোখ পানিতে ভেজা দেখে আমার মাথা হাত সরিয়ে নিয়ে পানির গ্লাস রেখে হাত ধুয়ে উঠে চলে গেলেন।উনার অভিমান কি এতটায় তীব্র হয়েছে যে আর কথায় বলবেন না কোনদিন।সেই রাতেই উনি ছাদে গিয়ে বসেছেন।উনার পরনে কালো হাতা লম্বা গেঞ্জি,গেঞ্জির হাতা গুটিয়ে রাখা কনুই পর্যন্ত,পরনে কালো জিন্স,পায়ে সিম্পল স্যান্ডেল পরা।আমি ও আস্তে করে ছাদে গেলাম।উনি টি টেবল আর চেয়ার নিয়ে বসে ল্যাপটপ দেখছেন।সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেওয়ালে চাপ লেগে চাপচে ছিদ্র হওয়া হাতে আঘাত লেগে আবার রক্ত বেরোনো শুরু হলো।আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।উনি বুঝলেন আমি উনার সামনে তবুও তাকালেন না।
ওড়নার এক কোনা আঙুলে পেচাতে পেচাতে মিহি কন্ঠে বললাম,বিহান ভাই।
উনি চোখ তুলে তাকালেন,উনার চাহনিতে শীতলতা।তাকিয়ে দেখেন আমার হাত দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরোচ্ছে।উনি দৃষ্টি সরাসরি আমার আঙুলের দিকে দিলেন।চোখে মুখে দুঃচিন্তা উনার। দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত ফাঁকা।ল্যাপটপের সাটার অফ করে সোজা হাত চালিয়ে দিলেন চুলের মাঝে।আমার হাত যত দেখছেন ততই চোখ আগুনে পরিনত হচ্ছে রাগে।বিরক্ত ভাবে হাত চালাচ্ছেন চুলে। সাইডে থাকা ফুলের টবএ লাথি মেরে ফুলদানি টা ভেঙে কয়েক টুকরো করে ফেললেন। নিজের পা খানিক টা কেটে আমার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে রোমাল বের করে আমার আঙুলে পেচিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেলেন।
ছাদ থেকে নেমে উনার রুমে এসে দেখি উনি নেই।বিছানায় পড়ে আছে দলা করে রাখা এক টুকরো কাগজ।কাগজ টা মেলে দেখি লেখা,
“এই সময় ভীষণ খারাপ
এই সময় কেনো কাটছে না,
বিরহের সময় কি তবে বেশী শক্তিশালী সুখের সময়ের থেকে।
বিরহ যতটা তাকে ভাবাচ্ছে, সুখ তো ততটা তাকে ভাবায় নি কখনো।
তাকে ভাবার জন্য হলেও
বিরহ দীর্ঘ হোক অনন্তকাল।”
সাইডে আরেক টা কাগজে লেখা পেলাম,
“এই অবেলায় তোমারি আকাশে নীরব আপোষে ভেষে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ কখনো দেখাইনি তোমায়।”
——-বিহান ভাই
চলবে,,
#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা (সিজন ২)
৩৮.
#WriterঃMousumi_Akter
গ্রীস্মের প্রচন্ড উত্তাপে হাঁপিয়ে উঠেছে প্রকৃতি ।চারদিকে ভ্যাপসা গরম, উত্তপ্ত পরিবেশ,নাজেহাল অবস্থা মানুষ সহ সকল প্রাণীর।ভীষণ খরা, মাঠঘাট পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।তৃষ্ণায় ভুগছে সব কিছু।রোদের প্রচন্ড উত্তাপে সমস্ত প্রাণীকুল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।কাল বৈশাখীর আগমন ও শুরু হয়েছে।সময়ে অসময়ে আকাশ কালো করে মেঘ জমছে,সাথে সাথে মেঘের গর্জন ও শুরু হচ্ছে সেই সাথে বজ্রপাত।শুরু হচ্ছে প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া,প্রবল বেগে ঝড় ও উঠছে সেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হচ্ছে সব কিছু,তছনছ হচ্ছে সব।বাইরে ঝড় উঠেছে ভীষণ ঝড়।মনের ঝড় কি বাইরে বেরিয়ে এসেছে।সকাল সাতটা থেকেই আকাশ কেমন ভারী থমথমে।যতটা থমথমে ছিলো ততটায় লন্ডভন্ড ঝড় শুরু হয়েছে।
সকালেই বিহান ভাই কোথায় একটা বেরিয়েছেন।এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে কোথায় গিয়েছেন উনি।চারদিকে এত বজ্রপাত ভীষণ ভয় লাগছে উনার জন্য।মনে মনে দোয়া পড়ছি উনি যেনো ঠিক থাকেন।মনের মাঝে ভীষণ খারাপ লাগছে।বাইরে বড় গাছ গুলো ভেঙে পড়েছে।শিউলি গাছের একটা ডাল ও ভেঙে পড়েছে প্রবল ঝড়ের হুংকারে।মারুফা খালা আর মামি বারান্দায় বসে চাল বাছছেন।দুপুর একটায় ভিজতে ভিজতে বাসায় প্রবেশ করলেন বিহান ভাই।এই ভীষণ ঝড় টা কি উনার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। উনি যে অনেক সময় ধরে ভিজেছেন সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।ভিজে চুপসে গিয়েছেন,হাত পায়ের আঙুলে টাস্কি লেগে গিয়েছে।ভিজে নেয়ে স্নিগ্ধ এক পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে মনে আঙিনায়।এমনিতেউ ফরসা মানুষ ভিজে হার পায়ের আঙুল একদম ই সাদা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।পকেট থেকে পলিথিন এ মোড়ানো ফোনটা বের করে মামির হাতে দিয়ে বললেন,আম্মু দেখোতো ফোন ভিজে গিয়েছে কিনা?
–মামি ফোন টা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো দেখ তো দিয়া।এর পর উনাকে বললেন,বিহান তুমি ভিজেছো ক্যানো?তোমার না বৃষ্টি লাগলেই জ্বর আসে।
–আম্মু আর কত সময় বসে থাকবো বাইরে।ছাতা ও তো নেয় নি আমি।একদম ই বিরক্ত লাগছিলো তাই চলে এসছি।
–কারো কাছ থেকে একটা নিয়ে আসতে এইভাবে ভিজলে জ্বর আসবে তোমার।দ্রুত চেঞ্জ করে নাও।চেঞ্জ করে মাথায় একটু সরিষা তেল দাও।
–আম্মু কিচ্ছুই হবে না।একদম ই চিন্তা করো না।মারুফা খালা রান্না হয়েছে খেয়ে ঘুমোবো।
–হ্যাঁ বাবা! আজ দিয়া মা খিচুড়ি রান্না করতে বলেছে তাই খিচুড়ি হয়েছে।
–আমার ঘরে একটু দিয়ে যাও তাহলে।
আমি মামি আর মারুফা খালার সাথেই বসে ছিলাম।উনি একবার আমার দিকে তাকালেন।চাওনি তে কোনো গম্ভীর ভাব নেই আজ।উনার গায়ের সাদা শার্ট ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের আছে।শার্টের বোতাম দুইটা খোলা।চোখের পাপড়ি ভিজে লাল হয়ে গিয়েছে।হাল্কা খুড়িয়ে হাঁটছেন গতরাতে পা কেটে গিয়েছে উনার।
নিচ তলার কমন ওয়াশ রুম দুইটা,একটা গোসলের জন্য।উনি নিচ তলার ওয়াশ রুম থেকে গোসল করে টাওয়াল পরে আজ উপরেই গেলেন।আমি বেশ অবাক হলাম এ ক’দিন উনি উপরেই যান নি।মনে হচ্ছে রাগ কমে এসেছে অনেক খানি।উনি উপরে গিয়ে মামিকে ডাকছেন,
আম্মু আমার ব্লু এ্যাশ কালারে শার্ট টা কোথায়?পাচ্ছি নাতো খুজে।
মামি আমাকে বললো দিয়া যাতো এগিয়ে দিয়ে আয়।
–আমাকে বকবেন উনি মামি।
–বকুক যাতো তুই।
–না মামি তোমার ছেলে বকবে।
–বকবে না তোকেই যেতে হবে।
–মামির জোরাজোরিতে নিচ তলা থেকে উপরতলায় গেলাম।উনার পরনে সাদা টাওয়াল।ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পায়ে কিছু লাগাচ্ছেন।উনি ড্রেসিন টেবিলের মাঝেই আমাকে দেখেছেন।ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।আমি আলমারি থেকে উনার শার্ট বের করে বিছানায় রাখলাম।
–উনি শার্ট হাতে নিয়ে দুই ভ্রু উচিয়ে বললেন,আর প্যান্ট?
–বেশ অবাক লাগলো,উনি আমার কাছে প্যান্টের কথা জিজ্ঞেস করলেন।নিমিষেই যেনো মনের উপর থেকে কয়েক মন ভারী কিছু নেমে গেলো।
প্যান্ট নিয়ে উনার হাতে দিতেই উনি শান্ত ভাবেই তাকালেন আমার দিকে।
আর কোনো কথা বললেন না। আমি উনার ফোন টা দিয়ে বললাম এই যে আপনার ফোন।উনি তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না।
–উনি শার্ট আর প্যান্ট আমার সামনেই পরলেন।তবে নিশ্চুপ আছেন কোনো কথা বলছেন না।
–আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আকস্মিক আমার কাঁন্নার শব্দে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
–আমি বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললাম,আমাকে ক্ষমা করে দিন বিহান ভাই।এই এম সরি।আমি আর কোনদিন মিথ্যা বলবো না।আমাকে যা শাস্তি দিতে হয় দিন তবুও কথা বলুন আমার সাথে।আমি এইভাবে আর থাকতে পারছি না।প্লিজ বিহান ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি বুঝতে পেরেছি আমি অন্যায় করেছি,ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়।তবুও আমায় ক্ষমা করুণ আপনি।এই কয়েকদিনে আমার কষ্ট হয়েছে ভীষণ কষ্ট হয়েছে।দুলাভাই মাইন্ড করে যদি বিভা আপুকে কথা শোনায় তাই আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম।কথা না বলার মতো শাস্তি নেই।আপনি এতদিন যেসব শাস্তি দিয়েছেন সেসব এই কথা না বলার কাছে কিছুই না।
উনি এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,”আমার কথা বলায় কার কি আসে যায়।আমি তো বিরক্ত করি সবাইকে।”
“যায় আসে, ভীষণ যায় আসে।আমার বিরক্তই এখন ভাল লাগে।আপনি বোঝেন না।”
“ভ্রু উচিয়ে বললেন,রিয়েলি?উনি যেনো ভীষণ অবাক হয়েছেন।চোখে মুখে বিস্ময়।আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ও ভ্রু উচিয়ে বললেন,চোখের পানি মুছে ফেলার রিকুয়েষ্ট করছি মিস দিয়া। এটা আমি দেখতে পারি না।চোখের পানি সহ্য হয় না আমার।”
উনি হাচি দিচ্ছেন ঘন ঘন।এক টানা কয়েক দিন ভিজেছেন উনি।একটা রাত ও ঘুমোন নি।ছাদে বসে কাটিয়েছেন।খাবার দুই একবার মুখে তুলে পানি ঢেলে দিয়েছেন।
আমি আবার ও কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“বিহান ভাই আপনি কেনো নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছেন?এই যে রেগুলার ভিজছেন,ঠিক ভাবে খাচ্ছেন না।ঘুমোচ্ছেন না।আমাকে যা খুশি বলুন তবুও নিজেকে কষ্ট দিবেন না প্লিজ।”
“থ্যাংক ইউ সো মাস আমার ব্যাপার এত কিছু ভাবার জন্য।নাউ ইউ লিভ আমি ঘুমোবো।”
“খাবেন না”
“খাবার না দিলে কিভাবে খাবো।”
“এরই মাঝে মারুফা খালা খাবার দিয়ে গেলো।আমি টেবিল এর বই এক কোনায় সরিয়ে রেখে মারুফা খালাকে খাবার রাখতে বললাম।খালা খাবার রেখে চলে গেলো।বিহান ভাই চেয়ার টেনে বসে খাবার খেতে খেতে বললেন,না খেয়ে চোখ মুখের এ অবস্থা করার মানে টা কি?শরীর খারাপ হলে নিজের ই কষ্ট হবে।আই থিংক খেয়ে সুস্থ থাকাটায় বেটার।”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো বিহান ভাই।আগের মতো কি আর কথা বললেন না।”
“আগের কথা ভুলে যাওয়াটায় বেটার।কথা এটুকুও বলার ইচ্ছা ছিলো না।বাট চোখ মুখ শুকনো রোগাটে দেখা যাচ্ছে তাই।দেখতে নিজের কাছেই খারাপ লাগছে তাই।”
“তার মানে আপনি আর কথা বললেন না?আপনি কি আর আমার সাথে থাকতে চাইছেন না।”
“উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,অযাযিত প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার থেকে পাওয়া যাবে না।আর কোচিং যাওয়া হচ্ছে না কেনো?”
“আমার কিছুই ভাল লাগে না, আপনি কথা না বললে।”
“আমি এমন কোনো ইমপর্টেন্ট মানুষ না যে আমার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হবে।আমাকে অবহেলা করাটায় হবে মিস দিয়া।আই থিংক আমি সেটার ই যোগ্য।”
“কথা না বললে আজ আমি কোচিং থেকে আর ফিরবো না বিহান ভাই।ফিরবো না মানে না।আপনাকে আর বিরক্ত করবো না আমি।আমার একটা অন্যায় ক্ষমা করতে পারছেন না আপনি।আমি আপনার চোখের সামনে থাকলেও আপনার রাগ হয় আমি বুঝি।আর আপনাকে জালাবো না আমি।”
“উনি শান্ত কন্ঠেই বললেন,আমি কি এসব বলেছি।নিজে থেকে এসব ভাবার কারণ কী?”
আমি কোনো কথা না বলে মন খারাপ করে বেরিয়ে এলাম।বিকালে বৃষ্টি শেষ হলে রিয়াকে কল দিয়ে দুজনে কোচিং এর জন্য রওনা হলাম।আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার তবে রাস্তাঘাট ভেজা,গাছ থেকে পানি পড়ছে হালকা বাতাস হলেই।কোচিং এর সাইডেই ফুচকার দোকানে মেহু আপু আর ভাইয়াকে দেখলাম।ভাইয়া ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে মেহু আপুর গালে তুলে।রিয়া আর আমি অবাক হয়েই দেখলাম কাহিনী কী?তবে ওদের সামনে গেলাম না।রিয়া কে বললাম আজ পড়বো না রিয়া আমার ভাল লাগছে না।মাথা প্রচন্ড ঘুরছে।
রিয়া বললো সকালে খেয়েছিস।
আমি মৌন রইলাম।রিয়া বুঝতে পারলো আমি খায় নি।
–শরীর হঠাত কেমন দূর্বল মনে হচ্ছে।চোখে কেমন ঝাপসা দেখছি।রিয়া আমাকে নিয়ে কলেজের ভেতরে গিয়ে সিড়িতে বসালো।ক্রমশ আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো।মাথার উপর দিয়ে যেনো পুরো পৃথিবী ঘুরছে।রিয়া দ্রুত একটা কেক এনে আমাকে খাইয়ে দিয়ে বললো কিছু খেলে ভাল লাগবে দিয়া।
–কেক একটু খেতেই বমি শুরু হলো ভীষণ বমি।
–রিয়া বেশ ভয় পেয়ে গেলো কি করবে বুঝে উঠতে পারে নি।
–বমি করতে করতে সেন্সলেস হয়ে কলেজের মাঠেই পড়ে গেলাম।
রিয়া অনেক ডাকাডাকি করেও কিছু করতে পারলো না।অবশেষে বিহান ভাই কে কল করলো।
চলবে,,
#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা (সিজন ২)
৩৯.
#WriterঃMousumi_Akter
“দিয়া এই দিয়া চোখ খোল আমি এসছি দেখ।”
কেউ আমার গালে হাত দিয়ে ডেকে চলেছে, তার কন্ঠে ভীষণ অস্হিরতা।আমার কানে তার কথা পৌছালেও আমি চোখ খুলতে পারলাম না।আমার শরীরের সমস্ত শক্তি ততক্ষণে যেনো ক্ষয় হয়ে গিয়েছে।কেউ পাগলের মতো করছে আর ডাকছে আমায় তার কন্ঠে স্পষ্ট কষ্টের রেখা বহমান।ছটফট করছে আর ডাকছে আমায়।বেশ কিছুক্ষণ পরে আস্তে করে কোনো রকম চোখ খুললাম।সব কিছু ঝাপসা দেখছি কুয়াশার মতো।চোখ বার বার খুলে দেখার চেষ্টা করলাম ঝাপসা কারো মুখ আস্তে আস্তে ক্লিয়ার হলো।কারো হাতের উপর আমার মাথা রাখা,আমার মাথায় সে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ভীষণ চেনা তার শরীরের গন্ধ,অনুভব করতে পারলেও মুখে বলতে পারছি না।চোখ পিট পিট করে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখি বিহান ভাই এর মুখ।উনি এখানে কিভাবে এলেন আর আমার মাথা ই বা উনার হাতের উপর কিভাবে দু’মিনিটে উনি কিভাবে এলেন মস্তিষ্কে এই মুহুর্তে এসব প্রশ্ন আর আসছে না।মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে গিয়েছে।
“উনি আমার মুখে পানি ছেটাচ্ছেন আর বলছেন,আমাকে এইভাবে ভয় পাইয়ে দিলি কেনো তুই?এক্ষুণি চোখ খুলে উঠে দাঁড়া বলছি।আমি এইভাবে তোকে দেখতে পারছি না।”
“আমি জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,আমার অনেক খারাপ লাগছে।মনে হয় আর বাঁচবো না।”
“উনি আমার হাতের তালু মুঠো থেকে ছড়ানোর চেষ্টা করছেন আর বলছেন,কিচ্ছু হবে না তোর দিয়া।এই এই সব কি কথা দিয়া।কখনো আর এইসব বলবি না।”
আমি আবার ও বমি করে সেন্সলেস হয়ে গেলাম।বাইরে সবার কথা কানে আসলেও আমি তার রেসপন্স করতে পারছি না।বিহান ভাই পাজা কোলে তুলে নিলেন আমাকে।রিয়াকে বললেন,কুইক এসো রিয়া। রিয়া পেছনে পেছনে আসছে আমাদের।আমাকে সাথে সাথে সদর হসপিটালে নিয়ে আসলেন।চোখে মুখে ভীষণ দুঃচিন্তা,কষ্ট,আর ভয় বিহান ভাই এর।শুধু প্রার্থনা করছেন আমি যেনো সুস্থ হয়ে যায়।ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিয়েই বেডে সুইয়ে দিলেন।সাথে সাথে ডাক্তার নার্স এগিয়ে এলেন।
বিহান ভাইকে হসপিটালের সবাই চিনে।ডাক্তার এবং নার্সরা সবাই বিহান কে দেখে ভীষণ অবাক হলো।
ডাক্তার বিহান ভাই এর কোলে আমাকে দেখে বললেন, কোলে কে বিহান?কি হয়েছে ওর।
বিহান ভাই খুব উত্তেজিত আর ব্যাস্ততার সাথে বললেন,শী ইজ মাই ওয়াইফ স্যার।।প্লিজ দেখুন তো ও কেনো সেন্সলেস হয়েছে।ওর বিশেষ কিছু হয় নিতো।ও কেনো এইভাবে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।
ডাক্তার বললেন,ডোন্ট ওয়ারি তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বা এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়লে।বিহান তুমি নিজেও তো ডাক্তারি পাশ করেছো।রুগি দেখে এইভাবে উত্তেজিত হলে কিভাবে ট্রিটমেন্ট করবা।ডাক্তার দের উত্তেজিত হলে হয় না।
অন্য রুগি আর দিয়া এক নয় স্যার।ওর কিছু হলে পুরা পৃথিবী ঘুরতে থাকে আমার।প্লিজ ভাল ভাবে দেখুন স্যার।
“দেখেছি কিছুই হয় নি। শরীর উইক,ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি তো তাই সেন্সলেস হয়েছে।প্রচুর খাওয়ার ঘাটতি।একটা ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি ঘুমের।তবে হ্যাঁ এইভাবে না খাওয়া দাওয়া চলতে থাকলে বড় কিছু হয়ে যেতে পারে।কেয়ারফুলি তার যত্ন করতে হবে।”
“স্যার ভয়ের কিছুই নেই তো।”
“এখনো পর্যন্ত নেই,তবে এর থেকে উইক হলে খারাপ কিছু হতে কতক্ষণ।এই বয়সী মেয়েগুলো প্রায় আসে তোমার ওয়াইফ এর মতো সেইম সমস্যা তারাও ভাত খায় না,পানি খায় না ঠিক ভাবে।তোমার ওয়াইফ এর পানি শূন্যতা প্রচুর।তুমি তো একজন ডাক্তার নিশ্চয়ই জানো পানি একটা মানব দেহের জন্য কত জরুরী।”
“জ্বী স্যার।”
–নার্স এগিয়ে এসে ইনজেকশন পুশ করলেন।সেখান দিয়ে একটু রক্ত বেরোলো। আমি উঁহু বলে উঠলাম ব্যাথায়।
–বিহান ভাই উত্তেজিত হয়ে বললেন,ওহ শীট আস্তে সুঁচ ফুটান।ও ব্যাথা পাচ্ছে না।উনি আমার হাত ডলে দিতে দিতে বললেন,ব্যাথা কি অনেক লাগছে।
–নার্স কিছুই বললো না।বিহান ভাই কে ভিষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছে।চোখে মুখে দুঃচিন্তার রেখা বিরাজমান।
–ডাক্তার বললেন,বিহান চাইলে ভর্তি করতে পারো আবার বাসায় ও নিয়ে যেতে পারো।ইয়াং ম্যান বউ এর একটু সুঁচ ফুটতে যে এত রিয়াকশন দেখায় তার ওয়াইফ এমনি সুস্থ হয়ে যাবে।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে বেশ কিছু মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।বিহান ভাই কে এমন পাগলামি করতে দেখে বলাবলি ও হচ্ছে অনেক কিছুই।
–হসপিটাল থেকে বিহান ভাই আমাকে কোলে অটোতে তুলে বাসায় নিয়ে এলেন।বাড়ির সামনে থেকে কোলে তুলে ঘরে তুলতে দেখে বিভোর ভাই,বিভা আপু, মামা মামি সবাই এগিয়ে এলো।সবাই একে একে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।বিহান ভাই কারো কথার উত্তর দিলেন না।আমাকে সোজা দো’তলায় নিয়ে বেডে নিয়ে সুইয়ে দিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিলেন।বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।বিহান ভাই কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার মুখ থেকে কোনো কথায় বের হচ্ছে না।রিয়া সবাইকে বললো,আমি অসুস্থ হয়ে গেছিলাম।বাড়ির সবাই আমার চারপাশেই বসে আছে আমাকে ঘিরে।কিছুক্ষণ বাদেই ও বাড়ি থেকে সবাই এসছে।কাকিমনি,কাকুরা বাবা আম্মু ভাইয়া সবাই।আম্মুর চোখ থেকে পানি পড়ছে।আম্মু কেঁদেই যাচ্ছে।মামি বললো, ভয়ের কিছুই নেই একটু শরীর উইক।আম্মু আমার মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলো।
বিহান ভাই ঘরের বাইরে বারান্দায় গিয়ে ভীষণ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।বাবা আম্মুকে বললেন,তুমি এত ভেঙে পড়লে বিহান আরো বেশী মন খারাপ করবে।ছেলেটা বাইরে আছে যাও গিয়ে বুঝাও।আম্মু বাবাকে বললো তুমি ও চলো। আম্মু আর বাবা দুজনেই বিহান ভাইকে বোঝালো যে,বিহান ভাই যেনো এইভাবে ভেঙে না পড়েন।আম্মু আর বাবার সামনেই বিহান ভাই এর চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেলো।আম্মু আর বাবা তখন ই নিশ্চিন্ত হলো তারা আমাকে যার হাতে তুলে দিয়েছে আমার কিছু হলে তার পুরা দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যায়।মা বাবা ভীষণ স্বস্তি পেলো।তারাও তো এমন ই চেয়েছিলো তাদের মেয়েকে বিহান ভাই এক পৃথিবী সমান ভালবাসুক।
কাকিমনি রিয়াকে বললো,বাসায় কেউ নেই রিয়া চাবি নিয়ে চলে যা।দিয়া একটু সুস্থ হলেই আমরা আসছি।তরকারি এসে রান্না করবো তুমি রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে দিও শুধু।
রিয়া মাথা নাড়িয়ে বললো ঠিক আছে আম্মু
।রিয়া চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে শহরে।সূর্য অস্তমিত হয়েছে পপশ্চিমাকাশে,ঈষাণ কোনে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে।সন্ধার কৃত্তিম আলোর শহরে লাল গাউন পরে এক সাইডে ব্যাগ নিয়ে নিরিবিলি হেটে চলেছে রিয়া রাস্তার এক সাইড দিয়ে।রিয়ার হাইট ৫ ফিট ৪, আমার থেকে অনেক ফর্সা,কোমর ছড়িয়ে গিয়েছে চুল।এক কথায় যাকে রুপবতী বললে একটুও ভুল হবে না।লাল গাউনে রিয়াকে কোনো পরীর থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না।হঠাত রিয়ার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলেন বিভোর ভাই।বিভোর ভাই এর পরনে কালো জিন্স,কালো শার্ট ফর্সা শরীরে মানিয়েছে বেশ।পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে,দুজনের সংস্পর্শে এসে দুজনের ই খুব ভাল লাগছে।দুজন ই মৌনভাবে হেঁটে চলেছে,তবে দুজনের মন ই কথা বলছে।দুজনের চোখে মুখে উজ্জ্বলতা, হাসির উচ্ছলতা।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে,
“রিয়া বললো,কোথায় যাচ্ছেন?কন্ঠে লাজুকতা।”
“তোমাকে এগিয়ে দিতে এসছি। ”
“কেউ দেখলে মাইন্ড করবে।আমি কি ছোট মানুষ যে এগোতে হবে।রিয়ার মুখে মুচকি হাসি।”
“কে দেখবে?ছোট ছাড়া বড় কোথায়?এটুকু একটু মেয়ে।”
“আশে পাশে এত মানুষ আছে সবাই দেখবে।আর আমি মোটেও এইটুকু না।হাইট দেখেছেন।”
“হাইট তো হতেই হবে।কার বউ দেখতে হবে না।”
“এমন ভাবে বলছেন যেনো রেজিস্ট্রি করা বউ আপনার।”
“রেজিস্ট্রি করে নিতে সময় লাগবে না।যাবে এক্ষুণি।”
“রিয়া হাসছে।দুজন দুজনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর লাজুক ভাবে হেসে যাচ্ছে।”
“রিয়া তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
“হঠাত এমন প্রশ্ন।”
“উত্তর দাও প্লিজ।বুক ধড় ফড় করছে।”
“যদি বলি আছে। কথাটা বলেই রিয়া হাসি আটকে দম বন্ধ ভাবে তাকালো বিভোর ভাই এর দিকে।”
“কি করে সে?”
“আমার পিছ পিছ ঘোরে। ”
“আই মিন তার প্রফেশন কি?”
“এত ইন্টারেস্ট কেনো তার ব্যাপারে।”
“কারণ তুমি মিথ্যা বলছো তাই।”
“কে বললো মিথ্যা বলছি।”
“তোমার চোখ আর মুখ।মিথ্যা তো গুছিয়ে বলতে পারো না। বলো কেনো?মজা নাও তাইনা।এই বাচ্চা ছেলেটাকে আর কতদিন ঘুরাবে।”
“যত দিন বেঁচে আছি ঘুরাবো।”
“মেয়ে মানুষ আসলেই যাদুকরী।কিভাবে একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে ঘুরাতে পারে।”
“না ঘুরলেই তো হয়।”
“তাহলে তো জীবন ই বৃথা যাবে রিয়ামনি।
বিভোর ভাই রিয়ার এক গোছা চুল ধরে খোপা করে বললেন, রাবার দাও বাঁধার জন্য।”
“রিয়া বেশ অবাক হয়ে বললো আপনি চুল বাঁধছেন যে।”
“কি করবো না হলে এই পরীর পিছনে কোনো জ্বীন লেগে যাবে যে রিয়া।”
রিয়া একটা রাবার বিভোর ভাই এর হাতে ধরিয়ে দিলো।দুজেন গল্প করতে করতে হেঁটে চললো।
ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে।বেশ সুস্থ লাগছে এখন।তবে মাথা তুলতে পারছি না।বিছানায় সুয়ে আছি আমি, উপরে ফ্যাণ চলছে।বিছানার এক কোনায় বসে আছে মামি।ফ্লোরে বসে মামির কোলে মাথা রেখে পাগলের মতো ছটফট করছেন বিহান ভাই।
“আমি আর পারছি না আম্মু,আর পারছি না।দিয়াকে উঠতে বলো প্লিজ।দিয়াকে এইভাবে দেখে আমি সহ্য করতে পারছি না,আবার চিৎকার করে কাঁদতেও পারছিনা।তুমিতো জানো আম্মু দিয়াকে আমি কতটা ভালবাসি।আমি বুঝাতে পারিনি এটাই ব্যার্থতা।মনের সাথে কয়েকদিন একটানা যুদ্ধ করেছি।ইচ্ছা করে কথা বলিনি,মনের বিরুদ্ধে এমন কাজ করতে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে বোঝাতে পারবোনা আম্মু।দিয়ার প্রতি অনেক অভিমান হয়েছিলো,মনের গভীরে কোথাও যেনো ভয় ঢুকেছিলো,ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।কিন্তু আমি তো আর পাঁচ জনের জন্য সিনক্রিয়েট করে নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করতে পারিনা।নিজের মান অভিমান গুলো বাইরে বের করতে পারিনা।আমার মনে হয়েছিলো দিয়া আমায় অবহেলা শুরু করেছে।আমার গুরুত্ব দিয়ার কাছে কমে গিয়েছে না হলে কত সহজে দিয়া আমার মুখের উপর মিথ্যা বলতে পারলো।তোমার ছেলে ভীষণ হিংসুটে হয়ে গিয়েছে আম্মু।দিয়া আমি ছাড়া পৃথিবীর কাউকে গুরুত্ব দিলে আমি সেটা মেনে নিতে পারিনা।দিয়ার জীবনে শুধু আমার ই গুরুত্ব থাকবে।জানো আম্মু এই ভয়ে আমি কখনো ভেতরের দূর্বলতা দিয়ার সামনে প্রকাশ করতে চাই নি।শুনেছি দূর্বলতা বেশী প্রকাশ করলে গুরুত্ব থাকে না।তবুও সেই অবহেলার স্বীকার হয়েছি।দিয়া যা করুক, যত বড় অন্যায় করুক আমার কাছে বলুক আমি মেনে নিবো এক বাক্য ক্ষমা করে দিবো।দিয়ার মিথ্যা আমি সহ্য করতে পারিনি।দিয়া আমায় কেনো মিথ্যা বলবে।দিয়ার জীবনে কিছুই আমার কাছে গোপনীয় থাকবেনা।আমার বার বার মনে হয়েছে আমার প্রতি এতই বেশী গুরুত্বহীন হয়েছে যে মিথ্যা ও বলতে দুবার ভাবছে না।বিভা আপুর সাথে কেনো যার সাথে ইচ্ছা যাক আমায় মিথ্যা বলেছে এটায় আমার কষ্ট।”
“দিয়া আসলে বিভার কথা ভেবেই এমন করেছে বাবা।তুই তো জানিস ই দিয়া বিভা বিভোর তুই সবাই কে নিয়েই কত ভাবে।”
“না আম্মু ও সবার কথা ভাবে, শুধু আমার কথা ভাবেনা।”
“কে বলেছে ভাবেনা।না ভাবলে কি মেয়েটা না খেয়ে এইভাবে অসুস্থ হয়ে যেতো।”
“না আম্মু ভাবে না।ও সবাইকে বুঝেলেও আমাকে বোঝে না।ও যদি আমাকে ভাবতো তাহলে না খেয়ে এইভাবে অসুস্থ হতোনা।ও অসুস্থ দেখে আমার নিজেকে আরো বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার জন্যই দিয়া আজ এত অসুস্থ।ও কেনো বোঝেনি ও অসুস্থ হলে আমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়।দিয়ার অসুস্থতায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।আমি দম নিতে পারছি না।”
“আমার ছেলে রাগী হলেও মন কত নরম আমিতো সেটা ভাল করেই জানি বাবা।তুমি দিয়ার কত বড় হয়েও বোঝো না।দিয়া কিভাবে বুঝবে বাবা।দিয়া সুস্থ হয়ে গেলে আর কখনো রাগারাগি করোনা।রাগ অভিমান থাকবেই তবে তার লিমিট থাকতে হবে বাবা।দিয়া তোমার ছোট দিয়ার ভুল তোমাকে ক্ষমা করতে হবে।”
আমি আস্তে করে ডাক দিলাম মামি।
বিহান ভাই চোখ মুছে দ্রুত আমার দিকে তাকালেন।
চলবে,,