এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা ২ পর্ব-৭৫+৭৬

0
1478

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা সিজন ২
৭৫.
#WriterঃMousumi_Akter
–হসপিটাল থেকে বিহান আমাকে বাসায় নিয়ে এসছে।বাসায় রেখে নিজেই সেবাযত্ন করবে।হসপিটালের থেকে বাসায় রেখেই নাকি বেষ্ট ট্রিটমেন্ট করতে পারবে।হসপিটালে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট দেখার পর থেকে বিহান আর একটুও হাসে নি।মনে হলো পৃথিবীর সব থেকে খারাপ কোনো সংবাদ বিহানের কানে গিয়েছে।এমন টা তো হওয়ার কথা নয়।বিহান বাবা হবে এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে ওর কাছে।হসপিটাল থেকে রাত আটটার দিকে বিহান,বিভোর ভাই আর রিয়া আমাকে বাসায় নিয়ে এলো।বিহান আমাকে কোলে তুকে নিয়ে বেডে সুইয়ে একটা স্যালাইন ধরিয়ে দিয়ে রিয়াকে বললো,

“দিয়ার পাশে বসো আমি একটু আসছি।কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে কিন্তু।আমার ইমারজেন্সি কাজ আছে আমি এক্ষুণি আসছি।রিয়া কোথাও কিন্তু যেও না ওর কাছ থেকে।”

রিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো।

–আমার মনের মাঝে তুমুল অশান্তি হচ্ছে।আমাদের বেবি হওয়ার নিউজ শুনে যেখানে বিহানের সব থেকে বেশী খুশী হওয়ার কথা সেখানে বিহান এর মুড পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।বিহানের মাঝে কোনো আনন্দ,উল্লাস কিছুই নেই।কিন্তু কেনো, এমন বিহ্যাভ করছে।মনের মাঝে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।রিয়া আর বিভোর ভাই আমার পাশে বসে আমাদের বেবি নিয়ে বিভিন্ন গল্প করে যাচ্ছে।বেবির নাম কি রাখবে,বেবিকে নিয়ে কি কি করবে বিভিন্ন প্লান করে যাচ্ছে।।আম্মু,মামা-মামি সবাই ফোন দিয়েছিলো।তাদের মাঝে আনন্দের শেষ নেই।তারা যেনো এক্ষুণি ছুটে আসতে পারলে খুশি হয়।দুটো পরিবারের সবাই যেখানে খুশি সেখানে বিহানের মুখে হাসি নেই কেনো।বিহানের চিন্তা মাথা থেকে যেতেই চাইছে না।নিজের আনন্দ ও ঠিক ভাবে উপভোগ করতে পারছি না।স্যালাইন শেষ প্রায় তখন বিহান প্রবেশ করলো রুমে।ঠিক ঠিক টাইমে বিহান কিভাবে প্রবেশ করলো রুমে।সময় নিয়ে এত সতর্ক কিভাবে হতে পারে।বিহান আসলে রিয়া আর বিভোর ভাই বেরিয়ে গেলো।বিহানের মুখ এখনো ভারী হয়ে আছে।হাতের স্যালাইন খুলে হাতে একটা টেপ মেরে বললো,

“ঘুমিয়ে যাও,রেস্টের প্রয়োজন তোমার।”

বিহানের চোখে মুখে মলিনতা দেখে বললাম,

“আপনি কি খুশী নন।”

বিহান গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বললো,

“কোন ব্যাপারে।”

“আমরা মা বাবা হতে যাচ্ছি এত বড় খুশির খবর আপনার কোনো ফিলিংস ই নেই।মনে হচ্ছে আপনি জানেন ই না।আবার জিজ্ঞেস করছেন কোন ব্যাপারে।”

বিহান মুড অফ করে খানিক টা বিরক্ত ভাবেই বললো,

“তুমি এক্সিডেন্ট করেছো আর আমি আনন্দ করে বেড়াবো।এই মুহুর্তে তুমি ছাড়া আমার কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয় দিয়া।হোক সেটা বেবি বা অন্য কোনো দামী জিনিস।তোমার থেকে দামী তো আর কোনো কিছু নয় তাইনা?তুমি আমাকে এখন ফিলিংস এর কথা বলছো।তুমি জানো কতটা স্ট্রেস গিয়েছে আমার উপর দিয়ে।এতটা ষ্টুপিড আর কেয়ারলেস তুমি।কখনো আমার কথা ভাবোই না।বারবার বলেছি তাড়াহুড়ো নয় সাবধানে রাস্তা ক্রস করবা।তোমার তো সেদিকে খেয়াল ই থাকে না।মন সারাক্ষণ এদিক সেদিক বেড়ায় তোমার।আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো আমার কি হতো।”

মাথা নিচু করে বললাম,

“আপনি কি আমায় বকছেন।”

বিহান আমার মন খারাপ দেখে চিন্তায় মাথার চুলে হাত চালিয়ে বললো,

“সরি দিয়া,সরি।আমার মাথা ঠিক নেই।তাই বকা দিয়ে ফেলছি।তুমি আগে সুস্থ হও পরে ভেবো বেবি নিয়ে।”

“এসব আপনি কোন ধরনের কথা বলছেন। বেবি গুরুত্বপূর্ণ না।”

“দিয়া প্লিজ টেক রেস্ট।আমি সাওয়ারে যাচ্ছি।”

বিহানের হাত টেনে ধরে বললাম,

“দাঁড়ান না প্লিজ।হঠাত কি হয়ে গেলো আপনার।বেবির ব্যাপার এড়িয়ে যেতে চাইছেন কেনো?বলুন না প্লিজ কি হয়েছে আপনার।”

“সাওয়ার নিয়ে আসছি।”

প্রায় দুই ঘন্টা কেটে গেছে,বিহান সাওয়ার ছেড়ে আসছেই না।কিছু তো সমস্যা হয়েছেই।ওয়াশ রুমে পানির টুপটাপ সাউন্ড হয়েই যাচ্ছে।প্রায় আড়াই ঘন্টা পরে বিহান কালো গেঞ্জি আর কালো ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এলো টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে।চুল গুলো কপালে পড়েছে দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ভীষণ সুন্দর লাগছে বিহান কে।বিহানের দিকে তাকিয়ে আছি আমি একভাবে।বিহানের চোখ আমার চোখে পড়তেই বিহান বললো,

“এখনো ঘুমোও নি।”

মাথা নাড়িয়ে বললাম,

” না ঘুম আসছে না।”

বিহান আমার পাশে এসে সুয়ে পড়লো।আমাকে টেনে বুকের সাথে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,

” এইবার ঘুমোও সোনা। ”

“আচ্ছা আপনি কি বেবি নিয়ে খুশি নন।”

“সুস্থ হও আগে পরে এসব নিয়ে কথা হবে।”

সাতদিন পরে আমি পুরাপুরি সুস্থ তখন।বিহান একটা টুলে বসে টি-টেবিলে ল্যাপটপ রেখে কিছু একটা করছে।সাত দিনে বিহান কে হাসতে দেখিনি আমি।কি হয়ে গেলো বিহানের।আমি এক কাপ কফি নিয়ে বিহানের দিকে এগিয়ে দিলাম।বিহান কফিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো,

“থ্যাংক ইউ ডিয়ার মিসেস বিহান।”

“বাহ মুড বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে।”

“তুমি সামনে আসলে আমার মুড অলওয়েজ ভেরি গুড হয়ে যায়।”

আমি ল্যাপটপ এর সাটার অফ করে বিহানের কোলে গিয়ে বসে বললাম,

” আচ্ছা তাই তাহলে এখন আর কাজ করতে হবে না।”

“তাহলে কি করবো?”

“বউ কে সময় দিন।গত সাত দিন দেখছি মুড অফ আপনার বাট হুয়াই।আপনার বেবি কিন্তু রাগ করছে তার পাপ্পা তাকে নিয়ে কোনো কথা বলে না কেনো?..”

“প্লিজ দিয়া!”

চিল্লাচিল্লি করে বললাম,

“কি সমস্যা আপনার।যখন ই আমাদের বেবির কথা বলি আপনি চুপ থাকেন কেনো?”

“দিয়া বিকজ আমি বেবি চাইছি না তাই।”

“হোয়াট কি বললেন আপনি বেবি চান না।”

“না চাই না।”

“বাট হুয়াই বিহান হুয়াই।”

“এখন কি তোমার বেবি নেওয়ার টাইম হলো।সামনে তোমার ফাইনাল ইয়ার বাকি।বেবি নিয়ে কিভাবে লেখাপড়া কমপ্লিট করবে।আগে লেখাপড়ার দিকে মন দাও পরে বেবি নিয়ে ভেবো।”

“আর যে এসেছে তাকে কি করবো।”

“নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।”

“ছিঃআমি ভাবতে পারছি না। আপনি এসব বলতে পারেন।আমি ভেবেছিলাম খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন আপনি।”

“দেখো দিয়া লেখাপড়া শেষ হোক তখন এসব নিয়ে ভেবো।”

“কি হবে লেখাপড়া দিয়ে,আমি বড় ডাক্তার হবো।কার জন্য ক্যারিয়ার গড়বো যদি আমার বেবি না থাকে।কি হবে টাকা দিয়ে ক্যারিয়ার দিয়ে।আই নিড বেবি।”

“আমি তো বলছি না আমাদের বেবি হবে না।তোমার লেখাপড়া শেষ হোক আগে।”

“আমার বেবি নিয়েই আমি লেখাপড়া শেষ করবো।”

সেদিন রাগারাগি করলাম খুব।আমার কাছে খুব আশ্চর্যের লাগছে ব্যাপার টা।বিহান তো সব সময় বলতো বেবি নিয়ে তার প্লান।তবে ঠিক সে সব সময় চেয়েছে আমার লেখাপড়া আগে শেষ হোক।কি লুকাচ্ছে বিহান। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না কিছু।

এভাবেই বেশ কয়েকদিন অশান্তি চলছে।বিহান কিছুতেই বেবি রাখতে চাইছে না।বিহানের আজ নাইট ডিউটি বাসায় আসবে না।কলেজের এক ফ্রেন্ড কে ফোন দিয়ে বললাম আমার হাজবেন্ড বেবি রাখতে চাইছে না।ও তো এ ধরনের ছেলেই না। কি করবো বল তো।তাছাড়া ওর এমন করার কারণ কি।

সে আমাকে বললো,

“পুরুষ মানুষের যখন বাইরে রিলেশন থাকে তখন বেবি নিতে রাজি থাকে না।আমার জামাই এমন করেছিলো।আমি জানি তোর জামাই খুব ভালো।তবুও পুরুষ মানুষ চেঞ্জ হতে সময় লাগে না।”

ফ্রেন্ডের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো।তবে আমি জানি বিহান এমন কখনো করবে না।তবে ইদানিং বিহান ঠিক মতো বাড়িতে আসে না সারাক্ষণ ল্যাপটপ এ মন। আসলেই বিহান চেঞ্জ। এই চেঞ্জের কি কারণ।কখনো হাসে ও না।সারাক্ষণ চিন্তিত।সারারাত বাসায় আসে নি।বলেছে ইমারজেঞ্জি ওটি আছে।আমি পরের দিন সকাল ছয়টায় বিহানের জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে গেলাম।সারারাত কিছু খেয়েছে কিনা তার ঠিক নেই।রাত থাকতে উঠে বিহানের ফেভারিট খাবার রান্না করলাম।হসপিটাল এ রওনা হয়ে বিহান কে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তোলে না।বিহানের কেবিনে গিয়ে দরজা নক করতেই ভেতর থেকে বললো কে পরে আসুন বিজি আছি।আমি সিওর বিহান অন্য কেউ ভেবেছে।তাই দরজা জোরে ধাক্কা দিলাম।দরজা খুলেই শকড হয়ে গেলাম আমি।আকাশ পাতাল যেনো এক হয়ে গেলো আমার।প্রেয়সীর হাত ধরে বসে আছে বিহান।সমস্ত শরীর কাঁপছে আমার।খাবারের বক্স নিচে পড়তেই বিহান আমার দিকে তাকালো।বিহান আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘দিয়া তুমি এত সকালে।’

‘চোখের পানি মুছে বললাম,আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।’

বিহান টেবিলে থাবা মেরে বললো,ওহ শীট।

আমি এক দৌড়ে বাসার দিকে রওনা হলাম।বাসায় এসে রুমের সমস্ত জিনিস ছোড়াছুড়ি করছি।রুমের সমস্ত জিনিস ভেঙে গুড়িয়ে ফেললাম।বুকের মাঝে ভেঙে চুরে যাচ্ছে ব্যাথায়।

সাথে সাথেই বিহান চলে এলো বাসায়।আমাকে ফ্লোরে বসে কাঁন্নাকাটি করতে দেখে বিহান হাতের আঙুল মুঠো করে দরজায় জোরে ধাক্কা মেরে বললো,

“ওহ গড!দিয়া প্লিজ কুল।তুমি অসুস্থ। এমন করলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

বিহানের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“ছিঃবিহান তুমি আমাকে এইভাবে ঠকাতে পারলে।”

“নো দিয়া,ভুল বুঝছো তুমি।”

“কিছু বোঝাতে হবে না আপনাকে।এইজন্য বেবি রাখতে চাইছেন না আপনি।আপনাকে আমি এত ভালবাসার পরেও অন্য মেয়ের হাত ধরতে বিবেক এ বাঁধলো না।কি কম আছে আমার মাঝে,আমি কি আপনাকে কম ভালবাসি,নাকি আমি ভালো বউ না। নাকি আপনি আমার সাথে খুশি না।আপনাকে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি আর আপনি কিনা।ছিঃবিহান ছিঃ।”

“এসব কি বলছো তুমি দিয়া।তুমি যা দেখেছো তা ঠিক নয়।আমাকে বলার তো সুযোগ দাও।”

বিহান আমার কাছে আসতেই সেন্স লেস হয়ে গেলাম।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি বিছানায় সুয়ে আছি।বিহান কোথাও নেই আশেপাশে।বিছানা থেকে উঠেই ড্রায়ার থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে নড়াইল রওনা হলাম।বাসে উঠে বিহান কে মেসেজ করলাম।

“আমি নড়াইল আম্মুর কাছে ফিরে যাচ্ছি।আমাকে আমার বেবিকে কাউকে প্রয়োজন নেই আপনার।ডাক্তারি পড়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।ভালো থাকুন আপনি।”

চলবে,,

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা সিজন ২
৭৬.
#WriterঃMousumi_Akter

–হেলে যাওয়া সূর্য, ক্লান্ত আমি, চেহারায় মলিনতা, চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া কাজলের কালি চোখের নিচে নিয়ে সাদা একটা শাড়ির লাল পাড় পরে,এলোমেলো চুল নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে বাসায় প্রবেশ করলাম আমি।কয়েকঘন্টা বাস জার্নি বেশ কয়েকবার বমি ও হয়েছে শরীর যেনো কেমন নুইয়ে পড়ছে।এত ক্লান্ত তো আগে কখনো লাগে না আমার।বাড়িতে প্রবেশ করেই বাড়ির পরিবেশ কেমন যেনো অন্যরকম মনে হলো।আম্মু বাড়ির গেটেই দাঁড়িয়ে আছে এক পলকে।যেনো আমার জন্যই পথ পাহারা দিচ্ছে।আম্মুর থেকে পাঁচ দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।কেমন যেনো থমকে গেলাম।আর যেনো পা চলছে না আমার।আম্মু এক নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।খানিক টা দূর থেকেই ক্লান্ত কন্ঠে ডাকলাম।

“আম্মু”

আম্মু যেনো কিছু বলবে কিন্তু বলতে পারছে না আমাকে এ অবস্থায় দেখে।আম্মুর চোখে পানি চলে এসছে,আম্মুর ঠোঁট কাঁপছে।আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।আম্মুর দিকে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম আম্মু শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে।আমি কাঁন্না ভেজা কন্ঠে উচ্চস্বরে কেঁদে ডাকলাম “আম্মু।”

আম্মু শাড়ির আঁচল মুখে গুজে কাঁন্না আটকানোর চেষ্টা করে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আমি কিছুই বলতে পারছি না আম্মুকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি আর আম্মু আম্মু করছি শুধু।আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে।আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার জন্যই ছুটে এসেছি ঢাকা থেকে।আম্মু কয়েকটা কষ্টের নিঃশ্বাস নিয়ে আধভেজা কন্ঠে বললো,

“শান্ত হও মা।এভাবে কাঁন্নাকাটি তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়।মাথায় যন্ত্রণা বাড়বে।”

কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“তাহলে আমি কি করবো আম্মু।কাঁন্না ছাড়া আমার জীবনে কি অবশিষ্ট আছে।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু।”

“যার পাশে বিহানের মতো ছেলে আছে তার চোখে কি কাঁন্না মানায়।”

“প্লিজ আম্মু বিহানের কথা আর বলোনা।আমার এই কাঁন্নার একমাত্র কারণ বিহান আম্মু।বিহান আমাকে ঠকিয়েছে,ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।”

“এসব তোমার ভুল ভাবনা দিয়া।তুমি হয়তো জানোনা বিহান তোমাকে কত ভালবাসে।শান্ত হও মা।ভেতরে চলো সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“বিহান আমাকে ভালবাসে না আম্মু,কোনদিন ভালবাসে নি।বিহান আমাকে এত কষ্ট দিয়েছে আমি কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবো না।কিন্ত কেনো আম্মু আমার অপরাধ কী?সেই ছোট বেলা থেকে বিহান কে ভালবাসি আমি আর আজ বিহান আমাকে ও চায় না এমন কি আমার সন্তান কেও চায় না।পৃথিবীতে এমন ও খারাপ বাবা আছে আম্মু,যে নিজের সন্তান কে খু*ন করতে চায়।আমার কপাল এত খারাপ কেনো বলতে পারবে আম্মু।আমি কি এতই খারাপ কারো সত্যিকারের ভালবাসা পেলাম নাহ।আমার কপালে সুখ টায় সইলো না।”

“তোমার কি সত্যি মনে হয় বিহান তার সন্তান চাইছে না। এটা যদি বিহান চেয়েও থাকে তাহলে বিহান কতটা কষ্ট পাচ্ছে তুমি ভেবেছো।”

“কি ভাববো আমি।এখানেও আমাকে ভাবতে হবে।প্লিজ আম্মু আর নিজের ভাতিজার পক্ষে কথা বলোনা।এত কিছুর পরেও অন্তত বলো না।আমার আম্মু হবার সুবাদে অন্তত অন্য কারো পক্ষ নিও না।যে তোমার মেয়েকে ঠকিয়ে অন্য মেয়ের কাছে যেতে পারে তুমি তার পক্ষ নিবে।”

“দুনিয়াতে কি এমন মা আছে দিয়া নিজের মেয়ের থেকে অন্য কাউকে বেশী ভালবাসে।তবে আমার মেয়েকে যে সব থেকে বেশী ভালবাসে আমি তাকে ভালবাসি দিয়া। তার সাপোর্ট আমাকে নিতেই হবে।আমার মেয়ের ভালোর জন্য হলেও।”

–আম্মুর কাছ থেকে ছুটে দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমের দিকে গেলাম।দরজার সামনে গিয়ে ভীষণ ভাবে চমকে গেলাম আমি।বিহান এখানে কিভাবে এলো।আমার আগে আমার ই বাড়িতে বিহান।চোখের পানি হঠাত থমকে গেলো আমার।বিহান মামির কোলে মাথা গুজে উচ্চস্বরে কাঁদছে আর বলছে,,

” আমি আর পারছি না আম্মু।আমাকে একটু তোমার কোলে মাথা রেখে কাঁদতে দাও।আমি তোমার সন্তান আমাকে তুমি এতটা ভালবাসো,ফুপ্পি দিয়াকে এতটা ভালবাসে, একজন বাবা হওয়ার সুবাদে আমিও আমার সন্তান কে ঠিক এতটায় ভালবাসি আম্মু।আমার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসার আগের আমি মে*রে ফেলতে চাইছি আমি কতটা নির্দয় আর নিষ্টুর বাবা।কিন্তু আম্মু বিশ্বাস করো এই পৃথিবীতে আমি ভীষণ অসহায় এই মুহুর্তে। আমার হাসি খুশি জীবন টা এলোমেলো হয়ে গেলো আম্মু।দিয়ার কিছু হলে আমার কি হবে। দিয়াকে ছাড়া এক সেকেন্ড ও বাঁচতে পারবো না আমি।দিয়ার শারিরীক কন্ডিশন দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমি ওর হাজবেন্ড একজন ডাক্তার চোখের সামনে দেখছি দিয়ার এই অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমার ভেতরে কি যন্ত্রণা হয়।কত গুলো রাত আমি ঘুমোয় নি,আমার ঘুম আসে না ঠিকভাবে,খাবার খেতে পারিনা সারাক্ষণ দিয়ার হাসিখুশি মুখটা ভেষে ওঠে।সেদিন দিয়াকে র*ক্তাক্ত অবস্হায় সেন্সলেস দেখে আমার কি হচ্ছিলো।দিয়ার মুখে অক্সিজেন চলছিলো পৃথিবীর সব কিছু অন্ধকার লাগছিলো আমার।দিয়ার প্রথম রিপোর্ট দেখলাম দিয়া প্রেগন্যান্ট বিশ্বাস করো আম্মু খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।নিমিষেই এক পশলা হাসি কোথা থেকে জড় হয়েছিলো আমার চোখে মুখে।কিন্তু দিয়ার পরবর্তী রিপোর্ট দেখে চুরমার হয়ে গেলো আমার সব হাসি আনন্দ।আমার সিনিয়র ডাক্তার আমাকে যখন স্পষ্ট জানিয়ে দিলো দিয়ার পক্ষে এখন কোনভাবেই বেবি ক্যারি করা সম্ভব নয়। দিয়ার হার্ট এ বড় প্রব্লেম হয়েছে চার’মাসের মাঝে সার্জারী করাতে হবে।কিন্তু তার আগে দিয়াকে মেডিসিন খাইয়ে সুস্থ করতে হবে।ওর শরীরের কন্ডিশন ভালো নয়।সার্ভাইভ এর চান্স এমনিতেই কম।দিয়া বাঁচবে কিনা তার ই নাকি কোনো গ্যারান্টি নেই আর বেবি থাকলে মোটেও চান্স নেই।তার উপর বেবি থাকলে মা বেবি কেউ বাঁচবে না।দিয়া সুস্থ হলে ফিউচারে আমাদের আবার বেবি হবে কিন্তু দিয়ার কিছু হলে আমার কি হবে।বেবি না হলেও আমি বাঁচতে পারবো কিন্তু দিয়া ছাড়া পারবো না।দিয়া আমাকে আবার ও ভুল বুঝে চলে এসছে।আম্মু সারারাত ডাক্তারদের বোর্ড বসেছিলো দিয়ার সার্জারী নিয়ে।সেই বোর্ডে প্রেয়সী ও ছিলো।প্রেয়সী আমার রুমে এসেছিলো আমাকে সান্তনা দিতে।আমার সেন্স ছিলো না চিন্তায় পাগল ছিলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে ফোন আসে প্রেয়সীর বাবা মারা গিয়েছে আমি প্রেয়সী কে বুঝাচ্ছিলাম।ঠিক তখন ই দিয়া গিয়ে দেখে ভুল বুঝলো।আমি জানি এতে দিয়ার কোনো দোষ নেই।কিন্তু আমি কি করবো আম্মু।আমি আর পারছি না আম্মু।সত্যি আর পারছিনা।পৃথিবীর যে কোনো কিছুর বিনিময়ে যদি আমার স্ত্রী সন্তান আমি রক্ষা করতে পারতাম তাহলে আমি সেটাই করতাম আম্মু।আমার জীবন দিয়ে হলেও করতাম।আমি এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।আমার দিয়াকে চাই আমার পাশে।”

বিহান আমাকে না দেখলেও মামি আমাকে দেখেছে।মামি চোখের পানি মুছে বললো,

“শান্ত হও বাবা।আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হবে।দিয়া এসছে।”

বিহান আমার দিকে ঝড়ের গতিতে তাকালো।আমি কেঁদেই যাচ্ছি।এত কিছু বিহান টা সহ্য করছে অথচ আমি জানি না।আমাকে কিছু বললোই না।আবার ও ভুল বোঝার অপরাধে কষ্ট পাচ্ছি আমি।আমার মরে যাওয়ায় ভালো বিহানের মতো হাজবেন্ড পেয়েও ভুল বুঝি বারবার।

মামি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“আমার পাগলি টা।কি অবস্থা তোর।নিজের চেহারার কি অবস্থা করেছিস।”

বাবা পাশেই ছিলো।বাবার ও হার্টে প্রব্লেম।বাবার চোখে ও পানি।পরিবারে যেনো অন্ধকার নেমে এলো আমার অসুস্থতায়।আম্মু বাবা কাকু কাকিদের কারো মনে শান্তি নেই।সন্ধ্যায় সুয়ে আছি বিছানায়।ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, কিচ্ছু হবে না তোর দিয়া।আমার বোন স্ট্রং মেয়ে, সব ঠিক হয়ে যাবে।ভাইয়া চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো।মেহু আপু আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলছে জানিস দিয়া তোর মেসেজ পেয়ে বিহান ভাই এয়ার টিকিট করে এক ঘন্টার মাঝে যশোর এসে নেমেছিলো।তোর ভাইয়া বাইকে করে এগিয়ে নিয়ে এসছে।বিহান ভাই কে জীবনে এতটা অসহায় কখনো দেখি নি।বিহান ভাই কে না দেখলে জীবনে বুঝতাম না হয়তো একটা ছেলের ভালবাসা কত গভীর হতে পারে।বিহান ভাই তার অনাগত সন্তানের জন্য ভীষন কষ্ট পাচ্ছে।বিহান ভাই কে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে।

আপুকে বললাম,” উনি কোথায় আপু।”

“উঠানে আছে সবার সাথে কথা বলছে।”

“একটু পাঠিয়ে দিবে প্লিজ।”

“আচ্ছা যাচ্ছি।”

দু’মিনিটের মাঝে বিহান রুমে প্রবেশ করলো।বিহান এসে বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে।আমাকে দেখেই বললো,

“কি ব্যাপার দিয়ার কি রাগ কমেছে।”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বিহানের দিকে।একটা মানুষ কিভাবে নিজের কষ্ট হাইড করতে পারে।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো,

“ওভাবে যে চলে এলে, কি সিদ্ধান্ত নিলে আমার সাথে আর থাকবে না।”

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কেঁদে দিয়ে বিহান কে জড়িয়ে ধরে বললাম,

“আমি মরতে চাই না।আপনার সাথে আরো কয়েকযুগ বেঁচে থাকতে চাই।আপনার মতো মানুষের সাথে আরো কয়েক টা যুগ বেঁচে থাকতে চাই আমি।”

“হোয়াট ননসেন্স,তুমি মরে যাবে মানে।”

“আপনি প্লিজ আর অভিনয় করবেন না।আমি সব জানি।কেনো লুকালেন এত কিছু।আপনাকে ভুল বোঝার অপরাধে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”

বিহান আমাকে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“আই লাভ ইউ দিয়া।তোমার কিছুই হবেনা।আমি তোমার কিছুই হতে দিবো না।দিয়া আমাদের সন্তান আমি ভীষণ ভালবাসি,আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।আমার কিছুই করার নেই।”

“আমি মরে গেলে যাবো তবুও আমাদের সন্তান কে বাঁচাবো।আমার কিছু হলে আপনি একা হয়ে যাবেন।আমাদের বেবি থাকলে আমাকে ভুলে থাকতে পারবেন।”

“স্টপ দিয়া প্লিজ!তুমি না বাঁচলে তো আমিও বাঁচবো না।আমাদের সন্তান কি মা বাবা ছাড়া বাঁচবে।”

বিহানের এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম পাগল টা আমায় ছাড়া থাকতেই পারবে না।

দিন যাচ্ছে,সময় এগোচ্ছে আমার অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে।আমার জিদের জন্য বাচ্চা কিছুই করলাম না।আমি জানি এক মা পারে তার সন্তান এর জন্য সব যুদ্ধ করতে।আর জন্ম,মৃত্যু উপরওয়ালার হাতেই।

কেটে গেলো সাত মাস,হাত পা ফুলে গিয়েছে আমার।প্রেগ্ন্যাসির সাড়ে আটমাস চলে আমার।প্রায় এক সপ্তাহ আমি অসুস্থ। হঠাত পেটে ভীষণ পেইন শুরু হওয়ায় বিহান আর বিভোর ভাই আমাকে হসপিটাল নিয়ে গেলো।নড়াইল থেকে আম্মু-বাবা,আয়রা,কাকিমনি,মামা -মামি,ভাইয়া-ভাবি চলে এসছে আমার অসুস্থতার খবর শুনে।আজ দীর্ঘদিন পরে কাকুর সাথে রিয়ার দেখা।কাকু বারবার রিয়ার দিকে তাকাচ্ছে ছল ছল চোখে।আমাকে ঘিরে যেখানে সবাই চিন্তা করছে আমি সেখানে রিল্যাক্স এ সুয়ে আছি হসপিটালের বেডে।আমার চারদিকে এত ভালবাসার মানুষ সেখানে আনন্দের শেষ নেই আমার।সবাই চিন্তিত তবে বিহান বেশী চিন্তিত।আমার সার্জারী আজ বিহান ই করবে।বিহান এই প্রথম কোনো সার্জারী করতে ভয় পাচ্ছে।কিন্তু আমি জানি বিহান সাকসেসফুল হবেই।

চলবে,,