অনুভবে তুই পর্ব-০৭

0
522

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

সেদিন রাত নয়টার দিকে একটি ফোন আসে আদ্রিশের। খুব জরুরি একটা কাজে ওকে এখনি কোথাও যেতে হবে। আদ্রিশ এটা মোটেও আশা করে নি। বিরক্ত হয়ে সেই কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। সবার মন খানিকটা খারাপ হলেও রোজা মনে মনে স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে, রাত বারোটায় একলা ছাদে ওঠে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করতে হবে না। অন্তত এই লোকটার কাছে। মনে মনে আদ্রিশের গোষ্ঠী উদ্ধার করা শেষ করে ঘরে এসে খোশমেজাজে বই নিয়ে বসলো রোজা। ড্রইংরুম থেকে আসার সময় নিশিতাকে বলে এককাপ চা-ও বানিয়ে নিয়ে এসেছে। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গভীরভাবে মন দিলো বইয়ের পাতায়। নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারে ঢাকা প্রকৃতি। ফুরফুরে বাতাস জানালা দিয়ে বইছিল, পর্দাগুলো ওড়ছিল নৌকার পালের মতো। তখনি দরজায় খট করে শব্দ হলো। নেহা-ফিহা দু’বোন একসাথেই ঘরে ঢুকলো। ইশা নিচতলায় মিতালি-নিশিতার সাথে বসে কথা বলছে, তাই সে আসেনি। নেহা ঘরে ঢুকেই সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে। হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে তোয়ালেটা এমনভাবে ছুড়ে মারলো যে, সেটা রোজার চায়ের কাপের ওপর পড়ল। কিছুটা চা ছলকে পড়ল রোজার ডানহাতে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে কী ঘটে গেল ঠাহর করতে পারল না রোজা৷ হাতে জ্বলুনি অনুভূত হতেই মৃদু আওয়াজ করল। নেহা ততক্ষণে দৌড়ে এলো ওর কাছে। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ইশ, কতখানি পড়েছে। আমি খেয়াল করি নি। স্যরি রে রোজা। ওফফ কি যে করি না আমি!’

রোজা চোখ বন্ধ করে জবাবে বলল, ‘আরে থাক না আপু।’

‘কী বলিস তুই? খুব বেশি জ্বলছে? জায়গাটা লাল হয়ে গেছে।’

‘না বেশি না।’

রোজার কথায় বিরক্ত হলো নেহা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর হাত লাল হয়ে আছে, আর মেয়েটা কি সুন্দর করে বলছে কিছু হয় নি। নেহা ওকে টেনে ধরে রাগী স্বরে বলল, ‘ওঠ এক্ষুনি। পোড়া হাত নিয়ে আবার বসে আছিস? আয় পানি দিয়ে দিই।’

ফিহা বলল, ‘আমি বরফ নিয়ে আসছি। টুথপেস্ট আনবো?’

‘সেটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? যা নিয়ে আয়।’

‘যাচ্ছি।’

ফিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নেহা রোজাকে ধরে নিয়ে নিয়ে গেল করিডোরের বেসিনের সামনে। ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে রোজার হাতটা পানিতে ভেজালো। পানি লাগতেই জ্বলুনিটা যেন আরও বেড়ে গেল। রোজা চোখমুখ খিঁচে হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘জ্বলছে খুব। আর দেব না পানি।’

নেহা চোখ গরম করে তাকালো, ‘বেশি বকিস তুই। চুপচাপ পানির নিচে হাতটা দিয়ে রাখবি। নয়তো এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দেব।’

‘আপুওও..’

‘চুপ একদম।’

নেহা রোজাকে আর একটাও কথা বলতে দিল না। অনেকক্ষণ ধরে বরফপানিতে হাত ডুবিয়ে রাখার পর জ্বলুনি ভাবটা কমলো৷ ফিহা একটা মলম লাগিয়ে দিলো রোজার হাতের পোড়া অংশটুকুতে। ঘন্টা কয়েকের মাঝেই জ্বলুনি কমে আগের মতোই হয়ে গেল। এর মধ্যে এই খবর শুনে মিতালি, নিশিতা, ইশা এসে রোজাকে দেখে গেল। আর যাবার সময় নেহাকে সঙ্গে করে কিছু একটা দেখাতে নিয়ে গেল ইশা। সবাই চলে যাওয়ার পর ঘরে রইল ফিহা, রোজা। ফিহা ফোন স্ক্রল করায় ব্যস্ত। রোজা বইয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে আলসে ভঙ্গিতে বসে রইল। এত শীতল আবহাওয়ার মাঝেও হঠাৎ করে ওর খুব গরম লাগছিল। বিছানা থেকে নামতেই ফিহা চোখ পাকিয়ে তাকালো। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘হাতমুখ ধুয়ে আসি। চোখমুখ কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।’

‘হাতের ব্যথাটা কমেছে?’

‘হুম। এখন ঠিক আছে।’

‘সাবধানে যা৷ হাতে পানি লাগাস না।’

‘আচ্ছা।’

রোজা ঠিকই চোখেমুখে পানি ছিঁটানোর উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে গেল। কিন্তু কখন যে আনমনে শাওয়ারের প্যাঁচটা খুলে দিল বুঝতেই পারে নি। যার ফলে বরফ শীতল ঠান্ডা পানি এসে পড়লো এসে ভিজিয়ে দিলো ওকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল জামাকাপড়। রাগে, বিরক্তিতে মাথা গরম হয়ে গেল। নিজেকে নিজেই কথা শোনালো, ‘কেন যে এতোটা বেখায়লি, সবাই ঠিকই বলে। আমি কোনো কাজের নই, অকর্মার ঢেঁকি। ভীতুর ডিম!’

জামাকাপড় ভিজে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ফিহাকে ডাকল রোজা। ওর গলা শুনে ফিহা উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’

রোজা নরম সুরে বলল, ‘কখন জানি ভিজে গেছি আপু। ব্যাগে আমার জামাকাপড় গুলো আছে। সেগুলো কষ্ট করে একটু দিয়ে যাও।’

ফিহা অবাক গলায় বলল, ‘কখন যেন ভিজে গেছি মানে? ওয়াশরুমে কী বৃষ্টি হয়েছে না-কি তুই স্বপ্ন দেখছিস? নিজের গায়ে পানি পড়লো আর তুই বুঝতেই পারলি না?’

‘না আপু। সম্ভবত শাওয়ারের প্যাঁচটা ঘুরে গিয়েছিল।’

‘আর তুই বুঝতেই পারিস নি?’

‘নাহ।’

‘রোজা? তুই আসলে কী দিয়ে তৈরি? এত রাতে গোসল করলি যে, ঠান্ডা লাগবে না? পাগল তুই?’

‘লাগবে না৷ কাপড়গুলো দিয়ে যাও না আপু।’

ফিহা রোজার ব্যাগ থেকে ওর সালোয়ারকামিজ বের করে ওয়াশরুমের দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। রোজাকে বলল, ‘তোর জামাকাপড় তুই নিজেই নে। আমি পারবো না।’

রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘প্লিজ আপু। আমার ঠান্ডা লাগছে।’

ফিহা মিথ্যে বলল, ‘আমি খাচ্ছি। হাত খালি না, এঁটো লেগে আছে।’

‘ধুয়ে দাও না।’

ফিহা কিছু একটা ভেবে বলল, ‘একটুও শান্তিতে বসতে দিবি না তুই৷ দিচ্ছি, তবে একটা কন্ডিশন আছে।’

রোজা ধৈর্যহীন গলায় বলল, ‘আবার কীসের কন্ডিশন?’

ফিহা ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল৷ পরক্ষণেই চোখমুখ কঠিন করে শক্ত গলায় বলল, ‘তোকে আমার ভাইয়ের বউ হতে হবে। আমি তোকে ‘ভাবি, ভাবি’ বলে ডাকবো। রাজি তুই? হবি তো?’

রোজা পূর্ণকথাটা ভালো করে শুনলো না৷ অলস কন্ঠে সে বলল, ‘হ্যাঁ হবো। রাজি আমি। এখন প্লিজ আমার জামাকাপড় দাও। নয়তো ঠান্ডায় জমে মরে যাব।’

ফিহা আনমনে বলল, ‘তুই আমার ভাইয়ের একমাত্র বউ। ঠান্ডায় জমে মরে গেলে ভাই তার চক্ষু দিয়েই আমার গিলে ফেলবে।’

তারপর জোরালো গলায় বলল, ‘নে কাপড় এনেছি।’

রোজা দরজা খানিকটা ফাঁক করে কাপড়গুলো নিয়ে নিলো। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওদিকে রোজার বোকামো, অবুঝ কথাবার্তায় বেশ ভালোই মজা পেয়েছে ফিহা। নিঃশব্দে হাসতে হাসতে একপর্যায়ে সেটা আর আটকাতে পারল না। ঘর কাঁপিয়ে হাসার একটা সময়ে সে আবিষ্কার করলো আদ্রিশ চোখ পাকিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর পেছনেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে নেহা আর ইশা ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তাঁদের বক্র হাসি। ফিহা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওরা আবার ওর কথাটথা শুনে ফেলেনি তো? অপ্রস্তুত হেসে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে ভাইয়া তুমি? কখন এলে? তুমি না কোথায় গিয়েছিলে?’

আদ্রিশ ওর কথা না শোনার ভান করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এরকম করছিলি কেন? মনে খুব ফুর্তি লেগেছে? তোর না সামনে এক্সাম?’

ফিহা চোখ রাঙিয়ে তাকালো নেহা-ইশার দিকে। দু’জন মিটিমিটি হাসছে। আদ্রিশের কথা শুনে ফিহা চট করে বলে ফেলল, ‘এক্সামের প্রিপারেশন অলরেডি ডান।’

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো, ‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

আদ্রিশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘গ্রেট। বাই দ্যা ওয়ে, তোর সেই ভীতুর ডিম বোনটি কই রে? সে নাকি হাত-পা পুড়িয়ে বসে আছে? এটা বিবেচনা করেই তো ওকে রান্নার ডেয়ার থেকে নিষ্কৃতি দিলাম। যেই লাউ সেই কদুই? এতটা কেয়ারলেস কেন এই মেয়ে? আমাদের বাড়ির নামে নিন্দেমন্দ করার জন্য ইচ্ছা করেই ও এমন করে। আমি ওকে… ‘

আদ্রিশ কথাটুকু শেষ করতে পারলো না। তার আগেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। একহাতে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো রোজা। নেহা-ফিহা-ইশা, আদ্রিশ সবাই একসাথে ওর দিকে তাকালো। ইশা একগাল হেসে চোখ টিপে ফিহাকে কিছু একটা বুঝালো। নেহা সেটা দেখলেও তেমন মাথা ঘামালো না।
অপরদিকে, সাদামাটা জামায় আবৃত রোজাকে দেখে আবিষ্ট হয়ে চেয়ে রইল আদ্রিশ। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখের গড়নে মোহায়িত হলো সে। রোজা ওকে দেখতে পেয়েই থমকে গেল। এই লোকটা এখানে কীভাবে আসলো? ওর না ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে? বাড়িতেই ফিরলো কখন? এখন কী ওকে সাহসীকতার ডেয়ার পূরণ করতে বলবে? রোজা বোকার মতো ওর বোনেদের দিকে দেখল। পরক্ষণেই নিজ হাতে টান অনুভব করলো। শক্তপোক্ত একটি হাত ওর কবজি এমনভাবে ধরেছে যে ব্যথায় একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো গালে। আদ্রিশ ওর জ্বলে যাওয়া হাতটার দিকে রক্তচক্ষু মেলে দেখছে। তারপর কঠিন গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘এটা কী করে হলো?’

রোজা নম্রভাবেই উত্তর দিল, ‘চা- পড়ে এমন হয়েছে।’

‘তুমি কী আমাদের নাম ডুবাতে এসেছ?’

‘না।’

‘তাহলে দেখেশুনে, সংযত হয়ে চলাফেরা করতে পারো না?’

রোজা বলল, ‘এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট।’

কথাটি আদ্রিশের কর্ণগোচর হতেই রাগে আরও কঠোরভাবে রোজার হাতটি চেপে ধরলো সে। ব্যথাটা আরও গাঢ় হতেই রোজার ধৈর্য সীমা ছাড়িয়ে গেল। শান্ত অথচ তীব্র গলায় সে বলল, ‘হাতটা ছাড়ুন, ব্যথা পাচ্ছি।’

আদ্রিশ গমগমে স্বরে বলল, ‘ছাড়বো না।’

চলবে…