#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩১
রজনীর আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। চারপাশে বইছে হিমেল হাওয়া। বাড়ির বাগান থেকে আসছে ফুলের মৃদু সুবাস। রোজা আকাশের দিক হতে নজর সরিয়ে ধ্যান দিলো মনের গহীনে, কিছু উন্মত্ত ভাবনায়। মাঝেমধ্যে যাবতীয় নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু উদ্ভট ভাবনা ওর মস্তিষ্কে জেঁকে বসে। ভিন্নরকম ইচ্ছা-অনিচ্ছা জেগে ওঠলেও সেগুলো আর পূরণ করা হয়ে ওঠে না। ওর ঘোলাটে দৃষ্টি আঁধার ঢাকা অন্তরিক্ষে। রাতের আকাশের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ফুটিফুটি তারা। বাইরে পক্ষীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে মাত্র। চিন্তা, অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে রোজার চোখ কখন যে লেগে এসেছিল বুঝতেই পারে নি৷ দরজায় টোকা পড়তেই ও সচকিত হলো। ঘুমের রেশ থেকে যাওয়ার চোখমুখ ফুলে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চেঞ্জ করে নিয়েছে সেই কখন! এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা বেঁধে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললো রোজা। ঘরে ঢুকলো ফিহা আর ইশা। ওদের দু’জনকে দেখেই লিভিংরুমের ঘটনার কথা মনে হলো ওর। ফিহাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই ও ফ্রেশ হতে চলে গেলো। আর ইশা ড্রয়ার থেকে ওর জামাকাপড় বের করছিলো চেঞ্জ করার জন্য। দুরুদুরু মন নিয়ে রোজা ইশার কাছে গিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। ইশা মুহূর্তেই ওর ভাবগতিক বুঝতে পারে। ঠোঁটে হাসি এঁকে বলে, ‘মনে হয় খুব শ্রীঘ্রই আরেকটা বিয়ে খেতে যাচ্ছি।’
বিস্ময়ে রোজার মুখ ‘হা’ হয়ে গেলো। এর মানে একটাই, বাবা-মা সবটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এত সহজে? যেখানে সুলতানা কোনোক্রমেই আত্মীয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না সেখানে কিভাবে এত সহজে রাজি? ও হতবিহ্বল হয়ে গেলেও আর কোনো প্রশ্ন করলো না ইশাকে। সবাই ভালোয় ভালোয় মেনে নিলেও রোজার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো। সুলতানা এ নিয়ে ওর সঙ্গে হালকাপাতলা আলাপও সেরে নিলো কিন্তু অবান্তর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সেদিন রাত সাড়ে এগারোটায় ডিনারে বসলো বাড়ির সকলে। ডাইনিংয়ে খেতে বসেও রোজা অস্বস্তিতে ভুগছিলো। তবে আদ্রিশ আসে নি খেতে, ও তখন নিজের ঘরে ঘুমিয়েছিলো। রাতের খাবারদাবার সারার পরে ক্লান্ত সবাই যখন ঘুমাতে গেল তখন রোজা ফিহার কাছে গেলো একরাশ দ্বিধা নিয়ে। আদ্রিশের অসুস্থতার কথাটা তখনই ফিহা জানতে পারলো। ও উদ্বিগ্ন হয়ে জানালো, আদ্রিশ রাতে কিছুই খায় নি। আর বাড়ির কেউ জানেও না আদ্রিশের জ্বর হয়েছে। অগত্যা ফিহা রোজাকে বলল, ‘তুই কি আগে থেকেই জানতিস ভাইয়ার জ্বর?’
রোজা নিচু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ। সকালেই জেনেছিলাম। কিন্তু ওনি কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।’
ফিহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাধ্য বরের বাধ্য বউ। ভাইয়া বলুক আর না বলুক, তোর তো উচিৎ ছিল বিষয়টা কাউকে জানানো। এটলিস্ট উৎস ভাইকে? এখন গিয়ে দেখ, মরার মতো পরে আছে। ঔষধ নিয়েছে কিনা কে জানে! তুই যে কি করিস না!’
বলেই গটগটিয়ে হেঁটে সামনে পা বাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে রোজাও এলো। ব্যগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কি করবে আপু?’
ফিহা চিন্তিত স্বরে বলল, ‘কি আর করবো? গিয়ে দেখি তোর হবু বর মহাশয় কি করছে। ঘুম ভাঙলো কি-না কে জানে৷ বাই দ্যা ওয়ে, তুই প্লেটে করে খাবার নিয়ে আয়। কিছু একটা পেটে দিয়ে ঔষধটা তো নিতে হবে তাইনা?’
‘তাও বটে। আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি।’
ফিহা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এনে দিচ্ছি মানে? তুই ভাইয়ার ঘরে নিয়ে আয়।’
রোজা শুকনো কন্ঠে বলল, ‘না। আমি ওনার ঘরে যাবো না।’
‘কেন?’
রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘ওনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে মাত্র। আমি ওনার বউ হইনি এখনো। ওই ঘরে যাওয়ার অধিকার এখনো আমার হয়নি, যার ফলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখাবে। সকালে তো না পারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার যতটুকু করা প্রয়োজন ততটুকুই করবো ফিহা আপু।’
ফিহা হতাশ হয়ে বলল, ‘তোর যা অভিমত। কিন্তু খাবারটা এনে দে। আমিই নিয়ে যাই।’
রোজা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘অবশ্যই।’
বলেই তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে এলো রোজা। আর ফিহা গেলো উৎসের ঘরে ঔষধ আনার জন্য। যেহেতু সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কাউকে আর ডাকলো না রোজা। ফ্রিজ থেকে কিছু তরকারি নামিয়ে গরম করে নিলো। ভাত খুব বেশি ঠান্ডা ছিলো না। প্লেটে করে খাবার নিয়ে আদ্রিশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো ফিহার জন্য। আচমকা কৌতূহলবশত পর্দাটা অল্প একটু সরিয়ে আদ্রিশের ঘরে উঁকি দিতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আদ্রিশ খালি গায়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আর ওর আধখোলা দৃষ্টিজোড়া ঠিক রোজার মুখেই নিবদ্ধ। একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে রোজার মুখপানে। ভুল দেখছে ভেবে রোজা চোখ কচলে আবারও তাকালো। কিন্তু বাস্তবেই যে আদ্রিশ পর্দার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখছে বুঝতে পারলো তখনই। অস্বস্তিতে মিইয়ে গেল ও। ওর হতবিহ্বল অবস্থা অবলোকন করেই আদ্রিশ দুর্বল অথচ শান্ত স্বরে বলল, ‘যেটা আমার সেটা শুধুই আমার, যদি একটুও অন্য কারো হয় সেটা আমার দরকার নেই। কিন্তু আমি কারোর ভাগ কেড়ে নিই না এবং আমার ভাগের জিনিস কাউকে কেড়ে নিতে দিইও না।’
কথাটুকু শ্রবণ করা মাত্রই রোজা ঝট করে পর্দা ফেলে দিলো। ফলে দু’জনের কেউই আর কাউকে দেখতে পেলো না। ফিহা এসে পড়লো মিনিট খানিকের মধ্যেই, সঙ্গে উৎসও আছে। খাবারের থালা আর ঔষধের বক্সটা হাতে নিয়ে ফিহা-উৎস আদ্রিশের ঘরে ঢুকতেই রোজা হাফ ছাড়লো। অতঃপর বড় বড় পা ফেলে নেহার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ওর বা-পাশে ইশা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। রোজা অন্যপাশে শুয়ে আনমনে খানিকক্ষণ আগের ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে। অস্বস্তি ও লজ্জার সংমিশ্রণের সাথে ওর মনের কোণে বারবার আরও একটি প্রশ্ন জাগ্রত হচ্ছে। আদ্রিশ আর ওর এক হওয়ার মাঝে তো আর কোনো বাঁধা নেই। তাহলে কেন একটু আগে সে এই কথাটি বললো? সেটা কি শুধুই কথার কথা? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো ব্যাপার? অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের কোনো কূল-কিনারা খুঁজে না পেয়ে চিন্তা করা বাদ দিলো রোজা। অতঃপর একরাশ সুখ, ভালোলাগা, নতুন কিছু স্বপ্ন আর মনের কোণে জেগে ওঠা কিছু সুপ্ত প্রশ্ন নিয়ে একসময় নিদ্রাগত হলো সে। আচ্ছা, পৃথিবী কি জানে, রোজা তাঁর আদ্রিশকে কতটা ভালোবাসে?
—————————————————————————
একটা সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেলো। এর মধ্যে নেহার বৌ-ভাতের আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছে। বাড়িতে এসে বেড়িয়েও গেছে নেহা-রিজভী আর ওর বোন ইমা। নেহা তো বিয়ের মতো চমকপ্রদ ব্যাপারটা শুনে খুবই পুলকিত হলো। ওর ভাইয়ের কান্ডকারখানা শুনে আর রোজার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে বিমোহিত। কিন্তু এই ক’টা দিন রোজা যে কতটা অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছে সেটা শুধু সে-ই জানে। জ্বর থেকে সুস্থ হবার পর আদ্রিশের ব্যবহার যেন আরও পালটে গেলো। ইতোমধ্যে আজিজুর সাহেব তো খুবই পছন্দ করে ফেলেছে ওকে। সুলতানাও একটু গলে গেছে। সচরাচর রোজাকে একটু স্পেসে পায় না আদ্রিশ। সারাক্ষণ কেউ না কেউ ওর সঙ্গেই আছে। মনমতো দুটো কথা বলারও সুযোগ পায় না সে। সেদিন এক গোধূলি সন্ধ্যা। বাড়ির সকলে মিলে আড্ডা বসিয়েছে ছাদের কোণের ঘরটিতে। বসে থাকতে থাকতে পা ঝিমঝিম করছিলো বলে রোজা একটু ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলো। আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরে বাড়ি সুনশান দেখে একগ্লাস পানি নিজেই নিয়ে খেলো। এরপর সোজা ছাদে চলে এলো। রোজাকে আনমনে পায়চারি করতে দেখে ও এগিয়ে গেলো। হঠাৎ সামনে আসায় রোজা একটু হকচকিয়ে যায়। নিজেকে ধাতস্থ করতে না করতেই আদ্রিশ ওর হাত টেনে চুমু খেয়ে বলে, ‘এই হাতদুটো আমার। আমি ছাড়া কাউকে ছুঁতে দেবে না কখনো।’
রোজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘বললেই হলো? আমার হাত আমি কাকে ধরতে দেব না দেব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।’
আদ্রিশ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আগে তো চুপচাপ ছিলে। এখন মুখে এত খই ফুটে কেন তোমার? সব কথায় অহেতুক রিয়েক্ট করো। দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। আর তাও না হলে, মেনে নিলাম। আদ্রিশের বউ তাঁর সাথে এক-আধটু বেয়াদবি করতেই পারে। কিন্তু একবার ভুল করেও তো ‘ভালোবাসি’ বলতেই পারো, কেন সেটা ভুল করেও উচ্চারণ করো না?’
রোজা শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনার সমস্যা কী হ্যাঁ? আমি যে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি এতে কি আপনি সন্তুষ্ট নন? যে ভালোবাসি শুনতে চাচ্ছেন? এসব ব্যাপার মনে ঘটে, মুখে নয়; যে সারাদিন ন্যাকামু করে ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ বলে আপনার থেকে ফেভার পাওয়ার আশায় থাকবো। আমি ও ধরনের মেয়ে নই।’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘আমি জানি তুমি এধরণের মেয়ে নও। তুমি শুধু এই একটাই, আর এই একটার মালিক শুধু আমি। সেজন্যই তোমাকে আমার কলিজার ভেতরে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। যদি কেউ হাত বাড়িতে তোমার হাত ধরতে আসে তাহলে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে ফেলতে কিন্তু দু’বার ভাববো না।’
রোজা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে?’
আদ্রিশ চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘ভালোবাসি বলতে হবে না। কিন্তু তুমি শুধু আমার দিকেই তাকাবে, আমাকেই ভালোবাসবে।’
রোজা নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘এর মানে কী? আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি অন্য কারো দিকে তাকাবো?’
আদ্রিশ ক্রোধিত স্বরে উত্তর দেয়, ‘তুমি হয়তো তাকাবে না। কিন্তু অনেকেই তোমার দিকে তাকাবে। তাই যথাসম্ভব নিজেকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করবে।’
রোজা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আমার জানামতে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু আপনি বারবার অহেতুক একটা বিষয়ে ইঙ্গিত করছেন কেন? রোজা নিজেকে নিজে প্রটেক্ট করতে জানে।’
আদ্রিশ বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, ‘তারপরেও তুমি একজন মেয়ে।’
রোজা ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘মেয়ে বলে কি আমরা দুর্বল? এমন মনে হয় আপনার?’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে বলল, ‘অনেকক্ষেত্রেই মেয়েরা যেমন পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে আছে, তেমনি অনেকদিক থেকেই তাঁরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে আছে। এই দিকটা একটু চিন্তা করলেই তুমি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
রোজা হতাশ হয়ে বলল, ‘আপনি হয়তো কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত। তাই এরকম বলছেন। আমাকে কি বিষয়টা বলা যায়?’
আদ্রিশ ওর নাক টেনে দিয়ে বলল, ‘তোমাকে বলে অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি ঝামেলা বাঁধানো মেয়ে।’
রোজা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তাহলে বিয়ে করতে চান কেন আমাকে?’
‘ভালোবাসি বলে।’
‘কেন?’
আদ্রিশ উত্তর না দিয়ে নিরব রইলো। রোজাকে সে কেন ভালোবাসে এটা সে নিজেই জানে না তো উত্তর দেবে কি! আর ভালোবাসায় সবসময় কারণ খুঁজতে হয় না। আদ্রিশ অফিসের স্যুট’টা খুলে হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নেমে গেলো। রোজা ওর যাওয়ার পানে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো।
——————————————-
চলবে…
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২
আদ্রিশ যে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত এটা রোজা বুঝতে পারলেও ওর কিছু করার ছিলো না। কারণ লোকটা কাউকেই কিছু বলে না। যা ভাবার, যা করার, নিজে থেকেই সেসব করে নেয়। সেজন্য বিষয়টা নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করা নিজের মস্তিষ্ককে সামলালো সে। এদিকে দুই পরিবারের সবাই যেহেতু রাজি সেজন্য খুব শ্রীঘ্রই বিয়ের দিনক্ষণ পাকাপোক্ত করা হলো। অবশ্য বাড়ির লোকজন সবাই সেটাই চেয়েছিল। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে, তাও আবার সবার পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে। এর থেকে আনন্দ আর খুশির কি হতে পারে! কিছুদিনের মধ্যে রোজার ভার্সিটির ক্লাসও শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়ের যেহেতু কয়েকদিন পরেই বিয়ে, সেজন্য সুলতানা স্বামীর সাথে কথা বলে ঠিক করলেন তারা রোজাকে নিয়ে গ্রামেই ফিরে যাবেন। বিয়ে পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। রোজার নিজ বাড়িতেই বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করা হবে। বাস্তবতা বুঝতে পেরে রোজারও সেটাই ঠিক বলে বোধগম্য হলো। কিন্তু বাদ সাধলো আদ্রিশ। বিয়ের যেহেতু দিন পনেরো বাকি, তো সবকিছু এখানে থেকেই করা যায়। ঝামেলাও কম হবে। কিন্তু আজিজুর সাহেব রাজি হলেন না। তিনি গ্রামের চেয়ারম্যান। আর তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে কি-না এখানে থেকে দেবেন? এটা কিছুতেই মানার মতো নয়। ধুমধাম আয়োজন করে তিনি মেয়েকে আদ্রিশের হাতে তুলে দেবেন। এখানে মেয়ের পরিবারেরও নিজস্ব চিন্তা-ইচ্ছা-স্বপ্ন আছে; সেটা ভেবেই ইনায়েত সাহেব আদ্রিশকে বোঝালেন। অগত্যা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে আদ্রিশ বিষয়টা মেনে নিলো। কিন্তু সে মোটেও রোজাকে দূরে করতে চায় নি। রোজ সকালে রোজাকে দেখেই ওর দিন শুরু হওয়াটা আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে সারাটাদিন কেমন অদ্ভুত অস্থির লাগে ওর। কিন্তু রোজাকে সে আজীবনের জন্য নিজের করে পাবে, এজন্য কিছুটা কষ্ট তো পোহাতেই হবে। এইসব বলে নিজেকে বুঝ দিলো আদ্রিশ।
কাল ভোরের ট্রেনে রোজারা গ্রামে চলে যাবে। টিকিট টাকাও ইতোমধ্যে শেষ। আদ্রিশ এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরে খবরটা শুনেই ওর মেজাজ তরতর করে বেড়ে গেলো। এত শ্রীঘ্রই যে রোজারা চলে যাবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি সে। ঠিকঠাক করে কফিটাও খেতে পারলো না। রাতের খাবারের সময় মনের কোণে সুপ্ত একটা ইচ্ছে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে রোজার পাশের চেয়ারে ইশাকে দেখেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো ওর। কেউ কি জানে না, এখন রোজার আশেপাশে থাকা, একটুখানি সময় কাটানোর ইচ্ছে আদ্রিশের থাকতে পারে? এটা তো ওর মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সবাই কি মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো ভুলে গেল? হয়েছেটা কি সবার?
আদ্রিশের চেহারায় গৌড়বর্ণের মেঘ যেন খেলাধুলা করতে লাগলো। ইশা পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে আচমকা ওর দিকে চোখ পড়লো। ভাইয়ের মনোভাব চট করেই বুঝতে পারলো ইশা। কেউ ওদের লক্ষ্য করছে না দেখে ইশা বোকা বোকা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে অতি নিচু স্বরে বলল, ‘এ–এখানে বসবে নাকি? আমি কি পাশের চেয়ারটাতে চলে যাব? হুম? তুমি কী রেগে আছ ভাইয়া?’
আদ্রিশ নিচু স্বরে কিন্তু কর্কশ গলায় উত্তর দিল, ‘ইচ্ছে করছে খাবারের টেবিলটাই উল্টিয়ে দিই। বুঝতে পারছিস?’
ইশা হাসি বন্ধ করে বলল, ‘ওকে ওকে। আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। এক্ষুণি ওঠে যাচ্ছি। টেইক ইউর টাইম।’
বলেই ইশা সেখান থেকে ওঠে গেলো। এসব কথা রোজার কর্ণগোচর হতেই ও অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। আদ্রিশ থমথমে চেহারা নিয়ে ওর পাশে বসতেই প্রশ্ন করল, ‘আপনার কি খানিকটা লজ্জাও নেই? কোথায়, কীভাবে ব্যবহার প্রদর্শন করতে হয় সেটার নূন্যতম জ্ঞান কি আপনার মধ্যে নেই? আচ্ছা আপনি কি বিয়ের পরেও সবার সামনে আমার সাথে এরকম ব্যবহার করবেন?’
আদ্রিশ ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘মনে হয়।’
রোজা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আই সোয়্যার, আমি আপনার সংসারই করবো না। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবো। যে আমাকে বুঝবে, যে আমাকে এমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে না, তাঁকেই খুঁজে নেব।’
আদ্রিশ হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে? সোজাসুজি কথা বলি, সেজন্য তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? তোমার একটুও মায়া হবেনা আমার জন্য?’
রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘একদমই না। যে আমাকে সম্মান দিতে জানে না, তার জন্য আবার কীসের মায়া?’
আদ্রিশ সবার সামনে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও নিশ্চুপ রইলো। কারণ রোজা এটা পছন্দ করবে না। সেজন্য ও ‘স্যরি’ কথাটি উচ্চারণ করে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভুলবশত টেবিলের নিচ দিয়ে রোজার পায়ে ধাক্কা লেগে গেলো। আর অসহায় ভঙ্গিতে রোজাকে দেখলো। এদিকে আদ্রিশের অসহায় ভঙ্গিমা দেখে রোজার পেট ফেটে হাসি এলো। কিন্তু মুরুব্বিদের সামনে আর হাসি দিলো না। চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে তীব্র দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে তাকাতেই ও থেমে গেল৷ আদ্রিশ বলল, ‘বিলিভ মি, এটা নিতান্তই এক্সিডেন্ট। আমি ইচ্ছে করে করি নি।’
‘এটা নিতান্তই দুর্ঘটনা নয়। সব আপনার ইচ্ছাকৃত কাজ। আপনি আজকাল বেশি লু-তু-পু-তু ব্যবহার করছেন।’
এটা বলেই রোজা আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আদ্রিশ আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালো। আদ্রিশ লু-তু-পু-তু কাজ করেছে? কীভাবে বলতে পারলো রোজা? এত নির্দয় ব্যবহারে আদ্রিশের মনটা যে ছাই হয়ে ধোঁয়ার ন্যায় ওড়ে যাচ্ছে এটা বুঝি বোঝে না রোজানু? আজ ওকে আগের তুলনায় ভীষণ কঠিন আর রাগী মনে হচ্ছে। এতদিন আদ্রিশ ওকে কতই না বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। আর এখন? ছোঁয়ার আগেই লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে। কথার মারপ্যাঁচে ফেলে ওকে নাস্তানাবুদ করেছে। লোকে বোধহয় ঠিকই বলে, বউয়ের সামনে অধিকাংশ লোকই নেংটি ইঁদুর। মাঝেমধ্যে বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করা ছাড়া ওদের আর কাজ নেই। শেয়ালের মতো চালাকি করলে ঘোড়ার পায়ের লাথি খেতে হয়! মেয়ে মানুষ এত নির্দয় হয় রোজাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না আদ্রিশ। ততক্ষণে
সবার খাওয়া শেষ। আদ্রিশ যেহেতু সবার পরে খেতে বসেছে তাই টেবিলে সে একাই রয়ে গেলো। ইশারা করে রোজাকে একটু অপেক্ষা করতে বললে রোজা ওকে পাত্তাই দিলো না৷ রোজার এ ব্যবহারে আদ্রিশ আর খেলোই না। ওঠে হনহন করে চলে গেলো। নিশিতা পেছন থেকে ডাকলেও আদ্রিশ শুনলোই না।
যেহেতু ভোরের ট্রেনেই সুলতানারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, তাই খুব তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লেন তিনি। রোজাকেও ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। কিন্তু ডাইনিংয়ের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়তেই রোজা আর হাসি চাপতে পারলো না। কীভাবে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে আদ্রিশকে ভাবতেই নিজেকে সুখী সুখী লাগছে। কিন্তু ভোরে যাওয়ার সময় যদি দেখা না হয় এই ভেবেই সে আদ্রিশের ফোনে একটা ম্যাসেজ লিখলো, ‘ভোরে বাড়ি যাচ্ছি। আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলাম বলেই জানালাম। শুভ রাত্রি।’
ফোনে বিরক্তিকর “টুং” শব্দটা হতেই আছাড় দিতে ইচ্ছে করলো আদ্রিশের। কিন্তু অনেকদিন পর স্ক্রিনে রোজার নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে দেখে তাড়াতাড়ি সেটা “সিন” করে লেখাটা পড়লো। তারপর তড়িঘড়ি করে টাইপ করে লিখলো, “সাবধানে থেকো৷ আর এখন একটু দেখা করবে প্লিজ। আমি সকালে দেরিতে ওঠি, যদি দেখা না পাই।”
ওপাশ থেকে রোজা উত্তর দিল, “কেন?”
____“প্লিজ, ভালোবাসি।”
অগত্যা রোজা নেহার ঘরের বারান্দায় এলো। আদ্রিশকেও ওর ঘরের বারান্দায় আসতে বললো। দু’জন দু’জনকে দেখলো। আদ্রিশ রেগে গিয়ে বলল, ‘এটা কি ধরনের দেখা করা?’
রোজা হাসি আটকে বলল, ‘কাছ থেকেও দূরে। না ছুঁয়ে দেখা করা।’
আদ্রিশ রেগে বলল, ‘তুমি এভাবে মিন করছো কেন? আমি কি সবসময় তোমায় ছুঁই নাকি? একবার রাগের মাথায় ভুল করে… ‘
রোজা ওকে থামিয়ে দিয়ে অসমাপ্ত বাক্যটা পূর্ণ করল, ‘গভীরভাবে ছুঁয়েছিলেন।’
আদ্রিশের রাগের পারদ হুট করেই নেমে গেলো। অদ্ভুত এক ঘোরে থেকেই বলল, ‘আরেকবার ছুঁই? দূর থেকে?’
রোজা অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে?’.
‘এভাবে।’
বলেই আদ্রিশ বাতাসে চুমু এঁকে দিলো। ওর কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রোজা দাঁড়িয়ে রইলো। ও অনুভব করলো বাতাসটা যেন মুহূর্তেই ওর গাল ছুঁয়ে গেলো। লজ্জা পেলো সে। রাত্রির নিঃস্তব্ধতার ঘনঘটায়, কালচে মেঘের ছুটে চলা দেখতে দেখতে দু’জনে বারান্দায় কাটিয়ে দেয় অনেকটা সময়। মাঝরাতে বৃষ্টি নামে, ঘুমের ঘোরে দু’জনেই দু’জনকে অনুভব করে। কিন্তু কেউই জানতে পারে না কারোর মনের খবর৷
——————————————-
চলবে…