#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৭৭.
বিছানার এক কোণে রাজ্যের সমস্ত রাগ নিয়ে বসে রয়েছে সূচনা। রাগে তার কান্নাও পাচ্ছে। সবাই মিলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল তাও আবার তাকে কিছু না জানিয়েই। কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নেবে? সূচনা তো বলেছে সে কোনো সম্পর্কে জড়াবে না। তবুও তাহলে তারা কেন আদিলের বাড়ি থেকে আসা প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল?
সাথী, সুখী কেউই সূচনাকে বোঝাতে পারছে না। সে রেডি হবে না, আর যাবেও না ওদের সামনে। ফাতেমা এবং সূচনার মা আদিলের বাড়ির সবাইকে আপ্যায়ন করায় ব্যস্ত ছিল। সূচনা এখনও আসছে না দেখে মা নিজেই আসে ওদের রুমে। এসে দেখতে পায় রাগে থমথমে মুখ নিয়ে বসে রয়েছে সূচনা। তিনি সাথী আর সুখীর দিকে তাকাতেই ওরাও অসহায়ভাবে মায়ের দিকে তাকায়। এই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে,’কোনোভাবেই রাজি হচ্ছে না।’
এবার তিনি গিয়ে সূচনার পাশে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,’এমন পাগলামি করলে চলে বল? মেয়ে হইয়া যখন জন্ম নিছিস, তখন আজ হোক বা কাল বিয়ে করে তো পরের বাড়িতে যাওয়াই লাগব।’
সূচনা রাগে ফোঁস করে ওঠে। আকারে-ইঙ্গিতে বলে,’আমি বিয়ে করব না মানে, করবই না। তোমরা আমায় না বলে কেন রাজি হলে? আমি যাব না ওদের সামনে।’
গর্ভধারিণী মায়ের সূচনার ইশারাকৃত ভাষা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। সত্যিই এবার তার আফসোস লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে সূচনার মতামতটা আগে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন যদি ওদের সামনে না যায়,ব্যাপারটা অনেক লজ্জাজনক হয়ে পড়বে। মা যখন কোনোভাবেই সূচনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি তখন সুখীকে বলল,’আস্তে করে গিয়ে আদিলকে একটু ডেকে নিয়ে আয় তো।’
সুখী চলে যেতেই মা বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,’এই সময়ে ভূমিটা যে আবার কোথায় গেল!’
‘আপু মনে হয় ছাদে গেছে।’ বলল সাথী
এই সময়ে সুখীর সাথে ঘরে প্রবেশ করে আদিল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। মা দরজার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,’সূচনা রাজি হইতাছে না বাবা।’
আদিল আড়চোখে একবার তাকাল সূচনার দিকে। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিছানার ওপর আকাশী রঙের শাড়ি আর কিছু প্রসাধনী পড়ে রয়েছে। ওর পরনে নীল রঙের একটা থ্রি-পিস। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। আগাগোড়া একবার পরখ করে নিয়ে সে মাকে বলল,’আপনি গিয়ে আব্বু-আম্মুর সাথে গল্প করুন। সূচনার বিষয়টা জানানোর প্রয়োজন নেই কাউকে। আমি দেখছি বিষয়টা।’
মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সাথীও চলে গেল ড্রয়িংরুমে। রুমে এখন শুধু সূচনা, আদিল আর সুখী। সাথী যাওয়ার আগে সুখীকে ইশারায় থাকতে বলে গেছে। না হলে হয়তো সুখীও চলে যেত। তবে সে রুমে অবস্থান না করে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে থাকে।
আদিল বসে সূচনার মুখোমুখি। রাগে, ক্ষোভে সূচনা তেড়ে আসে তার দিকে। শার্টের কলার দু’হাতে খাঁমচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলছে। কথাগুলো আদিল বুঝতে না পারলেও, এতটুকু অন্তত বুঝতে পারছে মেয়েটা তার ওপর ভীষণভাবে রেগে আছে। তার এবার একটু সত্যিই কষ্ট লাগছে। কী হতো যদি মেয়েটা একটু কথা বলতে পারত? তাহলে এখন যতখুশি আদিলকে গালাগালি দিত, কথা শোনাতে পারত। এতে মনটা একটু হালকা হতো। সে সূচনার দু’হাত ধরে কলার থেকে হাত সরায়। দু’হাতে সূচনার বাহু ধরে বলে,’রিল্যাক্স সূচনা! তুমি এমন কেন করছ? আমি এমন কী অপরাধ করেছি বলতে পারো?’
সূচনা কাঁদছে। অস্থিরভাবে কাঁদছে সে। আদিল ওর দু’গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,’আমি তোমায় ভালোবেসেছি সূচনা, কোনো অন্যায় তো করিনি। আমি জানি, তুমি কোনো সম্পর্ককে বিশ্বাস করো না। ভূমি আপুর সাথে যা হয়েছে, এরপরে হয়তো তোমার জায়গায় থাকলে আমিও সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আমি তোমাকে বলছি না তুমি আমায় বিশ্বাস করো। আমি চাচ্ছি, অনুরোধ করছি, তুমি আমায় একটা সুযোগ দাও। পৃথিবীর সব মানুষ যদি একই হতো, বিশ্বাস শব্দটিই হয়তো দুনিয়াতে আর থাকত না। তুমি তোমার আব্বু-আম্মুকেই দেখো, আমার আব্বু-আম্মুকে দেখো তারা এতগুলো বছর একসাথে আছে না? তারা কি কেউ কাউকে ছেড়ে দিয়েছে? ঝগড়া, মান-অভিমান যাই হোক না কেন তারা কিন্তু একসাথেই আছে। এখন যদি এটা ভাবো যে, তুমি কথা বলতে পারো না বলে, আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাব। তাহলে উদাহরণ হিসেবে আমি তোমার বাবা আর মাকেই দেখাব। তোমার বাবা তো কথা বলতে পারে না। তোমার মা কি তাকে ছেড়ে গেছে? একসাথে আছে না তারা? তাহলে এরপরও কেন তুমি সবাইকে ভয় পেয়ে এক ভাবো? আমি তোমায় অনুরোধ করছি সূচনা, আমায় একটা সুযোগ তুমি দাও।’
সূচনার কান্নার গতি বাড়ে। সে দৃষ্টি নত করে নিরবে কেঁদে চলেছে। পর্দার আড়াল থেকে সূচনাকে বোঝানোর দৃশ্যটি দেখছে ভূমি। সারাজীবন আদিল এমনই থাকবে তো? আদিল আর কোনোকিছু না ভেবে সূচনাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’বিশ্বাস করতে হবে না। শুধু একটাবার সুযোগ দাও।’
জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই সূচনার দৃষ্টি যায় ভূমির দিকে। ভাসা ভাসা চোখে সে এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ইশারায় সে সূচনাকে বলে একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। সেই দৃষ্টি কিংবা ইশারাতে কী ছিল সূচনা জানে না, তবে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। সে আর কারো জন্য না হোক, শুধুমাত্র ভূমির জন্যই রাজি হয়েছে। কোনো রকম সাজসজ্জা ছাড়াই সূচনা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই আদিলের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায়। যাওয়ার আগে সে আড়ালে বলে গেছে,’তুমি সব অবস্থাতেই সুন্দর, স্বচ্ছ এবং স্নিগ্ধ।’
______
৭৮.
পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে কারো মায়ায় জড়ানো। এবং সবচেয়ে কঠিনতম কাজ হচ্ছে কারো মায়া কাটানো। তবে একটা জিনিস ভারী অদ্ভুত। আমরা মায়ায় জড়িয়ে যাই অজান্তেই। আর সেই মায়া থেকে বের হতে চাই স্বেচ্ছায়। যখনই কোনো ব্যক্তি কারো মায়া ত্যাগ করতে চায়, তখনই বুঝতে হবে মানুষটি ভেতর থেকে ভেঙে গিয়েছে। নতুবা খুব সহজে কেউ কারো মায়া ছাড়তে চায় না। অতীতের সকল পিছুটান, রাসেলের প্রতি ভালোবাসা, মায়া সবকিছু ত্যাগ করে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিয়েছে ভূমিকা। এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির সামনে। ওহ না! কথাটিতে একটা শব্দের কমতি রয়েছে। সে এখন রয়েছে প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির সামনে। ভূমিকা কষ্টে হেসেই ফেলে। সে অনেকক্ষণ যাবৎ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটিকে দেখে। খুব বেশি সময় সে শ্বশুরবাড়ি ছিল না। তবুও একসময়ে তো এই বাড়িটাই তার সবচেয়ে প্রিয় এবং আপন ছিল। তার স্বামীর পরিচয়ে বাড়িতে ছিল। ডিভোর্স লেটারে সই করার পরপরই ভূমির এই পরিচয়টি অনেকটা কর্পূরের ন্যায়ই উবে গেছে। এখন থেকে ভূমির আলাদা একটা পরিচয় হবে। সে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবে।
দীর্ঘকায় শ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে আসায় সে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়বার প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করে সে রাস্তা পার হয়ে মেইন গেইটের সামনে যায়। ব্যাগ থেকে কাগজটি বের করে দারোয়ানকে দিয়ে বলে,’চাচা খামটি রাসেলের মাকে দিয়ে দিয়েন।’
‘জি আচ্ছা।’ বলে দারোয়ান খামটি ভূমির হাত থেকে নিল। ভূমিও আর সেখানে একদণ্ড না দাঁড়িয়ে, নিজ গন্তব্য অফিসে চলে যায়।
রিদি সোফায় বসে টিফি দেখছিল। ঐ সময়ে দারোয়ান এসে খামটি দিয়ে যায়। রেশমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’কে এসেছে?’
‘দারোয়ান। খামটা দিয়ে গেল।’
‘খুলে দেখ তো কী।’
রিদি খামটি খুলে বলল,’ডিভোর্স পেপার। ভাবি সই করে পাঠিয়েছে।’
‘দেখেছিস মেয়ের কাণ্ড! ভালোই হয়েছে। আমার ছেলের ঘাড় থেকে যে নেমেছে আমি এতেই খুশি।’
রিদি একটু হতাশসুরে বলল,’মেয়েটাকে কত ভালো ভেবেছিলাম। অথচ মনে মনে কী ছিল!’
‘আমি তো আগেই বলছিলাম মেয়ে সুবিধার না। বুঝস না, জীবনে এত আরাম-আয়েশ করছে? আমেরিকা দেখার কপাল হইতো রাসেলের লগে বিয়ে না হইলে?’
‘তাই বলে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াবে? এটা আমি সত্যিই আশা করিনি।’
‘ঐসব মেয়ের থেকে আর কী আশা করা যায়? রাসেলরে কত বুঝাইলাম, এই মেয়েরে বিয়ে করিস না। শুনছিল আমার কথা? পরে তো নিজেই প্রমাণ পাইল। বাদ দে। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে। এখন তোর ভাইরে ফোন দে তো। দিয়া বল ভূমি সই করে দিছে।’
‘মা একবার ফোন দেই ভাবিকে?’
রেশমা বেগম ধমক দিয়ে বলেন,’ভাবি ভাবি কী? এখন আর ওর সাথে কোনো সম্পর্ক আছে আমাদের? আর রাসেল বারণ করছে, ওর সাথে যেন আমরা কোনো যোগাযোগ না করি। খবরদার! ফোন দিবি না ঐ মেয়েরে।’
_______
৭৯.
বিলাশবহুল রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে রাসেল আর সুমি। ঝাড়বাতিতে পুরো রেস্টুরেন্ট ঝকঝক করছে। দুপুরে যখন রেশমা বেগম ফোন করে জানালেন ভূমি ডিভোর্স লেটারে সই করে পাঠিয়েছে, তখন থেকেই সে খুশিতে আত্মহারা। এবার আর সময় নষ্ট করবে না। সুমিকে সব বলে দেবে। তারপর বিয়ের প্রস্তাব দেবে। একটা ডায়মন্ডের রিং কিনে এনেছে সুমির জন্য। একটু ভয় ভয়ও লাগছে, সব জানার পর সুমি কেমন রিয়্যাক্ট করবে কে জানে!
জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সুমি বলল,’কী হলো? কখন থেকে চুপ করে আছো। আমার কাল পরীক্ষা আছে। বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। বেশি রাত করে বাইরেও থাকতে পারব না।’
রাসেল হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’মাত্র বাজে সাড়ে সাতটা। এখনও অনেক সময় আছে।’
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন তো বলো জরুরী তলবের কারণ কী? হঠাৎ শাড়ি পরতে বললে। তুমিও দেখি বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছ। যদিও তুমি সবসময়ই পরিপাটি থাকো।’ কথাটা বলে মুচকি হাসল সুমি। রাসেল একটু সময় নিয়ে সুমির হাত ধরল। বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,’কথাগুলো অনেক সিরিয়াস সুমি। আশা করছি, আমার সম্পূর্ণ কথাটা তুমি শুনবে। আর আমায় একটু বোঝার চেষ্টা করবে।’
সুমির মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে বলে,’এমন কী কথা বলো তো?’
‘সুমি, আমি বিবাহিত!’
সুমি বিস্ময় নিয়ে তাকায়। কথা বলার ভাষা নেই তার। রাসেল বলে,’তবে এখন আর আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘আমি কিছু বুঝতেছি না রাসেল। তুমি কি আমার সাথে মজা করছ?’
‘না, সুমি। আমি সবকিছু তোমাকে সত্যি বলছি। তোমার সাথে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন আমি বিবাহিত ছিলাম। কিন্তু আমার ওয়াইফের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ওর ক্যারেক্টার ভালো ছিল না। তখন তুমি আমার জীবনে আসো। তোমায় দেখে আমি বুঝেছি ভালোবাসা কী। তাই আমি তখন তোমায় সত্যিটা জানাতে পারিনি। কিছুদিন যাবৎ আমাদের ডিভোর্স হয়েছে।’
‘এক সপ্তাহের জন্য দেশে কি তাহলে ডিভোর্সের জন্যই গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। সুমি, তুমি আমায় ভুল বুঝছ না তো? বিশ্বাস করো, আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। আমি বিয়ে করতে চাই তোমায়।’
এরপর সে পকেট থেকে রিং বের করে জিজ্ঞেস করে,’উইল ইউ ম্যারি মি?’
এক ঝটকায় রাসেলের হাত সরিয়ে দেয় সুমি। কটমট করে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভরাট কণ্ঠে বলে,’তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি রাসেল।’
এরপর আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে সে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
চলবে…
#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________
৮০.
রাতের অন্ধকার ঠিক একটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি। রাসেল দাঁড়িয়ে আছে সুমির বাড়ির সামনে। এই পর্যন্ত কতগুলো ফোন করেছে তার হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সুমি ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। এই অবহেলাটুকু রাসেল সহ্য করতে পারছে না। উপায় না পেয়ে সে সুমির বান্ধবী রিয়াকে ফোন করে। তিনবার রিং হওয়ার পর রিয়া ফোন রিসিভ করে বলে,’জি ভাইয়া, বলেন।’
‘তুমি কি ব্যস্ত?’
‘একটু। কাজে আছি তো। সমস্যা নেই, আপনি বলেন।’
‘বলবনে পরে। তুমি তাহলে কাজ করো।’
‘সিরিয়াস কিছু?’
‘সেরকমই। আর শোনো, বাড়িতে এসে একটু ফোন দিও তো। সুমি ফোন বন্ধ করে রেখেছে।’
‘আচ্ছা।’ বলে রিয়া ফোন রেখে দিলো।
আরও ঘণ্টাখানেক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রাসেল নিজের বাসায় চলে আসে। দরজা খুলতেই যেন গরম হাওয়া ভেসে আসলো। চারদিক নিরব, নিস্তব্ধ। এমনটা নয় যে, সে আগে একা থাকেনি। ভূমি আসার আগেও সে এই বাড়িতে একাই ছিল। কিন্তু ভূমি আসার পরে বাড়িটাতে প্রাণস্পন্দন ছিল। বাড়িতে ফিরলে বাড়িটা ফাঁকা লাগত না। অনেকদিনের অভ্যেস হয়ে গেছিল বলে, এখনও সেই অভ্যাসটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার মধ্যে সুমির অবহেলা। সবকিছুই এখন তার বিষাদময় লাগছে, অসহ্য লাগছে। রাতে ঘুমও ভালো হলো না। চোখগুলো ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। রাতে আজেবাজে স্বপ্নও দেখেছে অনেক। সকাল হতেই সে সুমির বাড়ির সামনে চলে যায়। ফোন এখনও বন্ধ। রিয়াকে ফোন করতে যাবে, তখন রিয়া নিজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাসেল অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’সুমি কি বাসায়?’
রিয়া গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। বিরসমুখে বলল,’না। আগের জবটা নিয়েছে।’
‘জব নিয়েছে? ওর না আজ পরীক্ষা?’
‘হ্যাঁ। পরীক্ষার পর কাজে যাবে।’
‘ওর সাথে একটু কথা বলিয়ে দেবে প্লিজ?’
‘কেন বলুন তো? কেন চাচ্ছেন ওর সাথে কথা বলতে? এরকম একটা নাটক করার আগে এসব মনে ছিল না?’
রাসেল অপরাধীর মতো করে বলল,’আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই সুমিকে অনেক ভালোবাসি।’
‘আমার বিশ্বাস করা না করায় কী আসে যায় বলুন তো? সুমি সাফ সাফ আমায় বলে দিয়েছে, ও আর ব্যাক করবে না। আর আমাকেও বলে দিয়েছে আপনার সাথে যেন কোনো রকম যোগাযোগ না করি।’
রাসেলকে আর কিছু বলতে না দিয়েই রিয়া চলে গেল নিজের কাজে। কতক্ষণ সেখানেই রাসেল অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার অনুভূতিটা যে কী রকম তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এলোমেলো অবস্থাতেই সে অফিসের উদ্দশ্যে রওনা হয়।
______
৮১.
‘সূচনার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে শুনেছিস?’ রাতে খেতে বসে কথাটা তুললেন চাচা। জারিফ তখন ভাতের লোকমা মুখে তুলছিল। বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে জবাব দিলো,’না তো!’
‘গতকাল হয়েছে। আমায় ফোন দিয়েছিল। ব্যস্ত ছিলাম, তাই যেতে পারিনি।’
‘ছেলে কে? চেনো তুমি?’
‘না। সূচনার বান্ধবীর ভাই হয় শুনলাম। ছেলে ভালো। বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। এখন প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো বেতনের একটা চাকরী করছে। দেখতে, শুনতেও নাকি মাশ-আল্লাহ্।’
এবার খেতে খেতে তাচ্ছিল্যরসুরে চাচি বললেন,’ভালোই তো দেখি টোপ ফেলেছে! বান্ধবীর ভাইকে পটিয়ে নিল।’
এ কথা শুনে চাচা গম্ভীরকণ্ঠে বললেন,’না জেনে আজেবাজে কথা বলবে না। সূচনা কেমন চেনো না তুমি? ও তো বিয়েতে রাজিই হচ্ছিল না।’
‘ছেলেই কি ওকে দেখে পছন্দ করেছে?’ জিজ্ঞেস করল জারিফ। উত্তরে চাচা বললেন,’হ্যাঁ। পছন্দ করেছে আর কি, ছেলে তো সূচনা বলতে অজ্ঞান।’
জারিফ চুপ করে থাকে। এ কথার প্রত্যুত্তরে তার কিছু বলার নেই। তবে কথা বললেন চাচি। তিনি বললেন,’এক মেয়ের অঘটন ঘটিয়ে শান্তি হয়নি। এখন আরেক মেয়ের অঘটন ঘটাবে বলে বিয়ে দিচ্ছে। আরে শুধু পরীর মতো সুন্দর হলেই হবে? যেই ছেলে বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, ভালো বেতনের চাকরী করে ওদের অবস্থা কি আর যেনতেন? দেখবে দু’দিন পর ওর কপালেও একই শনি আছে।’
‘আশ্চর্য মা! তোমার মন-মানসিকতা এত নিচু কেন? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল। দোয়া করার কথা ছিল। তা না করে উলটা-পালটা কথা বলছ! আর শোনো, সবাই এক না। কার ভাগ্যে কী আছে তা তো আমরা জানিনা। এজন্য সবাইকে এক ভাবব? পারলে মাইন্ডটাকে একটু ফ্রেশ করো।’ কথাগুলো বলেই খাবার রেখে উঠে যায় জারিফ। পেছন থেকে চাচি চেঁচিয়ে বলেন,’ঐ মেয়েকে কিছু বললেই তোমাদের বাপ-ছেলের এত লেগে যায় কেন বুঝলাম না। আমি তো ভুল কিছু বলিনি।’
‘তুমি কথা বলোই গায়ে লাগার মতো।’ বললেন চাচা। চাচি মুখ ঝামটা মেরে বসে রইলেন। চাচারও আর খাওয়া হলো না। সেও খাবার রেখে হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেলেন।
______
৮২.
শুভ্র রঙের পাঁচ তলা ফ্ল্যাটটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শিশিরদের প্রাইভেট কার। গাড়িটি ওর নিজের নয়; বড়ো ভাই শোহেবের। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে আঙুলগুলো হারমোনিয়াম বাজানোর মতো করে নেড়েচেড়ে শোহেব প্রশ্ন করে,’আমাদের তো টিসএসসিতে যাওয়ার কথা। এখানে কেন গাড়ি থামাতে বললি?’
‘ভূমি আপুকে পিক করে নিয়ে যাব তাই।’
শোহেব ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,’কাকে?’
শিশির ফোন চাপছিল। পূণরায় ভাইয়ের প্রশ্নটি শুনে সে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,’ভূমি আপু।’
‘আমি যতদূর জানি, আমাদের বাবা-মায়ের কোনো মেয়ে নেই।’
শিশির নিজের ভাই সম্পর্কে জানে। একগুঁয়ে, রগচটা, ঠোঁটকাটা স্বভাবের সে। তাই এমন কথায় সে অবাক হলো না। বরং আগের তুলনায় আরও শান্তকণ্ঠে বলল,’সূচনার বড়ো বোন।’
‘সূচনাটা কে?’
‘আদিলের হবু বউ। তোমায় বলেছিলাম না ওদের এঙ্গেজমেন্টের কথা?’
‘ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। আমরা তো ওদের জন্যই টিসএসসিতে যাচ্ছি তাই না?’
‘হ্যাঁ। এঙ্গেজমেন্ট তো ঘরোয়াভাবে হয়েছে। তাই এখন আমাদের ট্রিট দিচ্ছে।’
‘বুঝতে পেরেছি। তাহলে তোর ভূমি আপু কেন যায়নি এখনও?’
‘আপু জব করে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে লেট হয়েছে। তাই আমি বলেছি, বাকিরা যেন আগেই চলে যায়। আমি যাওয়ার সময়ে ভূমি আপুকে নিয়ে যাব।’
‘দয়ার সাগর!’ বাঁকা হেসে বলল শোহেব। শিশিরও হালকা হেসে প্রসংশারসুরে বলল,’সি ইজ সো মাচ ইন্টেলিজেন্ট ব্রো!’
‘ওহ তাই? তা কীসের জন্য শুনি?’
‘আপু অনেক ভালো লেখে। তার বইও বের হবে শুনেছি। আর গানের গলা তো জাস্ট ওয়াও! না শুনলে বিশ্বাসই করবে না।’
‘ব্যস! এইটুকুই?’
শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। শোহেব বলে,’এইটুকুর জন্যই তুই তাকে ইন্টেলিজেন্টের তকমা লাগিয়ে দিলি?’
‘তুমি এভাবে কেন কথা বলছ, বলো তো ভাইয়া?’
‘যাদের সময়-জ্ঞান বলতে কিছু নেই তাদের বুদ্ধিমত্তার এত তারিফ করাটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। দেখি ফোন দে তোর আপুকে। বল আমরা নিচে অপেক্ষা করছি।’
শিশির কথা না বাড়িয়ে ফোন দিতে যাবে তখনই ভূমিকে আসতে দেখা যায়। ‘ঐতো আপু আসছে।’ বলল শিশির। সে ভূমির উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতেই ভূমি এসে গাড়ির পেছনের সিটে বসে। শোহেব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভূমির উদ্দেশ্যে বলল,’আপনার সম্পর্কে এতক্ষণ বেশ প্রশংসা শুনলাম শিশিরের কাছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনার এতসব গুণ কোনো কাজে আসবে না।’
ভূমিকা অবাক হয়ে শিশিরের দিকে তাকায়। শিশিরও পেছনে তাকিয়ে ইশারায় বলে,’পাগল একটা!’
শোহেব গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করে,’কেন জানেন?’
ভূমি কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শোহেব গাড়ির লুকিং গ্লাসটা এবার ভূমির মুখ বরাবর ঠিক করে রাখে। তখনই আয়নায় ভেসে ওঠে কাজলবর্ণ দুটো আঁখি। গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ হওয়া সত্ত্বেও চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল এবং গর্ত খুব সহজেই চোখে পড়ছে। রাতে বোধ হয় ঠিকমতো ঘুমায় না। সে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই বলল,’আপনার সময়-জ্ঞান খুব কম। সময় মেইনটেইন করার চেষ্টা করবেন মিস…কী যেন নাম?’
ভূমিকা এবার হাত-ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে কাঁটা কাঁটা গলায় বলল,’ভূমিকা! আমার সময়-জ্ঞান পর্যাপ্ত রয়েছে। আপনারাই সময়ের আগে চলে এসেছেন। এমনিতে আমি রেডিই ছিলাম। যখন এসেছেন, তখনই যদি ফোন করতেন তাহলে আরও আগেই যেতে পারতাম আমরা।’
ভূমির কাঁটা কাঁটা উত্তর শুনে শোহেব একবার লুকিং গ্লাসে ভূমিকে দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’ঝাঁঝের রাণী!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]