রঙিন রোদ পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
832

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৫(অন্তিম পর্ব)

রুমি আহমেদ মারা যাওয়ার পর মৃত্তিকা আরও ভেঙে পড়েছে। সে কারো সাথে কথা বলে না। নিজেকে একটা বদ্ধ রুমে সবসময় আবদ্ধ রাখে। চুলগুলো সবসময় অগোছালো হয়ে থাকে। ঈশান খুব দ্রুতই সবকিছুর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। সে তার এসব কাজ ছেড়ে দিয়ে খুব দ্রুত মৃত্তিকাকে নিয়ে বিদেশে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পাড়ি দিবে। মৃত্তিকার এমন মলিন চেহারা দেখে সে আর সহ্য করতে পারছে না।
তারা বিদেশ যাওয়া পর্যন্ত রিনিকে সুদূর দেশ পাড়ি দিয়ে মৃত্তিকার জন্য আনালো ঈশান । আর মাত্র কয়েকদিন। এরপরই এসবের প্যারা আর থাকবে না। তারপর রিনি, মৃত্তিকা আর ঈশান চলে যাবে বহুদূর। ঈশানের মাঝে মাঝে ভয় হয়, মৃত্তিকাকে সে সত্যিটা জানালে তাদের এই সুন্দর সম্পর্ক কী আর থাকবে! না কি মৃত্তিকা ঈশানকে ভুল বুঝে অনেক দূরে চলে যাবে! কিন্তু এই সত্যিটা মৃত্তিকাকে না জানালে এই সম্পর্কটা যে মিথ্যের উপর তৈরী হবে। আর যদি জেনেও যায় তাহলে কী হবে ভাবতেই ঈশানের মনের ভেতর কষ্ট চেপে ধরে! না, মৃত্তিকাকে এসব কিছুতেই বলা যাবে না। হোক না, মিথ্যের উপর সম্পর্ক। তবুও যদি ভালো থাকা যায়, মৃত্তিকাকে যদি সবসময় তার কাছে রাখা যায় তাহলে সে বেঁচে থাকতে পারবে। আর যদি সত্যিটা বলার পর মৃত্তিকা হারিয়ে যায়? না,মৃত্তিকে সে এসব কিছুতেই বলবে না। সে তো এসব কাজ থেকে বেরিয়ে আসবে।

রিনি আসার পর রিনির সঙ্গতাই মৃত্তিকা মাত্র একটু আধটু সুস্থ হয়ে উঠছে। ঈশান’ও অনেক খুশি। এইতো কালই চলে যাবে এরা।

সকালে উঠেই ঈশান নিজ হাতে মৃত্তিকাকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে দিল। তারপর মুখ মুছে দিতে দিতে বলে উঠল,

-‘আজ একটা সারপ্রাইস আছে।’

মৃত্তিকা খাবার চিবুতে চিবুতে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো ঈশানের দিকে।
ঈশান মুচকি হেসে বলে উঠল,
-‘সে না-হয় সন্ধ্যায় দেখে নিও।’

এরপর প্লেট রেখে এসে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে রিনির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘রিনি যাচ্ছি। কিছু-সময় পর আসছি। সারপ্রাইসটা মৃত্তিকে বলিস না।’

মৃত্তিকা ঈশানকে বিদায় দিতে তার পেছন পেছন আসতে গিয়ে ঈশানের কথা শুনে অভিমানে মুখটাকে মলিন করে ফেলল। ঈশান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে মৃত্তিকার এমন অভিমান-ভরা দৃষ্টি দেখে থেমে হাসলো। এরপর মৃত্তিকার গালে পরম মমতায় হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘তোমাকে এমন মানায় না। সবসময় হাসি-খুশি থাকবে। তুমি জানো? তোমার হাসিটা কত্ত সুন্দর?’

মৃত্তিকা রাগী দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘যান তো।’

ঈশান হেসে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে পা বাড়াতেই মৃত্তিকা দরজা আটকে দিতে গিয়ে আর আটকাতে পারলো না। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখলো ঈশান হাত দিয়ে দরজা আটকে ফেলেছে। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ঈশান ফট করে দরজা পেরিয়ে মুখ ঢুকিয়ে মৃত্তিকার কপালে তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া স্পর্শ দিল।
মৃত্তিকা কড়া দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে কিছু বলতে নিতেই ঈশান বলে উঠল,
-‘ভালোবাসি। ভালোবাসি প্রচুর।’

মৃত্তিকার রাগ মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল।

-‘একবার ভালোবাসি বলো? তোমার কাছ থেকে বোধহয় আমার আর ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শোনা হবে না!’ ঈশানের কণ্ঠ অসহায় শুনালো।

মৃত্তিকা কিছু না বলে লজ্জায় মাথা নিচু করে পেছনদিকে ঘাড় বাকিয়ে রিনিকে আসতে দেখে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করল।

-‘সাবধানে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ।’ বলেই পরপরই মৃত্তিকা ঈশানের বাচ্চা-পনাকে পাত্তা না দিয়ে হাসিকে আড়ালে ঢেকে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।

ঈশান মুচকি হেসে সিঁড়ি বেয়ে পেছন দিক থেকে নেমে যেতে যেতে বলে উঠল,

-‘ভালোবাসি মৃত্তি-বউ। ভালোবাসি প্রচুর।’

মৃত্তিকা দরজা বন্ধ করার পরেও বাইরে থেকে ঈশানের আওয়াজ শুনে আপনমনেই বিড়বিড় করে ‘আমিও প্রচুর ভালোবাসি আপনাকে ঈশান-সাহেব’ বলেই হেসে ফেলল।

এরপর দৌড়ে রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে ঈশানের গাড়ি যতক্ষণ পর্যন্ত চোখের আড়াল না হয় ততক্ষন তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা আছে বলেই সে আবার বাঁচার মানে খুঁজে পেয়েছে। এখন এই পৃথিবীতে মৃত্তিকার বাঁচার শেষ সম্বল এই মানুষটা। এই মানুষটাই তার প্রশান্তি।

কারো ধাক্কায় মৃত্তিকা ভাবনা থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল রিনি ভ্রু কুঁচকে মৃত্তিকার পানে চেয়ে আছে।

-‘কী রে এতো মিটিমিটি হাসি কেন! কী ব্যাপার মৃত্তিকা!’ রিনি ঠোঁট টিপে হেসে বলে উঠল।

-‘ঐটা বাদ দে। কীসের সারপ্রাইস আজ রিনি!’ মৃত্তিকা রিনির কথার জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল।

-‘ঐটা ভাইয়া আসলে দেখতে পারবি। এখন এতো উৎকণ্ঠা হইস না।’ বলেই রিনি রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।’

জীবন আসলেই সুন্দর। সেই জীবনের সাথে জড়িত প্ৰিয় মানুষটা যদি মনের মতো হয় তাহলে আরও বেশি সুন্দর। কল্পনার রাজ্যের মতো জীবনটা পরিপূর্ণ। ‘ঈশান’ নামক মানুষটার জন্যই মৃত্তিকার জীবনটা পরিপূর্ণ। তার কাঁধে মাথা রাখলে এমন হাজার হাজার বছর দিব্যি পার করে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে।
সময়ের সাথে সাথে ‘ঈশান’ নামক মানুষটা মৃত্তিকার জীবনের সাথে আরও বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষটার নিত্য নতুন কাজে তার প্রেমে বারেবারে পড়ে মৃত্তিকা। ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছে মানুষটার মাঝে। এইতো জীবন সুন্দর।

———

মৃত্তিকার রুমে খাটের উপর মোবাইলটা অনবরত বেজে চলছে কিন্তু ওয়াশরুমে গোসলে থাকায় সে ধরতে পারেনি। মোবাইলটা বাজতে বাজতে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল।

মৃত্তিকা গোসল শেষ করে এসে খাট থেকে মোবাইল হাতে নিয়েই দেখল ঈশানের নাম্বার থেকে কল। সে পুনরায় কল করতে গিয়ে দেখল ওয়েটিং আছে হয়ত অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কল করছে । মৃত্তিকা আর কল না দিয়ে মোবাইলটা এক পাশে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আজ সে ঈশানের পছন্দের খাবার রান্না করবে। হয়ত বাসায় এসেই ওর পছন্দের খাবার দেখে খুশি হয়ে যাবে। মৃত্তিকা চটপট রান্না সেড়ে নিল।
রান্নার কাজ শেষ করে রান্নাঘর থেকে বের হতেই মৃত্তিকা রিনিকে দেখে থমকে গেল।
রিনি মেঝেতে বসে স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে।

মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি দৌড়ে রিনির সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লো,
-‘রিনি, এই রিনি। কী হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস ক্যান বোন?’

রিনির চোখ ফোলা ফোলা। সে শান্ত দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকাতেই মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি ওকে বুঁকের ভেতর জড়িয়ে নিল।
-‘কী হয়েছে রিনি! বল, আমায়। রাহান কিছু বলেছে?’

মৃত্তিকা মনে করলো রিনির সাথে সম্পর্কে থাকা রাহানের সাথে কিছু হয়েছে কারণ রাহান আর রিনির মধ্যে প্রায়ই এমন ছোটোখাটো ঝগড়া হয়ে থাকে। তখন রিনির কেঁদে-কেটে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আজকেরটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।

রিনি মৃত্তিকাকে শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার বুঁকের ভেতর ডুকরে কেঁদে উঠল। মৃত্তিকা পরম মমতায় রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রিনি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা গেল। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। সে জানালা দিয়ে দেখলো, অ্যাম্বুলেন্সটা তাদেরই গেট দিয়ে ঢুকছে। সে কিছুই বুঝতে পারলো না।

রিনি দৌড়ে এসে তাড়াতাড়ি মৃত্তিকার হাত ধরে টেনে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামিয়ে ফেলল।

অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছন আরও কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে। আস্তে আস্তে অনেক চেনা-পরিচিত মানুষের ভিড় জমছে। মৃত্তিকা এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এইতো উনার বন্ধুরা। কিন্তু উনিই বা কই?

অ্যাম্বুলেন্স থেকে একটা স্ট্রেচার নামানো হলো। আস্তে আস্তে সেটা বাসায় ঢুকানো হলো।

বাসায় ঢুকাতেই রিনি সাদা কাপড়ে আবদ্ধ মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। রিনি সামনে থাকার কারণে মৃত্তিকা ঠিকঠাক দেখতে পারছে না স্ট্রেচারে রাখা মানুষটাকে।

হঠাৎ রিনি কাঁদতে কাঁদতে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে ডুকরে উঠল।
মৃত্তিকা একটু এগিয়ে যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। তার দৃষ্টি সাদা কাফনে ঢাকা মানুষটার দিকে নিবদ্ধ। সে কিছুক্ষন আশেপাশে তাকিয়ে পরিবেশটা বুঝার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন থমকে ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা সকালেই দিব্যি সুস্থ ছিল। এইতো মৃত্তিকাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল সেটার পরশ এখনো লেগে আছে মনে হচ্ছে কিন্তু এখন কী শান্তভাবে শুয়ে আছে।

‘এ কী! উনি এভাবে শুয়ে আছে কেন!’

ঈশানের কপালে ব্যান্ডেজ। রিনির এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে মৃত্তিকা বিরক্তিসূচক শব্দ করে রিনিকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো।

-‘রিনি, উঠ। উনি ব্যথা পাবে। দেখছিস না? ব্যান্ডেজ?’

রিনি স্তব্ধ হয়ে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইল। মৃত্তিকার চোখে কোনো পানি নেই। সে একদম স্বাভাবিক।
মৃত্তিকা সামনে থাকা উনার কয়েকজন বন্ধুকে চিনতে পারলো। ইনাদের ঈশানই মোবাইলে দেখিয়েছিল। মৃত্তিকা উদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-‘ভাইয়া, উনাকে রুমে দিয়ে আসতে পারবেন একটু? আসলে এরকম আওয়াজ আর মানুষের ভিড়ে উনি ঘুমাতে পারেন না। তখন আবার উঠে বকা-বকি করবে।’

সবাই মৃত্তিকার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি, ঈশান ঘুমাচ্ছে।

আস্তে আস্তে শূন্য ঘরটা অনেক মানুষের আনা-গুনায় পূর্ণ হলো। মৃত্তিকা এই রুম ওই রুমে গিয়ে সবাইকে অ্যাপ্পায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রান্নাঘরে গিয়ে ঈশানের জন্য রান্না করা পছন্দের খাবার’গুলো প্লেটভর্তী করে নিয়ে ঈশানের খাঁটিয়ার পাশে এসে বসলো।

-‘এই যে। উঠুন। আজ আপনার পছন্দের খাবার রান্না করেছি।’

সম্পূর্ণ বাসাভর্তী মানুষ মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ মৃত্তিকার জন্য কপাল চাপড়াচ্ছে আর কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করছে।

পরপর দুইবার ডাকার পরেও মৃত্তিকা যখন ঈশানের কাছ থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পেল না তখন সে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রিনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘রিনি শোন। তোর ভাই কিন্তু পরে আসলে এই খাবারগুলো আর পাবে না। আমি জানি ও সব শুনছে। আমাকে রাগানোর জন্য উঠছে না।’

রিনি কান্না থামিয়ে এক দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইল।

মৃত্তিকা উঠে গিয়ে রান্নাঘরে প্লেট রেখে কিছুক্ষন পর আবার আসলো। এসে ঈশানের কানের পাশে বসে ফিসফিস করে বলে উঠল,
-‘এই যে। আপনার সারপ্রাইসটা কিন্তু আমি এখনো পেলাম না।’ বলেই এরপর মৃত্তিকা আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে বাচ্চামো কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘এই, আপনারা যাচ্ছেন না কেন? আপনাদের কারণে আমার ঈশান লজ্জা পেয়ে খেতে উঠছে না।’

কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই নিস্পলক দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে আর মৃত্তিকা ঈশানের দিকে। কী সুন্দর লাগছে আজ উনাকে! সাদা কাপড়ে ভীষণ মায়াবী লাগে উনাকে। অন্যদিনের মতো আজ তার ঈশানের মুখে কোনো মায়াবী হাসি নেই। এটার কারণে সুন্দর কম লাগছে। মৃত্তিকা তার ডান হাত ঈশানের ঠোঁটের উপর দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করলো।
মৃত্তিকার এমন কান্ড দেখে রিনি আর কয়েকজন মহিলা এসে তাকে আটকে রুমে নিয়ে গেল।

মৃত্তিকা রুমে গিয়ে আলমারি খুলে ঈশানের দেওয়া প্ৰিয় কালো শাড়িটা হাতে নিল। এই শাড়িতে ঈশানের ছোঁয়া লেগে আছে এখনো।
মৃত্তিকা শাড়িটা নিয়ে ঝটপট পড়ে ফেলল। এরপর ঈশানের পছন্দের সবকিছু পড়ে নিল। যতবারই মৃত্তিকা শাড়ি পড়তো ততবারই ঈশান সবসময় তার খোঁপায় গাজরা পড়িয়ে দিতো। সবসময় এটার বায়না বেশি করতো। এরপর গাজরা পড়িয়ে দিয়ে কিছুসময় এক পলকে তাকিয়ে থাকতো।
মৃত্তিকা ঝটপট তৈরী হয়ে গাজরাটা না পড়ে হাতে নিয়ে ঈশানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
-‘এই যে, উঠুন। আজ আমি আপনার পছন্দের শাড়িটা পড়েছি। প্রতিবার আমি গাজরা পড়লে আপনি সেটা খুলে আবার নতুন করে নিজে পড়িয়ে দিতেন তাই আজ আমি আর গাজরা পড়িনি, আপনার হাতে পড়বো বলে। পড়িয়ে দিবেন না?’

এরপর মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে ঈশানের সাড়া-শব্দ না পেয়ে নিজে গাজরাটা পড়ে নিল। এরপর বাচ্চার মতো হেসে উঠলো।

রিনি মৃত্তিকাকে এসে জড়িয়ে ধরলো তাতেও মৃত্তিকা শান্ত না হওয়াতে আরও কয়েকজন মহিলাসহ মৃত্তিকাকে ধরে রুমে এনে ফেলল।

কিছুক্ষন পর একজন এসে মৃত্তিকার উদ্দেশ্যে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘মা, তোমার স্বামীকে শেষবারের মতো দেখে নাও। আসো।’

মৃত্তিকা ঝাপ্টা মেরে বলে উঠলো,
-‘উনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। তাই এটা শেষবার নয়। আপনি জানেন না আন্টি।’

এরপর মৃত্তিকা দৌড়ে ঈশানের খাঁটিয়ার পাশে গেল। সবাই তখন খাটিয়া তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মৃত্তিকা ঈশানের কানে ফিসফিস করে বলে উঠল,
-‘এই যে শুনুন। প্রথমবার আপনাকে বলছি, ভালোবাসি আপনাকে। বড্ড ভালোবাসি আপনাকে ঈশান সাহেব।’

এরপর পর সবাই খাটিয়া তুলে রওনা দিল। মৃত্তিকা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ না ঈশানের খাটিয়া চোখের আড়াল হচ্ছে ততক্ষন তাকিয়ে রইল।

————–

পরিশিষ্ট:
পরপর কয়েকটা গাড়ি এসে থামলো একটা ভবনের সামনে। সামনে-পেছনের গাড়ি থেকে গার্ড এসে মাঝখানের গাড়িটার দরজা খুলতেই এক সুদর্শন আধ-বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো। তিনি সবাইকে রেখে ভবনটাতে ঢোকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ভবনের উপর সাইনবোর্ডে গুটি গুটি অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা,’মানসিক হাসপাতাল’।

লোকটা ভবনের ভেতর ঢুকতেই একজন কর্মচারী এসে একটা বড়ো রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে চলে আসলো।

লোকটা অন্ধকার রুমের আশেপাশে তাকিয়ে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে একটা ডাইরি জড়িয়ে ধরে এক জীর্ণসির্ণ কালো শাড়ি পরিহিতা নারীটিকে দেখে ছলছল চোখে মলিন হাসলো।

নারীটিকে ইশারায় ডাকলো লোকটা। নারীটি প্রথমে আসতে চাইলো না। পরে আবার কী বুঝে ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে আসলো। শাড়ির পেছনের লম্বা আঁচলটা নিচে মেঝেতে পড়ে আছে। আগের মতো সেই মায়াবী চেহারাটা আর নেই। পরনের শাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে কতদিন ধুই না। চুলগুলো এলোমেলো। হাতে একটা ময়লা-যুক্ত গাজরা আছে। বুঝা যাচ্ছে না, এটা গাজরা না কি কোনো ময়লা-যুক্ত লম্বা কিছু!

নারীটি লোকটির সামনে দাঁড়াতেই লোকটি কিছু সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

-‘আমি দুঃখিত মৃত্তি। তোমার কাছে দেওয়া আমার সম্পূর্ণ পরিচয়’টাই মিথ্যে। আমার বাবা উপরমহলের এক কর্মকর্তা ছিলেন। আমিও সবেমাত্র অফিসার পদে ঢুকেছিলাম। নারী পাচারের পেছনে তোমার মামার হাত আছে সেটা বাবা জানতো কিন্তু কোনো প্রমান ছিল না। বাবার আদেশে আমি সেই মেডিকেলে পড়তে গিয়েছিলাম যাতে করে তোমার পাশাপাশি ঈশানের সানিধ্য লাভ করে প্রমান সংগ্রহ করতে পারি। কাজ’ও ঠিকঠাক হলো। সেদিন ঈশানকে মারা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। উপরমহলের কড়া নির্দেশ ছিল যাতে ঈশানকে গ্রেপ্তার করি। কিন্তু আমি ঈশানকে গ্রেপ্তার করলে চোখের সামনে তোমাকে ঈশানের সাথে দেখা করতে বারবার দেখতাম। যেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই তো ঈশানকে না চাইতেও দুর্ঘটনার শিকার হতে হলো। আমাকে ক্ষমা করে দিও মৃত্তি। তোমার সাথে অভিনয় করতে করতে এভাবে সত্যিকারের ভালোবেসে ফেলবো তা কল্পনাও করিনি। ভীষণ ভালোবাসি মৃত্তি তোমায়। তোমার এই অবস্থায় আমি ভালো নেই। দিন শেষে তোমার স্মৃতি নিয়ে আজ দশবছর কাটিয়ে দিয়েছি। তোমাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না মৃত্তি। জানো?

আমার আকাশটা আর সবার মতো নীল নয়! আমার আকাশে শরতে সাদা মেঘ খেলা করে না ;বর্ষায় এই আকাশ সবার সামনে কাঁদতেও পারে না! আমার আকাশটা বড়োই অদ্ভুত ;ছয়রঙা!বড়োই শান্ত, ভীষণ একা!

তোমার এই কষ্ট দেখে আমি মোটেও ভালো নেই। আজ, তোমার এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র আমি দায়ী। আমার এই ছাড়া উপায় ছিল না। ক্ষমা করে দিও আমায়।’ রিফাত কাঁদতে কাঁদতে রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল।

মৃত্তিকা নিশ্চুপ শান্ত ভঙ্গিতে রিফাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
হাতের ডায়রিটা চোখের সামনে ধরলো। এই ডায়রিটা প্রতিদিন পড়তে পড়তে তার মুখস্ত হয়ে গিয়েছে তবুও একদিনও বাদ যায়নি।

ডাইরিতে গুটি গুটি অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা,

“প্ৰিয় মৃত্তি,
ক্ষমা করে দিও মৃত্তি আমায়। আমি বেঁচে থেকেও মরার মতো হয়ে আছি। দিনশেষে তোমাকে কাছে পায় বলেই এই জীবনটা সার্থক মনে হয়। আমি পাপের রাজ্যে আছি সেই ছোটকাল থেকেই। সেদিন কিডন্যাপারদের হাত থেকে আমিই তোমাকে বাস স্ট্যান্ডে এনে রেখেছি। আরেকটা বড়ো সত্য, তোমার জীবনের এক অংশ জুড়ে অবস্থান করা সিয়াকে আমিই মেরেছি। আমি দেশের বাইরে যায়নি। পাচার কাজের জন্য কয়েকদিন লুকিয়ে থাকতে হতো তাই তোমাকে মিথ্যে বলেছি। সেদিন সিয়া হোস্টেলে আসার পথে বাস স্ট্যান্ডে আমাকে দেখে আমার পিছু নেয়। আমার পিছু নেয়ার ফলে আমার কিছু কাজ সম্পর্কে সে অবগত হয়ে গিয়েছে। আমি জানি, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে ও সবকিছু তোমাকে বলে দিবে। কিন্তু আমি এই জীবনে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তোমার ঘৃণা নিয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি মৃত্তি। সিয়াকে আমি আমার বোনের নজরে দেখতাম। না চাইতেও তাকে মারতে হয়েছে আমার। ক্ষমা করে দিও আমায়। এই হাত দিয়ে আমি অনেক পাপ কাজ করেছি। এই কথাগুলো তোমাকে মুখে বলার সাহস আমার কোনোদিনও হতো না। আমি জানি, আমার জীবন সংকটে আছে। যেকোনো সময় আমার প্রাণ যেতে পারে। তাই এগুলো লিখে রিনির হাতে ডাইরিটা দিয়েছি। আমি যদি কোনোদিন হারিয়ে যায় তখন যেন রিনি তোমাকে এই ডাইরিটা হাতে দেয়। মরার পর যদি ডাইরিটা পড়ে আমাকে ঘৃণা করো তবুও কোনো আফসোস হবে না কারণ বেঁচে থাকতে অন্তত কয়েকদিন হলেও তো তোমার ভালোবাসা পেয়েছি।

‘মৃত্যু ছাড়া বিষাদের গল্প’গুলো থেকে মুক্তি পাওয়া বড়োই কঠিন ‘

কিন্তু আমার তোমার সাথে বাঁচার তীব্র ইচ্ছে। যদি বেঁচে থাকি? প্রমিস করছি, আমি পাপের রাজ্য ছেড়ে দিবো। এমন পাপকাজ আর কোনোদিন করবো না। এই পাপের রাজ্যে কেউ একবার ঢুকলে বের হতে পারে না কিন্তু আমি ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। যেখান থেকে কেউ চাইলেও আমাদের আলাদা করতে পারবে না। আমি বাঁচলে তোমার সাথেই বাঁচতে চায় মৃত্তি।
ধৈর্য ধরো, আর কয়েকদিনের ভেতর আমরা সুদূর অনেক দূরের দেশে পাড়ি দিবো। যেখানে আমাদের মাঝখানে কেউ আসবে না। ভালোবাসি মৃত্তি।”

ইতি
ঈশান,

মৃত্তিকা ডাইরিটা বন্ধ করে খোলা এলোমেলো চুলে চোখ বন্ধ করতেই অশ্রু ঝরে পড়ল। ভেবেছিল, তার জীবনে বুঝি এতদিনে রঙিন রোদ এসেছিল কিন্তু তাও ক্ষনিকের!

#সমাপ্ত।