#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১২
প্রহরের ভাবনার মাঝে কেউ চলন্ত রিকশায় একলাফে উঠে পড়লো। ধাড়াম করে তার পাশে বসে পড়তে চমকে গেল সে। তাকিয়ে দেখলো, অনুভব ঘর্মাক্ত শরীরে তার পাশে বসে পড়েছে। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল প্রহর। সে কি কল্পনায় ভাসছে? অনুভব একই রিকশায় তার সাথে। এ-ও কি সম্ভব? বিস্মিত হয়ে অনুভবের দিকে চেয়ে রইলো। তার ঘোর কাটলো রিকশাওয়ালা মামার ডাকে। তিনি চেঁচিয়ে বলছেন,
‘এমনে রিকশায় উইঠলেন ক্যান? উনি রিজার্ভ যাচ্চে।’
রিকশা থেমে আছে। অনুভব কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছে না৷ প্রহর দ্রুত বলল,
‘মামা, আপনি যান। উনি আমার পরিচিত।’
রিকশাওয়ালার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বয়স তিরেশের কোঠা পেরিয়েছে। এসব মান অভিমান চট করে বুঝতে পারে। রিকশা আবার চলতে শুরু করলো। প্রহর মাথা ঘুরিয়ে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভব এক হাতে শার্টের উপরের দুটো বাটন খুলে ফেলল। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। কপাল কুঁচকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর তাতে পক্ষপাত করলো না। চিন্তিত মুখে বলল,
‘এত ঘেমে গেছেন কেন?’
অনুভব কিছু বলল না। প্রহর আবার বলল,
‘কি হলো? কথা বলছেন না কেন?’
‘তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমাকে? কি মনে করো নিজেকে?’
‘আশ্চর্য! রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ ছাড়া আর কিছু পারেন না?’
অনুভব উত্তর দিল না। তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চলমান রাস্তায়। সে এখন ব্যস্ত নগরীর ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষ দেখতে ব্যস্ত। আর প্রহর এসব অবহেলা গায়ে মাখলো না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাকে দেখতে। আচমকা সে অবাক হয়ে বলল,
‘সে কি! আপনি আমার সাথে এক রিকশায় উঠার জন্য ভার্সিটির গেইট থেকে দৌঁড়ে এসেছেন এতদূর। তাই না? হায়রে! আপনার বাচ্চা বাচ্চা বন্ধুদের এত ভয় পান? কিসের এত লজ্জা পান বলুন তো? আমরা তো স্বা…….’
‘চুপ!’
প্রহরকে ধমক দিয়ে অনুভব থামিয়ে দিল। অস্থির চোখ দুটো আবার দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত করলো। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া বলে দিচ্ছে প্রহর খুব একটা মিথ্যে বলেনি। প্রহর মুচকি হাসলো। খোলা আকাশের নিচে রিকশা মৃদু তালে এগিয়ে চলেছে। প্রহর কোলের উপর রাখা ব্যাগটা চেপে ধরে অনুভবের কাছ ঘেঁষে বসলো। অনুভব কটমট চোখে তার দিকে তাকাল। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। অনুভবকে জ্বালাতে বেশ ভালো লাগছে৷ এই সময়টার অপেক্ষায় ভীষণ ভয়ে ভয়ে কেটেছে তার দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী। কতবার একই রিকশায় তার পাশে বসার চেষ্টা করেছে৷ প্রতিবার কোনো না কোনো ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আজ দ্বিগুণ করে সব ফেরত পাবে বলেই এতদিন টুকরো টুকরো করে কষ্ট পেয়েছে বোধ হয়।প্রহরের বুকের ভেতর সুখপাখিরা উড়াউড়ি শুরু করলো। অনুভূতি গুলোর সুখের পাখা ঝাপটানোর শব্দে বুক ভরে গেল। সাহস নিয়ে অনুভবের ডান হাতটা চেপে ধরলো। অনুভব এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। গলার স্বর নিচু করে বলল,
‘বেশি বাড়াবাড়ি করবে না প্রহর। ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দিবো কিন্তু। এক রিকশায় উঠেছি বলে ভেবে নিও না তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওইদিন কখনো আসবে না। খালি রিকশা পাচ্ছিলাম না বলে বাধ্য হয়ে উঠেছি। কোনো মেলোড্রামা করবে না। আমি সহ্য করবো না।’
ইতোমধ্যে আকাশে মেঘ জমা শুরু করেছে। দূর-দূরান্ত থেকে পুঞ্জীভূত মেঘ এসে জমাকৃত হচ্ছে মাথার উপর। সূর্য মুখ লুকিয়েছে কালো মেঘের আড়ালে। প্রহরের মুখের হাসিটুকুও কোনো কালো মেঘের টুকরো শুষে নিল যেন। অনুভবের উপর অভিমান জমলো। সে অনুভবের থেকে সরে বসলো। রিকশা ওয়ালার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল,
‘মামা গাড়ি থামান। আমি নেমে যাব।’
অনুভব চমকে গেল প্রহরের কথায়। ঝটপট বলল,
‘না! মামা গাড়ি থামাবেন না। আপনি চালিয়ে যান।’
‘মামা, গাড়ি থামান বলছি।’
অনুভব আবারও বাঁধা দিয়ে গাড়ি থামানোর নিষেধ করলো। রিকশাওয়ালা পড়ে গেল ফ্যাসাদে। দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলল,
‘কার কথা শুনমু? আমি তো বিপদে পইড়া গেলাম।’
প্রহর এবার জোর গলায় বলল,
‘আপনাকে গাড়ি থামাতে বলেছি। থামান! নাহলে আমি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিবো।’
প্রহরের কন্ঠের দৃঢ়তা দেখে ভড়কে গেল অনুভব। এই মেয়েকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। নিজের জীবনের মায়া না করে সত্যি সত্যি লাফ দিয়ে দিতে পারে৷ সে অতিসত্বর প্রহরের ডান হাত চেপে ধরলো। তবুও প্রহরের ছুটোছুটি কমলো না। বাধ্য হয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো যাতে লাফ দিতে না পারে। রিকশাওয়ালাকে বলল,
‘মামা, আপনি টেনশন নিবেন না। সাবধানে গাড়ি চালান।’
অনুভবের বাহুডোরে প্রহর স্থির হয়ে গেল। তার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। ঠোঁট চেপে হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করলো। খুব একটা সফল হলো না। বাধ্য হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে রাখলো যাতে অনুভবের চোখে না পড়ে। কিছুটা সময় অতিক্রম হওয়ায় পর সে আড়চোখে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভব মুখটা পাংশুর মতো করে বসে আছে। সে হাসি চেপে মনে মনে বলল,
‘বেয়াদব ছেলে! শুধু হাত ধরতে চাইলাম তা তো তোর ভালো লাগলো না। এখন জড়িয়ে ধরে বসে থাক! হাত ধরতে দিবি না? এখন থেকে তুই হাত ধরতে দিবি, এরপর চুমু খেতে দিবি আরো কতকিছু! তুই শুধু দেখতে থাক, তোকে দিয়ে আরো কি কি করাই। এই প্রহরকে তুই এখনো চিনতে পারিসনি।’
গলির মোড়ে পৌঁছানোর আগেই ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। অনুভব চমকে প্রহরকে ছেড়ে দিল। দ্রুত রিকশার হুড তুলে দিল। হুটহাট বৃষ্টিতে ভিজলে নিশ্চিত অসুস্থ হয়ে যাবে। আশপাশে দমকা হাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। রিকশাওয়ালা বেশি জোরে গাড়ি চালাতে পারছে না। অনুভব মুখ ঘুরিয়ে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর ওড়না সামলাতে ব্যস্ত। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে তার ওড়না পাল তোলা নৌকার মতো উড়ে চলেছে। একটা অংশ এসে অনুভবের চোখে মুখে আছড়ে পড়লো। মিষ্টি একটা সুগন্ধ তার নাক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। অক্সিজেনের সাথে মিশে সেটা কোষাভ্যন্তরে পৌঁছে গেল। শীতল এক পরশে ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিল সে। ওড়নাটা ধরে প্রহরের পিঠের কাছে দিয়ে পেঁচিয়ে সামনে ধরিয়ে দিল। আর ছুটোছুটি করলো না। কিন্তু এবারে প্রহরের অল্প বিস্তর চুল উড়ে এসে গলার কাছটায় বার বার স্পর্শ করলো।
অনুভব গলা চুলকে ঘাড় কাত করলো। মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
‘নিজেকে সামলে রাখো।’
প্রহর তার চেয়ে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘কথায় কথায় মেজাজ দেখাবেন না একদম। আমি কি আপনার গায়ের উপর ঢলে পড়ছি?’
‘একবার তোমার ওড়না ঢলে পড়ছে। একবার তোমার চুল ঢলে পড়ছে। তুমি ঢলে পড়তে কতক্ষণ!’
অনুভবের কথাটা প্রমাণ করার জন্যই হয়তো গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলো। আচমকা হওয়ায় প্রহর ব্যাগ সমেত অনুভবের গায়ের উপর ঢলে পড়লো। অনুভব শ্বাস ফেলে বলল,
‘প্রমাণ হাতেনাতে পেলে। এবার কি বলবে?’
প্রহর কিছুটা অগোছালো হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলো গলির মাথায় রিকশা পৌঁছে গেছে। সে উঠার সময় এই জায়গার কথা বলেছিল। অনুভবের তোয়াক্কা না করে সে দ্রুত রিকশা থেকে নামলো। সঙ্গে সঙ্গে শীতল বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে আছড়ে পড়তে লাগলো। শীতল অনুভূতিতে শিড়দাঁড়া নড়ে উঠলো। ব্যাগ হাতড়ে টাকা বের করতে নিতে অনুভব ধমকে বলল,
‘তোমার বাবার টাকার গরম আমাকে দেখাবে না।’
বলে সে টাকা বের করে দিল। রিকশাওয়ালা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। প্রহর মাথা নিচু করে গলির ভেতর ঢুকতে উদ্যত হলো। অনুভব তার পাশে এসে বলল,
‘মাথা ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নাও। বৃষ্টির পানি যেন না পড়ে।’
‘এই ওড়নায় বৃষ্টির পানি আটকাবে? অলরেডি ভিজে চুপসে গেছি।’
অনুভব আর বাক্য ব্যয় করলো না। প্রহর পা টিপে টিপে সামনে এগোচ্ছে। সে তার পেছন পেছন। পেছনে রয়েছে যাতে প্রহর পড়ে গেলে ধরতে পারে। সে চাচ্ছে না এই নোংরা গলির নোংরা পানি প্রহর গায়ে মাখুক! শ্বাস ফেলে সে প্রহরের দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ শীতল এক কাঁপুনি দিয়ে উঠলো দেহে। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। লম্বা গলির এমাথা থেকে ওমাথা পরখ করে দেখলো কেউ নেই। সে চাইছে না ভেজা পোশাকে প্রহরকে অন্য কেউ দেখুক। গলার স্বর উঁচু করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি হাঁটো।’
‘পড়ে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙলে আপনি কোলে করে রাখবেন তো?’
বলে প্রহর দাঁড়িয়ে পড়লো। হালকা ঘুরে অনুভবের মুখের দিকে তাকালো। অনুভবও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার দৃষ্টি আটকে গেল প্রহরের ভেজা ঠোঁটের উপর। আকাশ থেকে পাহাড়ি ঢলের মতো বৃষ্টি পড়ছে। কাঁটার মতো শরীরে বিঁধছে একেকটা ফোঁটা। দুজনের শরীর ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। এরই মধ্যে দুজন একে অপরের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছে যেন।
পূর্ব-পশ্চিম কোণে বিজলি চমকাতে অনুভবের ঘোর কাটলো। প্রহরকে অতিক্রম করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। পেছনের এইসব মরীচিকা। নিজেকে মরীচিকার মায়ায় পড়তে দেওয়া যাবে না। প্রহরও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। কোনো ধরনের বিপত্তির সৃষ্টি করলো না। অনুভবের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো অনুভব। কিছুক্ষণ পর প্রহর এসে তার পাশে দাঁড়ালো৷ ভুলেও প্রহরের দিকে তাকালো না সে। তার দৃষ্টি টিনের চাল থেকে পড়া বৃষ্টির চিকন ধারার উপর আবদ্ধ রইলো। প্রহর এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দরজায় টোকা দিল। বৃষ্টিতে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে শীতল গলায় ডাক দিল,
‘মা, দরজা খুলুন।’
দরজা খুলে গেল। ফাতেমা বেগম দুজনকে দেখে চমকে গেলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি করে ভেজা কাপড় পাল্টে নাও।’
‘হু!’
প্রহর উত্তর দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ফাতেমা বেগম তসবিহ হাতে নিজের রুমে ঢুকে গেলেন। অনুভব সদর দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে নিজের রুমে ঢুকলো। কেমন সম্মোহনের মতো তার চলাফেরা। উদ্ভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। মাথার ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।
অনুভবের এত নিশ্চুপতা প্রহরের অতল স্পর্শ করলো। সে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে এলো। অনুভব কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করলো না। বাতাসে জানালার একটা পাল্লা খুলে গেছে। বৃষ্টির ঝাপটা এসে মেঝের অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে। প্রহর এগিয়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো অনুভব সম্মোহনী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন মায়াময় সে দৃষ্টি। খোলা বইয়ের মতো। না বলা সব কথা যেন এক নিমেষে পড়ে ফেলা যায়। প্রহর নিজেও সম্মোহনের মতো এগিয়ে গেল। অনুভবের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
(চলবে)