অনুভবের প্রহর পর্ব-২১

0
511

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২১

মাত্র তিনদিনের জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন ফাতেমা বেগম। বাড়ির সকলের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজমান। অনুভবের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মুখ শুকিয়ে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো, নির্ঘুম চোখ দুটোতে একরাশ শূণ্যতা! আসগর সাহেব কিছুক্ষণ পর পর ডাক্তার নিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু শরীরের দূর্বলতা কিছুতেই কমছিল না। সাথে না কমছিল জ্বর! শেষমেষ অনুভবের কথামতো তাকে সদরে ভর্তি করা হয়। বেসরকারি হাসপাতাল! খোঁজাখুঁজি করে ভালো ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।

দিন দুই হাসপাতালে কাটানোর পর ফাতেমা বেগম কথা বলার শক্তি পান। অনেকখানি সুস্থতা বোধ করেন। ছেলেকে ধমকে ধামকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করতে বলেন। পরে সেদিন সন্ধ্যায় তাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। বোনের রোগমুক্তি উপলক্ষে সেই রাতে রান্নার আয়োজন করেন আসগর সাহেব। দূরের গঞ্জের হাট থেকে তিনি বিশাল সাইজের রুই মাছ নিয়ে আসেন। রাতের বেলা ফাতেমা বেগম নিজ হাতে ছেলেকে আর ছেলের বৌকে খাইয়ে দেন!

কয়েকদিনের ধকলে অনুভবের কাহিল অবস্থা। খাওয়া শেষ করে মায়ের কথামতো ঘুমাতে গেল। প্রহর বরাবরের মতো মায়ের সাথে ঘুমানোর বায়না ধরলো। অনুভব বাধ সাধলো না। ঢুলুঢুলু চোখে রুমের দিকে এগোল। বিছানায় শোয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় চোখে গাঢ় ঘুম নেমে আসে তার।

______

শেষ রাতে অনুভবের ঘুম ভাঙে তার মামির চিৎকারের আওয়াজে। অনবরত দরজায় আঘাত করে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সে। দরজা খুলতে দেখতে পেল মামির উদ্বিগ্ন মুখ। অনুভব চোখ ডলে বললো,

‘কি হয়েছে মামি? এমন…. ‘

তার কথা মামি শুনতে পেলেন কি না বোঝা গেল না। ঝটপট বললেন,

‘তোমার মা! বুবুজান, কেমুন জানি করতাছে।’

অনুভবের ঘুম ছুটে গেল এক নিমেষে। বুক কেঁপে উঠলো। এক দৌঁড়ে দক্ষিণের রুমে গেল। মাকে ঘিরে ভয়ার্ত কিছু মুখ। দরজা ধরে সে কম্পিত কন্ঠে শুধাল,

‘মা-মা! কি হয়েছে?’

‘তোর মাকে ধর তো অনুভব। শ্বাস নিতে পারছে না। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।’

প্রহরের চোখ টলমল করছে। মুখে ভয়ার্ত ছাপ। অনুভব পথ ভোলাদের মতো টলতে টলতে এগিয়ে গেল। মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গাল স্পর্শ করলো। রুদ্ধ কন্ঠে কয়েকবার ‘মা’, ‘মা’ বলে ডেকে উঠলো। বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার। আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠলো সে।

আসগর সাহেব একনাগাড়ে ফোন করে চলেছেন। টানা সপ্তম বারের মতো গ্রাম্য ডাক্তার ফেরদৌস ফোন তুলল। তিনি ঝটপট তাকে ডাক্তারি সরঞ্জাম নিয়ে আসতে বললেন। সাথে নিজেও ছুটলেন এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য।

মিনিট বিশেক পরে তিনি যখন ডাক্তার নিয়ে ফিরলেন তখন চারিদিকে ফজরের আযান শুরু হয়েছে। মোড়ের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে শাহীন নামক যুবক ছেলেটির কন্ঠ। সুমধুর সুরে উচ্চারণ করছেন, ‘আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর!’ বোনের রুমে ঢুকতে সবার অথর্ব মুখ দেখতে পেলেন। বিছানায় নড়চড় হীন, চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা বোনকে দেখে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে যখন বিমর্ষ মুখে তাঁর দিকে তাকালেন ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি৷ পাশ থেকে স্ত্রী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

আসগর সাহেব দিশাহারা দৃষ্টি রাখলেন অনুভব নামক জন্মদুঃখী ছেলেটার দিকে। সে পাথরের মতো নিশ্চুপ। শূণ্য দৃষ্টি মেলে একনাগাড়ে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। ভেতরে যে কতটা রক্তাক্ত আর অসম যুদ্ধ চলছে তা বুঝতে পারলেন। তাঁর বড় ভয় হলো অনুভবকে নিয়ে। বোনের নিথর দেহটার দিকে তাকাতে হৃদযন্ত্রের পুরনো ব্যথাটা নাড়া দিয়ে উঠলো। চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

_____

মানুষের জন্ম সংবাদের চেয়ে মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফাতেমা বেগমের ক্ষেত্রে তার বিকল্প ঘটলো না। বাতাসে ভর করে মৃত্যুর খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন ভিড় জমাতে লাগলো। গ্রামের প্রতিবেশীরা মুখ ভার করে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রহর ভোর রাত থেকে ফাতেমা বেগমের শিয়রের কাছে বসে ছিল। কাঁদতে কাঁদতে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। চোখ ফুলে গেছে। কাছের কেউ, আপন কেউ, প্রিয় কেউ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলে সে অনুভূতি কেমন হয় তা জানা ছিল না। কতটা কষ্ট হয়, ঠিক কতবার কলিজায় অদৃশ্য কিছু হাতুড়ি চালায় তা অজ্ঞাত ছিল। বড় হওয়ার পর কাছে থেকে কাউকে মরতে দেখেনি সে। দাদা-দাদী, নানা-নানি সবাই তার ছোটবেলায় মারা গেছে। সেসব মৃত্যুর ঘটনা তার স্মরণে নেই। কিন্তু জীবনে প্রথম কাউকে কাছ থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দেখলো। আর সেই মানুষটা তার খুুব আপন। তার কেমন পাগল পাগল লাগছে। গতকাল রাতেও যেই মানুষটা তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল সেই মানুষটাকে কিছুক্ষণ পর দেখতে পাবে না ভাবতে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

বহুদিন পর আজ কড়া রোদ উঠেছে। ভোরের কুয়াশা বিদায় নিয়েছে। ঝকঝকে প্রকৃতি! আকাশ শরতের মতো উজ্জ্বল ও পরিষ্কার। দুপুরের নামাযের পর জানাযার সময় ঠিক করা হয়েছে। মৃতার শেষ গোসল সমাপ্ত!

বারোটার দিকে প্রহরের বাবা-মা এলো নিজস্ব মাইক্রোবাসে। মাটির রাস্তা ধরে এসে সেটা থামলো বাড়ির সামনে! সমস্ত গ্রামের লোক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। এক কান, দু-কান করে দ্রুত সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়লো। কৌতূহল নিয়ে সবাই অবলোকন করলো এই শহুরে মানুষগুলোকে।

মিসেস রাবেয়া চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে প্রহর দৌঁড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা বলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মিসেস রাবেয়া মেয়েকে আগলে নিলেন। দু চোখে অশ্রু ভিড় করলো তাঁর। গত মাসে যখন তিনি প্রহরকে দেখতে গিয়েছিলেন তখন মানুষটা সুস্থ, স্বাভাবিক ছিল। কত গল্পগুজব করছিলেন দুজন। অথচ সেই মানুষটা হঠাৎ করে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আচমকা মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তৎক্ষনাৎ গ্রামে আসার সিদ্ধান্ত নেন। একা আসার জন্য রওনা দিতে প্রহরের বাবা গাড়িতে উঠে বসলেন। এতে অবশ্য ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠেছিলেন তিনি। প্রহরের বাবা যে আসবে সেটা আশা করেনি।

প্রহরের কান্না কমে আসতে তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিলেন। জিগ্যেস করলেন,

‘অনুভব কোথায়?’

প্রহর ভেজা দৃষ্টি মেলে এদিক ওদিক তাকালো। অনুভব তো এতক্ষণ মায়ের পাশে বসেছিল। হঠাৎ কোথায় গেল? কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তার। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে সচেতন হলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘মা! তুমি থাকো। আমি দেখি অনুভব কোথায় গেল। রাত থেকে উনাকে চোখে চোখে রাখছি। উনি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি মা! পাথরের মতো নিশ্চুপ বসে রয়েছে। আমি ভয়ানক চিন্তায় আছি। কখন কি করে ফেলে! আমি আসছি!’

প্রহর দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। মিসেস রাবেয়া পেছন থেকে বললেন,

‘প্রহর তোর বাবা এসেছে! ‘

প্রহর শুনতে পেল না বোধ হয়। সে আগের মতো ছুটে চলে গেল। মিসেস রাবেয়া চোখ মুছলেন। প্রহর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব চলে এসেছে। ত্বকের সেই উজ্জ্বলতা নেই! মেয়ে যে একটু কষ্টে আছে তা বেশ বুঝতে পারলেন। থাকুক না একটু কষ্টে! ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে গেলে, এক টুকরো শান্তি দুজন ভাগাভাগি করতে গেলে এতটুকু কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে! তাঁর বিয়ের প্রথমদিকের কথা মনে পড়লো। তিনি যখন পরিবারের অমতে গিয়ে প্রহরের বাবাকে আপন করে নিয়েছিলেন তখন বড্ড অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল। প্রহরের বাবা তখন বেকার। চাকরির জন্য সারা ঢাকা চষে বেড়াচ্ছেন। শেষমেশ চাকরি হলো তার। তারপর কত চড়াই উৎরাই পার করে আজকের অবস্থানে। তার মেয়েও হয়তো রাজরানি হবে। সুখী হবে!

_______

অনুভব বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার পর। তার দৃষ্টি নত। আশপাশের কোনো খেয়াল নেই। পা টেনে টেনে চুপচাপ নিজের রুমে ঢুকলো। দরজাটা বন্ধ করে পেছন ঘুরতে প্রহরের চোখে চোখ পড়লো। বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অনুভব দেখেও যেন দেখলো না। শূণ্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে গেল। খোলা জানালা বন্ধ করে দিল। বিছানায় পড়ে থাকা গতরাতের শার্ট গুলো ভাঁজ করলো। গায়ের সাদা পাঞ্জাবি খুলে টিশার্ট পরে নিল। এলোমেলো ভাবে রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ফের জানালার কাছে গেল। জানালার পাল্লায় হাত রাখতে প্রহর নরম গলায় জিগ্যেস করলো,

‘আপনি ঠিক আছেন?’

অনুভব যেন শুনেও শুনলো না। আগের মতো নির্বিকার ভাবে জানালার পাল্লা খোলার চেষ্টা করলো। প্রহর বাঁধা দিল। বাম হাত স্পর্শ করে বলল,

‘এমন করছেন কেন?’

‘কি করছি? চুপচাপ রয়েছি থাকতে দিবে না?’

‘আমার সাথে কথা বলুন।’

‘প্রহর, আমি ঘুমাতে চাই। ডিস্টার্ব করবে না একদম। নিঃশব্দে রুম থেকে বের হয়ে যাও।’

ধাক্কা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল অনুভব। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। জানালার পাল্লা খুলে ঘন ঘন শ্বাস নিল। প্রহর ফের তার বাহু চেপে ধরলো।

‘অনুভব এমন করছেন কেন? একটু শান্ত হন৷ কান্না করতে চাইলে কান্না করুন। প্লিজ এমন করে থাকবেন না। আমার ভয় করছে!’

অনুভবের নির্বিকার ভঙ্গিতে ভাটা পড়লো না। শুধু কপালের রগ ফুলে ফেঁপে উঠলো। চোখের দৃষ্টি লাল হয়ে গেল। প্রহরের চোখের কোণে অশ্রু জমলো। সত্যি সত্যি বুক কাঁপছে তার। মানুষটাকে নিয়ে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। সেই ভোর রাত থেকে অনুভবের এত কঠিন রূপ, নির্বিকার ভঙ্গি সে নিতে পারছে না। হঠাৎ জোরপূর্বক টেনে অনুভবকে নিজের দিকে ঘুরালো। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার আগেই স্ব শব্দে থাপ্পড় পড়লো গালে। চমকে উঠলো প্রহর। ডান হাতটা বাম গালে চলে গেল। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো অনুভবের পানে। অনুভব চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘কখন থেকে বলছি, ডিস্টার্ব করবে না! কথা কানে যায় না? চোখের সামনে থেকে দূর হও। এক্ষুণি! না হলে খুন করে ফেলবো।’

কিছু মুহূর্ত গেল। প্রহর দূর হলো না৷ ঝাপসা চোখে অনুভবের কাছ ঘেঁষে এলো। আলতো করে ডান হাতটা বুকে রাখলো। কাতর স্বরে বলল,

‘গতরাতে মায়ের সাথে আমার কি কথা হয়েছে শুনবেন না আপনি?’

অনুভবের দৃষ্টির লাল আভা মুছে যেতে শুরু করলো। শূণ্য চোখের কোণে জমতে শুরু করলো বিন্দু বিন্দু পানি। ক্ষণিকের ব্যবধানে তা অতলস্পর্শী সমুদ্রে রূপ নিল। সে সমুদ্রে সৃষ্টি হলো বাঁধ ভাঙা ঢেউ। শরীর কেঁপে উঠলো তার। পা জোড়া ভেঙে এলো। বুকের ভেতরের ক্ষত বিক্ষত আঘাতে কেউ বিরতিহীন ছুরি চালাতে লাগলো। ‘মা নেই! মা পৃথিবীতে নেই।’ উপলব্ধি করতে পেরে দিন দুনিয়া আঁধার হয়ে এলো। আচমকা প্রহরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। মা, মা বলে চিৎকার করে উঠলো। এই কান্নার উৎস হৃদয়ের খুব গভীরে। এই কান্নার সুর ভয়ানক! এই কান্নার সুরে প্রকৃতি নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। পাখিরা ডাকতে ভুলে যায়! প্রহরেরও বুকটা পুড়ে উঠলো। কিছু বলতে নিতে অনুভব জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রহর। আ-মার দম বন্ধ হয়ে আসছে!’

(চলবে)