অনুভবের প্রহর পর্ব-৩০

0
441

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____৩০

ড্রয়িং রুমে বসে আছে অনুভব। বসার ঘরটা হরেক রকমের জিনিসপত্রে ঠাসা। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকার মতো অনেক কিছু রয়েছে। রয়েছে দেয়াল জুড়ে মনোমুগ্ধকর পেইন্টিং। অনুভবের এসবে আগ্রহ নেই। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝের কার্পেটে। প্রহর বসার ঘরে নাই। না থাকা স্বাভাবিক। শরীর এখনো অসুস্থ৷ ডাক্তার নড়াচড়ায় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অনুভবের বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। চট করে উঠে প্রহরের রুমেও যেতে পারছে না। দৃষ্টিকটু দেখায়!

টেবিলে মৃদু শব্দ হলো। চোখ তুলে তাকালো সে। মুহূর্তের মধ্যে হরেক রকমের ফল আর মিষ্টিতে সামনের ছোট্ট টেবিল ভরে গেল।

‘লতিফার মা! রান্নাঘরে খেয়াল রাখো।’

প্রহরের মায়ের গলা ভেসে এলো। মিষ্টির শেষ প্লেটটা নামিয়ে রেখে লতিফার চলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রহরের মা বসার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে দু তিন রকমের শরবতের গ্লাস। অনুভবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। হাসিমুখে বললেন,

‘কিছু মুখে পুড়ে উপরে যাও বাবা। প্রহর মাথা খেয়ে ফেলছে আমার। তুমি আসছো না কেন? কখন আসবে? রাত হয়ে যাচ্ছে নাকি আর আসবে না কোনোদিন ইত্যাদি প্রশ্ন করে পাগল করে ফেলছিল।’

অনুভবের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু মানুষজনের সাথে কথা বলে অভ্যাস নেই তার। পৃথিবীতে খুব অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে সে কমফোর্টেবল। পানির গ্লাসটা হাতে নিল সে৷ কয়েক চুমুক দিয়ে বললো,

‘আপনি কেমন আছেন?’

মিসেস রাবেয়া হাসলেন। তাঁর হাসি দেখে অনুভবের স্মরণ হলো ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। আজ সারাদিনে প্রহরের মায়ের সাথে তিনবার দেখা হয়েছে। তিনবারই একই প্রশ্ন করা হয়েছে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। ফলের প্লেট থেকে এক টুকরো মুখে পুড়ে বললো,

‘আমি উপরে যাচ্ছি একটু।’

সিঁড়িতে ধুপধাপ পা ফেলে সে উপরে উঠে গেল।

ছবির মতো সুন্দর এক রুম৷ দেয়ালে জলরঙের পেইন্টিং। পেইন্টিং এ বিশালকার এক সমুদ্র। সে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে বসে আছে এক কিশোরী। অনুভবের মনে হলো সত্যিকার কোনো সমুদ্র দেখছে বুঝি। পাশেই বিশালকার এক জানালা। তার পাশের দেয়াল ঘেঁষে মস্ত এক বইয়ের তাক। বিছানার এক পাশে সাজানো গোছানো ড্রেসিং টেবিল। এর আগে একবার দু চার মিনিটের জন্য রুমটাতে এসেছিল অনুভব। এতকিছু খেয়াল করা হয়নি। আজ এক ঝলকে বুঝতে পারলো এটা একটা রাজকীয় রুম!

ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে। ধবধবে শুভ্র রঙের বিছানায় প্রহর শুয়ে আছে। চোখজোড়া বন্ধ। মাথার ঘন চুল চারপাশে ছড়িয়ে আছে। পায়ের শব্দ পেয়ে নড়ে উঠলো সে। কিন্তু চোখ খুললো না। পাশ ফিরে জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘মা, অনুভব আসছে না কেন এখনো? রাত হয়ে গেল অনেক। কখন আসবে?’

অনুভবের মনটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠলো। ভেতরে চেপে রাখা সব রকমের অস্বস্তি কর্পূরের মতো উবে গেল। আড়ালে লুকিয়ে রাখা ব্যাগটা পাশের সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখলো। তারপর সটান প্রহরের ব্লাঙ্কেটের ভেতর ঢুকে গেল। কপাল কুঁচকে গেল প্রহরের। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলতে অনুভব মাথা উঁচু করে তাকালো। তাকে দেখে বরাবরের মতো ঘুম ছুটে গেল প্রহরের। চমকে বললো,

‘কখন এলেন আপনি?’

‘কিছুক্ষণ হলো। তুমি ঘুমাওনি কেন?’

‘আপনি সত্যি সত্যি এসেছেন অনুভব? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এই দেখুন, খুশিতে চোখ ভিজে উঠেছে।’

প্রহরকে কাছে টেনে নিল অনুভব। এই মেয়েটার তীব্র অনুভূতির কাছে বার বার হার মেনে যাচ্ছে সে। এত ভালোবাসা তার কপালে ছিল? প্রহরের চুলে আঙুল ছুঁইয়ে সে বললো,

‘ঘুমিয়ে পড়ো প্রহর।’

_________

শুক্রবারের বিকেল। প্রচুর লোকজন আসছে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে ভিড় লেগে আছে প্রায়। এর মধ্যে কাজ শেষ অনুভবের। অর্ধেক বেলা শুধু। পরবর্তী সময় কাজ করার জন্য রবিন নামের ছেলেটা এসে গেছে। প্রহর মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে বলে সে কাজ শুরু করেছে আবার। তবে পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কয়েক ঘন্টা কাজে ব্যয় করে বাকি সম্পূর্ণ সময়টা প্রহরের নামে বরাদ্দ।

অনুভব আর দেরি করলো না। বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো। হঠাৎ করে নাজমুলের চোখে চোখ পড়লো। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে। চিন্তিত দেখালো অনুভবকে। নাজমুলের হঠাৎ এখানে কি কাজ পড়লো?

গোল টেবিলে বসে আছে দুজন। সামনে দুটো কোল্ড কফি। অনুভব একটা নিজের দিকে টেনে নিল।

‘হঠাৎ এখানে এলি কেন? আমি এখানে কাজ করি সেটাই বা জানলি কি করে?’

‘জেনে গেছি৷ আপনা-আপনি!’

অনুভবকে সিরিয়াস দেখালো বেশ। সরু দৃষ্টিতে তাকালো নাজমুলের দিকে। বলে উঠলো,

‘সত্যি করে বলতো। তোর রহস্যটা কি? সবকিছু আগে থেকে জেনে যাস কিভাবে?’

হাসলো নাজমুল। কিছু না বলে কফিতে চুমুক দিল।

‘তুই প্রহরের বাবার অফিসে চাকরি করিস, ওনার ডান হাত বলা চলে। সবকিছুর দেখ-ভাল রাখিস। এসব কিচ্ছু জানাসনি কিন্তু আমাকে।’

‘আহা! আমি তো জানতাম না এই প্রহর সে-ই প্রহর। আমার স্যারই যে প্রহরের বাবা সেটা তো জানা ছিল না। তোদের দূর্ঘটনার সময় জেনেছি।’

‘যা বিশ্বাস করলাম। এখন বল, হঠাৎ কি মনে করে?’

নাজমুল বরাবরের মতো বললো,

‘কেন এমনিতে দেখা করতে পারি না? তোর শরীর কেমন?’

‘ভালোই মনে হচ্ছে। ব্যথা, যন্ত্রণা আগের মতো নেই।’

‘তোকে একবার আমার সাথে যেতে হবে। কাল সময় হবে?’

‘কোথায়?’

‘তোর পাসপোর্ট রেডি করতে হবে।’

নাজমুলের স্বর অতিশয় স্বাভাবিক। অনুভব ভয়ানক চমকে গেল। তিতিবিরক্ত স্বরে বললো,

‘পাগল তোরা? নিশ্চয়ই প্রহরের কাজ এটা। নাজমুল তুই অন্তত ভালো করে জানিস আমি দ্বিতীয় বার সার্জারির মধ্য দিয়ে যাব না। আর টাকা! কত খরচ হবে আইডিয়া আছে নিশ্চয়ই? ৫০-৫২ লক্ষ টাকা তোর কাছে ছেলেখেলা মনে হয়?’

‘কিছুই মনে হয় না। শুধু জানি ইমিডিয়েট তোর পাসপোর্ট রেডি করতে হবে। দেন মাদ্রাজ যেতে হবে।’

অনুভব লাফিয়ে উঠে পড়লো। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। ডায়ালাইসিস করে, টুকটাক ওষুধ খেয়ে সে যতদিন বাচঁবে তাই এনাফ! এতগুলো টাকা সে কিভাবে খরচ করবে? তাও আবার অন্যের টাকা! পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতর বেঁচে থাকা হচ্ছে অন্যের অনুগ্রহে বাঁচা। সে কারো অনুগ্রহে বাঁচতে পারবে না। সে কাঠ কাঠ গলায় বললো,

‘আমি আগামীকাল মারা গেলেও সার্জারি করাব না। কারো অনুগ্রহে বাঁচতে পারবো না। তার চেয়ে বড় কথা, কোনো এক অসহায় ব্যক্তি কিডনি ডোনেট করবে। দু-চার বছর পর সে আমার মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য হবে। আমি কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারবো না। কোনোপ্রকার পাসপোর্ট তৈরি করতে পারবো না নাজমুল।’

‘তুই বরাবরের মতো বড্ড বোকা রে অনুভব।’

নাজমুল হাসছে। অনুভবের কপাল কুঁচকে গেছে। রাগে নাক ফুলে ফুলে উঠছে। গলার রগ দেখা হচ্ছে। আচমকা হাসি থামালো সে। মুখটা অনুভবের কাছাকাছি নিয়ে আসলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,

‘তোর সার্জারির জন্য না হলেও প্রহরের জন্য তোর পাসপোর্ট রেডি করতে হবে। প্রহরের জন্য তোকে মাদ্রাজ যেতে হবে। তোর একবার মনে হয়নি অনুভব? সামান্য চোয়াল কাটা আর দু চার জায়গা চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য কেউ আইসিইউ তে থাকে? দুদিন অজ্ঞান হয়ে থাকে? তুই এত বোকা কেন? প্রহর ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত অনুভব। ওর চিকিৎসা প্রয়োজন যা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। ওকে বাঁচানোর জন্য তোকে ভিসা তৈরি করতে হবে। কারণ প্রহর তোকে ছাড়া এক পা নড়বে না।’

অনুভব প্রচন্ড রেগে গেল হঠাৎ। চোখ দিয়ে রক্ত ছুটে বের হবে যেন। শরীর কাঁপছে থরথর করে। আচমকা নাজমুলের কলার চেপে ধরলো। চেঁচিয়ে বললো,

‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন? হুঁ? সত্যি করে বল প্রহর সুস্থ আছে। ঠিক আছে।’

‘প্রহর সুস্থ নেই। এটাই একমাত্র সত্যি। বছর পাঁচেক আগে একটা মারাত্মক এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হয়েছিল প্রহর। অবস্থা এতটা আশঙ্কাজনক ছিল যে জীবন নিয়ে টানাটানি। ওই সময় ওর ফুসফুস প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। পাঁজরের হাঁড় ভেঙে ফুসফুসে ঢুকেছিল। ভাগ্য সহায় ছিল বলে বেঁচে গেছে সে যাত্রায়। এরপর দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সময়ের অতিক্রমতার সাথে সাথে ফুসফুসের সেই ক্ষতের জায়গাতে ইনফেকশন হয়ে গেছে। শুধু ইনফেকশন হয়নি। ইতোমধ্যে ক্যান্সারের জীবাণু আক্রমণ করেছে। দ্বিতীয় বার এক্সিডেন্টের পর ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধরতে পেরেছে সব। তোর কি এখনো মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি?’

অনুভবের হাত ঢিলে হয়ে গেল। নাজমুলের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে বিন্দু পরিমাণ মিথ্যে বলেনি। মুহূর্তে তার কাঠিন্যতা ভরা চেহারায় নেমে এলো কালো দূর্যোগ। কলার ছেড়ে অসহায় ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকালো। মনের আকাশে ঘনকালো মেঘ জমতে শুরু করলো। চোখের পলকে বুকের ভেতর ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। চোখের লাল আভা মুছে গিয়ে ঝাপসা হয়ে এলো। মাথক ঘুরছে তার। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো।

(চলবে)