আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-১৬+১৭

0
688

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব-১৬

একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে গাড়ি গুলো থামলো। পড়নের কালো লেহেঙ্গা টা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল তুলি। পাশে এসে উপস্থিত হলো সাদা লেহেঙ্গা পরিহিতা আমরিন। সামনে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে পূর্ব ও রনক। দু’জনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই সৌজন্যেমূলক হাসি হাসল তুলি। একে একে গাড়ি থেকে নেমে আসল সবাই। রনক রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম সবার সাথে কুশলতা বিনিময় করে আমরিনের কাছে এসে মাথায় একটা টোকা দিল।ব্যাস! এতেই ক্ষেপে উঠল আমরিন।

“জিজু!টোকা দেওয়ার শোধবোধ হবে কিন্ত। ”

“জিজু কি শালি, আদ্র ভাইয়া কোথায়?”

আদ্রর নাম শুনে তুলির হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনদিন ধরে মানুষ টা কোনো যোগাযোগ করছে না তুলির সাথে। হুটহাট গায়েব হয়ে যাওয়া আদ্রর স্বভাব নাকি ইচ্ছেকৃত তুলি ভেবে পায় না। এই তিনটে দিন তুলির কাছে অন্ধকার মনে হচ্ছে। যেই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে তুলি,হাজারো চেষ্টা করেও হাতড়িয়ে স্পর্শ করতে পারছে না তার ডাক্তার সাহেব কে। বাসায় পায়রা জোড়ার দিকে তাকালে আদ্রর প্রতি অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে উঠে। রাগে ক্ষোভে আমরিনের কাছ থেকে জানার আগ্রহ পায় নি তুলির। কেন জানবে সে? স্বামী বলে!আদ্রর কাছ থেকে সামান্য দূরত্ব টুকু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তুলির বেহায়া মন মাঝে মাঝে বলে উঠে,” বউ হয়ে স্বামীর কাছে থাকতে পারি না,কি লাভ এমন বিয়ের?” পরক্ষণেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে সারা মুখ। বিড়বিড় করে বলে,”স্বামী ডাকের মানুষ টাই তো দূরে দূরে রাখছে। আদৌও কি ঘুচবে দূরত্ব! ” তুলির মনটা বিষাদের ভারে নেতিয়ে পড়ছে। আজ আদ্র কে খুব বেশি মনে পড়ছে। বাসায় একা রুমে চক্ষুদ্বয় অশ্রু বিসর্জন দিলেও,এ মুহুর্তে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে কন্ঠনালিতে আঁটকে আছে। আমরিনের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল তুলি। আমরিন রনকের উদ্দেশ্যে বলল,

” ভাইয়ার একটা জরুরি সেমিনারে এটেন্ড করতে হয়েছে। সেখানে ফোন এলাউড না। তাই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না।”

” হুম যাওয়ার আগে জানিয়েছিল আমায়। কিন্তু ভাইয়া তো বলেছিল আমাদের রিসিপশনের সময় ঠিক ফিরে আসবে। ”

” আমাদের আর কিছু জানায় নি জিজু। জানেনই তো ভাইয়া কেমন স্বভাবের। কাউকে কিছু বলা,কৈফিয়ত দেওয়া পছন্দ করে না। নিজের মর্জিতে চলতেই পছন্দ করে। যেখানে বাবা-ই কিছু জিজ্ঞেস করতে হাজার বার ভাবে,সেখানে আমাদের ভাইয়া কে কিছু জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস হবে না। ”

” হুম। আচ্ছা চলো। সব মেহমান চলে এসেছে। ইনশিতা আমাকে সকাল থেকে জ্বালিয়ে মারছে তোমরা কেন আসছো না প্যান প্যান করতে করতে। ভাবছিলাম আরেকটু প্যান প্যান করলে সোজা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিব। প্যান প্যান থেকে বউ বিদায় করে দেওয়া ভালো। ঠিক বলছি না শালি সাহেবা টু?”

তুলির দিকে চেয়ে হাস্যরসাত্মক কন্ঠে বললো রনক। সাথে সাথেই তুলি ও আমরিনের সারা মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দিল। খিলখিল করে হেসে তুলি সায় জানালো রনকের কথার সাথে। হাসির রেখায় তুলির ফুটে উঠা মায়াবী মুখশ্রী তে অপলক চেয়ে রইল পূর্ব। ভিতরে ভিতরে প্রতিনিয়ত ঘায়েল হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড। তুলি কে পাওয়ার তেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

” কেমন আছো তুলি?”

ঠোঁটের হাসি টা ধরে রেখেই তুলি আলতো স্বরে জবাব দিল,

” আলহামদুলিল্লাহ!আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?”

” আছি কোনো রকম। ভাইয়া সবাই ভিতরে তুমি কি তোমার শালি দু’জন কে আজ বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখার প্ল্যান করলে নাকি?”

রনক মৃদু হাসল। আমরিন ও তুলি কে নিয়ে ভিতরের দিকে পা বাড়াল। এতোক্ষণে তুলি ভালো করে বাড়ি টা অবলোকন করল। চারদিকে ফেয়ারি লাইটের আলো ঝলমল করছে। বাগানের এক পাশ থেকে ফুলের ঘ্রাণ এসে নাকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। খানিক্ষন চোখ বুঁজে নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সুবাস নিজের মাঝে টেনে নিল তুলি। পূর্ব ও রনকের সাথে ভিতরে ঢুকল দু’জন। বাহ্যিক রূপ টা যতটা না সুন্দর, বাড়ির অভ্যন্তর রূপ টা তার চেয়েও দ্বিগুণ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের মাঝে ভরপুর। মেহমানে ভরপুর চারদিক। রিসিপশন টা কোনো সেন্টারে করার কথা থাকলেও রনকের দাদী চায় নিজের বাড়িতেই হোক। তুলি আমরিনের কাছ থেকে শুনেছে রনকের দাদী বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলেন। বৃদ্ধ মহিলা নাকি বাসর রাতেই স্বামী কে বলেছিলেন আমার পড়ালেখা শেষ হতে আরো কিছুদিন বাকি আছে তার আগে আমাকে স্পর্শ করলে আমি আপনাকে শুলে চড়াবো। কথাটা শুনেই তুলি কয়েক পল হেসেছিল। হাসতে হাসতে ঢলে পড়েছিল আমরিনের শরীরে। আজ মহিলা কে দেখেই তুলি বুঝতে পারছে কথাটা ফেলে দেবার নয়। চেহারায় আজো দৃশ্যমান কতটা সাহসের অধিকারীণি এই বৃদ্ধ মহিলা। কতটা তেজী তার রূপ। ইনশিতার পাশে বসেই সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করছেন তিনি। চেহারায় ফুটে আছে গাম্ভীর্যতা। ইনশিতা হাতের ইশারায় তুলি কে কাছে ডাকল। অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেয়েটা কে গোল্ডেন লেহেঙ্গায়। তুলি ধীর পায়ে হেঁটে ইনশিতার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। স্মিত হেসে কোমল স্বরে পূর্বের দাদী কে সালাম দিল। পূর্বের দাদী আশফিয়া চৌধুরী তুলি কে টেনে নিজের পাশে বসালেন। ইনশিতা সহ সবাই হতভম্ব। তুলি নিজেও হকচকিয়ে গেল। আশফিয়া চৌধুরী সহজে কারো সাথে মিশে না,কাউকে আপন করে না। আজ পর্যন্ত পূর্বর মার সাথে অব্দি ঠিক করে দু’টো কথা বলে নি, হোক না নিজের পছন্দের পুত্রবধূ। অথচ তুলির সাথে কখনও কথা নেই, বলা নেই এভাবে হুট করে হাসিমুখে কাছে টেনে নিলেন। এতটুকুই যথেষ্ট সবার হুঁশ উড়ানোর জন্য। তুলি নিজেই ইতস্তত অনুভব করছে। আশফিয়া চৌধুরী তুলির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

” এই মেয়ে তুমি তুলি?”

তুলি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অস্ফুটস্বরে জবাব দিল,

” জ্বি।”

” তোমার বাবা-মা এসেছেন?”

এহেন প্রশ্নে তুলির ঘাবড়ানোর পরিমাণ বেড়ে গেল। ভয়ার্ত চোখে ইনশিতার দিকে চাইল। ইনশিতা চোখের ইশারায় রিলেক্স থাকার আভাস দিল। তুলি আমতা আমতা করে বললো,

” এসেছেন।”

আশফিয়া চৌধুরী তুলি কে ভালো করে একবার পরখ করে নিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে মেহমান দের সাথে কথা বলা পূর্ব কে কাছে ডেকে পাঠালেন তিনি। পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ পূর্ব। পূর্ব কে দেখলেই প্রশান্তিতে ভরে যায় ওনার মন। আরেকটা মানুষ আছে যার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছেন উনি বছর খানেক আগে। বুড়ো বয়সে প্রেম!ইহা নিতান্তই হাস্যকর। কিন্তু আশফিয়া চৌধুরী নিজেই সেই মায়া ভালোবাসা টা কে প্রেম উপাধি দিয়েছেন। আজকাল মানুষ টার দেখা পায় না উনি৷ মানুষ টার দেখা পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া যেন উনার নিকট এক। বিয়েতে গেলে হয়তো দেখা মিলত সেই প্রেমিক পুরুষের। কিন্তু শরীরে বাসা বেঁধে থাকা রোগ গুলোর ভারে আর যাওয়া হলো না রনকের বিয়েতে। পূর্ব কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,

” নাত বউয়ের বাবা-মা এবং হবু নাত বউয়ের বাবা-মা কে আমার রুমে ডেকে পাঠাও। আর রনক কে বলো মেহমান সামলাতে। হবু নাত বউ, তোমার বাবা-মা কে নিয়ে আমার রুমে চলে এসো পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ”

হবু নাত বউ! শব্দটা শুনে পিলে চমকে উঠল তুলির। আমরিন, ইনশিতা, ঝুমু ও অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কাকে হবু নাত বউ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে কেউ ঠাওর করতে পারছে না। তবে তুলির মন কু ডাকছে। আশফিয়া চৌধুরী উঠে রুমে যেতেই পূর্ব মাথা চুলকে চলে গেল রনকের দিকে। দাদী যা যা করতে বললেন সবটা করে তুলির কাছে এসে দাঁড়াল। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে ইনশিতা কে বললো,

” তোমার খালাতো বোন কে সাময়িক সময়ের জন্য নিয়ে যেতে পারি ভাবী?”

থরথর করে কেঁপে উঠল তুলির সারা শরীর। যা বুঝার বুঝে গেল উপস্থিত সকলে। ইনশিতা জবাবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কারণ গতকাল রাতে আমরিনের কাছ থেকে শুনেছে আদ্রর সাথে তুলির বিয়েটা সম্পর্কে। এতে বিন্দুমাত্র অভিমান হয় নি ইনশিতার। না জানিয়ে হোক, তুলি যে তার ভাইয়ের বউ হয়েছে তাতেই প্রচন্ড খুশি ইনশিতা। তুলির মতো একটা সরল, মিষ্টি মেয়ে কেই সবসময় ভাবী রূপে কল্পনা করেছিল আমরিন,ইনশিতা। যেহেতু আদ্র কাউকে বলা নিষেধ করেছে,তাই রনক কে পর্যন্ত জানায় নি সে। রনক জানলেও পরিণাম খারাপ হবে না কিন্তু এই পরিবার জানলে বিশেষ ভালোও হবে না। পূর্বর জন্য প্রথমবার প্রস্তাব দেওয়াতে প্রত্যাখান করেছিলেন রাদিফ সাহেব বয়সে ছোট বলে উছিলা দিয়ে। কিন্তু আশফিয়া চৌধুরী ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে আদ্র। ভয়ের দাপটে এসির হিম করা ঠান্ডার মাঝেও ইনশিতার কানের পাশ দিয়ে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে গেল। কোনো রকমে উচ্চারণ করলো,

” নন,,নিয়ে যান ভাইয়া।”

আমরিনের ভীষণ রাগ হলো। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি ইনশিতার দিকে। পূর্ব কে কিছু বলতে গিয়েও বোনের জন্য থেমে গেল। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকা তুলি আশফিয়া চৌধুরী কে শ্রদ্ধার খাতিরে শেষমেশ উঠে দাঁড়াল। পূর্বর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে লাগল। আঁড়চোখে তুলি কে বার বার পর্যবেক্ষণ করতে লাগল পূর্ব। মেয়েটার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে ভয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। কিসের ভয় বুঝতে পারছে না পূর্ব। তুলি কে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,

” কালো রঙে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে তুলি।”

তুলি আলতো হেসে বলল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া। ”

রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই আশফিয়া চৌধুরী ভিতরে আসার জন্য অনুমতি দিলেন দুজন কে। তুলি রুমে ঢুকে দেখল ওর বাবা-মা,খালা-খালু,পূর্বর বাবা-মা উপস্থিত। রাদিফ সাহেবের মুখের চিন্তার রেখা টাও তুলির চক্ষু এড়ালো না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে আশফিয়া চৌধুরী গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

” তুলি কে পূর্বর বউ হিসেবে কল্পনা করেছি আমি। আমি চাই তুলি পূর্বর বউ হবে। কোনো রকম অযুহাত আমি শুনবো না। আর দ্বিতীয় বার প্রত্যাখান করার কারণও আমি দেখছি না। মেয়ের আঠারো হয়েছে। আপনার কাছে কি পূর্ব কে রিজেক্ট করার কোনো কারণ আছে তৌফিক সাহেব? ”

তৌফিক সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন৷ রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম,আফসানার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। সবাই খুব সম্মান করেন আশফিয়া চৌধুরী কে। তৌফিক সাহেব একবার ভাবলেন সরাসরি বিয়ের কথাটা বলে দিবেন। পরমুহুর্তে ভাবনা পাল্টে নিলেন। ইনশিতা ওনার মেয়ের মতো। মেয়ের শশুড় বাড়িতে যা ইচ্ছা তা বলা যায় না। বিয়ের কথা টা বলে মুখের উপর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে আশফিয়া চৌধুরী সেটা অপমান ভেবে নিতে পারেন। এতে দেখা যাবে হিতে বিপরীত হবে। তাই তৌফিক সাহেব জবাব দিলেন,

” না। কিন্তু! ”

” কোনো কিন্তু নয়। আশা করি তোমরা আমাকে ফিরিয়ে দিবে না।”

কথাটা বলেই উনি তুলি কে এক জোড়া হাতের বালা পড়িয়ে দিলেন। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তুলির। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে কিছুই বলার সুযোগ পাচ্ছে না কেউ। নিজেকে ধাতস্থ করে তুলি বলতে নিল,

” আমি বিবা,,”

তুলির বাক্য টা অসমাপ্ত থেকে গেল আশফিয়া চৌধুরীর গম্ভীর স্বরে। তিনি একটা আংটি পূর্বের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

” কারো কোনো আপত্তি নেই। তুমি রিং টা মেয়ে টা কে পরিয়ে দাও পূর্ব। ”

তড়িৎ বেগে কেঁপে উঠল তুলির হৃদপিণ্ড। রাদিফ সাহেবের চেহারা বলে দিচ্ছে তিনি কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু ততক্ষণ অব্দি সহ্য করার সময় নেই তুলির। আশফিয়া চৌধুরী তুলির হাত টা এগিয়ে ধরতেই পূর্ব,,,

#চলবে,,,,,!”

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_১৭

” আমি বিবাহিত! ভুলেও আমায় স্পর্শ করবেন না পূর্ব ভাইয়া।”

তুলির কঠিন স্বরে উচ্চারিত বাক্যটা ঝংকার তুলে উপস্থিত সকলের শ্রবণ গ্রন্থিতে প্রবেশ করল। বিমূর্ত দৃষ্টিতে চকিতে তাকাল দু’জন মানুষ। বাকি সবার মুখের ভঙ্গিমা চিন্তিত, নিরলস হলেও পূর্ব, আশফিয়া চৌধুরীর মুখে অবাকতার ছাপ। পূর্ব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না তুলির কথাটুকু। বুকের কোথাও একটা অংশে চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব করল পূর্ব। ব্যাথা টা ক্রমশ বেড়ে বিস্তার করে চলেছে হৃদপিণ্ডের কানায় কানায়। বাড়ন্ত হাত টা গুটিয়ে নিল তড়িৎ বেগে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

” তুমি মজা করছো তাই না তুলি?”

” না মজা করছি না আমি। ”

ভেজা কন্ঠে বললো তুলি। চোখের কার্ণিশে জল জমে আছে,যেকোনো মুহুর্তে গড়িয়ে পড়বে। গলায় আঁটকে থাকা অশ্রু টুকু ঢুক গিলে,তেজী স্বরে বললো,

” আপনারা কিভাবে এমনটা করতে পারেন দাদী?আমি বয়সে ছোটো হতে পারি আপনাদের থেকে তাই বলে কি আমার মতামত প্রয়োজন নেই?বাড়িতে আসা মেহমানদের সাথে বুঝি আপনারা এমন আচরণ করেন?বিয়ে কি ছেলে খেলা যে ধরে বেঁধে আমায়, আমার অভিভাবকের অনুমতি বিহীন রিং পড়িয়ে মোহরানা লাগিয়ে দিবেন? আমার বাবাই-মা,শশুর -শাশুড়ী কাউকেই আপনি কথা বলার সামান্য সুযোগ টুকু দেন নি দাদী। বাবা আপনাকে বুঝিয়ে ভদ্রতার সহিত বলতে চাইছিল কিন্তু সেই সুযোগ টুকুও ওনাকে দেওয়া হয় নি। আপনি নিজের মতো করে অন্যের মতামত ভেবে নিতে পারেন না। গল্প,সিনেমার মতো ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনার নেই। যদিও আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কোনো না কোনো অংশে গল্প,উপন্যাসের পাতার সাথে মিলে যায়, তাই বলে এই না যে বিয়ে নাম পবিত্র বন্ধন নিয়ে আমার সাথে অন্যায় করবেন।

এটুকু বলে সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল তুলি। আজ সাহস যেন তার আকাশচুম্বী। তুলি নিজেও অবাক এতো সাহস তার মধ্যে কোথা থেকে এলো। শুধু এতটুকু বুঝতে পারল এই সাহস এমনি এমনি আসে নি। কারণ একটাই!এবং তা হলো ‘আদ্র’। আদ্রর সঙ্গ। আদ্রর সঙ্গতা তুলির উপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে।আদ্রর প্রতিবাদী সোচ্চার রূপ তুলি নিজের অজান্তেই কিছুটা হলেও নিজের মাঝে ধারণ করে নিয়েছে। কই আগে তো তুলি ভীতু প্রকৃতির একটা মেয়ে ছিল। স্কুল জীবনে রাস্তায় কোনো ছেলে সামনে এসে পথ আটকালে থরথর করে পায়ের তলা কাঁপত তার। ছোট্ট দেহের হৃদপিণ্ড যেনো তখন আরো ছোট্ট হয়ে যেত। আজ তুলির কিছুতেই ভয় হচ্ছে না। ভয়,লজ্জা, জড়তা,ভালোবাসা সবটুকু স্রেফ আদ্রর জন্যই গচ্ছিত। তুলি কন্ঠ খাদে নামিয়ে, কোমল স্বরে বলে উঠল,

” ক্ষমা করবেন আমাকে। কিন্তু আপনার কাজ কর্ম আমাকে এতোটা ক্ষেপে যেতে বাধ্য করল দাদী। ইনশিতা আপুর শশুড় বাড়িতে এমন ধরনের বেয়াদবি অথবা সিন ক্রিয়েট করার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। আপনার ও পূর্ব ভাইয়ার কাছ থেকে আমি এমনটা একদম আশা করি নি। শুধু একটা বার আমাদের কিছু বলতে দিতেন তাহলে এমনটা হতো না। আমি সত্যিই আপনার কাছ থেকে আমি এমন টা আশা করি নি পূর্ব ভাইয়া।”

পূর্বর দিকে তাকিয়ে শেষ কথাটা বললো তুলি। পূর্বর চোখে জলের ছাপ স্পষ্ট। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,

” আমাকে ক্ষমা করে দিও তুলি। আর দাদী আমার জন্য একটু বেশিই ডেস্পারেট। তোমার পিছনে দাঁড়ানো ব্যক্তিই কি তোমার বর?”

পূর্বর কথায়, চোখের ইশারায় তুলি দ্রুত গতিতে পিছন ফিরে চাইল। চক্ষে বিধঁল আদ্রর হাসি মুখের মাদকতায় ভরপুর চেহারা। তুলির অন্তস্থল কেঁপে উঠল আদ্রর প্রগাঢ় দৃষ্টিতে। পাক্কা তিনদিন পর মানুষ টা কে জলজ্যান্ত দেখার সৌভাগ্য অর্জন হলো তার। আদ্রর কর্ণকুহরে কোনো কথা যায় নি তো?ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল তুলি। ভীত-সন্ত্রস্ত মনে জাগল-” তুলকালাম না বাঁধিয়ে দেয় আদ্র!” পকেটে হাত গুঁজে তুলির থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্র। শুধু যে ভয় হচ্ছে তেমন না,তুলির ভীষণ লজ্জাও অনুভূত হচ্ছে। সাহসের ঝুলি বুঝি আদ্রর সামনেই খুলতে হলো!আদ্র বড় বড় পা ফেলে তিন কদম হেঁটে এসে তুলির খানিকটা পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। পূর্বর দিকে চেয়ে তুচ্ছার্থক হেসে বললো,

” ইয়েস! শি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ ডা.আদ্র আহনাফ। ”

ভালোবাসা! শব্দ টা মধুর হলেও এতো কষ্ট অনুভব হচ্ছে কেন পূর্বর?তবে কি এই মেয়েকে ভালোবাসার আগে চোটের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল তার?কোনো প্রকার শব্দ বিহীন পূর্ব প্রস্থান করল ঘর থেকে। তুলির পাশে আদ্রর অনুপস্থিতি কাটার মতো বিঁধছিল তার দেহের সর্বাঙ্গে। রাদিফ সাহেব এগিয়ে এসে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই, থামিয়ে দিল আদ্র।

” আমি সবটাই স্বচক্ষে দেখেছি বাবা। আমার ধৈর্য জল গড়ানোর রেখা অব্দি সীমাবদ্ধ । বেশি গড়িয়ে গেল পরিণাম অথবা পরিণতি যেটাই বলা হোক তা কারো কারো জন্য ভয়ংকর হতো,বিনাশ কৃত রূপ ধারণ করতো।”

অলক্ষ্যে -অগোচরে আদ্রর থ্রেট মূলক বাক্যে ঢুক গিলল আশফিয়া চৌধুরী। কতোদিন পর প্রেমিক পুরুষের দেখা মিলল,অথচ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হলো নিজের দোষে। আশফিয়া চৌধুরী ভাবেন নিজের দাম্ভিকতা,ক্ষমতার জোরে তিনি সবাইকে কাবু করতে পারবেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই মন মানসিকতা বেড়েই চলেছে। সাইকিয়াট্রিস্টের মতে,তিনি মানসিক রোগে ভুগছেন,যার প্রভাবে তিনি অন্যের উপর নিজের মর্জি চালাতে পিছুপা হন না। আশফিয়া চৌধুরীর লুকোচুরি করে ভয়ের চোটে ঢুক গিলা টা আঁড়চোখে পর্যবেক্ষণ করল আদ্র। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল মুহুর্তেই। রাদিফ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো,

” আপনি সবাইকে নিয়ে নিচে যান বাবা। এতোদিন পর দেখা আশফিয়া চৌধুরীর সাথে,একটু কুশলাদি বিনিময় না করলে কি হয়?আপনি যান আমি একটু কথা বলে আসি।”

নিরবতা ছেয়ে গেল রুমে। আশফিয়া চৌধুরী শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল। পূর্বর জন্য ওনার বুকটা হাহাকার করছে।আদ্র আশফিয়া চৌধুরী কে তীর্যক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কেমন আছো আশফি?”

“ভালো! আপনি কেমন আছেন ডাক্তার?”

“ভালো আর থাকতে দিলে কই?যেভাবে আমার বউ নিয়ে তুমি টানাটানি শুরু করলা,শান্তি তো আমার বিনষ্ট করে দিলে। তিনটে দিনের জন্য দূরে যেতে না যেতেই তোমরা দাদী,নাতি মিলে আমার বউ কেঁড়ে নেওয়ার যুদ্ধ নেমেছিলে। আমার বউয়ের ক্ষেত্রে যুদ্ধে আমি হাজার বার জয়ী হবো। দরকার হলে তোমাকেও হাসিল করে নিব। কিন্তু তোমায় দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না, উল্টো কেইস খেয়ে যাবো। বুঝলে বুড়ি?”

রসাত্মক স্বরে কথাগুলো বলে তুলির এক হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তুলির মুখশ্রী। আশফিয়া চৌধুরী কেমন চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে,তুলির নজরে পড়তেই হাত ছাড়ানোর জন্য বৃথা চেষ্টা চালাল। আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের কাছে তুলির শক্তি পিঁপড়ের মতো হলেও তুলি হাত মুচড়াতে লাগল অনবরত। শেষমেশ নীলাভ চোখের অগ্নি তেজে নিভে গেল তুলি। পরাজয় ঘটল সঞ্চিত সাহসের। আশফিয়া চৌধুরী চোখ কুঁচকে লাজুক স্বরে বললেন,

” বুঝি নি ডাক্তার।”

রীতিমতো অবাক হলো তুলি। মনে আগুনের শিখা জ্বলে উঠলো। ‘ বুড়ির ভাব দেখলে তো মনে হয় বুড়ি এ বয়সে আমার জামাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছে। চোখ খুলে ফেলবো বুড়ি,আমার ডাক্তার সাহেবের দিকে নজর দিলে।” মনে মনে কথাগুলো বলে তুলি ক্ষান্ত হলো। ঠোঁটের কার্ণিশে বাঁকা হাসি টেনে বলে উঠল আদ্র,

” আমার বউ কে দেখেছো আশফি?আর তুমি নিজেকে দেখেছো?বউ কে আদর করলে লজ্জায় মাথা তুলতে ভুলে যাবে,মোমের মতো গলে পড়বে আমার প্রশস্ত বক্ষে। আর তোমায় করলে তোমার শ্বাস টাও চলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহবান আমি। জেলের খাটুনি চাই না। বুড়ির চেয়ে অষ্টাদশী বউ আমার ঢেড় ভালো।”

চোখ কপালে ঠেকেছে তুলির। আদ্র লাগামহীন কথায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। কথার মাঝে আদ্র কী বুঝিয়েছে তুলির অবুঝ মন আজ বিচক্ষণ ব্যক্তির ন্যায় এক নিমিষেই ধরতে সক্ষম। মনে মনে হাজার বার আদ্র কে অসভ্য,নির্লজ্জ ধাঁচের মানুষ বলে অভিহিত করে ফেললো। অথচ সামনে উপস্থিত আশফি চৌধুরী নির্লজ্জ হয়ে লজ্জালু গলায় বললো,

” কী যে বলেন না ডাক্তার! আমি আপনার বউ থাইক্কা ও সুন্দর আছি।”

আদ্র তুলির দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে আলতোভাবে আশফি চৌধুরীর দেওয়া হাতের বালা দুটো খুলে নিল। সেদিকে কোনো হদিস নেই তুলির। সে তো মনে মনে ফুঁসছে। হঠাৎ আদ্রর স্বর কর্ণপাত হতেই তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নত করে ফেলল ঝটপট। কানে বাজলো, –” আমার চোখে তুমিই ভীষণ সুন্দর তুলা।”

বালা দু’টো হাতে নিয়ে আদ্র আশফিয়া চৌধুরীর হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

” আমার তুলার হাতে কাঁচের চুরি বেশ মানায়,তোমার স্বর্ণের বালা নয়। কারণ তোমার স্বর্ণের বালার সেই রিমিঝিম আওয়াজ নেই,যেই আওয়াজ কর্ণে প্রবেশ করে ঠিক আমার বুকের বা পাশে গিয়ে বিঁধে। তোমার বর কে যদি কেউ কেড়ে নিতে চাইত তুমি কি করতে?”

আশফিয়া চৌধুরীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় ঠাঁই দাড়িয়ে রইল আদ্র। ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে কিঞ্চিৎ। আশফিয়া চৌধুরী স্বভাবে একটু ত্যাড়া হলেও স্বামী কে ভালোবাসতেন খুব। থমথমে গলায় জবাব দিল,

” কেটে কুঁচি কুঁচি করে মশলা মাখিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতাম, যদি কোনো ফকিন্নি সোয়ামীর উপর নজর দিতো!”

রহস্যময় হাসি হাসল আদ্র। আশফিয়া চৌধুরীর দিকে হালকা ঝুঁকে নিচু স্বরে বললো,

” আমি কাটবো না, জলেও ভাসাবো না। কিন্তু আমার তুলার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে দেহাবশেষের অস্তিত্ব টুকুও থাকবে না। হয় নাতিকে শোধরানোর চেষ্টায় নামো,নাহয় আমার স্টেপ নেওয়ার অপেক্ষা করো আশফি। ডাক্তার হয়ে যেমন হার্টের চিকিৎসা করতে পারি,তেমনি টেনে হিঁচড়ে হৃদপিণ্ড বের করে নিতে জানি।”

#চলবে,,,,!

(ভুল -ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)